মায়াগাশি




 মায়াগাশি একটা গ্রামের নাম। নামটা প্রথম যার মুখে শুনি, তিনি আমাদের বেলু ভাই। অনেকদিন হয়ে গেলো বেলু ভাইকে দেখি না। বেঁচে আছে না মরে গেছে, আল্লা মালুম। সোহাগ, মিরু, প্রণব তারাও কিচ্ছু জানে না। কোথা থেকে আসতেন, কার কাছে আসতেন, কেনো আসতেন। কিছুই জানা সম্ভব হতো না। পাছে তিনি কষ্ট পান, এজন্যে বেশি ঘাটাঘাটিও করিনি কেউ। তবে তাঁর ব্যাপারে একটা পিনপিনে সন্দেহ যে কাজ করতো না, তা নয়। সন্দেহের সাথে ভাষার টোন মিশিয়ে কেউ কেউ ভাবতাম নিশ্চয়ই তিনি উত্তরবঙ্গের কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক পার্টির সাথে জড়িত। হয়তো খুনটুনও করে থাকতে পারে। আত্মগোপন করতেই বোধহয় এদিকে আসা। এর আগেও এসেছিলো একজন। তিনি পুরুষ নন, নারী। আমরা যাকে কমলা দি ডাকতাম। আমাদের কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লেকচারার ছিলেন। বয়স কম, অথচ ব্যক্তিত্বে সকলের মন জয় করে ফেলেছিলেন। তিনি যখন ক্লাস নিতেন, আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। কথা তো নয়, যেনো আবৃত্তি করছেন। সে সাথে হাসি, চোখের চঞ্চলতা— দিনটাই সার্থক হয়ে যেতো। পরে শুনলাম, তিনি আন্ডারগ্রাইন্ড রাজনীতির সদস্য। পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে।
বেলু ভাইয়ের ব্যাপারেও আমাদের একটা অস্বস্তিকর সন্দেহ ছিলো। তারপরও আমরা ভালোবাসতাম। তাঁর কথাগুলো অমৃতের মতো গিলতাম। মাইনাস পাওয়ারের মোটা ফ্রেমের চশমা। কী যেনো খুঁজে বেড়ায় দুটো চোখ। মাথায় অবিন্যাস্ত চুল, গালে উসকোখুসকো দারি। দীর্ঘদিন আধুয়া জিন্সের শার্ট-প্যান্ট। সবমিলিয়ে অপছন্দ লাগতো না। সোহাগের লাইব্রেরিতে শেষ যখন দেখেছিলাম, প্রাণ খুলে গল্প করেছিলেন। গল্পকাররা সাধারণত বেশি কথা বলেন, তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। একটা পরিমিত বোধ তাকে ঘিরো থাকতো। হয়তো এজন্যেই তাঁর প্রতি আমাদের আগ্রহের কমতি ছিলো না। তিনি কখন ফের আসবেন, আমরা যেনো অপেক্ষায় থাকতাম।
সোহাগ তখন মার্ক্সবাদÑলেনিনবাদে দীক্ষা নিচ্ছে মাত্র। সামনে যাকেই পেতো মার্ক্সÑলেনিন সম্পর্কে চমকপ্রদ যত কথা একে একে বলতে শুরু করতো। আমরা যারা তাকে চিনি, তারা মজা নিতাম। কেউ কেউ বিরক্তও হতো। ‘গ্লোবালাইজেশন যুগে এসব অচল। পৃথিবীর কোথাও সমাজতন্ত্র নাই।’ এসব বলে কেউ কেউ তর্ক করতো। পা-িত্য দেখাতো।
বেলু ভাই এলে সোহাগসহ আমরা সব প-িৎ অবুঝ হয়ে যেতাম। কিন্ডারগার্টেনের শিশুর মতো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চোখ বড়ো করে তাঁর দিকে চেয়ে থাকতাম। এমনকি বলন কাইজির শিস্য মোবারক ভাই পর্যন্ত বেলু ভাইয়ের কথা শুনে বোকা হয়ে যেতো। ‘দেহতত্ত্ব করবা মিয়ারা, দেহতত্ত্ব? পঞ্চতত্ত্ব বুঝো? কি কি মিশায়া পঞ্চতত্ত্ব, বলতে পারবা?’ মোবারক ভাইয়ের এসব ঝারিঝুরিও সেদিন যেনো কোথায় পালিয়ে যেতো।
বেলু ভাই যখন আসতেন, শিল্পÑসাহিত্যের বিভিন্ন শাখা নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ করতেন। কে কাকে নকল করে বিখ্যাত হয়ে গেলো। বাদ দিতেন না কিছুই। একদিন কথা প্রসঙ্গে মায়াগাশির কথা তুললেন। মায়াগাশি একটা আজব গ্রাম। কারো চোখ, যকৃত কিংবা কিডনি প্রয়োজন তো, ওখানে গেলেই কাজ হয়ে যায়। কারো সন্তান লাগবে, হাজার পাঁচেক দিলেই চলবে। রক্ষিতা লাগবে, তাও মিলবে অনায়াসে।
‘রক্ষিতা’ শব্দটি উচ্চারিত হতেই আমি অন্যরকম কিছু কল্পনা করতে লাগলাম। আমার একটা বাতিক, সেটা তুলারাশির লোক বলেই কিনা—। আমি অল্পতেই সম্মোহিত হয়ে পড়ি। সবকথাকেই গুরুত্ব দিই। যে বিষয়েই কথা হোক, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি এবং অল্পতেই বিভ্রমঘোরে হারিয়ে যাই। ঘটনার ভেতর ঢুকে চরিত্রদের ভিড়ে ঢুকে পড়ি। এর আগে মোবারক ভাই যখন দেহতত্ত্বের বয়ান শুরু করতো, আমি তখন মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও যৌন সঙ্গম ইত্যাদি মশলা মিশিয়ে এক ধরনের রসায়নে ভাসতে থাকতাম। ‘কসমিক সেক্স’, ‘কামসূত্র’, তিব্বতি ফ্রি-লাইফ’, ‘নাথ সাহিত্য’ ইত্যাদি বইয়ের ভেতর বিভিন্ন স্থির চিত্রগুলো জীবিত হয়ে আমার চারপাশে কিলবিল করে বেড়াতো। বিশেষ করে ‘নাথ সাহিত্য’ এর গোপীচন্দ্র যখন হীরা নটীর বাড়িতে ষোল হাজার গোপিনীর সঙ্গে ওপেন ক্রিয়াকলাপে মগ্ন হয়, সেসব দৃশ্য পর্নফিল্মের রিলের মতো আমার উৎসুক চোখে টলটলিয়ে ভাসতে থাকতো।
চা-কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বেলু ভাইয়ের শেষ কথাছিলো, ইচ্ছে করলেই যে কেউ মায়াগাশীতে যেতে পারে। সে-রাতেই বেলু ভাইয়ের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলাম। তখনই দেখি সহজিয়া বাউলের মতো পাকুরগাছটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। যার ছায়ায় গেলেই ভালো লাগে। বসে পড়তে ইচ্ছে করে। আশপাশে মাইল তিনেকের ভেতর কোনো বাড়িঘর নেই। হাওড়ের মাঝখানে গাছটা। হয়তো এজন্যেই ক্লান্ত পথিক এর ছায়ায় এসে বিশ্রাম নেয়। বসে। শোয়। কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়ে। ঘুম একটা মহৌষধ। যতক্ষণ ঘুম ততক্ষণ ক্ষুধা নেই। হ্যাজাক লাইটের গোল আলোর মতো, যেটুকু ফর্সা ততটুকুই অন্ধকার মুক্ত।
গাছটার পেছন দিকে যেতেই মোটা আইলটা চোখে পড়লো। তাতে মানুষ চলাচলের চিহ্ন স্পষ্ট। পেন্সিলের মোটা দাগের মতো একটা রেখা আইলটার পিঠের দারা ধরে বয়ে গেছে। বেলু ভাই বলেছিলো, রেখা ধরে হাঁটতে হবে। আমি হাঁটতে লাগলাম। মাইল দেড়েক যেতেই তারগাছটাও চোখে পড়লো। তখন বিকেল। গাছের ছায়াটা পুবদিকে ধীরে ধীরে লম্বা হচ্ছিলো। ছায়া ধরে গেলে জিয়ংগা নদী। নদীর পাড়ে মেড্ডাগাছের সারি, চিতাঘাট, কবরস্থান। পাড় ধরে একধরনের ভূতড়ে নির্জনতা ঘুরে বেড়ায়। ওদিকে আমার কাজ নেই। আমি যাবো ছায়াটা বিপরীত দিকে।
আমি বিপরীত আইল ধরে হাঁটতে লাগলাম, প্রথমেই চোখে পড়লো, ছোট একটা জঙ্গল। হয়তো এটাই সে জঙ্গল, এক সময় যা ছিলো পাখিদের অভয়ারণ্য। এখন কিচ্ছু নেই। খা খা করে শূন্য। নগ্নÑনির্জন জায়গা দেখলেই আমার ভয় হয়। মনে হয়, চার দিক থেকে কারা যেনো চেয়ে চেয়ে দেখছে। ভয়ে দেহটা একবার আমূল কাঁটা দিয়ে উঠলো। জঙ্গলটা পেরোতেই বড়সড় একটা গৃহস্থ বাড়ি। সম্ভবত ওটাই সামন্তবাড়ি। যাদের সরাইলা কুকুরটা ভল্লাঘাট বাজারে যেয়ে আর ফেরে না। বাড়িটা থেকে সিঁদলশুটকি পোড়ার গন্ধ ভেসে আসছে। বাঁপাশে একটা বাড়ি, ওখান থেকে ধুপধোঁয়ার গন্ধ নাকে লাগছে। উলুধ্বনিও উঠলো কোনো একটা ঘর থেকে। সাথে কাঁসার টনটনানি। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলেও একে একে সবার সাথেই দেখা হতে লাগলো। ওই লোকটার সাথেও দেখা হলো, যে ঢাকায় যেয়ে অ-কোষের রগ কেটে হিজড়া হয়ে গেলো। তার নাম নূরুলদীন। নাম শুনেই আফসোস বেড়ে গেলো। আহ! কী নামের ছেলে কী হয়ে গেলো। সৈয়দ হক সারাজীবন শহরে কাটালেন বলে এই নূরুলদীনদের দেখে যেতে পারেননি। এদের কারো একজনের সঙ্গে তাঁর দেখাটা হলে আমরা আরেকটা মহৎ কিছু পেতাম। জিজ্ঞেস করি, ‘কেনো এটা করলেন? সংসার না পাতেন, গরম পানি ব্যবহার করতেন। হাদিসে তো এমনই লেখা।’ সে তখন টিপটিপ করে চোখের পানি ফেলে, কথা বলে না। হয়তো অভ্যাসবশত কথার ভেতর হিজড়ার ভাষা ঢুকে গেছে। শুনলে সিরিয়াস মুডটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে আমার; সে ভয়েই নিজেকে সংযত করে নেয়। দেখা হয়ে যায় করিমের বোন সাকিনার সাথেও। মাটির চুলোয় খরÑবিচালি দিয়ে রান্না বসিয়েছে। রান্না বলতে বতুয়াশাক আর মলামাছের শুটকি। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী এবং আবেদনময়ী হওয়ার পরও তার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যায়। জৈবিক চাহিদা কার নেই? তারও আছে। হয়তো ওটাকেই দমন করতে গলায় এতোগুলো তাবিজ। তার মায়ের জবাব, ‘গেরামের বেবাক জোয়ান হিজড়া অইয়া যাইতাছে গা। ঢাহাত যায়া রগ কাইট্যা আয়ে। এহন মাইয়াগোর কী অবস্থা অইবো কন।’ ঠিক এই সময় দেখা হয় আক্কাসের বাপ আবদুল আওয়ালের সঙ্গে। একমাত্র ছেলেটারে হারিয়ে বেচারা একেবারে শামুকের মতো হয়ে গেছে। তবলিগি লেবাস, আটইঞ্চি লম্বা কিসের যেনো একটা ডাল দিয়ে দাঁত ঘষাচ্ছে। অনেক টোকাটুকি করলাম, কোন কথা বের করতে পারলাম না। ‘কতা কয় না, মানু দেকলে খালি চায়া থাহে। একমাত্র পোলাডারে জ্বীনে মাইরালাউনের পর থিকা ইমুন অবস্থা। আগে ইমুন আছিলো না, বাজারের ভিটখান লইয়া চেয়ারম্যান সাবের সঙ্গে অনেক দেন-দরবার করিছে। কোনো দরবারেই মাতবর সাব জিততে পারে নাই।’ করিমের মায়ের মুখ থেকে কথাগুলো শুনতে শুনতে তাকিয়ে দেখি, লোকটা চোখের আড়ালে চলে গেছে। জানতে চাইলাম, ‘সত্যিই কি জ্বীনে মেরেছে?’
‘এমা ইতা কি কন! জ্বীন হুজুর তো এইডাই কইলো।’
হঠাৎ খেয়াল হলো তাদের ভাষার টোনটা যেনো চেনা চেনা লাগছে। ময়মনসিংহ, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট কারো সঙ্গেই মিলছে না। আবার পরিচিতও। কোথায় যেনো শুনেছি। কল্পনায় একে একে সব বন্ধুকে সামনে বসিয়ে কথা বলতে লাগলাম। না, কারো সাথেই মেলাতে পারিনি। ঠিক এ সময় বেলু ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। হা, তাঁর মুখের ভাষাই তো এটা। তিনি শিক্ষিত লোক বলে গ্রাম্যভাষায় আদর্শ চলিতের রং মেখে উচ্চারণ করেন। টোনটা তো ঠিকই অভিন্ন। তার মানে বেলু ভাইয়ের বাড়ি এ মায়াগাশিতে! তাঁর পোশাকÑআশাক আর সংস্কৃতিবোধ মিলিয়ে দেখলে আমার জোর সন্দেহ, হয়তো তিনি মায়াগাশির সামন্ত পরিবারেই সন্তান। নদীটা মরে গেছে, এখন রেখটাও যায় যায় বুঝি। ‘আঘাট ঘাট হবে, আপথ পথ হবে’— এধরনের এক কথা লোকমুখে প্রায়ই শুনি। হয়তো ওটারই আয়োজন চলছে। একবার ভেবেছিলাম, কাউকে জিজ্ঞেস করে চেয়ারম্যান সাহেবের বাংলোটাও ঘুরে দেখে যাই। ঠিক তখন দরজায় কড়ানাড়ার শব্দে আমার সম্বিৎ ফিরে আসে।
সিটকিনি খুলে দেখি তাহের কবিরাজ। তুলারাশির লোক বলে, তার কাছে আমার বেশ কদর। তাহের জানে, তুলারাশির লোক ঠাডায় মরলে, তার লাশ তার কাছে লাখ টাকার মাল। আর শনিÑমঙ্গলবার মরলে তো কোনো কথাই নেই। আমার লাশ পাহারা দেয়ার জন্যে আত্মীয়স্বজনকে কবরের পাশে সাতরাত জেগে থাকতে হবে। এই তো গেলো আমার মরার পরের খবর। জীবিত থাকতেও কম মূল্য নয়। প্রতি শনিবার আমার চুল নেয়ার জন্যে তাহের বাসায় এসে বসে থাকে। আমার চুল দিয়ে তাবিজ বানায়। সে তাবিজ তাহের বিভিন্ন হাটে মজমা বসিয়ে বিক্রি করে। মহিলাদের নানান রোগের মহৌষধ। এখানেই শেষ নয়, যাদুটোনা, বানমারা, অবাধ্যকে বশ করা, হারানো মাল ফিরে পাওয়া ইত্যাদি জটিল কাজেও আমার চুলের পাওয়ার অব্যর্থ। এজন্যে কবিরাজরা আমাকে যথেষ্ট তাজিম করে। বিশেষ করে তাহের। সে আমার চেয়ে চারপাঁচ বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও আমাকে গুরু মানে। এজন্যে আমিও মাঝেমধ্যে দুয়েকটা ফুটÑফরমাশে তাকে ডাকি।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমাকে রাঙামাটি ট্রান্সফার করা হয়েছে। চাকরি করতে হলে এসব সহ্য করতে হয়। তাহেরকে একটা পিকÑআপ ভ্যান ভাড়া করতে বলেছিলাম। হয়তো ওটারই খবর নিয়ে এসেছে।

বেলু ভাই নাই হয়ে গেলেন। আমিও চাকরির সুবাদে দেশের এক কিনারা তথা রাঙামাটিতে পড়ে রইছি। পরিচিত কারো সাথেই দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। এখন কাপ্তাই হ্রদ আর পাহাড়ই কথা বলার সঙ্গী। আর মাঝেমধ্যে কল্পনায় মায়াগাশিতে ঢুকি। নূরুলদীনÑসাকিনাদের সাথে দেখা হয়। কথা হয়। দেখি—নূরুলদীনের মাথার চুল লম্বা হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেয়েদেরকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে সাকিনার গলার তাবিজের গুছাও বসে নেই। দুই বুকের মাঝখানে কায়তনের তলায় একটা একটা করে বেড়েই যাচ্ছে।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট