অধরা থেকে যায় সে...







অধরা থেকে যায় সে...
ইসলাম তরিক

- না তোকে আর এক পয়সাও দিতে পারব না। এইতো দুদিন আগেই দুশ টাকা নিলি। কী করিস এত টাকা?
- টাকা কী থাকার জিনিস বল? ওটা খরচের জন্যই।
- তাই বলে এভাবে খরচ করবি?
- আচ্ছা ঠিক আছে আর ফালতু খরচ করব না। আজ একশ টাকা দে।
- না দিতে পারব না। তুই প্রতিদিনই এমন কথা বলিস।
আমিও নাছোড়বান্দা। জোর করে ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একশ টাকা নিয়ে চম্পট দিলাম। সেও কম যায় না। মুখটা পেঁচার মতো করে অভিমানের সুরে আমাকে ইচ্ছেমতো বকা দিলো। সে আর কেউ না । সোমা। আমার বন্ধু-বান্ধবী দুটোই । ঘনিষ্ঠ বন্ধ কাকে বলে সেই সজ্ঞা হয়তো আমি দিতে পারব না। তবে সোমা আমার এত কাছের কেউ, যেন দুটি দেহের এক আত্মা।
সোমা আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। সেই প্রাইমারি থেকে হাইস্কুল, তারপর কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও সোমা আমার পাশে ছিল। প্রাইমারিতে আমরাই ছিলাম প্রথম ও দ্বিতীয়। হাইস্কুলেও তাই। জুনিয়র বৃত্তি আমি মিস করলেও সোমা মিস করেনি। সোমা ছিল ডানপিটে মেয়ে। কিছুটা পুরুষ স্বভাবের। আমরা দুজন মিলে সমস্ত গ্রামটা চষে বেড়াতাম। আমি গাছে ওঠতে ভয় পেতাম। কিন্তু সোমার কোনও ভয়ডর ছিল না। সে বানরের মতো লাফিয়ে গাছে ওঠত। আমি সাঁতার জানি না, সোমা আমাকে সাঁতার শিখিয়েছিল।
 সে আমাকে পদ্মফুল তুলে দিতে বলেনি। উল্টো সোমাই আমাকে পদ্ম, শাপলা তুলে দিত। আম, কদবেল আমাকে চুরি করতে হয়নি। সোমাই সব করত। আমি শুধু ওর পিছুপিছু ছুটতাম। সোমা আমাকে বলত, ইস! আমি যদি ছেলে হতাম আর তুই যদি মেয়ে হতিস তাহলে আরও ভালো হত। ওর কথা শুনে আমি হাসতাম। শৈশবের সেই বয়সটা পেরিয়ে আমরা আজ অনেক বড় হয়েছি। পরিবর্তন এসেছে আমাদের শরীরে। আজ সোমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে হাজারও কাব্যিক ছন্দ দোল খায়। তবুও কেন যেন আমার প্রতি সোমার আচরণ সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।
আমাদের দুজনার মেস ছিল পাশাপাশি। আমার মেসে মহিলা গেস্ট নিষিদ্ধ হলেও সোমার জন্য সিদ্ধ ছিল। আমাদের দুজনার আচরণ দেখে আমার বন্ধুমহল বলত সোমা তোর বান্ধবী নয়, তোর বউ। তাদের কথায় আমি খানিকটা লজ্জা পেলেও সোমা হাসত। হ্যাঁ, বন্ধুরা অবশ্য ঠিকই বলেছে। সোমা আমার বউ। আচ্ছা বউ তার স্বামীর জন্য কী কী করে? শুধু সেক্সচুয়াল দিকটি বাদ দিয়ে সোমা তো তার সব কিছুই করে আমার জন্য।
আমি ছোট থেকেই অগোছালো ছিলাম। সোমাই সব গুছিয়ে দিয়েছে। গুছিয়ে দিয়েছে আমার ছাত্রত্বের বিশৃঙ্খল দীর্ঘ জীবন। তার অনুপ্রেরণায়ই আজ আমি এতদূর আসতে পেরেছি। আমি ছিলাম বরাবরই খাপছাড়া বাউ-েলে। সোমাই আমাকে সুগঠিত উজ্জ¦ল আলোকবর্তিকা নিয়ে পথ দেখিয়েছে। আমার পরিধেয় কাপড় আমি ধুতে পারতাম না । তাই মাস শেষে ময়লা কাপড়গুলো ব্যাগভর্তি করে বাড়ি নিয়ে আসতাম। আমার মায়ের কষ্ট হবে ভেবে সোমাই সেসব কাপড় ধুয়ে দিত। রান্না ভালো হয়নি এই অজুহাতে সে গ্যাসের চুলায় ডিম ভেজে আমাকে খাওয়াত। আমাকে খাওয়াতে পেরে তার যেন রাজ্যের তৃপ্তিতে হৃদয় ভরে যেত। কারণে-অকারণে, সময়ে-অসময়ে সে আমার রুমে এসে আমার শিয়রে বসে কপালে হাত রাখত। আমিও মাঝে মধ্যেই মাথাব্যথার অজুহাতে  তাকে দিয়ে মাথ ম্যাসেজ করে নিতাম। সোমা দারুণ ম্যাসেজ করতে পারত।
তার নরম হাতের স্পর্শে আমি এক সময় ঘুমিয়ে যেতাম। আর সোমা আমার পাশে বসে গুনগুন করে গান গাইত। ঘুম থেকে জেগেও যখন সোমাকে দেখতে পেতাম তখন অজানা এক অনুভূতিতে তাকে জরিয়ে ধরতাম। আমার ভেতরে-বাহিরে  সোমাই সব। কেবল সজ্জাসঙ্গিনী ছিল না সোমা। সে কী দেয়নি আমাকে ? নিজের শরীরটা বাদ দিয়ে সে সবকিছুই আমাকে উজার করে দিয়েছে। সোমাকে একদিন ঠাট্টাছলে বলেছিলাম, তুই আমার জন্য এত কিছু করিস কেন রে? তুই কী আমার অর্ধেক বউ?
প্রতিত্তোরে সে বলেছিল, অর্ধেক কেন রে? আমাকে পূর্ণ বউ ভাবতে পারিস না? সেদিন ঠাট্টাচ্ছলে সোমা যে তার মনের কথাটি প্রকাশ করেছিল সেটা বুঝিনি।কিন্তু অনার্স থার্ড ইয়ার থেকে ফাইনাল ইয়ারে ওঠতেই হঠাৎ সোমার বিয়ে হয়ে গেল। মহাধুমধামে বিয়েটা পার হলো। সোমা হয়ে গেল  অন্যের ঘরণী। সোমাহীনা আমার জীবনেও নেমে এলো একাকীত্বের ঘনকুয়াশা। সোমার বিয়ের পর আমাকে এত কষ্ট পেতে হবে ভাবিনি কখনও। প্রতিটি নিঃশ্বাসে বেদনার কাঁপন ওঠবে তাও কখন কল্পনাও করিনি। প্রতিটি মুহূর্তে তার কথায় আমি ভাবতাম। হঠাৎ একদিন সোমা আমার মেসে এসে হাজির হলো। তাকে দেখে  যেন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। ছুটে গিয়ে বললাম,
- কেমন আছিস তুই?
- তুই যেমন রেখেছিস?
- ঠাট্টা বাদ দে। তোকে এত রুগ্ণ দেখাচ্ছে  কেন রে?
- ঠাট্টা নয়রে। সত্যিই বলছি তুই তোর সোমাকে যেমন রেখেছিস, সোমা ঠিক সেরকমই আছে।
 সোমার কথার মাথামু- আমি কিছুই বুঝলাম না। কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলাম সোমার দিকে। সোমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। কিছু একটা হয়েছে ভেবে আমি ভয় পেলাম।
সোমা আমার চোখে চোখে রেখে বলল,
-তুই পারলি নারে আমাকে তোর পূর্ণ বউ করতে। সারাজীবন আমি তোর অর্ধেক বউই থেকে গেলাম। এই জীবনে তোকে ছাড়া আমি আর কাউকেই চাইনি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার চাওয়া পূর্ণ করল না।
 সোমার কথা শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। সত্যিই আমি এক জড়পুরুষ, যে কি না সোমার এত কাছে থেকেও তার হৃদয় বুঝতে পারেনি।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট