প্রেমের স্টেশন

 



প্রেমের স্টেশন

মুহিব্বুল্লাহ কাফি


‘ইমরান তোর ফোন। 

ইমরানের রুম থেকে জোরে হাঁকলেন সুফিয়া বেগম। 

‘মা, কার ফোন? 

ওয়াশরুমের দরজা খুলে উঁকি দিলো ইমরান। 

‘আননোন নাম্বার। কয়েকবার দিয়েছে। 

‘মা আননোন হলে রেখে দাও, গোসল সেরে দেখছি। 


ইমরান ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর ইমরান গোসল সেরে রুমে এসে কাপড় পরে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যেই চুল আচড়াতে যাবে তখন মনে পড়লো ফোনের কথা। ইমরান চুল না আচড়িয়েই চিরুনি বাঁ হাতে রেখে, মোবাইল নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে পাঁচটা কল। কল ব্যাক করলো ইমরান । 

‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। 

ওপাশ থেকে কোনো সাড়া-শব্দ এলো না। 

ইমরান আবার, হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

এবারও কোনো রা শোনা গেলো না। ইমরান যেই কলটা কেটে দেবে ভাবলো ঠিক তখন ওপাশ থেকে ভেসে এলো,

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো ইমরান?

অচেনা মেয়েলি কণ্ঠস্বর শোনে ইমরান কৌতুহলি হয়ে উঠলো। জবাব করলো,

‘আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনি কে?

‘আমি আফিয়া। ওপাশ থেকে জবাব আসলো। 

ইমরান মুহূর্তের মধ্যে তার পরিচিত, আশপাশের চেনা সবার কাছ থেকে ঘুরে এলো। কই, আফিয়া নামে তো তার চেনা কেউ নেই। 


‘কোন আফিয়া? ঠিক চিনতে পারলাম না। জানতে চাইলো ইমরান। 

এবার ফোনের ওপাশ থেকে একটু ব্যাখ্যা আসলো। 

‘আমি আফি, প্রিন্সিপালের মেয়ে আফি। এবার মনে পড়লো তো?



বিদ্যুৎ না থাকা অবস্থায় অন্ধকারে হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসায় আচমকা লাইট যেমন জ্বলে ওঠে, ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আকস্মিক বজ্রপাতের আওয়াজে যেমন ভেতরটা নাড়া দিয়ে ওঠে, তার চেয়েও তড়িতে ‘প্রিন্সিপালের মেয়ে আফি’ শব্দটা ইমরানের দেমাগে উপস্থিত হলো। প্রচ-বেগে শর্ট খেলো ইমরান। তার এখন বুকে সেই ধুক ধুক শব্দটা শুরু হয়ে গেলো। 


ইমরান এবার খাটে দু’পা নামিয়ে জড়সড়ো হয়ে বসলো। যেনো ইমরান প্রিন্সিপালের সামনে বসে আছে। ইমরান দীর্ঘ এক গরম নিশ্বাস ছেড়ে বললো-

‘আফি, কেমন আছো তুমি! 

‘যাক, তাহলে চিনতে পারলে! তুমি যেভাবে বললে কোন আফিয়া, আমি তো ভেবেই বসেছিলাম তুমি আমায় চিনতে পারবে না। 

‘যাক! আমি ভালো আছি। 


আফিয়া একটু থেমে আবার বলতে লাগলো, 

‘আচ্ছা ইমরান, তুমি কি এখন ব্যস্ত? 

‘আরে না, না। আমি এখন একদম ফ্রি। ইমরানের অজানতেই বের হয়ে গেলো তার এই কথাগুলো।  


অথচ, এখন ইমরান তার মামাতো ভাই সুমনের সঙ্গে এক জরুরি মিটিংয়ে যাবার কথা। সুমন ইমরানের ক্লাসমেট-ও। সেই স্কুলজীবন থেকে ভার্সিটি, একসঙ্গেই কাটিয়েছে দুজন। এখনও একসঙ্গে জব করে একই কম্পানিতে। 


কিছুদিন আগে সুমন বিয়ের কাজটা সেরে ফেললো। খুব কড়াভাবে বরযাত্রীর সঙ্গে যাবার কথা থাকলেও কোনো কারণে ইমরান যেতে পারেনি। তাই সুমন রেগে লাল হয়ে আছে তার ওপর। এবার সুমন ইমরানকে একটা জরুরি মিটিংয়ে নিয়ে যাবে বলে রেখেছে। ইমরানের ধারণা, সুমন তাকে জরুরি মিটিংয়ের নাম করে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবে। বিয়েতে যায়নি তাই ইমরান সুমনের সঙ্গে এবার যাবে ভেবেই রেখেছে। জরুরি মিটিং হোক আর শ্বশুরবাড়ি হোক। কদিন ধরেই সুমন আজকের দিনের কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছিলো ইমরানকে। দুপুরের খাবার ওর ওখানেই খেতে হবে। একটু আগেও সে-কথা ইমরানের মাথায় ঘুরছিলো। কিন্তু সেই স্কুলজীবনের আফিয়ার আকস্মিক ফোনে যেনো ইমরান এলোমেলো হয়ে গেলো। সুমন, সুমনের জরুরি মিটিংয়ের কথা, মুহূর্তের মধ্যে সব উবে গেলো। আর উবে যাবেই না বা কেনো। স্কুলজীবনে যে আফিয়ার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলো ইমরান, সেই আফিয়াই যখন এতো বছর পর হঠাৎ ফোন করে জানতে চাইলো-‘ইমরান তুমি কি ব্যস্ত?’ তখন ইমরানের মতো যে কেউ-ই হাজার ব্যস্ততা মারিয়ে এক লাফে বলে উঠবে, আরে না, কোনো ব্যস্ততা নেই। আমি একদম ফ্রি। ইমরানও তাই করলো।  



তুমি এখন আসতে পারবে আমাদের সেই বাংলা স্কুল এন্ড কলেজের মাঠে। আমি বসে আছি। বললো আফিয়া। 


ইমরান পারছেনা এখনি উড়ে যেতে। ইমরান তার সব আবেগ চেপে রেখে স্বাভাবিক হয়ে বললো- 

‘কেনো পারবো না, তুমি ওখানেই থাকো আমি এখনই আসছি। 

ইমরান মাথার চুলে চিরুনি দিয়ে দুটো বাড়ি মেরে বাসা থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলো। ছেলের এমন দ্রুত বের হওয়া দেখে সুফিয়া বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন, এই ইমরান, এই ভরদুপুরে যাচ্ছিস কোথায়! 


ইমরান ফিরেও তাকালো না। দ্রুত বেরিয়ে গেলো। সুফিয়া বেগম দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখেন, ঘড়ির কাটা বারোটা বিশে। 


ইমরান বাসে চেপে বসলো। বাসের ভেতর মানুষের হইহুল্লোড় খুব হচ্ছে। ভাড়া নিয়ে কন্ডাক্টরের সাথে বাকবিতন্ডা চলছে। কিন্তু ইমরান ওই চিৎকার-চেচামেচিকে ইয়ত্তা না দিয়ে সে চলে গেলো ক্লাস নাইনের সেই বাংলা ক্লাসে। 


ক্লাসের সবাই আফিয়াকে ঘিরে আছে। আফিয়ার হাতে একটা চিঠি। উদগ্রীব হয়ে উঠলো সবাই। আফিয়া জানালো, তার ব্যাগে এই চিঠি পেয়েছে। কত্তবড় সাহস, প্রিন্সিপালের মেয়েকে চিঠি দিয়েছে! কিন্তু এই চিঠিতে কী লেখা আছে, এর প্রেরক-ই বা কে, চিঠি পড়ে তা বের করতে বা চিঠির লেখা বুঝতে ক্লাসের সবাই হাঁপিয়ে উঠলো। কেউ বললো, আফি চিঠিটা তোর বাবাকে দেখা। কেউ বললো, আগে চিঠিটা তো পড়ে নিই। পরে না হয় বিচার-আচার হবে। কত্তবড় কলিজা বেটার, প্রিন্সিপালের মেয়েকে চিঠি লেখে! আরেকজন বললো, শালায় চিঠি এমনভাবে লেখছে পড়ায় দুষ্কর। আবার কেউ বললো, ও তো দেখি ডাক্তারি লেখা লেখছে! এই চিঠির অনুবাদ ডাক্তার ছাড়া হবে না রে। এবার ক্লাসের সবাই হেসে দিলো। হা, হা, হা।


সবাই যখন চিঠি নিয়ে ব্যস্ত তখন ইমরান ক্লাসের এককোণে বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ তসবি জপছিলো। ধুক ধুক করতে লাগলো তার বুক।  আর খুব করে প্রার্থণা করছিলো কেউ যেনো ওই চিঠি পড়তে না পারে। কারণ, চিঠির প্রেরক যে ইমরান ছিলো। ইমরানের ভয়ের সাথে সাথে রাগও পাচ্ছিলো ভীষণ। 


ভয়ের কারণ, যদি আফি এই চিঠি তার বাবা, প্রিন্সিপাল স্যারকে দেখায় তাহলে তো তার স্কুলের ইনিংস এখানেই শেষ। 


আর রাগের কারণ, যারা বলছে চিঠি প্রিন্সিপাল স্যারকে দেখাতে, বিচার-আচার হবে, তারা চায় না আফিয়াকে কেউ চিঠি লেখুক বা আফিয়ার সাথে কারোর ভাব হোক। কারণ তারা সবাই আফিয়ার সাথে ভাব জমাতে চায়। ইমরানের সবচে’ বেশি রাগ চড়েছে তার মামাতো ভাই সুমনের ওপর, ও-ওই বলেছে, চিঠিটা আগে পড়ে নিই, পরে বিচার-আচার হবে।  


আর ওইদিন কারণবশত বাংলা স্যার ক্লসে আসেননি। তাই ক্লাসের পুরো সময়টাই গেলো ওই চিঠি পড়তে, বুঝতে, চিঠির প্রেরকের নাম বের করতে। যেই চিঠি পড়তে যায় সেই চিঠি হাতে নিয়ে কতক্ষণ ঠোঁট দুটো উঁচু-নিচু করে, এরপর চেহারায় একরাশ বিরক্তি বসিয়ে বলে উঠে, না বাবা, এতো পড়া অসম্ভব। একে একে ক্লাসের সবার চিঠি দেখা শেষ, চিঠির লেখা নিয়ে সবার গবেষণা শেষ, শেষ বাংলা ক্লাসের সময়ও, কিন্তু কেউ চিঠির মানে খোঁজে বের করতে পারলো না। কেউ চিঠির অনুবাদ কারতে পারলো না। 


‘মামা ভাড়া দেন। 

কন্ডাক্টারের অসহ্যকর ভাড়া চাওয়ার বাজখাঁই গলার আওয়াজে বাস্তবে ফিরে আসলো ইমরান। ভাড়া মিটিয়ে ইমরান আনমনে মুচকি হাসলো। মনে মনে বললো, ইশ! সেদিন কি বাঁচাটাই-না বেঁচে গিয়েছিলাম। সেসময় আমার হাতের লেখা যদি সুন্দর ও স্পষ্ট হতো, যেভাবে হিংসুটেরা উঠেপড়ে লেগেছিলো, তাহলে তো নির্ঘাত আসামির কাঠগড়ায় দন্ডয়মান হতে হতো। আমার খারাপ হাতের লেখাই সেদিন ওই কিছু হিংসুটে সহপাঠীদের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। হা হা হা, এবার ইমরান একটু আওয়াজ করে হাসলো। সেসময় ইমরানের হাতের লেখা খারাপ ছিলো বলে তার এখন গর্বে বুকটা ফুলে যাচ্ছে!  


ইমরান রাস্তার জ্যামে আছে। গাড়ি ধীরে ধীরে চলছে। ইমরান খালি পেটে বাসে চড়তে পারে না। সেই ছোটকাল থেকেই। বুমি বুমি ভাব হয় তার। একরাশ খারাপ লাগা তার ভেতর জমা হয়। দুহাতে পেট চেপে সামনের সিটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে সারা রাস্তা পার করতে হয় তাকে। পৃথিবীতে কী হচ্ছে না হচ্ছে সে সময় তার কোনো যায়-আসে না।  কি আশ্চর্য! ইমরান আজও খালি পেটে বাসে চড়েছে, কিন্তু তার আজ না আসছে বুমি বুমি ভাব, না আসছে বিরক্তিকর ভাব।  


ইমরান আবার তার আতিতের পৃষ্ঠা উল্টালো। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে সেদিন শিক্ষাসফরে বের হয়েছিলো সবাই। সফর শেষে স্কুলে ফেরার পথে কাকতালীয়ভাবে আফিয়ার সিট পড়ে ইমরানের পাশে। কিন্তু হায়! ইমরান সেদিন একটা কথাও বলতে পারেনি আফিয়ার সঙ্গে। এর অন্যতম কারণছিলো, সেদিন সফরেই হঠাৎ ইমরানের পেট খারাপ হয়ে যায়। সারাদিন কিছুই খেতে পারেনি ইমরান। তাই পেট খালি থাকায় একরাশ বিরক্তি চেপে বসে তার ওপর। সফর শেষে ফেরার পথে রাস্তাজুড়ে বাসে ইমরান দুহাতে পেট চেপে মাথা সামনের সিটের সাথে ঠেকিয়ে এসেছে। পাশের সিটে যে আফিয়া বসে আছে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হবে, তা যেনো ভুলেই গিয়েছিলো ইমরান। 


মামা বাংলা কলেজ নামেন। 

কন্ডাক্টারের হাঁকে আবার সংবিৎ ফিরলো ইমরানের। 



ইমরান রাস্তা পার হলো। কলেজের গেইটে পা দিতেই ইমরানের বুক আবার ধুক ধুক করতে শুরু করলো। ইমরান ডানহাতে বুকের বাঁ পাশটা চাপ দিয়ে ধরলো, লাভ হলো না। হাতসহ কাঁপতে লাগলো। খুব জোর করে সামনে এগুলো ইমরান। দেখলো স্কুলের পুব-উত্তর কোণে নীল শাড়ি পরে বসে আছে একটি মেয়ে। ওই বসে থাকা মেয়েই যে আফিয়া, ইমরান নিশ্চিত হয়েছে তার চুল বাধাঁর ধরন দেখে। অদ্ভুত তার চুল বাধাঁর ধরন, যা অন্য সবার থেকে ভিন্ন। দুপাশ থেকে দুটো চিকন চুলের বেণি টেনে পেছনের মোটা ও লম্বা একটা বেণির সাথে সংযুক্ত করে ছেড়ে দিয়েছে। দেখতে বেশ লাগছে। ইমরান বসে থাকা আফিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। দাঁড়ালো আফিয়াও ইমরানকে দেখে। মুচকি হেসে আফিয়া বললো, এতো দেরি করে কেউ? 



ইমরান বাঁ-হাতে মাথা চুলকালো নিচে তাকিয়ে। তার আসার দেরি হবার কারণ যে রাস্তার জ্যাম, তা ইমরানের বলতে ইচ্ছে করছে না।  


‘আচ্ছা ভালো কথা, তুমি আমায় চিনলে কিভাবে? নিজেকে অবাক মেনে বললো আফিয়া। 

ইমরান এবারও চুপ। আফিয়াকে চিনতে তার চুল যে সাহায্য করেছে তাও বললো না ইমরান। একই প্রশ্ন ইমরানের মনেও, আফিয়া তাকে কিভাবে চিনলো, নাম্বারই বা কোথায় পেলো? কিন্তু ইমরান তাও জিজ্ঞেস করলো না। 


‘বসো। আফিয়া বসে তার পাশে ইমরানকে বসতে বললো। 

দুজন পাশাপাশি বসে আছে। কারও মুখে কোনো রা নেই। কিছুসময় কেটে গেলো নিরবে। আফিয়া ইমরানের সংকোচবোধ দূর করার জন্যে সুমনের প্রসঙ্গ টেনে আনলো। আফিয়া বললো, কদিন আগে আমার এক ফুফাতো বোনের বিয়ে হলো। বর এর সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে জানতে পারলাম বর আর কেউ নয়, আমাদের সেই স্কুল লাইফের সহপাঠী সুমন। তোমার মামাতো ভাই সুমন। এরপর তার থেকেই তোমার খোঁজ, তোমার ছবি দেখা, নাম্বার, ফোন আর এখন দেখা।


এতোক্ষণ ইমরান নিচে তাকিয়ে আফিয়ার কথা শুনছিলো। কিন্তু যেই সুমনের কথা, সুমনের বিয়ের কথা শুনলো অমনি অবাক চাহনিতে তাকালো ইমরান আফিয়ার দিকে। আর ভাবলো, ইশ! কেনো যে বিয়েতে গেলাম না!

‘কি, অবাক হয়ে গেলে? বললো আফিয়া। অবাক হবারই কথা। এতোবছর পর আমাদের এ নাটকীয়ভাবে দেখা হবে কে ভেবেছিলো বলো! তোমাকে আরও অবাক করে দিই, এই নাটক মূলত আমিই সাজিয়েছি।


‘কিভাবে? ইমরান ভ্রু কুঁচকে কৌতুহলি হয়ে উঠলো। 



আজ এখন তো তোমার সুমনের সঙ্গে তার একটা জরুরি মিটিংয়ে যাবার কথা। ওই মিটিংটা মূলত আমাদের প্ল্যান ছিলো, পরে প্ল্যান পরিবর্তন করে তোমাকে ফোন করে এখানে নিয়ে আসলাম। কথা শেষ করে ফিক করে হেসে দিলো আফিয়া। 


ইমরানও একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হেসে উঠলো।  

‘আচ্ছা তুমি সুমনের বিয়েতে আসলে না কেনো? তাহলে তো এতোকিছু করার প্রয়োজন ছিলো না আমার। আমাদের বিয়েবাড়িতেই দেখা হয়ে যেতো। 


ইমরান বিয়েতে না যাবার কারণ না বলে চুপ মেরে রইলো। 

‘তোমাকে আরেকটু অবাক করে দিই, এই নাও আমাকে দেয়া তোমার সেই চিঠি। আফিয়া ছোট্ট একটা ভাজ করা কাগজ ইমরানের দিকে বাড়িয়ে দিলো।  


ইমরান থ মেরে গেলো। চিঠি! ক্লাস নাইনের সেই চিঠি! যে চিঠির কথা একটু আগেও বাসে বসে মনে উঠিয়েছিলাম। ইমরান কাঁপা-কাঁপা হাতে চিঠিটা নিলো। চিঠি খুলে ইমরান বিমূঢ় হয়ে গেলো। বিস্মিত হয়ে উঠলো তার চেহারা। এতোবছর পর...। তৃপ্তির পর্দা এঁটে গেলো তার মুখাবয়বে। চিঠি থেকে চোখ আফিয়ার দিকে নিয়ে ইমরান উৎকর্ণ হয়ে বললো-  

‘এ চিঠি তুমি এখনও রেখেছো! 

‘শুধু কি চিঠি! বললো আফিয়া। এ চিঠির প্রেরক যে তুমি ছিলে তা আমি সেসময়ই জানতাম। ক্লাসের সবাই যখন চিঠি নিয়ে ব্যস্ত তখন আমি লক্ষ করেছিলাম তোমার এককোণে বসে থাকা, ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা। আমি তো তখনই বুঝেছিলাম এই চিঠির প্রেরক আর কেউ নয় ইমরান ছাড়া।   


এবার ইমরান লজ্জায় লাল হয়ে লাজুক চোখ আফিয়ার থেকে সড়িয়ে নিলো। 


আফিয়া আবার বললো, সেই ক্লাস নাইনের পর থেকে তোমাকে আর খোঁজে পেলাম না। গিয়েছিলে কোথায়?

ইমরান জবাব করলো না। 

আফিয়া আবার তার হাত ইমরানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, এই নাও। 

ইমরান আড়চোখে তাকালো আফিয়ার হাতের দিকে। দেখলো আরেকটা ভাজ করা ছোট্ট কাগজ, নিলো ইমরান।

আফিয়া বললো, তোমার চিঠি বুঝতে পেরে সেসময় আমিও এই চিঠিটা লিখেছিলাম। কিন্তু দেখো কী দুর্ভাগ্য আমার আজ দিলাম তোমার হাতে। 

‘তোমার মনে আছে কি না জানি না, আমাদের ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে শিক্ষাসফর থেকে ফেরার পথে আমি ইচ্ছে করেই তোমার পাশের সিটে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম, অনেক কথা বলবো, আর এই চিঠিটাও দেবো তোমায়। কিন্তু তুমি! সেই যে মাথা ঠেকিয়ে বসেছিলে, একবারও ফিরে তাকালে না আমার দিকে! 


ইমরান এবারও কথা বললো না। আফিয়ার চিঠির দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো শুনছিলো আর মনে মনে বলছিলো, আমার সব মনে আছে আফি। সেদিন তোমার পাশে বসেও কথা বলতে পারিনি। সে তো আমার অপারগতা ছিলো। 

‘আমার চিঠি পড়বে না? ইমরানের দিকে তাকিয়ে বললো আফিয়া। 


ইমরান হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে চিঠিটা খুলে দেখলো ছোটবেলার সেই ছোট্ট-ছোট্ট অক্ষরে লেখা-

‘ইমরান আরেকটু স্পষ্ট করে তো লেখতে পারতে।

‘এমন চিঠি লিখে কী লাভ বলো? যে চিঠি প্রাপক পড়তেই পারে না।

‘তবে আমি বুঝেছি চিঠিতে তুমি কী লিখেছো।

‘আমি চাই তুমি চিঠিতে যা লিখেছো তা আমার সামনা-সামনি বলো।

ইতি, আফিয়া।


ইমরান চিঠিটা পড়ে মুচকি হেসে তাকালো আফিয়ার দিকে। 

আফিয়া বললো, আমার চিঠির কথা তো তুমি বোঝলে। এবার আমায় বুুঝিয়ে দাও তোমার লসই চিঠির ভাষা, যা আজও আমি বোঝিনি। বুঝবো কিভাবে বলো, তোমার চিঠির অনুবাদ যে আমি করতে পারিনি। 

এবার দুজন একসঙ্গেই হেসে উঠলো। ইমরান হেসে হেসে বললো, আমার চিঠির অনুবাদ আমিই করছি। শোনো তুমি। ইমরান এবার তার ক্লাস নাইনের সেই চিঠি পড়তে শুরু করলো... 


‘আফিয়া আমি তোমাকে’ এতোটু পড়ে ইমরান থেমে গেলো। কি হলো! থামলে কেনো? পড়ো! উৎকর্ণ হয়ে উঠলো আফিয়া। ইমরান আবার পড়তে লাগলো...

‘আফিয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি। 

অনেক ভালোবাসি। কিন্তু তোমাকে বলার সাহস পাচ্ছি না। যদি তুমি তোমার বাবাকে বলে দাও। প্লিজ বলো না। 


ইতি, ইমরান।


ইমরান চিঠি শেষ করে লজ্জায় লাল হয়ে নিচে তাকিয়ে রইলো। তার বুক আমার ধুক ধুক ডাকছে। শরীর নামক ইঞ্জনটা রীতিমত ঘামতে শুরু করলো। এমন সময় আফিয়া ইমরানের হাতটা চেপে ধরলো। ইমরান কেঁপে উঠলো। তাকালো আফিয়ার দিকে। আফিয়া বললো-

‘হাতটা ধরি! 

কিছু বলি,

চলো না


বাকিটা পথ একসাথে চলি!


ইমরানও আফিয়ার হাত চেপে ধরলো। দুজনে হাতে রেখে হাত একসঙ্গে পা বাড়ালো।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট