মায়া
মায়া
রেহমান আনিস
সন্ধ্যায় কেরোসিন কিনতে যায় বিকাশ। দোকানে টিমটিম করে হারিকেন জ¦লছে। সোলতেটা একেবারে নামানো। কালি পড়তে পড়তে অস্পস্ট হয়ে গেছে কাঁচ। অস্পস্ট আলো। সামনে বাঁশের বেঞ্চে বসে ধুমছে গোপাল বিঁড়ি টানছে দুই বুড়ো। বিকাশ কেরোসিন কিনে বোতল হাতে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। দোকান পেরিয়ে আটদশ গজ দূরে যেতেই শারমিনের মুখোমুখি। দুজনেই থেমে যায়। এমন সময় বিকাশের হাতের কবজি ধরে শারমিন বলে, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’ এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে আশেপাশে তাকায় বিকাশ। শারমিন মুচকি হেসে বলে, ‘ভয় পেয়েছ?’ বিকাশ কিছু না বলে বাড়ির দিকে হাটা দেয়। শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, আজ এমন করল কেন শারমিন? জীবনে এই প্রথম কোন নারী তার হাত স্পর্শ করেছে।
মসজিদ থেকে ফজরের আজানের শব্দ ভেসে আসে। ঘুম ভেঙে যায় বিকাশের। মনে পড়ে যায় সেই সংগীত সন্ধ্যার কথা। সেদিন বিকাশের কন্ঠে গান শুনতে শুনতে জমে যায় শারমিন। ষ্টেজ থেকে নামার পর একটা তরতাজা লাল গোলাপ তুলে দেয় বিকাশের হাতে। শারমিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বিকাশের মনে মায়া জন্মায়। কিন্তু কেন এমন মায়া জন্মায় সে উত্তর বিকাশের জানা নেই। আড়মোড়া দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে সে। তার অদ্ভুত রকমের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে ভাবনার গভীরে হারিয়ে যায়।
একদিন ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরছে বিকাশ। উঠোনে পা রেখেই আঁচ করতে পারে কিছু একটা ঘটেছে। চারিদিকে নীরব। বারান্দায় একখানা কাঠের পিড়িতে গম্ভীর হয়ে বসে আছে মা। বাবা হাতের তালুতে গাল ঠেকিয়ে কী যেন ভাবছে। আর এককোণে বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোটবোন মিতালী। যেন অচেনা তিনজন মানুষ। বিকাশ এগিয়ে যায় মিতালীর দিকে। মিতালী শাড়ির আচল দাঁতে চেপে এক দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঠাস করে দরজার খিল আটকে দেয় ভেতর থেকে। ওকে যে কেন তাড়িয়ে দিয়েছে বুঝতে বাকি রইলো না বিকাশের। মনে মনে গাল পাড়ে, ‘পরের চুল-দাড়িতে ক্ষুর-কাঁচি চালিয়ে, বগল কামিয়ে দিনে কত কামানো যায়, জানিস না অমানুষের দল?’
বাপ-ছেলে জন্তুর মতো কাজ করতে থাকে। ধীরে ধীরে যৌতুকের সব টাকা শোধ হয়ে যায়। মিতালী ফিরে যায় শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু, বিকাশের আর কলেজে ফেরা হয় না।
এইচএসসি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের মাত্র একদিন বাকী-বিকাশ ছাড়া ক্লাসের সবাই ফর্ম ফিলাপ করেছে। সন্ধ্যার আগমুহূর্তে বিকাশদের বাড়িতে যায় শারমিন। উঠোনকোণে ফুলে বেদীতে পানি ঢালছে বিকাশের মা। শারমিন এগিয়ে গিয়ে কোমল স্বরে বলে, কাকিমা, ‘বিকাশ কী পরীক্ষা দিবে না?’ অধোবদনে না সূচক মাথা নেড়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভেতর চলে যায় বিকাশের মা।
পরীক্ষা শেষ। তিন মাস পর ফল বের হয়। শারমিন মেধাতালিকায় স্থান পায়। খুব আনন্দ হয় বিকাশের। কিন্তু এই আনন্দের মধ্যেও থেকে থেকে বিষাদের আগুন জ¦লে ওঠে। কী যেন একটা হারিয়ে ফেলেছে সে!
মেডিকেলে ভর্তি হয় শারমিন। পড়াশোনার চাপ অনেক বেশি। এদিকে বিকাশ সংসারের দ্বায়ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে। বাবা অসুস্থ। সেলুনটা এখন ওকেই সামলাতে হয়। দীর্ঘদিন দুজনের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। প্রথম দিকে ঘনঘন চিঠি আসত ঢাকা থেকে। এখন আর আসে না। বিকাশের ধারনা, হয়তো তার কথা আগের মতো এখন মনে পড়ে না শারমিনের। পড়বেই বা কেন? কয়দিন পর বড় ডাক্তার হবে সে। তার সাথে বিকাশের মতো নাপিতের প্রেম করাটা একেবারেই বেমানান। যে কেউ শুনলে দুই গালে নিশ্চিত স্যান্ডেল উঠবে।
একদিন সেলুনে চুল কাটাতে আসে চেয়ারম্যান।
শুনিছির, বিকাশ?
কী, কাকা ?
‘আমাগে শারমিন তো ডাক্তারি পাস কইরে গেছে। এইবার মায়েডারে একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে বিয়ে দিতি পারলি বাঁচি।
বিকাশের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। মুমূর্ষু রোগীর মতো অস্ফুট কন্ঠে বলে, হ কাকা।
ওই দিন আর ক্ষ্রু-কাচি চালানোর শক্তি ছিল না বিকাশের।
রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করে, ঘুম ভেঙে যায়। মাঝরাতে উঠোনে এসে উদাসভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণিমার চাঁদটা একেবারে জ¦লজ¦ল করছে । অসংখ্য তারা মিটমিট করছে। হালকা হিমেল হাওয়া এসে বিকাশের বুকে লাগে। সম্বিত ফেরে তার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে শারমিনের ঝলমলে মুখখানি। তাহলে শারমিন কী আমার জীবন থেকে বিয়োগ হয়ে যাচ্ছে?
ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসে শারমিন।
রাতে শুয়ে আছে মা, শারমিন আর রেশমা। মা শারমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, এবার বলতো, তোর পছন্দের ছেলেডা কে?
শারমিন একদম চুপ।
ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার?
কিছুই না।
তাহলে?
মানুষ।
‘তা বাড়ি কোন জাগায়?’
এই দেশেই।
এমন কাটা কাটা উত্তর শুনে অবাক হয় মা ।
রেশমা মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘বিকাশ দা। আমাগে গিরামের বিকাশ দা।‘ প্রেসার বেড়ে রেশমার কোলে ঢলে পড়ে মা। ঐ রাতে চেয়ারম্যানের লোকজন গিয়ে হুমকি ধামকি দেয় বিকাশের বাবা মাকে। পরদিন থেকে বিকাশের সেলুনের শাটার আর খুলতে দেখা যায়নি।
শারমিন ইন্টার্নশিপের টাকা দিয়ে কোন রকম একটা রুম সাবলেট নেয়। রুবেলকে চিঠি লেখে, ‘রুবেল, মাঝে আমি যে চিঠিগুলো পাঠিয়েছিলাম, সেগুলি বিকাশের হাতে পৌছানোর আগেই পিওনের হাত থেকে আমার বাবা নিয়ে যায়। বাবা আগেই জেনে গিয়েছিল আমাদের সম্পর্কের ব্যপারটা। কিন্তু, বাড়ির কাউকে বলেনি, জানাজানি হবে তাই। তুমি বিকাশকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা কর। আমি বিকাশকেই বিয়ে করব। ‘
বিকাশকে নিয়ে ঢাকায় যায় রুবেল। কোর্টে গিয়ে সিভিল ম্যারেজ সম্পন্ন হয়। বিষয়টি গ্রামে জানাজানি হয়- চারিদিকে ছিঃ ছিঃ রব ওঠে। বাজার-ঘাট সব জায়গায় কানাঘুষা চলে। শিক্ষক থেকে কৃষক সবার মুখে একই কথা, একজন নাপিত কীভাবে ডাক্তারকে বিয়ে করে?
ডাক্তারকে বিয়ে করা নাপিতের জন্য মহাপাপ। কিন্তু ঘরে বউ থাকতে চেয়ারম্যান যেদিন কন্যাবয়সী কুমারী মেয়েটিকে গায়ের জোরে বলাৎকার করেছিল সেদিন কি এই সমাজের চোখে গামছা বাঁধা ছিল? হয়তো তার বেলায় পাপ নেই!
চেয়ারম্যান বিকাশের নামে অপহরণ মামলা দায়ের করে। নির্মম পরিস্থিতি নেমে আসে পরিবারের উপর। একদিন চেয়ারম্যানের লোকজন বাজার থেকে ঘাড় ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দেয় বিকাশের বাবাকে।
‘রাজধানীর একটি সেলুন থেকে ডাক্তার শারমিন অপহরণ মামলার আসামি বিকাশ গ্রেপ্তার‘- শিরোনামে কাগজে হেডলাইন হয়। বিকাশকে হাজতে পাঠানো হয়। চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। পিনু এবং সাদিকে বিষয়টি জানায় রুবেল। পিনু সাংবাদিক। আর সাদি আইনজীবী। বিকাশের পক্ষে যুক্তিতর্ক এবং দলিলাদি প্রস্তুত করে সাদি। এই মামলা সে নিজেই লড়বে। নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে শুনানি শুরু হয়। বাদী পক্ষের কুশলী বিকাশকে আচ্ছা মতো ধবলধোলাই শুরু করে। পুরো এজলাস যেন নিস্তব্ধ। হতাশার ছায়া পড়ে বিকাশের চোখমুখে। সাদিও পাল্টা যুক্তি দিতে থাকে। সে শারমিনের বক্তব্য নেওয়ার জন্য অনুমতি চায়। বিচারকের অনুমতি পেয়ে শারমিন বিনয়ের সাথে বলে, ‘মহামান্য আদালত, আমি স্বেচ্ছায় বিকাশকে বিয়ে করেছি। ওকে নিয়ে শান্তিতে সংসার করছি।‘ বাতাস ঘুরে যায়। ভিকটিম প্রাপ্তবয়স্ক। বিজ্ঞ বিচারক হাতুড়ি ঠুকে বলেন, ‘মামলা এখানেই খারিজ করা হলো।
বিকাশকে মুক্তি দেওয়া হয়। হাজতের গেটে দাঁড়িয়ে রুবেল, পিনু, সাদি এবং শারমিন। শারমিনের চোখদুটি ছলছল করছে। বিকাশ সামনে এগিয়ে আসে। শারমিন এগিয়ে গিয়ে বিকাশের বুকে কপাল ঠুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ওর চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে বিকাশের বুকে। শারমিনের মাথার তালুতে চিবুক রেখে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় বিকাশ। বিকাশের দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে পানি। ডাক্তার আর নাপিতের মধ্যে কথিত সীমান্তরেখা দু’জনের চোখের পানিতে একাকার যায়।
ছায়ারোদ্দুর
ছায়ারোদ্দুর
রমজান আলী রনি
মনের কথাগুলো হারিয়ে যায় । ছায়া এলো, রোদ্দুর এলো- সে এলোনা । গতিপথ পরিবর্তন করে, ছায়া মরুর বুকে বরফকে গলিয়ে কালো করে দেয় । সৃষ্টি হয় ভয়ানক কৃষ্ণগহব্বর। মঞ্চ সাজিয়ে নাটক করার মত, পাথরে ঢেকে যায় সে। অভিনয় করি, অভিনয় দেখি সে অভিনয় ক্ষণিক, বিশ্ব অভিনয়ে পরিনত হই আমি তিলে তিলে।
-রোদ্দুর তুমি কালকে পাঠশালাতে যাওনি? মা তোমাকে আচ্ছা করে বকুনি দিবে ?
- ছায়া, আমি আলোকে ভয় পাই। যদি অতিরিক্ত বিদ্যা তোমাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
ভয় হয় তখন, যখন- কান্নার মিশ্রণ আলোতে পরিণত হওয়ার আগেই, গোঁফ খেজুরে রূপ নেয়। বায়ুমন্ডলে ক্যালিগ্রাফি সমাজ্ঞীর আকারে প্রকাশ করার মত কড়ি নেই আমার, তাই অল্পবিদ্যার বড়াই জাগে।
-ওমা মরে গেলাম, চুল এভাবে টানে কেউ !
-বেঞ্চ পরিস্কার কর জলদি?
গুণবতী, মায়াবতী, অলংকৃত, ঝংকারগুলো কবরি করে, আলোক চিত্র- পঞ্চকাশের কাশবনে সমাহিত হয়।
-রোদ্দুর রাগ করেছ ?
থনা, একটুও না !
-মিথ্যা বলার বিদ্যা কোথা থেকে পাও, পন্ডিত মশাইয়ের কাছ থেকে বুঝি ? আকাশ রাগ করলে মেঘ হয়, মেঘ রাগ করলে বৃষ্টি হয়, তুই রাগ করলে বানান ভুল করিস ?
-তুই একটু বেশি কথা বলিস ?
-ছোটবেলায় কম কথা বলতাম বলে- মা আমাকে বোবা ভেবে স্পীক থেরাপি দিয়েছিলো । তোর কথা শুনলে বোধ হয় ঐটা দরকার হতোনা ।
-আমি রেগে গেলে বৃষ্টি দেখি, তুই রেগে গেলে কথা বলিসনা ।
ভয়ের মত সঞ্চালনা আমার ছিলোনা সেদিন । তার রেগে যাওয়ার কারণ মাঝে মাঝে আমাকে একা করে দিতো, আমি ফ্যালফ্যালিয়ে তার কেশরাশি বিন্যাস করতাম ।
-আমি কিন্তু সত্যিই রেগে যাচ্ছি ?
-এইবার তোরে আমি রাগাতে
পেরেছি, এজন্য নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে । কবি বলেছেন, মেয়েদের রাগানো সবচেয়ে কঠিন কাজ ।
-কচু জানিস তুই ?
-কচুপাতায় পানি স্থায়ী থাকেনা । এজন্য আমার জানার কথা নয়- তুই বললি, তাই এখন থেকে কেমিস্ট্রি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, কটুবিদ্যা রপ্ত করার চেষ্টা করবো।
-বাপরে বাপ, এত কথা কোথায় পাস তুই ?
-মেয়েদের গর্ভ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য- সেখান থেকে জন্ম হয় কতশত বীরপুরুষের, আর আমি দুইটা কথা বলতে পারবোনা..?
-কে বলেছে পারবেনা ? তুমি নাচতে, গাইতে, আবৃতি করতে, সব করতে পারবে।
-তাহলে এখন একটা দেই?
-কি ?
-মার?
-দাঁড়া তবে ?
পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন সত্য হলো- নিজেকে লুকিয়ে রেখে, পুড়িয়ে ছাই করা । যার শেষ পরিণতি কান্না নতুবা মৃত্যু । তার রূপের ছন্দপতন হয়েছিলো এক গভীর আমাবস্যা রাতে। যেথায় -আমি আলোকিত হয়েছিলাম ।
-রোদ্দুর, আমাকে দেখা হলো, আমাবস্যা রাতে চাঁদ খোঁজার মত !
-ছায়া, মিথ্যা বিদ্যার জন্য মার খেতে না তুই ?
-রাত্রি হলে সকাল হবে, তখন তুই হারিয়ে যাবি ।
-চিরমুক্তিকা হয়ে রবে তোর আলোকচিত্র । নদীতে ভাসমান দুলতে থাকা চাঁদনী নোঙর ।
মনের কথাগুলো হারিয়ে যায়... অপেক্ষা বাড়ে
ছায়া রোদ্দুরের...
পদাবলি : ০১
দু’টি কবিতা
রওশন রুবী
১
চুপিচুপি জেগে ওঠে ফাগুন
দুপুর গড়িয়ে গেলে চুপিচুপি জেগে ওঠে ফাগুন
দাঁতে লাগে স্বাদ তার মিহিদানা মিছরি যেমন
মুনি কী সবটা বুঝে শেয়ালের মায়া, সারমেয় চোখ
আধাসিকি অন্ধকার কিনে ফিরে কেন পড়শির মন
ফাগুনের ডালে ডালে ঘনআগুন ভেলভেট কাঁপন
খুশবুর ব্যাকুলতায় হেঁটে সারা যুগের খোয়াজ খিজির
তৃষ্ণায় লালন সাঁই, সাধন দরিয়ায় বাঁকে আদিম শরীর
দূর থেকে আহত শোনায় জিহ্বা ও হাড়ের জিকির।
২
বারুদ
ন্যায়ের বারুদ আমার হাতে অন্য বারুদ তোদের থাক্
এই বারুদে হবেই দেখিস্ সব পৃথিবী পুড়ে খাক।
এলিজি
মুহম্মদ আশরাফুল ইসলাম
[উৎসর্গ : ইজাজ আহমেদ মিলন]
একদিন আপনার বাড়ি থেকে সব কালো জামা
উধাও করে দেব।
একশো আটটি কমলালেবুর আত্মজীবনী
খুব ঘন করে টাঙিয়ে দেব দেয়ালে আপনার।
ফেরার পথে যতগুলো ফলজ গাছ,
যতগুলো অচেনা মুখ চোখে পড়ে আপনার;
একদিন তাদের নিজস্ব গোঙানি
তোলে দেব আপনার বুকপকেটে।
একদিন তামাকের মতো গাঢ় যে সন্ধ্যেটা
আমাদের আঙুল ধরে হাঁটতে চেয়েছিল,
একদিন ঝলসানো স্মৃতিদের ধাওয়া করতে গিয়ে
আমরা যে নদীটাকে আঁকতে চেয়েছিলাম,
সেই সন্ধ্যে সেই নদী বেপাত্তা এখন।
নিভৃত প্রমোদে একদিন,
আমরাও উড়াতে চেয়েছিলাম পার্টির পতাকা।
একদিন আপনার দৃষ্টির সীমা থেকে সরিয়ে নেব
ভাঙাচুরা মেঘেদের।
চিবুকে, দীর্ঘশ্বাসের ট্যাটু এঁকে
আপনাকে শোনাবো ফুসলানো পূর্ণিমার গান।
পুনরুদ্ধার প্রকল্পে অবিকল আপনার মতো দেখতে
যে মুখোশ, পাঠ করেছিল আপনারই চোখ;
একদিন সেই মুখোশকেও বিক্রি করে দেব
আশ্চর্য কোনও মাছরাঙার কাছে।
একদিন যেসব পথ থইথই করতো আমাদের মুঠোয়
এবং বুকেপিঠে লেপ্টে থাকতো সারাটাক্ষণ,
একদিন যে একার সরোদ বাজাতে বাজাতে
আমরা হতে চেয়েছিলাম দারুণ সন্ন্যাস,
সেই পথ সেই সন্ন্যাস এখন আলোকবর্ষ দূরে।
খুব বিকেলে একদিন,
পুনরায় চুনকাম করবো নিজেদের সমাধিবিথান।
রক্তজবা
শেখ ফয়জুর রহমান
আমার বুকপকেটে যে রক্তজবা ছিল
তা শুকিয়ে গেছে রোদের প্রখরতায় ,
মিশে গেছে আমার একমুখী চাওয়া ।
যে বসন্তে কোকিলার সুর ছিল না
সে বসন্তে ফুলগুলোও ছিল নির্জীব
আর পোকায় খাওয়া।
তার আগমনের অপেক্ষায় ছিল
ব্্রহ্মপুত্রের নদ আর একটা শালিক পাখি ।
সে আসলো না বলে একদিন বিরহ বেদনায়
খসে গেল একটা তারা
মরে গেল শুকনো বালি
তাই আমি এখনও পচে যেতে পারিনি !
টান
রফিকুল নাজিম
আমাদের দেখা হয়নি কখনো
তুমি কখনো চোখ রাখোনি আমার চোখে
অথবা আমিও রাখিনি চোখ তোমার চোখে...
তবুও মনে হয় তুমি চেয়ে আছো আমার দিকে এবং আমিও।
অথচ আমাদের সাক্ষাৎ হয়নি কখনো;
প্রিয় নদীর তীরে আমাদের পা ছড়িয়ে বসা হয়নি
বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে পার্কে বেঞ্চে বসে গল্প করিনি,
তোমার হাত ছুঁয়ে জোছনাও দেখিনি কভু,
তবুও কেন এতো টান? বড্ড ভয়ংকর রকমের টান...
আমি চাক্ষুষ দেখেছি- এমন টানে ঘর ভাঙতে
যমুনার ঘোলা জলের ঘূর্ণিতে চক্কর খায় আলগা মাটি
এইরকম দুর্র্ধষ টানে গেরস্থালিও মরে যায়!
চাঁদের মিহি আলো, সূর্যে প্রভাব-প্রতিপত্তি,
পাহাড়ের রাজকীয় দম্ভ, নদীর তর্জনগর্জন-
সবকিছু আমার কাছে ঠুনকো মনে হয়; ভঙ্গুর মনে হয়!
কেবল তুমি আমাতে থেকে যাও নীরবে
চোরা ¯্রােতের মত টেনে নাও আরো কাছে
অথচ আমাদের দেখা হয়নি কখনো; কোথাও!
তবুও কেন এতো টান! কেন টানো?
বিলকিস
সাদিক আল আমিন
আমরা দেখেছি স্বপ্ন সুমধুর একাকী কিংবা একত্রে
তুমি-আমি ভিন্ন দুই দরিয়ার বাসিন্দা হয়েছি এক
যখন তুমি শান্ত নীরব মেয়ে জেগে থাকো গভীর রাত্রে
নিজেকেই বলেছি নিজের বুকের ক্ষতটুকু মেপে দেখ
তখন কিজানি বিলকিস হয় বিলকুল অনুভূতি যেন
পাহাড় ভেঙে পড়ছে বুকে আর চোখ-ভর্তি নীল সমুদ্র
তোমাকে দেখলেই তোমার প্রতি এতো আড়ষ্টতা কেন
কান্ত শীতল বর্ষায় আমার হঠাৎ মেঘ সরে উঠে রৌদ্র
জুলেখা চাচি একদিন ঠিকি ধরে ফেলেছিল সব ঘটনা
আর বলেছিল আমাকে কাউনের বাছতে বাছতে চাল
‘যা শুনছি তার সব-ই কি সত্য না কি রটনা?
আমি বলি, ‘যাও চাচি। কী সব বলো ভুল-ভাল!’
আমি মনে মনে হেসে আবার ইবাদতে যাই
মোনাজাতে আজ চাইবো তোমাকে, তোমার চোখে বেহেশতের ঠাঁই
মনের আলাপন
রাকিবুল হাসান রাকিব
তুমি নেত্রমেলে অবাক দৃষ্টিতে মুগ্ধ করে।
আমাকে প্রেম জাগিয়ে দিও না এ-ই ভুবনে।
অকাতরে মরে যাব; হঠাৎ তুমি হারালে!
কোমল সুরে কথা বল নাকো কাছে এসে;
আমার হৃদয়ে কথাগুলো জমা রয়ে যাবে।
তুমি চলে গেলেও যাবে; আপনার সুখে-
স্মৃতিগুলো মনের দেয়ালে দেখা দিবে!
আমাকে শুধু চোখের নিচে কালোদাগ জন্মাবে।
তুমি হয়তো তাতেই সুখে রবে!
তুমি এমন মায়া কেন বাড়িয়ে দিলে?
কাছে এসে ভুলে যাবে?
দূরে থেকে দূরে যাবে?
ভালোবাসা শিখিয়ে দিলে;
ভুলাতে না শিখিয়ে চলে গেলে?
পদাবলি : ০২
কল্পনা
নবাব আব্দুর রহিম
একদিন সকালে
গুগ্রামের দোচালা বাড়িটার পিছনে
একজোড়া চটি পায়ে
বাগানের ফুলগুলো কোমল আঙুলে
স্পর্শ করবে আর বিমুগ্ধ মুখাবয়বে তোমার
বাতাবী লেবুর মত নমনীয়তা।
সেদিন সকালে গোলাপের কাঁটা যখন
তোমার কোমল তালুকে ছিঁড়ে খেতে চাবে
সামান্য আঘাতেও তা ছুঁয়ে দেবে তোমার কোমল মনকেও
অশ্রুর ¯্রােতে বাঁধ ভাঙার মত ভেঙে যাবে যখন শখের কাজল।
কিংবা তোমার মুখ থেকে বুলির নহর
যেন বায়তুল মুকাররমের স্নিগ্ধ আজান,
যেন পাহাড়ি পাখির সকালের গান
আর
কোলের মেয়েটি যখন দারুণ উৎপাতে
তোমার রক্তের উদগ্র নিশান,
তোমার আঁচলে মুখ লুকিয়ে সুখের ঠিকানা যার।
একদিন সকালে চোখ মেলে যখন
সূর্যস্নাত ধানক্ষেতের পশ্চিমের দাওয়ায়
একটা চুমুকের জন্য অধীর আগ্রহ তোমার
কিংবা কপালে, কপোলে, ঠোঁটে, চিবুকে
স্নেহের অদৃশ্য চিহ্ন বয়ে যাবে তুমি
আর তোমার সুবাস যখন দখিনের দমকা বাতাস
অথচ সেদিন, তোমার পাশে থাকব না আমি
অথচ সেদিন তুমি অন্য কারো
যার প্রতি আমার ক্ষোভ নেই।
যার প্রতি আমার অন্তহীন শুভকামনা।
যার প্রতি আমার হৃদয়ের হৃদ্যতা।
নারী জাতি তো তাকেই ভালবাসে
যার সামর্থ্য আছে
ভালবাসার সামর্থ্য
খাওয়া-পরার সামর্থ্য
প্রভৃতি রকমের যার সামর্থ্য আছে।
আমি নাহয় সেই সকাল, সেই দিন
সেই সুবাস কল্পনা করি!
এক রাত্রি ঘুমে ছিলাম
স্বপন শর্মা
আমার ভাবনাগুলো-
চিরদিন বন্দি থাকে খাতার পাতায় অথবা
মুছে যায় শরৎ বাতাসে,
তবু হৃদয় আকাশে চিন্তার খোরাক আসে।
চিন্তার ভাষা ভুলি না আমি-
অজ¯্র কল্পনা, জেগে থাকে প্রাণে;
পৃথিবীর প্রান্ত ঘেঁষে বার বার পদচারণা
নক্ষত্রের বুকে ঘুরে বেড়ানো...
কোনদিন বাস্তব হবে না সেটা, জানি আমি-
রাতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেখি-
জল, ঢেউ, সমুদ্র কিংবা প্রিয়ার দেহের-বেগ হয়ে
সব ভেসে যায় সাগর জলের আবেগে;
জানি না কোন ঢেউ আমায় খুঁজেছিল-
রাত্রি সিন্ধুর ঢেউ, জলের আবেগে চলে যায়
মনের উচ্ছ্বাসে চোখ বুজে থাকি।
কল্পনায় ছুটে চলি-
সমুদ্রের পাড়ে, বনে-মাঠে কিংবা আকাশজুড়ে
যেখানে উল্কার আলেয়া ভাসে, অথবা...
কাস্তের মত বাঁকা চাঁদ জেগে ওঠে ডুবে যায়
যেখানে গাছের শাখা নড়ে শীত রাতে সাদা হাড়ের মত...
সেখানে আমি আদিম রাত্রির ঘ্রাণ বুকে নিয়ে
নিঃসঙ্গ নিশীথের পথে এক রাত্রি ঘুমে-ছিলাম।
জেগে উঠে হে নারী
লাভলী ইসলাম
কিশোরী মেয়েটি দৌড়াতো উঠোন জুড়ে
ভাঙ্গা মাটির হাঁড়ির টুকরো দিয়ে
এঁকে ঘর বানাতো মাটির উঠানের বুকে
এক্কাদোক্কা বলে দম বন্ধ করে লাফাতে লাফাতে ছয়ের ঘরে বাড়ি যেয়ে থেমে যেত ।
ফের মাটির টুকরোটাকে দম বন্ধ করে এক পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফিরে আসতো ঘুরে ।
চাঁদনি রাতে লুকোচুরি খেলতো সখীদের খুঁজে ফিরে ।
কখনো জোনাকিদের তাড়া করে ধরতে যেয়ে বিফল হয়ে ফিরে এসে বসতো মাটিতে ক্লান্ত হয়ে।
খিলখিল হাসিতে গাছের লতা পাতারাও নড়ে উঠতো আনন্দ উপভোগে ।
সে মেয়েটি এখন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে অনড়
হাসতে ভুলে গেছে, আনন্দ ভেসে গেছে অদেখা কোন প্লাবনে ।
কিশোরী মেয়েটি আপন গৃহে শকূনদের বিষাক্ত বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে খুইয়ে ফেলেছে জীবনের সব হাসি আনন্দ উল্লাস মহামূল্যবান নারীত্বের অংহকারী গৌরব।
দুরন্ত কিশোরী এখন এক নরকীয় আবর্জনা ঘূণে ধরা নষ্ট মানবের লালসার শিকার।
এখন মেয়েটি কাঁদে না
এখন মেয়েটি হাসে না
এখন মেয়েটি খেলে না
এখন মেয়েটি ছোটাছুটি করে না
এক দুনিয়া জোড়া নরকীয় যন্ত্রণার ছোবলে
বিষাক্ত মেয়েটি বাঁচতে চায় কিন্তু কে দেখাবে আলো তার অন্ধকার ভুবনে ?
আছে কি কেউ, আছে কি কেউ ?
আছে কিছু সংখ্যক মানবতাবাদী সুপুরুষ।
নিশ্চিত আছে কেউ ধর্ষিতার অসহায় পিতা নয়ত অসহায় কোন ভাই
আর আছে অভাগীনি মা জননী, যার বুকে বইছে এক ক্ষতবিক্ষত খাল নদী সাগর
মহা সাগরের রক্তাক্ত সতীত্ব বয়ে যাবার
স্রোতের জীবন ভাঙ্গার তীব্র দহন ।
তবু ও আজ বলি উঠো, জেগে ওঠো হে নারী
হে শিশু কন্যা মা জায়া জননী
তোমরা ভালবাসার ফসলাদি বল আমরা কি প্রতিবাদ করতে না পারি ?
জেগে ওঠো হে নারী মুছে ফেলো অশ্রু নয়ন
ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঁচতে শেখো
ঐ যে নতুন সূর্যের আশার আলোর বাধ ভাঙ্গা হাসি দেখো ।
উঠে দাঁড়াও হে লাঞ্ছিতা নির্যাতিতা নতুন প্রত্যয় নিয়ে বাঁচতে শেখো
বিরামচিহ্ন
বিরামচিহ্ন
মুহম্মদ মাসুদ
স্কুল। যে স্কুলসবার, সকলের। স্কুলেরবারান্দার সামনে টাঙানো পতাকাটিও সবার। এখানে কোন ভেদাভেদ নেই। নেই কোন হিংসাবিদ্বেষ, উষ্কানি। স্কুলে সকল ধর্মের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। পাশাপাশি বসে। খুব কাছাকাছি বন্ধুত্ব হয়। খেলাধুলা করে, হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে।
চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে মিঠু আর নিমাই। খুবই ভালো বন্ধুত্ব ওদের। পাশাপাশি বসে, খেলাধূলা-দৌড়াদৌড়ি করে, ছবি আঁকে। দোকানের বিস্কুট, চানাচুর, লজেন্সও ভাগাভাগি কওে খায়। আবার ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়াও করে। কিছুক্ষণ পওে মিলেও যায়। সত্যি! প্রকৃত ভালোবাসা ছেলেবেলার বন্ধুত্বে। যেখানে কোন দৈন্যদশার চিহ্নটুকুও নেই। ঈদেও মধ্যেও নিমাই মিঠুদেও বাড়িতে গিয়ে একসাথে আনন্দ মশকারি করে, খাওয়া-দাওয়া করে। সারাদিন একসাথে গ্রামের এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করে। পুজোতেও মিঠুকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে নিমাই। দু’জনে একসাথে ঠাকুর দেখে। নাচগান দেখে। পাঁপড় ভাজা কিনে খায়।
মিঠুর আব্বু সরকারি চাকুরিজীবী। শহরে থাকে। প্রতিমাসেই চকলেট. বিস্কুট নিয়ে আসে। চকলেট নিয়েও ওদের দু’জনের মধ্যে ভাগাভাগিহয়। নিমাইয়ের বাবা খেটে-খাওয়া মানুষ। মাঝেমধ্যে বাজার থেকে জিলাপি আর মুড়ির মোয়া নিয়ে আসে। এখানেও চলে দু’জনের ভাগাভাগি। কিন্তু, সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে নিমাইয়ের বাবার কোন কাজকর্ম নেই। গোছানো যেটুকু টাকাপয়সা ছিলো সেটাও শেষ। খুবই কষ্টে দিনপাত করছে।
মিঠুর আব্বু বেতন পাচ্ছে। ঝুঁকিভাতাও পাচ্ছে। শহর থেকে ছুটি না পেলেও খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটছে ওদের। মিঠুদের বাড়ির দশ বাড়ি পরে কেউ একজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এনিয়ে জয়নব বেগম চিন্তায় অস্থির। ছেলে-মেয়েকে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করেছে। কিন্তু মিঠুকে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছেনা। জয়নব বেগম,‘মিঠু, তোমাকে না বারবার বলেছি বাড়ির বাইরে যাবেনা। তবুও তুমি...।’
মিঠু বলর, ‘কেন আম্মু? যাবোনা কেন?
জয়নব বেগম উত্তরে বলল,‘কেন আবার! তুমি শোন নাই যে আমাদের বাড়ির দশ বাড়ি পরে একজন করোনা আক্রান্ত হয়েছে।’
মিঠু মাথা নিচু করে বলল,‘শুনেছি আম্মু। তুমি দশ বাড়ি পরের বাড়ির খোঁজখবর ঠিকই রেখেছ। কিন্তু আমাদেও বাড়ির সাথেই নিমাইদেও বাড়ি তুমি একবারও খোঁজখবর নিলে না। নিমাই বলেছে ওরা নাকি না খেয়ে আছে।’
মিঠুর চোখেঅশ্রুজল। হাতের মুঠো থেকে লুকানো চকলেটগুলো পড়ে গেল। জয়নব বেগমের মুখটি চুপসে গেলো নিমেষেই। মুখউজ্জ্বল বর্ণের চাহনিটি নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে গেলো।
প্রখর জীবনবোধের গল্পকার
ইজাজ আহমেদ মিলন। এ সময়ের দীপ্তমান এক তারুণ্যের নাম। তীব্র জীবনবোধ তার গতিধারাকে করেছে শৈল্পিক এবং আলোকিত। তার সৃষ্টি; তার মানবিক চিন্তায় রয়েছে সামাজিক সুস্থতার বিশেষ ভূমিকা । পেশায় সাংবাদিক। বর্তমানে সে দৈনিক সমকাল’র গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োজিত আছে। গত ০৩ ফেব্রুয়ারী ছিল এই সৃষ্টিশীল মানুষের জন্মদিন। ইজাজ আহমেদ মিলন; আপনি বেঁচে থাকুন বছর। সার্বিক সুস্থতায় ‘ধানশালিক’। সুস্থ থাকুন; সুন্দর থাকুন; আনন্দে বাঁচুন। তার জন্মদিনকে ঘিরে ‘ধানশালিক’র এই আয়োজন ।
প্রখর জীবনবোধের গল্পকার
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ইজাজ আহ্মেদ মিলন একজন তরুণ কবি। তাঁর কবিতা আধুনিক এবং তাতে সমাজ চিত্রের ছাপ আছে। বছর চার আগে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে’ (এই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সিটি ব্যাংক ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম( চ্যানেল আই০ প্রবর্তিত ‘সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছিলেন) এবং গেলো বছর প্রকাশিত দ্বিতীয় বই ‘ দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ’ আমার হাতে আসে। তখনই তাঁর লেখার শক্তিমত্তা ও পারদর্শীতার পরিচয় পাই। বয়সে খুবই তরুণ Ñ এই কবি যে একদিন আমাদের সাহিত্য অঙ্গনের প্রথম সারিতে এগিয়ে আসতে পারে তার আভাস তাঁর লেখাতেই রয়েছে।
ইজাজ আহমেদ মিলন প্রতিভাবান একজন সাংবাদিকও । ঢাকার বিভিন্ন মিডিয়ার সঙ্গে তিনি জড়িত। এই এবারের মেলায় তাঁর প্রথম গল্পের বই বেরিয়েছে। নাম ‘ ছাতিম গাছের মৃত ছায়া’। আমি তাঁর কয়েকটি গল্প পড়ার সুযোগ পেয়েছি। গল্পগুলো আগে দেশের এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গল্পগুলোতে আধুনিক জীবনবোধ প্রখর। ভাষা ও প্রকাশ ভঙিতেও নতুনত্ব আছে। শুধু দেশের বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় নয়, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আমাদের জাতীয় জাগরণের খন্ড খন্ড ছবিও আছে গল্পগুলোতে। কোন কোন গল্পে বড় উপন্যাসের পটভূমি আছে।এ প্রজন্মের শক্তিমান লেখক ইজাজ আহ্মেদ মিলন কবিতার মতো গল্প লেখাতেও মুনশীয়ানা দেখিয়েছে। তাঁর কবিতার বইয়ের মতো গল্পের বইও পাঠকদের সমাদর লাভ করবে -এটা আমার ধারণা।
ইজাজ মিলনের লেখাগুলো আমাকে অশ্রুসিক্ত করেছে
ইজাজ মিলনের লেখাগুলো আমাকে অশ্রুসিক্ত করেছে
গোলাম সারওয়ার
ইজাজ আহ্মেদ মিলন সমকালের গাজীপুর প্রতিনিধি। একাšøই একজন স্বল্পবাক, আত্মমুখীন নিভৃতচারী সাংবাদিক। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা সাংবাদিকদের মধ্যে যথেষ্ট প্রকট। এই ব্যাধি থেকে মিলন মুক্ত বলে ওর সঙ্গে কথা হয় কদাচিৎই। স্বল্পবাকই নয়, মিলন চলনে-বলনেও খুব নিরীহ। সম্প্রতি সে আমার সঙ্গে দেখা করে তার প্রকাশিতব্য নতুন গ্রন্থ ‘১৯৭১ :বিস্মৃত সেই সব শহীদ’-এর ভূমিকা লেখার অনুরোধ জানাতেও সে ছিল ™ি^ধান্বিত। দেশে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক অস্থিরতা। পেট্রোল বোমায় দ¹ব্দ হচ্ছে নারী, পুরুষ, শিশু। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মাংস পোড়ার গন্ধ, আহতদের আর্তনাদে বাতাস ভারি। ভয়ঙ্কর উত্তেজনা ও ব্যস্ততার মধ্যে সাংবাদিকদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত। এ সময়ে কোনো পুস্তকের ভূমিকা লেখার দুরূহ কাজ (যে কাজে আমি আদৌ অভ্যস্ত নই) সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে জানালেও মিলনের করুণ মুখ দেখে অবশেষে দু’কথা লেখার জন্য সম্মত হয়েও তাকে অনেক দিন অপেক্ষমাণ রাখতে হয়েছে। এ জন্য কিছুটা মর্মবেদনাও অনুভব করেছি। মিলন তার নতুন বইয়ের পা-ুলিপি দেওয়ার সময় প্রকাশিত তিনটি বইও দিলÑ ১. পোড়ামাটির ক্যানভাসে বিরামহীন বেদনা, ২. দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ, ৩. ছাতিম গাছের মৃত ছায়া। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্রজলে’ পাওয়া গেল না।
মিলনের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘১৯৭১ :বিস্মৃত সেই সব শহীদ’-এর সূচিবদ্ধ ২৫ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার অজানা মর্মস্পর্শী কাহিনীগুলোর ওপর চকিত চোখ বুলিয়েছি। সবগুলো পড়া হয়নি। লেখাগুলো আমাকে অশ্রƒসিক্ত করেছে। স্বামী ফিরে আসবেন Ñ পথের দিকে আজও চেয়ে থাকা শহীদজায়া আনোয়ারার কথা লিখতে গিয়ে বারবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে মিলন। শুধু আনোয়ারার কথা লিখতে গিয়েই নয়, অন্যদের গল্পেও আবেগ ও বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মিলনের বাংলা একেবারেই নির্ভার, ঝরঝরে। বর্ণনার অনুষঙ্গে দৃশ্যমান হয়েছে যেন কবির চোখে দেখা প্রকৃতি। শহীদ শামসুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারার জবানিতে, ‘দুধভাত খুব প্রিয় ছিল তার। সাথে কলা। আমাদের একটা গাভী ছিল। খুব সকালে উঠে রান্না শেষ করেছি। গাভীর দুধ দিয়ে ভাত দিলাম। তিনি খেতে বসলেন। কিন্তু আমাকে ছাড়া খাবেন না। যু™েব্দ না যাওয়ার জন্য বারবার আমি অনুরোধ করেছিলাম। তিনি শুনলেন না। অনেকটা অভিমান করে সেদিন তার সাথে খেতে বসিনি। আমি বসিনি বলে তিনিও আর খেলেন না। চলে গেলেন, অনেকটা অভিমান করে।’ এমনি করে বহতা নদীর মতো এগিয়ে গেছে জীবনের গল্কপ্প, জীবনের বেদনা-অশ্রƒপাত। তার লেখায় বারবার ফিরে এসেছে আমাদের চারপাশের নিসর্গ, প্রকৃতি। সম্ভবত মিলন মূলত কবি বলেই প্রকৃতিতে প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে। তার কবিতার প্রশংসায় দেশের সেরা কবিরা পঞ্চমুখ। কবি আল মাহমুদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মহাদেব সাহা তার কবিতা ও গদ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গদ্য লিখতে তাকে প্রেরণা দিয়েছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও হুুমায়ূন আহমেদ। তারা যে একজন যোগ্য লোককেই অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, তা ‘১৯৭১ :বিস্মৃত সেই সব শহীদ’ পাঠ করে হƒদয়ঙ্গম করতে পেরেছি।
ইজাজ আহমেদ মিলন তার এলাকার বিস্মৃত শহীদদের কথা জানতে, তাদের কথা আমাদের জানাতে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে। জহির উদ্দিনের ‘কষ্টগুলো পাথর’ হয়ে যাওয়ার গল্প, শাহাব উদ্দিনের লাশ হয়ে ফিরে আসার কথা, গোলাম মোস্তফার ‘তেতাল্লিশ বছরেও স্বীকৃতি না মেলা’, শামসুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারার ‘পথপানে চেয়ে থাকা’, শহীদ খন্দকার আবুল খায়েরের সন্তান আবুল কাশেমের যন্ত্রণার গুরুভার বেদনার অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছে। ইজাজ আহ্মেদ মিলনের গ্রন্থটি প্রকাশকালও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাাধীনতায় যারা বিশ^াস করে না, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত , যারা দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চাকা রুদ্ধ করতে চাইছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা এখন যুদ্ধে লিপ্ত। মিলনের এই পুস্তকটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও শানিত করবে বলে আমার বিশ^াস।
মিলনের আত্মকথন:বেদনা আমার জন্ম সহোদর
মিলনের আত্মকথন:বেদনা আমার জন্ম সহোদর
ফরিদুর রেজা সাগর
ওর জীবনের গল্প বলার ভঙ্গিটাই আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। কোনো রাখ ঢাক নেই। জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলো দ্বিধাহীন, অকপট ভঙ্গিতে বলে গেছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। একবার মনে হয়েছিল ছেলেটি কী এমন মর্যাদায় নিজেকে দাঁড় করিয়েছে যে এখনই জীবন কাহিনী লিখতে হবে? ওর এখন তরুণ বয়স। কবিতা লিখে। মফস্বল সাংবাদিকতার সাথে জড়িত। এই তো মোটামুটি পরিচয়। এই পরিচয়ে, এই বয়সেই জীবনের গল্প নিয়ে ঢাউস সাইজের একটা বই লিখেছে। এক ধরনের বাড়াবাড়ি নয় কী? কিন্তু ওর বই পড়ে আমি যার পর নাই মুগ্ধ। হ্যাঁ, ইজাজ মিলনের এই বইখানি তার জন্য যতনা দরকারি তার চেয়ে বেশি দরকারী হয়ে উঠতে পারে তরুণদের জন্য। যারা জীবন সংগ্রামে একটুতেই হাঁপিয়ে যায় তারা বোধকরি উপকৃত হবে মিলনের এই বই পড়ে।
আমরা অনেকে যখন একটু বড় হই, সমাজে নাম-ডাক হয় তখন বেমালুম ভুলে যাই পিছনের কথা। শেকড়কে অস্বীকার করতে থাকি কেউ কেউ। কিন্তু ইজাজ মিলন তা করেনি। ওর বইখানি শুরু হয়েছে জীবনের এক সত্য ভাষণ দিয়ে। ‘ রিকশাওয়ালার পোলা বলে প্রায় সময়ই আমাকে গালি দেন দু’একজন বন্ধু কিংবা ঘনিষ্ঠজন। প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে বহুবার গালিটি আমাকে শুনতে হয়েছে। এটা শুনে এখন আর আমার খারাপ লাগে না। এক সময় খারাপ লাগত। অপরাধী মনে হতো। ভাবতাম, রিকশাওয়ালার ঔরসে জন্ম নিয়ে যে অপরাধ আমার হয়েছে কার কাছে ক্ষমা চাইলে বন্ধুরা আর আমাকে এই বলে গালি দিবে না। অবশ্য এ অপরাধের জন্য কখনও আমার ভেতরে অনুশোচনা কাজ করেনি। গালিটা ছিল আমার কাছে এক ধরনের প্রেরণা, এক অর্থে উৎসাহও...’
কি অকপট স্বীকারোক্তি। ক’জনই বা পারে এভাবে কষ্টের অতীতকে মহিমান্বিত করতে? এই তরুণকে আমাদের উচিত সহায়তা করা। তার পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। দেশের বিশিষ্ট দৈনিক পত্রিকা ‘সমকাল’ এর গাজীপুর প্রতিনিধি হিসেবে সে এখন সাংবাদিকতা করছে। নিয়মিত কবিতা লিখে। সাংবাদিকতায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রবর্তিত ‘ বজলুর রহমান স্মৃতিপদক ’ পেয়েছিল। পুরস্কার প্রদান কমিটির একজন নিয়মিত বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ওর ব্যাপারে জানতে পারি। আত্মকথন গ্রন্থ ‘বেদনা আমার জন্ম সহোদর’ ওর জীবনের বেদনা দূর করে অন্যদের জীবন সংগ্রামেও প্রেরণার উৎস হয়ে উঠুক এই শুভ কামনা থাকলো।
ফরিদুর রেজা সাগর
শিশু সাহিত্যিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চ্যানেল আই
মিলনের বইটি মুক্তিযুদ্ধের সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস”র্চ্চায় গবেষকদের কজে লাগবে
মিলনের বইটি মুক্তিযুদ্ধের সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস”র্চ্চায় গবেষকদের কজে লাগবে
নির্মলেন্দু গুণ
আমার জন্মসাল আর সংগ্রামী জননেতা এডভোকেট রহমত আলীর জন্মসাল এক, ১৯৪৫। আমি একই খ্রিষ্টবর্ষের জুনে, তিনি সেপ্টেম্বরে। অকালপক্ব শুভ্র-শ্মশ্র“ ও দাড়ির কারণে আমরা দীর্ঘ চলি¬শ-বিয়ালি¬শ বছর ধরে পরস্পরকে অগ্রজ বলে জ্ঞান করে এসেছি। ‘অর্ধ শতাব্দীর রাজনৈতিক জীবন : কালের আয়নায় রহমত আলী’ গ্রন্থের পান্ডুলিপি পাঠ করে জানলাম তিনি আমার প্রায় জন্ম-সহোদর। জন্মগ্রহণ করার জন্য দ্বিতীয বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবমুক্ত ১৯৪৫ বছরটি যে মন্দ নয়, আমার এই ধারণা ও দাবির প্রতি জনাব রহমত আলীর সমর্থন রয়েছে জেনে আমার খুব আনন্দ হলো।
আত্মজৈবনিক রচনার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ এবং দুর্বলতা রয়েছে, তা যদি কোনো অখ্যাতজনের জীবনীও হয়, তাতেও আপত্তি নেই। নীরদ সি চৌধুরীর ‘অটোবায়োগ্রাফি অব এন আননোন ইন্ডিয়ান’- গ্রন্থটির কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
শ্রীপুরের কৃতী সন্তান, আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট রহমত আলীর অর্ধ-শতাব্দী-ব্যাপ্ত রাজনৈতিক জীবনের এমন অনেক অজানা-অধ্যায় বর্তমান গ্রন্থটিতে বর্ণিত হয়েছে, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস”র্চ্চায় গবেষকদের কজে লাগবে।
তিনি তাঁর জীবনকথা নিজে রচনা করেননি বটে, তবে, তরুণ কবি-সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন যে তাঁর নির্দেশিত পথেই তাঁর সংগ্রামী জীবনের আলেখ্য রচনা করেছেন, সে আমি ব্যাক্তিগতভাবে জানি। ইজাজ আহমেদ মিলন সুখপাঠ্য কাব্যিক ভাষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহচ্ছায়ায় বেড়ে-ওঠা জননেতা রহমত আলীর দীর্ঘ জীবনকাব্যের অনেকটাই পাঠকের দরবারে বিশ্বস্ততার সঙ্গে হাজির করতে সমর্থ হয়েছেন।
এই গুরুত্বপূর্ণ জীবনী-গ্রন্থের প্রাক-কথা রচনার দায়িত্ব দিয়ে জননেতা বন্ধুপ্রতিম রহমত আলী আমাকে গৌরবান্বিত করেছেন।
আমি পরম করুণাময়ের কাছে তাঁর জন্য সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করছি।
নির্মলেন্দু গুণ
কামরাঙ্গীর চর, ঢাকা।
ইজাজ মিলনের ‘স্বপ্নগুলো ডানা মেলে উড়বে হেমন্তের আকাশে
ইজাজ মিলনের ‘স্বপ্নগুলো ডানা মেলে উড়বে হেমন্তের আকাশে
মুস্তাফিজ শফি
ইজাজ আহ্মেদ মিলন বেদনার জন্ম সহোদর। আত্মজৈবনিক লেখা থেকে শুরু করে কবিতা, সর্বত্রই তিনি এই ছাপ রেখে চলেছেন। যেকোনো মহৎ সাহিত্যের পেছনেই থাকে কোনো বড় বেদনা, কবিতারতো বটেইÑ কথাটি বহুকাল ধরেই সর্বজনবিদিত। প্রথম কবিতার বই ‘নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে’ থেকে শুরু করে ‘দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ’, ‘পোড়ামাটির ক্যানভাসে বিরামহীন বেদনা,’ ‘নিথর রাতের গন্ধ’ কিংবা আলোচিত ‘জন্মান্ধ চোখের মতো শুষ্ক পৃথিবী’র কবিতাগুচ্ছ পড়লেই বোঝা যাবে কবি কতটা বেদনায়, কতটা বিরহে দীর্ণ। এই বেদনা, এই বিরহ পাঠক থেকে পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে এটা নি:সন্দেহে বলা যায়।
‘অন্তহীন এক শূন্যতা ঘিরে আছে/ আমার এই হৃদয়ের দেয়াল’ দিয়ে শুরু। তার আলোচিত বইয়ের কবিতাগুলো পাঠ করতে শুরু করিÑ ‘আমি রৌদ্রক্লান্ত এক পথিক/সুদীর্ঘ পথ হেঁটে/প্রাচীরের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছি’। তিনি উচ্চারণ করেন, ‘ সাগর সৈকতের মতো দীর্ঘ আমার বিরহ রেখা’। তার রচিত ‘ ঘন সবুজের এই বাগানে/রক্তজবা কখনো এতো রক্তাক্ত/হয়ে ফুটেনি আগে’।
পেশায় সাংবাদিকতা এবং লেখালেখির নানা মাধ্যমে যুক্ত থাকলেও ইজাজ আহ্মেদ মিলন একজন উদীয়মান এবং উদ্যমী কবি। আলোচিত বইটি তার সর্বশেষ কাব্যপ্রয়াস। নতুন পুরনো মিলিয়ে এখানে স্থান পেয়েছে নির্বাচিত একশটি কবিতা। এই কবিতাগুলো পাঠক মনের শুষ্ক পৃথিবীতে ফুল ফুটাবে, ইজাজ মিলনের ‘স্বপ্নগুলো ডানা মেলে উড়বে হেমন্তের আকাশে - পাকা ধান ক্ষেতের নিমন্ত্রণে’Ñ এই প্রত্যাশাতো অগ্রজ হিসেবে করতেই পারি।
অনেক শুভ কামনা, অনেক ভালোবাসা।
মুস্তাফিজ শফি
কবি ও কথাসাহিত্যিক
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক সমকাল
ইজাজ মিলনের কোনো সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই
ইজাজ মিলনের কোনো সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই
আনিসুল হক
সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। বলেছিলেন জীবনানন্দ। আবার কথা আছে, প্রতিটা মানুষই কবি, যখন সে প্রেমে পড়ে। কবিতা মানে সুন্দরতম কথার সুন্দরতম বিন্যাস। আবার আমরা জানি, আজকালকার কবিতা কেবল সৌন্দর্যের প্রশস্তি নয়, সুন্দরের ধ্যান নয়, অসুন্দরকেও কবিতা নিজের মধ্যে ধারণ করে। সর্বোত্তম কথার ধারণাও তো পাল্টে যায়। সর্বোত্তম বিন্যাস বলতে কী বোঝায় সেই বিষয় নিয়েও কোনো স্থিরতা নেই। কখনও কখনও বিন্যাসহীনতাই শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস। কবিতার মানে খুঁজতে হয় না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ফুল শুঁকে কেউ যদি বলে কিছুই বুঝলাম না, তার যেমন কোনো মানে হয় না, তেমনি কবিতা পড়ে কেউ যদি বলে কিছুই বুঝলাম না তারও কোনো মানে হয় না। আবার ইচ্ছা করেই পৃথিবীর বহু কবি তার কবিতাকে মানে বোঝানোর ভার থেকে মুক্তি দিয়েছেন। কখনও কখনও গেঁয়ো শব্দ, কখনও কখনও সুধীজনে উচ্চারণ-অযোগ্য শব্দ প্রয়োগ করেছেন কবিতায়। আপাতত গদ্যে যা ভুল, কবিতায় তার প্রয়োগ চলে, যাকে বলে পোয়েটিক লাইসেন্স।
দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ কবি ইজাজ আহমেদ মিলনের সর্বশেষ কাব্য-প্রয়াস। নতুন দিনের কবিরা স্পর্ধাময়, তারা কোনো প্রবীণ কবির সনদপত্রের জন্যে হা করে তাকিয়ে নেই। ইজাজ আহমেদ মিলনের কোনো সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। তিনি বিলাপ করছেন, সেটা করছেন দেহারণ্যের ভাঁজে, আর সেই বিলাপ শূন্যতার। সেখানে আমি কে কথা কইবার? তাকে বিলাপ করতে দিন। বিলাপ গোলাপ হয়ে উঠুক। গোলাপ সৌরভ না ছড়ালে কাঁটা ছড়াক। কবিতা আজকাল কাঁটাও ছড়াতে পারে। আবার গোলাপের মতো সৌন্দর্য ও সৌরভও তার করায়ত্ত।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও উপ সম্পাদক প্রথম আলো
সাহসী চেতনায় দীপ্ত একটি গ্রন্থ
সাহসী চেতনায় দীপ্ত একটি গ্রন্থ
সেলিনা হোসেন
‘ ১৯৭১: বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং ’ বইটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত ইজাজ আহমেদ মিলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিশেষ করে উল্লেখ্যযোগ্য মনে হয়েছে একটি এলাকাকে ঘিরে তার নানামুখী বর্ণনা একদিকে হৃদয় বিদারক,অন্যদিকে সাহসী চেতনায় দীপ্ত। স্বাধীনতা অর্জনের সময়ে গণহত্যার বিবরণের পাশাপাশি যুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণার নানাদিক সুলিখিত ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। প্রতিটি লেখার একটি শিরোনাম দিয়েছে ইজাজ মিলন। শিরোনামগুলো ধরে বর্ণিত বিবরণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। একটি শিরোনাম ‘ রক্তে লাল হয়ে যায় বেলায়ইয়ের জল ’- গণহত্যায় জীবনদানকারী মানুষের রক্ত স্বদেশের জন্য ধারা প্লাবিত করেছে। আরেকটি শিরোনাম ‘পড়ে থাকে শেয়ালে খাওয়া বুলু আর ফুলুর বীভৎস দেহ ’- এমন দৃশ্যও চিত্রিত হয়েছে স্বদেশের মাটিতে। আর একটি শিরোনাম ‘ বাকের মুখে মৃত মায়ের স্তন, পাশেই পড়ে আছে তিন সন্তানের লাশ ’- গণহত্যার নির্মমতা এভাবেই সংগঠিত হয়েছে। এমন আরো অনেক বর্ণনা আছে এই বইয়ে। একটি শিরোনাম ‘ গামছায় চিড়ামুড়ি নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন আবদুর রশিদ চিনু’- এমন অসংখ্য মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্নে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধে।
এমন লেখায় ভরা বইটি পাঠকের আগ্রহ তৈরি করবে। বাংলাদেশের একটি এলাকার বর্ণনা হলেও, দেশের প্রতিটি এলাকার এমন চিত্র নিয়েই আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ‘ ১৯৭১: বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং ’ গ্রন্থের প্রণেতা ইজাজ আহ্মেদ মিলনকে শুভেচ্ছা জানাই।’
সেলিনা হোসেন
কথাসাহিত্যিক
মিলন খুবই উচ্ছ্বসিত ও প্রাণবন্ত তরুণ
মিলন খুবই উচ্ছ্বসিত ও প্রাণবন্ত তরুণ
মহাদেব সাহা
ইজাজ আহ্মেদ মিলনের তৃতীয় কবিতার বই ‘ পোড়ামাটির ক্যানভাসে বিরামহীন বেদনা’; নাম থেকেই বোঝা যায় কবিতাগুলি কবির অর্ন্তলীন বেদনার প্রকাশ; আর এ কথা তো বলাই যায় যে , বেদনাই কবিতার আদি উৎস। সব কবিই তার বেদনা ও জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতাগুলি ব্যক্ত করেন কবিতায়। একজন কবির তৃতীয় বইয়ের ভূমিকার কিংবা তার পরিচয় তুলে ধরার বিশেষ প্রয়োজন হয় না,নিজের পরিচয়েই তার নিজের পরিচয় জানা হয়ে যায় আমাদের। মিলন আমার স্ন্হেভাজন ও অনুরাগী, সে আমাকে গাজীপুরে অঞ্চলের উপচে পড়া সবুজ অরণ্যভূমি ঘুরে দেখিয়েছে, সেই অগাধ সবুজে ও উন্মুক্ত প্রান্তরে আমি অশেষ আনন্দবোধ করেছি। মিলনের কিছু কিছু কবিতা আমি পত্রিকায় দেখেছি,মিলন খুবই উচ্ছ্বসিত ও প্রাণবন্ত তরুণ, সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে আমার মতো নির্জন ও বিচ্ছিন্ন স্বভাবের মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখে ও অনুপ্রাণীত করে। আমি লক্ষ্য করেছি নানা বিষয়ে তার উৎসাহ থাকলেও কবিতাই তার প্রধান আকর্ষণ। সে যদি তার এই আকর্ষণ কবিতার প্রতি আরও নিবদ্ধ করে , আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যায় কবিতার সঙ্গে,তাহলে তার কবিতা আরও শিল্পিত ও লাবণ্যময় হয়ে উঠবে,কবিকে নিরন্তর তা-ই করতে হয়। কবিতার ক্ষেতে কোনো সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ নেই, কবিতার জন্য কতো যে যাতনা সইতে হয় কবিকে,কবিতা হচ্ছে অপার সুখ ও অপার দু:খের দুলর্ভ ফসল, সত্যই কবিতা হচ্ছে বিরামহীন বেদনা ও বিরামহীন যুদ্ধের ফল। আমার বিশ্বাস, মিলন এই দু:খ বরণের প্রস্তুতি নিয়েই এই দু:খের পথে পা বাড়িয়েছে, আমি কয়েকশো বাক্যে প্রার্থনা করি তার এই কাব্যযাত্রা সফল হোক। ইজাজ আহ্মেদ মিলন কবিতা লেখে নিজের মতো করে,তার খুব বেশি কবিতা আমি পড়েছি তা নয়, কিন্তু তা সত্যেও তার কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যপঙ্ক্তির ঔজ্জ্বল্য ও গভীরতা আমাকে সপঠ করেছে, নিজের গুণেই তার কোনো কোনো পঙ্ক্তি আমার প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে, আমি লক্ষ্য করেছি এই নবীন কবির মধ্যে সম্ভাবনার ঝলক আছে, পৃথক একটা আবেদন আছে। তার এই শক্তির প্রতি তাকে নিজেই আস্থশীল হয়ে উঠতে হবে। আমার অনুভূতি ও উপলব্ধি সব সময়ই নতুন কবি ও কবিতার পক্ষে, এখন এই নবীন ও তরুণেরাই আমার প্রিয় সঙ্গীও আর এটা হওয়ার কারণ তাদের কবিতার প্রতি আমার ভালোবাসা, সেই তালিকায় মিলনও নি:সন্দেহেই এক পছন্দের নাম। সব কবিকেই নিজস্ব একটি জগৎ তৈরি করতে হয়,সেজন্য চর্চার কোনো বিকল্প নাই। মিলনের কবিতার প্রধান বিষয় প্রেম, প্রকৃতি, সমাজ,দেশ ও দেশের প্রতি মমত্ববোধ। তার কবিতার ভাষা স্বচ্ছ ও সাবলীল , অকারণ দুর্বোধ্যতা সৃষ্টির প্রয়োগমুক্ত। এ কারণে কবিতা পাঠকদের সব সপঠ করে। এ ক্ষেত্রে যদি আরও যতœবান হয়, তাহলে তার কবিতা আরও বেশি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হবে।
মিলনের একটি কবিতার নাম ‘ ঢেউহীন জলের উপর তুমি আঁকো ছবি’ বেশ অমিয়, ‘ যার আঁচল তলে’, একটি প্রেমের কবিতা, ‘ মুিদ্রত তর্জমা,’ বেশ অভিনব, বন্ধুর স্মৃতি নিয়ে তার লেখা আর একটি কবিতা‘ নিখিলের স্মৃতি’ হৃদয়গ্রাহী,মাটির সাথে যে সম্পর্ক এটা সহজে বোঝা যায় তার একটি কবিতার নাম থেকে ‘ মাটির সাথে কথা বলি এখন’। কবিতা নিয়ে কোনো শেষ কথা বলা যায় না, আশা করি মিলন তা মনপ্রাণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে। তাকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
শুভ জন্মদিন গুরুজি
শুভ জন্মদিন গুরুজি
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ভাই হিসেবে যদি বলি; তবে সে আমার আমার গুরু। বন্ধু হিসেবে যদি বলি; তবে সে আমার দারুণ এক ছায়াবিশেষ । আর সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে যদি বলি; তবে সে আমার কাছে অন্যরকম এক বলিষ্ঠ পুরুষ। তার মানবিকচিন্তা কিংবা সামাজিক চিন্তা আরো দশটা তারুণ্যকে যে উৎসাহ্ উদ্দিপনা দেয়; তা সত্যি অবাক করার মত । বরাবর’ই আমি তাকে আমার গুরু হিসেবে মানি। কারণ তার কাছে থেকে অনেক কিছু শিখি প্রতিনিয়ত। তার প্রতি আমার যে ভালোবাসার জায়গা; কিংবা তার প্রতি আমার যে সম্মানের জায়গাটা পরিমানহীন; সীমাহীন । এই যে তার জন্মদিন গেল; যদি তাকে ওভাবে সময় দেয় হয়নি কিংবা তাকে সাথে ওভাবে কথা হয়নি; তবুও তার জন্মদিনটা আমাকে মনে করি দিয়েছি; যে; আমার গুরুজির আরেকটা জন্মদিন গেল; আরেকটু বড় হলো; আরেকটু পথ এগিয়ে গেল । এই জন্মদিনে তার প্রতি রইল রইল আমার মৃদুমিহি অজ¯্র ভালোবাসা এবং দোয়া । ইজাজ আহমেদ মিলন; প্রিয় ভাই আমার; প্রিয় বন্ধু আমার; বেঁচে থাকুন হাজার বছর; ভালো থাকুন; সুস্থ থাকুন; সুন্দর থাকুন; আনন্দে বাঁচুন সব সময়; ।
পদাবলি
ধুলোর শহরে শুধুই আমি একা
জহির খান
এই যে মেঘ আকাশ জুড়ে আছে
জমে থাক তুমুল হাওয়ার বেগে
একটু আধটু ভালোলাগার ছায়ায়
ধুলোর শহরে শুধুই আমি একা
একটু পরেই বৃষ্টি হবে ঝিরিঝিরি
মাঠের পর মাঠ দৌড় ছাগলছানা
কানামাছি ভোঁ, দৌড়ে গোল্লাছুট
এই যে আমি বর সেজে বসেছিলাম
আষাঢ়-শ্রাবণ বরষার উঠোন জুড়ে
কনের খোঁজে মিছে মিছে গেলো
আমার এক সরষে ইলিশ যৌবন
এখন একটু আধটু টিপটিপ শব্দে
ঘুম ভাঙলে শুধুই আড়াল, দেয়াল
তবু প্রেম আমার খুন হলে পরে
হবে রক্তপাত এই শহরের বুকে
ডেথ সার্টিফিকেট
সৈয়দ শরীফ
‘সব হারিয়েও যারা বেঁচে আছে, তাদের সকলকে
একটি করে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া হোক’
রাষ্ট্রের কাছে এ আবেদনটুকু করার প্রস্তুতিকালে আমার পকেট হতে
কিছু শূন্যগন্ধ উড়ে বাতাসে মিশে গ্যালোÑ
পেছন থেকে কিছু অদ্ভুত লোক আমাকে
হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় কাঁটাঘরে;
এখানে এসে জানলামÑ পরিবেশ দূষিত করার
অপরাধে আমাকে কাল সকালে আদালতে পাঠানো হচ্ছে...
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ভাবছিÑ আমার পকেটের
গন্ধে যদি পরিবেশ দূষিত হয়, তবে এই দূষিত
নিঃশাসে তো রাষ্ট্রই ধ্বংস হয়ে যাবে !
বিচারকের কাছে নিজের ফাঁসি দাবি করে হাতজোড় করার
সময় আমার হাত থেকে আবেদন পত্রটি নিচে পড়ে গ্যালো;
পত্রটি সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হলে
ওটা তিনি গভীর মনোযোগে পড়েন এবং
পড়া শেষে জানানÑ ‘রাষ্ট্রেরও তো সব হারিয়ে
যাচ্ছেÑ জীবনমৃত এই রাষ্ট্রটিকেও একটি ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া প্রয়োজন।’
অস্তিত্তহীন
অলোক আচার্য
মাথার ওপরে নিশ্চল আকাশ
আমি অপেক্ষায় থাকি
আরেকটি বিকেলের।
মেঘগুলো আজকাল ফাঁকি দেয় আমাকে
অকারণে বাতাসে ভাসে না সে উত্তর
আমার দ্বিধাণি¦ত চোখ ফাঁকি দিয়ে
প্রায়ই বৃষ্টি হয়।
আমি টের পাই ভেঁজা উঠানে হাঁটতে গিয়ে
আমি বেশ অবাক হই। এই তো সেদিনও
আকাশের সাথে আমার গভীর প্রণয় ছিল
আমি মিশে ছিলাম-অথবা সে ছিল
অথবা মাঝে ছিল কারও বসবাস
অস্তিত্তহীন, আমি বুঝতে পারিনি।
জিঘাংসার ছাড়পত্র
মাজেদুল হক
দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মাত্রা আর বাড়াতে চাই না-
চাই না এক আনা জীবনে সুরের সিম্ফনী টেনে
অদম্য ইচ্ছের নামতা পড়ার।
চৈত্রের দুপুরে পিপাসিত তটিনির বুকের পাঁজরে
ঝরাপাতার মরমর ধ্বনি শুনতে চাই না
দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মাত্রা আর আওড়াতে চাই নাÑ
চাই না বিন্দু বিসর্গের কোন অভিযোগের শুনানী
চাই না তিলে তিলে দগ্ধ হওয়া মৃত্যু বিভীষিকার ফাঁদ
অগ্নিঝরা অসহ্য দুপুর, শোকাবহ খরতাপ।
অতৃপ্তির বাসনা, বঞ্চনা উপেক্ষা করে
অজ¯্রবার আসতে চেয়েছি একফোঁটা স্বচ্ছ আলোর দ্রাঘিমায়
অথচ জিঘাংসার ছাড়পত্র ছাড়াই ক্রুদ্ধ হীম
আগুনের হলকায় জ্বলছি...
মানুষই মানুষকে পারে বদলাতে
আকিব শিকদার
একটু আঘাত যদি পাই, জ¦লে উঠবো আক্রোশে
বারুদে বারুদ ঘষা খেলে যেমন জ¦লে ওঠে
একটু আদর যদি দাও, গলে যাবো ভালোবেসে
প্রজাপতির পাখার বাতাসে যেমন ফুল ফোটে।
আঘাত নাকি আদর, বলো, কোনটা আমায় দেবে...?
মানুষই মানুষকে পারে বদলাতেÑ দেখেছি ভেবে।
দু’টি কবিতা
মিশির হাবিব
১. আলফা
আজ বুঝতে পারি, কেন একজন প্রতিষ্ঠিত পুরুষ রূঢ় হয়।
প্রতিষ্ঠার জালে বন্দি করে সমাজ একজন পুরুষকে নিয়ে যায় বিষাক্ত জীবনে
অথবা মৃত্যুমুখে।
হতাশার ঝলসানো আগ্নেয়গিরি থেকে
মধ্যবিত্ত বেকার জীবন বলে ওঠে-
সমাজ একটা মাদারচোদ।
২. বিটা
সুখের মুহূর্তগুলো একেকটি মুখর উৎসব,
আর বেদনাগুলো জীবনের ধর্ম।
এরপর মানুষ বলে- ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।
স্বরূপ
জাহিদ আজিম
তোমার বাড়িতে হয় রাজভোগ রান্না
পাশের বাড়িতে হাড়ি শূন্য,
পেট পুরে খেয়ে ঢেকুর তুলে তুমি
মসজিদ-মন্দিরে খোঁজো পুণ্য !
তোমার বিছানাটা খুবই আরাম-নরম
কতো জন ঘুমায় পথ-ধারে ,
ঘুম ভেঙ্গে তুমি ভারি ফুলবাবু সেজে
সাম্য-স্বপ্ন শোনাও ঘুরে ঘুরে।
বুক ভরা তোমার ভীষণ ভালোবাসা
কখনো কি কাঙাল খোঁজো?
কতো নজরানায় পুষ্প ডালি সাজিয়ে
রোজই তো তীর্থ-মাজার পুজো।
আগে মন মননে তুমি মানুষ হও
স্বরূপ চিনবে পরম পূর্ণতায়,
অবয়ব দিয়েই কি কখনো কোন দিন
পূর্ণ প্রকৃতির মানুষ হওয়া যায়?
মা
মা
মুহাম্মদ বরকত আলী
মেহেজাবিন কলেজ থেকে ফিরেই রুমে গিয়ে ব্যাগটা রেখে উঠানে এসে দাঁড়াল। বাড়ির চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে ফিরে এল চোখ জোড়া। নানি হাজিরন বিবি রোয়াকে বসে পানের বাটা সামনে রেখে পান সাজাতে সাজাতে বলল, ‘কীরে, পোশাক বদলাবি না?’ মেহেজাবিন কোনো কথা বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এবার রান্না ঘর থেকে আওয়াজ ভেসে এল, ‘কেমন হলো তোদের অনুষ্ঠান?’ এতক্ষণ চুপচাপ যাকে খুঁজছিলো পেয়ে গেছে মেহেজাবিন। রান্না ঘরে ঢুকে মায়ের পাশে বসল। মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে মেহেজাবিন। আমেনা বানু রুটি বেলতে বেলতে বলল, ‘পোশাক না বদলিয়ে এখানে এলি যে? যা পোশাক বদলে হাত মুখ ধুয়ে আয়। সেই সকালে খেয়েছিস। খাবি, যা।’ মেহেজাবিন কোনো কথা না বলে চুপচাপ মায়ের পাশে বসে রইল। এমন আচরণ ও কখনো করেনি। কলেজ থেকে এসে মাকে হাক ডাক ছেড়ে বলে, ‘মা, খিদে পেয়েছে খেতে দাও।’ ব্যস এতটুকুই। আজ ওর কী হলো যে কথা বলছে না। আমেনা বানু হাতের কাজ রেখে দিয়ে মেয়ের দিকে তাকাতেই দেখল মেয়ের চোখে জল। আমেনা বানু ভয় পেয়ে গেলেন। কাপড়ের আঁচলা নিয়ে মেয়ের চোখ মুছতে মুখতে বলল, ‘কীরে, কী হয়েছে? কলেজে কেউ কিছু বলেছে? কী হয়ে আমাকে বল মা?’ মেহেজাবিন এবার কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘মা, তুমি সত্যি করে একটা কথা বলবে?’
মেয়ের হঠাৎ এই প্রশ্নে ভয় পেয়ে যায় আমেনা। ‘কী কথা?’
মেয়ে কঠিন ভাবে বলে, ‘আগে বলো সত্যি বলবে?’
আমেনা শক্ত হয়। কী এমন কথা যে এভাবে তাকে সত্য বলার শপথ করতে হবে। মেয়েকে লুকানোর কোনো কথাত তার কাছে নেই। তবে কী কথা? প্রস্তুত নেয় প্রশ্ন শোনার। ‘আচ্ছা বল, বল কী কথা?
মেহেজাবিন ধুম করে বলে বসে, ‘আমার বাবা কে?’
আমেনা বানু আবার কাজের দিকে মন দেয়। কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘সে কথা তোকে অনেক আগেই বলেছি। আবার কেন? আমি কী তোর কোনো চাওয়া পাওয়া অপূর্ণ রেখেছি? তোর বাবা মারা গেছে।’
মেহেজাবিন উঠে দাঁড়াল। কঠিন স¦রে বলল, ‘এই আমি রুমে যাচ্ছি, আজ তুমি আমার কাছে সত্যিটা না বললে এক ফোটা জলও স্পর্শ করবো না।’
কথা শেষ হতেই নিজের রুমে গিয়ে ঐ পোশাকে শুয়ে পড়ল। এতক্ষণ মেয়ে নাতীর কথা শুনেছে মেহেজাবিনের নানি। এই বাড়িতে মেহেজাবিনের নানী, মামা মামী আর ওর মায়ের বসবাস। সেই ছোটবেলা থেকেই মেহেজাবিন ওর মায়ের সাথে নানা বাড়িতে আছে। এটাই ওর বাড়ি। এখানেই বড় হওয়া। একটি বারের জন্যও বাবার মুখ দেখার সৌভাগ্য হয় তার। যখনি বাবার কথা জানতে চেয়েছে, তখনি আমেনা এড়িয়ে গেছে। বলেছে বাবা মারা গেছে। মেহেজাবিন সব মেনে নিয়েছে। কিন্তু দাদা দাদী, চাচা চাচীরা তো আছেন। অন্তত এতটুকু জানতে চেয়েছে বাব দাদার গ্রামের নামটা। বাবার গ্রামের নামটা পর্যন্ত সে জানে না। এখন সে বড় হয়েছে, কলেজে বন্ধু বান্ধব হয়েছে। তারাও তো জিজ্ঞাসা করে। তখন কী উত্তর দিবে সে? লজ্জায় পড়তে হয়। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য কথায় চলে যেতে হয় বুদ্ধি খাঁটিয়ে। কিন্তু কলেজের বন্ধুরাওতো এত দিনে ওর মত চতুর হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গ ধরে রাখতে ওরাও যে পারদর্শী। শুধুমাত্র মা আর নানার পরিচয়ে এখন আর পেরে উঠছে না। সে এখন বাবার পরিচয়ে পরিচয় দিতে চায়।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। নানী খুব করে জোরাজোরি করলেও মেহেজাবিন বিছানা থেকে মুখ উঠায়নি। মামা মামি তেমন খবর রাখে না। দুজনেই চাকুরি করেন। সকালে বের হন আর বিকেলে ফেরেন। সংসারের কাজ আমেনাকেই একা করতে হয়। সেই কাকডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির সমস্ত কাজ আমেনাকেই করতে হয়। রান্না বান্না করা, কাপড় কাচা, বাজার করা, সব কাজ আমেনাকেই একা সামাল দিতে হয়। এর মধ্যে একটা স্কুলে শিশুদের ক্লাসও নিয়ে আসেন এক ঘন্টা সময় বের করে। শুধু পেটে খেলেই চলবে না, হাতে কিছু কাচা পয়সাও থাকা চায়। সময় অসময় মেয়েটার আবদার পুরন করতে হয়। সন্ধ্যার পর সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে বাসন কোসন গুছিয়ে মেয়ের জন্য কিছু খাবার হাতের নিয়ে রুমে ঢুকল আমেনা। মেহেজাবিন বালিশে মুখ লুকিয়ে আছে। আমেনা বানু বলল, ‘উঠে বস মা। খেয়ে নে।’ মাথায় হাত বোলাতেই মেহেজাবিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমেনা মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছ বলবো সব। আগে খাবার খেয়ে নে।’ কোনো মতে খাবার খেয়ে শেষ করল। আমেনা একটু গুছিয়ে বসল। মেদের দিকে তাকিয়ে বলল তাহলে শোন, ‘আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও ভালো ছিলাম। বিশেষ করে দৌঁড়ে আমার সাথে কেউ পেরে উঠত না। জেলা থেকে বিভাগ, এমনকি ঢাকাতেও গিয়েছি। কলেজ জীবনে আমার অনেক বন্ধু বান্ধব ছিল। এর কারণ, আমি সব সময় সবার সাথে খোলা মনে ব্যবহার করতাম। কিন্তু এটা আমার জানা ছিল না যে, দ্বিতীয় বর্ষের একটা ছেলে আমাকে পছন্দ করত। বন্ধু বান্ধবীদের কাছ থেকে প্রথম শুনলাম কেউ আমাকে পছন্দ করে। আমি তাকে পাত্তা দিতাম না। কিন্তু সেই ছেলেটা আমাকে দেখার জন্য আমাদের বাড়ির আশে পাশে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরত। তোর মামা, নানা আর আশে পাশের লোকজন যখন বিষয়টা জানতে পারল তখন আমার বিয়ের জন্য ছেলে দেখতে শুরু করল। আমকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি ঐ ছেলেটার সাথে আমার সম্পর্ক আছে কিনা। একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি বাড়িতে অনেক লোকজন। ওরা নাকি আমাকে কলেজেই দেখেছে। আজকেই বিয়ে। তোর বাবা উচ্চ শিক্ষিত। আমি অনেক প্রতিবাদ করেছিলাম। ছেলের বাড়ির খোঁজ খবর না নিয়ে এভাবে বিয়ে মানতে পারি না। বিয়েটা আমার খালুজান দিয়েছিল। বাবা মা দুজনেই খালুর উপর ভরসা করেই বিয়েটা ঠিক করেছিল। তোর দাদার সয়সম্পত্তিও কম নেই। জমিদার বলা চলে। কথা গুলো ঠিক ছিলো। তবে খালুজান একটা কথা লুকিয়ে ছিল। বিয়ের দিন ওখানে গিয়েই জানতে পারলাম এত তাড়া কেন। প্রথম দিন থেকেই তোর বাবা আমাকে সেভাবে মেনে নিয়ে পারেনি। আমাকে যেমন জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল ঠিক তোর বাবার মতের বিরুদ্ধে বিয়েটা দিয়েছিল। কিছুদিন ও বাড়িতে সবাই আমাকে বেশ প্রাধান্য দিলো। শশুর মশায় আর শাশুড়ি আমাকে বোঝালেন যে, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুই ঠিক হলো না। দিন দিন তোর বাবা আমার উপর অত্যাচার করতে লাগল। জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাকা দিতো। একদিন তোর বাবার ডায়েরী পড়ে জানতে পারলাম যে, তোর বাবা তার খালার মেয়েকে ভালোবাসে। কিন্তু বাড়ি থেকে সেই সম্পর্ক মেনে দিতে পারেনি। আস্তে আস্তে নেশার জগতে চলে যায় তোর বাবা। হেরোইন সেবন শুরু করে। ছেলের এই পাগলামো ঠিক করতে আর নেশার জগৎ থেকে বের করে নিয়ে আসতেই খুব দ্রুত বিয়েটা দিয়ে দেয়। একপ্রকার আমার ও আমার পরিবারের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। একদিকে তোর বাবার অমানবিক অত্যাচার অন্যদিকে তোর চাচা ফুপুদের মুখের গালি শুনতে হত। বাড়ির সমস্ত কাজ আমাকেই করতে হতো। তবুুও ছোট লোকের মেয়ে বলে গালাগালি দিতো। একদিন পাচির টপকিয়ে পালিয়েও এসেছিলাম। কিন্তু তোর নানা নানির জোরাজোরিতে আবারও ফিরে যেতে হয়েছিল। তুই যখন পেটে এলি তখন তোর বাবা আমাকে ইলেকট্রিক সক দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সেদিন রাতেই সবার অলক্ষে পালিয়ে এসেছিলাম। সেই আসাই আমার শেষ আসা। আর ফিরে গেলাম না। তোর বাবাও দিন দিন নেশার মধ্যে ডুবে গেল। আমি চেয়েছিলাম তোর বাবাকে নেশার জগত থেকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পারিনি। বিয়েটা দিয়েছিল খালুজান। বাড়ির সবার বুঝতে বাকি থাকল না যে খালুজান প্রতিশোধ নিয়েছেন। খুলজানও খালার সাথে প্রেম করে একা একা বিয়ে করেছেন। এজন্য আমার নানা নানী সেই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। খালা খালুর সাথে নানা নানীর সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়ে যায়। খালা খালু মনে করেন যে, আমার মা আর বাবা মিলে ওদের বিরুদ্ধে নানা নানীকে খাপিয়ে তুলেছে নিজেরা সুবিধা নেওয়ার জন্য। তাই খালুজান যেনেও একজন নেশা গ্রস্থ ছেলের সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে। তুই যখন জন্ম নিলি তখন তোর দাদা দাদীকে খবর দেওয়া হয়েছিল। কেউ আসেননি। শুনেছিলাম তাদের অভিযোগ হল বাড়ির বৌ কাউকে না বলে একলা পালিয়ে গেছে। মান ইজ্জতের ব্যাপার। তাই সেখানে যাব না। ইচ্ছে হলে বৌ নিজেই চলে আসুক। আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম সে বাড়িতে আর যাব না। তোকেই আকড়িয়ে বেঁচে থাকব। তোর লেখাপড়ার খরচ, অন্যান্য খরচে জন্য একটা এনজিওর শিশু শিক্ষা স্কুলে চাকুরি নিলাম। সকালে এক ঘন্টা ক্লাস আর বাকি সময় বাড়ির সমস্ত কাজ করা ছিলো আমার ডিউটি। তোকে নিয়েই আমার স¦প্ন। তোর মাঝেই বেঁচে আছি। আমেনার কণ্ঠ আটকিয়ে আসে। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। মা মেয়ে দুজনেই চুপ। নিস্তব্ধ রাত। দুর থেকে কিসের যেন আওয়াজ ভেসে আসছে।
সকালবেলা মেহেজাবিন বের হলো দাদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। রংমহল গ্রামে দাদার বাড়ি। মায়ের কাছে ঠিকানা নিয়ে বের হয়েছে। এই প্রথম দাদা বাড়ী যাওয়া তার। বাস থেকে নেমে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিলো সারাফাত চৌধুরীর বাড়ি। বাড়িতো নয় যেন আস্ত একটা রাজবাড়ি। অনেক পুরনো আমলের এই রাজ প্রাসাদ। মেহেজাবিনের মনে মনে ভাবল এই হলো তাদের রাজ প্রাসাদ। সে এই বাড়ির মেয়ে। অত্র গ্রামে সারাফাত চৌধুরীর বেশ নাম ডাক আছে। এই এলাকার প্রভাবশালী লোকদের মধ্যে সারাফাত চৌধুরী সবার উপরে। জমিজমা, বংশ, সয় সম্পত্তিতে সারাফাত চৌধুরীর সমান আশে পাশে কয়েক গ্রাম মিলে কেউ নেই। বাড়িটা চারিদিকে উচু প্রাচির দিয়ে ঘেরা। একদিন এই প্রাচির টপকিয়ে তার মা এই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। এত বড় প্রাচির টপকানো বেশ কষ্টের ব্যাপার। তবে এর চেয়ে বেশি কষ্ট না পেলে কেউ এই প্রাচির টপকাতে পারবে না। বিরাট পুরনো লোহার গেট পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করল মেহেজাবিন। বাড়ির ভিতরে বড় উঠান। উঠানে একজন বয়স্ক লোক চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখে চশমা পরে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন। আমার যাওয়ার শব্দ পেয়ে বললেন, ‘এই তুমি কে? কাকে চাচ্ছো? এদিকে এসো।’
মেহেজাবিন ধীর পায়ে লোকটার কাছে গেল। এই বয়স্ক লোকটাই ওর দাদা। মেহেজাবিন বলল, ‘আপনি সারাফাত চৌধুরী?’
‘হ্যাঁ, আমিই সারাফাত চৌধুরী। তোমর পারিচয় কী?’
মেহেজাবিন কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এরি মধ্যে বাড়ির অন্য লোকজন এসে হাজির। দাদী, চাচা, চাচি, চাচাত ভাই বোনেরা এসে হাঁজির। মেহেজাবিন বলল, ‘আমি আপনার বংশধর। ভয় নেই। আমি আপনাদের সম্পত্তির ভাগ নিতে আসিনি। আমার কাছে বড় সম্পদ ও সম্পত্তি আমার মা। এসেছি আমার জন্মদাতা পিতাকে একটি বার চোখের দেখা দেখতে।’
সবাই চুপচুপ মেহেজাবিনের কথা শুনছে। কেউ কথা বলছে না। দাদীমা মেহেজাবিনের হাত ধরে বলল, ‘এসো তোমার বাবাকে দেখবে।’
দাদীমার হাত ধরে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করল মেহেজাবিন। অন্যরা নিজ নিজ রুমে চলে গেলেন। কারো কোনো প্রশ্ন নেই। কোনো কিছুই যেন জানার নেই। মেহেজাবিনকে নিয়ে যাওয়া হল একটা রুমের সামনে। দাদিমা রুমের দরজা খুলে দিতেই দেখল রুমের ভিতর একজন মধ্য বয়স্ক লোক মেঝের উপর উপুড় হয়ে ঘুমুচ্ছে। দরজা খোলার শব্দ শুনে উঠে বসল। দেখে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক একজন মানুষ। মাথার চুল ছাটা, মুখে ছোট ছোট কাচাপাকা দাড়ি। পোশাক পরিষ্কার। মেহেজাবিন কাছে গিয়ে বসল। মানুষটা হাত পা কাপাতে কাপাতে একটু সরে বসল। মেহেজাবিন বলল, ‘আমি তোমার মেয়ে, বাবা। জানি তুমি চিনতে পারবে না। আমার জন্মের পর একটি বারও যে আমার মুখ তুমি দেখনি। কেন বাবা, কেন? আমার কী অপরাধ ছিল? একবারও আমাকে দেখতে মন চায়নি তোমার?’ মেহেজাবিন কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললো। মেহেজাবিনের বাবা স্থির হয়ে মাথা বাকা করে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। কী যেন ভাবছে। হঠাৎ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মেয়ের। মেহেজাবিন বাবার প্রথম স্পর্শ পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। দাদি এতক্ষণে মুখে আঁচল দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। বাবার চোখে জল। সেই জল বাবার মুখের আধাপাকাকাচা দাড়ি গোফ ভিজে গেল। হয়তো মনে পড়েছে তার সেই সব দিন গুলির কথা। নিজের রক্তের সাথে দুরত্ব তৈরি করেছে সে নিজেই। মেহেজাবিন চোখে অশ্রু নিয়ে বের হয় রুম থেকে। বাবা শুয়ে পড়লেন মেঝের উপর।
মেহেজাবিন চলে আসার পথে দাদি খুব করে ধরল কিছু মুখে দিয়ে যেতে হবে। মেহেজাবিন বলল, ‘দাদিমা, আমি এসেছি আমার টানে। তোমরাতো আমাকে নিয়ে আসোনি।’
উঠানে চেয়ার পেতে বসে আছে সারাফাত চৌধুরী। মেহেজাবিন বাইরে আসতে তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের মত জেদি হয়েছো। তোমার মায়ের অহংকার আর জেদ কমেছে? নাকি আগের মতই আছে?’
মেহেজাবিন দাদার নিকটে গিয়ে দাঁড়াল দাদার মুখোমুখি। বলল, ‘সারাফাত চৌধুরীর আত্মহংকার কমেছে? মান সম্মান ইজ্জত এগুলো কি আগের মত আছে? সারাফাত চৌধুরী, আমি চাইলেই আপনার মান সম্মানকে কোর্টে তুলতে পারি। আমি এই বাড়ির ইজ্জত। কিন্তু আমার মা আমাকে সেই শিক্ষা দেয়নি। তোমার সম্পত্তির ছিটেফোটা আমার প্রয়োজন নেই। আমার সম্পদ মা। আমার মাকে তোমরাই ঠগিয়েছো। তাকে রাখতে পারোনি। যদি পার আমার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে এসো।’ এই মিথ্যা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির পথ ধরল।