হৃদকম্পন

 


হৃদকম্পন 

হাসান মাহাদি 


‘বুঝলে মুহিব, মানুষ এখনো শিক্ষিত হতে পারেনি। সব মূর্খ আর ভ-ের দল।’  অন দ্যা রক হুউস্কির গ্লাসটাতে চুমুক দিতে দিতে কথাটা বললেন মুহিবের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মইনুল ইসলাম বাবলু স্যার।

গবেষণায় মুহিবের আগ্রহ আছে দেখে স্যার মাঝে মাঝে কিছু কাজ দেন। সে কাজের মধ্য দিয়ে শেখার চেষ্টা করে। আর স্যারের মতো একজন অভিজ্ঞ গবেষকের সান্নিধ্য পেলে তো আর কথাই নেই। মাঝে মধ্যে টুকটাক কাজ করে দেয় সে।। সেই সুবাদে স্যার মুহিবকে মোটামুটি স্নেহ এবং বিশ্বাস দুটোই করেন। এখন সে স্যারের বাসায় আছে। স্যারের ব্যক্তিগত রিডিং রুমের সোফায় বসে ল্যাপটপে ডাটা এন্ট্রির কাজ করতেছে। রাত মোটামুটি সাড়ে নয়টা। স্যার বিপরীত পাশে বসে পেগ বানাচ্ছেন। স্যার কখনো মুহিবকে অফার করেননি। স্যার জানেন সে ধূপমান পর্যন্ত করে না। তবে স্যার তার সাথে মোটামুটি খোলামেলা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেন।

স্যারের কথা শুনে কিবোর্ড থেকে হাত নামিয়ে স্যারকে বিনয়ের জিজ্ঞেস করে মুহিব, ‘স্যার, হঠাৎ এ কথার উদ্দেশ্য কি?’ 

স্যারের একহাতে মদের গ্লাস আরেক হাতে স্মার্ট ফোন। ফোনের দিকে তাকিয়েই বলতে লাগলেন, ‘আরে একটু আগে যে ভূমিকম্প হলো সেটা নাকি কোন আল্লাহওয়ালার দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নেওয়ার জন্য হয়েছে। ভূমি নাকি সেই শোক সহ্য করতে পারে নাই।’ বলেই স্যারের অট্টহাসি। ‘হোয়াট এ ইলিটারেরট নেশন! দ্যা রিলিজিয়াস ফুলস!’ 

মুহিব কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি বাদ দিয়ে আপাতত স্যারের দেয়া ডাটা গুলো মাথায় এন্ট্রি করছে। সন্ধ্যা থেকে অফলাইনে থাকায় অনলাইনে কি ঘটছে তা সে টের পাচ্ছে না। শুধু মাঝখানে কয়েক সেকেন্ডের ভূমিকম্পটি টের পেয়েছিল সে। স্যার বলতে লাগলেন, ‘আরে কুরআন হাদিস তো আমিও মাঝে মাঝে পড়ি। ঐ যে দেখো! দেখতে পাচ্ছো? সহীহ আল বুখারি। পাশেই দেখো কুরআনের তাফসীর।’ বলেই একটা তাকের দিকে মদের গ্লাস সমেত হাতটি দিয়ে মুহিবকে তাকাতে নির্দেশনা দিলেন। মুহিব দেখল। সহীহ বুখারীর কয়কটি খন্ড দেখা যাচ্ছে সাথে তাফসীরে মাআরেফুল কুরআনের একটি খন্ড। স্যার বললেন,”আমার থেকে হাদিস শুনো। আমি পড়েছি যে, ভূমিকম্প সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কতা হিসেবে নাজিল হয়। কারো শোকের জন্য না। সরাসরি নবী মুহাম্মদের মুখ থেকে বলা কথা। হোয়াট এ ফ্যানাটিক্যাল নেশন!’ এবার কটাক্ষপূর্ণ হাসি। 

ফ্যানাটিক্যাল মানে যে ধর্মান্ধ মুহিব সেটা জানে। স্যারের দিকে তাকিয়ে স্যার কে সে বলল, “স্যার, মানুষ আসলেই ধর্মান্ধ এবং সাথে সাথে অসতর্কও। ভূমিকম্প হওয়ার পরেও তাদের অন্ধত্ব ঘুচলোনা।“

স্যার নেশার ঘোরে নিজের মদের গ্লাসের দিকে একবার এবং মুহিবের দিকে একবার গম্ভীর ভাবে তাকালেন। হাসতে হাসতে বললেন, “ইউ আর এ হিউমরিস্ট এন্ড ইন্ঠেলিজেন্ট ওয়ান। আই লাইক ইট।“ 

আরেক প্যাগ বানাতে বানাতে স্যার বলতে লাগলেন, যা-ই বলো মুহিব, বাংলাদেশের বেশির ভাগ পাবলিক আবেগী এবং ধর্মান্ধ। এই ধর্মান্ধরা প্রগতি এবং উন্নতির অন্তরায়।

মুহিব কিবোর্ডের উপর হাত রেখে মদ্যপানরত শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে, স্যার  আমার মনে মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন জাগে ।

গ্লাসে চুমুক দিতে স্যার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ছাত্রের দিকে তাকায়।

মুহিব বলে, বাংলাদেশ একটা ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি। যেহেতু সাংবিধানিক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটে সরকার গঠন হওয়ার কথা সেহেতু স্যার, যদি কোনোদিন এ দেশের বেশির ভাগ ধর্মান্ধ এক হয়ে একটি সরকার গঠন করে বসে তখন কি হবে?

মদের গ্লাস হাতে সোফায় হেলান দিয়ে স্যারের চাপা অট্টহাসি। 

“জানো মুহিব, ডিপার্টমেন্টের কিছু কিছু টিচার তোমাকে কেনো দেখতে পারেনা?”

“কেনো স্যার?”

“তুমি বড্ড খোঁচা দিয়ে প্রশ্ন করো। তোমার প্রশ্নগুলো দিলের ঠিক স্পর্শকাতর জায়গায় লাগে। তোমাকে ঠিক একই কারণে আমার ভালো লাগে। দেখনা, তোমার প্রশ্ন শুনে আমার অন দা রক হুইস্কির পিনিকটাই কেটে গেছে। ক্লাশে থাকলে একটু মাইন্ড করতাম  কিন্তু এখন করছি না। তুমি ট্যাকনিক্যালি একটু ত্যাড়া বাট এই লাইক ইউ।“ 

মুহিব কাজের ফাঁকেই স্যারের দিকে তাকিয়ে একটা লাজুক মুচকি হাসি দেয়।  “ কি যে বলেন স্যার!”

“বাই দা ওয়ে, মজার ব্যাপার কি জানো মুহিব? এই ধর্মান্ধরা আবার পুরোপুরি ধর্মান্ধ না। কেউ কেউ তাহাজ্জুদের মুরগী চোর।“

আবারো স্যারের হাসি।

মুহিবও হাসে। একটা শব্দহীন বুদ্ধিবৃত্তিক হাসি।  অনেকেই তার এই ধরনের হাসিকে কটিল হাসি বলে বিশেষায়িত করে। তাহাজ্জুদের মুরগী চোরের ভাবার্থ কি গুরু-শিষ্য দুজনেই জানেন।


মুহিব স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনে এসে রেললাইন হয়ে হাঁটতে থাকল। পনেরো মিনিট হাঁটলেই তার বাসা। হৃদয় আন্দোলিত হচ্ছে। রেললাইনের অমসৃণ পথে মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে চিন্তারত পথিক। তার সেদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ বাবলু স্যারের সাথে কথোপকথনের একটি দৃশ্য মনে পড়ল মুহিবের। মদের গ্লাস হাতে নিয়ে ভূমিকম্প ও সতর্কতা বিষয়ক হাদিসটি। “ভূমিকম্প সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কতা হিসেবে নাজিল হয়।“ মুহিব অতটা প্র্যাকটিসিং মুসলিম নয়। তবুও তার মনে কেনো যেন সূরা আসরের আয়াতগুলো স্মরণ হলো। 

“কসম সময়ের। নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ। তবে তারা ছাড়া, যারা সৎকাজ করেছে এবং পরস্পরকে সত্য ও সবরের উপদেশ দিয়েছে।“ 


মুহিব বাসায় গিয়ে তার ডাইরিতে লিখছে,

“আমি পাথুরে পথে হাঁটছি আর ভাবছি, মানুষ আসলে পুরোটাই অন্ধ। শেষ ট্রেন আসার হুইসেল পেলাম। সতর্ক হলাম এবং লাইন থেকে নেমে পরলাম। ভাবলাম, প্রতিনিয়তই আমাদের সামনে দিয়ে কত শেষ ট্রেনের যাত্রী প্রস্থান করতেছে। আমরা কি সতর্ক হচ্ছি? যাত্রীতো আমিও। আবারো মনে হলো, অন্ধত্ব আমাদের চেপে ধরেছে খুব ভালো করেই। আমার হৃদপিন্ড প্রকম্পিত হচ্ছে। এই কম্পন কি কোনো স্কেলে মাপা যায়! এ কম্পন ডাক্তারের ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাফফিতে মাপা যাবে না কিংবা কোনো রিখটার স্কেলে।“


হাসান মাহাদি 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।







শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট