বাসার তাসাউফ
সুলতানা ইসলাম হিমু
বাসার তাসাউফ তরুণ প্রজন্মের লেখক। জন্ম ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি। কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার অনন্তপুর গ্রামে।
তার প্রথম বই ‘কার কাছে যাবো’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে। বইমেলায়। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ ১০টি। এর মধ্যে ‘সূর্যঘড়ি’ ‘ছুঁয়ে দিলাম তোমাকে’ ‘চন্দ্রাহত পুরুষ’ উল্লেখযোগ্য। তিনি শিশুদের জন্যও লিখেন। ‘স্কুল থেকে পালিয়ে’ নামে তার একটি কিশোর উপন্যাস রয়েছে। জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ব্লগ এবং অনলাইন পোর্টালগুলোতে তিনি নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। ‘জীবিত অথবা মৃত’ ‘একটা কাকের মৃত্যুতেও শোক হয়’ ‘যখন সবকিছুতে অন্ধকার থাকে’ ‘ফুল-কাঁটা’ ‘ডাকপিয়ন ঠিকানা পেল মানুষটা পেল না’ বিভিন্ন দৈনিকে ছাপা হওয়া তার উল্লেযোগ্য কিছু গল্প।
২০১৫ বইমেলায় প্রকাশিত ‘সূর্যঘড়ি’ নামের উপন্যাসটি পাঠক ও সূধীজনের মাঝে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। তার গ্রামের বাড়ির সামনের বিস্তৃত ফসলের মাঠ থেকে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক, নারিকেল গাছের চিরল পাতার ফাঁকে জেগে থাকা পূর্ণিমার চাঁদের অবারিত আলোর উন্মাদনা, অরণ্য আঁধারে জোনাকীর সিম্ফনী, কেরোসিন তেল ও লবণ নিয়ে প্রাক-সন্ধ্যায় হাট থেকে বাড়ি ফেরা কিষাণের নাকের ডগায় লেগে থাকা শীতের শিশিরের মতো ঘামের ফোঁটা, রঙিন ফিতে দিয়ে মাথার চুল দুই ভাগ করে বেঁধে পাঠশালায় যাওয়া কোনো বালিকা অথবা কোনো পল্লীবধূর কপালে সকালের উদীয়মান সূর্যের মতো টকটকে লাল টিপ দেখে তিনি আপ্লুত হয়েছেন আর গ্রামীণ এসব ‘সিম্বলিক’ বিষয়আশয় নিয়ে লিখেছেন ‘সূর্যঘড়ি’ উপন্যাসটি। এ বইটি পাঠ করলে পাঠক বোহেমিয়ান জনাকীর্ণ নগরজীবন ছেড়ে ফিরে যায় ফেলে আসা গ্রামে, জন্মভিটায়Ñযেখানে শেকর, উৎসমূল এবং যেখান থেকে জীবনযাপনের সূূচনা। সেখানে ফেলে আসা নানা স্মৃতি আবার নতুন করে উঁকি দেয় মনের আয়নায়। একটা সময় ছিল, যখন আমাদের বাবা-কাকারা লাঙ্গল-জোয়াল আর গরু দিয়ে জমিনে হালচাষ করতো। এখন ইঞ্জিন চালিত ট্রাক্টরে খুব অল্প সময়ে হালচাষের কাজ সারা হয়। তখন চিঠির মাধ্যমেই দেশ-বিদেশে যোগাযোগ করা হতো। এখন এসএমএস, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইমু, ভাইভার, হোয়াটসআপ আর স্কাইপির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। যেখানে পুরো গ্রামে হাতেগোনা দুয়েকটা সাদা-কালো টেলিভিশন ছিল আর তাতে অ্যালুমিনিয়ামের অ্যান্টেনায় সিলভারের পাতিলের ঢাকনা লাগিয়ে রীতিমতো সাধনা করে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘আলিফ লায়লা’ ‘টিপু সুলতান’ ‘ম্যাকগাইভার’ ‘আকবর দা গ্রেট’ ও ‘ছায়াছন্দ’ দেখতে হত, সেই গ্রামে এখন প্রায় প্রতি ঘরেই রঙিন টেলিভিশন আছে। স্যাটেলাইট সংযোগে কত চ্যানেল দেখা যায়! বাবার আঙ্গুল ধরে হেঁটে হেঁটে গঞ্জের হাটে যাওয়া, হাটের মধ্যস্থলে ডালপালা মেলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো বটবৃক্ষের তলে লোকজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সাপ-বেজিতে লড়াই দেখার প্রত্যাশায় বড় বড় দাড়ি-গোঁফঅলা লোকটিকে কি কখনও ভোলা যায়? তার লেখায় যাপিত জীবনের সেই সব সিম্বলিক বিষয়ের বহুমাত্রিক পর্যবেক্ষণ আমাদের সচকিত করে। কম্পিউটার মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগে এসেও গ্রামের সেই সময়ের স্মৃতিতে সে আমাদের বুঁদ করে রাখে, যে সময়ে রাত্রি শেষে ভোর বেলায় মোরগের ডাকে মানুষের ঘুম ভাঙ্গত। নামাযের সময় হয়েছে কিনা সেটা বুঝতে হলেও আকাশের দিকে তাকাতে হতো।
তখন ঘড়ি ছিল না। সূর্যঘড়িই ছিল সময় নির্ধারণের একমাত্র উপায়। কিন্তু ‘পৃথিবী সে যুগ পার হইয়া আসিয়াছে।’ তবু ফেলে আসা পৃথিবীর দিকে একবার উঁকি দিয়ে কার না দেখতে ইচ্ছে করে! সেই যে খেলার সাথিরা মিলে বালুচরে খেলাঘর বানানো, পাটকাঠির মাথায় মাদার গাছের আঠা লাগিয়ে পুঁই আর লাউয়ের মাচায় ফড়িং ধরা, চৈতালি দুপুরে তেপান্তরের মাঠে ঘুড়ি উড়ানো, বনে বনে ঘুরে পাখির বাসা ভেঙ্গে ছানা এনে বাড়িতে পোষা, দিঘির জলে ডুবসাঁতার, দল বেঁধে জলকেলি করাÑ সেই সব আমাদের শুধু উঁকি দিয়ে নয়, একেবারে ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে বাধ্য করেছে এই উপন্যাসের কাহিনির পরতে পরতে। আমাদের দেখা না দেখা পুরনো সেই পৃথিবী, সেই সময়ের মানুষ ও তাদের জীবনাচরণ সম্পর্কে অবহিত করেছে। তার লেখায় গ্রামীণ জনজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি, কান্না, আনন্দ-বেদনার কথা বর্ণিত হয়েছে সুচারু রূপে। এবারের বইমেলায় ‘স্বরচিত নির্বাসন’ নামে তার একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছে ‘বেহুলাবাংলা প্রকাশন।’