ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১১



(গত সংখ্যার পর)
অথবা ঝিনুক নীরবে সহো ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও, ভিতরে বিষের বালি মুখ বুজে মুক্তা ফলাও। এক বুক শূন্যতায় ভাসতে থাকে উর্মিলা। হু হু করে বাড়তে থাকে বুকের ভেতরকার দহন। যার বোধ ভাষা ওর জানা নেই। কেবলি হাহাকার। উর্মিলা কি জানে ঝিনুকের মতো সর্বংসহা একজন ঊনিশের তরুণী, ভাঙতে ভাঙতে নিজেকে আবিষ্কার করে ভুবনের সব দায়ভার তার স্কন্ধে। ওর চোখের কোনায় জল জমতে থাকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বিকেল নেমে আসছে। নিরুত্তাপ রোদের ঔজ্জ্বল্য ক্ষীণ হয়ে আসছে।
ক্লাস শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজে যায়। রুবী ঘুমের মধ্যেই ছিল। রুমের দরজা খুলে দিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘দীপু ভাই, আমাকে রূপকথার বই দিয়েছে। এটা কি তার ঠিক হয়েছে? আমি কি বাচ্চা মেয়ে?’
কিছু বলার আগেই ও লাইটের বিপরীতে মুখ নিয়ে ঘুমের আশ্রয়ে চলে যায়। প্রাত্যহিক কাজ শেষ করে উর্মিলা যখন বিছানায় এল তখন এগারোটা বেজে গেছে। রুবী মৃদু স্বরে নাক ডাকছে। টেবিলে বেবী আপার ডায়েরি আর কলম।
বিছানায় গা এলিয়ে বুকের কাছে বালিশ নিয়ে ডায়েরির পাতা ওলটাতেই ওর লিখতে ইচ্ছে করে, আজ তিরিশে এপ্রিল, ১৯৮৯ সাল। আজ আমার কলেজের প্রথম দিবস। আমার মনে হলো, আমি যেন এক অন্ধকার গহ্বর থেকে হনুমানের মতো হামাগুড়ি দিয়ে আলোর দিকে হাঁটতে লাগলাম। শুভপুর গ্রামের উর্মিলা নামের এক  নারী আবছায়ায় পথরেখায় মিল খুঁজতে থাকে। আত্মায় লালন করে, এই তো মুক্তির একমাত্র পথ। বাবা তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো। আমি যেন বেবী আপা হয়ে জন্ম নিই। কী অদ্ভুত কা-। ক্লাস থেকে বেরিয়ে রিকশা নেব। ঠিক এ সময় ল্যাম্পপোস্টের ওপাশ থেকে দীপু ভাই এগিয়ে এল। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। কিছু বোঝার আগেই দীপু ভাই বলেন, ‘বেবী আপার বারণ থাকলেও কী হবে। ভাবলাম দেবী তো নগরে আগন্তক। রাত-বিরাতের ব্যাপার। বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’
রিকশায় উঠে বলে, ‘উঠুন।’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো কোনো ব্যবধান ছাড়াই দীপু ভাইয়ের পাশে বসে বলি, ‘আপনি সিগারেট খান?’
‘না খাই না। আজ খেতে ইচ্ছে করল।’
‘ও।’
‘আপনি কি রাগ করেছেন?’
‘না।’
কোনো কথা ছাড়াই বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে চলে যায় দীপু ভাই।

১২.

শুক্রবার। সকাল থেকে নিজের ভেতরে উত্তেজনা অনুভব করে উর্মিলা। আজ বেবী আপার সঙ্গে থাকতে হবে। আজই প্রথম বেবী আপার একান্ত সান্নিধ্য পাবার সুযোগ। ইতোমধ্যে বেবী আপার দেওয়া প্রায় সব বই পড়ে ফেলেছে। অর্থনীতি উর্মিলা বুঝেনি। কিন্তু হো চি মিন-এর সংগ্রামী জীবন ওকে আকর্ষণ করেছে বেশি। রুটস লেবেল থেকে উঠে আসা একজন মানুষ কীভাবে একটি নেশনকে বিপ্লবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। অবিকল আমাদের বঙ্গবন্ধুর মতো। তিন হাজার বছরের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে গেছেন। বাঁশের লাঠি হাতে কামানের সামনে বুক পেতে দিতে দ্বিধা করেনি মানুষ। তাঁর জন্য পেয়েছে একটি স্বাধীন ভূখ- এবং লাল-সবুজ পতাকা।
উর্মিলা নিজের মধ্যে একটু একটু করে পরিবর্তন অনুভব করে। শুভপুরের বন-বাদাড়ে ঘাস-ফড়িংয়ের পেছনে ঘুরে বেড়ানো উর্মিলার ক্রমেই মৃত্যু ঘটছে। তার জায়গায় বাসা বাঁধতে শুরু করেছে দৃঢ় ক্রোধে এক মানবিক সত্তা। জীবন এবং জগৎকে আবিষ্কার করার দুর্নিবার আকর্ষণ। বিশ্বাসের ঝুল বারান্দায় শেকড় গজাতে শুরু করেছে। উর্মিমালা, উর্মি তুই পারবি। হঠাৎ উর্মিলার মনে হয় বেবী আপা কি বই- সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করবে? করতে পারে। দীপু ভাই তো সে রকম  ইঙ্গিতই দিয়েছিল।
‘কী বলবে ও!’
‘সত্যি বলবে।’
যা বুঝেনি তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওর। বোঝার জন্য ঢের দিন অপেক্ষা করছে।
যদি জিজ্ঞেস করে প্রিয় চরিত্র কে? বলব, বঙ্গবন্ধু, আর চে গুয়েভারা। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। অন্যজন যোদ্ধা। রাইফেল হাতে বাঙ্কারে লাফিয়ে পড়ে শত্রু নিধনের অব্যর্থ সৈনিক। আর শহীদ জননী দেশমাতৃকার ইস্পাত দৃঢ় মমতাময়ী ছায়া। উর্মিলা সেই ছায়াতলে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে নির্মল বাতাস গ্রহণ করতে চায়। কার্বনশূন্য সুশীতল বায়ু। আহা!
‘বেবী আপা আমাকে থ্রি-পিস দিয়েছে। দারুণ।’ রুবী বলে।
‘ভালো। আমাকে কলম আর ডায়েরি।’
‘তুই বিদ্বান হবি, তাই কলম দিয়েছে। আর আমি নায়িকা হব তাই থ্রি-পিস? বলে উচ্চস্বরে হাসতে থাকে রুবী।
বেবী আপার গিফট রুবী খুশি হয়েছে। ধোবাউড়া রুবীকে বেবী আপা খুশি করেছে, ভেবে আনন্দিত হলো উর্মিলা। কত চাওয়া পাওয়ার বঞ্চনা রয়েছে ওর। সংসারে এসে একেক জনের একেক রকম স্বপ্নবিলাস। রুবী নিজকে বঞ্চিত করবে কেন?
বেলা আড়াইটার দিকে মকিম চাচা ওপরে উঠে এল।
‘মা-জননী। গাড়ি প্রস্তুত। আপনার রেডি হতে হবে যে।’
‘আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি?’
উর্মিলা দশ মিনিটের মধ্যে বের হতে পারল না।
 ক’মিনিট গেল কী পড়ে বেবী আপার সম্মুখীন হবে!
বাবার দেয়া পুজোর সালোয়ার-কামিজের সাথে কুমারী বিনুনি করে বের হতে পনেরো মিনিট পেরিয়ে যায়। তবুও মনের মধ্যে শঙ্কা অনুভব করে। বেবী আপা কী পছন্দ করে তা ওর জানা নেই। তারপরও ভরসা, এ মাটি-মানুষের জন্য যার দীঘির অতলস্পর্শী মমতা সে কি এর বাইরে?
ইন্দিরা রোড থেকে বেবী আপাকে পিকআপ করে গাড়ি যখন রূপসী বাংলা অতিক্রম করছে, ঠিক তখন বেবী আপা বলল, ‘তুমি কি জানো তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?’
‘জি-না আপা।’
শহীদ মিনারে। ওখানে প্রতিবাদ সভা আছে।’
‘কেন?’
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শরিক হতে। আমি আর শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বক্তৃতা করব।’
‘শহীদ জননীর সঙ্গে দেখা হবে।’
‘হ্যাঁ। তুমি তার বইটি পড়েছ?’
‘জি আপা, এইরকমও হয়? যতবার পড়েছি আমার চোখে বারবার জল এসেছে।’
‘খুশি হলাম উর্মিলা। উনি হলেন আমাদের জাগ্রত বিবেক। প্রতিকূলতায় কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় জননী বঙ্গমাতার কাছে শিখবে।’
বেবী আপার এমন সাধারণ রমণীর মতো কথা বলায়Ñউর্মিলার চোখে জল এসে যায়।
উর্মিলা অনুভব করে ওর হাত পা ঘেমে উঠছে। ছুটে চলা রাস্তার যানবাহনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপা, আমি তো এতকিছু জানি না।’
‘জানবে। জানতে জানতে একসময় নিজেকে তখন আর শুভপুরের উর্মিমালা ভাববে না। ভাববে জননী বঙ্গভূমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
উর্মিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
ততক্ষণে টিএসসি পেরিয়ে শহীদ মিনার থেকে একটু দূরে গাড়ি ইন করে।
বেবী আপা একটি ফাইল উর্মিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘যতœ করে রেখো, আর আমাকে ফলো করো।’
উর্মিলা তাকিয়ে দেখে শহীদ মিনার লোকে লোকারণ্য। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার ঢেউ। প্ল্যাকার্ড ফেস্টুনে সয়লাব চারপাশ। আর গগনবিদারী চিৎকার, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’
‘খুনি এরশাদ বিদায় হও।’ এ সময় মাইকে ঘোষিত হচ্ছে, এখন এ সমাবেশে উপস্থিত হচ্ছেন, বর্তমান বাংলাদেশের নারীমুক্তি আন্দোলনের বলিষ্ঠ নেত্রী, দেশ-বিদেশে একজন যুদ্ধবিরোধী মানবিক চরিত্র হিসেবে স্বীকৃত, বাংলাদেশের শহীদ জননীর ছায়াযোদ্ধা আমাদের প্রিয় বোন, বেবী তাসমিন, আমাদের বেবী আপা।
চারদিক দিগন্ত প্রকম্পিত চিৎকার, বেবী আপা এগিয়ে যাও, আমরা আছি তোমার সাথে।’
হাত উঁচু করে সমাবেশকে অভিবাদন জানিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান বেবী আপা।
উর্মিলা তাকে অনুসরণ করে।
মাইকে তখনও ঘোষিত হচ্ছে, ‘আমাদের সম্মানিত  অতিথি প্রিয় আপনজন, বেবী তাসমিন মঞ্চে আসন গ্রহণ করছেন। আর অল্পক্ষণের মধ্যে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মঞ্চে উপস্থিত হবেন। আপনারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন।’
এ সময় শাপলা চত্বর থেকে এক বিশাল মিছিল আসছে। মেডিকেল গেট, বকশিবাজারের দিকের রোড আর বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হল খেলার মাঠের দেয়াল ঘেঁষে শতাধিক পুলিশ সমাবেশ বেষ্টন করে রেখেছে।
মিছিলের কণ্ঠস্বর যেন উত্তাল সমুদ্রের গর্জন করতে করতে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে আসছে। ‘স্বৈরাচার এরশাদ নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’
উর্মিলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনুভব করল কে যেন ওর মধ্যে ভর করছে। সমাবেশের সহস্র কণ্ঠস্বর একাকার হয়ে শিরায় শিরায় বসতি গেড়েছে। একবার সমাবেশ, একবার বেবী আপার দিকে তাকাতে থাকে। ওর মনে হয় ও কি এরকম সমাবেশ আগে দেখেছে? না ও কিছুই দেখেনি। শুভপুর তো এরকম না। নির্ভার। নিস্তরঙ্গ। স্বৈরাচার কেন? কে স্বৈরাচার? ওর মাথায় তালগোল পাকাতে থাকে।
মাইকে বক্তৃতা চলছে। কে বক্তব্য রাখবে, কী বক্তব্য রাখছে তার কোনো শব্দই ওর কানে ঢুকছে না। একবার মনে হয় এ সমাবেশে কি দীপু ভাই এসেছে? আসতে পারে। বেবী আপার পছন্দের মানুষ। নিশ্চয়ই স্বাধীনতাকামী। জনতার স্বপ্নদ্রষ্টা।
মাইকে ক্রমাগত বক্তৃতা-চলছে। টিএসসি থেকে ছাত্র-জনতার দীর্ঘ মিছিল আসছে শহীদ মিনারের দিকে। মিছিলের অগ্রভাগে শহীদ জননী। পাশে সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। কালো চশমা পরিহিত শহীদ জননী জনতার উদ্দেশে হাত উঁচু করতে করতে মঞ্চে উঠে এল।
জনতার গগনবিদারী চিৎকারের মধ্যে উর্মিলা লক্ষ করল শহীদ জননী বেবী আপার বুক জড়িয়ে ধরে বলল, বেবী ক্যামন আছ?’
‘জি খালাম্মা ভালো। আপনার শরীর ক্যামন?’
‘ভালো না। গলার ব্যথাটা বেড়েছে। শাহরিয়ার ছাড়তে চায় না।’
‘আমি তো আপনার জন্য এসেছি।’
‘তুমি তো আসবেই।’
উর্মিলা অত্যন্ত কাছে থেকে শহীদ জননীকে দেখতে থাকে। কী নির্মল মুখ। চুলের সাথে কোথায় যেন সূচিত্রা সেনের মিল আছে। এমন ব্যক্তিত্বময় নারীর মুখ উর্মিলা আগে কখনো দেখেনি। তার মস্তিষ্কে সদ্য পঠিত একাত্তরের দিনগুলির চরিত্র ছায়া ফেলতে থাকে। আর একটু একটু করে অদম্য সাহস বুকে ভর করতে থাকে। এ সময় মাইকে ঘোষিত হয় এদেশের নারী নেত্রীর পুরোধা, মানবাধিকার কর্মী, সংগ্রামমুখর নির্যাতিত মানুষের প্রিয় কণ্ঠস্বর বেবী তাসমিন আমাদের বেবী আপা।
বেবী আপা একবার সমাবেশের দিকে তাকিয়ে উর্মিলার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মাইকের দিকে এগিয়ে যান।
উর্মিলা বেবী আপার মুখের দিকে তাকায়।
(চলবে)

ধানশালিক ইউটিউব চ্যানেল : সাবস্ক্রাইব করে পাশে থাকুন : https://www.youtube.com/watch?v=YO9D0KK6Jps

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট