বিবর্ণ তৈলচিত্র !




একটা আজব স্বপ্ন দেখে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় অয়নের। গভীর রাত। এমনিতেই সময় কাটে না। তার ওপর জেগে থেকে আজগুবি সব কথা তার মাথায় আসতে থাকে। অবচেতন মনে তার পুরনো অনেক ভুল এখন মনে করে কষ্ট পাচ্ছে। নীরা ঘুমিয়ে আছে।অয়নের চোখে ঘুম নেই। দিন শেষে শরীরের যতটুকু ক্লান্তি,সেই সময় মাত্র নিঃসাড় পড়ে থাকে সে। নীরাকে ঘুম থেকে  ডেকে তোলা ঠিক হবে না। সারাদিন  নানা কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখে। সে রাতে খুব আরাম করে  ঘুমায়। অয়ন তাকে ডাকে না। ঘুম হতে ডাকলে সকালে অন্তত পঁচিশবার অভিযোগ করবে। ‘মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছৃএখন মাথা ব্যথা করছে। আরও কত কি!'

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলবে নীরা। মেয়েরা একটু  ঘুম কাতুরে হয় ! যখন চাকরি  ছিলো নীরা তখন তেমন কোনো অভিযোগ তুলত না। এখন নানা অভিযোগ তুলে। এসব আর ভালো লাগে না অয়নের। তার চারপাশে শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ । অসহ্য! নিজের কাছেও তার শত নালিশ।  এই নির্জন নিস্তব্ধতায় অয়নের মনে চায় সুঁই দিয়ে নিজেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সকল অভিযোগ রক্তাক্ত করতে। এতে তার মুখ আর গালের যন্ত্রণা কমে। এছাড়া তার কোনো পথ নেই। অয়নের মনে হয়, ফেস ইজ দ্য ইনডেক্স অব মাইন্ড। তার চেহারায় এক সাগর নিরত্যোর বিমর্ষতা। এক অসহ্য অসহায় বিষণ্ন মুখ। চেহারায় শত শত অভিযোগ আর হতাশার বিবর্ণ তৈলচিত্র মাত্র। মানুষ বিষণ্ন মুখায়ব পছন্দ করে না। অয়ন তেমনই একজন কেউ তাকে তেমন পছন্দ করে না। যেখানে দাঁড়ায় ভীষণ শুন্যতা তাকে ঘিরে ধরে । ছায়াঢাকা অসম্ভব চমৎকার দিন কালো মেঘে মেঘে আচ্ছন্ন হয়। অয়ন তাই ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকতে ভালোবাসে। অয়ন এক সময় আলোয় ছিল,নিজেকে আলোকিত করার চেষ্টা ছিল।এখন শুধু যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণার শেষ হওয়া প্রয়োজন। একটি সুঁই দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। কলিজার কষ্ট এড়িয়ে সুঁই দিয়ে কষ্ট গেঁথে গেঁথে বুকের রক্ত ঝরালে মাথা হাল্কা হবে। চেহারা গাল মুখের যন্ত্রণা কমে যাবে।এছাড়া আপাতত কোনো পথ নেই তার।
কয়েক দিন আগে ডাক্তার দেখাতে গেল অয়ন। ডাক্তারের এসিস্ট্যান্ট একটি স্পাইরেল নোটবুকে নাম লিখছিল। নামের তালিকা। সিরিয়াল নম্বর। অয়নের সিরিয়াল হলো সাতাশ। বেশ অদ্ভুত সংখ্যা। সাতাশ, সাতাশের যুবক, এখন সাতাশ দ্বিগুণে চুয়ান্ন; চুয়ান্নের বৃদ্ধ। নিজেকে বৃদ্ধ ভাবতে সকলেরই কষ্ট লাগে। কারণ যুবাকালের সোনালি দিন আর মধুময় স্মৃতি মনের গভীরের আঁকশিতে লটকে থাকে। ছাড়তে চায় না। তবু দিনে দিনে ধীরে ধীরে বয়স বাড়ে, কেউ বলে কমে; যেহেতু মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসে মানুষের জীবন ওয়ানটাইম বলপয়েন্ট পেন। এক কিলোমিটার, আসলে তেমন দূরত্বের সত্যি কি না প্রমাণিত নয়, যেটুকু পথ পেরোন যাক; শেষ তো আয়ুর সমাপ্তি। এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে শেষে তীরে এসে মনে হয়, এই তো সেদিন কি সুন্দর দিনগুলো চলে গেল! আহা সময় কত দ্রুত যায়! জীবন কত ছোট! লোকটিকে অয়ন বলল, 'নাম তালিকায় একটু সামনে এগিয়ে নেয়া যায় না?’ সে এমনভাবে তাকাল যে, ব্যাটা দুদকের চেয়ারম্যান; সে একাই সত্যবাদী যুধিষ্ঠির! তার বিস্ময় আবর্তিত জিজ্ঞাসা, –‘আপনার সিরিয়াল?
’সাতাশ।’
'সাতাশ, অয়ন; এতগুলো লোককে টপকিয়ে আপনাকে নেব?এ অনৈতিক কাজ আমার দ্বারা অসম্ভব।'
‘একটু দেখেন না, কিছু করা যায় কি না। সময় কম যন্ত্রণা হচ্ছে। এদের বলেন, তারা যদি বলে।’
অয়ন আর কোনো কথা বলতে পারে না।শুধু মনে মনে ভাবতে থাকে, সকলের তাড়া আছে। স্বার্থ আছে। যেমনভাবে খুব অনায়াসে যন্ত্রণার ওজর দিয়ে গেল। যন্ত্রণা ছিল এখনো আছে। তেমন যন্ত্রণা থাকলে কোনোকিছু করার নেই। দুটো প্যারাসিটামল সে যন্ত্রণার কিছু দমিয়ে রেখেছে মাত্র। যন্ত্রণা সহজে যায় না।
গোধূলির আকাশে ফেরারি সূর্য, ডিমের কুসুম হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে ঝিলমিল করছে। হাসপাতাল রোডে প্রচুর ধুলো, রিকশা আর নানা রকম মানুষের ভিড়। জোড়া ব্রিজের পাশে ক্লিনিকের ফার্স্ট ফ্লোরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। অয়নের সিরিয়াল সাতাশ। তার সেলফোনের শেষ দুই ডিজিট তেরো, আনলাকি থার্টিন। সবকিছুতে আনলাকি। ব্যাংকে গেল, হিসাব নম্বরের শেষ ডিজিট সাত। সাত নাকি লাকি নাম্বার। সেই লাকে দেখা গেল, হিসাব নম্বরে কোনো টাকা বাড়ে না; শুধু চার্জ দিতে হয়। এভাবে একদিন আরব্য উপন্যাস শেষ। শাহারজাদির গল্পের যবনিকা। উপসংহার যা সে শুধু এক ভীষণ ভারী দৈত্য জীবনের কাঁধে খুব শক্ত করে গেঁথে বসে গেছে। সে একাউন্ট একদিন বন্ধ হয়ে গেল, তা যাক; এসব নিয়ে আর তেমন ভাবনা নেই অয়নের।

অপেক্ষার ঘরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে কয়েকজন। সেখানে উপস্থিত এক তরুণী  সকলের কমবেশি মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। সে বোঝে কি বোঝে না নাকি বুঝেও না বুঝারর ভাণ করে আছে কে জানে! বার কয়েক এ পোড়া দুচোখ তার দিকে ঘুরে এলো । তার পরনে লাল জমিনের উপর হলুদ কালো সবুজ বেগুনি রঙের শাড়ি। তার ভেতর আশ্চর্যরকম এক আকর্ষণ আছে। হাল্কা চুল আর পেছনে পরচুলা দিয়ে তৈরি এক খোঁপা, সেখানে একটি বেলীফুলের মালা গোজা। আমার দৃষ্টি মেয়েটির চোখ মুখ ঠোঁট আর ডানদিকের স্ফীত গণ্ড ঘুরে এসে বারবার বেলীফুলের সাদা রঙে থমকে দাঁড়ায়। সাদা নাকি শান্তির রঙ। না এ ফুলের সঙ্গে কোনো পিরিত নেই। সত্যি বলতে অনেকদিন পর বেলীফুল দেখছি। যুগপৎ দুটো ভাবনার ঢেউ বয়ে যায় মস্তিষ্কে। সেগুলো ঘুরপাক খায়, একটি গ্রহের দুটি কক্ষপথে যেমন দুটি উপগ্রহ পরিক্রমণ করে; করতে থাকে। কখনো মনে হয়, ক্যাসিনোর আসরে চক্রের মতো কোনো মোহনীয় মায়াজাল, হুইল অব ফরচুন। অয়নের আসলে কোনো ফরচুন নেই।
কোনো কোনো দিন একজন বেলীকে দেখে বাসের ভেতর। প্রাইমারি স্কুলের টিচার। জোড়া ব্রিজ থেকে বনলতা এক্সপ্রেসের ভেতর কখনো দাঁড়িয়ে কখনো ভাগ্য প্রসন্ন হলে বসে বসে হেলেদুলে বিজয়নগরে গিয়ে নামে। তারপর হাঁটা পথ। একদিন কথা হয়, সে নাকি গোপালের ভাগিনি। চারটি থার্ড ডিভিশন নিয়ে একেবারে আঠারো বছরের অভিজ্ঞ প্রভাষক গোপাল,বিত্তশালী ভূস্বামী লোক; তারপরও মাইনরিটি কোটা। এ দেশে টাকায় কি না হয়! বাদরের গলায় মুক্তোর মালা ওঠে, দস্যু আর ক্যাডাররা মোহামেডান ক্লাবের মতো নামিদামি জায়গায়  ক্যাসিনোর আসর জমায়। এ সমাজে সবকিছু সম্ভব। এসব না জানলেই ভালোৃবলতে গেলে শত বিছুটির দংশন। রিমান্ড আর টর্চার। গণতন্ত্রের ইউনিফর্মে বারুদের গন্ধ, নিগ্রহদের রক্তের ছোপ,ত্রাসের স্ফুলিঙ্গের ছায়াচিত্র, জাতির সূর্যসন্তানদের পোড়া লাশের স্তুপ,তবু নৈবেদ্য শৈল্পিকসত্ত্বায় ঘুমায়।
বেলীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে বেশ সুন্দর করে হাসে। মেয়েদের হাসিতে কি জাদু মাখা।লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার রহস্য খুঁজে গেছেন।তার দৃষ্টি সে তুলনায় যথেষ্ট নগণ্য !সে শুধু অবাক হয়ে থাকে আর চুয়ান্ন বছরের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে এক দুঃখের স্রোত বুকের শিরা উপশিরায় লাভার ঢেউ হয়ে বয়ে যায়। হায় জীবন! আজ হাসতে ভুলে গেছে সে, এখন এক অনন্ত পিপাসায় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া খুলে কমেডি সার্কাস দেখে। এডাল্ট কথনের টুকরোতে হাসির গমকে গমকে অদ্ভুত কম্পন বাতাসে ঢেউ তুলে তুলে ঘরের দেয়াল থেকে আছড়ে অবশেষে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে ।

অয়নের দুচোখ ঘুরে ফিরে বেলীতে এসে হোঁচট খেতে থাকে। অনেকদিন বেলীফুল দেখে নি সে। আর এ জনমে দেখা হবে এমন ভরসা নেই। দেখা হলে কী হবে, এমন উৎকট ভাবনায় শিহরণের কোনোকিছু নেই জেনেও সে ভাবতে বসে। সে বেলী থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশে চোখ রাখে।
সন্ধ্যা নামছে। চারপাশে হাত পা ছড়িয়ে এক অদ্ভুত  অন্ধকারের প্রস্তুতি। সিরিয়াল পাঁচ ভেতরে গেছে। একেকজন প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট। কেউ কেউ তারও বেশি। সিরিয়ালের কয়েকজন নেই। হাবিব ঘন ঘন বাইরে তাকায়। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তার কোনো রঙিন হাউজি খেলা চলে, কখনো নির্বিকার অথবা কৌতূহলি দোলাচাল। এর মধ্যে সাতাশ আসতে অনেক দেরি। সেই দেরিতে অনুপস্থিত লোকজন ‘ইয়েস স্যার’ হয়ে যাবে নিশ্চিত। অয়ন পুনরায় বেলীতে চোখ রাখে। অয়ন আর বেলীফুল। বেলীফুল একুশ-বাইশ, অয়ন সাতাশ; চুয়ান্নকে গোলি মারো! অয়ন তাকে ভাবতে বসে। সীমাকে মনে পড়ে। ওদের বাসার পশ্চিম দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটি বেলীফুলের গাছ ছিল। গন্ধে মাতোয়ারা বেলীফুল দেখতে দেখতে কত দিন অপরাহ্ণে তার সঙ্গে দৃষ্টির যোগ হয়েছে। কোনো কথা না বলেও দুজন কত কাছের আর দুজনের হয়ে গেছিল। সে এক স্মৃতি, শত শত দৃষ্টির সংযোগ হলো; যোগফল হয় নি। সে এখন কোথায়? অয়ন তা জানে না।

অয়ন ড্রয়ার খুলে খুঁজতে বসে। সেখানে প্লাস্টিকের কয়েকটি কৌটা। এর কোনো একটিতেও সুঁই নেই। অয়নের ড্রয়ারে সুতীক্ষ্ণ ভয়ংকর একটি এ্যান্টিকাটার রয়েছে। সেটি দিয়ে তার কাজ হবে না। নির্দিষ্ট কাজের জন্য বিশেষ টুল বা অস্ত্রের দরকার পড়ে। এটি লঘু অপরাধে গুরুদণ্ড। এর জন্য সুঁই সবচেয়ে উপযুক্ত। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা যায় খুব সহজে। উপড়ে তুলে ফেলা যায় অসহ্য  যন্ত্রণার শিকড়।

নীরার দিকে তাকায় সে । তার নাকে আর ঠোঁটের উপরে মৃদু স্বেদবিন্দু। এমন মেয়েরা স্বামি সোহাগি হয়, ছেলেরা বউ পিয়ারি। সে-সময় তারও এমন চেহারা ছিল।
সীমা একদিন বলে, –‘তোমার ভাগ্য ভালোৃবউ পিয়ারি।’
‘সেতো এখন থেকেই দেখছি প্রিয়, আমিও তোমায় খুব ভালবাসি।’
‘কেমন?’
‘খুব মানে প্রচণ্ড!’
সীমার সাথে শেষ পর্যন্ত কিছু হলো না। অয়নের জানা হলো না, স্বামি পিয়ারি আর বউ পিয়ারির কাল্পনিক খাবনামা। এর সকল দায় অয়নের। কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে জানালা গলিয়ে দূর আকাশে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় সে। রাতের আকাশ। তার পরতে পরতে এক অদ্ভুত সৌম্য শান্ত গভীরতা; এক অনাস্বাদিত রহস্যময়। তার পটভূমিকায় নক্ষত্রেরা হাতে হাত রেখে সখ্যতার ছায়াপথ তৈরি করেছে। অয়নের মনে আকস্মিক তার দৃশ্যকল্প ভেসে ওঠে। সে ছবির কোনো বয়স বাড়ে না। সে মুখ রাতের আলোছায়া দেয়ালে ভেসে ভেসে চলচ্চিত্র হয়। এক অসম্ভব ফর্শা কিশোরী, তার প্রজাপতি বেণিতে লাল ফিতের দুটো ফুল। কলাপাতা সবুজ কামিজ আর অফহোয়াইট পাজামা। নাকের ডগায় সদ্য ছিদ্র করা একটি বিবর্ণ সুতোর রিং। অয়নের কৈশোর এক স্বপ্ন দোলা, মিথ্যে স্বপ্ন আর কল্পনার এক অসমাপ্ত গল্প। সে কাহিনী একান্ত অয়নের, কারও প্রবেশ অধিকার সেখানে নেই। নীরারর দিকে তাকায় সে। সীমা ঘুমিয়ে আছে। সে এক মাতাল ঘুমের শহরে।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট