সাফল্যের ভেতরের গল্প



সাফল্যের ভেতরের গল্প
মাহবুব এ রহমান

নিঝুম  রাত। ঘড়ির কাটা প্রায় দেড়টা ছুঁইছুঁই।  কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। সবাই পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের দেশে। পুরো বাসাটা ছেয়ে গেছে পিনপতন নীরবতায়। দূরের কোথা থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের হুক্কাহুয়া চিৎকার। ঝিঁঝিঁ পোকারাও জেগে আছে তখনও। এই নিস্তব্ধ পরিবেশকে মাতিয়ে রেখেছে ওরা। মাথার উপর ঝুলন্ত ফ্যানটা শাঁশাঁ করে মৃদু শব্দ করছে। পাশে ঘুমন্ত দুজনের নাকের খড়খড়ানির শব্দও যেনো তাল মিলিয়েছে এর সাথে। পুরো বাসার মদ্যে তখনো জেগে আছে ওয়াসিম। টেবিলল্যাম্পের মৃদু আলোর মধ্যে চোখ দুটো তার বইয়ের পাতায়। হঠাৎ টেবিলঘড়ির দিকে তাকায় সে। ‘না আর দেরি করা যাবেনা। খুব ভোরে আবার উঠতে হবে’ এসব ভেবে বই বন্ধ করে ওয়াসিম। শোয়ে পড়ে দ্রুত। এমন চিত্র তার প্রতিদিনকার। পুরো নাম রোমান সরদার ওয়াসিম। এবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী। চোখে-মুখে তার স্বপ্ন ছুঁয়ার হাতছানি। একটাই টার্গেট এখন তার সামনে। যে করেই হোক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স তাকে পেতেই হবে। ভাইয়া বলেছেন ‘পাবলিকে চান্স না পেলে আর পড়ালেখার দরকার নেই। এটা অবশ্য তাকে উৎসাহিত ও আত্মপ্রত্ময়ী করার জন্য বলেছেন তিনি। দারুণ আত্মবিশ্বাসী ও স্বাপ্নিক এক তরুণ ওয়াসিম। লেখাপড়ার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজের প্রতি ওর দারুণ ঝোঁক। সাংবাদিকতা, লেখালেখি আবৃত্তি কোনো কিছুই যেনো ছেড়ে যায়নি তাকে। আবৃত্তিতে থানা, জেলা ও বিভাগ টপকিয়ে অংচলশ নিয়েছিল জাতীয় পর্যায়ে। কিন্তু এত্তো সবের পাশাপাশি ক্লাস রাওল ০১ ছিল ওরই দখলে। এখন ওর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ঢাকা,চট্টগ্রাম অথবা রাজশাহী যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া। পরিবারে সবার প্রত্যাশাও তাই। ওর বড়ো ভাইয়া স্বপ্ন দেখান ওকে। তাই এইচ এস সি পরীক্ষা শেষেই চলে আসে শহরে।  ভাইয়া ভর্তি করিয়ে দেন একটি কোচিং সেন্টারে। শুরু তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। সময়কে খুব মূল্য দেয় সে। কোচিং ক্লাস ব্যাতীত আর বেরোয়না কোথাও। টেবিলে পড়ে থাকে সারাদিন। একটুও বিরক্তিবোধ নেই। স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় পেতে সব করতে রাজি। চালিয়ে যাচ্ছে বিরামহীন চেষ্টা। সেই কবে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি থেকে এসেছিল আর যাওয়া হয়নি বাড়ি। সামনে রোজার ঈদ। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ওদিকে। ঈদের আগের দিন বাড়ি যায়। আবার চলে আসে দ্রুত। বড় ভাইয়া বলেন ‘ভার্সিটিতে চান্স পেলে প্রত্যেক দিনই হবে একেকটি ঈদের দিন। সারাজীবনের জন্য সামাজিক হতে চারমাস অসামাজিক হতে দোষের কিছু নেই’। কথাগুলো খুব মনে ধরেছে তার। বন্ধু-স্বজন বা রিলেটিভ কারো সাথে নেই তেমন একটা যোগাযোগ। সেই এইচ এস সি টেস্ট পরীক্ষার আগ থেকে ব্যাবহার বাদ দিয়েছে ফেসবুক। আব্বু-আম্মু সহ প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য ব্যাবহার করছে সাধারণ একটি সেট। দিন দিন ঘনিয়ে আসছে এডমিশন টেস্টের এক্সাম। আবার সামনে কোরবানির ঈদ। সিদ্ধান্ত নেয় এবার ঈদে বাড়ি যাবেনা। একাই থাকবে বাসায়। নিজে নিজেই রান্না করে খাবে। কিন্তু সবার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয় বাড়ি যেতে। ঈদের আগের দিন গিয়ে আবার চলে আসে পরের দিন। বাড়িতে সবাই যখন হইহুল্লোড় আর ফূর্তি-আমোদে ব্যস্ত ঠিক তখন সে বসা পড়ার টেবিলে! পাশের ফ্ল্যালেটের আন্টিরাও এবার ঈদে বাড়ি যায়নি। ওদের রান্না ঘর থেকে যখন বেরুচ্ছে গরুর গোস্তের ঘ্রাণ আর সে কিনা ভাত খাচ্ছে ডিম ভাজি দিয়ে। তাতে কী! একটুও দুঃখ নেই তার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি সে। সাথের সবাই ভর্তি হয়েছে। ব্যাতিক্রম সে। এতো দিনের প্রস্তুতি তারমনে এনে দিয়েছে প্রচুর মনোবল। যুগিয়েছে আত্মবিশ্বাস। চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। পরীক্ষা দেয় সে। কিন্তু মনমত হয়নি। রেজাল্ট বেরোয়। ওর পজিশন আসছে। তবে পেছনের দিকে। কিছুটা ভেঙে পড়ে। কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারায়নি একটুও। খুব মনেপড়ে তার তাহমিদ স্যারের কথা। স্যার বলেছিলেন ‘জীবনকে স্টাবলিশ করতে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তোমার প্রয়োজন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে শখ। শখের চেয়ে প্রয়োজনটা তোমার কাছে বড়ো’। তাই সে শুরু করে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রস্তুতি। পরীক্ষা দেয়। দুটোতেই ঠিকে যায়। রাজশাহী দূর হবে তাই ভর্তি হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভাবতেই তার চোখ দুটো হয়ে ওঠে অশ্রুসিক্ত। এ অশ্রু গর্বের। এ অশ্রু আনন্দের। মূহুর্তেই ম্লান হয়ে যায় তার বিগত দিনের সব কষ্ট।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট