আলো বিসর্জন



আলো বিসর্জন
মুনঈম রাব্বি

মহসিনের ছোট্ট উঠোন ভাড় হয়ে আছে। সমস্ত মানুষের নিশ্বাসের উষ্ণতায় ফাল্গুনের শেষ শীত টুকুনও কেটে গেছে। দুপুর গড়াতে এখনও অনেক দেড়ি। এবাড়ি, ও বাড়ির বউ ঝিয়েরা মুখে আঁচল গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে. ঢেঁকিঘর আর মাচাল ঘড়ের আবডালে। বহু মানুষের গুনগুনানি যেন অট্টোরোলের মত শোনায়। হাতেম মুন্সি হাঁকছেড়ে আজান দিলেন। বড় অদ্ভুত তাঁর ধ্বনি। লেটু কোবরেজ এর মতই একটানা কি যেন পড়ে গেলেন। ফাগুনের শুকনো দুপুরে উছলডাঙ্গি গ্রামের পুবপাড়ায় আজ যেন সবার বড্ড তাড়াহুড়া। আজান দিতে না দিতেই দোচালা ঘড়ের মসজিদ ভরে গেল। গ্রামের সমস্ত মানুষ যেন ছুটে এসেছে পঙ্গপালের মত। বড়বাড়ির কাসেম গাজী, স্কুলপাড়ার মোখলেস ব্যাপাড়ী, মুন্সি বাড়ির মোতালেব মুন্সি এমনকি হালিম ওরফে হালু পাগলাও এসে হাজির। মহসিনের বড়চাচাও ব্যস্ত। বাদ যোহর শালিস বসবার কথা।
গেল বৈশাখের এক দুপুরের ঘটনা। মাঠ থেকে কোনরকমে বাড়ি ফেরে মহসিন। অমন কাঠফাটা রোদ্দুরে মহসিনকে মাঠে যেতে বারন করেছিল আলো। আলোর অনুরোধ মহসিন অগ্রাহ্য করে। মাজায় গামছা বেঁধে গোয়ালের গাদায় রাখা ঝাঁকা আর নিড়ানী নিয়ে থর থর করে নেমে যায় বিলের মাঠের আল পথ ধরে। কাসেম গাজীর বড়দাগের জমি বর্গা নিয়েছে মহসিন। একাই চাষ দেবে। একটা পোরেতও খাটাবেনা। দিন পাঁচেকের জন্যে জোগাল খেটে ছিল বড় চাচার ছেলে মুরাদ। এজন্য তাকে একশটাকা দিতে হয়েছে। বড় দুঃশ্বাহস মহসিনের। বড় দাগের জমিন একলা চাষ দেয়া মুখের কথা না। যদিও সোনার মত মাটি তবুও মহসিন ঝুঁকিই নিয়ে নিল। তবুও হত, যদি মুরাদের সাহায্য আরো কিছুদিন পেত। মুরাদ কাজের বেলায় ফাকিবাজ। একদিন কাজে গেলে বাকি পাঁচদিন ওকে আর পাওয়া যায় না। দোপপাড়ার দক্ষিনের বাগানে সারাদিন পাশা খেলে। নেশাতুর চোখ আর সমস্ত শরীরে মদের গন্ধ।
তারপড়েও মহসিন এই অসাধ্যও যেন উতরে যায়। পারেও সে। কালো চামড়ার আস্তরণে যেন নিখুত কিছু মাংশ পেশী এক তাগড়া জোয়ান পুরুষ মহসিন। হালের এক বলদ আর ধামরী গাই দিয়েই পুরো জমিন আলগা করে ফেলেছে মহসিন। নাদাঘের অগ্নিবারিষায় যেন চোখ দুটো শুধু লাল হয়। কিন্তু সেদিন কি যেন হলো।

মাথার উপড় আগুন উরাচ্ছে টনটনে সূর্য। আলো শাড়ির আচল গুছিয়ে ডোয়া লেপছে। পানি নিয়ে যাবার কথা কিন্তু এ অবস্থা কি ভাবে যাবে সে? বাড়ির একপাশে শুপাড়ি পাতার আস্তরন খচ খচ করে উঠল। সরলা আলো মাথা উকি দিলে একটা চতুর চাহুনি তড়িহড়ি সটকে পড়তে চাইল। আলো মুরাদকে দেখতে পেয়ে ডাক দিল। মুরাদ যেন খানিক ঘাবড়ে গেল। আলো হাত ধুয়ে কাসার জগে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসল। ঢাবের উপর ছড়ানো ছেড়া একটি গামছায় কিছু মুরকি পেচিয়ে মুরাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, যা না ভাই, তোর ভাই বড়দাগের জমি নিড়াচ্ছে, বেজায় রোদ তার হাতে একটু কাজ করে আয়! মুরাদ মৃদু পায়ে এগিয়ে চেলল। দস্যি মুরাদ এত সন্তর্পনে হাটে না।
জমি চষে রোব বারের হাট ধরবে মহসিন। হাটের বেলা চলে যাচ্ছে। তবুও মাঠ থেকে ফেরার নাম নেই। আলোর কপাল ঘামে না কিন্তু মন ঘামতে থাকে। তাহলে কি মহসিন হাটে যাবে না? কাল সন্ধ্যায় যে বলেছিল আজ হাটে গেলে মোটা লাল পারের শাড়ী কিনবে, হলুদ, কমলা আর লাল রঙের চুল বেনী করার ফিতা কিনে আনবে? আলোর মন পরন্ত বিকেলের বুজে আসা আকাশের মত চুপসে আসে।
বিকেলটা গড়িয়ে গেছে বেশ। হঠাৎই মহসিন দৌড়ে এসে পড়ে গেল খরের গাদার উপর। কি হলো মহসিনের? চোখ দুটো যেন ইট ভাটার আগুন উৎড়াচ্ছে। গোবর লেপা উঠোনে দু পা আর হাত বার বার আছড়ে পড়ছে মহসিনের। আলো ছুটে আসে। ঢেঁকি ঘড়ের ডোয়া লেপতে গিয়ে মেহেদি রাঙা হাতের রঙ ধুয়ে গেছে। বিয়ের পড় শুক্লা চাদের এক পক্ষও গেল না। আলোর লাজ ভেঙে ছিল সবে। নতুন হৃদয়ে যেন রং লেগেছিল। বিয়ের পর থেকেতো কথাই হতনা মহসিনের সাথে। লাজ্জায় যেন নিশ্বাস আটকে যেত। এইত কাল বিকেলেই সাহস পেল কিছু।
মহসিনের কপালের সামনে বেঁকে আসা চুল ভাল লাগে আলোর। মাঝে মাঝেই সেই দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে  থাকে। সেই ত শুরু প্রেমে পড়ার। আলো সবে মাত্র মহসিনের চোখের দিকে চাইতে পেড়েছে। আঁখির কাজলে যেন মহসিনের প্রাণটা বাধতে শিখেছে। কালই প্রথম আলো তার স্বামীর কাছে বায়না করেছে। লাল পেড়ে শাড়ী আর চুল বেনী করার ফিতের। চুল বেনী করে রাখে আলো। কি ভেবেছিল আলো? কালো দীঘল চুলে তিনটে রং মিশাবে সে। কিন্তু কি হয়ে গেল মহসিনের?


নবীন প্রেম প্রাণ পেল না। মহসিনের দেহে নীলোৎপলের ছায়া পড়েছে যেন। নীল রঙ এ ঢেকে যাচ্ছে মহসিনের মুখ। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে কালো রক্ত। মহসিনের চোখের আলেয়া যেন হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মহসিন চোখ পাকায়, মুখ নাড়ায়। কি যেন বলবে, ললাট চেপে আসে মহসিনের। দিগন্তের অস্তগামী সূর্যের মত মহসিনের চোখ যেন  দিকহারায়। মহসিনের শক্তিহীন মাথা আলোর কোলে নেতিয়ে পরে। আলো তবুও বোঝেনা। দাঁত মুখ চেপে আসে আলোর। তারো যেন কথা বলার শক্তি নেই।
বৈশাখের শেষ বিকেল সন্ধ্যা টেনেছে। মহসিনের শরীরে পৌষের অসম্ভব শীতলতা। আলোর চিৎকারে ভেসে যায় পুরো গ্রাম। সবাই ছুটে আসে। মহসিনের বাপ হড়িমরি করে ধেয়ে আসে, মা গিয়েছিল মোমেনাদের বাড়িতে, সেও কাল বিলম্ব  করেনা। মহসিনের বড় চাচা চাচি ও ছুটে আসে। আশে পাশের দশ ঘরের সবাই ছুটে আসে। কিভাবে কোত্থেকে যেন মুরাদও এসে গড়াগরি শুরু করে। ভাই ভাই আমার বলে আহাজাড়ি করতে থাকে। কিন্তু কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারে না।  কিভাবে কি হয়ে গেল। মহসিনের মত জোয়ান মর্দ ছেলের কিভাবে এমন হলো এমন পরিনতি।
মহসিনের মরে যাওয়া কেউই মেনে নিতে পারেনা। আলোও না। তাঁর নবীন চোখ কাদতে জানে না। সবাই আলোকে জিজ্ঞেস করে কিন্তু আলো চুপ। আলোর মুখ যেন মরে গেছে। আলোর চুলের বেনী যেন শুকনো বেলী ফুলের মালার মত প্রাণহীন। পায়ে আলতাঁর পদ্মরাঙা ডেউরীতে ধুলো জমে গেছে। গাঢ় লাল ছাপার শারীরেও আলো যেন সফেদ, ফ্যাকাসে এক অবশাদের মূর্তি।
চাঁদ যখন প্রায় মধ্য গগনে দ্বিক-বিদিক জোছনা বিলোচ্ছে, তখন মহসিনের দাফন হলো বাড়ির পূব পাশের চালায়। জোছনা বিহারে তাঁর কবরের নয়া বাশের বেড়া ধফ ধফ করে। তারপর চাঁদ ডুবে যায়।এক দিন, দুই দিন গত হয়। সবার মাঝেই কৌতুহল মহসিন কেন, কিভাবে মারা গেল? 
চাঁদের যৌবন শেষের দিকে। রুপেলী আভা ধীরে ধীরে তামাটে হয়ে যাচ্ছে।  তখোনো আলোর কান্না থামেনা। বালিসে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদে। এই ঘর, এই সাজানো সংসারে যেন প্লাবিত সাগর পারের আর্তনাদ। মাঝরাতে ঠক ঠক করে কড়া পরে দরজায়। অতি নীশ্বব্দের মাঝে যেন কান ছাপিয়ে যায় আলোর। আলো জানেনা রাত কত গভীর কিংবা সকাল হয়েছে কি না। আলোর কাছে হঠাৎ কি যেন মনে হয়। তাঁর ভ্রম হয়। আলো ভাবে মহসিন এসেছে বুঝি। সে দরজা খুলে দেয়। আলো অবাক হয়। এত রাতে মুরাদকে সে েেখতে চায়নি। এই মুরাদ অন্য মুরাদ। তার চোখ দুটো যেন চোখের কুঠরে আটছে না। বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আকষ্মাৎ মুরাদ আলোর ঘরে ঢুকে গেল। আলোর হাত ধরে নেশাতুর লোলুপ দৃষ্টিতে আলোর কাছে আসতে চাইল। আলো সম্বিৎ ফিরে পেল। মুরাদ কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল উঠোনের বাইরে। ছিমছিমে মুরাদ যেন আস্তাকুড়ের মত ধপাস করে পড়ে গেল। আলো দরজা বন্ধ করে দিল। বাইরে থেকে মুরাদের হিংসার স্পষ্ট গোঙানী শোনা যাচ্ছে। মুরাদ যেন তাকে ছিড়ে খাবে। আলো শক্ত করে দরজায় খিল লাগায়।
স্বামীর শোক সে ভুলতে পারে না। এর মধ্যে মুরাদের এমন বেহাপনায় সে আরো ভেঙে পড়ে। আলো বাপ আসে তাকে নিয়ে যেতে। আলোও যাবে। যাওয়া ছাড়া তাঁর আর উপায় নাই। কিন্তু আর দু চারদিন বাদেই সামনের শুক্রবার বাদ জুমা মহসিনের জন্য দোয়া আছে। দোয়া সেরেই স্বামির ঘরকে বিদায় দিতে চায় আলো।
সেদিনের পর মুরাদকে আর দেখা যায়নি। কিন্তু মুরাদ বসে থাকেনি। চার দিকে বলে বেড়িয়েছে গত দু দিন ধরে। এত দিন তেমন কিছু শোনা না গেলেও আজ সকাল থেকে মুখে মুখে কথা ছড়িয়ে পরতে থাকে। কানা ঘষা ছড়িয়ে দেয়ার এই দায়িত্ব নিজ মুখে গ্রহন করে মুরাদ আর মুরাদের মা। ধ্রুব সত্য কথা যেন। গ্রামেরর চরম কৌতুহলী মানুষেরা ঘটনাটা যেন নিজ চোখে দেখেছে। সবাই দম পেল বুঝি। অজানা এক কৌতুহলের তবুওত একটা কারন পাওয়া গেল! মহসিনের চাচা হঠাৎ আলেয়ার উঠোনে এসে চেচিয়ে ওঠে। সাথে মুরাদ আর গ্রামের দুই চার জন। মহসিনের চাচা রক্ত চোখে রাগ ঝারতে থাকে। চেচিয়ে  চেচিয়ে বলতে থাকে, হারামীর বাচ্চা কৈ? আমার শোনার লাহান ভাইজতারে মারলি ক্যা বেজম্মা? তোর নাগর ভালা লাগে নাই তুই যাইতি তোর ভাতারের লগে! আমার মহসিন রে বিষ দিলি ক্যা?
মহসিনের চাচা যেন বেদ বাক্য আওড়ালেন। তার সাথে গলা মেলাল সবাই। মহসিনের ছোট্ট দেহলি জুড়ে আবার মানুষের আনাগোনা। মুরাদ আজ বেজায় খুশি। তার চোখ যেন শান্ত হয়েছে। সে ভাবেনি তাঁর গুজব এতটা রটে যাবে। আলেয়া ভাষা হারিয়ে ফেলে আবারো। তার যে ভাগ্য বেজায় খারাপ। স্বামীকে হাড়িয়ে আজ সেই স্বামীকে খুন করার দায়টাও নিতে হবে বুঝি।
গ্রামের লোক বহুদিন পর একটা উপলক্ষ পেল। লোক মখে ঘটনা দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের মোড়লেরাও বাদ গেল না। গ্রামের মানুষের দাবি উঠে  গেল, এই খুনের একটা শাস্তি হওয়া চাই। মোড়লেরাও সেই দাবি উপেক্ষা করতে পারল না। তারা দিন তারিখ ধার্য করলো সামনের রবিবার শালিস বসবে। বাদ যোহর মহসিনের বাড়িতে।
আজ সেই রবিবার। কানায় কানায় ভরে গেছে দোচালা মসজিদ ঘর। নামাজ শেষ হয়। হাতেম মুন্সি এসে  গেছে। মোতালেব মাতব্বর উঠোনে বসে বসে ঘামে আর মুরাদ হাত নেড়ে নেড়ে পাখা ঘুরায়। লোকে লোকারন্য মহসিনের উঠান। মহসিনের চাচা হাক ছাড়ে। মাগী কোই? মাগীরে আন!
মহসিনের মাও থেমে থাকে না। থেমে থেমে গাজন গায় যেন। খুব বেশিদিন হয়নি আলো এই বাড়িতে এসেছে। যা কিছু বন্ধুত্ব, সম্পর্ক হয়েছে তাঁর সবই মহসিনের সাথে। আজ তাঁর পাশে কেউ দাড়ালো না। কেউ দায় নিল না।
লোকের জমায়েত বায়বাড়ি অব্দি পৌছে গেছে। সালিশ শুরু হবে। কিন্তু আলোকে ছাড়া সালিশ কিভাবে শুরু হবে। আলো যে ঘরে নেই। আলোকে খুজে পাওয়া যায় না। হাজার হাজার চোখের অতন্দ্র পাহাড়া এড়িয়ে আলো কোন আঁধারে লুকালো?
ঘন্টার পর ঘন্টা পাই পাই করে খুজেও আলোকে পাওয়া গেল না। আলোর হাড়িয়ে যাওয়াকে সবাই পালিয়ে যাওয়া ধরে নিল। তারা যেন আরো নিশ্চিত হয়ে গেল। আলোই মেরেছে, না হলে পালাবে কেন?
অবলা আলোর ললাটে অপবাদ জুটে গেল। সে জানে সে না লুকালে তাকে অপদস্থ হতে হবে। স্বামী হত্যার মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে তাকে পুরো গ্রামময় ঘুরানো হবে। তাকে বুঝবার মত এখানে আর কেউ নাই। মরা গাঙের শেষ জল টুকুও যেন শুকিয়ে যায়। আলোর চোখ আঁধারে ঢেকে যায়। সে হাটতে থাকে দিগন্তে। সে পালতে চায়না, শুধু হাড়িয়ে বাচতে চায় এই পৃথিবীর অন্ধকার হতে। আলো হাটে আর হাটে। নতুন শাড়ীতে অজস্র দুঃখ জড়িয়ে। আলো ছুটে যায় , আলো জানে তাঁর স্বামীর গন্তব্যে যেতে  আরো অনেকটা পথ বাকি!
   


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট