ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৩



ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন

[গত সংখ্যার পর]
শালবনের এই এলাকাটা খুব মায়াবী। শহরের যানজট, কোলাহলের ঠিক উল্টো পৃষ্ঠা। যেখানে নিঝুম নির্জনতা, নিস্তব্ধতা। তবে হঠাৎ হঠাৎ নাম না জানা অনেক পাখি সেই নিস্তব্ধতাকে দূরে ঠেলে বিনামূল্যে গান শুনিয়ে যায়। ভাবতে ভাল লাগছিল, দাদাজান হয়তো এ কারণেই এ স্থানটা পছন্দ করেছেন। এক দিকে নিঃসঙ্গ কুমার জীবন যাপন, অন্য দিকে প্রাকৃতিক নিসর্গে ছোঁয়া। কিন্তু না, তিনি তো গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য এখানে থেকেছেন। এ কয়েক দিনে অনেকবার দাদাজানের লেখা ডায়েরি-খাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখেছি। বুঝতে পারার মতো তেমন কিছু পাইনি। কেবল দীর্ঘ সংখ্যার সমাহার। শত শত খাতায় কেবল অঙ্ক আর অঙ্ক। ডায়েরিগুলোর কভার বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। কিন্তু সে রাতের ঐ লাল বর্ডারের ডায়েরিটা পেলাম না। একটা চাপা কৌতূহল মনের ভেতর থাকলেও কদিন পর তা মুছে গেল। পরিবেশের সাথে সখ্য তৈরিতে মন দিলাম।
মিজান মিয়ার সাথে নানা ধরনের গল্প-গুজব করে দিন যাচ্ছে। ভূত ও সাপের অসংখ্য গল্প সে মুখস্থ বলতে পারে। তার দাবি গল্পগুলো সত্যি! রেফারেন্স হিসেবে বাবা, দাদা কিংবা গাঁয়ের অমুক-তমুকের মুখে শোনা বলে উল্লেখ করে। তবে এটা সত্য মিজান মিয়া গল্প বলতে পারদর্শী। একদিন তার বাবার একটি ভুতুড়ে গল্প শোনাল। গল্পটি সংক্ষেপে এ রকম, একদিন মিজান মিয়ার বাবা শাজান মিয়া হাট থেকে ফিরছিল। হঠাৎ দেখতে পেল, একটি ছোট বাচ্চা রোড থেকে খানিকটা দূরে তালগাছের পাশে শোয়ে আছে। চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর মুখ, দেখলেই মায়া জাগে। শাজান মিয়াকে দেখে বাচ্চাটি হামাগুড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বাজারের ব্যাগটা বাম হাতে নিয়ে শাজান মিয়া বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো। মাছ, সবজি-তরকারি ভরা ব্যাগটা বেশ ভারি। এভাবেই হাঁটতে লাগল।
শাজান মিয়া প্রথমেই ভাবল, হয়তো বাচ্চাটি আশপাশের কারোর। হামাগুড়ি দিতে দিতে নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে চলে এসেছে। এখানে পড়ে থাকলে বাঘে-শেয়ালে খেয়ে ফেলবে। বরং কারোর বাড়িতে খবর দেয়া উচিত।
প্রায় এক কিলোমিটার পথ হাঁটার পর কয়েকটি বাড়ি-ঘর। শাজান মিয়ার ডাকাডাকিতে লোকজন দরোজা খুলল। শাজান বেড়া পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে যাবে। তখন মনে হলো বাচ্চাটিকে কেউ টেনে ধরেছে, চেষ্টা করেও এগোতে পারল না। বাধ্য হয়ে পেছনে তাকাল, শাজান মিয়া দেখল বাচ্চাটির বাম পা বিশাল লম্বা, দূরত্ব ঠিক ঐ তালগাছের গুঁড়ি পর্যন্ত। এ দৃশ্য দেখে শাজান মিয়া কেঁপে ওঠল! মুখের দিকে তাকাতেই বাচ্চাটি বিশ্রী হাসি দিলো। সাথে সাথে শাজান মিয়া জ্ঞান হারাল। ঐ বাড়ির মানুষজন তার মাথায় পানি দিয়ে সেবা করল। সে রাতে তাঁর জ্ঞান ফেরে নি। জ্ঞান ফিরল পরদিন দুপুরে। জানা যায় বাজারের ব্যাগে সবজি-তরকারি ঠিক থাকলেও, কোনো মাছ পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে এ ঘটনা এলাকার সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। মিজান মিয়া গল্প শেষে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হা-হুতাশ ভঙ্গি করে ওঠে। গল্পটি শুনে আমি সামান্য ভয় মাখা মজা পেয়েছিলাম, তবে বিশ্বাস করতে পারিনি।
চার দিন হয়ে গেল এখানে এসেছি। আব্বু আমার প্রতি কিছুটা অবাক হলো। বিগত কয়েকবছরে শহরের বাইরে এভাবে একা কোথাও থাকিনি। আমি নিজেও জানি না, কী ভালোলাগা থেকে এ বনবাস করছি। ফেসবুকে, ইমোর ম্যাসেঞ্জারে বন্ধুরা নানা ধরনের মন্তব্য ছুঁড়ছে। উৎসব সেদিন খুলনা থেকে ফোনে বলল, রামের বনবাস কাটাতে এসেছিস ভাল কথা। কিন্তু সাথে একজন সীতাকে জোগাড় করে নিসনি কেন? রাবণ এসে কাকে হরণ করবে শুনি? সাথে একজন লক্ষণ ভাই তো থাকা উচিত, তারপর হনুমান-বানর বাহিনী। আচ্ছা, লক্ষণ ভাই হিসেবে না হয় আমিই থাকলাম। একজন সীতাকে যে চাই-ই চাই, এভাবে আর কতদিন থাকবি?
আমি ওর কথা হেসে উড়িয়ে দিলাম। তবে আজ হঠাৎ নীলার কথা মনে পড়ল। একটা চনমনে হাওয়া এসে আমাকে বাস্তবিক জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো। চিৎ হয়ে বিছানায় শোতেই বুকে মৃদু চাপ অনুভব করলাম। বাধ্য হয়ে সোজা বাইরে গেলাম। মিজান মিয়াকে ডাকলাম। সে ছুটে এল।
কী, ব্যাপার স্যার? আপনি অসুস্থ?
সামান্য শ্বাসকষ্টের মতো লাগলেও, আমি মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম।
না, ঠিক আছি। এক কাপ চা দিতে পারবে?
জ্বি, স্যার দিতাছি এখনই।
বুনোঘাসে ভরা উঠোনে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে চেয়ারে বসে আছি। এখানে আসার পর কিছু প্লাস্টিকের ফার্ণিচার কিনেছি। একজোড়া চেয়ার ও একটি টী টেবিল দিয়ে সবুজ উঠোনটাকে সাজিয়েছি। যাতে মিজান মিয়ার গল্পগুলো সুবিধা মতো শুনতে পারি। বিশ মিনিট পর মিজান মিয়া চা দিলো। চায়ে চুমুক দিতেই তন্দ্রা টুটে গেল। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ আমার নাকে নাড়া দিলো, চোখ খুলতেই নীলাকে দেখতে পেলাম। সে আমার সামনে চেয়ারে বসে আছে।
নীলা বলে ওঠল, কেমন আছ সোম?
আমি তড়িধড়ি চমকে ওঠলাম।
তুমি কোথা থেকে নীলা?
এই তো বেড়াতে এসেছি। তোমার কথা শুনেই ছুটে এলাম।
সত্যি? তুমি আমাকে এখনো ভালবাস?
কেন বাসব না? তোমাকে জীবনে-মরণে কখনোই আমি ভুলতে পারি না।
নীলা আমার সামনে বসে আছে, এ সত্যটা কেমন মিথ্যে ঠেঁকছিল। তাই ওকে বললাম, তোমাকে একটিবার ছুঁয়ে দেখি?
নীলা হাসল।
আমি তোমার কল্পনা নই। ছুঁয়ে দেখো। তোমাকে চমকে দেবার জন্যই চুপিচুপি এখানে আসা।
নীলা হাত এগিয়ে দিতেই, ওর হাত চেপে ধরলাম। না, কল্পনা নয়। সত্যিই তো নীলা আমার সামনে বসা।
তেরো-চৌদ্দ বছর পর নীলাকে কাছে পেয়েছি। কেন পেয়েছি জানি না। নীলা কি ওর ভুল বুঝতে পেরেছে? সে কি আবার আমার কাছে ফিরে আসতে চায়? তাহলে ওর আমেরিকান স্বামী কি ওকে ডিভোর্স দিয়েছে? নানা প্রশ্ন আমাকে ঘিরে ধরল। আমি এক দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে আছি। নীলা আবার হাসল।
শুধু তাকিয়েই থাকবে কিছু বলবে না?
নীলা আমার হাত ধরে মৃদু ঝাঁকি দিলো। আমি আবারো চমকে ওঠলাম।
হ্যাঁ, নীলা, আমি তোমাকে দেখছি।
নীলা আবারও হাসল। ওর কপালের চুলগুলো চোখের উপর আসতেই, ডান হাতের মধ্যমা আঙুল চুলগুলোকে সরিয়ে দিলো।
চা ঠা-া হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নাও।
হ্যাঁ, তাই। আচ্ছা, নীলা তোমাকে এককাপ চা দিতে বলি?
হ্যাঁ, দিতে বলো।
আমি মিজান মিয়াকে ডেকে বললাম, আরেক কাপ চা দিতে। কিছুক্ষণ পরেই সে চা দিয়ে গেল। ততক্ষণ আমি নীলার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
নাও নীলা, চা নাও।
নীলা ডান হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা টেনে কাছে নিলো। ওর ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রভাগে একটি তিল ছিল, সেটি অনেক বছর পর আবার দেখতে পেলাম। আমি এ তিলটির নাম দিয়েছিলাম শুকতারা।
একটি কথা আমার মনের ভেতর বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে। এবার আমি বলেই ফেললাম, নীলা তুমি কি আমার কাছে ফিরে এসেছে? আমার সাথে আবার ঘর বাঁধবে?
নীলা কিছুই বলল না। আমি আবার বললাম, চলো আমরা আবার বিয়ে করি। এখানেই ঘর বাঁধব, এই বনের ভেতর থাকব। কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। এই বাড়িটা আমরা দু’জন মিলে সাজিয়ে তুলব। দাদাজান বাড়িটি আমার নামে উইল করে দিয়েছেন।
নীলা বলল, সোম, আমি তোমার কাছেই ফিরে এসেছি। চিরদিনের জন্য আর কখনো তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। তোমার-আমার ভালবাসাই চিরন্তন সত্য। আমাদের তো একবার বিয়ে হয়েছে, আবার নতুন করে কী প্রয়োজন বিয়ে নামের ছেলেখেলার?
নীলা, তুমি সত্যিই আমার সাথে থাকবে?
হ্যাঁ, সোম। আমি রোজ তোমার কাছে আসব। এ বাড়িটি আমরা সাজিয়ে, গুছিয়ে তুলব। তারপর একদিন আমাদের ফুলশয্যা হবে।
আমি খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে তৃপ্তির হাসি ঠোঁটে টানলাম।
নীলা বলল, আজ আসি, বনবিভাগের গেস্ট হাউজে আমি ওঠেছি। কাল আবার আসব।
নীলাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। নীলা হেঁটে যাচ্ছে। ওর গোলাপি রঙের শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে। পারফিউমের ঘ্রাণটা এখনো আমার নাকে লেগে আছে। আবার চেয়ারে গিয়ে বসলাম। একটা ভাললাগা আমাকে ঘিরে রেখেছে।
হঠাৎ মিজান মিয়া বলে ওঠল, স্যার, রাতে কী খাবেন? বাজারে যাব।
খানিকটা চমকে ওঠলাম। অতঃপর মিজান মিয়ার হাতে পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বললাম, তোমার যা খুশি কিনে নিয়ে এসো।
মিজান মিয়া বাজারে চলে গেল। নীলার কথা ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা নেমে এল।
নীলা ছিল আমার কলেজ ফ্রে-। একই সাথে পড়তাম, আড্ডা দিতাম, ঘুরতাম, সিনেমা দেখতে যেতাম, সত্যি বলতে ওকে আমি ভালবাসতাম। কিন্তু কথাটি একদিনও মুখ ফুটে বলতে পারিনি। তবে নীলা নিজে থেকে বুঝে নিয়েছিল। তাই আমার সাথে মিশতে ওর কোনো সংকোচ ছিল না। দাদাজানের মৃত্যুর কিছুদিন পরের কথা। একদিন নীলা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমাকে বাঁচাও সোম, বাবা-মা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আমি কথাটি শুনে একটাই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি, তা হলো পালিয়ে যাওয়া। বন্ধুদের সাহায্যে আমরা বিয়ে করে ফেললাম, তারপর পরিকল্পনা মতো পালিয়ে গেলাম। কয়েকমাস এই শহরে ঐ শহরে কাটিয়ে নীলাকে সাথে নিয়ে বাড়িতে হাজির হলাম। আম্মু আমার প্রতি খুব রাগান্বিত ছিলেন, বিছানায় শুয়ে থেকে আমাকে অবাধ্য বলে বকাঝকা করলেন। আব্বু, আমাদের বরণ করে নিলেন। কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করা, ঠিক হয়নি। এই টপিকের উপর তিনি এক ঘন্টা লেকচার দিলেন। তারপর সুখেই আমাদের দিন কাটছিল। আব্বু-আম্মু আমাদের মেনে নিলেও, নীলার পরিবার ওকে গ্রহণ করেনি। নীলার আপনজন বলতে আমি ব্যতীত আর কেউ রইল না। আমাদের ছোট্ট সংসার একদিন দু’দিন করে এগোতে লাগল। দু’বছর পরেই আমাদের ঘরে একটি মানব পুতুল এল। নীলা সে ফুটফুটে চন্দ্রমুখীর নাম রাখল শশী।
একদিন আমরা ঢাকা থেকে লঞ্চে চড়ে আমার ফুপুর বাড়ি বরিশাল যাচ্ছিলাম। দীর্ঘ পথ লঞ্চের সিটে বসে থাকাটা বোরিং লাগছিল। ঘুমন্ত শশীকে কোলে নিয়ে দু’জনই লঞ্চের ছাদে ওঠলাম। মেঘনা নদীর ঢেউ দেখছি, শশী তখন আমার কোলে বুক জড়িয়ে আছে। আর নীলা গুনগুনিয়ে গান গাইছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে ওর চুল উড়ছে, আমি কাছে গিয়ে নীলার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে আদর করলাম। নীলা উচ্চস্বরে হেসে ওঠল। সে হাসতে হাসতে রেলিঙয়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে। ওর কা- দেখে আমিও অকারণে হাসছি। জানি না কি হলো, হঠাৎ লঞ্চটা কেঁপে ওঠল। প্রথম ঝাঁকুনিটা সামলে নিতে না নিতেই আরেকটা তীব্র ঝাঁকুনি। নীলা রেলিঙ থেকে পড়ে যাচ্ছে দেখে আমি অপ্রস্তুত ওকে ধরতে গেলাম, আর তখনই আরো কয়েকটা ঝাঁকুনি। নিজের অবস্থানটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেল, সরল দোলকের মতো দুলছি। আমার ডান হাতটা নীলাকে ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। একটানা ঝাঁকুনিতেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারল। এক ন্যানো সেকে-েরও কম সময়ের মধ্যে আসা পরের ঝাঁকুনিটা কেড়ে নিলো আমার বাঁ হাতের বাঁধনে বুকে আগলে ধরা শিশু শশীকে। আমার মানব পুতুল চোখের পলকে পানিতে পড়ে গেল। পাথরের টুকরোর মতো মেঘনার জলে মিলিয়ে গেল আমার প্রিয় সন্তান। আমার আত্মজা, আমার অংশ! নীলা আর আমি তাকিয়ে আছি নিচে পানির দিকে, যেখানে ঢেউ জাগছে শশীর ঘুমের মতো নিঃশব্দে। জানি না, তখন আমার চোখ ফেটে জল এসেছিল কিনা।
আমার পুরো পৃথিবী তখন প্রলয়ের বেগে ঘুরছিল। নীলা সেন্স হারিয়ে ফেলল। জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে সে আমাকে খুন করতে চাইত। শশী পানিতে পড়ে যাবার কারণ হিসেবে আমাকে দায়ী করত। একটা সময় ওর মানসিক অবস্থার আশঙ্কাজনক অবনতি ঘটে। মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করালাম, চিকিৎসক জানাল, স্নায়ুতন্ত্র আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে, দীর্ঘ মেয়াদী ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন।
ভাবলাম, এ অবস্থাটা নীলার পরিবারকে জানানো প্রয়োজন। কে জানত এটাই হবে আমার জীবনে চরম ভুল। খবর দেবার পর ওরা হাসপাতালে এল, প্রতিদিনই নীলার সেবাযতœ করছে। কিন্তু নীলার পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও হাসপাতালে গেলাম। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানাল নীলাকে ওর পরিবার নিয়ে গেছে। নীলাদের বাড়িতে যাবার পর, ওর বাবা জানাল, নীলাকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে। ফিরে এলাম।
একবছর পর, নীলার ডিভোর্স পেপার হাতে পেলাম। আমি নীলাদের বাড়িতে গিয়ে ওর সাথে কথা বলতে চাইলাম। নীলার বাবা খুব রূঢ় আচরণ করল, শেষে নীলার সাথে কথা বলার সুযোগ দিলো। নীলা শুধু বলল, আমাকে ভুলে যেও সোম। ডিভোর্স পেপারটা আমার ইচ্ছাতেই পাঠানো হয়েছে।
ফিরে আসার সময় নীলার বাবা বলল, শীঘ্রই নীলার বিয়ে হচ্ছে, তারপর সে বরের সাথে আমেরিকা যাচ্ছে।
এতগুলো বছর পর হঠাৎ নীলার আবির্ভাব আমার জন্য আনন্দ নাকি বিস্ময় আমি জানি না। ভাবনার পরতে পরতে ভাবনার জাল। সে জাল ঠেলে আমি ওঠে আসার চেষ্টা করছি।

 
রাত নটা। দোতলায় দাদাজানের ঘরে গেলাম। ঘরটি পরিষ্কার করার পর থেকে বেশ ভাল লাগছে। আমি যেন আমার কল্পনায় আঁকা দাদাজানের পরশ খোঁজে পাচ্ছি। ঘরটা আকারে মাঝারি ধরনের, আলমারিগুলো উত্তরপাশে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো। পশ্চিম পাশে একটি কাঠের খাট, নকশা আঁকা এ খাটটি নিঃসন্দেহে খুব পুরনো। দক্ষিণ পাশে একটি কাঠের শোকেস, পাশে চেয়ার ও টেবিল। পূর্বদিকে দরোজা ও দরোজার পাশেই একটি জানালা। পশ্চিমপাশে খাটের অপর প্রান্তে আরেকটি জানালা।
সেদিন গুনে দেখেছি আলমারিতে দাদাজানের ডায়েরি সংখ্যা মোট ঊনসত্তরটি। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ মতে দাদাজানের জন্ম ১৯১১ সালে। সেই সাথে ডায়েরিগুলোর সাল দেখে একটি হিসেব কষেছি। সে হিসেব অনুযায়ী, দাদাজান বিশ বছর বয়স থেকে ডায়েরি লেখা শুরু করেছেন, মৃত্যুর আগেরদিন সে লেখা বন্ধ করেছেন। প্রতিটি ডায়েরির গায়ে সাল উল্লেখ করা রয়েছে। ডায়েরির কভারগুলো একই রকম নীল রঙ, বর্ডার কালো। আলমারির উপরের তাকের ডানদিকে প্রথম ডায়েরিটার গায়ে ১৯৩১ সাল লেখা, তারপর পর্যায়ক্রমে সালগুলো এগিয়েছে, নিচের সর্বশেষ তাকের বামপাশের ডায়েরিটির গায়ে লেখা ২০০০ সাল। সাল অনুযায়ী হিসেবে করলে ডায়েরি সংখ্যা হওয়া উচিত সত্তরটি, কিন্তু আলমারিতে মোট ডায়েরি ঊনসত্তরটি। হঠাৎ চোখে পড়ল, নিচের তাকের উপরের তাকটিতে একস্থানে সামান্য ফাঁকা। যেখানে অনায়াসে একটি ডায়েরি রাখা যাবে। একটিবার মনে হলো এখানে কি একটি ডায়েরি ছিল, যা এখন নেই? ফাঁকা স্থানটার দুপাশের ডায়েরি দুটির সাল লক্ষ্য করলাম, ডানপাশে ১৯৮৪ বামপাশে ১৯৮৬। অর্থাৎ ১৯৮৫ সালের ডায়েরিটি অনুপস্থিত। আমার মন বলছে, ঐ ডায়েরিটি হয়তো দাদাজান ভুলবশত অন্য কোনো আলমারিতে রেখেছেন। বইপত্রের আলমারিটা খুলে দেখতে পেলাম তাক ভর্তি সারি সারি বই। বইগুলোর পাশে ডায়েরি জাতীয় কিছু নেই। নিচের দিকে কয়েকটা ড্রয়ার রয়েছে। একটি ড্রয়ার খুলতেই কিছু ভারতীয় রুপি চোখে পড়ে। মহাত্মা গান্ধীজীর ছবি সম্বলিত নোট। অন্য একটি ড্রয়ারে থরে থরে অনেকগুলো ছোট ছোট বইপত্র সাজানো। একদম নিচের ড্রয়ারে একটি ছোট্ট বালুঘড়ি খুঁজে পেলাম, পাশে বড় একটি জ্যামিতি বাক্স। বাক্সটা খুলে দেখতে পেলাম, কাঠের চাঁদা, পেন্সিল কম্পাস, কাঁটা কম্পাস, ত্রিভুজ ও দুটো গোলাকার নীল রঙের পাথর। পাথরদুটো হাতে নিয়ে দেখলাম। ভারি সুন্দর! দেখতে একই রকম, ভেতরটা উজ্জ্বল! পাথর দুটোর মধ্যে কেবল একটি পার্থক্য, তা ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়। একটি পাথরের ভেতরে একটি দাগ, অন্য পাথরটির ভেতরে দুটো দাগ। সে দাগগুলো জ্বলজ্বল করছে। এটা যে মূল্যবান পাথর তা আমি শতভাগ নিশ্চিত। আলমারি বন্ধ করে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। ডায়েরি খুঁজে পাবার আশা ইস্তফা দিলাম। পাথর দুটো নিয়ে মার্বেলের মতো খেলার ছলে সময় কাটাতে লাগলাম। রাত বেড়েই চলেছে, একটা পাথরের গায়ে আরেকটা পাথর টোকা দিচ্ছি। খেলতে খেলতে হঠাৎ একটি পাথর গড়িয়ে টেবিল থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। নিচে পড়েই পাথরটা ¯্রােতের মতো ছুটে গেল খাটের তলায়। দেরি না করে খাটের তলায় যাবার চেষ্টা করলাম, কষ্ট হলেও সেখান থেকে পাথরটা কুড়িয়ে নিলাম। মাথা উঁচু করতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ল খাটের গায়ে খোদাই করা লেখার দিকে। সেখানে লেখা “ক্রাইটেরিয়ন ফর্মুলা-১৯৬৯”। মাথা নিচু করে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে দুটো পাথর একসাথে টেবিলের উপর রাখলাম। গায়ে ধূলি-বালি লেগে যাওয়াতে অস্বস্তি লাগছিল। দেরি না করে দ্রুত গোসল করে নিলাম।
দাদাজানের নামটি গোপন রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা করা হলে, কিছু কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল কালাম মজুমদার। তাঁর আরেক নাম “ক্রাইটেরিয়ন”। তবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত ডক্টর রিয়ন সাহেব নামে।
রাতের খাবার খেয়ে ঘুমুতে গেলাম। ভাবতে লাগলাম নীলাকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখব। দু’চোখ বুজতেই আমার স্বপ্নের জগতে সত্যিই নীলা চলে এল।
নীলা আমাকে নিয়ে নদীর পাড়ে গেল। কাশবন, ঘাসবন ঘুরে বেড়াচ্ছি। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো বটগাছে অসংখ্য পাখি পাকা বটফল ঠোঁকরাতে ব্যস্ত। একটি লাল বটফল আমার পায়ের কাছে পড়ল।
হঠাৎ নীলা বলে ওঠল, সোম, ওটা খাবে না প্লিজ, এই ফলে বিষ আছে। তোমাকে মারার জন্য এই বিষমাখা ফল ছুঁড়ে দিয়েছে।
নীলার কথা শুনে আমি হেসে ওঠলাম, আমার হাসি দেখে নীলার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম, বললাম, পাখিদের ফল আমি খেতে যাব কেন? আর ঐ ফলে বিষ থাকবে এ কথাটাই বা তোমাকে কে বলল?
নীলা থর থর কাঁপছে, ভয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ওকে অভয় দিয়ে বললাম, আমি তো আছি। আর কী এমন হলো তোমার, অকারণে ভয় পাচ্ছ কেন?
নীলা বলল, তোমাকে কেউ যদি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, তাই ভয় হচ্ছে। চলো, সোম আমরা নদীর ঐ পাড়ে চলে যাই।
আমি বললাম, কেন এপাড়ের জায়গাটাতো সুন্দর, দেখো কত সুন্দর কাশবন, শুভ্রতার ঢেউ, আর ওপাড় শূন্য, ফাঁকা।
নীলা বলল, না সোম, এপাড়ে এক মুহূর্তও নয়, এই কাশবনে ছদ্মবেশী ঘাতক লুকিয়ে আছে।
আমি বুঝানো সত্ত্বেও নীলা বার বার অনুনয় করে বলছে, ঐ পাড়ে যেতে। আমি রাজি হলাম, মাঝ নদী থেকে মাঝিকে ডেকে এনে নৌকায় ওঠলাম।
¯্রােতের পিঠে নৌকা ভেসে যাচ্ছে, শোঁ শোঁ বাতাসের সঙ্গীত কানে বাজছে। নদীর এপাড়ে এসে নামার পর খুঁজে পেলাম অন্য ঠিকানা। এটা তো দেখছি আমাদের কলেজ ক্যাম্পাস। একি আমি আটত্রিশ বছর বয়স থেকে হঠাৎ আঠারো বছরের কিশোর হয়ে গেলাম, এটা কী করে সম্ভব? নীলার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়ে থেকেই ভাবছি, এসব কেবলই স্বপ্ন, স্বপ্নে সবই সম্ভব। বুঝতে পারছি এসব মিথ্যে, অবচেতন মনের খেয়াল। বার বার নিজেকে বলছি, এটা ধোঁয়াশা স্বপ্ন, তাছাড়া আমি এখন দাদাজানের বাড়িতে ঘুমিয়ে আছি।
ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে হঠাৎ আমাকে তনিমা ডেকে ওঠল, এই হাবা সোম, এদিকে আয়। নীলা তোর সাথে কথা বলবে।
আমি তাকালাম সামনের দিকে, নীলা আমাকে ছেড়ে ওদের মাঝে চলে গেছে। সবার সাথে কথা বলছে। নীলার পরনে কলেজ ড্রেস, চোখে চশমা। অথচ কিছুক্ষণ আগের নীলা ছিল সাঁইত্রিশ বছর বয়সী মহিলা, ওর চোখে চশমা ছিল না। জানি না কেমন করে আমিও ওদের ¯্রােতে মিলিয়ে গেলাম।
আমরা সবাই আড্ডা দিচ্ছি, হৈ চৈ ছুটোছুটি করছি। আমার পাশে সবাইকে দেখতে পাচ্ছি, উৎসব, সুজাত, ¯েœহা, রিমু, স্মৃতি, আরতি, সৌরভ, সুজান আরো অনেকে। খানিকটা দূরে তনিমা ও নীলা। আমি সবাইকে ডিঙিয়ে নীলার কাছে গেলাম। তনিমা সাহস যুগিয়ে বলল, তুই নীলাকে কী যেন বলবি? বল
আমি বলতে যাচ্ছি, নীলা... আমি তোমাকে...
বলা হলো না, ঘণ্টা বেজে ওঠল। ফিজিক্স ক্লাস শুরু হলো। আলাউদ্দিন স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। রোল কল শেষে সেকে- সেমিস্টার পরীক্ষার খাতা দেখাচ্ছেন। আমার বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছে। আমি আল্লাকে ডাকছি। নানার কাছে শেখা মসিবতের দোয়া পাঠ করছি। লা-হাওলা ওলা-কুয়াতাই ইল্লাবিল্লাহি আলি-উল আমি। এক সময় স্যার ডেকে ওঠলেন, সোম মজুমদার, আমি এগিয়ে গেলাম, স্যার মুখ বিকৃত করে বললেন, পেয়েছে তেরো। গণিতবিদের নাতি..। ক্লাসে সবাই হেসে ওঠল।
লজ্জ্বায় ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম। আমাকে বেরুতে দেখে নীলাও চলে এল। আমরা দু’জনই ছাদে গেলাম। আমি সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার কু-লী সৃষ্টিতে মন দিলাম। আর নীলা আকাশের নীল দেখছে, আমি নীলার মায়াবী ফর্সা মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ওকে তীব্র সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখ দু’টোর সৌন্দর্যেও কোনো উপমা খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎ গান গেয়ে ওঠলাম,
....নীল নীল নীলাঞ্জনা...চোখদুটো টানা টানা,
কপালের ঐ টিপ যেন জোনাকির দীপ,
প্রেমে পড়েছি আমি করো না মানা।

আমার গান শুনে নীলা মন্ত্রমুগ্ধের মতো নাচতে লাগল। সিগারেট ফেলে একটানা গেয়েই চলেছি। দু’চোখ বন্ধ করে দরদ দিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ চোখ মেললাম, দেখলাম নীলা নাচতে নাচতে একদম ছাদের কিনারে চলে গেছে, চিৎকার করে ওঠলাম...নীলা...আ...। ততক্ষণে নীলা ছাদ থেকে মাটিতে পড়ে লুটিয়ে পড়েছে। উপর থেকে তাকিয়ে দেখলাম, ওর মাথা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে। কৃষ্ণচূড়া গাছে একটা কাক একটানা ডেকে যাচ্ছে। নিচে নীলার মৃতদেহ ঘিরে একটা জটলা তৈরি হয়েছে। মুহূর্তে আমার বাঁচার ইচ্ছে ফুরিয়ে গেল। নীলার মতো আমিও ছাদ থেকে নিচে পড়ে যেতে চাইলাম। ছাদের কিনারে গিয়ে গা ভাসিয়ে দিলাম। কিন্তু আমি মাটিতে পড়লাম না, আকাশেই রয়ে গেলাম। আমার ডান চেপে ধরে আছেন দাদাজান। দাদাজান বললেন, বুঝে শুনে কেউ এমন বোকামি করে? আমি চুপ করে আছি।
দাদাজান আমাকে মাটিতে নিয়ে গেলেন। বললেন, এটা নীলা নয়, এটা মরীচিকা।
তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই তো, এটা তো এক অচেনা তরুণীর লাশ। তাহলে আমার নীলা কোথায়?
দাদাজানের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নীলাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি...নীলা...আ...আ। নী...ল..আ...।
ঘুম ভেঙে গেল।
শুনতে পেলাম দোতলার ঘরে শব্দ হচ্ছে। কেউ খাট, চেয়ার বা টেবিল নাড়াচাড়া করছে। স্বপ্নের ঘটনা ভুলে বাস্তবতায় ফিরে এলাম। মনে পড়ল, গত এক সপ্তাহ আগে এখানে আসার প্রথম দিন এমন ঘটনা ঘটেছিল। দোতলার শব্দে আমার ঘুম হারিয়ে যায়। প্রথমদিন মিজান মিয়াকে সন্দেহ হলেও, এই কদিনে তার সরলতায় সে সন্দেহ মুছে গিয়েছিল। তাকে বাইরে থাকতে অসুবিধা হয় কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে এক বাক্যে বলেছিল, না। তারপরও তার প্রতি নতুন করে সন্দেহের জাল বুনতে লাগলাম। এমনও তো হতে পারে, তার কাছে নতুন তালার একটি ডুপ্লিগেট চাবি রয়েছে। যা দিয়ে সে ঘরের ভেতর ঢুকে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মনে হল, নীল পাথরের কথা, পাথর দুটো যতœসহকারে ব্রিফকেসে রেখেছি। আচ্ছা, এমন মূল্যবান পাথর কি সে ঘরে আরো রয়েছে? থাকাটা তো অস্বাভাবিক কিছু না।
দ্রুত উপর তলায় ওঠে গেলাম। করিডোর ক্রস করার পর সবকিছু শান্ত-স্বাভাবিক। দাদাজানের ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলে দিলাম। চারপাশ বাজ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম। না, কেউ নেই।
হুট করে আলমারি খুলে ডায়েরিগুলো গুনতে ইচ্ছে হলো। গুনতে গুনতে চোখে পড়ল, ১৯৮৪ সালের ডায়েরিটা নেই। বামপাশের ডায়েরিটি ১৮৮৫, তারপর ১৯৮৬ সালের। হতভম্ব হয়ে গেলাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না, কেউ একজন এ ঘরে ঢুকে ১৯৮৫ সালের ডায়েরিটা রেখে, ১৯৮৪ সালের ডায়েরিটা নিয়ে গেছে। ব্যাপারটা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। কিভাবে এটা সম্ভব? আর মিজান মিয়াই বা কেন এ কাজ করবে? সে তো পড়াশোনা কিছুই জানে না।
কিছুক্ষণের মধ্যে তীব্র গরম অনুভূত হলো, ঘরে টিকে থাকতে পারলাম না। দ্রুত আলমারি বন্ধ করে, তালা আটকিয়ে চলে এলাম। গা বেয়ে দর দর ঘাম ঝরছে। গরম সহ্য করতে না পেরে দ্রুত গোসল করে নিলাম। দু’চোখ জ্বলছে, ঘুমুতে পারলাম না। কেন যেন ইচ্ছে হলো আবার দাদাজানের ঘরে যেতে। চাবি নিয়ে সোজা দোতলায় চলে গেলাম। করিডোর ক্রস করছি ধীরে ধীরে, জানালার কাছে এসে ভেতরে তাকালাম, মোবাইলের টর্চ ফেলতেই চোখে পড়ল, টেবিলের উপর একটি ডায়েরি। সেই লাল বর্ডারের ডায়েরি, যা আমি প্রথম রাতে দেখেছিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো, ভেতরে কেউ একজন আছে। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটি ধোঁয়াশা কিংবা ছাই রঙের হাত এগিয়ে আসছে ডায়েরিটির দিকে। ভালভাবে দেখার চেষ্টা করলাম, কারোর দেহ চোখে পড়ল না। খানিকটা ধাক্কা খেলাম। সে হাত ডায়েরিটি নিয়ে উধাও হয়ে গেল। সামান্য সময়ের জন্য আমি নির্বাক! আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। নিজেকে এই বলে সান্তনা দিলাম, নিশ্চয়ই আমাকে কোনো উপায়ে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে। যেহেতু দরোজা বন্ধ সেহেতু আগুন্তুক এ ঘরেই আছে। চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি এল। চোর বা যাই হোক, লোকটাকে বন্দি করব। দৌড়ে নিচের ঘরে গেলাম, ব্রিফকেসের তালাটি খুলে নিয়ে এলাম। নিঃশব্দে দাদাজানের ঘরের দরোজায় সে তালাটি আটকে দিলাম।
মনে মনে বললাম, মিজান মিয়া হোক আর যেই হোক, এখন বেচারাকে পালাতে হলে তালাটা ভেঙে পালাতে হবে। এমন তো হতে পারে মিজান মিয়া ঘরে ঢুকেছে। বাইরে থেকে কেউ ওকে হেল্প করছে। দরোজায় তালা আটকানো দেখিয়ে আমাকে বোকা বানাতে চাচ্ছে। এবার সে উপায় সফল হবে না। ডবল তালা আটকানো, বের হতে চাইলে ভেঙেই বেরুতে হবে। আর শব্দ হলেই ওকে পাকড়াও করব।
অপেক্ষা করতে লাগলাম। সে শুভক্ষণ আর আসছে না। একবার ভাবলাম, ঘুমুতে যাই। চোর বেচারা যদি পালায় তবে তালা ভেঙেই পালাবে। আজকেই ওর লাস্ট চান্স। আর চুরির মতলব নিয়ে এখানে আসতে পারবে না। আগামীকাল আমি নিজেই নতুন তালা কিনে দরোজায় লাগাব। মিজান মিয়াকে প্রয়োজনে চাকুরিচুত্য করব। এসব ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে এলাম।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট