পদাবলি - ২

 




ঔদ্ধত্য আমার ক্ষমা করুন 

জাফর ওবায়েদ


শৈশবের সেই শ্লেট-পেন্সিলের উদ্দাম সময় জীবনস্রোতে ভেসে গেছে 

এখন আমি আর অ আ ক খ লিখতে পারি না, কৈশোরের সেই স্বপ্নপুরুষ ম্যাকগাইভার মলাটের নোটবুকও কালপেটে লীন 

এখন আর মিষ্টি করে পদ্য লিখি না যে আমার প্রেমিকা মুগ্ধ হবে! 


আজকাল আমি চোখের কালিতে দুঃখ লিখি 

ধমনির লালস্রোতে চিরায়ত বেদনার বহ্নি লিখি 

কষ্টের কুসুমে দীর্ঘশ্বাস লিখি, হতাশার ঝড় লিখি উদ্ধত প্রাণের পতাকায় স্বেচ্ছামৃত্যুর সুনামি লিখি দারিদ্রের অক্ষরে ক্ষুধা লিখি- ক্ষুধার আগুন লিখি অশান্ত মনের যন্ত্রণায় তৃষ্ণা লিখি- তৃষ্ণার তাঁতানো হাওয়া আঁকি 

আগুনের আস্ফালনে বেইলি রোড লিখি, চুড়িহাট্টা লিখি 

রুদ্ধদ্বার গৃহের হাওয়ায় কাঁচা ধর্মান্ধতা লিখি ধর্মান্ধতায় আত্মীকৃত কলমে নাসির নগর লিখি বাণিজ্যের বহুমুখী আদরপোষ্য রাষ্ট্রের রাহুগ্রাসী থাবা লিখি 


নিসর্গের গোমটা খোলে আমি আর বাসররাতের মৌনতা উদযাপন করি না 

সবুজ সোহাগি বৃক্ষের থুতনি ছুঁয়ে ললাটে কোমল চুম্বন আঁকি না 

এখন আমি বাধভাঙা ভাষার ঠোঁটে অঙ্কুরিত যৌবন লিখি 

প্রেমিকের নির্লজ্জ তুলিতে ভুল বানানে প্রতিবাদ লিখি- প্রতিবাদের ভাষা শিখি 

তিতুমীরের আস্তিন গুটানো হাতে সংগ্রাম লিখি- সংগ্রামের মানচিত্র আঁকি 

মানুষের মন্ত্রে যুদ্ধ লিখি- ইউক্রেন ও ফিলিস্তিন লিখি, রেকি করি 

ক্ষোভের দহনে বন্দুক বুলেট বোমা ক্ষেপনাস্ত্র ও মারোনাস্ত্র লিখি 


এই অনাকাক্সিক্ষত ঔদ্ধত্য আমার ক্ষমা করুন 

ক্ষমা করুন প্রিয় রাষ্ট্রনায়ক নেতানিয়াহু, বাইডেন, পুতিন



প্রেমিকার চোখের মত

খালিদ নিশাচর


কাঁশফুলের দিন। নীলাকাশের কোল ছুঁয়ে শুভ্র মেঘ শিশুদের হুটোপুটি। সোনারাঙ্গা রোদ লেপ্টে থাকে অবণীর মেঠো পথে। মৃদু সমীরণ হিল্লোল তোলে বাঁশঝাড়ে। বৃষ্টিভেজা লেবু গাছের ডালে একটি বুলবুলি। জীবনানন্দের কবিতার ন্যায়, এর সবটা জুড়ে আমি কিংবা কোথাও আমি নেই।


আমি হাজার বছর ধরে হেটে যেতে চাই পৃথিবীর পথ ধরে। প্রজাপতির ডানায় ঝুলে থাকে শৈশবের উচ্ছল দিন। জীবন সে তো ঝরে যাওয়া হলদে পাতা। দিনশেষে মাটির ছেলে মাটিতে মিশে যাওয়া। আকাশি রঙ্গের বুনোফুল ফুটে থাকে সেখানে।


কান্ত দিঘির জ্বলে ভাসে ঝিরি ঝিরি হাওয়ার আঁচল। একটি শিশু ভোর শুয়ে থাকে ভাঁটফুলের গায়। মন ভাল করে দেয়া ভাট ফুলের গন্ধে আমি এক কোটি বছর বাঁচতে চাই। পৃথিবী এত মায়াভরা কেন, প্রেমিকার চোখের মত?

দুপুরের রোদে ছেঁচি শাকের জঙ্গলায় ভাসা সাদা হাস, একটি ভীত হরিণ শাবক আর ফুটপাতে শুয়ে থাকা একটি ক্ষুধার্ত কুকুর আমার অপেক্ষায়। আমাকে যেতে হবে সেখানে। আজ একটি গোলাপ ফুটবে শুধু আমারই জন্য।


শিশিরভেজা ক্ষেতের আইলে কৃষকের পায়ের ছাপ জীবনের গল্প আঁকে। পৃথিবীর পাঠশালায় মক্তবের শিশু আমি। জীবনের খেলাঘরে জীবনের পাঠক।

জানি, বেলাটুকু পোহালেই রাতে দেয়াল। কালশিটে  দেয়াল জুড়ে মানবতার পরছায়া। বুকচেরা দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় পৃথিবীর অক্সিজেন। মিটিমিটি জলতে থাকা এক আকাশ তারা যেন অন্ধকারের ক্যানভাসে আশার প্রদীপ।



তুখোড় ইচ্ছে বাড়ে

নীহার মোশারফ


তুমি কবি হলে, আমি বিকেল হবো

ছন্দে ছন্দে দোলাব কাব্যের শরীর।

     গৌরবান্বিত সময় শুভ্র খাতায় আসন নিলে

আমি পড়ব পুশকিনের অমর গল্পখানি

ধ্রুপদী বইয়ের পাতায় ছড়ানো যে বাণী

             সেখানে আপাদমস্তক কবিতা তুমি

কেউ কেউ তোমাকে ভাউড়া বলে

              তাতে কী?

আমার এই কথা যদি মনে ধরে তোমার

বুকের কপাটে রেখো আমার নাম ঝুলিয়ে

তোমার যে হৃদে আমাকে পাবার ইচ্ছে প্রবল

জানি, সে হৃদে স্বপ্ন হাজার দুলে দুলে ওঠে।

তুমি কবি হলেÑ

          আমি হবো পূর্ণিমার চাঁদ

আষাঢ়ের ঢলে দলেমুচড়ে ওঠলে রূপ

সেখানে চাষের লাঙ্গল উর্বর জমিন খোঁজে

সহ্যে আগ্রহ বাড়ে, আরো সহ্যে

                            তুখোড় ইচ্ছে হয়

জড়িয়ে রাখতে আমায় সুখের চাদরে।

তুমি কবি হলেÑ

         আমি তার ধ্যানস্থ রাত

বর্ণিল অনুরাগে, আদরে- সোহাগে

        বৃষ্টিতে ঠোঁট আমার নেচে নেচে ওঠে।



ছাতার কঙ্কাল 

ছাদেকুর রহমান


ঘরের কোণে অথবা বেড়ায় যে ছাতাটি ঝুলছে 

ওটা রোদ কিম্বা বৃষ্টিতে খুব কাজে আসে। 

প্রচ- শীতের দিনেও

ওটাকেই আশ্রয় করে সংসার পাতে একঝাঁক তেলাপোকা।

কখনোবা এপিঠ-ওপিঠ জাল বুনে

মাকড়সারাও তৈরি করে ফেলে চমৎকার ফাঁদ।


এভাবে রোদে পুড়তে পুড়তে কিম্বা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে

কখনোবা প্রচ- ঝড়ের দখল বইতে বইতে

তছনছ হয়ে নিঃশেষে উবে যায় ছাউনির কাপড়।


তারপর বছর ঘুরে

খাঁ খাঁ দুপুর বেয়ে আবার ঝড় ওঠে, বৃষ্টি নামে 

আবার হৈচৈ ফেলে নেচে উঠে শেওলা পড়া উঠোন।

বাইরে যাবার তাড়া নিয়ে 

আবার চোখ যায় বেড়ার দিকে 

ওখানে তখনও ধুলো ঝুল মাখামাখি করে

বাঁশের ফালিতে ঝুলতেই থাকে, ঝুলতেই থাকে... 

জং ধরা মরচে পড়া নিঃসঙ্গ এক ছাতার কঙ্কাল!



এই ঝড় ফুরোয় না আর

সাইফুল্লাহ ইবনে ইব্রাহিম 


থেকে থেকে মনে পড়ে যে নাম

সে স্বপ্ন; ভেঙে গেছে

আচমকা এক ডাক এসে আমায় নিয়ে ফিরেছে বাস্তবতায়

এরপর গত হয়ে গেছে বহুকাল 

বহু ঝড় বয়ে গেছে পৃথিবীর দুই প্রান্তে

এই ঝড় থেকে থেকে জেগে উঠে 

এই ঝড় ফুরোয় না আর!

কিছু ঝড় এভাবেই আমৃত্যু বয়ে যায়। 


আর থেকে থেকে আমার হৃদয় আঙিনায় ঘুরে বেড়ায় যে ছায়া 

থেকে থেকে কল্পনার মানসপটে ভেসে উঠে যে ছবি

সে শুধু তুমি!



বাঁচো

হেলাল সালাহ উদ্দীন


আনন্দ অনিবার বিপুল আলোড়নে বাঁচো,

প্রবল অপ্রতিরোধ্য শিহরণ ছড়িয়ে দাও;

দ্বিধার চৌকাঠ পেরিয়ে তেপান্তরের মাঠে খোলা হাওয়ায় এসে দাঁড়াও-

শির থেকে খোলো শিরস্ত্রাণ,

শরীরের ভাজে ভাজে যত জ্যামিতিক বিন্যাস-

সরল জলের মতো নিটোল করো।

বাঁচো জ্যোৎস্নাঝরা রাত্রির মতো,

ঘোর অমানিশার সৌন্দর্য বিভা নিয়ে-

ঋতুচক্রের গতিপথে অভেদ ব্যঞ্জনায়,

কবোষ্ণ মাঘের শিরশিরে হাওয়ায় উড়ে উড়ে।

প্রতœতত্ত্ব ও ইতিহাসের পোশাক খুলে,

পুরাণ আর শাস্ত্রের গোধূলি মায়া ভুলে,

তন্ত্র, মতবাদের স্থুলজ বাণিজ্য জাহাজ থেকে নেমে এসো-

মায়াভরা সবুজের কোলাহলে,

লোকালয়ে মানুষ ও প্রাণীর হৃদয়ের কাছে,

ভালোবাসার অরণ্যে দীপ্য ঔজ্জ্বল্যে,

নির্ভার জীবনের ঢেউ তুলে নাও ঠোঁটে।

বাঁচো পর্বতের মতো সুউচ্চ সম্ভাবনায়,

বসন্তের উদাস বাতাসের মতো চঞ্চলতায়,

দূর নক্ষত্রের মতো আলো ঢালো আলোকবর্ষ পরিক্রমায়।

বাঁচো অভ্রভেদী ঔদ্ধত্যে,

একজীবনের সব ব্যবধান ভাঙো কোমল হাতে,

গহন অনলে জ্বলে জ্বলে খুঁজে দেখো-

ভষ্মের আধারে কতটুকু নিরেট তুমি।

বাঁচো উল্লাসে,

কলহাস্যে,

শ্রাবণের বর্ষার মতো ঝরুক সবটুকু বেদনা আনন্দের ফোয়ারা হয়ে।

বাঁচো বর্ষীয়ান বৃক্ষের মতো ফলবতী,

পথের মতো অনিঃশেষ,

প্রেমিকের মতো সর্বহারা স্বার্থহীন।

বাঁচো মানুষের মতো স্পর্ধিত মর্যাদায়,

খর¯্রােত স্রোতস্বিনী হও নৃত্যে নৃত্যে-

তুমি অবিনশ্বর!

কেবল মানুষ হও।



রায়েরবাগে এক রাত

বশির আহমেদ 


এলোমেলো চিলেকোঠায় পোড়া সিগারেটের 

ভস্ম গুলো মাঝে মাঝে উড়ে যায় স্তনের মতো 

ঝুলে থাকা ছাদ বাগানের থোকা থোকা ফুলে। 

একটি কাব্যিক রাত হুসকির বোতলে কবিতা বিলাস

আসন্ন ভোরে যাওয়ার তাড়া।

ঘুম ঘুম চোখে জেগে উঠে কবিতার বরপুত্র!

একটি কলঙ্কিত রাত অগ্নিঝরা ভাষনে বুকের রক্ত দিয়ে লেখেছে অজস্র কবিতা।

অতঃপর কবি একদিন চলে গেল, শিথানে 

অজস্র কবিতার বই।



দেওয়ালের দেউরি

অনন্ত পৃথ্বীরাজ


দেওয়ালের দেউরিতে কান পেতে শুনি চড়ির নিক্কণ;

সাপের হিস হিস কানের মধ্যে শোঁ শোঁ করে বাজে।

হে পৃথিবী; তুমি আমাদের অন্ধ-বধির করে রাখো

কৃষ্ণলীলা আমাদের নয়-

প্রত্যহ ক্ষেত খামারে চলে পেটের তেলাওয়াত।



ফেরারী

শরীফ নাফে আচ্ছাবের


মান অভিমান গায়ে 

অভিরাম ছুটাছুটি করি

ভবঘুরে 

কানুনের তোয়াক্কা করিনি কশ্যিন কালেও

মন্দ লোক, মাপ চাই-

সামাজিকতার।

বহুদূরে, আজ আমি দাড়িয়ে 

সরিয়ে নিয়েছি নিজেকে

কাঁটাতারের বেড়া দূরত্বে-

এতটাই ফারাক

অথচ- একটাই রাত, চন্দ্র, সূর্য 

এখানেও ঘুঘুর ডাকে ঘুম ভাঙ্গে

আশ্চর্য! 

ভাসামান ভাষাভাষী মানুষগুলো 

গল্প ফাঁদে আমায় নিয়ে 

আমি নাকি ফেরারী। 



ছিন্নমূল হৃদয় 

রেজা কারিম 


তোমাকে পেতে যত পথ দিয়েছি পাড়ি

তোমার দোষ কী আর দেবো

সে পথেরাই গিয়েছে ছাড়ি।  


পথেরাও নারী

ভালোবেসে কেটে নেয়

পথিকের নাড়ী।


জানি না কখন হারিয়েছি মন

জখম হৃদয়ে আজ নেই আলোড়ন।





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট