ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : পর্ব ০৪




অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
৭.
ক্লাশ শেষ। সবাই বই-খাতা গুটিয়ে ব্যাগে ভরছে। তখন তূর্য বলল, তুমি একটু বসো।
তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নিশ্চয় কোনো ভুল-চুক হয়ে গেছে। নির্ঘাত এবার বকা খেতে হবে। তূর্য স্যার মিষ্টি মিষ্টি ভাষায় কি যে কঠিন বকা দেয়! যাকে বলে মিশ্রির ছুরি। সেদিন ফয়সালকে মিশ্রির ছুরি বিঁধিয়ে দিলো না? শুধু আমার ব্যাগ টান দিয়ে বলেছিল, তোমার সেলফোনটা একটু দাও তো। আর অমনি শুরু করে দিলেন, এ্যাই ছেলে, তুমি ক্লাশের মধ্যে ওর ব্যাগ টানাটানি করছো কেন? বেশি বড় হয়ে গেছো না? এটা ইউনিভার্সিটি না। মনে রাখবে স্কুলে পড়ো। তুমি আর কখনো ওর আশেপাশের বেঞ্চিতে বসবে না। পাকামো আমি একদম পছন্দ করি না।
কিন্তু আজ ভুলটা কি হলো সে তা বুঝতে পারছে না। আজ তো তূর্য স্যার ক্লাশে কোনো পড়া ধরেন নাই। শুধু এ্যাকটিভ টু প্যাসিভ ভয়েস এর রুল লিখে দিয়েছেন। তাহলে ?
সে ফ্যাকাশে মুখে বসে রইল। সবাই একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্লাশ থেকে। সবাই বেরিয়ে গেলে সে ক্লাশে একা। না, ঠিক একা নয়। সে আর তূর্য। তূর্য একটু এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে ঠিক তার মুখোমুখি বসল। সে কোনো কথা বলছিল না কিছুক্ষণ। তাকিয়ে ছিল নিচের দিকে। পাখার বাতাসে তার লম্বা চুলগুলো উড়ছিল। তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিন্দু বিন্দু ঘাম নাকের ডগায়। সে ঘাম দেখে তূর্য স্যারের আবৃত্তি করা একটা কবিতার লাইন মনে পড়ল-নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে টুকু দি বলেছিল/দেখিস, তোর বউ তোকে খুব ভালোবাসবে।
ছেলেদের নাক ঘামলে নাকি বউরা খুব ভালোবাসে। তূর্য স্যারকেও নিশ্চয় তার বউ অনেক ভালোবাসবে। সে গোপনে তূর্যের দিকে তাকাচ্ছিল। তখন তার কাছে তূর্যকে আগের যে কোনো দিনের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছিল।
বেশ একটু সময় পেরিয়ে যাবার পর তূর্য মাথা তুলে বলল, আচ্ছা, তোমার কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে ?
তার মুখ এবার একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল-রক্তশূন্য প্রায়। তূর্য একদিন ক্লাশে বলেছিল, চোখের দিকে তাকিয়ে সে ছাত্র-ছাত্রীদের মনের ভাষা বুঝতে পারে। তা না বুঝলে সে পড়াবে কেমন করে?
নিলয়ের সাথে যে তার ঘনিষ্টতা, অনেকটা প্রেম-প্রেমের ব্যাপার তা বোধহয় সে বুঝে ফেলেছে। অবশ্য নিলয়কে তো সে এখন অতোটা ভাবে না, যতটা ভাবে তূর্যকে। তাহলে কী বুঝলো সে? পরীক্ষার আগে প্রেম-টেম অবশ্যই লেখাপড়ার ক্ষতি সৃষ্টি করে। সে তবু কথাটা গোপন রেখে বলল, জি না স্যার, আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।
তাই বলো। শোন, রাখ-ঢাক না করেই বলছি-প্রথম দেখায়ই তোমাকে আমার ভাল লেগে যায়। প্রতিটি মুহূর্তে আমার সে ভাল লাগা বাড়তেই থাকে। বলবো না, বলবো না করেও শেষ পর্যন্ত কথাটা তোমাকে না বলে পারলাম না। আমি যদি তোমার কাছে ভালোবাসার জন্য হাত প্রসারিত করি, তুমি কি আমার হাত ফিরিয়ে   দেবে?
এবার তার ফ্যাকাশে মুখ রক্ত রঙিন হয়ে উঠল। বুকের মধ্যে কাঁপন। সারা অস্তিত্বময় ছড়িয়ে পড়ল অসম্ভব এক ভাল লাগার অনুভূতি। যেন হাজার বছর বা তারও বেশি সময় ধরে এরকম একটা অনুভূতির জন্য সে অপেক্ষা করছিল। সে সহসা মুখে কিছু বলতে পারছিল না।
তূর্য বলল, তোমার যদি আপত্তি থাকে......আমি জোর করছি না......তুমি ভেবে দেখো.....।
না না, সমস্যার কিছু নেই স্যার।
কাউকে ভাল লাগা নিশ্চয় অন্যায় কিছু নয় ?
অন্যায় হবে কেন ?
ভাল লাগা, ভালবাসা আছে বলেই তো পৃথিবীটা এত সুন্দর।
ঠিক তাই।
কখন যে কার, কাকে ভাল লেগে যাবে তা কেউ জানে না।
ঠিক তাই।
এতদিন ধরে পড়াচ্ছি, কত মেয়েকেই তো পড়ালাম, অথচ তোমাকে দেখেই......।
ঠিক আছে স্যার।
তাহলে তুমি আমাকে একসেপ্ট করছো?
কেন করবো না স্যার? আপনাকে একসেপ্ট না করার কোনো কারণ আছে বলুন? কিন্তু আমি কি আপনার যোগ্য? আপনি এত কিছু......।
এরকম কোনো কথা বলো না প্লিজ। পৃথিবীর সবাই সবার যোগ্য যদি হৃদয়ে নিখাদ ভালোবাসা থাকে। ভালোবাসাই ভালোবাসার যোগ্য। অন্য কিছু দিয়ে ভালোবাসার যোগ্যতা মাপা ভুল।
আপনি অনেক সুন্দর কথা বলেন স্যার। ঠিক আছে, আসি স্যার।
বাসায় ফিরে তার মনে হতে লাগলো, কে যেন তার দুই হাতে অদৃশ্য দুটি পাখা লাগিয়ে দিয়েছে। সে এরুম থেকে ওরুমে উড়ে উড়ে চলছে যেন। অতি দুঃখে মানুষ খেতে পারে না। অতি সুখেও কি তাই হয়? কোচিং থেকে ফেরার পর তার কিছুই খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তূর্যের ভালোবাসা পাবার পর তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা যেন সব মিটে গেছে। জগতের সব চাওয়া-পাওয়াও যেন পূরণ হয়ে গেছে। সে যেন দিশেহারা। কি করবে, না করবে তা কিছুই বুঝতে পারছে না। একবার টিভি খুলে, আবার বন্ধ করে। সিডি প্লেয়ারে একটা গান চালু করে, গানটা এক লাইন বাজতে না বাজতেই বন্ধ করে দেয়। একটা বই চোখের সামনে খুলে ধরে, পর মুহূর্তেই বইটা ছুড়ে ফেলে দেয় খাটের উপর। রান্না ঘরে গিয়ে অকারণে কুলসুমকে ধাক্কা দিল। কুলসুমের হাত থেকে চামচ কেড়ে ভাজিতে নাড়া দিল। চুলার আগুন বাড়া-কমা করল কয়েক বার। কুলসুম বলল, কী করেন ? আগুন বাড়ান ক্যান ? পুইড়া যাইব তো!
পুড়–ক। পোড়া ভাজি খাব। পোড়া ভাজি খেয়েছিস কখনো ? দারুন টেস্ট! মিষ্টি আলু পোড়ার মতো লাগে।
তারপর সে গরম কড়াইতে হাত ছুইয়ে আগুনের ছ্যাঁকা খেয়ে কানের লতিতে হাত ছোঁয়াল। কুলসুম বলল, ছ্যাঁকা খাইছেন ?
কিসের ছ্যাঁকা ? আমাকে ছ্যাঁকা দেবে কে? আমার পেছনে ঘোরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছেলেরা। আমিই যাকে খুশি ছ্যাঁকা দিব।
আফা, আপনের কি হইছে কন দেহি? নিলয় ভাই আসবো?
ধ্যাত তোর নিলয় ভাই! ও একটা গেঁয়ো ভূত-খ্যাত। চলবা, করবা, ধরবা করে কথা বলে।
কুলসুম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার মুখে। একদিন সে নিলয়কে গেঁয়ো বলাতে রামঝারি খেয়েছিল।
তার উৎফুল্লতা বাবা-মা’র চোখও এড়ায় না। সন্ধ্যায় মা বলেন, পরীক্ষার তো আর বেশি দেরি নাই। তোমাকে খুব উৎফুল্ল লাগছে। যারা সারা বছর ঠিকমতো লেখাপড়া করে না, পরীক্ষা যত কাছে আসে তাদের উদ্বিগ্নতা তত বেড়ে যায়, তারা ভয়ে তত কুঁকড়ে যায়। আর যারা ঠিকমতো লেখাপড়া করে, পরীক্ষা যত কাছে আসে তাদের আনন্দ তত বেড়ে যায়। তোমাকে দেখেই সেটা বুঝতে পারছি। আমারও পরীক্ষার আগে এমনটিই হয়েছিল। আমার মতোই আমার মেয়েটা সারা বছর মন দিয়ে লেখাপড়া করেছে।
জি মা।
তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা। তুমি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে।
জি মা।
তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান।
জি মা।
আমরা জানি, তুমি আমাদের স্বপ্নকে পায়ে দলতে পারো না।
জি মা।
কী জি মা, জি মা করছো! এখানে কি জি মা বলা যায়?
রাতে বাবাও বললেন একই রকম কথা। সে বাবার কথার পৃষ্ঠেও কয়েক বার ‘জি বাবা’ বললো। আসলে সে বাস্তবিক কারও কথাই মন দিয়ে শোনেনি। তার মনের ভেতর হাজারটা প্রজাপতি হাজার রঙের পাখা মেলে দিয়েছে। হাজারটা পাখি হাজার সুরে গান গাইছে। কারো কথা কি শোনার মত অবস্থা মনের আছে?
রাত এগারোটা। ধরা যায় সে কিছুই খায়নি। তার কন্ঠ কেমন শুকিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর পর সে এক ঢোক পানি খাচ্ছে। কুলসুম ভাত-তরকারি তার ঘরে রেখে গেছে। সেগুলো ঢাকা পড়ে আছে। খাবারে সে মন বসাতে পারছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে, কখন রাত শেষ হয়ে ভোর আসবে। ভোর শেষ হয়ে সকাল। নয়টা বাজলেই সে কোচিং-এ ছুটে যাবে। দশটায় তূর্য স্যারের ক্লাশ।
বেজে উঠল ফোন। অপরিচিত নাম্বার। সে ভুরু কুঁচকে তাকালো ফোনের দিকে। অপরিচিত কারও সাথে তার এখন কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার সমস্ত অস্তিত্ব এখন শুধুই কথা বলছে তূর্যের সাথে। তবু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া-ধরি না। দেখি কে। অপ্রয়োজনীয় হলে কেটে দেব।
ফোন রিসিভ করতেই কর্ণ কুহুরকে অবশ করে দেবার মত সুন্দর একটা কন্ঠ, কেমন আছো তুমি ?
যেন এফএম রেডিওর লাভ গুরুর কন্ঠ! সে প্রথমটায় কিছু বলতে পারছিল না। কন্ঠটা আবার বলল, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না?
ঠিক.....মানে.....।
প্রতিদিন যার কথা শোন.....আশ্চার্য!
আপনি কি.......... ?
আচ্ছা, একটা কবিতা শোনাই, তারপর দেখ চেনা যায় কি না-ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/ বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে .........।
স্যার আপনি! আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায় ?
তোমার নাম্বার পাওয়া বুঝি খুব কঠিন? কোচিং-এ আর কাউকেই কি তুমি তোমার নাম্বার দাওনি?
তাই বলেন।
কী করছিলে? লেখাপড়া করছিলে?
হ্যাঁ, প্যারাগ্রাফ পড়ছিলাম-দ্যা মুন লিট নাইট।
ভেরি ইম্পর্টেন্ট ফর দিস ইয়ার। ডিসটার্ব করলাম তাহলে?
না না, কি যে বলেন স্যার! মুন লিট নাইট আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। এখন একটু রেস্ট নেবো ভাবছিলাম, আর তখন আপনি.....। স্যার, আপনি ফোন করেছেন, কি যে ভাল লাগছে! সত্যি আমি কল্পনাও করিনি যে......!
আজ সারাদিন শুধু তোমারই কথা মনে পড়ছিল। ফোন করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে করেই ফেললাম।
খুব ভাল করেছেন স্যার। আমি সন্ধ্যায়ই পড়তে বসি। এগারোটার মধ্যে আমার লোখাপড়া শেষ হয়ে যায়। এগারোটার পর আপনি প্রতি রাতেই ফোন করবেন। আপনি ফোন করলে আমি অনেক খুশি হব।
তুমি বলছো ?
জি স্যার, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি-আপনি আমাকে প্রতি রাতেই ফোন করবেন।
এর মধ্যে নিলয়ের ফোন ঢুকে গেল। তূর্যের ফোন গেল কেটে। বিরক্তিতে ভরে গেল তার মন। সে নিলয়ের ফোন কেটে দিয়ে আবার তূর্যকে ফোন করল। কিছুক্ষণ পর আবার নিলয়ের কল ঢুকে যায়। আবার কেটে যায় কল। আবার। আবার। আবার।
এভাবে কেটে কেটে তূর্যের সাথে রাত একটা পর্যন্ত কথা বলল সে। তার ভাল লাগার অনুভূতি অনুভবের সীমানা ছাড়িয়ে গেল। তূর্য স্যার আজই ভালোবাসার কথা বললেন, আর আজই ফোন নাম্বার যোগার করে কল করে ফেললেন! এমনটি যে সে ভাবতে পারেনি।
যখন সে এসব ভাবছিল ঠিক তখন আবার নিলয়ের কল এল। বিরক্তিতে ছেঁয়ে গেল তার মন। তবুও সে কল রিসিভ করল। নিলয় বলল, কী ব্যাপার ? এগারোটা থেকে ফন করছি আর ফোন রিসিভ করলে একটা দশে।
আপনি ফোন করছেন কেন ?
আশ্চর্য! প্রতিদিন কেন ফোন করি ? একদিন ফোন না করলে কেঁদেকেটে অস্থির হও-কাল ফোন করলেন না কেন? কাল ফোন করলেন না কেন? আর এখন কি বলছো তুমি?
আপনি আর আমাকে ফোন করবেন না।
তুমি কি কিছু পান করেছো? টাল অবস্থায় আছো নাকি? আমাকে মনে হয় তুমি চিনতে পারছো না। আমি নিলয়। তোমার ভলোবাসা। লাভ। তোমাদের শহুরে আধুনিক ভাষায় যাকে বলে-বয়ফ্রেন্ড।
অতো পরিচয় দিতে হবে না। সত্যি বলতে কি, এখন আর আপনি আমার লাভার বা বয়ফ্রেন্ড কোনোটাই নন। এখন আপনি শুধুই আমার খালাতো ভাই।
যা বাব্বাহ! গত রাতেও না আই লাভ ইউ-আই লাভ ইউ করে মুখ দিয়ে ফেনা বের করে ফেললে।
গত রাত পাস্ট হয়ে গেছে। এখন যা বলছি তাই ঠিক। আজ থেকে আপনি আর আমাকে ফোন করবেন না।
তুমি কি তাহলে নতুন কোনো বয়ফ্রেন্ড পেয়েছো? কোচিং সেন্টারের অতি মেধাবী কোনো টিচার?
যদি মনে করেন তবে তাই।
তাই বলো! কোচিং সেন্টারে যাবা আর অতি মেধাবী টিচারের প্রেমে পড়বা না, তা কি করে হয়? আমাদের এই মফস্বল টাউনেই তো দেখি.......।
তিনি আপনাদের মফস্বল টাউনের টিচারদের মত না।
বুঝলাম, তিনি সুন্দর গান গাইতে পারেন-আমি যামিনী, তুমি শশী হে। আর সুনীলের সেই কবিতাটা নিশ্চয় সুন্দর আবৃত্তি করেন-ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেধেছি লাল কাপড়/বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি একশ’ আটটা নীল পদ্ম/তবু কথা রাখেনি বরুনা/সে এখন যে কোনো নারী/ তার বুকে এখন শুধুই মাংসের গন্ধ। আহারে! বরুনাদের জন্য ওরা সবাই এই কবিতাটা খুব ভাল করে শিখে রাখে। আচ্ছা, প্রথম যেদিন তার কন্ঠে এই কাবিতাটা শুনেছিলা সেদিন তোমার মনে কষ্ট বাজেনি? রাগ হয়নি বরুনার ওপর যে, কেন সে কথা রাখল না? এখন তো বুঝছো, বরুনারা সব এক। তুমিও বরুনা। বরুনার মতোই তুমিও এখন যে কোনো নারী। তোমার বুকেও এখন শুধুই মাংসের গন্ধ। 
যাই বলেন, আপনি তার কাছে ত্যাজপাতা।
বরুনারা তো এমনই। তার জন্য যে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিলো, দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বাধল লাল কাপড়, বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনলো ১০৮টা নীলপদ্ম। এক সময় বরুনা তাকে মনে করল ত্যাজপাতা। ত্যাজপাতা না কাঁঠাল পাতা তা আগেই বোঝা উচিত ছিল তোমার। আমি কিন্তু প্রথমেই বলেছিলাম-তোমার যদি ভাল না লাগে তো ডাইরেক্ট বলে দিবা, চলে যাব। আমি এক হাতে তালি বাজাতে চাই না। মানা করে দেবার পর ফ্যাচর ফ্যাচর করার ছেলে নিলয় না। কি বলি নাই? তখন তো ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছো-কি যে বলেন নিলয় ভাই! আপনি কেন যোগ্য হবেন না? কেন আপনাকে ভাল লাগবে না? কি বলো নাই? তখন ত্যাজপাতার কথা মনে হয় নাই? মনে হয় নাই সামনে কাঁঠাল পাতাও আসতে পারে? ছাগলের কাছে তো ত্যাজপাতার চাইতে কাঁঠাল পাতাই বেশি প্রিয়।
আপনি আমাকে ছাগল বলছেন ?
তোমাকে ছাগল বলা ঠিক হবে না, বলতে হবে ছাগী-মহিলা ছাগল-বকরি।
যা খুশি বলেন, আমি এখন আর আপনাকে ভালোবাসি না। প্লিজ, আপনি আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করবেন না।
তুমি কি আমাকে মুরগির বিষ্ঠা মনে করেছো যে, কোঁদাল দিয়ে তুলে ছুড়ে ফেলে দিলাম? অতো সোজা না। আমি সেই বাপের ছেলে যে বাপ রিস্ক না নিয়ে কোনো কাজ করে না। আমি রিস্ক নিয়েই তোমাকে ভালোবেসেছি।
মানুষের ভাল লাগা, মন্দ লাগা পরিবর্তন হয়। সব সময় যে একজনকেই ভাল লাগবে তা হতে পারে না।
তুমি দেখছি দার্শনিক হয়ে গেছো। দার্শনিক ফরহাদ মজহার। নাম শুনেছো এই দার্শনিকের? সব সময় লুঙ্গি পরে থাকেন। একবার তিনি ঘোর নাস্তিক ছিলেন। তখন আল্লাকে তার ভাল লাগতো না-বিশ্বাস হতো না। আর এখন এমন ভাল লাগে, যাকে বলে জামাতি ভাল লাগা। জামাতি ভাল লাগা বোঝ?
আপনি নিজেকে আল্লার সাথে তুলনা করছেন?
তুমি দেখছি কাঁঠাল পাতা খাওয়ার শেষ ধাপে চলে গেছ। আমি নিজেকে কোনো তুলনা করি নাই। আমি তোমাকে ফরহাদ মজহারের সাথে তুলনা করছি। দর্শন কপচায়লা তো তাই।
আপনি আমার পথ থেকে সরে যাবেন, এটাই শেষ কথা। আর আমাকে বিরক্ত করবেন না।
আমি তোমাকে তো বিরক্ত করবোই, তোমার বাপ-মা, তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠিরে বিরক্ত করবো। কোনো বকরি আমাকে ত্যাজপাতা ভেবে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইবে তা আমি সহ্য করবো না। আমিও আবৃত্তি করতে পারি-
সুরঞ্জনা, ঐখানে যেও নাকো তুমি,
বলোনাকো কথা অই ভন্ডের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রুপোলি আগুনভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে-আরো দূরে
ভন্ডের সাথে তুমি যেও নাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে ? তার সাথে।
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজঃ
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাসঃ
বাতাসের ওপাড়ে বাতাস
আকাশের ওপাড়ে আকাশ।
কার লেখা কবিতাটা?
তোমার নতুন ভাল লাগা পুরুষকে জিজ্ঞেস করে দেখো।
কবি কি এখানে ভন্ড বলেছেন?
হ্যাঁ।
আমি বিশ্বাস করি না।
তোমার বিশ্বাস-অবিশ্বাস মাথায় নিয়ে কি জীবন বাবু কবিতা লিখেছেন ?
জীবন বাবু কে? এই নামে কোনো কবির কথা শুনিনি।
তুমি জীবনে কি যে শুনছো তা তো বুঝতেই পারছি। জীবন বাবু আমার আত্মীয়।
আত্মীয়!
হ্যাঁ, আত্মার আত্মীয়। আমার আত্মার কথাগুলো তিনি লিখে গেছেন।
ধ্যাৎ!
তারপর থেকে তার ২৪ ঘন্টার রুটিনটা এরকম-সন্ধ্যা থেকেই মনটা উড়– উড়–। মনের মধ্যে কেমন অস্থির অস্থির ভাব। সামনে বই খোলা। চোখ বইয়ে। কিন্তু মনের আয়নায় তূর্যের ছবি। বইয়ে কোনো পাঠ নেই। পাঠ হয় সে ছবিতে। ফোন কখন আসবে ? এলে কি কী বলবে। আগের দিন যা বলা হয়নি তা বলতে হবে। যা ভুল বলেছিল তা শুধরাতে হবে। এরকমই রিহার্সেল চলে।
পরীক্ষার চিন্তায়, লেখাপড়ার ধ্যানে মেয়ে যে ধ্যানমগ্ন। ডাকলে সাড়া দেয় না। জোরে ডাকলে চমকে ওঠে। খাবারে আগ্রহ নেই। দুঃশ্চিন্তার কথা মা জানান বাবাকে।
দু’জন মিলে মেয়েকে বোঝান-মাগো, তুমি তো শুরু থেকেই মনোযোগি ছাত্রী। কখনো অকারণে সময় নষ্ট করো নাই। তাহলে এত চিন্তার কি আছে? এখন এতটা পড়ার কোনো দরকার নাই। সব দুঃচিন্তা ঝেড়ে ফেলো। স্বাভাবিক পড়াটা পড়ে যাও। অহেতুক রাত জাগার দরকার নাই। ঠিকমতো খাও, ঘুমাও, স্বাস্থ্য ঠিক রাখো। শরীর ভাল থাকলে মনও ভাল থাকবে। রিমেম্বার-হেলথ ইজ ওয়েলথ। বডি ইজ রিলেটড উইখ মাইন্ড। সাউন্ড বডি মিনস সাউন্ড মাইন্ড।
রাত এগারোটার সময়ই সে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। আর তখনই তূর্যের ফোন আসে। রাত ১/২টা পর্যন্ত চলে প্রেমালাপ। তারপর ৩/৪টা পর্যন্ত নিলয়ের সাথে ঝগড়া। রাতের রুটিন মূলত এটাই।
সকালে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে নয়টা কি সারে নয়টা। তারপর সাজগোজ করে কোচিং-এর দিকে ছুট। আগে সাজগোজের ব্যাপারটা তেমন ছিল না। তূর্যের সাথে সম্পর্ক হবার পর সাজগোজের ব্যাপারটা বেড়ে গেছে। সে কেমন সাজ পছন্দ করে, কোন পোশাকটা তার ভাল লাগে এ ব্যাপারটা মাথায় রেখেই ঘর থেকে বের হতে হয়।
আগে ক্লাশে পড়াশোনায় কম-বেশি মন দেবার একটা ব্যাপার ছিল। এখন সেটার বালাই নেই। কেচিং-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিচার এখন তার বয়ফ্রেন্ড। সে আর কাউকে পরোয়া করে না। প্রায়ই পেছনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে নীল ছবি দেখে। ব্যাপারটা অনেকটা নেশার মতো হয়ে গেছে। নিলয় বলেছিল-তুমি তো কুয়ার ব্যাঙ। আজকাল সেভেন/এইটের পোলাপানের মোবাইলেও এসব থাকে। কোচিং-এ আসার পর সে কথাটার সত্যতা পেয়েছে। অনেকের সেলফোনেই এসব আছে। কোচিং-এ এসে সে ইন্টারনেটের প্যাকেজ নেয়া আর ডাউনলোড করাও শিখে গেছে। তবে ডাউনলোড সে কম করে। ক্লাশ চলাকালীন সে অন্যের সেলফোন থেকে নিজের মোবাইলে এসব শেয়ার করে নেয়। যার কাছ থেকে শেয়ার করবে সে তার পাশে বসে। দু’জনের পায়ের ফাঁকে নামানো থাকে দু’টো ফোন। তার ফোন মেমোরিতে আসতে থাকে নীল ছবিগুলো। শুধু কিছুক্ষণ পর পর একজন সেন্ড বাটন আর আরেকজন রিসিভ বাটনে চাপ দেয়।
বারোটার পর সে আর কোনো ক্লাশ করে না। বারোটার পর সে ঘুরতে বের হয় তূর্যের সাথে। হ্যাঁ, প্রায় প্রতি দিনই। চারটা/সারে চারটা পর্যন্ত তারা এক সাথে থাকে। খায়। গল্প করে। হাসে। ঢাকা শহরে ঘোরার মত কোনো স্থান তার বাদ নেই। কোথায় বলদা গার্ডেন, কোথায় বোটানিক্যাল গার্ডেন, কোথায় লালবাগ কেল্লা, কোথায় আহসান মঞ্জিল, কোথায় তামান্না স্পট, টিএসসি, কলাভবন, চারুকলা, পাবলিক লাইব্রেরী সব তার নখদর্পনে। আর চাইনিজ, ফাস্টফুডের ব্যাপারটাও এরকমই। কোন রেস্টুরেন্টের কোন খাবারটার দাম কত, কোন রেস্টুরেন্টের কোন খাবারটা অধিক সুস্বাদু তাও তার মুখস্থ। বেড়ানো আর চাইনিজ, ফাস্টফুড খাওয়াটা তার নেশার মধ্যে চলে এসেছে।
আর নেশার মধ্যে এসেছে তূর্যের স্পর্শ। বেড়ানো, আর খাবার ছাড়া যেমন একদিন ভাল লাগে না, তেমন একটা দিন ভাল লাগে না তূর্যের স্পর্শ ছাড়া। ওর স্পর্শের মধ্যে একটা মাদকতা আছে। নিলয়ের স্পর্শ ছিল অনেকটা বল প্রয়োগের মতো। পেশি বহুল শরীরে ঝাপটে ধরা, পিশে ফেলার মতো অবস্থা। আর তূর্যের স্পর্শ মানে আলতো ছোঁয়া। খুব আলতোভাবে হাত নেমে আসে শরীরে। প্রথমে মুখে, তারপর গলার কাছে, তারপর......। শিরশির করে সারা শরীরে অনুভূতিটা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অনেক সময় শরীরের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠে। ঠোঁট ফুলে যায়। শরীর জেগে উঠে ভীষণভাবে।
আর ওর চুমুর ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন রকম। আলতোভাবে ওর ঠোঁট নেমে আসে ঠোঁটের উপর। তারপর আস্তে আস্তে একেবারে মিশে যায় চারটি ঠোঁট। দীর্ঘ সময়েও ভাল লাগা শেষ হয় না। অথচ নিলয়ের ব্যাপারটা এমন ছিল না। সে এমন ভাবে ঠোঁট জোড়া নিজের মুখের মধ্যে পুড়ে ফেলতো যেন কামড়ে ছিড়ে ফেলবে। কিছুক্ষণ পর ব্যাথার অনুভব হতো।
তূর্য তাকে গল্প শোনায় ঢাকা শহরের আশে-পাশের দর্শনীয় জায়গাগুলোর। আমাদের প্রাচীন রাজধানীর কথা বলে। সেখানে বিরাট দিঘী আছে। সানবাঁধা ঘাট আছে। নৌকা করে পানিতে ভাসার সুযোগ আছে। শিল্পাচার্যের নিজ হাতে তৈরী লোকশিল্প যাদুঘর আছে। ফুলের বাগান, বৃক্ষের ছায়া, পাখির গান আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলে। সেখানে সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশ। শান্ত-নিরিবিলি। সাথে আছে লেক, বন-বনানী। শীতে লেক ভরে যায় অতিথী পাখিতে।
তারপর বলে গাজীপুরে একটা রিসোর্টের কথা। পানির ওপর ভাসমান রিসোর্ট। কাঠের পুল। পুরো লেক হেঁটে বেড়ানো যায়। বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে জলের ঢেউ দেখা। ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে যাবে নিজের ছায়া। ইচ্ছে করলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যায়। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। সেখানে চাইলেই এক দিনের জন্য একটা রুম ভাড়া করা যায়।
শুনে শুনে তার মন আকুলি-বিকুলি করে। একটু দূরে যদি যাওয়া যেত! কিন্তু তা কি করে সম্ভব ? মা তো পাঁচটায় অফিস থেকে ফেরেন। পাঁচটার আগে বাসায় ফিরতেই হবে। কিন্তু ঢাকা শহরের একই জায়গায় বার বার যেতে ভাল লাগে না।
ভাবতে ভাবতে একদিন সে মরিয়া হয়ে তূর্যকে বলে, আচ্ছা, সকাল নয়/দশটার দিকে রওয়ানা হলে পাঁচটার আগে গাজীপুর থেকে ফিরে আসা যাবে না ?
ঠিক পাঁচটার আগে ফেরা বোধহয় সম্ভব হবে না। তবে সন্ধ্যার আগে ফেরা যাবে।
আচ্ছা, কিছু একটা বলে যদি মাকে ম্যানেজ করতে পারি?
সেটা তোমার ব্যাপার। কী বলবে?
বলবো-কোচিং-এ পরীক্ষা ছিল।
তুমি যদি ম্যানেজ করতে পারো তো আমার যেতে আপত্তি নেই।
সামান্য চিন্তা-ভাবনা করেই সে মাকে ম্যানেজ করার পথ বের করে ফেললো। যথাদিনের আগের দিন মাকে বলল, কাল কোচিং-এ আমার দুইটা এক্সাম আছে।
কখন ?
একটা নয়টা থেকে বারোটা, আরেকটা তিনটা থেকে ছয়টা।
মাঝে এতখানি গ্যাপ?
তখন ক্লাশ হবে।
কোন কোন সাবজেক্টের এক্সাম?
ইংলিশ সেকেন্ড পেপার আর জেনারেল ম্যাথ।
টাফ পেপারস। কোচিং-এ বেশ চাপ দিচ্ছে মনে হয়। লাঞ্চ কোথায় করবে?
কেচিং-এর পাশে ভাল রেস্টুরেন্ট আছে। টিচারদের টাকা দিলে পিয়ন দিয়ে খাবার আনিয়ে দেন।
তাহলে তো ভালই। তোমার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে রাখো।
কাল সকালে নেব।
সকালে মনে থাকবে না। তুমি ইদানিং যে মনভুলো হয়ে গেছো-এখনই নিয়ে রাখো।
সবচেয়ে বড় সুবিধা কোচিং-এ ভর্তি হবার পর থেকে কুলসুম তার সাথে থাকে না। এখন সে আর ছোট্টটি নয়। সাথে কাউকে রাখার কোনো দরকার নেই-এমনটি সে বাবা-মাকে বোঝাতে সক্ষম হয়।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট