দরবার



দরবার
যাহিদ সুবহান

আজ দরবার বসেছে সোহরাব মুনশীর উঠোনে। জুলেখা আজকের দরবারের আসামী। মাথা নিচু করে উঠোনের এক কোনে বসে আছে। ছয় বছর বয়সী জুলেখার ছেলেটা মায়ের পিঠের কাছে বাঁশের একটা খুঁটিতে হালকা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ বিকেলের সুর্যটা রক্তিম আভায় রঞ্জিত; একটু পরেই পশ্চিম আকাশে ঢলে পরবে। সোহরাব মুনশী আজকের দরবার প্রধান। শুধু আজকের নয় এই গ্রামের সকল দরবারই তাকে মেটাতে হয়। সকলেই তাকে খুব মানে। খুব পরহেজগার মানুষ তিনি। গত বছর মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্জ্ব করেছেন। বড় মায়াবী সুরত তার। হেলেদুলে হাঁটেন।
সোহরাব মুনশীর মত এ গ্রামের সব দরবারে আরেকজন মানুষকে থাকতে হয়। তিনি মসজিদের ঈমাম হুজুর। জুমআর নামাজসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ান তিনি। সব সময় তসবিটা হাতেই থাকে তাঁর। বাড়তি কথা কম বলেন। সব দরবারের ফয়সালা তাকেই দিতে হয়। সোহরাব মুনশী শুধু রায় ঘোষনা করেন। তিনি অবশ্য এ গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন। এ গ্রামের যত মিলাদ-দোয়া-খায়ের সবই তাঁকে করতে হয়। মসজিদের সম্মানীতে তার সংসার চলে। এ ছাড়া গাঁয়ের মানুষদের জ্বিনের আছড় হলে কিংবা শিশু বাচ্চারা ভয় পেলে এমনকি বিছানায় প্র¯্রাব করলেও তাকে তাবিজ-কবচ দিতে হয়; পড়া পানি, তেল পড়া দিতে হয়। অবশ্য তাবিজ-কবচ কিংবা পানির ব্যবস্থা ভুক্তভ’গী যারা আসে তারাই নিয়ে আসে। হুজুরের কাজ শুধু দোয়া পড়ে তিনটি ফুঁ দেওয়া। সামান্য হাদিয়া সেখানেও মেলে তাঁর।
চিরায়ত ভঙ্গিমায় দরবারের প্রধানের নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে বসেন সোহরাব মুনশী। যথারীতি হাঁক ডেকে রহমুদ্দিকে বললেন,
কী রে রহমুদ্দী, কী হয়ছে ক দেহি?
রহমুদ্দী আজকের দরবারের বাদী। হাত মোচর পাড়তে পাড়তে সে সোহরাব মুনশীর সামনে এসে বলে,
আর কবেন না, কাহা! এই নষ্টা মহিলা (জুলেখাকে নির্দেশ করে) চেলাকাঠ দিয়ে মাইরে আমার সালামের মাতা ফাটা ফ্যালাইছে। আপনে ইর একটা বিচার কইরি দেন কাহা।
রহমুদ্দীর কথা শুনে আর কারো কোন কথা না শুনেই ক্ষেপে যায় সোহরাব মুনশী। যেন বাঘের তর্জন-গর্জন শুরু হয়ে যায়। দরবারে উপস্থিত সকলে দেখতে পায় সোহরাব মুনশীর আসল চেহারা। সবাই ভীত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বলে,
এ ছেড়িডা কী কইরলো রে! আইজ যে কপালে কী আছে। মুনশী আইজ ক্ষেপিছে।
এত বড় সাহস এই মহিলার! একটা মহিলা মানুষ হয়ে তাও আবার বিধবা, একজন পর পুরুষের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। সোহরাব মুনশী ক্ষেপে গিয়ে রক্তচক্ষু করে জুলেখাকে জিজ্ঞাসা করে,
ক্যারে জুলেখা, সালামের মাতা ফাটাইছস ক্যা?
সোহরাব মুনশীর কথায় কোন কর্ণপাত করে না জুলেখা। একবার মাথা তুলে তাকায় সোহরাব মুনশীর দিকে। আবার আগের মতই সে মাথা নিচু করে মাটির দিকে একপানে চেয়ে থাকে। জুলেখার রক্তলাল চোখে যেন আগুন ঝরছে। নাগিনীর মত ফুসে আছে সে। জুলেখার মুখে কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে দ্বিগুণ ক্ষেপে যায় সোহরাব মুনশী। জুলেখার এমন বেয়াদবী মেনে নিতে পারে না সে। সোহরাব মুনশীর চেয়ে বেশী ক্ষেপে যায় দরবারে উপস্থিত থাকা জামাল। সোহরাব মুনশীর চোখে চোখ তুলে কথা বলে এমন সাহস নেই এ গাঁয়ের কারো। অথচ জুলেখা কোন কথাই বলছে না। এত বড় সাহস ওর! সোহরাব মুনশীর সাথে বেয়াদবী! এতক্ষণ চুপ ছিল। যদি সোহরাব মুনশী ক্ষেপে যায়; বেয়াদবী হয়, তাই কিছু বলে নি। এবার আর থেমে থাকা যায় না। সে গিয়ে ক্ষপ করে জুলেখার চুলের মুঠি ধরে মাথা ঝাঁকাতে থাকে আর বলতে থাকে, কতা কইস নি ক্যা মাগী, কতা ক!
জুলেখার মুখে তখনও কোন কথা বের হয় না। ব্যথায় ককিয়ে উঠে সে অষ্পষ্ট আওয়াজ করতে থাকে, উহ্!
জুলেখা গাঁয়ের শেষ মাথায় বনের ধারে একটা খুপরি ঘরে থাকে। ২৫ বছর বয়স। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে। ছয় বছর বয়সের ছেলেটাকে নিয়ে সে থাকে। এই ছেলেটাই তার বেঁচে থাকার সম্বল। এ বাড়ী ও বাড়ী দাসীবাদী করে তার কোনমতে চলে যায়। গ্রামের গৃহস্থের কাঁচা ঘর, কাঁচা উঠোন লেপার দরকার হলে ডাক পরে জুলেখার। জুলেখা বাড়ির পাশের পুকুর কিংবা খাল থেকে কাদামাটি এনে তাতে কাঁচা গোবর- ধানের তুষ মিশিয়ে খুব যতœ করে সেগুলো লেপে দেয়। জুলেখার নিখুত কাজে সবাই খুশি। গাঁয়ের নায়েব আলীর মা, সাদ্দামের মাও লেপার কাজ করে কিন্তু জুলেখার মত এত ভাল কাজ কেউ করতে পারে না। শুধু কি ঘর লেপা; গোয়ালঘর পরিষ্কার করা, বাড়ির চারপাশ ঝাড়– দেওয়া, কাপড়কাঁচা, এমনকি রান্নার কাজও করতে হয় জুলেখার। বিনা আপত্তিতে জুলেখা এসব করে দেয় বলেই সবার বিশেষ পছন্দের মানুষ সে। সবাই ওর প্রশংসা করে বলে,
জুলেখার কামের মেলা ঢক!’ সবাই কাজ শেষ হলে খুশি হয়ে ভাত-তরকারি, কয়েকটা টাকা এবং এককেজি চাল দেয়। ঈদ উৎসবে কমদামী প্রিন্টের শাড়ীও জোটে জুলেখার কপালে।
জুলেখার ছেলেটা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। জুলেখার চিন্তাও বাড়ছে দিন দিন। ছেলে বড় হচ্ছে। ওর ভবিষ্যত কী? ছেলেটাও মাকে ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। স্কুল থেকে ফিরে মাকে বাড়িতে না দেখলে ও বিগড়ে যায়। বইগুলো বারান্দার মাঁচায় ছুড়ে ফেলে এক দৌড়ে ছুটে যায় হয় মোল্লাদের বাড়ি নয়তো মুনশীর বাড়ি। ও ঠিকই জানে ওর মাকে কোথায় পাওয়া যাবে। মাকে পাওয়ার সাথে সাথে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। জুলেখার হাতে-গায়ে তখন হয়তো লেগে আছে কাদা কিংবা গোবর। তরিঘরি করে হাত ধুয়ে ছেলেটাকে পরম যতেœ জড়িয়ে ধরে সে। কপালে একটা চুমু খায়। হালকা ঘামে ভেজা ছেলের কচি মুখটা আঁচল দিয়ে মুছে দেয়। ছেলের মুখটা দেখার সাথে সাথে একটা প্রশান্তি এসে জুলেখাকে ছুয়ে যায়। মুহূর্তেই তার সকল ক্লান্তি যেন হাওয়ায় ভেসে যায়।
সারাদিন কাদামাটি, গোবর, ময়লা-আবর্জনার মধ্যে থাকলেও এগুলো জুলেখার সুন্দর রুপলাবণ্যকে একটুও ম্লান করতে পারে নি। অভুক্ত-অপুষ্টিতে অবিরাম দিনপাত করলেও দৈহিক গড়নে একটু ঘাটতি নেই। অবিরাম অযতেœ দেহের চামড়ার ভাজে ভাজে ময়লার স্তর পরলেও তার রুপলাবণ্য প্রকাশে এগুলো ব্যর্থ। চুলগুলোতে নিয়মিত তৈল-সাবান হয়তো পড়ে না তাতে কী, সেগুলো দীঘল কালো! অনেকেই আফসোস করে বলেই ফেলে,
হায় রে অভাগী, আল্লাহ ওকে সব দিয়েও সব কেড়ে নিয়েছেন!
আর এত হারখাটুনি পরিশ্রমের পরেও দাঁতের ফাঁক গলে এক ফোটা হাসি যেন লেগেই আছে। তবে জুলেখা এসব নিয়ে ভাবে না। ছেলেটাকে মানুষ করাই তার একমাত্র লক্ষ। সব কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরে জুলেখা। পাশের জঙ্গল থেকে জোগাড় করা লাকড়ি চুলার পাশে নিয়ে রান্না করতে যায়। কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে মায়ের পাশে খেজুর পাতার বোনা পাটি পেরে বসে পরে জুলেখার ছেলে। জোরে জোরে পড়তে থাকে, ‘অ তে অজগরটি আসছে তেড়ে!’
সব হারিয়ে নিঃস্ব জুলেখা। বাবা গত হয়েছেন অনেক শিশুবেলায়। বাবার মুখটাও মনে পড়ে না তার। স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা মা অনেক কষ্টে বড় করে তুলছিলেন জুলেখাকে। একদিন মাকেও হারাতে হয়েছিলো অবেলায়। বিধবা মায়ের ঘরে ঢুকেছিল এক অচেনা পুরুষ। মা প্রতিরোধ করেছিলেন। কিন্তু এই অন্ধ সমাজ সেদিন জুলেখার নিরপরাধ মায়ের পক্ষ না নিয়ে বরং বিপক্ষে গিয়েছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেদিন ওর মাকে চরিত্রহীনা অপবাদ দিয়েছিলো। সেদিন এই সোহরাব মুনশীর উঠোনেই বসেছিল দরবার। সোহরাব মুনশীই ছিলেন দরবার প্রধান; দিয়েছিলেন রায়। বেদম প্রহার জুলেখার মাকে সামান্যতম আঘাত করেনি। চরম আঘাত করেছিল চরিত্রহীনা অপবাদ। সেদিন আজকের মতোই গোধূলি নেমছিল পৃথিবীতে। সাদা বকেরা আজকের মতই নীড়ে ফেরার প্রতিক্ষায় ছিল। জুলেখা বাড়িতে ফিরে আবিষ্কার করেছিল তার মা ঘরের একটা ডাবে নিজের শাড়ীতেই ঝুলে আছে। নিরব; নিথর! সেদিন থেকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজটার প্রতি জুলেখার প্রবল ঘৃণা। এই সমাজের কাছে জুলেখারা বরাবরই দূর্বল-অসহায়। তাই এই সমাজের সোহরাব মুনশীদের মুখে অবিরাম থু থু ছিটিয়ে প্রতিবাদ করা ছাড়া জুলেখা আর কী ই বা করতে পারে!
ঘটনাটা গতকাল সন্ধ্যার। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রহমুদ্দির ছেলে সালাম এসময় হাজির হয় জুলেখার বাড়িতে। বেশ কয়েকদিন ধরেই সে জুলেখার পিছু নিচ্ছে। সময় অসময়ে সে জুলেখাকে বিরক্ত করে চলছে। মাঝে মাঝেই নতুন শাড়ী, নগদ টাকা নিয়ে হাজির হয় জুলেখার বাড়িতে। জুলেখা এসব পছন্দ করে না। সে সালামকে এসব করতে নিষেধ করে। সালাম বিবাহিত মানুষ; তার বাড়িতে সুন্দরী বউ আছে। মানুষ এসব শুনলে বরং জুলেখারই কলঙ্ক হবে। গতকালও এসেছিল হাতে করে ছেলের জন্য একটি স্কুলব্যাগ হাতে করে। জুলেখা বাড়িতে এমনিতেই একা থাকে; বিধবা মানুষ। সে সালামকে অনুরোধ করে বলে,
সালাম ভাই, আপনে চইলে যান, এই বাড়িত এইভাবে আইসপেন না!’
সালাম জুলেখার কোন কথাই শোনে না। সে খপ করে জুলেখার হাত ধরে ফেলে।
তুমি রাগ করো ক্যা জুলেখা? আমি কি তুমার পর মানুষ? তুমি রাজী থাকলি আর কি ডা কী জানবি কউ!
জুলেখা এক ঝটকায় সালামের হাত থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। বারান্দায় সাজিয়ে রাখা একটা চেলাকাঠ নিয়ে সে এলাপাথারি সালামকে পেটাতে থাকে।
পরদিনই দরবার বসায় সকলে। সোহরাব মুনশীর উঠোনে দরবার বসে; দরবার প্রধানও সেই সোহরাব মুনশী। দরবারে মাটির দিকে মুখ করে জুলেখা তার অতীত নিয়ে ভাবতে লাগে। সে এক অন্যগজতে চলে যায়। বাবা-মা কিংবা স্বামীটা বেঁচে থাকলেও কি এমন নরক যন্ত্রনা পোহাতে হতো তাকে। অন্ধ এ সমাজ কি জুলেখার মত অসহায় মেয়েকে কঠিন দরবারের মুখোমুখি করতে পারতো? হঠাৎ সম্ভিৎ ফিরে পায় জুলেখা। সে টের পায় কেউ একজন তার চুলের মুঠি ধরে ঝাকাচ্ছে আর বলছে,
কতা কইস নি ক্যা মাগী, কতা ক!
জুলেকার মুখে তখনও কোন কথা বের হয় না। ব্যথায় ককিয়ে উঠে সে অষ্পষ্ট আওয়াজ করতে থাকে, উহ্!
পাবনা

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট