একটি প্রাপ্তিময় সকাল
এস এম নূরনবী সােহাগ
সুন্দরী মেয়েদের মুখের কথা বেশীর ভাগ সময়েই শ্রুতিমধুর হয়। আর কথাগুলোতে যদি মাঝে মাঝে মিথ্যার প্রলেপ থাকে তবে তো শ্রুতিমধুর সাথে যুক্ত হয় কিছু নিষ্পাপ অঙ্গভঙ্গিও। যাকে বলে একের ভেতর দুই। নিজেকে এই মুহূর্তের ভাগ্যবান ব্যক্তি মনে হচ্ছে কেননা নিষ্পাপ অঙ্গভঙ্গি সমেত আমি নীলা আপুর শ্রুতিমধুর কথা শুনছি। আমি এখন বাস স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে আছি। আমার থেকে একটু দূরে নীলা আপু দাড়িয়ে। তিনি তার বান্ধবীর সাথে কথা বলছে যে কথাগুলো আমি অনেকটা স্পষ্টভাবেই শুনতে পাচ্ছি। তাদের কথা বলার প্রসঙ্গ বয়ফ্রেন্ড। নীলা আপু ভ্রু কুঁচকে বলছে ‘ছেলেদের আমার একদম বিশ্বাস হয়না। প্রেম ট্রেম আমায় দিয়ে হবে না’। নীলা আপুর কথাগুলো আমার কাছে মিথ্যে মনে হয়েছে কারণ নীলা আপুকে মাঝে মাঝেই একটা ছেলের সাথে রিক্সায় ঘুরতে দেখা যায়। আমার কাছে সম্পর্কটা প্রেম’ই মনে হয় আবার নাও হতে পারে। হয়তো কলোনির সবাই নীলা আপুকে ওরকম ভাবে কেউ খেয়াল করেনি যেরকম ভাবে আমি প্রতিনিয়ত খেয়াল করি। নীলা আপু যখনই আমার সামনে দিয়ে যায় আমি নিজের মধ্য একটা মৃদু স্পন্দন অনুভব করি। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমি বোধহয় ফেঁসে গেছি। কিন্তু নীলা আপু আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়। পড়েও বিশ্ববিদ্যালয়। এমনটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস এসে থামল। নীলা আপু ও তার বান্ধবী বাসে উঠলেন। আমি বাস চলে যাওয়া অবধি দাড়িয়ে রইলাম। পরে আমি বাসার দিকে হাঁটলাম। না, আমি কোথাও যাব বলে বাস স্ট্যান্ড আসিনি আমি নীলা আপুর পিছু পিছু এসেছিলাম। এরকমটা আমি প্রায়ই আসি। কেউ সন্দেহ না করে তাই কাঁধে একটা ব্যাগও ঝুলিয়ে রাখি। নীলা আপুর ফেসবুক আইডি নাম নীলা হক। তার প্রোফাইলে একটা প্রজাপতির ছবি দেয়া। ছবিটায় বাড়তি কোন বিশেষত্ব নেই তবুও ফেসবুকে ঢুকলে তার প্রোফাইল ছবিটা বার বার জুম করে দেখা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। নীলা আপু আমার ফেসবুক বন্ধু নয় কিন্তু আমি তাকে ফলোইং করে রেখেছি যাতে তিনি কোন স্ট্যাটাস আপডেট করলে আমি তা আমার টাইম লাইনে দেখতে পারি। রাতে পড়ার টেবিলে যখন বারবার ঝিমুনি চলে আসে তখন চোখের ঘুম তাড়াতে ফেসবুকে লগিং করি। এটাও একটা অভ্যাস তবে বাজে অভ্যাস। আজ ফেসবুকে ঢুকতেই নীলা আপুর নতুন স্ট্যাটাস আমার টাইম লাইনে এসে হাজির। তিনি লিখেছেন ‘বান্ধবীরা মিলে বান্দরবান যাচ্ছি। সাত দিন অন্তত ডুবে থাকবো প্রকৃতির মাঝে’। আমার ঘুমটা মুহূর্তের মধ্য হাওয়া। ক্ষুধার অনুভূতিটাও চলে গেল। যেটা বাড়ল সেটা হচ্ছে অস্থিরতা। এখন রাত এগারো’টা। সকাল হতে এখনো অনেক বাকী! দারুন রকম অস্থিরতায় আমি পায়চারী করতে পারি না। দুম করে এক জায়গায় বসে থাকি একদম গুটিসুটি মেরে। নীলা আপুর উপরে এই মুহূর্তে আমার খুব জেদ হচ্ছে। বান্দরবান কেন যেতে হবে? আর যাবে যাবে তাও সাতদিন! আমার এই রাগের কোন ভিত্তি নেই আমি জানি, তবুও নিজেকে দমাতে পারছিলাম না। বিশ্রী রকম রাগের কারণে আমার মাথায় চিনচিনে ব্যাথা শুরু হল। ঘড়ির অ্যালার্মে আমি ধড়ফড় করে উঠলাম। সকাল ছয়টা। আমি ঘুমের কোন আয়োজন ছাড়াই খাটের এক কোনায় অর্ধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পরেছিলাম। আমি বেশ তড়িগড়ি করে ফ্রেস হলাম। নীলা আপু সাধারণত সকাল সাতটা নাগাদ বাসা থেকে বের হয় তবে আজ একটু তাড়াতাড়িও বের হতে পারে। আমি সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বেড় হলাম। নীলা আপুর বাসা কলোনির একদম শেষ প্রান্তে, ওদিকটায় যাওয়া একদম বেমানান হবে। আমি বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। পরিপাটী বেশ ভূষায় নিজেকে আদর্শ ছেলে ভাবতে ইচ্ছে করছে আমার। আমি পায়ে বেশ গতি নিয়েই হাঁটছি। হঠাৎ একটি নারী কণ্ঠের আবির্ভাব-‘এই রাতুল’। আমি যেন হোঁচট খেলাম, কে ডাকল? ডামে বামে তাকালাম। পরক্ষণেই আবার- ‘রাতুল’। পিছনে ফিরে তাকাতেই নীলা আপুকে দেখলাম। নীলা আপুর সাথে আমি একা একা অনেক বলেছি অবচেতন মনে। কিন্তু সামনে দাড়িয়ে একবারও নয়। আমি ভুল দেখছি নাতো! না। শিশির ভেজা বাইরের আবহাওয়া মোটামুটি ঠা-া বলা চলে। কিন্তু শার্টের তলায় আমার শরীর বেয়ে ঘাম গড়ানো অনুভব করছি। নীলা আপু ততক্ষণে আমার সামনে চলে এসেছে।
‘কোথায় যাচ্ছো?’
আমি মুখে অনেকটা জড়তা রেখেই বললাম-‘এই তো মর্নিং ওয়াকে।’
‘এরকম বাবুয়ানা সাঁজে মর্নিং ওয়াক?’
‘না মানে প্রাইভেট আছে তো। ওখান থেকেই যাবো।’
‘ও তার মানে আজ বাস স্ট্যান্ড যাবে না?’
আমি তো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম-‘জ্বী?’
‘আমি তো তোমার কলেজ চিনি। কিন্তু তুমি রোজ উল্টো পথে বাস স্ট্যান্ড যাও কেন?’
‘না মানে আসলে...ওইযে...’
‘বেশী পেকে গেছ তাইতো! মাকে বলে দেই?’
‘না, না একদম না। আমি...আমি আর যাব না।’
‘রাতে ঘুম হয়েছে?’
‘হুম হয়েছে।’
‘কিন্তু তোমার চোখ মুখ তো তা বলছে না।’
‘না মানে...’
‘আমি বান্দরবান যাচ্ছি না।‘
‘এ্যাঁ?’
‘হুম।’
নোভেল প্রাইজ প্রাপ্তির সংবাদ শোনার মত একটি অবিশ্বাস্য আনন্দ আমার বুকে চিলিক দিয়ে গেল। নীলা আপু বললেন,‘চলো সামনে একটা টঙের দোকান আছে ভাল চা বানায়।’ আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তার সাথে হাঁটতে লাগলাম। আমার মনে হচ্ছে আজকের এই ঘটনাগুলোর সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। এটি একটি অন্যরকম স্বপ্ন। যে স্বপ্নের বাসিন্দা আমি আর নীলা আপু। যেই স্বপ্নটা এই মুহূর্তে আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউই দেখছে না।