মায়া

 


মায়া

রেহমান আনিস


সন্ধ্যায় কেরোসিন কিনতে যায় বিকাশ। দোকানে টিমটিম করে হারিকেন জ¦লছে। সোলতেটা একেবারে নামানো। কালি পড়তে পড়তে অস্পস্ট হয়ে গেছে কাঁচ। অস্পস্ট আলো। সামনে বাঁশের বেঞ্চে বসে ধুমছে গোপাল বিঁড়ি টানছে দুই বুড়ো। বিকাশ কেরোসিন কিনে বোতল হাতে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। দোকান পেরিয়ে আটদশ গজ দূরে যেতেই শারমিনের মুখোমুখি। দুজনেই থেমে যায়। এমন সময় বিকাশের হাতের কবজি ধরে শারমিন বলে, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’ এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে আশেপাশে তাকায় বিকাশ। শারমিন মুচকি হেসে বলে, ‘ভয় পেয়েছ?’ বিকাশ কিছু না বলে বাড়ির দিকে হাটা দেয়। শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, আজ এমন করল কেন শারমিন? জীবনে এই প্রথম কোন নারী তার হাত স্পর্শ করেছে।

মসজিদ থেকে ফজরের আজানের শব্দ ভেসে আসে। ঘুম ভেঙে যায় বিকাশের। মনে পড়ে যায় সেই সংগীত সন্ধ্যার কথা। সেদিন বিকাশের কন্ঠে গান শুনতে শুনতে জমে যায় শারমিন। ষ্টেজ থেকে নামার পর একটা তরতাজা লাল গোলাপ তুলে দেয় বিকাশের হাতে। শারমিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বিকাশের মনে মায়া জন্মায়। কিন্তু কেন এমন মায়া জন্মায় সে উত্তর বিকাশের জানা নেই। আড়মোড়া দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে সে। তার অদ্ভুত রকমের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে ভাবনার গভীরে হারিয়ে যায়।

একদিন ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরছে বিকাশ। উঠোনে পা রেখেই আঁচ করতে পারে কিছু একটা ঘটেছে। চারিদিকে নীরব। বারান্দায় একখানা কাঠের পিড়িতে গম্ভীর হয়ে বসে আছে মা। বাবা হাতের তালুতে গাল ঠেকিয়ে কী যেন ভাবছে। আর এককোণে বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোটবোন মিতালী। যেন অচেনা তিনজন মানুষ। বিকাশ এগিয়ে যায় মিতালীর দিকে। মিতালী শাড়ির আচল দাঁতে চেপে এক দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঠাস করে দরজার খিল আটকে দেয় ভেতর থেকে। ওকে যে কেন তাড়িয়ে দিয়েছে বুঝতে বাকি রইলো না বিকাশের। মনে মনে গাল পাড়ে, ‘পরের চুল-দাড়িতে ক্ষুর-কাঁচি চালিয়ে, বগল কামিয়ে দিনে কত কামানো যায়, জানিস না অমানুষের দল?’ 

বাপ-ছেলে জন্তুর মতো কাজ করতে থাকে। ধীরে ধীরে যৌতুকের সব টাকা শোধ হয়ে যায়। মিতালী ফিরে যায় শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু, বিকাশের আর কলেজে ফেরা হয় না। 

এইচএসসি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের মাত্র একদিন বাকী-বিকাশ ছাড়া ক্লাসের সবাই ফর্ম ফিলাপ করেছে। সন্ধ্যার আগমুহূর্তে বিকাশদের বাড়িতে যায় শারমিন। উঠোনকোণে ফুলে বেদীতে পানি ঢালছে বিকাশের মা। শারমিন এগিয়ে গিয়ে কোমল স্বরে বলে, কাকিমা, ‘বিকাশ কী পরীক্ষা দিবে না?’ অধোবদনে না সূচক মাথা নেড়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভেতর চলে যায় বিকাশের মা।

পরীক্ষা শেষ। তিন মাস পর ফল বের হয়। শারমিন মেধাতালিকায় স্থান পায়। খুব আনন্দ হয় বিকাশের। কিন্তু এই আনন্দের মধ্যেও থেকে থেকে বিষাদের আগুন জ¦লে ওঠে। কী যেন একটা হারিয়ে ফেলেছে সে!

মেডিকেলে ভর্তি হয় শারমিন। পড়াশোনার চাপ অনেক বেশি। এদিকে বিকাশ সংসারের দ্বায়ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে। বাবা অসুস্থ। সেলুনটা এখন ওকেই সামলাতে হয়। দীর্ঘদিন দুজনের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। প্রথম দিকে ঘনঘন চিঠি আসত ঢাকা থেকে। এখন আর আসে না। বিকাশের ধারনা, হয়তো তার কথা আগের মতো এখন মনে পড়ে না শারমিনের। পড়বেই বা কেন? কয়দিন পর বড় ডাক্তার হবে সে। তার সাথে বিকাশের মতো নাপিতের প্রেম করাটা একেবারেই বেমানান। যে কেউ শুনলে দুই গালে নিশ্চিত স্যান্ডেল উঠবে। 

একদিন সেলুনে চুল কাটাতে আসে চেয়ারম্যান।

শুনিছির, বিকাশ?

কী, কাকা ? 

‘আমাগে শারমিন তো ডাক্তারি পাস কইরে গেছে। এইবার মায়েডারে একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে বিয়ে দিতি পারলি বাঁচি।

বিকাশের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। মুমূর্ষু রোগীর মতো অস্ফুট কন্ঠে বলে, হ কাকা।

ওই দিন আর ক্ষ্রু-কাচি চালানোর শক্তি ছিল না বিকাশের।

রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করে, ঘুম ভেঙে যায়। মাঝরাতে উঠোনে এসে উদাসভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণিমার চাঁদটা একেবারে জ¦লজ¦ল করছে । অসংখ্য তারা মিটমিট করছে। হালকা হিমেল হাওয়া এসে বিকাশের বুকে লাগে। সম্বিত ফেরে তার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে শারমিনের ঝলমলে মুখখানি। তাহলে শারমিন কী আমার জীবন থেকে বিয়োগ হয়ে যাচ্ছে?  

ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসে শারমিন।

রাতে শুয়ে আছে মা, শারমিন আর রেশমা। মা শারমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, এবার বলতো, তোর পছন্দের ছেলেডা কে?

শারমিন একদম চুপ।

ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার?

কিছুই না।

তাহলে?

মানুষ।

‘তা বাড়ি কোন জাগায়?’

এই দেশেই।

এমন কাটা কাটা উত্তর শুনে অবাক হয় মা ।

রেশমা মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘বিকাশ দা। আমাগে গিরামের বিকাশ দা।‘ প্রেসার বেড়ে রেশমার কোলে ঢলে পড়ে মা। ঐ রাতে চেয়ারম্যানের লোকজন গিয়ে হুমকি ধামকি দেয় বিকাশের বাবা মাকে। পরদিন থেকে বিকাশের সেলুনের শাটার আর খুলতে দেখা যায়নি।

শারমিন ইন্টার্নশিপের টাকা দিয়ে কোন রকম একটা রুম সাবলেট নেয়। রুবেলকে চিঠি লেখে, ‘রুবেল, মাঝে আমি যে চিঠিগুলো পাঠিয়েছিলাম, সেগুলি বিকাশের হাতে পৌছানোর আগেই পিওনের হাত থেকে আমার বাবা নিয়ে যায়। বাবা আগেই জেনে গিয়েছিল আমাদের সম্পর্কের ব্যপারটা। কিন্তু, বাড়ির কাউকে বলেনি, জানাজানি হবে তাই। তুমি বিকাশকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা কর। আমি বিকাশকেই বিয়ে করব। ‘

বিকাশকে নিয়ে ঢাকায় যায় রুবেল। কোর্টে গিয়ে সিভিল ম্যারেজ সম্পন্ন হয়। বিষয়টি গ্রামে জানাজানি হয়- চারিদিকে ছিঃ ছিঃ রব ওঠে। বাজার-ঘাট সব জায়গায় কানাঘুষা চলে। শিক্ষক থেকে কৃষক সবার মুখে একই কথা, একজন নাপিত কীভাবে ডাক্তারকে বিয়ে করে?

ডাক্তারকে বিয়ে করা নাপিতের জন্য মহাপাপ। কিন্তু ঘরে বউ থাকতে চেয়ারম্যান যেদিন কন্যাবয়সী কুমারী মেয়েটিকে গায়ের জোরে বলাৎকার করেছিল সেদিন কি এই সমাজের চোখে গামছা বাঁধা ছিল? হয়তো তার বেলায় পাপ নেই!   

চেয়ারম্যান বিকাশের নামে অপহরণ মামলা দায়ের করে। নির্মম পরিস্থিতি নেমে আসে পরিবারের উপর। একদিন চেয়ারম্যানের লোকজন বাজার থেকে ঘাড় ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দেয় বিকাশের বাবাকে।

‘রাজধানীর একটি সেলুন থেকে ডাক্তার শারমিন অপহরণ মামলার আসামি বিকাশ গ্রেপ্তার‘- শিরোনামে কাগজে হেডলাইন হয়। বিকাশকে হাজতে পাঠানো হয়। চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। পিনু এবং সাদিকে বিষয়টি জানায় রুবেল। পিনু সাংবাদিক। আর সাদি আইনজীবী। বিকাশের পক্ষে যুক্তিতর্ক এবং দলিলাদি প্রস্তুত করে সাদি। এই মামলা সে নিজেই লড়বে। নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে শুনানি শুরু হয়। বাদী পক্ষের কুশলী বিকাশকে আচ্ছা মতো ধবলধোলাই শুরু করে। পুরো এজলাস যেন নিস্তব্ধ। হতাশার ছায়া পড়ে বিকাশের চোখমুখে। সাদিও পাল্টা যুক্তি দিতে থাকে। সে শারমিনের বক্তব্য নেওয়ার জন্য অনুমতি চায়। বিচারকের অনুমতি পেয়ে শারমিন বিনয়ের সাথে বলে, ‘মহামান্য আদালত, আমি স্বেচ্ছায় বিকাশকে বিয়ে করেছি। ওকে নিয়ে শান্তিতে সংসার করছি।‘ বাতাস ঘুরে যায়। ভিকটিম প্রাপ্তবয়স্ক। বিজ্ঞ বিচারক হাতুড়ি ঠুকে বলেন, ‘মামলা এখানেই খারিজ করা হলো।   

বিকাশকে মুক্তি দেওয়া হয়। হাজতের গেটে দাঁড়িয়ে রুবেল, পিনু, সাদি এবং শারমিন। শারমিনের চোখদুটি ছলছল করছে। বিকাশ সামনে এগিয়ে আসে। শারমিন এগিয়ে গিয়ে বিকাশের বুকে কপাল ঠুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ওর চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে বিকাশের বুকে। শারমিনের মাথার তালুতে চিবুক রেখে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় বিকাশ। বিকাশের দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে পানি। ডাক্তার আর নাপিতের মধ্যে কথিত সীমান্তরেখা দু’জনের চোখের পানিতে একাকার যায়।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট