ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : শেষ পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : শেষ পর্ব

[গত সংখ্যার পর]
ভিড় ঠেলে টিএসসি-র দিকে এগোচ্ছি। ডিসেম্বরের এই শীতে ঘাম বের হচ্ছে। রাস্তায় উপচে পড়া ছাত্র-জনতা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছড়িয়ে গেছে। স্লোগানমুখর, ‘এরশাদ, তুই কবে যাবি?’
‘উমির্, ‘চিপপা লাইগাতো মইরাই যাইতাম।’ চামেলী আপা বললেন।
আমি বলি, ‘এমনি করেই এগোতে হবে। বেবী আপা ও শহীদ জননী টিএসসি-র মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন।’
কবি নজরুলের মাজার পেরোতেই মনে হলো, কবি কী শুনতে পাচ্ছে জনতার উল্লাস? কবি ঘুমিও না। আমরা জেগে আছি।
ডা. মিলন স্তম্ভের কাছে আসতেই সাংবাদিক হারুন হাবীব বললেন, ‘উর্মি কতক্ষণ পর তুমি সবচেয়ে খুশি হবে।’
আমি বলি, ‘কেন, হারুন ভাই?’
‘স্বৈরাচার নাকি নিপাত যাচ্ছে?’
‘বলেন কী?’
‘হ্যাঁ। এ সংগ্রামে তুমি তো আলোচিত নারী।’
‘সংবাদে আপনার কলাম পড়লাম। রাষ্ট্রধর্ম বদলানোর কারণে দেশে মৌলবাদীদের উত্থান ঘটবে। বিষয়টি আমাকে নাড়া দিয়েছে।’
‘ধন্যবাদ। দেখো, অপেক্ষা করো।’
ঠিক এ সময় জনতার গগনবিদারী চিৎকার আর হুড়োহুড়িতে হারুন ভাই হারিয়ে গেলেন। চামেলী আপা আমার এক হাত শক্ত করে ধরে আছে। টিএসসি চত্বর থেকে মাইকে ঘোষিত হচ্ছে, ‘এইমাত্র দাঁতাল এরশাদ প্রধান বিচারপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তিন দলের রূপরেখা অনুযায়ী নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী তিন মাসের ভিতর নির্বাচন হবে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।’
এখন আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বেবী আপার কাছে পৌঁছানো অসম্ভব।
সেøাগানে সেøাগানে বন্যার মতো মিছিল যাচ্ছে।
‘উর্মি, সেইফ সাইডে দাঁড়াতে হবে নইলে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে।’ চামেলী আপা বলতে থাকেন।
কিন্তু কোথায় দাঁড়াব, ঢাকা শহরে এত লোক সেটা তো আগে জানতাম না। বুক ধড়ফড় করছে। একধরনের ভয় কাজ করতে থাকে। টিএসসি খোলা চত্বরে বক্তৃতা করছে ছাত্র নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক, এবং  সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। হঠাৎ আমার মনে হলো, শহীদ জননীর শরীর খারাপ। আজকের দিনে কি তিনি থাকবেন না? ডা. মিলনস্তম্ভ ত্যাগ করতেই মনে হয়, ‘প্রিয়, শহীদ মিলন, আজ তোমার রক্তের জন্য এইসব।’
জনতার উন্মাতাল উল্লাসে সমগ্র ঢাকা শহর এখন মানুষের নগরী। মানুষের মনে এত ক্ষোভ জমা ছিল। নয় বছর স্বৈরশাসনের পর মানুষ যেন হাফ নিঃশ্বাস ফেলছে। এরপর মনে হলো, বক্তৃতা কেউ শুনছে না। মুহুর্মুহ করতালিতে মুখরিত যে নগরী সেখানে বাণী শোনার ধৈর্য কোথায়?
মঞ্চ থেকে ওরা অনেক দূরে। বেবী আপাকে দেখা যাচ্ছে না। কে কে বক্তৃতা করছে তাও বোঝার উপায় নেই। শুধু চামেলী আপা একবার বলল, ‘উর্মি ভুগ লাগছে তো?’
‘উপোস করুন।’
‘আমি তো আগে এত মানুষ দেখি নাই।’
জগন্নাথ হল মাঠে আতসবাজি ফুটছে। আকাশে আতশবাজির খেলা। বেবী আপা মাইক পেল রাত পৌনে দুটোয়। জনতার কণ্ঠ মেলানো আমি শুনতে পেলাম বেবী আপা নূর হোসেনসহ সকল শহীদের স্মরণ করছে। ওইটুকুই। বেবী আপার কণ্ঠ ধরে এগোতে গিয়ে ছাত্রদল নেতা খন্দকার বাবুল চৌধুরী, ছাত্রলীগ নেতা আবদুস সাত্তার টিংকুর দেখা পেলাম।
টিংকু ভাই বললেন, ‘উর্মিলা, আজকের দিনটি আমি তোমায় উৎসর্গ করলাম।’
আমি হেসে বলি, ‘কিছু করতে হবে না। দেশটার প্রতি মমতা রাখবেন।’
হঠাৎ মাইকে ঘোষিত হলো, ‘এই গণ-আন্দোলন একটি বাঁকের মধ্যে এসে বেগবান হয়েছে, সেই বাঁকের নাম, উর্মিলা পাল। আর শেষ হলো একজন নূর হোসেনের জন্য। নূর হোসেন নেই। উর্মিলা আছেন। এখন উর্মিলা পাল তার অনুভূতি জানাবেন।’
আমি লক্ষ করলাম সাংবাদিক কামাল লোহানী আমাকে ডাকছেন। পাশে কবি সুফিয়া কামাল। আমি মাইকের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার হাত পা কাঁপছে। টিএসসি চত্বরে লাখো জনতা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত জনতা হঠাৎ করে নিথর হয়ে যায়। আমি একবার বেবী আপা, একবার কবি সুফিয়া কামালের দিকে তাকালাম। আমার মনে হতে লাগল, এক জনমে মানুষ এর বেশি কিছু চায় না।
‘আমি শুভপুরের উর্মিলা পাল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখিনি। আজ এ দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের জন্য যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি উর্মিলা পাল হয়ে গেলাম। তার আগে একাত্তরের শহীদদের স্মরণ করছি। স্মরণ করছি বসুনিয়া, নূর হোসেন, ডা: মিলনসহ গণতন্ত্রের লড়াকু মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদদের। গণতন্ত্রের এ মুক্তির দিনে এ প্রত্যাশা রাখছি।  আর যারা দেশ চালাবেন, তারা যেন দেশ ও মাটির প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন। মনে রাখবেন, জননী-জন্মভূমি আক্রান্ত হলে এগিয়ে যেতে হয়। সন্তান হিসেবে এটাই আমাদের দায়িত্ব। আমি প্রতিজ্ঞা করছি। যতদিন বেঁচে থাকব ততোদিন এ ভূমির ফসল কাউকে লুণ্ঠণ করতে দেব না।’
চারদিক জনতার উল্লাসে আমি এখন মাইক ছেড়ে চলে এলাম। কবি সুফিয়া কামাল আমাকে জড়িয়ে ধরলেন গভীর মমতায়।
বেবী আপা একবার বলল, ‘উর্মি, তোর মতোন সন্তান জাতি উপহার পেয়েছে।’
আমি আবেগে কেঁদে ফেলি। রাত পৌনে তিনটার দিকে বেবী আপাকে নিয়ে আমি আর চামেলী আপা নজরুলের মাজার অতিক্রম করছি ঠিক তখনও মনে হলো, ‘কবিকে বলি, ঘুমিও না। আমরা জেগে  আছি। আর তুমি কেবলি কাস্তে শানানোর শব্দ শোনো।’
বেবী আপা একবার বলল, ‘উর্মি একটু চা খেলে ভালো লাগত।’
চামেলী আপা বলে, ‘ভুখে পেট পোড়ায়।’
শাহবাগের রাস্তায় চলছে নানান রকম বিজয় উৎসব। দেশাত্মকবোধক গান বাজছে মাইকে। ড্রাম আর খোল-করতালের দ্রিমিকি দ্রিমিকি শব্দ।
পিজি পেরোতেই বিচিন্তার মিনার মাহ্মুদের সঙ্গে দেখা।
বেবী আপাকে বললেন, ‘আপা, আমি দু’মিনিট উর্মিলা পালের সঙ্গে কথা বলি।’
‘বেবী আপা হেসে বলেন, আজকের দিনে তো ওর সঙ্গেই কথা বলবে।’
শেষ রাতে বেবী আপাকে ইন্দিরা রোড পৌঁছে দিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম তখন ভোর হয়ে আসছে। চারদিকের মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে, ‘কল্যাণের জন্য এসো।’ ডিসেম্বরের কনকনে শীতের এই ভোরবেলা অন্যরকম একটি সূর্যোদয় হবার আগেই আমি আর চামেলী আপা ঘুমিয়ে গেলাম।

যখন ঘুম ভাঙল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ক্লান্তিতে বিছানা ছাড়তে দেরি হলো। নিজেকে পরিপাটি করে  দুপুরের খাবার খেয়ে যখন কলেজে পৌঁছালাম তখন চারটা বেজে গেছে। কলেজজুড়ে উল্লাস চলছে। রিকশা থেকে নেমে গেট পেরুতেই সেøাগান এল, ‘উর্মিলা দিদি, এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে।’
আর কিছুই মনে নেই। কে আমাকে চ্যাংদোলা করে ডলি আপার রুমে নিয়ে গেল তা বোধগম্যের আগেই যেন কলেজ ক্যাম্পাস জনারণ্য হয়ে গেল।
ডলি আপা বলল, ‘ব্র্যাভো, উর্মিলা। তুমি আমাদের গর্ব।’
হই-হুল্লোড়ে কলেজ উড়ছে। ডলি আপার রুমের টিভিতে বারবার আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন স্পিস দিচ্ছেন। সবাই গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করছেন। কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা এড়াতে ছাত্র-জনতার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছেন। ডলি আপার রুম থেকে বেড়িয়ে দেখি সন্ধ্যা নামছে। নানান ছাত্র সংগঠনের নেত্রীরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
ছাত্রলীগ নেত্রী সালমা দিদি আমার গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘উর্মি আজকের দিনটির জন্য এত রক্তপাত। এ মালাটা রক্তে চুবানো নয়। ভালোবাসায় সিক্ত।’
আমি বললাম, ‘সালমা দিদি, আমি রাজনীতি বুঝি না। ন্যায়-অন্যায় বুঝি।’
সালমা দিদি বলেন, ‘তাতেই চলবে। তুমি আমাদের স্বপ্নের তরীর কাপ্তান। পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে আছ।’ আমার চোখে জল এল।  শ্রাবণের ধারার মতো জল। কেন আমি জানি না। সালমা দিদি আমাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন।
কলেজ থেকে বের হতে রাত আটটা বেজে যায়। গেট পেরিয়ে যেতেই মনে হয় ওই চায়ের দোকানে দীপু ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। একট্ ুএগিয়ে গেলে তড়িৎ এসে বলবেন, ‘দেবী ভেনাস, আপনার জন্য আমি  ট্রয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। পড়েননি? কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘নিহত জনক আগামেনন কবরে শায়িত আজ।’
আমি রিকশায় নাখালপাড়ার দিকে এগিয়ে যেতেই মনে হয়, ‘প্রিয় দীপু ভাই, আপনার জন্য এক জীবন অপেক্ষা করা যায়। শুভপুরের উর্মিলা পাল অপেক্ষা করছে।’ 
[সমাপ্ত]

ধোঁয়াশা

ধোঁয়াশা


ধোঁয়াশা
আহমদ আবদুল্লাহ

নিমগাছটা ঠিক রেল লাইনের পাশে বেড়ে ওঠেছে। গাছটির বয়স যে খুব বেশী হয়েছে তা নয়। তবে বয়সের তুলনায় খুব দ্রুত ডালপালা মেলে দারুণ ঝাঁকড়া চেহারা হয়েছে। গাঢ় সবুজ পাতাগুলো সকালের নরম বাতাসে আনন্দে যেন দুলে ওঠে। মিষ্টি রোদ যখন ঐ কচি সবুজ পাতায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন মনে হয় কেউ বুঝি পাতায় সোনারঙ মখমল বাতাসে শুকাতে দিয়েছে। এই নিমগাছটার একটি ডাল বেরিয়ে এসেছে রেললাইনের দিকে। দূর থেকে মনে হয় গাছটি তার একটি হাত বাড়িয়ে কাউকে সাহায্য করছে।

ঠিক এই ডালটায় বসে সকাল সন্ধ্যা গান করে এক জোড়া বুলবুলি। রাতের আঁধার সরে যেতে না যেতেই পাখি দুটোর কণ্ঠ বেজে ওঠে। কণ্ঠে কী মজার কারুকাজ! কেমন মিষ্টি সুরে গান করে জোড়া পাখি। গানের সুর যখন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এ নিমপাতার মত বাতাসও দুলতে থাকে।

রিহান কিশোর বয়স থেকেই বেশ পাখিপ্রিয়। সকাল-দুপুর বলে কথা নয়, যখন তখন সে পাখিদের দেখতে, গান শুনতে ছুটে যায় গাছ-গাছালিভরা কোন পার্ক কিংবা বনাঞ্চলে। ভোর থেকে সারাদিন পাখিদের পেছন পেছন এগাছ-ওগাছ ঘোরা তার নেশায় পরিণত হয়েছে। পাখিদের জন্য রিহানের এত ভালোবাসা কোত্থেকে জন্ম নিল, তার মা-বাবা চিন্তা করে পান না। শহরে জন্ম হয়েছে তার। ইট-পাথরের এই শহরে শিশুরা পুতুল কিংবা রোবট বা কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ততা থাকে সারাক্ষণ। অথচ রিহানের এমন পাখি প্রিয় সুলভ আচরণ দেখে খুবই অবাক হন তারা।

পাখি নিয়ে নানান কাহিনী আছে রিহানের। একদিন পাখির পেছনে যেতে অনেক দূর চলে আসে। পূব আকাশে তখন সূর্য নিবুনিবু। চারদিক অন্ধকার। কিন্তু রিহানের এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে। হঠাৎ পাখি উধাও হয়ে যায়। এতে রিহান ভয় না পেলেও চমকিয়ে ওঠে। বাসার ফিরতে প্রায় রাত হয়। আম্মু কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে রুমে চলে যায়। কেমন যেন বিরক্তির ছাপ তার চেহারায়। ধীরে ধীরে রিহানের অঙ্গ-ভঙ্গিমা সব কিছুতে পরিবর্তন হতে থাকে। সেদিন রাত থেকেই পাখিপ্রিয় রিহান হয়ে ওঠলো পাখি বিদ্বেষী। রিহানে এহেন আচরণ অনেকটা শংকিত মা-বাবা। কি করবেন ভেবে পান না তারা। হঠাৎ ছেলের মাঝে পরিবর্তন। এদিকে সাপ্তাহিক ছুটি প্রায় শেষের দিকে। প্রস্তুতি চলছে হোস্টেলে যাওয়ার।

বুধবার আসরের পর রিহান চুপচাপ বসে আছে রুমে। ইদানীং পড়ালেখায় একদম মনোযোগ নেই। সারাদিন কি যেন ভাবে আর গম্ভীরভাবে চুপটি মেরে বসে থাকে। কারও কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। তাই সাথীরাও বৃথা চেষ্টার পেছনে পড়ে না। রাত দুইটা। হঠাৎ রিহান ঘুম থেকে ওঠেই বড় বড় চোখ করে অদ্ভুত দৃষ্টিতে সবার দিকে নজর বুলালো। পাশের সীটে থাকা ফাহীম জেগে গেল তার আচরণে। কি করবে তখন, ফাহীমের কিছুই বুঝে আসছে না। ভয়ে ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখল কিছুক্ষণ। রিহান ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। ফাহীম চোখ খোলে দেখে রিহান নেই। কিন্তু পরক্ষণেই আওয়াজ পেলো রিহান বিছানায় শুয়ে পড়েছে।

ক্লাসে সবাই পড়ালেখায় মগ্ন। কিন্তু ফাহীমের মুখে ভয়ের ছাপ এখনও। ফাহীম কিছুক্ষণ পর পর রিহানের অঙ্গ-ভঙ্গির দিকে লক্ষ্য করছে আর ভাবছে আজ ক্লাসের পর তাকে গতকাল রাতের ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। ক্লাশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফাহীম রিহানকে বলল,
‘এই রিহান, রিহান! শোন।
‘কি? (বড় বড় চোখ করে)
‘গতকাল রাতে তোর কি হয়েছিলোরে?
‘মানে?
‘দেখলাম তুই ঘুম থেকে ওঠেই সোজা উপরে চলে গেলি।
‘যেখানেই যাই, তোর কাছে বলতে হবে নাকি? বলেই রুমে চলে গেল।

এক সপ্তাহ অন্তরায় বাসায় আসে রিহান। তাই আজ সে খুব খুশি। বাসায় যাবে, আম্মু আব্বুর সঙ্গে দেখা করবে। রিহান প্রতি বৃহস্পতিবার বাসায় যায়, এ নিয়মটি কেবল রিহানের জন্য। মেধাবী ছাত্র বলে কথা। কোনো পরীক্ষায় তাকে টপকিয়ে দ্বিতীয় হয়েছে এমন কেউ বলতে পারবে না আজ অবধি। সবার আদরের মধ্যমণি হিসেবে পরিচিত রিহান। ফাহীম রিহানকে বলল, ‘দোস্ত! নিজের দিকে একটু বেশী খেয়াল রাখিস।’ রিহানও হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল। বাড়িতে যাওয়ার আগে রিহান তার প্রিয় স্যারদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়া মাত্রই মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। পাশে থাকা শরীফ স্যার রিহানকে দ্রুত ধরে ফেললেন। কিছুক্ষণের জন্য সেখানে ছোটখাটো জটলা বেঁধে গেল। শরীফ স্যার সবাইকে চলে যাওয়ার আদেশ দিলেন।

রিহান শুয়ে আছে শরীফ স্যারের কামরায়। সহসা রিহান লাফ দিয়ে উঠেও আবার শুয়ে পড়ল। শরীফ স্যার বললেন, ‘কি হল রিহান?’
‘জি না স্যার, কিছু না। আমি ঠিক আছে।
‘আচ্ছা, তুমি চিন্তা কর না, তোমার আব্বু কিছু সময়ের ভেতর এসে পড়বেন। সাঈদ স্যারকে বলল, রিহানের আব্বু এসেছেন। শরীফ স্যার দেখা-সাক্ষাত ও কথা পর্ব শেষ করে বললেন, ‘আপনার ছেলের মধ্যে এ কদিন অদ্ভুত আচরণ দেখতে পাচ্ছি। আপনি খুব খেয়াল রাখবেন আর ডাক্তার অবশ্যই দেখাবেন।
‘জি স্যার, দোয়া করবেন খাছ করে ছেলেটার জন্য। আমার তিন ছেলের মধ্যে সবার ছোট রিহান। বুঝেনই তো অনেক আদরের।
‘ফি আমানিল্লাহ, দোয়া অবশ্যই করব।

রিহানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন আম্মু। রিহান বলে ওঠল, আরে কান্দো কেন? আমি তো ঠিক আছি। এইযে দেখ না, আমি তোমার সামনে।
‘চোখ মুছে আম্মু বললেন, ‘যাও বাবা হাত-মুখ ধুয়ে এসো। দুপুরের খাবার খেতে হবে।
‘জি আম্মু।
খাওয়ার মাঝে রিহানের বড় ভাই বললেন, কেমন আছিসরে ভাই? তোর শরীরের এই হাল কেনো? না ভাই, আমি ঠিক আছি।
‘আচ্ছা আগে খাবার খেয়েনে। পরে কথা বলব, সব খবর নিব।
‘জি ভাই।

আসরের পর বাসায় কেউই নেই। রিহান শুয়ে আছে নিজ কামরায় একলা ঘরে। আম্মু পেরেশান হয়ে গেলেন। মাগরিবের সময় হয়ে যাচ্ছে কিন্তু গরু কে আনবে তার কোন খবরই নাই। রিহানের আম্মু অনিচ্ছাবশত রিহানকে ডাক দিয়ে বললেন, পাশের বাগানে গরুটা বাঁধা আছে যা তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। রিহান ওঠেই চলে গেল। রিহান তার মা-বাবার একান্ত বাধ্যগত ছেলে। যা বলবে সঙ্গে সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করবে। তাই রিহান ছিল সবার প্রিয়।

সুনসান নীরবতা, মাগরিবের ঠিক পূর্বমুহূর্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের আজান দিবে। রিহান গরুর খোটা টান দেয়া মাত্রই পড়ে গেল মাটিতে। পানি ছিল টাখনু সমান। পানির ভিতরই ঝাপটাতে লাগল। মনে হচ্ছে কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে বারংবার পানিতে চুবাচ্ছে। অনেকটা শক্তি প্রয়োগ করেও রিহান ওঠতে পারছে না। পুরো শরীর যেনো অবশ হয়ে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে রিহানের আব্বু বাসায় এসে বললেন, রিহান কোথায়?
‘তাকে গরু আনার জন্য পাঠিয়েছি।
‘ইন্নালিল্লাহ, তুমি কি জান না? এ সময়ে জ্বীন, ভূত ও পেতœীর আনাগোনা বেড়ে যায়। আমাদের প্রিয় নবী (সা) এর হাদিস কি খেয়াল নেই তোমার? হুজুর (সা) বলেছেন, ‘মাগরিবের পূর্ব মুহূর্তে তোমরা তোমাদের বাচ্চাদেরকে ঘরের বাইরে বের হতে দিবে না। ঘরে বন্দি করে রাখবে। অন্যথায় খারাপ জ্বীনের নজর এমনকি ক্ষতিও করতে পারে।’

রিহানের আব্বু কোনরকম বিলম্ব না করে দ্রুত এসে পড়লেন গরুর কাছে। কিন্তু গরুর কোন চিহ্নই দৃষ্টিগোচর হল না। তার মাঝে এক ভয় কাজ করতে লাগল। তাহলে রিহান কোথায়? সহসা অদূরে কি যেনো লাফাচ্ছে পানিতে। দ্রুত সেখানে গিয়ে যা দেখলেন তার জন্য তিনি নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। বিকট চিৎকার দিয়ে পানিতে ঝাপিয়ে পড়লেন। ছেলেকে ওঠাতে গিয়ে পারলেন না। কে যেনো তাকেও জড়িয়ে ধরছে। পাশের মসজিদ হতে আজানের সুমধুর আযানের শব্দে সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে গেলো। কোনরকমভাবে রিহানকে বাসায় নিয়ে এলেন। পাড়ার লোক সকল জড়ো হয়ে গেল তার চিৎকারে।  শান্তনা দিয়ে সবাই সবার মত করে চলে গেল। কিন্তু এক বৃদ্ধ হঠাৎ বলে ওঠলো, ‘তোমার ছেলে বেশীদিন বাঁচবে না, তাকে সাবধানে রাইখো।’ রিহানের বাবা অসহায়ের মত তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলের পরিষ্কার করার কাজে লেগে গেলেন। এদিকে জানা গেল রিহানের গরুর মাথা পাশের পুকুরপাড়ে ভাসমান। অবাক রিহানের আব্বু খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। পাশেই রিহানের আম্মু বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন, কান্না করছেন খুব। তার কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে এলো।

রিহানের জ্ঞান ফিরেছে ঘণ্টা খানিক আগেই। সকলের মনোযোগ এখন রিহানকে নিয়ে। রিহানের আম্মু এক দৌড়ে তার ছেলের পাশে বসে গালে কপালে চুমু দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘কেমন লাগছে বাবা? কি হয়েছিল বাবা তোর?’ রিহান চুপ। কোনো কথা নাই। বারবার রিহানের আম্মু বলছেন, ‘বল বাবা কি হয়েছে তোর, বল বাবা।’ মায়ের চোখের পানিতে রিহানের জামা ভিজে গেছে অনেক আগেই। রিহান ওঠে বসল, সবার দিকে অবাক দৃষ্টি। আম্মু কাঁদছো কেন? কি হয়েছে ? এখানে এতো ভিড় কেন? আব্বু তোমার চোখে পানি কেন? ভাইয়া তোমার চোখ ফুলা কেন? কি হয়েছে আমার?
‘না, কিছুই হয়নি তোর। তুই ভালো আছিস।
আমার কোলে ঘুমাবি এখন থেকে। প্রতিদিন এভাবেই ঘুমাবি বাবা। রিহানের গাল বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ল। মা বললেন, বাবা কান্দিস না। আমি তোর কান্না সহ্য করতে পারি না। রিহান ঘুমিয়ে পড়ল মায়ের কোলে। আরামের ঘুম, যে ঘুমের তৃপ্তি পুরো পৃথিবীর সব ঘুমকে হার মানাবে।

বর্ষার পানি নেমে গেছে। খোলা পানির মাছেরা আশ্রয় নিয়েছে নদ-নদী আর খাল-বিল ডোবায় এতদিন অথৈ পানিতে সাঁতার কাটা মাছদের জন্য বিল-ঝিল যেন কয়েদখানা। তাই একটু বৃষ্টির ছোঁয়া পেলে মাছেরা উজান স্রোতে ছুটে আসে। মুক্তির উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে। উজানী মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। রিহানের সখ জাগলো মাছ ধরার। এমন মুহূর্তে কার মন না চায়। তাই একদিন রিহান পাশের বাড়ির মাহমুদের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে। মাহমুদ রাজি হয়ে গেল। উভয়ে সানন্দে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ল। অনেকগুলো মাছ ধরেছে তারা। এদিকে বেশ সময়ও হয়েছে। মাহমুদ ওঠে পড়ল। কিন্তু রিহান এখনও মাছ ধরায় ব্যস্ত। মাহমুদ বলল, ‘দোস্ত! চলে আয়।’ 
‘আর কিছুক্ষণ দোস্ত।
‘না, না! দুপুর হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি এসে পড়।
‘আচ্ছা তুই যা,আমি আসছি।
‘আচ্ছা।

দুপুর ২টা। রিহানের কোন খবর নাই। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে পাড়াপড়শি সবাই। মা দিশেহারা হয়ে এদিক সেদিক ঘুরছে আর কান্না করছে। হঠাৎ রিহানের চাচা জাফরের বিকট চিৎকার, সবাই তার কাছে এলো। কি হল জাফর? কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন রিহানের আব্বা। জাফর কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা দিয়ে বললেন, ঐ যে রিহান। রিহানের আম্মু এক চিৎকারে অজ্ঞান। বাবা পড়ে যাওয়া অবস্থা। রিহান ভাসছে পুকুর পারে। পা উপরে মাথা নীচুতে। রিহানের বড় ভাই রিহানকে ওঠাতেই অঝর ধারায় রক্ত বের হতে লাগল। কোন থামাথামি নেই। তাজা রক্ত বের হচ্ছে। রিহানকে নিয়ে আসা হল বাসায়। রিহানের আম্মুর আর্তনাদে এলাকার সবার চোখে পানি এসে পড়েছে। বাবা কোনরকম নিজেকে সামলিয়ে নিলেন।

কাফনের কাপড় আর খাটিয়া রক্তে রঞ্জিত। রক্ত বন্ধ করার কোনো উপায় খোঁজে পাচ্ছে না কেউ। বাবা জানাযার ইমামতি করবেন সন্তানের। কি নির্মম দৃশ্য। প্রথম তাকবীর বলার সাঙ্গেই বাবা অজ্ঞান। এদিক দিয়ে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে মসজিদ প্রাঙ্গন। দ্বিতীয়বারও অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তৃতীয়বার পড়ালেন খুব কষ্ট করে। মায়ের কান্না চিৎকার ভেসে আসছে এখনও। কি নিদারুণ দৃশ্য। বাবা আর রিহানের বড় ভাই মিলে রক্তাক্ত রিহানকে কবরে রেখে চলে এলেন বাসায়।

দুদিন পর সেই লোকটি এসে বললেন, ‘আমি যা বলি তা বাস্তবে ঘটে যায়। বলেছিলাম, তোমার ছেলে বাঁচবে না বেশীদিন।’ রিহানের বাবা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই লোকটি উদাও। কিন্তু কে এই লোকটি? কি দোষ ছিলো রিহানের? কেন হল এমন করুণ পরিণতি? তা আজও রহস্যের চাদরে ঢাকা, ধোঁয়াশার আবরণে ঘেরা। আদৌ কি এ রহস্যের চাদর, ধোঁয়াশার আবরণ উন্মোচিত হবে? অজানা সবার....

শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।