পদাবলি - ১


 


রূপান্তর

তমসুর হোসেন


এই আমি কি সেই বিস্মৃত আমি?

অযতেœ রাখা ছেঁড়া পুস্তকের মতো অপঠিত

আমার ভেতর ফোটে নিরাশার কাব্য শতদল

জন্মে ব্যতিক্রমী, কল্পিত, অবাস্তব সব কিংবদন্তি।


মানুষ পুরনো হলে তার দেহ হতে কি মিশে যায়

সুদৃশ্য মুরলি আঁকা রঙিন মলাট?

সহসা অন্তর্হিত হয় ব্যক্তিত্বের সরব দাপট

ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসে গতির সীমা-পরিসীমা?


আমার ভেতর আমিত্বের নীরব রূপান্তর

বাল্য, কৈশর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব এবং বার্ধক্য

আমি তো কাউকেই হারাতে চাই না

কোনখানে বয়ে যায় অনাবৃত জীবনের নদী।



অনুচর

সুশান্ত  হালদার 


কে যায় হেঁটে উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর 

নদীর মতো 

আঁকাবাঁকা চলে, নারীর মতো ঢঙ

রক্তজবা বুকে 

আজও তারে খোঁজে বিনোদ বিহারি গণ 


কে যায় হেঁকে

পলাশের বনে সিরাজ ডাকে উত্তর থেকে দক্ষিণ বরাবর 

আমি কি চিনি? চিনেছি তাঁরে 

মাভৈ মাভৈ বলে গর্জে উঠেছিল একাত্তরে,

চিনে যদি থাকি এই মাটি আর নদী বেষ্টিত মধুমতী-চর 

তবে ভাঙনের ডাকে আমিও আজ বিপ্লবী এক অনুচর!



অতিথি

দেলোয়ার হোসাইন


আমার ক্লান্ত চোখ

নিয়ন আলোয় জোনাকির ডিম্বানু ছড়িয়ে

রাত এগিয়ে যায় জলজ শরীরে...


আমি পেরুতে পারি না শৈশব, স্কুলের 

বারান্দায় ঝুঁলে আছে ছুটির ঘন্টা...


দূর দেখতে হলে দাঁড়াতে হয়

দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ঘুমের শহর!



দীর্ঘশ্বাস   

নূরনাহার নিপা


বুকের নির্বাক রোদনের অর্থ 

বোঝো কি তুমি?

যেখানে লেখা হয় মহাকালের অযুৎ কাব্য?


তোমার ভালোবাসার পাপে

নিজেকে আবৃত করেছি

আর তুমি

আমার অস্তিত্বকে নেহাত’ই ছেলেখেলা ধরে

ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যেন বাঁচলে


একদিন না হয় ভুল করে চলে এসো

আমার শহরে।

দেখে যেও

আজও তোমার প্রতীক্ষায়

আমার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস।



প্রতীক্ষার গান 

আলোক মহিয়ান


শৈশব থেকে শুরু

শিশুফুল-বাঁকাচাঁদ চুপচাপ ফুটতে থাকে

ফুটুক

হাত দেব না

অসময়ে মাখব না আলো

শুধু দেখে যাব ফুল-বিকাশ

মাপব চন্দ্রোদয়


ফুল-চাঁদ পেলে পূর্ণতা-

প্রজাপতি হব

নেব ঘ্রাণ

নেব জ্যোৎস্নাস্নান


বুকের মধ্যে

লুকোনো সেই স্বপ্নানন্দ নিয়ে

একলা কাটানো দিন যাপনের গানে

বাজে বেসুরো

বাতাসে মিশে যায় ফুল-চন্দ্রগুঁড়ো




মেঘ সমাচার

নুরুল ইসলাম বাবুল


১.

ভেঙে ভেঙে মেঘ ভুলে যায় অভিমান,

বুকের দুয়ার খুলে ঢেলে দেয় ভালোবাসা।

২ .

তুমি মেঘ হও, অথবা আমিও হতে পারি-

যদি শর্তহীন ছেড়ে দাও দুপুরের অধিকার।

৩.

বাতাসে উড়িয়ে চুল

চলে যায় এলোকেশী

অবিন্যস্ত চুলে তার শুয়ে থাকে মেঘডম্বর আকাশ।

৪.

যদি ভুলে যাও মেঘের সংবাদ

তবে মুছে ফেলতে হবে বপনের রীতি,

বরং দূরে রেখে বিগত অভিশাপ

মেঘদের নিয়ে এসো নদী ও রমনীর কোলে।



চেতনার শেষ সীমান্তে 

অরুণ বর্মন


আমি যখন একান্তে ভাবি

অনুভব করি, আমি একি আবাস গড়েছি কুপম-ুকতার গ্রীণহাউজে!

অজস্র কীটের মাঝে বসে আছি ময়দানব সেজে,

নিজেকে জাহির করছি খাটাশ বনের বাঘডাসা।

জিহ্বার ফাঁক গলে অনবরত ছাড়ছি অচেনা হুঙ্কার।


কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি, 

দেখছি স্বচ্ছ আকাশ আমাকে ডাকছে, 

নির্মল বাতাস আমাকে ইশারা দিচ্ছে ,

কিন্তু বের হতে পারছি না।


নষ্ট নগরের বিনষ্ট প্রেম আমার চৈতন্যকে সম্মোহিত করেছে।

আমার চেতনার রঙকে অপহরণ করেছে

আমার বোধিসত্ত্বকে বিকলাঙ্গ করেছে। 


আধুনিকতার নামে নির্লজ্জ রাষ্ট্রের ভ্রষ্টা রাজা সেজে আমি 

দিনরাত তেল মালিশ করে চলেছি মেকি আব্রুতে ঢাকা মদ্যপ নর্তকীর পায়ে।

যাজ্ঞসেনীর বস্ত্র হরণ আমার দুচোখকে ভিজাতে পারে না।

বাতাসের কান্না আমার হৃদয়ের আবেগে মথিত করতে পারে না।

ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে আমি ডুবে যাচ্ছি, আর ডুবে যাচ্ছি, অতলান্ত গহীনে ডুবে যাচ্ছি।


হঠাৎ ভাবনায় ঝংকার এলো

যদি কখনও সঞ্চিত অব্যক্ত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারি

সেদিন গ্রীণ হাউজের কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসবোই।

তবে এই বেরিয়ে আসা হবে না কোনো পরকালের শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার জন্যে।

এই বেরিয়ে আসা নিশ্চই হবে আমার চেতনার শেষ সীমান্তে পৌঁছে 

পৃথিবীতে একটা ভূমিকম্প আনার জন্যে।




চিঠি

রিমন মোরশেদ 


স্টেশনে পরিত্যক্ত বগিগুলো বিধ্বস্ত যতটা

তার অধিক করুণ প্রচ্ছদ উপযোগী

বুক নিয়ে

কতকাল পুষে রাখবো অপেক্ষা!


বুকের উঠোনে মৃত্যুগাছ 

তরতরিয়ে বড় হয়! দুঃখীর কন্যা সন্তান। 

তোমার ফেরা ঠিক না ফেরাই থেকে যায় 

দিন, মাস, বছর! 


চারপাশে শুধু দোআঁশ দুঃখ 

কি দারুণ ফলন দেয়- অপেক্ষার মৌসুমে!



বেনামী 

জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


পর্দা খুলেই দিলে তবে;

বাতাশ আর ঘোড়ার পায়ে পড়িয়ে নুপুর,

খোশ মেজাজে খেয়ে নিচ্ছো

গোছানো সব দুপুর;

বালিকা, তুমি কার্তিকের প্রিয় খুনি। 


এভাবেই যদি শেষ হয় কাঙ্খিত জনপদ, হোক;.

তারপরও-

নিভিয়ে দাও মোমের কান্না;

চোখ খুলে দেখুক মৃত কবিরা।



গল্পের রুপালি রুপান্তর

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ


মাঝে মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে যখন উড়তে থাকি তখন 

মনে মনে ভাবি এ আর এমন কি?

মশা ওড়ে....মাছি ওড়ে, 

পাখি ওড়ে, তেলাপোকা ওড়ে.. 

এমনি করে ওড়ে আরও হাজারো কতো কী!


আসলে জীবন কেবলই দু আঁটি পাটের বোঝা

সরল অংক কেবল নামেই, নয় এতো সোজা!

তবুও ডেকে আনি ঢেকুর বেদনা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে

অন্তর, আমি জানি আজ হউক, কাল হউক

একদিন না একদিন ঘটবেই গল্পের রুপালি রুপান্তর!


তবুও....

সারাদিন কতোকিছু আঞ্জাম দিই বাড়ি, গাড়ি,

নারী; আচ্ছা, যে পথে হেঁটে যাই... সে পথ কি চিনে

আমায়? নাকি সবকিছু কেবলই লজ্জাবতীর লজ্জা..

আশা, ভয় ও শংকার আলো-আঁধারীর ফুলশয্যা!!


তথাপি থেমে নেই মধ্যরাতের উড়নচ-ী ভুল

হাঁটতে হাঁটতে ওড়তে ওড়তে ফিরে ফিরে আসে

মৃতনদীর দুকূল; অথচ পৃথিবীর কেউ বুঝে না 

বুঝতে চায় না.. নাটাইবিহীন ঘুড়ির পাস্তুরিত ভুল!!





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট