ইজাজ মিলনের লেখাগুলো আমাকে অশ্রুসিক্ত করেছে

 



ইজাজ মিলনের লেখাগুলো আমাকে অশ্রুসিক্ত করেছে

গোলাম সারওয়ার 


ইজাজ আহ্মেদ মিলন সমকালের গাজীপুর প্রতিনিধি। একাšøই একজন স্বল্পবাক, আত্মমুখীন নিভৃতচারী সাংবাদিক। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা সাংবাদিকদের মধ্যে যথেষ্ট প্রকট। এই ব্যাধি থেকে মিলন মুক্ত বলে ওর সঙ্গে কথা হয় কদাচিৎই। স্বল্পবাকই নয়, মিলন চলনে-বলনেও খুব নিরীহ। সম্প্রতি সে আমার সঙ্গে দেখা করে তার প্রকাশিতব্য নতুন গ্রন্থ ‘১৯৭১ :বিস্মৃত সেই সব শহীদ’-এর ভূমিকা লেখার অনুরোধ জানাতেও সে ছিল ™ি^ধান্বিত। দেশে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক অস্থিরতা। পেট্রোল বোমায় দ¹ব্দ হচ্ছে নারী, পুরুষ, শিশু। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মাংস পোড়ার গন্ধ, আহতদের আর্তনাদে বাতাস ভারি। ভয়ঙ্কর উত্তেজনা ও ব্যস্ততার মধ্যে সাংবাদিকদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত। এ সময়ে কোনো পুস্তকের ভূমিকা লেখার দুরূহ কাজ (যে কাজে আমি আদৌ অভ্যস্ত নই) সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে জানালেও মিলনের করুণ মুখ দেখে অবশেষে দু’কথা লেখার জন্য সম্মত হয়েও তাকে অনেক দিন অপেক্ষমাণ রাখতে হয়েছে। এ জন্য কিছুটা মর্মবেদনাও অনুভব করেছি। মিলন তার নতুন বইয়ের পা-ুলিপি দেওয়ার সময় প্রকাশিত তিনটি বইও দিলÑ ১. পোড়ামাটির ক্যানভাসে বিরামহীন বেদনা, ২. দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ, ৩. ছাতিম গাছের মৃত ছায়া। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্রজলে’ পাওয়া গেল না।

মিলনের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘১৯৭১ :বিস্মৃত সেই সব শহীদ’-এর সূচিবদ্ধ ২৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার অজানা মর্মস্পর্শী কাহিনীগুলোর ওপর চকিত চোখ বুলিয়েছি। সবগুলো পড়া হয়নি। লেখাগুলো আমাকে অশ্রƒসিক্ত করেছে। স্বামী ফিরে আসবেন Ñ পথের দিকে আজও চেয়ে থাকা শহীদজায়া আনোয়ারার কথা লিখতে গিয়ে বারবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে মিলন। শুধু আনোয়ারার কথা লিখতে গিয়েই নয়, অন্যদের গল্পেও আবেগ ও বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মিলনের বাংলা একেবারেই নির্ভার, ঝরঝরে। বর্ণনার অনুষঙ্গে দৃশ্যমান হয়েছে যেন কবির চোখে দেখা প্রকৃতি। শহীদ শামসুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারার জবানিতে, ‘দুধভাত খুব প্রিয় ছিল তার। সাথে কলা। আমাদের একটা গাভী ছিল। খুব সকালে উঠে রান্না শেষ করেছি। গাভীর দুধ দিয়ে ভাত দিলাম। তিনি খেতে বসলেন। কিন্তু আমাকে ছাড়া খাবেন না। যু™েব্দ না যাওয়ার জন্য বারবার আমি অনুরোধ করেছিলাম। তিনি শুনলেন না। অনেকটা অভিমান করে সেদিন তার সাথে খেতে বসিনি। আমি বসিনি বলে তিনিও আর খেলেন না। চলে গেলেন, অনেকটা অভিমান করে।’ এমনি করে বহতা নদীর মতো এগিয়ে গেছে জীবনের গল্কপ্প, জীবনের বেদনা-অশ্রƒপাত। তার লেখায় বারবার ফিরে এসেছে আমাদের চারপাশের নিসর্গ, প্রকৃতি। সম্ভবত মিলন মূলত কবি বলেই প্রকৃতিতে প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে। তার কবিতার প্রশংসায় দেশের সেরা কবিরা পঞ্চমুখ। কবি আল মাহমুদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মহাদেব সাহা তার কবিতা ও গদ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গদ্য লিখতে তাকে প্রেরণা দিয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও হুুমায়ূন আহমেদ। তারা যে একজন যোগ্য লোককেই অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, তা ‘১৯৭১ :বিস্মৃত সেই সব শহীদ’ পাঠ করে হƒদয়ঙ্গম করতে পেরেছি।

ইজাজ আহমেদ মিলন তার এলাকার বিস্মৃত শহীদদের কথা জানতে, তাদের কথা আমাদের জানাতে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে। জহির উদ্দিনের ‘কষ্টগুলো পাথর’ হয়ে যাওয়ার গল্প, শাহাব উদ্দিনের লাশ হয়ে ফিরে আসার কথা, গোলাম মোস্তফার ‘তেতাল্লিশ বছরেও স্বীকৃতি না মেলা’, শামসুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারার ‘পথপানে চেয়ে থাকা’, শহীদ খন্দকার আবুল খায়েরের সন্তান আবুল কাশেমের যন্ত্রণার গুরুভার বেদনার অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছে। ইজাজ আহ্মেদ মিলনের গ্রন্থটি প্রকাশকালও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। বাংলাদেশের গৌরবময়  স্বাাধীনতায় যারা বিশ^াস করে না, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত , যারা দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চাকা রুদ্ধ করতে চাইছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা এখন যুদ্ধে লিপ্ত। মিলনের এই পুস্তকটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও শানিত করবে বলে আমার বিশ^াস।


[মরহুমের অতীত ভালোলাগার অংশবিশেষ]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট