নূরে জান্নাত
ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশার মাঝে অলৌকিক সব দৃশ্য ফুটে উঠছে। দক্ষিনের বাতাস মাটির সর্পিল পথে আচ্ছাদন করে রাখা সবুজ দুর্বার ডগাকে হালকা কাঁপিয়ে তুলছে। দুর্বা ডগায় লেগে থাকা শিশির বিন্দুগুলো হিরের মত ঝলক মেরে ওঠে মাঝে মাঝে। দেবদারুর পাকা কালচে বীজগুলো পাকপাখালির উপাদেয় খাদ্য হয়ে দাড়িয়েছে। সকালের সকাল টিফিন কেরিয়ার হাতে বেরিয়ে পরেছে গ্রাম থেকে শহরে কাজে যাওয়া মানুষ গুলো। আলমগীর নামের যুবকটিকে প্রতিদিন এ পথে দেখা যায়। মোড়গ ডাকা ভোরে দুই ফিতার স্যান্ডেল, কাধে গামছা রেখে চট চট শব্দ করে পায়ে হেটে এগিয়ে চলে উপার্জনের উদ্দেশ্যে। খুব বেশিদিন হয়নি আলমগীরের বিয়ের বয়স। কাজের ফাকে ফাকে বার বার তার স্ত্রীর সুখটা স্বরনে এবরো থেবরো মচকা দাতে হেসে নেয়। হালকা পাতলা কুচকুচে কালো তার স্ত্রীর গায়ের রঙ। নাকে ফুর ফুর করে নেচে বেরানো নথ, সাদা দাতের হাসি, চুলের গুমোট গন্ধ, গোপন সৌন্দর্য, স্ত্রীর নরম হাতের পর্শ আলমগীরের কর্মোদ্দাম বাড়িয়ে দেয়। স্ত্রীর ভালবাসা থাকায় তার কাছে কাঠ ফাটা রোদ্দুরেও ক্লান্তি আসে না। কাজ শেষে সন্ধ্যেয় বাড়ি ফেরার সময় ৮ টাকা দামের এমি ¯েœা, আতরের কৌটো, গন্ধরাজ তেল, সুগন্ধী সাবান মাঝে মাঝে তার হাতে দেখা যায়। আলমগীরের চাচাতো বোন ফুলীর জানার খুব ইচ্ছে আলমগীর তার স্ত্রীকে যে ভিউকার্ড গুলো এনে দেয় তাতে কি এমন আছে যা দেখে তার স্ত্রী ওভাবে হেসে ঢলে পরে? কি আছে ও ভিউকার্ডে?
ধীতপুর কানু গ্রামের সর্পিল মেঠো পথে শিশির সিক্ত দুর্বার চাদরে প্রায়ই পায়ের চিহ্ন দেখা যায়। আলমগীরের জানার ভীষণ ইচ্ছে চিহ্ন গুলো কার? একই রকম চিহ্ন একই ভঙ্গিতে পরে থাকে সবুজ মখমলে। কে হতে পারে এ পথে হেটে যাওয়া পদ চিহ্নের অধিকারী? কোন নারী, পুরুষ, নাকী ভূত? ভূতের তো পা থাকে না তবে কেমন করে পায়ের চিহ্ন আসবে?
ঠিক যে সময়ে কাজে যাবার কথা শুক্রবারে তার থেকে আরো সকাল করে বের হয় আলমগীর। পথে খুজতে থাকে পায়ের চিহ্ন। কেমন যেন ও চিহ্ন দেখতে দেখতে তার নেশাতে পরিণত হয়েছে। আলমগীর বিস্ময়ে পদ চিহ্নের পাশে পরে থাকা কটা শিউলী ফুল কুড়িয়ে গামছার গিটে রেখে দেয়। তবে কি কোন দেবী, লক্ষী নাকি পরীর পদ চিহ্ন?
রাতে আালমগীরের স্ত্রী ¯েœা মাখিয়ে, মোটা করে চোখে কাজল এঁকে, মাথায় চিপচিপে তেল দিয়ে প্লেন খোপা করে। কালো হাতে টকুটুকে লাল চুড়ি, খুব একটা মানায়নি, ঠোটে লাল লিপিস্টিকটার জন্য ভয়ংকর লাগছে। তবুও সে নির্দ্বিধায় স্বামীর সামনে এসে দাড়াতেই স্বামী তাকে বুকে টেনে নিয়ে-----
তুই আমার সব থেইকা সোন্দোর বউ।
আলমগীরের স্ত্রী লজ্জামাখা মুখে-
কি কন এগনাল? কালীমুত্তির মত দেহা যায়।
বউ তুই কি তুই নিজেও জানোস না। আমার চোখ খান খুইলা তোর চোহে নাগা, দেকপার পারবি তুই কত সোন্দর দেকতি। আর কালি মুত্তি হোলিও মুত্তি তো মুত্তিই। (মূলত আলমগীর এখানে প্রতিমা শব্দটির ব্যবহার বা প্রতিমার মূল্য বোঝাতে চেয়েছে)
টুকটাক কথপকথোন শেষে আলমগীর স্ত্রীকে বলে বসে-
দে তোর পাউ দে।
ক্যা?
দিবার কইতাছি, দে...।
দিমু না।
ছেরি বেশি বুজবিনা কইলাম, পাউদে.....?
অনেক সংকোচে আলমগীরের স্ত্রী পা বাড়ায়। আলমগীর আলতার কৌটোর মুখ খুলে নিজের হাতে স্ত্রীর পায়ে আলতা লাগানো শেষে গামছার গিট খুলে শুকিয়ে যাওয়া শিউলী ফুল গুলো পায়ের কাছে রেখে-
নে বউ, তোরে দেবির পায়ের ছাপের কাছে পাওয়া ফুল দিয়া পূজা দিলাম।
আলমগীরের স্ত্রী লজ্জায় মাখা মাখা হয়ে-
আমার ফুল লাইগবোনা, আহ্্নেই আমার সব থেইকা বড় ফুল।
স্বামী স্ত্রীর মাখা মাখা ভালবাসার নীরব স্বাক্ষী হয়ে থাকে রাতের অন্ধকার, আকাশের তারা, জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকা বেড়েওঠা কাঠাল চারা, মরচে পরা টিনের ফুটো দিয়ে হুমরি খেয়ে পরা চাঁদের আলো, ঝিরিঝিরি বাতাসে নরে ওঠা গাছের পাতা, জোনাকির নিভু নিভু আলো, গাছের ঝোপে বসে থাকা নিশাচর।
পরদিন সকালে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দকেও উপেক্ষা করে আলমগীরদের চাপ কলের শব্দ। কলের পারে আলমগীর ও তার স্ত্রীকে একেবারে বৃষ্টি ভেজা দুটো চড়ুইয়ের মত লাগছিল। স্বামীর প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে নিলে ঘারের উপর ঝুলে আসা ভেজা চুল থেকে টপ টপ করে কয়েক ফোটা পানি পরে।
কিিদন হলো দুর্বা ঘাসে পায়ের চিহ্ন না দেখতে পেয়ে আলমগীরের মনটা বিষন্নতা ঘিরে ফেলে। তার ভাবনা মূখর মুখটা দেখে স্ত্রী জিজ্ঞাসা করে-
কি অইছে? চুপ তাকেন ক্যা? কামের উহুনে কিছু অইছে?
আলমগীর দীর্ঘশ^াসে-
নারে, আমার মন বালা না।
ক্যা?
বেশি প্যাচর না হইরা গুমা গা যা।
গুমাইতাছি, তাইলে পেরতেক আইতের মতন আইজো আমারে সোনা বউ কইয়া ডাহেন?
আলমগীরের চোখে পায়ের চিহ্ন ভাসতে থাকে, দেঘল কালো এলোকেশী, পায়ে মল পরা আলতার রঙে ঝলকানী দিয়ে হেটে যাচ্ছে...........আস্তে আস্তে। আকাশ থেকে নেমে সিড়িতে পা রাখে, শাড়ীর আচল উড়ে ওঠে, মুখটা পুরো দেখা না গেলেও ডান চোখের পাশের তিল, আর নাকের ঝোলানো নথটা দেখা যায়। সিড়িটা শূন্যে মিলিয়ে যায়। আলমগীর দীর্ঘ শ^াস ফেলে বিছানায় খেয়াল করে দেখে এত তারাতাড়ি তার স্ত্রী ঘুমিয়ে পরেছে।
কাজে যাবার সময়ের অনেক আগেই টিফিন কেরিয়ার হাতে আনমনে পথ হাটছে আলমগীর। না দেখতে পেয়ে পেয়ে পায়ের চিহ্ন দেখার লোভটা খুব একটা নেই। ভুলেই গিয়েছে স্বর্গীয় দেবির কথা। পায়ের চিহ্ন!
আলমগীর চমকে ওঠে। বুকের মধ্যে কেমন যেন মোচর দিয়ে ব্যাথ্যা করে ওঠে। টিফিন কেরিয়ার মাটিতে রেখে পদ চিহ্নটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে নেয়। চিহ্নের রেশ ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। রাস্তার মাঝখানে গিয়ে পদ চিহ্নের কোনো হোদিস না পেয়ে আশে পাশে চোখ বুলাতে থাকে। মাটির রাস্তা থেকে একটু দুরে কাঠ বাগানের মধ্যে শিউলীফুল তলায় কেউ একজন ফুল কুড়াচ্ছে। তবে কি...?
আলমগীর আগ্রহে এগিয়ে যায়। উজ্জল শ্যাম বর্ণের লম্বাটে এলোকেশী হালকা পাতলা গড়নের চঞ্চল এক কিশোরী গভীর মনযোগে মেহেদী রাঙ্গা আঙ্গুল দিয়ে পরম যতেœ মাটি থেকে একটি একটি করে শিউলী ফুল কুড়িয়ে ওরনার কোচে রাখছে। ফুল কুড়ানো শেষে দাড়িয়ে ঘুরে উঠতেই ফুলওয়ালী আলমগীরকে সামনে দেখে চিৎকার করে কোচের সব ফুল ফেলে ছুটে পালিয়ে যায়। আলমগীরকে দেখে ফুলওয়ালী ভয় পাওয়ায় আলমগীরের ভেতরটা পুরতে থাকে। কাজে গিয়ে সেদিন সারাটা বেলা চোখে ফুলওয়ালীর ভয় পাওয়া মুখটা ভাসতে থাকে। কাজকর্ম কোন দিকে খেয়াল থাকে না। আচমকা হাতুরীর বাড়িতে বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। বাড়ি ফিরে ভীষণ ভাবে কোকাতে থাকে। রাত গভীর হয়, দুর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে, কুকুর গুলোর অহেতুক ঘেউ ঘেউ রাতের নিস্তবদ্ধতাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। জানালার ফাক দিয়ে আসা চাঁদের আলোতে আলমগীর ফুলওয়ালীকে দেখতে পায়। আস্তে আস্তে ফুল ওয়ালীর পোশাক বদলে যায়। দেবীর সাজে সজ্জিত হয়ে ডাকতে থাকে আলমগীর কে। আলমগীর জানালার পাশে গিয়ে দাড়াতেই এক পলকে আশে পাশের সব কিছু বদলে যায় শিউলী ফুলের বাগানে অসংখ্য দেবী ফুল কুড়াচ্ছে।.....।
আলমগীরকে যেন তারা দেখতেই পাচ্ছে না। সবার কাছে আলমগীর ফকিরের মত হাত পাতে কটা শিউলীফুল নিতে। কেউই আলমগীরের ফাকা হাত ভড়িয়ে দেয় না শিউলী ফুলে। খালি হাতে ক্ষুন্ন মনে আলমগীরকে ফিরতে দেখে সবচেয়ে কম সুন্দরী, জীর্নসীর্ন পোশাক পরা মুখ ঢাকা এক ললনা আলমগীরকে ডেকে দুহাত ভরিয়ে দেয় শিউলীফুলে। আমলগীরের ভীষন মায়া হয় ফুলদানকারী ললনার প্রতি। অনুরোধ করে বলে ওঠে-
কেডা তুমি? এত দয়া তোমার মনে? দেহাও না তোমার মুকখান? খুব সাধ যে ও মুক দেহার।
মুখ থেকে ঘুমটা সরাতেই আলমগীরের চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। এযে আর কেউ না তার স্ত্রী। চোখ খুলে দেখে তার স্ত্রী নিষ্ঠার সাথে মাথায় জল পট্টি দিয়েই চলছে।
দিন আসে দিন যায়। আলমগীরের স্ত্রী সাত মাসের গর্ভবতী। সারাদিন কাজ শেষে গ্রাম্য হাটখোলা থেকে গামছার গাটে বেধে চাল, ডাল, লবন কাধে করে বাড়ি ফেরে। আলমগীরদের জীবন মানে বাচ্চা উৎপাদন, সারাদিন খেটে খেটে সন্ধ্যেয় বাজার হাতে বাড়ি ফেরা, পরেরদিন কাজে যাবার প্রস্তুতি। কাজে যাওয়া ঘরে ফেরা পর্যন্ত তাদের সীমানা। আজ আর আলমগীর পায়ে হেটে কাজে যাবে না। অটোর অপেক্ষায় মেইন রোডে দাড়িয়ে। অটো এলে আলমগীর বসে পরে। অটো চলতে নিয়ে থেমে যায়।
ধান ক্ষেতের পানিতে পা ধুয়ে কোনো রকমের জুতোটা পায়ে দিয়ে স্কুল ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে এক কিশোরী হাপাতে হাপাতে অটোতে এসে বসে। আলমগীর হা করে কিশোরীর দিকে চেয়ে থাকে। মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বার বার কিশোরীর পায়ের দিকে তাকানো দেখে কিশোরী খেয়াল করে তার সালোয়ার গীরা থেকে উপরে উঠে আছে। শিশিরের ভিজে যাওয়া থেকে বাচাতে কিশোরী গীরার উপরে গুটিয়ে রেখেছিল সালোয়ার। কিশোরী হাসির আড়ালে লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করে, আস্তে সালোয়ার পায়ের পাতা পর্যন্ত নামিয়ে দেয়। কিছু পথ যাবার পর আলমগীর আবার কিশোরীর পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিশোরী বিরক্তবোধ করে। আলমগীর কিশোরীর বিরক্তমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আগবাড়িয়ে কথা বলে-
তোংগা বাড়ি আংগো গায়ে, তায়ন্যা?
কিশোরী বিরক্তিমাখা সুরে-
-জি?
হেদিন ভ্যানা তুমিই ফুলতালা ফুল খুইটপার আছিলা না?
-জি।
আমারে ডরাইছিলা, তাই দোর দিছিলা?
জি।
এহন কি ইকসুলে যেইত্যাছো?
হিহিহি.....না কলেজ যাচ্ছি। আপনি ইকসুল বল্লেন না উচ্চারণটা ভুল। শুদ্ধ উচ্চারণ হল ইশকুল বা স্কুল।
ও..... মুক্য মানুষতো অতো বুল ঠিক বুজিনা। এককান কতা কই, কিছু মাইন (মাইন্ড) হইরো না?
জি বলুন?
তোমার পায়ে ওডো কি পিন্দিছো?
কিশোরী পায়ের দিকে চেয়ে....
জুতো।
না না, ঐ যে একখান যে..?
কিশোরী বুঝতে না পারায় আলমগীর তার পায়ে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিশোরী আলমগীর কে ভাসমান সেলাম করে হেসে পায়ের দিকে আঙ্গুলউচিয়ে-
এটা?
হ, ঐডো।
পায়ের গহনা।
বুচ্চি, ঐডো নিপুর, তা একখান পিন্দিছো ক্যা, আরেকখান কি আইরা (হারিয়ে) গ্যাছে?
নিপুর অশুদ্ধ, শুদ্ধ উচ্চারণ হল নুপুর। আর আমি যেটা পরেছি এটা নুপুর নয়। এটাকে পায়েল বলে। পায়েল একটাই পরতে হয়।
কি জানি বাপু। দুনিয়ায় কত কি বাইরোইছে যে আল্লাই জানে!
হু, এখন অনেক কিছুই বেরিয়েছে, সব কিছু স্টাইলেস।
সব কিছু স্টিলের, কও কি? সোনা উপা নাই?
হিহিহি....উপা নয় রুপা হবে। সোনা রুপা আছে, আমি স্টিল বলিনি, স্টাইলেস বলেছি।
ও....তোমার পায়ের ওডো কত নাগে (লাগে) কিনতি?
একেকটার একেক দাম?
কোন থেকা কিনছো?
মুক্তা প্লাজার, রুপা স্টোর থেকে?
হেতা কোনে?
উফ.....এ তো প্রশ্ন কেন হ্যা?
আগ হইরো না, তোমার ভাবির নেইগা একখান কিনলামনী।
কে বারণ করেছে, কিনে নিন?
আলমগীর কোন কথা না বলে নেমে যাবার আগমূহুর্তে লুঙ্গীর ডোরের উল্টাপিঠে গুজে রাখা ১০০ টাকার নোট বের করে কিশোরীর ব্যাগের উপর দিয়ে-
আফামনি আমার, দয়া হইরা তোমার পায়ে পিন্দুইনা (পরিধান করা) অগুনা একখানা কিনা এইনা দিয়ো। আমাক কাইলদিন ভেনা ফুল তালার উহুনে পেইবা হেদিন যে সমায়ে পাছিলা।
আলমগীর এক মুহুর্ত দেরি না করে গটগটিয়ে চলে যায়। কিশোরী ভ্যাবা চ্যাকা খেয়ে ১০০ টাকার নোটের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। পরদিন সকালে ফুলতলায় আলমগীরের অপেক্ষা ব্যর্থ কিশোরীর না আসার ফলে। পরপর এভাবে তিনদিন আলমগীর ফুলতলায় অপক্ষো করে। কিন্তু কিশোরীর কোন হোদিস নেই। আলমগীরকে আজ একটু বেশিই রাগান্বিত মনে হচ্ছে। রাতের খাবার খেতে খেতে স্ত্রীকে স্বাক্ষী করে-
জানোস বউ মাইনসের চোপা দেইহা বিশ^াস হরতে নাই।
ক্যা কি অইছে?
হালা মিয়া নোক যে এত খারাপ জাইনতাম না। থুঃ, ফহিন্নির জাত- কোনহানকার। বাপের জন্মে ট্যাহা দেহে নাই।
কেডা ট্যাহা দেহে নাই?
ঐ বদ সোন্দোর ছেমরি ডা।
মাইনে? তুমি কি কোনে মিয়ার নগে পেম হরো?
মাতায় গুমার তুলবিনা কইলাম। না জেইনা একখান কতা কলি? তোর নেয়গা পায়ে পেন্দার গয়না কেনার জইন্যে ঐ ছেমরিরে ১০০ ট্যাহা দিছিলাম। হের পরের থন হাওয়া, কুনাহানি নেইংকা। বজ্জাদের বেডি বজ্জাত ছেরি।
পঞ্চম দিনের দিন যে সময় আলমগীর আশা ছেরে দেয় তার স্ত্রীর পায়ে গহনা পড়ানোর ঠিক সে সময় পথের মাঝে কলেজ থেকে ফেরার পথে আলমগীরের সাথে কিশোরীর দেখা হয়ে যায়। আলমগীর ঠিক করে কিশোরী সামনে এলে জুতো খুলে পিটাবে আচ্ছামত। তারপর যে বিচার হয় হবে। কিশোরীর জন্য তার স্ত্রীকে পায়ে গহনা পরানোর স্বপ্ন বার বার দেখানোর পর ও বাস্তবে রুপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কিশোরী আলমগীরের কাছাকাছি আসতেই আলমগীর তার ডান পায়ের স্যান্ডেল খুলে ফেলে। কিশোরীকে আঘাত করবে করবে শব্দে কিশোরী বাস কাগজে মোরানো একটা প্যাকেট আলমগীরের দিকে তুলে ধরে। আমগীর স্যান্ডেল ফেলে দিয়ে প্যাকেট টি হাতে নেয়। কিশোরী জিজ্ঞাসা করে-
জুতো হাতে নিয়েছিলন কেন?
আলমগীর থতোমত খেয়ে-
্ওই কইয়ো না, জুতার ফিতাহান হারার জন্যে নিছিলাম। তা প্যাকেডের মদ্যে কি?
পায়েল।
মাইনে?
পায়ের পরার গহনা যেটি আমায় কিনতে দিয়েছিলেন। দেরি হলো আপনাকে দিতে। আসলে একদিন কলেজ বন্ধ ছিলোতো তাই যাওয়া হয়নি। কিছু মনে নেবেন না।
আলমগীর নিজেকে মনে মনে অপরাধী ভাবে। কিশোরীর সম্পর্কে যা নয় তাই ভেবেছিল। তার ভাবনা পুরোটা ভুল প্রমাণ হয়ে গেলো রাতে বাস কাগজের প্যাকেট খোলার পর। অবাক ব্যাপার পায়েলতো আছেই সঙ্গে ১০০ টাকার নোটটি অক্ষত আছে। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের বাইরে থেকে একরকম ভাবা হলেও ভেতরটা একেবারে ভিন্ন রকম, সবার থেকে আলাদা।
ফোন কানে অন্যপ্রান্ত থেকে দেওয়া ডিরেকশন মনযোগে শুনছে........
“শোন টুকুটুকে নীল জরজেট শাড়ী পরবে। সুন্দর করে চোখ আঁকাবে। হাত ভর্তি নীল কাছের চুড়ি পরবে। চুলটা পাম্পিং করবে মাথার উপর দিকটায়, বাকিটা ছেরে দেওয়া থাকবে। শ্যাম্পু করা সিল্কি যেন থাকে চুল। আমার আঙ্গুলে একটু জট বাধলে না এক দম ন্যাড়া করে দেবো। দরকার পরলে পাঁচটা কন্ডিশনার মাখবে। ব্লাউজের গলাটায় যেন কলার থাকে। ইশ তুমিতো আবার লিপিস্টিক, মেকাপ, টিপ, নেইলপলিশ, আইস্যাডো পছন্দ করো না। থাক এ চ্যাপ্টার বাদ দিলাম। ফ্লাট স্যান্ডেল পরবে, আর পায়ে যেন আলতা থাকে, হাতের আঙ্গুল গুলোতেও। আঙ্গুলে আলতা না থাকলে না কেটে ফেলবো, একদম আঙ্গুল কেটে ফেবো বুঝেছো। আর শোনো কানে ঝোলা দুল পরবে। এই না না তুমিতো আবার ঝোলা টাইপের দুল পছন্দ করো না। ঠিক আছে নীল স্টোনের টপ পোরো। হাতের পার্স, ডাইরি, কলম, রুমালটাও নীল হওয়া চাই। মনে থাকে যেন, আগামিদিন তিনটেয় ট্রেন থেকে নেমে প্রথমেই তোমাকে দেখতে চাই। এক মিনিট এদিক সেদিক হলে.... আমাকেতো চেনোই।
ওপাশে ফোনে এতক্ষণ যে কথাবলছিল সে হলো সুহৃদ। ৩৭তম বিসিএস এ উত্তীর্ন হয়ে আগামী দিন গ্রামে ফিরছে। এ পাশ থেকে কথাগুলো গভীর মনযোগে যে শুনছিল সে হলো গ্রামের চঞ্চলা কলেজ পড়ুয়া কিশোরী সুনয়না। সুহৃদ সুনয়নার সম্পর্ক হবু স্বামী স্ত্রী। সুহৃদ সুনয়নাকে পাগলের মত ভালোবাসে। কথায় কথায় হুমকি দেওয়া সুহৃদ সুনয়নার প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।
ষ্টেশনে অপেক্ষমান নীল শাড়ী পরা রমনীর দিকে সবার চোখ। হাত ভর্তি নীল গোলাপ, চুড়ি, শাড়ী সব কিছু নীল। মাইকে এনাউন্স শুনে উঠে দারায় সুনয়না। ষ্টেশনে ট্রেন থামে। ফাস্টক্লাশ কামরার দিকে এগিয়ে গিয়ে ট্রেনের দরজায় চোখ রাখে। তাকে দেখতে পয়েছে। নীল জীন্স, নীল শার্ট, নীল গ্লাস চোখে, হাতে নীল ঘড়ি, নীল ট্রলিব্যাগের হাতল টেনে সুনয়নার দিকে এগিয়ে আসে সুঠাম সুপুরুষ। বাতাসে সুনয়নার চুল গুলো উড়ে ওঠে , সঙ্গে শাড়ীর আচল। সুহাদর চোখে লাগানো গ্লাসের আড়ালে চুপি সারে প্রাণ ভরে দেখে নেয় ও প্রিয় মুখ। ঠিক যেন কোন নীল পড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছে। স্টেশনের সবাই, ট্রেনের সকল যাত্রী বিষ্ময়ের চোখে দেখছিল নীল জুটিটিকে।!! একে বারে পারফেক্ট। সুনয়না সুহদর হাতে ফুলগুলো তুলে দেয়। সুহৃদ ফুল গুলো বুকের সাথে জড়িয়ে গালের সাথে লাগিয়ে চুমো আঁকে ও ফুলে বহুবার। পুনারায় ফুলগুলো সুনয়নার হাতে দিয়ে প্লাটফর্মে বসে পরে। নিজের হাটুর উপর সুনয়নার পা চায়তে সুনয়না সংকোচ করলে সুহৃদ সুনয়নার দিকে বড় বড় চোখে চাইতেই লাজ লজ্জা ফেলে সুহৃদর হাটুতে পা রাখে সুনয়না। সুহৃদ বুক পাকেট থেকে নীল পাথরের একটি পায়েল বের করে পরিয়ে দেয় সুনয়নার পায়ে। ডান পায়ের গীরার নীচের তিল টা মাদকতাময় সুন্দর। এক হাতে ট্রলির হাতল, গোলাপতোরা, অন্য হাতে সুনয়নার হাত ধরে স্টেশনকে পেছনে রেখে আসে তারা দুজন। গাড়িতে পাশাপাশি, গা ঘেসে বসা, হাতে হাত রাখা অথচ কারো মুখে কোন কথা নেই।
অনেক্ষন পর সুহৃদ জিজ্ঞাসা করে-
কেমন আছ সোনা বউ আমার?
সুনয়না লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলে। সুহৃদ সুনয়নার চিবুক ধরে মুখটা উপরদিকে তুলে-
কি বৌ, উত্তর পেলাম না?
ভালো, আপনি?
এতক্ষণ ভাল ছিলামনা, শুধু আতœাটা ছটফট ছটফট করছিল। কখন আমার পিচ্চি বউ কে দেখবো। এখন আমি এত্ত ভালো আছি বলে বোঝাতে পারব না।
তাই?
হ্যা।
কি করে বুঝলেন আমি আপনার কাছে এমন কিছুই আশা করেছিলাম?
যেমন?
পায়েল।
ও....হা....হা....হা...তুমি এখনো এত বোকা?
মোটেও না আমি অনেক ক্লেভার।
সুহৃদ সুনয়নার নাক টিপে তোতলামো করে বলতে থাকে-
ওলে বাবালে, আমাল পিচ্চি বউ নাকি ক্লেভারের ডিব্বা! হা....হা...হা..
সুনয়না সিরিয়াস হয়ে-
হাসি থামান, কি বিশ্রি উদ্ভট স্টাইলে হাসেন আপনি।
হা....হা....হা...তাই?
জি, বল্লেন নাতো কি করে বুঝলেন পা...য়ে...ল?
তুমি ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছিলে না, গ্রাম্য আলমগীরের স্ত্রীর জন্য পায়েল কিনতে গিয়ে তোমার পায়ে পরা পায়েলের মত পায়েল খুজে না পাওয়ায় নিজের পায়েলটাই দিয়ে দিয়েছো। তাই ভাবলাম....।
জানেন ঐ পায়েলটা দিতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো।
কেন?
ওটা ছিলো আপনার দেওয়া আমাকে প্রথম উপহার। ওটার সাথে আপনার ছোঁয়া ছিল।
রিলেশনের প্রথমটা পায়েল দিয়ে, শেষটাও পায়েল দিয়ে অদ্ভুত না!
শেষ মানে, রিলেশনের শেষ মানে কি?
সুহৃদ সুনয়নার মাথায় খোচা দিয়ে-
আরে বুদ্ধ আমরাতো রিলেশনে থাকছিনা, এবার সংসার জীবনে ইলভল্ব হচ্ছি।
সমাপ্ত