রাঙাশাড়ি


 

রাঙাশাড়ি

ইয়াসিন আহসান


দেড়মাস হল রফিক মিয়া বিয়ে করেছে। তার ঘরওয়ালীর নাম আমেনা। এরই মধ্যে আমেনাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে রফিক। আর আমেনা? 

স্বামীই যেন তার দুনিয়া। তার ধ্যান জ্ঞান সবকিছুই স্বামীকে ঘিরে। রফিক পেশায় একজন রিকশাচালক। এ নিয়ে আমেনার তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। তার স্বামী যে হালালভাবে রোজগার করে তার মুখে দুটো ডালভাত তুলে দেয়- এতেই আমেনা খুশি। তার স্বামীর অকৃত্রিম ভালোবাসাটাই তার কাছে মুখ্য। তবে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার পর রফিক মিয়া যখন ঘরে ফেরে তখন তার শ্রমক্লান্ত দেহ দেখে আমেনার খুব কষ্ট হয়। ব্যাথা ও পরম মায়া মিশ্রিত গায় সে রফিককে বলে- আপনারে কাইলকা থিকা আর যাইবার দিমু না। আপনে অন্য কিছু করবেন। রোজ রোজ আপনার এই কষ্ট আমি দেখবার পারুম না। বউয়ের এ কথা শুনে রফিক মনে মনে যেন বড্ড পুলক অনুভব করে। তার মন চায় আমেনার এই কথাগুলো শুনবার জন্য হলেও আরও অনেক বছর তাকে রিকশা চালিয়ে যেতে হবে। এ কথাগুলোর প্রতিটি হরফে হরফে কি যে এক অপার ভালোবাসা ও মায়া-মমতা লুকিয়ে আছে যার জন্য রফিকের বার বার এই কথাগুলো শুনতে মন চায়। নিমিষেই যেন তার সব ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়। কাছের মানুষের শাসনের মাঝেও যে একধরণের অস্পৃশ্য সুখ লুক্কায়িত থাকে। সেই সুখে ছোঁয়া পাবার আশায় মানুষ অনেক সময় ইচ্ছাকৃত ভাবেই অনেক ভুল করে। রফিকের অবস্থাটাও ঠিক এমনই। আমেনার কথার জবাবে রফিক তাই মুচকি হেসে বলে- কি যে কও বউ! রিকশা না চালাইলে আমাদের সংসার চলব কেমনে? আল্লাহ’য় তো এই রিকশা বদৌলতেই আমাদের রুটিরুজির ব্যবস্থা করছেন। আমেনা অভিমানী সুরে বলে- হইছে বুচ্ছি আপনি আমার কথা শুনবেন না। এখন হাত মুখ ধুইয়া আসেন দেখি আমি গরম ভাত বাইরা দিতাছি।

রফিক তৃপ্তি নিয়ে তার বউয়ের হাতের রান্না খায়। আর আমেনা তাল পাখা নেড়ে নেড়ে তাকে বাতাস করে। মাঝে মাঝে রফিক অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আমেনার দিকে। আমেনা বলে- অমন কইরা কি দেহেন? 

-তোমারে দেহি বউ, তোমারে দেহি। আল্লাহ তোমারে কি পরীর লাহান একখান মুখ দিছে।

স্বামীর ভূয়সী প্রশংসা শুনে আমেনা যেন কলাপাতার মতো কেপে ওঠে। লজ্জায় মুখ ঢাকে কাপড়ের আচল দিয়ে।

ওমনি রফিকের চোখে পড়ে আমেনার শাড়িটা বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। দু এক জায়গায় ছেঁড়া ফারাও দেখা যাচ্ছে।

রফিকের মুখটা কালো হয়ে যায়। আচমকা সে বলে ওঠে- ও কি বউ, তোমার শাড়িটা যে বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। আমারে কবা না তুমি, তোমারে একটা শাড়ি কিনা আইনা দিতাম? 

আমেনা শাড়ির ছেঁড়া অংশটুকু লুকানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলে- ও কিছু না। আপনি খান তো আমার এখন শাড়ি লাগবো না। আপনার লুঙ্গিডাও তো অনেক পুরান হয়ে গেছে আপনি বরং একটা লুঙ্গি কিনেন। আমি তো সারাদিন ঘরেই থাকি আমার শাড়ি আর কেডা দেখব। আপনি বাইরে খাটেন। দশজন মানুষের সাথে চলাফেরা করেন আপনার একটা লুঙ্গি কেনা পয়োজন।


-আমি ওত কথা শুনবার চাই না বউ তোমার এইবার ঈদে কেরাম শাড়ি চাই সেইডা আগে কও। নইলে আমি এই যে খাওয়া থুয়ে উঠলাম।


-আরে আরে খাওয়া থুয়ে কেউ উঠে। বসেন বসেন। আপনার যখন এত ইচ্ছা তহন আমার জন্যি একটা রাঙা শাড়ি আইনেন। কিন্তু আপনিও কিন্তু একটা লুঙ্গী কিনবেন।


তপ্ত দুপুর।  রাস্তায় তেমন লোকজন দেখা যাচ্ছে না। শুধু আকাশে  দু একটা কাক এলোমেলো ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে। দিনের এই সময়টাতে খুব ঠেকায় না পড়লে কেউ বের হতে চায় না। রিকশাওয়ালারাও এ সময়টাকে একটু বিশ্রামের জন্য বেছে নেয়। সুবিধামত কোনো এক জায়গায় রিকশা দাঁড় করিয়ে রিকশার হুড তুলে ভীতরে বসে থাকে। কেউ বা ঘুমায় আবার কেউ মনের সুখে চুরট টানে। রফিকও একইরকম ভাবে বসে আছে।


কিছুক্ষণ আগেই সে তার এ মাসের জমানো টাকার বড় একটা অংশ খরচ করে আমেনার জন্য লাল টকটকে একটা শাড়ি কিনেছে। নিজের জন্য অবশ্য কেনা হয়নি কিছুই। এত টাকা কই তার? তাছাড়া আমেনার খুশিতেই তার খুশি। আমেনার সুখেই তার সুখ। 


আচ্ছা আমেনাকে যখন এই শাড়িটা সে দেবে তখন আমেনা কেমন করে উঠবে? তার মুখের ভাষ্যটাই বা কি হবে? নিশ্চয়ই সে প্রথমে বলবে- ও আল্লাহ এতো দেহি অনেক দামী শাড়ি। কি সুন্দর লাল রঙ! কি সুন্দর পাইরের কাজ! 


আর আমেনা যখন বলবে- আপনার জন্য কি কিনছেন? 

তখন পাগলি বউটাকে কি বলে বুঝ দিবে সে?

আচ্ছা আমেনা যখন শাড়িটা পড়বে তখন তাকে দেখতে কেমন লাগবে? সে কি শাড়ি পড়ে আমার সামনে দাঁড়াতে খুব লজ্জাবোধ করবে? 

নিশ্চয়ই তাকে নতুন বউয়ের থেকে কোনাংশে কম সুন্দর লাগবে না।

ক্রমাগত ভাবে কেবল এসব কথাই রফিকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। হঠাৎ তার মনে হল রাস্তার ওপার থেকে কে যেন তাকে জোর গলায় ডাকছে- ও খালি!   

-আজমপুর যাইবা?

- হ যামু।

- এইপারে আসো।

রফিক রিক্সার সিটের নিচে তার স্ত্রীর জন্য কেনা রাঙা শাড়িটা রেখে প্যাডেলে চালাতে শুরু করল।

তখনও যেন সে আমেনাকে নিয়ে দেখা মধুর স্বপ্নের জগৎ থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি। কি এক আবেশে ডুবে আছে। এবং প্রতিনিয়ত অথৈ জলের মত সে চিন্তার মাঝে ডুবে যেতে চাইছে তার মন।


ওদিকে বিকট হর্ণ বাজিয়ে ধেয়ে আসছে এক বিশালাকার মালবাহী ট্রাক। রফিকের সেদিকে যেন কোনো খেয়ালই নেই। খুব খুশি কিংবা বেশ বেদনার সময় মানুষের অনেক ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দেয়। রফিকের বেলায়ও তাই হলো। সে যেন কিছুই শুনছে না। কিছুই দেখছে না। মুহুর্তের মধ্যেই ভয়াবহ এক সংঘর্ষ হল।


ট্রাকের ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে গেল রফিকের রিক্সাটা।

খেলনা পুতুলের মতো শুন্যে ভেসে ঘটনাস্থল থেকে কয়েক গজ দূরে আছড়ে পড়ল রফিকের দেহ।


পিপীলিকার মতো চারিদিক থেকে ছুটে এলো মানুষ। করুণ দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে আছে রফিকের দিকে। তার শরীরে আঘাত পাবার কোনো চিহ্ন নেই।শুধু মুখ দিয়ে গলগল করে রক্তের অবিরত ধারা বইছে। সে রক্তের রঙ অবিকল  তার কেনা রাঙা শাড়িটির মতোই লাল....!


শিক্ষার্থী, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ 







শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট