আল্লাহর বান্দা
শরীফ সাথী
সবুজ সমারহে ছেয়ে আছে যে গ্রামটি, তাঁর নাম তীরধরা। অরণ্যে ভরা পাখিদের আদরে আদরের কলরবে মুখরিত হয় পাখিদের আঙ্গিনা। গ্রামটির তিন দিকে নদীর জলের অবাধ কলতান। বৈঠা ঠেলে মাঝি দলের এদিক ওদিক ছোটা ছুটি। তীরে বসে রাখাল বাঁশির সুর সুমধুর। যদি সে বাঁশি ,নিশীথ সুরের মূর্ছনায় হারায়। বিকালেতে কিশোর দলের বিভিন্ন রকমের খেলা। গরু ছাগলের আপন মনে সবুজ সবুজ লকলকে ঘাস খাওয়ার মনোহরী দৃশ্যে। একাকার হয় নীল জমিনের নীল নয়ন। থোকা থোকা ফুলেদের মিষ্টিময় নির্গত ধোঁয়া, বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে, সারা গাঁয়ে দিয়ে যায় অনাবিল সতেজী সুগন্ধ। মৌসুমি ফুলের সুঘ্রানে ভরে থাকে বার মাস। নদী জলের ছোট মাছ গৃহিনীদের রান্নার চূলোয় কড়াইতে ভাজা। মুগ-কলাই ডালে ভাত মাখিয়ে ছোট মাছের চাকনি খাওয়া তৃপ্তিভেজা মজাদার অনুভুতি গুলো সারা গাঁয়ে ছড়ানো। গ্রামটি ছোট হলেও গোল বৃত্তে আবদ্ধ। মানুষ গুলোর অসাধারণ চালচলন। একেবারে সাদামাটা। নম্রতাই ভদ্রতাই গড়া দেহমন। একে অপরের প্রতি সহনশীল মনোভাব। ভালোবাসার চাদরে জড়ানো, মায়াবি পরিবেশে ছড়ানো সীমাহীন দায়বদ্ধতা। এই গ্রামে গ্রীষ্মের বজ্রে আলোকিত হয়। বাতাসের উওাল ঝাপটাই বৃক্ষের ডালগুলো এদিক ওদিক দোল খাই। বর্ষার রিম ঝিম বৃষ্টি টিনের চালে, গাছের ডালে আছড়ে পড়ার দুরন্ত আওয়াজ আর বাতাসের বৃষ্টি ভেজা শমশম শব্দ শীতল করে । এ গাঁয়ে কাদা মোড়ানো পথে পিছলে পিছলে হেঁটে যাওয়া, কখনো আছাড় খাওয়া সারা শরীরে কাদা মাটি মেখে বাড়ি ফেরা মানুষ গুলোর খাঁিট চিত্র। বাদল দিনে বৈঠক খানার আঙিনা ভরে ওঠে প্রতিটি পাড়ার জমে ওঠে মানুষগুলো রুপকথার কাল্পনিক গল্পে। জ্বিন, ভূত, দৈত্য, দানবের নানান কাহিনীর নিদারুন সংলাপে হারিয়ে যায় সবার মন। ছোলা -মুড়ির ঠুসঠাস শব্দ সবার মুখে মুখে ছন্দ সুরে বেজে ওঠে। শরতে কদম কেয়ার লাবন্যতায়, বৈচিত্রের ছোঁয়ায় সজ্জিত হয় এ গাঁয়ের প্রতিটি আঙিনা। ভাদ্রের প্রকট গরমে হিমসিম খাওয়া। আশ্বিনে কখনো বা বানের জলের মারাত্বক উৎপাত। তাল পিঠার ধুম বয়ে যায় পাড়ায় মহল্ল¬ার ঘরে ঘরে। হেমন্তে -কাস্তে হাতে মাঠে মাঠে কৃষকের ধান কেটে মাথায় করে, গরুর-মহিষের গাড়িতে করে বয়ে এনে বাড়ি বাড়ি নয়া ধান ঝাড়াতেই ব্যস্ত থাকে । নবান্নের মহা উৎসব চলে নতুন চালের আটা করে। নতুন চালের যাও ,খির ছিন্নি করার মুহর্তে শিশু কিশোরের দৌঁড় দৌঁড়, হৈ- হুলে¬াড়¬ আনন্দে ভরে ওঠে সারাগ্রাম। বৈচিত্রময় চালের পিঠাই সাজে বাড়ি বাড়ির প্রতি হাড়ি। শীতে জবুথবু হয়ে চাদর কম্বল মুড়িয়ে, সকালের আলো পেতে মুখিয়ে থাকা। জানালার পর্দা ঠেলে উঁকি ঝুকি মারা। হাত-পা ঠান্ডা ঠেকাতে পাড়ায় পাড়ায় আগুনের কুন্ড জ্বেলে তাপ নিবারন করা । কুয়াশার বেড়াজাল ঘিরে রাখে এ গাঁয়ের সব কিছু। শিশিরে ভরে থাকে সবুজের বিস্তৃর্ন সমারোহ। বসন্তের হিমেল বায়ুতে যৌবনের উদাত্ত্ব আহবান দিতে থাকে। কোকিলের দুরন্ত ডাকে উড়ন্ত হয় প্রকৃতির সবকিছু। নতুন সাজে সেজে ওঠে নান্দনিক রুপে। রবির আলোর মুচকি হাসিতে জেগে ওঠে তীরধারা গ্রামের সাবলিল পরিবেশ। জোৎ¯œার স্বর্নালী ঢেউয়ে দোল খায় প্রকৃতিরা। এমনই দৃষ্টিপ্রিয় মিষ্টিমিয় গ্রামের নির্ভেজাল মানুষ খোদা বকশ। সহজ ,সরল, নিরিহ জীবন চলার পথ। কাদায় দেহ সাদায় মন তাঁর। নয়নে স্বপ্নীল সুখের ছোঁয়া। মুখে যদিও হুকোর ধোঁয়া বেমানান হলেও গ্রম্যে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো। প্রতি মুহুর্তের আনন্দটুকু সানন্দে গ্রহন করে হাসি খুশি মনে তার চলাচল। ব্যথাতুর কষ্টমাখা হৃদয়টা সহজে ধামাচাপা দিয়ে ফেলে ঠোঁটের কোণের মায়াবী হাসির ঝলকে, পলকে পলকে সুখের বীজ ছড়াতে একদম ভুল করে না কখনো। মনন জোয়ারে সতেজ ছোঁয়ার ঢেউয়ে ঢেউয়ে পাড়ি দেয় আগামির পথ। সহজেই কাউকে মনের আলোয় আলোকিত করে ভালো করে তুলতে পারে। সংসারিক পারিবারিক জীবনে অনন্য উজ্বল নক্ষত্র। যা সামাজিক দেশাতœবোধে, সংগ্রামী ন্যায়ের চেতনা বোধে জাগ্রত। সত্য স্বভাবে চলতে অভাব নেই। নেই তার কোন দ্বিধাদ্বধা। মনুষত্বে আতœবিশ্বাসী সে একজন। খোদা বকশের চলনে কিছু কিছু ব্যতিক্রমী বৈচিত্রের প্রতিফলন ফুঁটে ওঠে। যা কারো কাছে সে গুলো নেই। চরিত্র বর্ননায় ভেসে ওঠে সততা, তাঁর মিষ্টি কথায় হেসে ওঠে জনতা। তাঁর প্রতিটি কথায় একাট কথা সম্পৃক্ত হয় সারাজীবন জুড়ে, মুখে বলা প্রতি মুহুর্তের সেই কথাটি এরুপ: যদি মাঠের দিকে চাষাবাদ ক্ষেতখামারে যাই সে। তাকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় কোথায় যাও?
-যাই আল্লাহর বান্দাদের জন্য কিছু বীজ বুনে আসি। তা না হলে আল্লাহর বান্দাদের জন্য ফসলগুলো কেমন হয়েছে দেখে আসি। আবার নদীর দিকে যেতে দেখে যদি প্রশ্ন করা হয় কোথায় যাচ্ছো? উওর দেয় এরুপ -যাই আল্লাহর বান্দাদের জন্য কিছু মাছ ধরে নিয়ে আসি। সেই সঙ্গে গোসলটাও সেরে আসি। গরুর গাড়িতে করে ধান গম ভানতে নিয়ে যেতে দেখে যদি বলা হয় কোথা যাও? বা কী হবে ?
-যায় আল্লাহর বান্দাদের জন্য ধান ভেনে আনি। তাঁর জীবনটা জুড়ে প্রশ্নের উওরে একটি কথা থাকবেই। আল্লাহর বান্দাদের জন্য। খোদা বকশ ব্যাগ হাতে বাজারে যাচ্ছে। পথের বাঁকে হোক গ্রামের মাঁচায় বসা মানুষগুলো যদি প্রশ্ন করে "কোথায় যাচ্ছো?্ ঐ একই সুরের কথা-যাই আল্লাহর বান্দাদের জন্য কিছু বাজার করে নিয়ে আসি। এভাবে দিন মাস ঘুরতেই খোদা বকশের নাম পরির্বতন হয়ে গেল। বাইরে থেকে খোদা বকশের খোঁজে লোকজন আসলে গ্রামে ঢুকতেই মানুষ দেখলে বলে, ভাই আল্লাহর বান্দার বাড়িটি কোন দিকে। আবার কেউ যদি তাকে খুঁজতে থাকে প্রশ্ন হবে আল্লাহর বান্দা কোথায় গেছে বলতে পারিস? কালে কালে খোদা বকশ নামে আর তাকে কেউ চেনেনা। শিশু কিশোর তরুনরা তাকে আল্লাহর বান্দা নামে চেনে। এমন উপাধীময় নাম আর ক’জনেরই ভাগ্যে জোটে? ধীরে ধীরে পুরো গ্রামের নামটিই পাল্টে যাবে কিনা তা কে জানে? দেশবাসী হয়তো জেনেই গেল আল্লাহর বান্দা গ্রাম। কখন হয়তো এমন হবে -কেউ প্রশ্ন করল ও ভাই কেথায় যাচ্ছো? উওর হল এরুপ-আল্লাহর বান্দা গ্রামে যাচ্ছি।