ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০৪


ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন

[গত সংখ্যার পর]
সকালে নীলা এলো। আমাকে বিমর্ষ দেখে কারণ জানতে চাইল। গতরাতের ঘটনাটা ওকে বিস্তারিত খুলে বললাম। বলতে বলতে আমরা চা-নাস্তাও খেলাম। আজ মিজান মিয়া এসেছে সকাল সাড়ে ন’টার দিকে। আমাকে ঘুমুতে দেখে জাগিয়ে দেয়। দোতলায় গিয়ে দুটো তালা দরোজায় ঝুলতে দেখি। মিজান মিয়াকে নিয়ে উপরতলার পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কারোর অস্তিত্ব সেখানে নেই।
নীলা সবকথা শুনে বলল, তুমি একটা হাত দেখেছ। অথচ কোনো মানুষ দেখোনি। সে হাত টেবিলের উপর থেকে ডায়েরিটা তুলে নিলো, তারপর উধাও! কিভাবে পসিবল? যদি তোমার কথা বিশ্বাস করে ধরে নিই, তুমি যা দেখেছ, ঠিকই দেখেছ। কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য কিভাবে?
নীলা, এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা আসছে না। যা ঘটেছে তাই তোমাকে বললাম।
নীলা কিছুটা সময় চুপচাপ ভাবল।
সোম, ধরে নিচ্ছি যা ঘটেছে সবই সত্যি। কিন্তু কেন এমনটি ঘটল? কী এমন কারণ লুকিয়ে রয়েছে এর পেছনে?
নীলার প্রশ্নের জবাবে বললাম, আমি মিজান মিয়াকে কিছুটা সন্দেহ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, মূল্যবান কিছু খোঁজার জন্য হয়তো সে এ কাজ করতে পারে। কিন্তু ওর দ্বারা এসব সম্ভব বলে মনে হয় না। যে ঘরে এসেছিল সে মিজান মিয়া নয়, কিংবা ভুতুড়ে ঘটনা নয়।
এই পুরনো ঘরে অন্য কেউ কী উদ্দেশ্যে হানা দিতে পারে?
জানি না নীলা। তবে হতে পারে মূল্যবান কিছু খোঁজতে এসেছে।
মূল্যবান কী জিনিস আছে সে ঘরে?
ঘরে আসবাব পত্র বলতে কতগুলো আলমারি। পুরনো একটা খাট, শোকেস, চেয়ার-টেবিল। আলমারিতে পুরনো বই, খাতা আর ডায়েরি। মূল্যবান কী আছে জানি না।
আচ্ছা, যে ডায়েরিটা গতরাতে ফিরে এল, সেটি তুমি ভালভাবে দেখেছ?
আলমারির তাকে সাজানো দেখেছি, হাতে নিয়ে খুলে দেখিনি।
নীলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ব্যাপারটা ভারি ইন্টারেস্টিং। মনে হয়, কেউ পড়ার উদ্দেশ্যে ডায়েরি চুরি করে নিয়ে যায়। আবার চুপি চুপি ফেরত দেয়। তোমার দাদাজানের ডায়েরিগুলো তুমি পড়ে দেখেছ?
না। এলাম তো মাত্র কদিন হলো, তবে ইচ্ছে আছে পড়ব।
দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই নীলা একগ্লাস পানি পান করল। আমি আগ্রহ ভরে তাকে বললাম, তুমি ডায়েরিগুলো দেখবে?
নীলা হাসল, ওর প্রসারিত ঠোঁটে একরাশ সজীবতা, ঘাসের ডগার শিশিরের মতো একবিন্দু পানি জমে আছে।
নীলাকে নিয়ে দাদাজানের ঘরে গেলাম। আলমারিগুলো সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ১৯৩১ সালের ডায়েরিটা খুলে প্রথম পৃষ্ঠা পড়তে লাগল। আমাকে শুনিয়ে নীলা পড়ছে,
“মেঘাদ্রি, আজ তুমি অমর্ত্যলোকের অধিবাসী। ধূলির ধরাতে আমি তোমাকে ভুলে দিব্যি বেঁচে আছি। অথচ কতবার বলেছিলাম, তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।.... মিথ্যে বলেছিলাম। সে মিথ্যেকে কেন্দ্র করে আমি এখন ক্রমশ আবর্তিত হচ্ছি। জানি না, এ বৃত্তের পরিধি পেরুতে পারব কিনা। কখনো কখনো ইচ্ছে করে, মহাব্যাস অতিক্রম করে পরিধির ওপাড়ে চলে যাই। সেখানে কি তুমি?”

নীলা থেমে বলল, তোমার দাদাজান কবিতা লিখত? মেঘাদ্রি নামে কাউকে ভালবাসত?
দাদাজান কবিতা লিখত না, তিনি গণিতবিদ ছিলেন। সেটা তো তুমি জানো। কাউকে ভালবাসত কিনা সেটা আমি জানব কী করে?
হুম।
নীলা একটা নিশ্বাস ফেলে ডায়েরির পাতা উল্টে অন্য একটি পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করল।
“মনে পড়ে প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিত স¤প্রদায়ের কথা? যাঁরা পৃথিবীর বুকে গণিতের অভিষেক ঘটিয়েছিল।
সাবধান! অকৃতজ্ঞ মানব সমাজ ওদের ভুলে যেও না। তোমাদের মস্তিষ্ক বরাবরই বিস্মৃতির দুষ্টচক্রে ঘূর্ণায়মান। ভুলে যাওয়া, এ গ্রহের সর্বাধিক উন্নত প্রাণী মানুষের নিজস্ব স্বভাব। তোমরা ইচ্ছে করলেও এ স্বভাবকে এড়িয়ে যেতে পারবে না। তবু বলছি ভুলে যেও না।”
নীলা অন্য একটি ডায়েরি হাতে নিলো। সেটা ১৯৫৫ সালের।
“এই পৃথিবীর প্রতিটি ঘটনা বা রাশি এক একটা রহস্য সমীকরণের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একটি রাশির পরিবর্তন সাপেক্ষে অন্য একটি রাশি কেন কিরূপ পরিবর্তিত হয়, তা নির্ণয় করার একটা তীব্র প্রেষণা আমাকে প্রতিনিয়ত টোকা দেয়। সেগুলোর গাণিতিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব হলে, মহাবিশ্বের মহাগোপন তত্ত্ব উদঘাটন সম্ভব হতো। আমার কল্পিত কিছু সমীকরণ নিচে উল্লেখ করলাম।”

নীলা গাণিতিক সমীকরণগুলো পড়েনি বা বুঝেনি। অন্য একটা পৃষ্ঠা পড়তে যাচ্ছিল, আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। এবার ইচ্ছে হচ্ছিল আমি ওকে পড়ে শোনাব। তাই নিজেই একটি ডায়েরি তুলে নিলাম। সেটা ছিল ১৯৪৭ সালের ডায়েরি।
মাঝখান থেকে একটা পৃষ্ঠা খুলে পড়তে শুরু করলাম।
সেখানে কয়েকটা গাণিতিক রাশির শেষাংশে ছোট করে বাংলায় লেখা “একটি ভুল তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ভেঙে গেল মহাকালের একটি বৃহৎ রাশিমালা। বিভক্তির যুক্তিতে জন্ম নেয়া নবীন রাশিমালাদ্বয়ের সম্মিলিত সমীকরণ একটি ভুল সমান বা অসমান চিহ্নের দ্বারা আবদ্ধ। সমান চিহ্নের এ অযাচিত ব্যবহার উভয়পাশের রাশিমালার জন্য অসম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সূত্রপাত ঘটাবে। যা বরাবরই বিদ্বেষ দ্বারা আবৃত ও বিষাদগ্রস্ত ইতিহাসে মোড়া থাকবে।”
লেখাটা পড়ে আমি কিছুই বুঝলাম না। অপর একটি পৃষ্ঠা খুলে নীলার দিকে তাকিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম সে পাতায় একটি মাত্র বৃত্ত, সে বৃত্তের ভেতর অনেকগুলো পিঁপড়া আঁকা। কিছুই লেখা নেই। হতাশ হয়ে অন্যপৃষ্ঠায় গেলাম। সেখানে কতগুলো বিন্দুর সমাহার। সে বিন্দু গুলোর উপর হালকা কাঠপেন্সিলের ছোঁয়া। ভালভাবে খেয়াল করলে মনে হয় ছবির মতো কিছু। যেখানে কেউ তীর-ধনুক হাতে শিকারির ন্যায় প্রস্তুত।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে নীলা বলল, কী হলো থমকে গেলে কেন?
না, কিছুই না।
নীলা সর্বশেষ নিচের তাকের বামপাশের ডায়েরিটা তুলে নিলো। অর্থাৎ ২০০০ সালের ডায়েরি। বলল, এবার আমি পড়ছি, তুমি শুনো। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে সে পড়া শুরু করল।
“এ শতাব্দীকে আমি ছুঁতে পারব, তা কখনো কল্পনাও করিনি। অথচ দিব্যি বেঁচে আছি। কেউ আমাকে বাধাগ্রস্থ করতে চায়। থামিয়ে দিতে চায়, আমার গাণিতিক তপস্যা। প্রায়ই আমার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে সে অতিশক্তিমান শত্রুটি। আমি সম্পূর্ণ সন্দেহ মুক্ত সে এই পৃথিবীর কেউ না। সে ভিন্ন মাত্রার মহাজগত থেকে আসে।”
কতগুলো তারকা চিহ্নের পর তিনি লিখেছেন,
“আজ আমার এ বন্য বাড়িটি সোমকে উইল করে দিলাম। ফারদিনকে আমি পালিতপুত্র হিসেবে পরিচিত করে তুলেছি বটে, কিন্তু দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। ফারদিনের একমাত্র পুত্র সোমকে কোনোদিন স্বচক্ষে দেখিনি। জানি না, ছেলেটি কেমন মেধার অধিকারী হয়েছে।”
অনেকগুলো লাইন ডট চিহ্ন দিয়ে ভরা, নিচের অংশে সামান্য লেখা।
“ক’দিন পরেই আমি নব্বই বছর বয়সে পা দেবো, আমার গাণিতিক সমীকরণগুলো দায়িত্ববান কারোর হাতে সমর্পণ করে যেতে পারলাম না। “ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা” আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিস্ময়। অথচ বহুবছর আগে অসম্পূর্ণভাবে ফর্মূলাটি সাজিয়েছি আমি নিজেই। এখনো শেষ পর্যায়ে যেতে পারিনি। যেভাবেই হোক আয়ু সমীকরণ শেষ প্রান্তে পৌঁছার আগে কাজটি সম্পন্ন করা চাই। কারণ এ ফর্মূলার সাথে সম্পর্কিত কতিপয় সমীকরণ রয়েছে। যাতে জড়িয়ে আছে, বহুমাত্রিক জগতের রহস্য। সমীকরণগুলোর সমাধান আবশ্যক।”

নীলার পড়া শুনে আমি অনেকটা বিস্মিত হলাম। দাদাজান আমার কথা যে তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন তা কেমন স্বপ্নের মতো লাগছিল। একটা ভালোলাগার অনুভূতিও তৈরি হলো। নীলা ডায়েরিটার অন্য একটি পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করল।
“কেউ আমাকে হত্যা করতে চায়। একটি অচেনা তরুণ রোজ রাতে আমাকে বিরক্ত করছে। নানা প্রশ্নের সম্মূখীন করে, আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। ওকে আমি অবশ্যই শাস্তি দেবো।”
নীলা আমার দিকে তাকাল।
তোমার দাদাজান কিভাবে মারা যায়?
প্রশ্নটার সঠিক উত্তর আমার কাছে নেই। তুমি হয়তো জানো না দাদাজানের সাথে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। এ বাড়িতেই উনি মারা গিয়েছেন, মিডিয়া বার্ধক্যজনিত কারণ উল্লেখ করে খবর প্রচার করেছে।
না, সোম। তোমার দাদাজানকে খুন করা হয়েছে। সেটা কী উদ্দেশ্যে করেছে তা আন্দাজ করা কঠিন। তবে এতটুকু বুঝা যায়, তাঁর গাণিতিক কাজ থামিয়ে দেবার জন্যই এমনটা হয়ে থাকতে পারে।
কী বলছ নীলা?
ডায়েরির লেখা তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সোম, তোমার উচিত সাবধানে থাকা। তোমার দাদাজানের ডায়েরির লেখাগুলো ভালোভাবে পড়া ও জানা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে আমরা বিস্ময়কর নতুন কোনো তথ্য পেতে পারি। “ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা” তিনি হয়তো ব্যাখ্যাসহ সূত্রটির সমাধান কোথাও না কোথাও লিখে রেখেছেন।
আমি নীলার কথায় সায় দিলাম।
হতে পারে।
নীলা আমার কাছে এসে বলল, তুমি চাইলে আমি তোমাকে হেল্প করব। ডায়েরি ও খাতাপত্রগুলো মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে।
ঠিক আছে নীলা।

নীলা চলে যাবার পর দীর্ঘ সময় ভাবনায় ডুবে রইলাম। আমার মধ্যে দাদাজানকে জানার প্রবল আগ্রহ তৈরি হলো। আব্বুকে কল দিলাম, দাদাজান সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করলাম। আব্বু জানাল, দাদাজান সম্পর্কিত তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাঁর কাছে নেই। তবে কেয়ারটেকার শাজান মিয়াকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে কিছু না কিছু জানা যেতে পারে।
আব্বু আমাকে ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করলেও, আমি আপাতত ফিরব না জানিয়ে দিলাম। আব্বু বলল আম্মু আমার প্রতি রেগে আছে। তাছাড়া আম্মুর শরীরের অবস্থা ভাল নয়।

মিজান মিয়াকে ডাকলাম। সে তড়িধড়ি ছুটে এল। শাজান মিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই জানাল, তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায়। দাদাজান এখানে আসার কিছুদিন পর থেকে শাজান মিয়াই দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেছে। দাদাজানের মৃত্যুর একবছর পর, তিনি হঠাৎ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। শরীরে পক্ষাঘাতও দেখা দেয়। শাজান মিয়ার অসুস্থতার কারণে বাড়িটি দেখার দায়িত্ব মিজান মিয়ার উপর বর্তায়। বাড়িটিতে সে রাতে পাহারা দেয়, আর মাস শেষে আব্বুর পাঠানো টাকা ডাকে বেতন হিসেবে পেয়ে যায়। এভাবেই তার দিন কেটে যাচ্ছে।
মিজান মিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে রূঢ়ভাবে বললাম, একটা সত্যি কথা বলবে, এ বাড়িতে তুমি ব্যতীত অন্য কেউ আসে?
স্যার, একি বলছেন। আর কে আসবে? মিজান মিয়া কাঁচুমাচু হয়ে বলল।
আমি সহজ হয়ে বললাম, গতরাতে কেউ এ বাড়িতে এসেছিল। উপরতলার ঘরে ঢুকে চেয়ার-টেবিল নাড়াচাড়ার মতো শব্দ করেছে। যা আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি।
মিজান মিয়া ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার এমন ঘটনা তো হরহামেশা ঘটে। প্রথম দিকে আমার ডর লাগত। যখন থেকে পাত্তা দেই না, তখন শব্দ শুনলেও না শোনার মতো থাইকা ঘুমাতাম।
তোমার বাবার সাথে একদিন দেখা করতে যাব।
আচ্ছা, স্যার। আমি আপনাকে নিয়া যাব।
আর শুনো, আমি উপরতলায় দাদাজানের ঘরে থাকব। বিছানা, বালিশ, চাদর সবকিছুর ব্যবস্থা করো। তুমি নিচের ঘরে থাকবে। তোমাকে দিন-রাত এখানে থাকবে হবে, বেতন বাড়িয়ে দেয়া হবে। তবে প্রয়োজন হলে যেকোন মুহূর্তে বাড়িতে যাওয়া-আসা করতে পারবে।

দুপুরে ঘুমানোর আগে দাদাজানের সেই ডায়েরিটা হাতে নিলাম, ১৯৮৫ সালের। যা চুরি যাওয়ার পর ফিরে এসেছে। আর মিসিং হয়েছে ১৯৮৪ সালের ডায়েরিটা। একটিবার মনে হলো, এ ডায়েরিটিও পড়া শেষে ফিরে আসবে, তারপর অন্য কোন ডায়েরিটি মিসিং হবে? ১৯৮৫ সালের পর ১৯৮৪ সালের ডায়েরি নিয়েছে, এবার নিশ্চয়ই ১৯৮৩ সালের ডায়েরি নিতে আসবে। দাদাজানের সবগুলো ডায়েরি দেখতে একই রকম, একই সাইজের। কিন্তু বিগত দু’রাতে টেবিলের উপরে দেখা সে ডায়েরিটা ছিল কিছুটা ছোট, ও ভিন্ন ধরনের। নানা কিছু ভাবতে ভাবতে আমি ডায়েরির পাতা খুললাম।
একি প্রথম পৃষ্ঠাটা ছেঁড়া। পরের পৃষ্ঠায় খ-িত লেখাটা পড়তে লাগলাম। সেখানে লেখা, “.......তবে তোমাদের জন্য একটি বিকল্প উপায় রয়েছে। তা হলো অন্তরপণ। নিত্যদিনের প্রতিটি বিষয় মানুষের মস্তিষ্কে নথি আকারে সঞ্চিত থাকে। মনে করো, গাণিতিক অঙ্ক ও প্রতীক চিহ্নের সম্পর্কে আবদ্ধ একেকটি স্নায়ু নথিকে স্মৃতিরাশি বলে। ধরা যাক, একটি নির্দিষ্ট পরিধির বৃত্তে একশোটি রাশি রয়েছে। এ রাশিগুলো আমাদের স্মৃতিময় ঘটনা। আবারো ধরা যাক, বৃত্তের ধারণ ক্ষমতা একহাজার স্মৃতিরাশি। প্রতিদিনই বৃত্তে রাশির সংখ্যা বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে পুরো বৃত্ত বোঝাই হয়ে গেল। কিন্তু প্রতিদিনের তথ্য-উপাত্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হতে থাকবেই, তখন বৃত্তের পুরনো রাশিগুলো সংকুচিত হয়ে বৃত্তের বাইরে ঠাঁই নেবে। সংকুচিত রাশিগুলো মিলে অন্য একটি বৃত্ত সৃষ্টিতে মন দেবে, সে বৃত্তে রাশিগুলো থাকবে সংক্ষিপ্ত ও ঘুমন্ত আকারে। এভাবে একের পর বৃত্ত সৃষ্টি হবে, সে বৃত্তগুলো একটির সাথে আরেকটি পরিধির বাহুবন্ধনে সংযুক্ত থাকবে। তখন ঐ সকল বৃত্ত স্প্রিংয়ের আকার ধারণ করবে। সে স্প্রিংয়ের সর্বনিম্নে অবস্থান করা বৃত্তটি আমাদের প্রথম স্মৃতিম-ল বা শৈশবের স্মৃতিরাশির সমাহার। আর সবচেয়ে উপরের বৃত্তটি নতুন বা চলিত বর্তমান সময়। যেখানে এই মুহূর্তের স্মৃতিটি ক্রমাগত সঞ্চিত হচ্ছে।
অন্তরপণ হচ্ছে ইচ্ছেমতো স্মৃতিরাশি বাছাই ও গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিরাশিকে সতেজ রাখার প্রক্রিয়া। প্রতিটি বৃত্তের রাশিগুলোর মধ্যে কোনোটি সজাগ সাবলীল সেগুলোকে বলে প্রসারিত রাশি। আবার কোনোটি ঘুমন্ত সংক্ষিপ্ত সেগুলোকে বলে সংকুচিত রাশি।
সংকুচিত রাশিকে প্রসারিত করার প্রক্রিয়াই অন্তরপণ।
তুমি তোমার পুরনো স্মৃতি থেকে একটি ঘটনা স্মরণ করে কিছুটা সময় এগোতে থাকো, ঘটনাটি পরিপূর্ণ রূপে তোমার কাছে স্পষ্ট আকার ধারণ করতে থাকবে। অর্থাৎ এ স্মৃতিরাশিটি প্রসারিত হচ্ছে। ঠিকই একই সময় ভিন্ন একটি ঘটনা বা স্মৃতিরাশি সংকুচিত হতে থাকবে। এর কারণ বৃত্তের সুনির্দিষ্ট পরিধি, যেখানে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক স্মৃতিরাশি ঠাঁই পাবে। এবং রাশিসমূহের অবস্থানও (প্রসারিত, সংকুচিত প্রভৃতি) ধ্রুবক বা চলক।
এখানে দেখা যাচ্ছে, একটি রাশির হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে অন্য একটি রাশির ক্রম হ্রাসমান বা বর্ধমান সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। এখন বৃত্তটিকে যদি আমরা মহাবিশ্ব কল্পনা করি তাহলে কী দাঁড়াবে?
মহাবিশ্বের এক একটি ঘটনা বা রাশির সাথে অন্যান্য ঘটনা বা রাশির আপেক্ষিক সম্পর্ক জড়িত।
রাশি সমূহের এ রহস্যময় সম্পর্ককে সমীকরণ আকারে প্রকাশ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে একটি প্রামাণ্য রাশি বা ধ্রুবক রাশি ধরে নিতে হবে। আগের পৃষ্ঠাতে একটি গাণিতিক সমীকরণ চিত্রসহ রয়েছে। যেখানে ধ,ন,প,ফ....া বৃত্তসমূহের কেন্দ্র পরস্পর পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত। এর ফলে বৃত্তগুলো পরস্পরকে ছুঁয়ে গেছে বা ছেদ করেছে।”
আমি আগের পৃষ্ঠা খুলে দেখলাম, সে পৃষ্ঠাটি ছেঁড়া। বুঝতে বাকি রইল না, অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত সে চিত্র, ব্যাখ্যার প্রথমাংশ ও গাণিতিক সমীকরণ সম্বলিত পৃষ্ঠাটি ছিঁড়ে ফেলেছে। যার ফলে আমার পড়া অংশটুকু খ-িত আকারে প্রকাশ পেয়েছে।



রাত দুটো।
আমি দাদাজানের ঘরে চেয়ারে বসা। ১৯৩৪ সালের ডায়েরিটা পড়ছি। গত ছয়রাত ধরে এ ঘরেই রাত যাপন করে আসছি। নীলা প্রতিদিন ভোরে এখানে আসে। ঘণ্টা তিনেক আমার সাথে কাটিয়ে আবার ফিরে যায় গেস্ট হাউজে। যতক্ষণ এখানে থাকে ততক্ষণই সে দাদাজানের ডায়েরি পড়তে ব্যস্ত থাকে। নীলাকে ফিরে পেয়ে আমি এক নতুন ভুবনের খোঁজ পেয়েছি। যেখানে আমি পথহীন পথিক, এক অজানা মরুভূমির যাযাবর, হেসে খেলে বসে বা দাঁড়িয়ে কেবল খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আর মেঘ গুনছি, আর মেঘ গুনছি। মেঘের সে হিসেব জমা দিচ্ছি নীলার কাছে। কল্পিত সে মেঘগুলো হলো দাদাজানের লেখা গাণিতিক সমীকরণ, ডায়েরি থেকে খুঁজে বের করে নীলাকে দেখাচ্ছি। নীলা সমীকরণগুলো নোট আকারে ওর নতুন একটি ডায়েরিতে তুলে রাখছে। প্রতিদিনই আমরা দু’জন দুটো ডায়েরি নিয়ে বসি,পাতা উল্টিয়ে লেখাগুলোর মাঝে খোঁজে বেড়াই গাণিতিক রাশিমালা ও বিভিন্ন সমীকরণ। এভাবেই কাটছে আমার বনবাস দিনগুলো। এ কদিনে আমি এক অন্যরকম নীলাকে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করছি। আগে কখনো নীলার মধ্যে গণিত নিয়ে আগ্রহ দেখিনি, কলেজে সে চতুর্থ বিষয় হিসেবে নিয়েছিল কৃষিবিজ্ঞান। এছাড়া বিজ্ঞানের মধ্যে ওর আবশ্যিক বিষয় ছিল কেবল পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান। আমরা কৃষিবিজ্ঞান অগ্রাহ্য করে গণিত নিলেও, সে গণিতকে ভয় পেয়ে বরাবরই দূরে থাকত। সেই নীলার মধ্যে গাণিতিক কৌতূহল ও প্রেম দেখে সত্যিই অবাক হচ্ছি। ভালোলাগছে নীলার ভিন্নভাবে পাল্টে যাওয়া দেখে। তবে একটু অন্যরকম অবাক হচ্ছি, ওর মধ্যে অতীতের কোনো অভ্যাস, ভালোলাগা, মন্দলাগা, বিরক্তি, ঘৃণা কিছুই যেন নেই। সবকিছু ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেছে। সেখানে ডালপালা মেলেছে কেবল গাণিতিক আবহ। সবচেয়ে বেশি অবাক হচ্ছি এই ভেবে, নীলা একটিবারের জন্য শশীর কথা বলেনি। সে মানসিক বিপর্যয় থেকে সুস্থ হবার পরও শশীর কথা ভুলেনি। অথচ আমার এতটা কাছে এসেও নীলা শশীকে কেন ভুলে আছে? ও কি অতীতের এ করুণ স্মৃতিকে ভুলে থাকতে চায়? ও কি কষ্টকে দূরে ঠেলে রাখার জন্যই শশীকে আমাদের মধ্যে টেনে আনতে চায় না। জানি না, হয়তো তাই।
আজ পর্যন্ত আলমারিতে ডায়েরি সংখ্যা ঊনসত্তরই আছে। ১৯৮৪ সালের ডায়েরিটা এখনো অপশক্তির হাত থেকে ফেরত আসেনি, অপেক্ষায় আছি। এবার হয়তো ১৯৮৩ সনের ডায়েরিটা গুম হবে। প্রতিদিনই ডায়েরিগুলোর উপর সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছি।
গতকাল মিজান মিয়ার সাথে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম তা সফল হয়নি। শাজান মিয়ার সাথে দাদাজানের বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হলো না। মিজান মিয়া প্রথমেই আমাকে জানিয়েছিল। তার বাবা যখন তখন কাশতে শুরু করে, তাছাড়া বয়স বৃদ্ধির ফলে রগচটাভাবে রেগে যায়। হঠাৎ কারণে-অকারণে বেখেয়ালে গালমন্দ করে।
তাদের বাড়িতে যাবার পর বৃদ্ধ শাজান মিয়া হাত উঁচিয়ে লম্বা করে সালাম দিলো। মিজান মিয়া আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করতেই শাজান মিয়া তার শরীরের হাল-অবস্থা সম্পর্কে বিশাল ইতিহাস বর্ণনা করল। ততক্ষণে মিজান মিয়া চার কাপ চা নিয়ে এলো। এককাপ চা শাজান মিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আমি এক কাপ নিলাম। মিজান মিয়া আরেক কাপ তুলে নিলো। শাজান মিয়া পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে দেহের বামপাশ অসুস্থ হলেও ডানপাশটা বেশ সচল। আমরা সবাই চা পান করছি।
ট্রেতে আরো এক কাপ চা রয়ে গেল। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগল মিজান মিয়া চার কাপ চা তৈরি করল কেন? তার মধ্যে কি সংখ্যা জ্ঞান বলে কিছু নেই? এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনতে না পারা মিজান মিয়া জীবন সংসার কিভাবে চালাবে?
এসব ভেবে মিজান মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, মিজান, তুমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনতে পারো?
হুম, কেন পারব না স্যার?
আমরা তিনজন মানুষ, তুমি চারকাপ চা কেন তৈরি করলে? এক কাপ চা শুধু শুধু অপচয়।
স্যার, আপনার জন্য এক কাপ এক্সট্রা তৈরি করছি। বাসায় সবসময়ই তো দুই কাপ করে চা খান, তাই আরকি।
না, মিজান এ অপচয় মোটেও ঠিক নয়। এমনটি আর কক্ষনো করবে না।
মিজান মিয়াকে এ উপদেশটা দিতে গিয়েই হলো মূল বিপদ। শাজান মিয়া উচ্চস্বরে বলা শুরু করল, হারামজাদারে ইশকুলে দিছিলাম, পড়ালেহা করে নাই, হিসাব-পত্র কিচ্ছু শিখে নাই। মূর্খ, পুরাপুরি মূর্খ আমার পোলা। অসভ্য, বেয়াদবের হাড্ডি, বাপের সামনে বিড়ি খায়, আরো কি কি যেন খায়।
শাজান মিয়াকে চেষ্টা করেও থামাতে পারিনি। শেষে কাশির আক্রমণে আপনাতেই থেমে গেল। তবে কথা বলা থামলেও কাশি থামেনি।
লোকটা পুরনো কাশিতে আক্রান্ত। চেষ্টা করেও মুখ ফুটে কথা বলার সুযোগটুকু পাচ্ছে না, অনবরত কেশে যাচ্ছে। কথা বলার উপায় নেই দেখে ফিরে এলাম। চলে আসার আগে মিজান মিয়ার হাতে দু’হাজার টাকা দিয়েছিলাম। তার বাবাকে চিকিৎসা করানোর জন্য। আজ সকালে সে তার বাবাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। মিজান মিয়া ফিরে এসে জানাল, হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি নিতে রাজি হয়েছে। জানিয়েছে, সুস্থ হয়ে ওঠতে বেশ সময় লাগবে। আমি শাজান মিয়ার সুস্থতার অপেক্ষায় আছি। দাদাজানকে নিয়ে মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি মারছে। জিজ্ঞাসা করার মতো একজনই আছে, সে শাজান মিয়া। আজ রাতের জন্য মিজান মিয়াকে ছুটি দিলাম। বললাম, আগামীকাল সকালে এসো।

রাত এখন আড়াইটা। অনিদ্রা আমাকে ভালোভাবেই আঁকড়ে ধরেছে। ডায়েরিটা পড়তে পড়তে চা খেতে ইচ্ছে হলো। মিজান মিয়া নেই তাই নিজেই ওঠে গেলাম। নিচতলায় লাকড়ির চুলা জ্বেলে চা বানাতে আমাকে বেগ পেতে হলো না। চায়ের মগ হাতে নিয়ে উঠোনে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি। একফালি চাঁদ আকাশে। উঠোনের নরম ঘাসগুলোকে শরতের শীতল আবরণ ঢেকে রেখেছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নীলার কথা মনে হলো। নীলার সাথে প্রতিদিনই দেখা হয়, অথচ ওর ফোন নম্বরটা নেয়া হয়নি। নিজের খামখেয়ালির প্রতি রাগ হচ্ছে। ইশ, এ সময়টাতে নীলার সাথে ফোনে কথা বলা যেত। কাল অবশ্যই নীলার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিতে হবে। আমার ভেতর টান টান উত্তেজনার ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে। ইচ্ছে করছে নীলার গেস্ট হাউজের দিকে যেতে। সেখানে গেলে নিশ্চয়ই ওর সাথে অনেক গল্প করা যাবে, সময়টা সহজে কাটবে।
চোখের চশমাটা খুলে, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে লাগলাম। এখানে আসার পর একদিনও দাড়ি কামানো হয়নি। আশপাশে কোথায় সেলুন আছে তাও খোঁজ নেওয়া হয়নি। ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ দেখি সেই বাচ্চা সাপটি ধীরে ধীরে ড্রেইনের দিকে এগোচ্ছে। কি সুন্দর নিরীহ ভঙ্গি, অথচ মানুষ এ প্রাণীটার প্রতি আক্রমণাত্বক আচরণ করে। সেই আচরণের রিপ্লে দিতে গিয়ে ওরাও হিং¯্র হয়ে ওঠেছে। মানুষের মতো সর্পশ্রেণীও মানবজাতিকে অবিশ্বাসের তালিকায় রেখেছে। তাই তো এই শত্রুতা অধ্যায়ের উদ্ভব।
আরেক মগ চা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। নীলা বলেছিল বনবিভাগের গেস্টহাউজ সামনের মোড় থেকে ঠিক উত্তর দিকে, অনেকটা গভীর বনে। জায়গাটা নাকি খুব সুন্দর! আমি হেঁটে চলেছি একপা দুপা করে, সাথে হাঁটছে চাঁদ। চায়ের মগে প্রতিটি চুমুক আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অজানার দিকে। শালবনে রাতের সৌন্দর্য নিস্তব্ধতা কেন্দ্রিক! গজারি গাছের পাতার উপর হালকা আভা, বাতাসের গতি সে আভাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে এদিক-সেদিক। পাতাগুলোকে আলোর ঝালর মনে হয়, দুলছে তো দুলছেই। অনেকটা পথ হেঁটে যেতে চোখে পড়ল দূরে কোথাও আলো জ্বলছে। পাশে বিশাল বটগাছ ছাতার মতো ডাল-পাতা ছড়িয়ে স্থির দাঁড়িয়ে। প্রাসাদের মতো দেখতে এই ভবনটিই কি বনবিভাগের গেস্ট হাউজ? সামনে এগোতেই দেখলাম, নীলা পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হলাম না, সহজভাবে এগিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। কেন অবাক হইনি, সে প্রশ্নটা নিজেকে করে কোনো উত্তর পাইনি। যেন এমনটিই হবার কথা ছিল।
নীলা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মিনিট খানেক পরে সে সামনে এগিয়ে এসে আমার বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরল। আমিও ওকে কাছে টেনে নিলাম। কতক্ষণ কেটে গেল জানি না। রাতের বুনো বাতাস ওর চুলে ঢেউ তুলছে, আমি শত চেষ্টা করেও সে ঢেউ রোধ করতে পারছি না।
নীলা আমার হাত ধরে গেস্ট হাউজের ভেতরে নিয়ে গেল। বাইরে থেকে দেখতে কেবল প্রাসাদ মনে হলেও ভেতরটা রাজপ্রাসাদের সমতুল্য। নীলা আমাকে ওর কক্ষে নিয়ে বসাল। চমৎকার একটি কক্ষ! সুন্দর সব আসবাবপত্র ও পেন্টিংয়ে ভরপুর। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বোধশক্তি ফিরে পেলাম। প্রশ্ন করলাম, তুমি কী করে জানলে, আমি আসব?
মনে হচ্ছিল তুমি আসবে। ওর মুখে লাজুক হাসি।
আমিও হাসলাম। বললাম, তোমার ফোন নম্বর দাও। যেন যখন তখন কথা বলতে পারি।
নীলা ফোন নম্বর বলার পরপরই মুঠোফোনে সেভ করে নিলাম। রুমের এসি অন করে নীলা নিচে নেমে গেল। পাঁচ মিনিট পর সে এক গ্লাস শরবত, ও এক পিরিচ মিষ্টি নিয়ে এল।
শরবত ও মিষ্টি দুটোই খেলাম।
নীলা বলে ওঠল, সোম তোমার চোখ দুটো এত সুন্দর কেন?
চমকে ওঠলাম। নীলা আগে কখনো চোখের প্রশংসা করেনি, আজ ওর কী হয়েছে?
কিছু না বুঝেই পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কেন সুন্দর তুমিই বলো।
মায়া, তোমার চোখে মায়া লেগে আছে তাই। নীলা দরোজাটা বন্ধ করে দিলো। ধীরে ধীরে আমার কাছে এলো। আমাকে ওর বিছানায় টেনে নিলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো নীলাকে অনুসরণ করছি। ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চির পরিচিত ভাষা, অথচ বুঝেও না বুঝার ভান করছি। জীবন বহু বক্ররেখার সমাহার, আমি আমাকে দেখে তাই শিখেছি।
নীলা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমি ধ্রুবকের মতো স্থির ওর সম্মূখে। নীলা বাঁধ ভাঙা নদীর মতো আমার বুকে আছড়ে পড়ল, আর আমি পাহাড়ের মতো নিশ্চুপ!
অজানা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে একসময় আমরা দু’জনই বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। আমার ঠোঁটে ওর ঠোঁটের স্পর্শ লাগল। আমি আঁতকে ওঠলাম, একি! তোমার ঠোঁট এত ঠা-া কেন? প্রশ্নটা আমার কণ্ঠেই আটকে রইল। ওকে স্পর্শ করতেই বুঝলাম বরফের মতো শীতল ওর দেহ। হিম রমণীর সাথে আলিঙ্গন আমাকে মেরু দেশের তুষার পুরুষে রূপান্তর করতে পারল না। ওকে জড়িয়ে ধরতেই থমকে গেলাম। ক্রমেই আমার শরীরের তাপমাত্রা কমতে লাগল। উপায়ান্তর না পেয়ে নিজেকে মুক্ত করে বিছানা ত্যাগ করলাম। নীলা হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, একসময় সেও ওঠে দাঁড়াল। ওর চোখে মিনতি, দু’ফোটা অশ্রুও! এ জলকণা অগ্রাহ্যের অপমান কষ্ট নাকি কেবলই প্রেমক্ষুধা আমি জানি না।
নীলাকে একেবারে স্তব্ধ হয়ে থাকতে দেখে বললাম, চলো নীলা, বাইরে হাঁটতে যাব। নীলা অনিচ্ছা প্রকাশ করল না, মাথা নেড়ে সায় দিলো।
দু’জনই বাইরে বেরিয়ে এলাম। শালবনের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। ঝোপের পাশের জোনাকিদের ভিড়। দূরে কোথাও শেয়ালের হাঁক ডাক শোনা যাচ্ছে। দু’একটা নিশি পাখির কণ্ঠস্বর থেকে বেরুচ্ছে বিরহের কথামালা। নীলা একেবারে চুপ হয়ে আছে। আমাদের কিছুটা সামনে জলাশয় ও বাইদ জমি, যেখানে কৃষকরা ধান চাষ করেছে। আরো উত্তরে পাড় বাঁধানো লেক। লেকের মাঝখানে বৃক্ষ ফোয়ারা থেকে অনবরত পানি ঝরছে। আমরা লেকের পাড় ধরে হেঁটে পূর্বদিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এদিকটাতে খানিকটা আনারস বাগান, বাকিটা বন। হুট করে একদল বানর চোখের সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল। আমাদের আগমনে ওরা যে অসন্তুষ্ট তা ওদের চেঁচামেচিতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নীলা আমার হাত চেপে ধরল, সোম সামনে যেও না।
কেন?
পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলাম। একটা সজারু আমার পায়ের পাশে স্থির দাঁড়িয়ে, ওর সুঁচালো কাঁটাগুলো ঊর্ধ্বমুখী ক্ষিপ্ত আকার ধারণ করে আছে। আরেকটু হলে প্রাণীটার উপর পা দিতে যাচ্ছিলাম। সজারুটা ধীরে ধীরে এগিয়ে একটা গর্তে ঢুকে গেল। নীলা সাবধান না করলে আমার পা কি যে হতো জানি না।
রাতের ভ্রমণ ফজরের আজান অবধি চলল। আমি ফিরে যেতে চাইনি, তবু নীলা বলল, এবার ফিরে যাও সোম।
বাড়িতে ফিরে বিছানায় ঠাঁই নিলাম। বালিশের উপর মাথা রেখে এপাশ ওপাশ করা সত্ত্বেও ঘুম এল না। হুট করে মনে হলো, নীলা ফিরে এসেছে এ সুসংবাদটা কাউকে জানানো হয়নি। একবার উৎসবকে জানানো উচিত। ওকেই প্রথম কল দিলাম। উৎসব কল ধরল না। ভাবতে ভাবতে রিমনের নম্বরে ডায়াল করলাম। কল রিসিভ করল।
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, হ্যালো।
শোন, রিমন, একটা সুসংবাদ আছে।
কথা না বাড়িয়ে,বলে ফেল।
আরে শোন, নীলার কথা বলছি...
আরে ভাই, বলতে তো মানা করিনি
তুই কি বিরক্ত হচ্ছিস?
এই শোন, পরে কল দিস, আমি এখন ঘুমে।
রিমন লাইন কেটে দিল।
মলয়কে কল দিলাম। ওর মোবাইল বন্ধ, মুহূর্তে একটি মেসেজ এল, সিম অপারেটরের মিসকল এ্যালার্ট থেকে।
তনিমা ও সুজাতকে লাইনে পাবার জন্য চেষ্টা করলাম। সুজাত কল ধরল,
দোস্ত, কেমন আছিস?
ভাল আছি। নীলার কথা মনে আছে?
কেন মনে থাকবে না? সে তোর সাবেক বউ, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলি।
হুম, তোর দেখছি সবই মনে আছে।
থাকবে না, কেন? আমার স্মৃতি কি এতই কাঁচা নাকি?
কাঁচা-পাকা যাই হোক। শোন, আমার বউ আবার ফিরে এসেছে, বুঝলি।
কবে? ওর তো আমেরিকান স্বামীর সাথে বিয়ে হয়েছিল।
হ্যাঁ, হয়েছিল, সেটা তো অতীতকাল। এখন সে আমার, ও আমার কাছে আছে।
কি বলছিস এসব?
কেন তুই খুশি হসনি?
না, মানে....সোম শোন
রেখে দিচ্ছি এখন, আর কিছু শোনার মুড নেই।
কলটা কেটে দিলাম। সুজাতের প্রতি রাগ হচ্ছে। ও আমাদের নতুন প্রেমকে মূল্যায়ন করতে পারল না। আর পারবেই কি করে, ওরা সবাই তো রীতিমত সংসারি। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ আর অভাব অর্থনীতির মেশিনে পৃষ্ট হয়ে বহুমুখী টেনশনে বুঁদ হয়ে থাকে। রাগ হলে আমি গান শুনি, যাতে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারি।
গান শুনতে শুনতে ঘুমে ঢলে পড়লাম।
[চলবে...]

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট