গৃহবন্দি গৃথিবী : প্রকোষ্ঠে রুদ্ধ মানবজীবন
গৃহবন্দি গৃথিবী : প্রকোষ্ঠে রুদ্ধ মানবজীবন
আসআদ শাহীন
হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে থাকতে তনুমন বেশ অস্বস্তিকরের মাঝে কাটছে। তাই একটু বাহিরে আসলাম। গহীন তমিস্র রাত। নিশীথ প্রস্ফুটিত শ্বেতকাঞ্চনের আঘ্রাণে গুঞ্জিত প্রকৃতিজ। রাতের কৃষ্ণাভ অন্তরীক্ষ জোনাকিপোকার হলুদাভ রঙয়ে রঙিন হয়ে এক বিচিত্র রূপে সসজ্জিত। মনোহর-মনোজ্ঞ আমার প্রাণের গ্রামীণ পল্লি। নৈসর্গিক লালিত্য-মনোহারিতার লীলাভূমি বালিতিতা। সবুজের সামিয়ানায় ঘেরা। সৌম্য শান্তের এক বিরল রূপকার। আজকের হিমাংসুর ঔজ্জ্বল্যদীপ্ত রশ্মি বেশ চমকপ্রদ। নিশাকান্তের নিঃসৃত জ্যোৎস্না পুকুরের সলিল জলে ঝিলমিলিয়ে উঠেছে। জ্যোৎস্নাবিধৌত জলে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভাবনার অতল সাগরে ডুবে যাই। আর এমন দৃষ্টিশোভন প্রাকৃতির ফরাশে ভাবান্তর মন শায়িত হয়ে কেবলই কাব্যের মূর্ছনায় বিমুগ্ধ হয়। এমনই জ্যোৎস্নাময় লগনে বোধোদয় হলো কবি হরিশঙ্কর রায়ের কবিতার কথা। কতই না চমৎকার করত; কাব্যিকতায় এই প্রকৃতির কথা ব্যক্ত করেছেন-
‘দিনের যবনিকা প্রান্তে
চারিদিক কোলাহল পূর্ণ।
অবশেষে রাত্রি নীরব।
প্রকৃতি এক ঘুমন্ত শিশুর মত।
পাশ ফিরে চায়; কত রাত জাগা পাখি,
ডুকরে ডুকরে, কেঁদে উঠে।
যেন অনন্ত যৌবন তরঙ্গ ¯্রােতে মত্ত।
কি যেন নাই, কে যেন নাই,
শুধু জেগে থাকে ক্ষীণালোক তারকারাজী।
ফুল পাপিয়ার মুহু মুহু গন্ধ ভাসে
বাঁশের ঝাড়ে জোনাকী জ্বলে
প্রকৃতি অন্ধকারে যেন বিরহিনী।’
তদ্রুপ কবি জীবনানন্দ দাশ তিনিও নিশিকান্তের প্রেমে মুগ্ধ হয়ে কবিতার ক্যানভাসে তুলি দিয়ে এঁকেছেন-
‘বেবিলোন কোথা হারায়ে গিয়েছে-মিশর-অসুর কুয়াশাকালো;
চাঁদ জেগে আছে আজও অপলক, মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!
সে যে জানে কত পাথারের কথা, কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!
কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জোছনা, শুক্লা তিথি!
হয়তো সেদিনও আমাদেরই মতো পিলুবারোয়ার বাঁশিটি নিয়া
ঘাসের ফরাশে বসিত এমনি দূর পরদেশী প্রিয় ও প্রিয়া!
হয়তো তাহারা আমাদেরই মতো মধু-উৎসবে উঠিত মেতে
চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে, সবুজ চরায়, সবজি ক্ষেত!
হয়তো তাহারা মদঘূর্ণনে নাচিত কাঞ্চীবাধঁন খুলে
এমনি কোন এক চাঁদের আলোয়-মরু ওয়েসিসে তরুর মূলে!’
অনুরূপভাবে আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও শব্দ ও উপমার রেকাব টেনে বলেছেন-
‘কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে,
হাবুডুবু খায় তারা-বুদবুদ, জোছনা সোনায় রাঙে!
তৃতীয়া চাঁদের ‘সাম্পানে’ চড়ি চলিছে আকাশ প্রিয়া,
আকাশ-দরিয়া উতলা হ’ল গো পুতলায় বুকে নিয়া।
তৃতীয়া চাঁদের বাকি ‘তের কলা’ আবছা কালোতে আঁকা
নীলিম-প্রিয়ার নীলা ‘গুল রুখ’ অব-গুণ্ঠনে ঢাকা।
সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রাণী,
সেহেলি ‘লায়লী’ দিয়ে গেছে চুপে কূহেলী-মশারী টানি!
দিক-চক্রের ছায়া-ঘন ঐ সবুজ তরুর সারি,
নীহার-নেটের কুয়াশা মশারি ওকি বর্ডার তারি?
সাতাশ তারার ফুল-তোড়া হাতে আকাশ নিশুতি রাতে
গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে!’
প্রামীণ পল্লীর এই রাতের নৈসর্গিকতা বেশ উপভোগ্য। খোলা আকাশ। নিঝুম রাত। মৃদুমন্দ দমকা হাওয়া। গাছে গাছে পত্রপল্লবের মর্মরধ্বনি। বলাবাহুল্য শহুরে জীবন আর গ্রামীণ জীবনের মাঝে আকাশপাতাল ব্যবধান বিদ্যমান। শহরের পরিবেশ থেকে গ্রামীণ পরিবেশ অনেক আরামদায়ক। পড়ালেখার তাগিদে শহরে থাকতে হয়। তাই সারাক্ষণ গ্রামের কথা স্মরণ হয়। তবে সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস ইস্যুতে এবার অনেকদিনের ছুটি কাটানোর বন্দবস্ত হয়েছে। জীবনের প্রথম দীর্ঘতম ছুটি। জানি না জীবনে এমন দিনগুলো আর ফিরে পাবো কিনা!
সারাদিনে হয়ত বা কোরআন তেলাওয়াত কখনো, কখনো বই পাঠ আবার দিনের যবনিকায় পুরনো অভ্যাসানুযায়ী ডায়েরি ও কলম নিয়ে রোজনামচা লিখতে বসা। তবে একটা বিষয় ভালোই লেগেছে তা হলো এ কয়েকদিনে বুকশেলফে থাকা পুরাতন বইগুলো আবার পড়ার সুযোগ হয়েছে। ধুলোবালিতে ধূসরিত-মলিন বইগুলো পুনরায় পরিষ্কার করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার অনুভূতি অনুভব করে বোধ হলো আমি যেন সেই আশৈশবে পৌঁছে গিয়েছি। যার পুরো সত্ত্বা জুড়েই ছিল নতুন নতুন বইয়ের গ্রাণে উন্মাদক। শেলফের ওপর জমে থাকা ধুলোবালি পরিষ্কার করার সময় সহসা করতলস্থ হলো অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’। তাঁর মহাকাব্যিক এই উপন্যাসটি আগেও পড়েছি। আজকেও পড়ছি। কিন্তু নতুন এক ভিন্নতর স্বাদ পাচ্ছি। ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এর এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়-এপ্রিল, ১৯৭১। উপন্যাসটিকে যদি কয়েক লাইনে সারসংক্ষেপ করা হয় তাহলে এই দাঁড়ায়। বিপুল বাংলাদেশের ছোট্ট একটি গ্রামের কথা। আর সেই ছোট্ট গ্রামটির মধ্যে দিয়েই গোটা বঙ্গদেশকে এঁকেছেন লেখক। প্লাট স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু। আছে রায়টের ক্ষুদ্র প্রচ্ছদ, মুসলিম লীগের তৎপরতার কথা। আর সেই সাথে ধানের শীষে আর নদীর বহমানতায় বাঙালির জীবন, বৃহৎ অর্থে বাংলাদেশের জীবন এবং তার রঙ।
এই করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্ব আজিকে লকডাউন পালনে ব্রত। ইতিহাসের পাতায় চির অমর হয়ে থাকল। ইতিহাস গবেষণা করলে দেখা যায় পৃথিবীতে এর আগেও মহামারি এসেছে। একেক সময় একেক মহামারি। ইতিহাসের পাতা উল্টালেই দেখি-
১. খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দ: এথেন্স
পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে একটি রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানের লিবিয়া, ইথিওপিয়া ও মিসর ঘুরে তা গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ রোগে ওই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়। ওই রোগের মূল লক্ষণ ছিল জ্বর, প্রচ- তেষ্টা, গলা ও জিব রক্তাক্ত হওয়া, ত্বক লালচে হয়ে যাওয়া ও ক্ষত সৃষ্টি। ধারণা করা হয়, এটি ছিল টাইফয়েড জ্বর। বলা হয়ে থাকে, এমন মহামারির কারণেই স্পার্টানদের কাছে যুদ্ধে হারতে হয়েছিল এথেনিয়ানদের।
২. ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দ: জাস্টিনিয়ান প্লেগ
মিসরে প্রথম এই রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে ফিলিস্তিন ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি। পরে পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এই প্লেগ তা-ব চালায়। সম্রাট জাস্টিনিয়ান ওই সময় রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাইজেন্টাইনকে একীভূত করার পরিকল্পনা করছিলেন। মহামারিতে সব ভেস্তে যায়। শুরু হয় অর্থনৈতিক সংকট। এই রোগ পরবর্তী আরও দুই শতাব্দী ধরে বিভিন্ন সময়ে মহামারি আকার নিয়েছিল। মারা গিয়েছিল প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। তখনকার হিসাবে এটি ছিল পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ। এই প্লেগের মূল বাহক ছিল ইঁদুর। মূলত মানুষের চলাচলের মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে।
৩. একাদশ শতাব্দী: কুষ্ঠ
কুষ্ঠরোগের অস্তিত্ব ছিল আগে থেকেই। কিন্তু মধ্যযুগে ইউরোপে এই রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। কুষ্ঠ ব্যাকটেরিয়াজনিত একটি রোগ। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত কুষ্ঠ ছিল প্রাণঘাতী রোগ। বর্তমানেও বছরে লাখ লাখ লোক কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আর এই রোগে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে না।
৪. দ্য ব্ল্যাক ডেথ: ১৩৫০ সাল
এই মহামারিতে তৎকালীন সময়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়েছিল। একে বলা হয় একধরনের বুবোনিক প্লেগ। একটি নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া এ রোগের জন্য দায়ী। দ্য ব্ল্যাক ডেথ নামে খ্যাতি পাওয়া এই মহামারি প্রথমে এশিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরে তা পশ্চিমে ছড়ায়। একপর্যায়ে পুরো ইউরোপ এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত এলাকায় প্রাণহানির ঘটনা এতই বেড়ে যায় যে রাস্তাঘাটে পড়ে ছিল মানুষের লাশ। এসব লাশ পচে গলে আরেক দুঃসহ সংকট সৃষ্টি করে। শুধু এই মহামারির কারণে ওই সময়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যুদ্ধ থেমে যায়। এই প্লেগে জনমিতিগত ও অর্থনৈতিক ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় ধসে পড়েছিল ব্রিটিশ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা।
৫. দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন: ১৬৬৫ সাল
এটিও ছিল বুবোনিক প্লেগ। এতে লন্ডনের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের মৃত্যু হয়। প্রাথমিকভাবে রোগের উৎস হিসেবে কুকুর-বিড়ালের কথা ভাবা হয়েছিল। রোগের আতঙ্কে তখন নির্বিচারে শহরের কুকুর-বিড়াল মেরে ফেলা হয়। লন্ডনের বন্দর এলাকায় এই প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে।
৬. প্রথম কলেরা মহামারি: ১৮১৭ সাল
কলেরা রোগের প্রথম মহামারির শুরুটা হয়েছিল রাশিয়ায়। সেখানে এতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। দূষিত পানির মাধ্যমে এই রোগ পরে ব্রিটিশ সেনাদের মধ্যে ছড়ায়। পরে তা ভারতে ছড়ায়, যাতে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতেও কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি ও আমেরিকায়ও কলেরা ছড়িয়ে পড়ে মহামারি আকারে। এসব অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ফলে সব মিলিয়ে ২২২৩ লাখ লোক মারা যায়। এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী আরও দেড় শ বছর ধরে কলেরা বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় মহামারি আকারে দেখা দিয়েছিল।
৭. তৃতীয় প্লেগ মহামারি: ১৮৫৫ সাল
চীন থেকে এর সূত্রপাত হয়েছিল। পরে তা ভারত ও হংকংয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় দেড় কোটি মানুষ এই মহামারির শিকার হয়েছিল। ভারতে এই মহামারি সবচেয়ে প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছিল। ইতিহাসবিদেরা বলে থাকেন, এই মহামারিকে উপলক্ষ হিসেবে নিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসকেরা নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নেয় এবং সেসবের মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করে।
৮. রাশিয়ান ফ্লু: ১৮৮৯ সাল
ফ্লুর মাধ্যমে সৃষ্ট প্রথম মহামারি ছিল এটি। সাইবেরিয়া ও কাজাখস্তানে এর সূত্রপাত। পরে মস্কো হয়ে ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ডে তা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ইউরোপেও দেখা দেয় মহামারি। সমুদ্র পেরিয়ে উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকা অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই ফ্লু। ১৮৯০ সালের শেষ নাগাদ এই রোগে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
৯. স্প্যানিশ ফ্লু: ১৯১৮ সাল
এই মহামারিতে বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয়, স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তিস্থল ছিল চীনে। চীনা শ্রমিকদের মাধ্যমে তা কানাডা হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৮ সালের শুরুর দিকে এই ফ্লু উত্তর আমেরিকায় দেখা দেয় এবং পরে ইউরোপে ছড়ায়। স্পেনের মাদ্রিদে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর এর নাম হয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মে এই রোগের প্রকোপ কমে আসে। সালফা ড্রাগস ও পেনিসিলিন তখনো আবিষ্কৃত না হওয়ায় স্প্যানিশ ফ্লু অত্যন্ত প্রাণঘাতী রূপে দেখা দিয়েছিল। স্পেনের মোট ৮০ লাখ মানুষ এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি।
১০. এশিয়ান ফ্লু: ১৯৫৭ সাল
হংকং থেকে এই রোগ চীনে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তা ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যুক্তরাজ্যে ব্যাপকভাবে ছড়ায়। এ কারণে প্রায় ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়ে। ১৯৫৮ সালের শুরুর দিকে এশিয়ান ফ্লু দ্বিতীয়বারের মতো মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় এশিয়ান ফ্লুতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গিয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষ। পরে ভ্যাকসিন দিয়ে ওই মহামারি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল।
১১. এইচআইভি/এইডস: ১৯৮১ সাল
১৯৮১ সালে এইডস প্রথমবারের মতো শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এইচআইভি ভাইরাস মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ১৯২০ সালের দিকে পশ্চিম আফ্রিকায় এই ভাইরাসের উদ্ভব ঘটে। রোগ শনাক্তের পর থেকে এ পর্যন্ত এইডসে বিশ্বব্যাপী সাড়ে তিন কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
শেষকথা: সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস ইস্যুতে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে পৃথিবী। ইট-কঙ্করের বড় বড় প্রাসাদ,অট্টালিকা ও প্রকোষ্ঠের চার প্রাকারের মাঝে রুদ্ধ মানবজীবন। অখ- বিশ্ব এহেন পরিস্থিতিতে এক ভয়াল সময় অতিবাহিত করছে। আতংক, ভয় ও ডরের শিকলে বন্দি বিশ্বায়ন। সময় প্রবাহ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। থমকে গিয়েছে বিশ্বচক্র। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস ইস্যু বিশ্বচরাচরকে পাল্টে দিয়েছে। পাল্টে দিয়েছে তারিখ। চীন, ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে।
সমীরণের বেগে ভেসে আসছে কর্ণকুহরে মৃত্যুর বার্তা। এমন একটি ব্যাধি-যা মানুষকে বিষিয়ে তুলেছে। আপনজনের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। এই করোনা নামক এক ক্ষুদ্র ভাইরাসে সমগ্র বিশ্ব কুপোকাত। মৃত্যুর ভয়ে ত্রস্তবিভীষিকা সমগ্র মেদিনীর মানবকুল। মৃত্যুর এই মিছিলে ক্রমশই বাড়ছে শবের সারি। এমন এক মৃত্যু যে-মৃত্যুর সময়ও মৃতের পাশে থাকছে না কোনো আপনজন। এই শেষ বিদায়ী যাত্রায় পাচ্ছে না যথাযথ সম্মানটুকুও।
করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে থাকছে না কেউ। মানুষ পারছে না মানুষদের সাথে মিশতে। মুসাফাহা ও মুআনাকাও করতে পারছে না লোক সকল। এই ভয়াল করোনা ভাইরাস গ্রাস করে নিয়েছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি-লাল সবুজের প্রতীকরূপ বাংলাদেশকে। ক্রমাগতভাবে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। শবের মিছিলে যোগদান করেছে এদেশের জনতাও। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সকলেই অবিদিত যে এই শবের মিছিল কত দীর্ঘ হতে চলেছে...!
(তথ্যসূত্র:
ডিজিজ অ্যান্ড হিস্ট্রি, ফ্রেডারিক সি.কাটরাইট, ২০১৪, ডিজিজ: দ্য স্টোরি অব ডিজিজ অ্যান্ড ম্যানকাইন্ডস কনটিনিউয়িং স্ট্রাগল অ্যাগেইনস্ট ইট, মেরি ডবসন, ২০০৭, হিস্ট্রি ডট কম এনসাইক্লোপিডিয়া অব পেস্টিলেন্স, প্যানডেমিকস অ্যান্ড প্লেগস, এড.জোসেফ পি. বায়ার্ন, ২০০৮, ইনফ্লুয়েঞ্জা, দ্য আমেরিকান এক্সপেরিয়েন্স সোর্স বুক অব মেডিকেল হিস্ট্রি, লোগান ক্লেনডেনিং, ১৯৬০)
আসআদ শাহীন
শিক্ষার্থী: আন্তর্জাতিক ইসলামি আরবী বিশ্ববিদ্যালয় "আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া" চট্টগ্রাম।
বেদনার নক্ষত্র
বেদনার নক্ষত্র
শফিক নহোর
ক .
ভোরেই পাশের বাড়িতে হট্টগোল। চিৎকার আর চেঁচামেচির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন আমাকে নাম ধরে ডাকলো। আমি তখনো বিছানায় শুয়ে আছি। বিছানা ছেড়ে উঠবো, কিন্তু অলসতার কারণে উঠতে পারছি না। পুরোটা শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। অপরিচিত একটি মুখ আমার চোখের সামনে বৈদ্যুতিক বাতির মতো জ্বলে উঠলো।
‘রিয়াদ, প্লিজ ওঠো! ঘুমানো কি শেষ হয়নি তোমার?’
খানিকটা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। চোখ কচলাতে কচলাতে চারপাশে তাকালাম। কিন্তু কাউকেই চোখে পড়লো না! কী আশ্চর্য! আমি কি সত্যিই ঘুম থেকে উঠেছি? নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখলাম। হ্যাঁ, আমি তো বিছানা ছেড়ে পা ঝুলিয়ে আছি! তাহলে যে মেয়ের কণ্ঠটি ভেসে এলো, সে কে?
রিপার সাথে হঠাৎ করেই একদিন কলেজে আমার পরিচয়। যেদিন ভর্তি হই, গুণে গুণে ঠিক তার তেরোদিন পর। মেয়েটির কান্নাকাটি আমাকে অবাক করে দিয়েছিল।
দেখতে দেখতে কতোগুলো দিন চলে গেল! আমরা একে অপরের সম্পর্কে জানলাম, পরিচিত হলাম। এরপর আমাদের মাঝে একটা সম্পর্কও তৈরি হল- যাকে বলে ‘বন্ধুত্ব’।
ভীষণ আবেগি মেয়ে রিপা। যেকোনো ছোটোখাটো বিষয়কেও বেশ প্রাধান্য দিত। আমি মনেকরি এটা ওর একটা ভালো গুণ ছিল। ওর কথায় কিছুটা আধ্যাত্মিক ভাব ছিল। হুট-হাট অনেক কথা বলতো। ওর ছেলেমানুষী আমার ভীষণ ভালো লাগতো। বেশ আহ্লাদী ঢঙের রোমান্টিক মেয়ে রিপা।
রিপা কেন জানি আমার গা ঘেঁষে বসতে চাইতো। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আমার জামার কলার ধরে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিতো। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ফেলতো। তখন তারুণ্যের জোয়ারে আমি সবেমাত্র স্মোকিং শুরু করেছি। ব্যাপারটা অনেকটা ‘সঙ্গদোষে লোহা ভাসে’ এরকম। ফলে প্যান্টের পকেটে প্রায়ই সিগারেট থাকতো। রিপা সিগারেট পেলেই ভেঙে ফেলতো। শেষে পাঁচকথা শুনিয়ে ছাড়তো। বলতে গেলে খানিকটা ঠোঁটকাটা স্বভাবের মেয়ে।
রিপা নিজেই ওর বিষয়ে গল্পবলা শুরু করতো। বলতো, ‘মা জন্মের সময় আমার মুখে দুধ না দিয়ে নিমপাতার রস দিয়েছিলেন। তবে এখন আর সেদিন নেই; হাসপাতালে বাচ্চা হয় বলে এসবের বালাইও নেই। মা প্রায়ই বলেন, পরিচিত কেউ নাকি আমাকে বিয়েই করবে না।
আমার মা গ্রামের মেয়ে। তাই তাঁর চলনে-বলনে কেমন যেন একটা গ্রাম্য ভাব আছে। পৃথিবী এখন মেট্রোরেলের গতিতে এগিয়ে চলছে। মা হয়তো তা বিশ্বাস করেন না, নয়তো আমলে নেন না। সবার হাতে মোবাইলফোন। কেউ কারোর বাড়ি যাচ্ছে না, অথচ সব খবর পাওয়া যায়। ইন্টারনেটের সুবিধা পেয়ে অধুনা সবাই একটা পারস্পরিক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি করে নিয়েছি। এখন সে দেওয়াল পরিবার থেকে সমাজ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। মা তবুও তাঁর সেই পুরোনো চিন্তাভাবনার ভেতরেই ডুব মেরে থাকতে চান। আমি বুঝি, মা’র ভেতরে শিক্ষার আলো নেই। তাছাড়া গ্রামে মানুষ হয়েছেন। ছেলেবন্ধু তাঁর একদম পছন্দ না। আমার মা যে এতো সুন্দরী, অথচ মনেহয় না কখনো কারোর সঙ্গে প্রেমটেম করেছিলেন। বেচারি জীবনে কতো কী মিস করেছেন। তাঁর কাছে জীবনে মানে সংসার, স্বামী আর ছেলেমেয়ে। এসব ভাবনার ভেতর থেকে বের হওয়ার কথা মা’র কখনো হয়তো মনেই হয়নি।
আমার কোনো মেয়েবন্ধু নেই। যাদের সাথে চলি তারা ঠিক বন্ধু না, সহপাঠী। বন্ধুত্ব আলাদা জিনিস। কারণ বন্ধুর কাছে মনের সব গোপনকথা খুলে বলা যায়। এরকম আচরণ দেখে অনেকেই জেলাস ফিল করে। কেউ কেউ হিংসায় জ্বলে ওঠে। কমনরুমে প্রায়ই মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়া হয়। কেউ কেউ চরম উৎসাহ নিয়ে ফিসফিস করে কতকিছু জিজ্ঞেস করে। যেমন- ‘তোর ব্রা এতো টাইট কেন রে? তোর ফিগারটাও তো খুব সুন্দর!’ মেয়ে হয়ে মেয়েদের থেকে এসব প্রশংসা শুনতে আমার কখনও ভালো লাগে না। বিশেষ করে মৌসুমী আর সালমা এমন টাইপের গল্প করতে পছন্দ করে। গোপনে কী সব বাজে ধরণের বই পড়ে! আমাকে ইশারায় ডাকে। ওরা আকার ইঙ্গিতে কতো কী বোঝাতে চায়। আমি কখনো কারোর মনের মতো হতে পারলাম না!’
রিপার আজ ভীষণ মনখারাপ। এই প্রথম কলেজে শাড়ি পরে এসেছে। কলেজের পুকুরের পাড়ে কৃষ্ণচূড়া আর তার পাশের বটগাছের নিচে একাকী বসে কী যেন ভাবছে?
আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পর সম্বিৎ ফিরলো রিপার। সে আমাকে দেখেই চোখের জল আড়াল করে মেকি হাসি ছড়িয়ে দিল। ইশারায় পাশে বসবার সম্মতিও দিল। তারপর আমি খানিকটা ওর শরীর ঘেঁষেই বসলাম।
-কী ব্যাপার? বলো তো? তুমি কাঁদছিলে কেন?’
-না, তেমন কিছু না। একটা স্মৃতি মনে পড়েছিল, তাই...।’
-তোমার সেই স্মৃতির কথা আমাকে বলবে না?
‘আমার সেসব স্মৃতি শোনে তুমি কী করবে? তারচেয়ে এইতো বেশ ভালো আছো বন্ধু।’
প্রকৃতি নির্দিষ্ট একটা সময়ে নিজস্ব রূপ নিয়ে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। প্রকৃতির এই নিজস্বতা যেন প্রতীকী, সেখানে আপন পর বলে কিছুই থাকে না। পাতা ঝরার সময় হলে পাতা ঝরে, কুঁড়ি আসার সময় হলে কুঁড়ি আসে। সে তার নিজস্বতা বজায় রাখে। আমরা প্রকৃতির মতো হতে চেয়ে নিজেদের ক্ষতি বয়ে বেড়াই। এভাবেই হারিয়ে ফেলি আমাদের নিজস্বতা। শেষ সময়ে মেকি যা পাই, ভেবে নেই এই বুঝি ভাগ্যে ছিল। বিধাতা আমার জন্যও তাই রেখেছেন। এ নিয়েই সুখী হতে হবে।’
-রিপা, তুমি নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছো।’
-তা হবে কেন?’
-তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছো?
-এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কি আছে, বল ? ‘নিশ্চয়ই তোমার আজ মন শরীর দু’টোই খারাপ? চলো, তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিই। এখানে এভাবে বসে মনমরা হয়ে বসে থাকলে তোমার শরীর খারাপ করবে। আজ নাকি আর ক্লাস হবে ন- আমি টিচার্স রুম থেকে জেনে এসেছি।
‘রিয়াদ, আমি কি তোমার হাত ধরতে পারি ?’
রিপার সিল্কি চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। চিবুকের রেশমি চুলগুলোর কয়েকটা উড়ে এসে ঘামের সাথে নাকের ডগায় লেপ্টে আছে। আমি হাত দিয়ে ঐ চুলগুলো সরাতে চাইছিলাম। হাত বের করতেই ওর হাতে মৃদু স্পর্শ লাগলো। রিপা অপেক্ষা করছিল হাতটা যেন এগিয়ে আসে।
-কি হলো? তুমি কী আমার কথা শোনোনি !
-কোন কথা?
-আমি যে বললাম, তোমার হাতটি ধরতে পারি ?
-তুমি এমন ছেলেমানুষি করছো কেন? শুধু হাত কেন - আমাকেই তো ধরে আছো।
-তোমাকে ধরে আছি মানে? আমি কি তোমার প্রেমিকা, যে তোমার সাথে প্রেম করি?
-হ্যাঁ, প্রেম করো। কেন তোমার মন কি বলে না যে, তুমি আমার প্রেমে পড়েছ? নিজেকে কখনো প্রশ্ন করেছ কি? আমার সাথে তোমার কীসের সম্পর্ক? বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ছেলেমেয়ের সম্পর্ক বন্ধুত্ব হয় না, রিপা। তবে কিছু সম্পর্ক একেবারে হয় না বললে ভুল হবে।
খ.
রিপা, আমরা কি প্রেমের পথে পা রেখেছি? আমার তো মনেহয় প্রেমের বিষয়ে আমাদের দু’জনের ভাবনার এখনো মিলই হয়নি। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে খানিকটা মুচকি হাসলো। তারপর বললো, ‘বাদ দাও, বাড়ি যাবার সময় হল।’
বাড়ি ফেরা নিয়ে সেদিনের কাহিনি মনেহলে আমি নিজেই ভীষণ লজ্জা পাই। এমন গল্পে মজেছিলাম সেদিন, নিজেদের বাড়ি পাড় হয়ে চলে গেছি! মনেই হয়নি এতকাল এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করেছি। এই রাস্তায় আমার মায়ের শরীরের একটা ঘ্রাণ লেগে আছে। তবুও এই পথ ঘেঁষে নিজের বাড়িটাই পার হয়ে গেলাম বেমালুম! মোহ মানুষকে ডুবিয়ে রাখে পৃথিবী থেকে ।
রিয়াদ পুরুষ মানুষ হিসাবে অত্যন্ত ভদ্র ও মানবিক। তাছাড় স্পর্শকাতর, সৎ, মেধাবী ও স্পষ্টভাষী। প্রেমিক হিসেবে কাছে চাইলে হয়তো আমাকে আশাহত করবে না। তবুও নিজের ভেতরে একটা ভয় কাজ করে। যদি না করে বসে? সে অপমান আমি কোনোদিনই সইতে পারবো না।
রিয়াদকে আমি বিশ্বাস করি; সম্মানও করি। হয়তো এ দু’টো শব্দের ভেতরেই গভীরতম ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।
বিকেল হলেই রিয়াদ মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসে। মা তাকে ভীষণ অপছন্দ করে। সঠিক কারণটা আমি খুঁজে বের করতে পারিনি।’ রিয়াদের খারাপ কোনো দিক আমার চোখে পড়েনি। আমি অনেক ছেলেকেই দেখেছি, মেয়েরা জামার নিচে কোন রঙের ব্রা পরেছে, তা শিকারীর চোখে দেখে। বেহায়ার মতো বুকের দিকে তাকায়। এদিক থেকে রিয়াদ সত্যিই ভালো ছেলে। কিন্তু মা তাকে পছন্দ করেন না কেন?
বিষয়টা নিয়ে ভেবেচিন্তে কিছুই পাইনি। রিয়াদ একটা সময় বুঝতে পেরেছ, মা তাকে পছন্দ করে। যদিও আমাকে বলেনি, হয়তো আমার সাথে প্রেম করতে চায়। হয়তোবা রিয়াদ আমাকে ভালোবাসে; আমাকে নিয়ে সংসার করবে।’
গ.
আজ দু’দিন হল রিয়াদ কেমন জানি পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, হয়তো মায়ের ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে। দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে নেবো। কিন্তু তা আর হল না। প্যারেন্টস ডে’তে একবার রিয়াদের বাবার সাথে পরিচয় হয়েছিল। সাতপাঁচ ভেবে মনিরামপুরে বইয়ের দোকানে ওর বাবার সাথে দেখা করি।
-কাকা, আমি রিপা। আমাকে চিনতে পারছেন?
-কেন নয়? তুমি আমার মা। ভেতরে এসে বসো, মা।
-কাকা, কিছু মনে করবেন না, প্লিজ। রিয়াদকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। তাই দোকানে চলে এলাম।
-তুমি এসে ভালোই করেছো, মা। আমি মনে মনে তোমাকেই খুঁজছিলাম। কিছু প্রশ্ন করি, মা। রিয়াদ কি তোমাদের বাড়িতে যেতো?’
-হ্যাঁ, যেতো। কিন্তু, কেন বলুন তো, কাকা?
-তোমাদের বাড়ির আশেপাশের মানুষ ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। যদিও এটা তোমাকে বলা ঠিক না। তুমি রিয়াদের বন্ধু বলেই বলছি। রিয়াদ আমার সন্তান হলে, কথাটা ওকে সরাসরিই বলতাম। তবে আমি কিছু বললে রিয়াদ ভীষণ কষ্ট পাবে।’
রিয়াদের বাবার কথায় আমি আকাশ থেকে মাটিতে পড়লাম। আমার কাছে সবকিছু অন্ধকার মনে হচ্ছে।
তোমাদের মতো আমারও কলেজ জীবন ছিল। রঙিন স্বপ্নও ছিল, ছিল ভালোবাসা। রিয়াদ জেনে গেছে আমি ওর জন্মদাতা পিতা নই। পথে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম ওকে। আমার সংসার করা হয়নি। ছোটবোনের স্বামী মারা যাবার পর আমাদের সংসারে চলে আসে। বাড়িতে সারাদিন বিষণœ হয়ে থাকতো সে। বোনের বিষণœতা দেখে আমার মন খারাপ হত। একদিন শহরে যাবার পথে রিয়াদকে পেলাম। সেই থেকে আমি রিয়াদের বাবা। গ্রামে দুষ্টু মানুষের অভাব নেই। কেউ হয়তো আমার ভালো চায়নি, তাই সত্য কথাটা রিয়াদকে বলে দিয়েছে। অভিমান করে দু’দিন হল বাড়িতে আসে না। কী অবস্থায়, কোথায় আছে, তাও জানি না! থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি।
তুমি কী জন্য আমার কাছে এসেছো, মা? আমি কি জানতে পারি?’
রিয়াদ মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে যেতো। মা তাকে অপছন্দ করতো। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো মায়ের উপর রাগ করে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আজ আপনার সাথে কথা না হলে নিজের ভেতরে একটা ভুল থেকে যেতো। এতে বিষয়টা ভিন্ন রূপ নিতে পারতো। আপনাকে কষ্ট দিলাম, কাকা। এজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
-রিপা, তোমার মতো বিনয়ী মেয়ে আমি দেখিনি। রিয়াদের মুখে তোমার কথা অনেক শুনেছি। মাগো, তোমার মা-বাবাকে মাকে আমার সালাম দিও ।
এসব কথা শোনার পর রিপার মুখ বিষণœতায় ছেঁয়ে গেল। অজান্তেই কোথাও হয়তো আঘাত লেগেছে।
-আমি দুঃখিত। আমার কথায় তুমি হয়তো কষ্ট পেয়েছো।
-আমার একটা অভাব আছে।
-অভাবের কথা কেউ কখনো এমন করে বলেনি।
-পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কিছু না কিছুর অভাব থাকে। এই অভাবটাকে আমরা সয়ে যেতেও শিখে ফেলেছি।
-অভাবটা কি আমাকে বলবে, মা?
-আমি কখনো বাবাকে দেখিনি!
কথাটা শোনার পর রিয়াদের পালক বাবার বুকের ভেতরে একটা প্রচ- ধাক্কা লাগলো। মুখের মলিনতায় যেন হৃদপি- ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো অজানা এক আবেগে।
এদিকে রিয়াদের বাবার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে মা কিছু একটা আমার কাছে আড়াল করেছেন। রিয়াদকে অপছন্দ করার কারণটাও আড়াল হয়েই রইলো।
মায়ের কুটিল আচরণে আমার সমস্ত মনোজাগতিক ভাবনার দুয়ার বিধ্বস্ত হতো। আমি চিৎকার করে উঠতাম। আবেগে ভিজে যেতাম। আমি তখন নিষ্পাপ শিশু। আমার রূপ-সৌন্দর্য বেড়ে ওঠেনি। সুঢৌল বক্ষও ছিল না। ছিল না গভীরতম নাভি। তবুও আমি তখন এক শিশুকন্যা! আমার বয়স ছয় কি সাতবছর হবে। সে বয়সেও আমার দিকে লিবিডো দৃষ্টিতে তাকাতো। কামুক চোখের সেই অন্ধকার রাতের স্মৃতি আমি ভুলতে পারি না। ওরা মরা গরুর মতো টেনেহিঁচড়ে ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়েছিল। মুখগুলো ঝাপসা ফ্যাকাসে। আমি দেখলেও চিনতে পারবো না। একজন চিত্রকর হয়েও আমি সেই পশুদের চিত্র অঙ্কন করতে পারি না। বারুদের মতোন জ্বলে ওঠে বুকের ভেতরটা। বুকের ভেতর থেকে পোড়া গন্ধ বের হয়, তবুও কেউ বুঝতে পারে না। কেবল নিজেই বয়ে বেড়াই সেই বিষাদময় করুণ আর্তচিৎকার।
সেদিন আমার চিৎকারে আকাশ কেঁদেছিল, তবুও পশুদের অন্তর কাঁদেনি। সেই বৃষ্টিস্নানেই শরীরে অসৃখ বাসা বাঁধে। ও যে কেঁদে উঠার অসুখ!
আমার সেই পুরনো স্মৃতি আমাকে ঘুমাতে দেয় না। আমি কেঁদে উঠি সময়ে-অসময়ে। কাউকে বলতে পারি না, আমার একটা বিষাক্ত শিশুকাল ছিল। স্মৃতির পাতাজুড়ে বেদনাগুলো আমাকে শুধু বিষধর সাপের মতো অবিরত দংশন করে। রিয়াদ জানতে চাইতো আমার কেঁদে উঠার গল্প।
রিয়াদ ফিরে এলে সব বলবো একদিন। শুধু আড়ালে থেকে গেল মায়ের কুটিল আচরণ। মা কি সত্যিই রিয়াদকে চিনতো?
পদাবলি
ওগো পাহাড়ি মিষ্টি গ্রাম
ফজলে রাব্বী দ্বীন
ঝর্ণার কোলে হেসে ওঠো ওগো পাহাড়ি মিষ্টি গ্রাম
স্নিগ্ধ ভেলায় ফিরে আনো খেলায় শামুকের শৈশব;
ছিনিয়ে নাওনি তুমি পুষ্প প্রাণের সুগন্ধি সরোবর
কাচের দেয়ালে আঁকোনি কোনো শতাব্দীর বিদ্বেষ।
স্কুল পালানো মেঠোপথে সেই দস্যু ছেলের ভোঁদৌড়।
ঘন বাঁশঝাড় থেকে নেমে আসে তাই কবিতারা মোট
বনমালীর ঐ উদ্দামে হাসে সাঁঝের পুরনো দু’ঠোঁট।
ওগো প্রথম জোয়ারের গল্প বলা দুষ্টু শিশির দল
ভোরের খেয়ায় সবুজ ধুয়াও স্বচ্ছ পায়ের তালে
কুমড়ো-লাউয়ের বৃষ্টি হলে ইস্টিরা ভিড়ে উঠোন
চায়ের চুমুকে ভাগ্যঘুড়ি শেকড় ছেড়ে পালাবে কই?
বকুলের ডালে স্বপনের খেয়াল স্মৃতিটুকু রাজমনি!
যে শোভনের প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেনি দাঁড়কাক
তোমার কন্ঠে জ্যোৎস্না নিখিল হৃদয়-মনে ভরে থাক।
জলকাদা মাটি, চা বাগান আর শেষ বিকেলের ঘুড়ি
ওগো ফুলের গালে চুমু দেওয়া বাগানের প্রজাপতি
মেঘের বারান্দায় ধুলো পায়ে কালো দিয়েছে সাঁতার।
কাঁঠাল পাতার উদোম ছায়ায় নেচেছিল ঘাসফড়িং।
সেই ফাগুনের চকচকে রোদ ও সোনাঝরা মৌসুম
ভুলিয়ে দিয়েছে ঊষার তরী উচ্ছলতায় মাটির প্রাণ
দেখেছি বনে নাচে ময়ূর আর নবান্ন তে ধানের ঘ্রাণ।
দুঃখের দ্বীপ
সবুজ আহমেদ
আমি তোমার দূর দেশের দুঃখ দ্বীপ
মায়াররাজ্য আড়ালে গলা বরফ কুচি ;
পাবোনা জেনেও অধির অপেক্ষা মিথ্যে আবেগ
বেখায়লে ছন্দে সাজানে শত কবিতা
কষ্ট উস্কে দেয় ফেলে আসা স্মৃতির সবিতা
উড়ে যাওয়ার সাধ্য আমার নাই ?
ভিষণ ভাবায় একাচ্ছন্ন মনে-
নয়তো কবেই ডানা ঝাপটে যেতাম চলে...
না বলে নিঃশব্দে তোমার নীড়ে ?
সবেত্রি মালহোত্রা ও অন্যান্য
মুহম্মদ আশরাফুল ইসলাম
সবেত্রি মালহোত্রা আমাদের পাড়ার মেয়ে।
রক্তজবা বন্দকের দিনে,
সে আমার তছনছ হতে চেয়েছিল।
সবেত্রি মালহোত্রা আমাদেরই পাড়ার মেয়ে।
যখন আমার ইচ্ছেরা ‘ইচ্ছেবিহীন’ পড়ে থাকতো
ঘরবারান্দার আলো আঁধারে। তখন
সে এসে জ্বালিয়ে দিত নিজেকে।
তার আলোয়,
তার ফর্সা শরীরের পাশে
সন্ধ্যে পর্যন্ত আমি ঝিলমিল করতাম।
আমার হাতঘড়ি ছিল না কোনও,
ছিল না নিজের জন্য আলাদা করে সময়।
৯৮’য়ে আমিও কিছুদিন,
দেবযানী স্কুলে সবেত্রির সহপাঠী ছিলাম।
জলপাই ভেবে কত কতবার খেয়েছি তার চোখ।
মাঝেমধ্যে খরগোশের মতো নরম বুকটাও;
যদিও তার ঝাঁজালো ঠোঁটে,
বড্ডো অভিমানে একদিন
এঁকে দিয়েছিলাম আমার কিছু বখাটে দুপুর।
যে পাড়াটাকে আমরা আমাদের পাড়া বলতাম,
যে পাড়ায় নিজেদের লাল-নীল শৈশব বিক্রি করে
ছুটে যেতাম সূর্যোদয়ের দিকে! আজ আর,
তোমাদের মানচিত্রে সেরকম কোনও পাড়া নেই।
সেই সবেত্রি
সেই পাড়া এখনও আছে,
বিপুল বিস্ময় হয়ে আঙ্গুলে আমার।
দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
ভালোবাসা বৃষ্টির পানির মত অঝরে ঝরে পড়ছে । রঙিন স্বপ্ন। দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি, পারলে আটকে রাখো । কেউ একজন স্বপ্নগুলো নিজের করে নিজের করে নিতে চাও ? তবে এসো নিরুদ্দেশের হাওয়ায় হাওয়ায়। ও ডাক্তার ঔষধ হবে! ঘুমের মধ্যে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখবো । আকাশের তারার দল পৃথিবীর পানে স্তব্ধতার অনুবাদ করে কিছু শুনছো, ডাহুকের ডাকে আর ঘুম ভাঙ্গে না । পরিণতি ভেবে লাভ নেই। ফুয়েল, ডিজেল, ওয়েল সব মানুষের হাড়; হাজার বছরের জীবাশ্ম সব ব্যথার পাহাড় ।
নিশুতিরাতে
শাহীন খান
বুকে বাজে গান, বাজে সেতার
বিরহ অনলে পুড়ছি অনন্তকাল।
স্বপ্ন গুলো পাড় ভেঙ্গে হারিয়ে গেছে নদীগর্ভে
টানাপোড়েন জীবন যাঁতাকল।
মহুয়া বনে পাখিদের নেই আনাগোনা
দীর্ঘশ্বাস ভারী হতে হতে বুক পেট পিঠ ছেয়ে যায়
কষ্টরা গলা ধরে নিশুতিরাতে।
গহনের ক্ষতি
মাসুদ পারভেজ
আমি ঘোরের মাঝে ভোর তুলে নিতাম
সরিয়ে আঁধারের খেল,
রক্তে আমার পিনাক দ্যুতি,
বক্ষে ক্রোধের শেল।
মুষ্টি ভরা বেজায় আলো- জ্বলে শিখা অনির্বাণ,
আমার ভোর-
জ্বলজ্বলা সোনার বাসনের সূর্য একখান।
উচ্ছল-উচ্ছ্বাসে সবুজ পাতার নাচ
ধানের শীষে শিশির বিন্দু, শিশির ভেজা ঘাস,
ঘোমটা তোলা বধূ আমার কী সোনামুখ আহা!
জানলা খোলা আকাশ জুড়ে নীল গেল কাহা?
আমার চাষে নষ্ট জন্ম, ভ্রষ্ট পথের ফুল
পরের ফুলে গাঁথি মালা, পরের বাঁধি কূল,
আমার লাশ মরে হলো মরাদেহের ঢল
আমার মায়ের কলসী পানি দাদার হাতের জল।
সূর্য ওঠে-সূর্য ডুবে দিনটা শুধু নেই
কোন প্রভাতে-
রাতটাও আমার চুরি হলো তিস্তা ¯্রােতের সাথে।
সবুজ মাঠের মধ্যভাগে লালজ্বলা সেই নিশান
কে লুকালো কার কপালে, কে বাজালো বিষাণ।
গহন গহনে কাহার আসন, কাহার দোষে গহন দূষণ।
হুমায়ূন আহমেদ উঁকি দেন দিনমান
হুমায়ূন আহমেদ
উঁকি দেন দিনমান
ইরফান তানভীর
আমার মা নিকটতম কোনো লেখককে তেমন জানেন কিনা জানিনা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে নাকি অনেক আগ থেকেই চিনতেন। জানতেন। তার গল্প উপন্যাস পড়তেন সেই নানা বাড়ি থাকতেই। ১২ তে যখন হুমায়ূন আহমেদ মারা যান সেসময় মাকে দেখেছি বাসায় বসে বসে পত্রিকায় তিনি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখাগুলো পড়ছেন গভীর মনোযোগে। মাঝেমধ্যে আব্বু থাকতে গুলতেকিনের কথা উঠাতেন। কোনো কোনো বিকেলে বাসায় সবাই বসে আছি হয়ত। প্রসঙ্গ উঠতো মেহের আফরোজ শাওনকে নিয়ে। মেয়ের বান্ধবী!
একজন হুমায়ূন আহমেদ নানাদিকে নানাভাবে বেজে উঠেন।
তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ মেধাবী লেখক। লেখক হুমায়ূন আহমেদের অনুপম উপস্থাপনশৈলী অনবদ্য রসবোধ আর জীবন নিয়ে অসামান্য পর্যবেক্ষণ তাঁকে আসিন করেছে মহা নন্দিত এক জাদুর আসনে। হুমায়ূন আহমেদ যেনো এক জাদুর কলম হাতে নিয়ে জন্মেছেন। তার জাদুকরী হাতের লেখায় বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে।
ভাষা প্রয়োগ আর নান্দনিক চরিত্র নির্মাণ করে হুমায়ূন আহমেদ তার লেখাকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। যা পাঠকের কাছে জীবন্ত মনে হতো। মনে হতো এইসব গল্প তাদের নিজেদের’ই গল্প অথবা এ হচ্ছে মানবজীবন।
একজন লেখকের সার্থকতা কোন জায়গাতে? অবশ্যই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে যেনো এই বাংলা মুলুকের পাঠকরাই পরম যতেœ কাছে টেনে নিয়েছেন। এর অবশ্য কারণও আছে।
বলতে দ্বিধা নেই- হুমায়ূন আহমেদ পাঠকের আগ্রহকে গুরুত্ব দিতেন অনেকবেশি। তিনি বুঝতে চাইতেন পাঠক গল্পের বয়ানে কেমন পটভূমি চাইছেন! চিন্তা করতেন পাঠকের সীমিত অবসর নিয়েও।
কাহিনীর বিবরণীতে তিনি অযথা বর্ণনায় যেতেন না। দুই পৃষ্ঠার একটা বর্ণনা তিনি এক সংলাপেই প্রকাশ করতে পারতেন। এজন্য লেখক হুমায়ূন আহমেদের গল্পের মায়াজালে পাঠক বুঁদ হয়ে যায়। বিরক্তি আসেনা। হুমায়ূন আহমেদের বই শেষ করে ফেলে এক বাসাতে। পাঠক যে দ্রুতগতিতে চলতে পছন্দ করে হুমায়ূন আহমেদ সেটি বুঝতেন এবং সেদিকে তিনি মনোনিবেশও করেছেন। অযাচিত কোনো বর্ণনায় গিয়ে পাঠককে বিরক্ত করেননি।
হুমায়ূন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার অথবা নন্দিত নরকের মতো পরিপূর্ণ একটা জীবনের এপিঠ ওপিঠ তিনি উপস্থাপন করেছেন খুবই অল্প পৃষ্ঠায়। লিও টলস্টয় এ বইগুলোর বয়ান দেখলে আন্না কারেনিনার মতো দীর্ঘ কলেবরের বই করতে চাইতেন। তিনি হয়ত বলতেন- এত অল্প কথায় শেষ করা কী করে সম্ভব!
কিন্তু সৃষ্টিশীল লেখক হুমায়ূন আহমেদের সে ক্ষমতা ছিলো। তিনি গল্পের জন্য যে ফাঁদ পাততেন, সেখানে সবাই ধরাশায়ী হতো।
এ কথা তো চিরসত্য যে বাংলাদেশের পাঠক তৈরিতে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অবিস্মরণীয়। বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদ যখন যেতেন, সমস্ত স্টলগুলো ফাঁকা হয়ে জনস্রোত গিয়ে ভিড় করত হুমায়ূন আহমেদের চারদিকে। একজন হুমায়ূন আহমেদ লেখালেখির পাতায় যেমন উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছেন ঠিক তেমনই নির্মাতা হিসেবেও হালআমলের মহারথী হয়ে আছেন।
জীবনঘনিষ্ঠ, সাবলীল পটভূমি আর আবহমান বাংলার মানুষের জীবন বৈচিত্রকে অসাধারণ বৈভবে টিভি পর্দায় নিয়ে এসেছেন এ কারিগর।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলা সাহিত্যের চালকের আসনে বসেও হুমায়ূন আহমেদ বিন্দুমাত্র যৌনতার আশ্রয় গ্রহণ করেননি।
একজন গল্পবাজের ক্লান্তিহীন ভাবে কত গল্প বলতে পারাকে আপনার জাদুকরী মনে হবে!
হূমায়ূন আহমেদ সে গল্পজাদুর জাদুকর।
মানুষটি তিন দশকেরও বেশী সময় পর্যন্ত আমাদেরকে গল্পের পাতায় পাতায় জমিয়ে রেখেছেন। কী নান্দিনকতায় তিনি হেঁটেছেন। অথচ কতো বিবর্ণ ছিলো সে দীর্ঘতম পথ।
ব্যাক্তি হুমায়ূন আহমেদের শিল্প-সৌন্দর্য আত্মবিশ্বাসের সাথে বেজে উঠে পরম্পরায়।
আয়না
আয়না
হেমন্ত হাসান
বাস থেকে নেমে আমি একটা রিক্সা নিলাম। অনেক দিন পর আজ আমি নিজের বাসায় যাচ্ছি। হ্যাঁ, অনেক দিন পর, প্রায় এক বছর। গত এই এক বছরে পরিবারের কারো সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি জানিনা বাসার সবাই কেমন আছে? তারা নিশ্চই আমার জন্য ভীষণ অপেক্ষা করে আছে। মা, ছোটবোন তুলি, আমার পাঁচ বছরের কন্যা রুহী আর রূপা। রূপা- আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। না জানি বেচারি এই একটা বছর আমাকে কত খুঁজেছে! না জানি কত রাত না খেয়ে থেকে থেকে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পরেছে! যা কাঁদতে পারে মেয়েটা! খুব সামান্য কারনেই কেঁদে ফেলে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম এই কান্নাটাই খুব ভালো লাগত আমার। রূপা একটু কাঁদলেই আমার চোখেও জল এসে টলমল করতে থাকত। তারপর রুহীর জন্মের পর থেকে রূপার কান্নাকে আমার অকারণ আদিখ্যেতা মনে হতে লাগল। একটা মেয়ে যে কিনা নিজেই একটা সন্তানের মা, সে কেন অতি তুচ্ছ কারণে ক্যাচ ক্যাচ করে কাঁদবে?
আমার মেয়ে রুহীও জন্মের পর ছয় মাস খুব কান্নাকাটি করেছে। এত বিরক্ত লাগত আমার! সারাদিন অফিস করে রাতে ঘরে এসে শান্তিতে একটু ঘুমানোর উপায় ছিল না। এই নিয়ে খুব রাগারাগি করতাম আমি। আহারে! ছয় মাসের শিশু, কথা বলতে পারেনা, কান্নাই যার সকল অনুভূতির ভাষা; কত অসহায় সে, আর আমি কিনা ওর উপরে রাগ করতাম! ভাবতেই আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। আমি রিক্সাটাকে একটা চায়ের দোকানের পাশে দাঁড় করাতে বলি। রিক্সাওয়ালাটির হাতে এক কাপ লেবু চা ধরিয়ে দিয়ে আমি একটা সিগারেট ধরাই। এটা আমার পুরনো অভ্যাস। কোন কারণে বুকে একটু দুঃখ অনুভব হলেই আমি সিগারেট খাই। সিগারেট একেবারে পছন্দ নয় রূপার।
কত বার এ নিয়ে মান-অভিমান হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে- কিছুতেই কিছু হয়নি। সিগারেটে প্রথম টানটা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমার মনে হলো, কাজটা ঠিক হলো না। আজকের দিনে অন্তত নিকোটিনের গন্ধ গায়ে মেখে রূপার কাছে না গেলেই পারতাম। কিংবা রুহী যখন আমাকে দেখে দৌড়ে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পরবে, বাবা বলে ডেকে আমার গালে চুমু খাবে তখন সিগারেটের গন্ধটা ওর কাছে বিশ্রী লাগবে না? পরক্ষণেই আবার মনে হলো, ধুর! এতদিন পর সবার সাথে দেখা হবে- সবাই নিশ্চই আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরবে, আলাদা করে আমার গায়ের গন্ধ নিয়ে নয়।
এই এক বছর আমি কোথায় ছিলাম, কেন ছিলাম, কেমন ছিলাম, কেন কেউ আমার কোন খোঁজ পায়নি- সেসব যখন আমি বাসায় গিয়ে সবার কাছে বলব, নিশ্চই সেসব শুনে এবং আমাকে ফিরে আবার অশেষ আনন্দে সবাই হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। দিক। আজ আমি আর রাগবো না। ঐ কান্না তো আমাকে ভালোবেসেই বাড়বে। প্রত্যেককে বুকে চেপে সেই কান্নায় আমি নিজেও বিলীন হয়ে যাব। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমার আবার চোখে পানি এসে যেতে থাকে। কি আশ্চর্য! আজ আমি নিজেই কাঁদছি নাকি!
২
সদর দরজায় ছিটকিনি খোলা। আমি নির্দ্বিধায় বাসার ভিতরে ঢুকে গেলাম। কোন সঙ্কোচ নেই আমার, বরং বুক ভরা উত্তেজনার বারুদ।এটা আমার নিজের বাড়ি! বাড়ি জুড়ে কোথাও কারো কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সবাইকে চমকে দেব বলে আমিও কারো নাম ধরে ডাকব না ভাবলাম। বাসার চারটা রুমের তিনটার দরজাই হা করে খোলা। একটা ঘরের দরজা শুধু অল্প করে ভেজানো। আমি সবগুলো খোলা রুম ঘুরে এলাম। নেই, কেউ নেই। মা, রুহী, রূপা সবাই গেল কোথায়! এমন হতে পারে মা আর তুলি রুহীকে নিয়ে পাশের বাসায় গেছে, কিংবা মোড়ের দোকানে। আর রূপা নিশ্চই অন্য ঘরটিতে একটু ঘুমিয়েছে দুপুরে ভাত খেয়ে। দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়া ওর পুরনো অভ্যাস।
কী করতে হবে আমি এক মূহুর্ত ভেবে নিলাম। প্রথমে দরজাটা খুলতে হবে নিঃশব্দে যেন তার ঘুম ভেঙে না যায়। তারপর ওর কপাল ছুঁয়ে আলতো স্বরে ডেকে ওর ঘুম ভাঙাতে হবে। ঘুম ভেঙে তাকিয়েই যখন সে আমায় দেখবে, কেমন হবে তখন? নিশ্চই তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হতে চাইবে না। হুড়মুড় করে উঠে বসবে বিছানায়। তারপর হাউমাউ করে বুকে ঝাঁপিয়ে পরবে? আমি তাকে বুকে ধরে রাখব শক্ত করে। আদর করে চুমু খাব তার কপালে। উত্তেজনায় আমার ঘাম হতে থাকে!
খুব সাবধানে আমি দরজাটা খুললাম। আমার সামনে অনন্য সুন্দর এক দৃশ্য ফুটে উঠল। ঘরের ভেতর অল্প আলো। একটু করে খুলে রাখা জানালার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে শুয়ে আছে বিছানার মাঝামাঝি। হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরে প্রায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রূপা। তবু এই অল্প আলোতেই আমি তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি। রূপা ঘুমুচ্ছে। তার আঁচল খসে পড়েছে বিছানায়। নাভীতে এসে মিশেছে অপরাহ্নের আলো। সেই আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে ভালো করে আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি রূপার দিকে হাঁটি। কাছাকাছি যেয়ে রূপার মুখের দিকে তাকাতেই আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। ভয়াবহ বিষ্ময় এবং দুঃখ নিয়ে আমি দেখতে পাই রূপার গলাটা জবাই করা! আমার নিজের গলা শুকিয়ে আসতে থাকে। হাত-পা অবশ হয়ে আসতে থাকে আমার। আমি রূপার পাশে বসি। তার মাথাটা কোলে তুলে নিই। তারপর হাত রাখি তার গালে এবং চিবুকে। আমার আঙ্গুলে রুপার রক্ত লেগে যায়। আমি স্পষ্টত অনুভব করি, সেটা এখনো উষ্ণ। সারা ঘরে আমি কোন আয়না দেখতে পাইনা। ঘরে কোন আয়না থাকলে, আমার ঠোঁটের কোণে কোন হাসি ফুটে উঠেছে কিনা- হয়তো আমি তা দেখতে পেতাম!