ক্ষমা করো
ক্ষমা করো
আতিক এ রহিম
আমাকে ক্ষমা কর। আমি পারিনি তোমাকে কথা দিয়ে কথা রাখতে। আমি সকল বীর যুদ্ধাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। কেন ক্ষমা চাচ্ছি তা খুলে না বললে হয়তো কেউ বুঝবেন না। আমার লেখায তার কোন উপকার হতো কি না আমি জানি না? তার পরও কথা দিয়ে ছিলাম আমি তার কথাগুলো পত্রিকায় লেখব। আমি একজন ক্ষুদ্র রিপোর্টার। জেলার একটি পত্রিকায় কাজ করি। সেদিন গিয়েছিলাম নিউজ সংগ্রহ করার জন্য। এটি একটি সাংস্কৃতিক সাহিত্য সভা হলে কি হবে এখানে বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়েছেন যারা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। মঞ্চ ভর্তি লোকজন।আমি দাঁড়িয়ে আছি মঞ্চের সামনে । অতিথিদের বরণ করা হচ্ছে। আমি অতিথিদের ছবি নেওয়ার জন্য আমার দাঁড়িয়ে থাকা। এর মধ্যে একজন বয়স্ক লোক বারবার মঞ্চে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। প্রধান অতিথি এবং আরেকজন বিশেষ অতিথির সাথে কথা বলার জন্য।সে কিন্তু তাদের ধারে কাছে যেতে পারছে না। তার হাতে একটি ফাইল । ফাইলের মধ্যে কিছু পত্র দেখা যাচ্ছে। লোকটি যত বার যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে তত বারই বাধার সম্মুখিন হচ্ছেন। লোকটি দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। এমনিতেই লোকটি বয়সের ভারে ন্যুহ হয়ে গেছে।আমি কাছে গেলাম ভাই আপনার কি সমস্যা? আমি মনে মনে ভাবছিলাম কোন মামলা মোকদ্দমা বা মেয়ের বিয়ের জন্য কোন সাহায্য সহযোগিতার জন্য এসেছেন। সে আমার সাথে একটু সরে এল আমরা দুজন মঞ্চের কাছ থেকে সরে লোকজন যেখানে চেয়ারে বসেছে আমরা দুজন পাশাপাশি বসলাম। লোকটি বলতে লাগল আমার নাম দেলোয়ার হেসেন। বাড়ি কুড়িগাওঁ। আমার মনে হলে তিনি কথা বলছেন তার দম ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বললেন আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ ফাইলে আমার সব কাগজ পত্র আছে। কিন্তু আমি এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তালিকাভুক্ত হতে পারিনি।আমি বললাম কেন আপনি হতে পারেননি ? সে বলল জানি না আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কাগজ পত্র জমা দিয়েছি কিন্তু আজো কোন কাজ হয়নি।আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করে তাকে বিরক্ত করতে মন চাইল না। আমি লোকটির কথা ভেবে কষ্টপেতে লাগলাম যে লোকটি জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধ করেছেন সে আজ একটি স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দেশের নেতৃবৃন্দদের কাছে এক জন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছে দৌড়াচ্ছেন। জানি না সে সরাসরি যুদ্ধ করতে পেরেছেন কী না আমার জানা নাই তবুও সে দেশের মানুষের জন্য দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যৌবনে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশ থেকে শত্রু তাড়ানোর এগিয়ে এসেছিলেন। আমি মুক্তযুদ্ধ দেখিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে শুনেছি বইপুস্তকে পড়ে জেনেছি,বড়দের মুখে শুনেছি সে সময়ের পরিবেশ পরিস্থিতির কথা। তখন স্বাভাবিক ভাবে বেচেঁ থাকাটা ছিল খুব রিস্কি। আর যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা তাদের পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানি আর রাজাকারদের চোখে কেমন ছিলেন তা সে সময় যারা বড় ছিলেন তারাই বলতে পারবেন।আমি তার সাথে কথা বলছি আর তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছি।সে আমাকে বলেন,আমার কোন জমি জমা নেই বড় কোন ছেলেমেয়ে নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু একটা ঘর তোলার জায়গা।আমার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ায় আমার দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়েছে সে ঘরে ছোট ছোট দুটি মেয়ে । ওদের লেখা পড়া চালানো আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর আমি ওদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারলাম না । আমি লক্ষ্য করে দেখলাম তিান যে জাম কাপড় পড়ে আসছে সে কষ্টে দিন যাপন করছে।তার মনের যত আকুতি মিনুতি আমাকে বলতে লাগলেন।আমি বুঝতে পারলাম তার মনের কথাগুলো হয়তো কেউ শুনেনি আজ পযর্ন্ত । তিনি আমার পরিচয় জানতে চান। আমি বলি আমি একটি পত্রিকায় নিউজ করি তিনি পত্রিকার কথা শুনে তার কথাগুলো লেখে পত্রিকায় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।আমি মনে মনে ভাবি আমি সামান্য একজন একটি জেলার পত্রিকায় নিউজ করি আমার লেখা দ্বারা তার কোন উপকার হবে না ? আজ এখানে আপনার কথাগুলো শোনা সম্ভব না কারণ সাউন্ড বক্সের শব্দ তাছাড়া আজকের নিউজ কভারেজ করতে হবে। তাই তাকে বলি আপনার মোবাইল নাম্বার দেন আমি আপনার সাথে দেখা করব। তিনি আমাকে তার নাম্বার দিলেন।
আমি আমার কাজে চাপে ভুলে যাই তার কথা। এর মধ্যে সে আমাকে ২ দিন মোবাইল করে ছিলেন। আমি তার ফোন পেয়ে আশ্বাস দেই আমি আসব তবে যে কোন শুক্র বার। তিনি খুশি হলেন এবং বলেন, আমি যেন তার বাড়িতে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করি। আমি বলি,না ভাই সেরকম ঝামেলা করবেন না কারন আমি আসলে সকাল সকাল আসব। আমি কিন্তু কাজের চাপে যেতে পারিনি তাকে কথা দেওয়ার পরও। এর মধ্যে এক সন্ধ্যায় তার কথা মনে পড়ে।লোকটিকে কথা দিলাম এখনো যাওয়া হলো না।দেখি আগামি সপ্তাহে যাওয়া যায় কিনা? তাই তাকে মোবাইল করলাম। তখন রাত আটটা সাড়ে আটটা হবে। একবার দুইবার রিং বাজছে কেউ রিসিভ করে না। ভাবলাম আরেক বার দিয়ে দেখি এবার ধরলেন একজন মহিলার কন্ঠ।
সে বলেন,কে?
আমার পরিচয় দিলাম এবং বললাম আমি দেলোয়ার সাহেবের সাথে কথা বলতে চাই।
আমি জানতে চাই আপনি তার কি হন ?
তিনি বললেন, আমি তার গৃহিনী।
আমি বললাম সে বাড়ি নেই?
মহিলা যেন একটু ধাক্কা খেলেন মনে হয় এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। মহিলাটি বললেন, সে মারা গেছেন ৩ মাস হলো।
আমি থমকে যাই,বলেন কী ?
মহিলা বলেন,হ্যাঁ
আমি বলি, তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল কিছু দিন আগে। তার একটি সাক্ষাত নেওয়ার কথাছিল ।
মহিলা বলেন,হ্যাঁ সে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কত লোকের কাছে গেছেন। কেউ এগিয়ে আসেননি। সে মনের মধ্যে একটি বড় কষ্ট নিয়ে মারা গেলেন। তিনি বলতেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি কিন্তু কী পেলাম ? আমি তার কথার কোন উত্তর দিতে পারিনি। বড় অপরাধীর মত লাগছে নিজেকে। আমি মনে মনে বলি ক্ষমা কর হে যোদ্ধা, ক্ষমা কর মোরে।
পদাবলি
হরিয়াল
রওশান ঋমু
কৈশোরের কুসুম গোধূলিবেলায়
ক্লান্ত ধূলিকণা খোঁজে,
আকাশে মধুর তৃষ্ণায়
ইশারায় ডাকে নির্ঘুম মাছ;
রুপালি চোখ শিশিরের ছায়ার
আশ্চর্য সঙ্গী !
কপালের মাঝখানে করুণার কুমকুম চিহ্ন
বিষন্ন ঠোঁটে থরোথরো মুগ্ধ বর্ষা,
আমলকী ফুলের গন্ধে,
নিঃশেষে পোড়ে চুলের কুয়াশা।
কর্নফুলী ভাসিয়ে রাখে ময়ূরপঙ্খী,
দুই কূলে
সারাদিন, সারারাত দিগন্তে-
পুতুলের ডুব সাঁতার,
শিথানে সন্ধ্যামনি-
পৈথানে অন্ধ রজনীর নিষিদ্ধ হরিয়াল।
নীল কপাট
সা’দ সাইফ
আমি নাহয় একটু ব্যথাই পেলাম
তাতে কী; ওটা তো ভালবাসা।
এই যে তুমি আমাকে দিচ্ছ, রাশি রাশি
অথবা অলিন্দে গাঁথা সুখ।
এ ঠিক আঁকাবাঁকা শর।
আমি না হয় একটু দূরে’ই গেলাম।
এ ঠিক দূর নয়; ইস্পাতের রিং।
দূর নাকি পথের পানে বুক কাঁপা সুর!
আমি মূর্ছা যায়।
ওই সাদা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে।
ওটা তো চোখ ধাঁধানো নিয়ন বাতি!
আমি আর জাগিনা
ডাকিনা আপন মহিমায়।
প্রহর কেটে যায় প্রহর নিয়তে।
কীবোর্ডে হাতড়িয়ে চার ইঞ্চির দিকে আর তাকাই না।
এ হাত বাঁধা;
আমি না হয় চলেই যাব নীল কপাটে ধাক্কা খেয়ে।
যে খেদ জমেছে
জারিফ এ আলম
অগোছালো আর ইশারার ঈর্ষাকাতর উৎসবে
ঊষর ঋণের এই ঐকান্তিক ওড়াউড়িতে;
ঔপনিবেশিক কষ্টের খেরোখাতায় গতানুগতিক
ঘুরছে চালক। ছড়ানো জন্মের ঝিনুকে
টাঙানো ঠুনকো ডামাডোল।
ঢাকনার তলদেশে থুতনিতে দরদাম ধরপাকড়;
নিবিড় পদাবলিতে ফাগুনের বৈভব।
ভারহীন মন্বন্তরে যুক্তির রিপুতে লালনগীতি;
শব্দের শাসনে সাপুড়ের সরল স্বীকারোক্তি।
যেসব সকাল আক্ষেপভারি
নিঃশব্দ আহামদ
কপাট খোলার কড়া নেড়ে নেড়ে আড়ষ্ট আমি বসে থাকি, তালাবদ্ধ সব ঘরে রেখে গেছে ঘুম-আমি শুধু আওড়ায়, আয় ঘুম, গভীর কোনো ঘুম-সাগ্রহে কোনো ঘরে খুলে গেলে কপাট, আঁকড়ে থাকি চৌকাঠ-
মানুষের চোখে অপেক্ষা খুঁজে, কেঁদেছি, অনেক অনেক কান্নার ভেতর মনে হতো যেনো মরে যাচ্ছি, তবু এতোটুকু অপেক্ষা, আমাকে ছুঁয়ে গেলে- সব ঘরে আলোর উল্লাস দ্যাখি, যেনো নেভানো হয়নি কোনো বাতি এতোটারাত,
বেঁচে আছি রোজদিন, এতোটা অপেক্ষার ভেতর।
ঠিক যদি কোনো সন্ধ্যায়, পেয়ে বসে ভয়- আমি আর নানাবিধ ভাবনার ভেতর কাঁদছিনা, না কোনো ঘর ফেরা-আকস্মিক ঝড় কবলের মতো বুকের ভেতর গোঙানি রেখে লুটে যাচ্ছে দেহ, অতলে- নিমজ্জিত অন্ধকারে আমার অনন্ত ফ্যাকাশে চোখ।
আর কোনো অপেক্ষা নেই, দীর্ঘ ঘুমের ভেতর খবরদারি রেখে স্থির এইসব রাত-সকালের কোনো মাঠে হাঁটবেনা আর নিঃশব্দের কোনো ত্রস্ত পা।
ধারাবাহিক উপন্যাস : পর্ব ০১
জোছনা রাতে জাগে আমার প্রাণ
আবুল কালাম আজাদ
১.
অন্তর গল্প লিখতে বসেছিল।
গল্পের বিষয় বস্তু আগে থেকেই মোটামুটি ঠিক করা ছিল। সায়েন্স ফিকশন গল্প। ভিন গ্রহের একটা প্রাণীর সাক্ষাত পাওয়া যায়। সৌর জগতের ৫৮১ নামের তারা ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে একটা গ্রহ। এই গ্রহটি বিভিন্ন নক্ষত্র জগতের তুলনায় পৃথিবী থেকে যথেষ্ট কাছেই অবস্থান করছে। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২০ আলোক বর্ষ। এক আলোক বর্ষ সমান প্রায় ৯ লাখ ৪৬ হাজার কোটি কিলোমিটার। অর্থাৎ, আমরা যদি পৃথিবী থেকে এমন একটা নভোযানে চড়ি, যার গতিবেগ আলোর গতির দশ ভাগের এক ভাগ, তবে সেই গ্রহে পৌছুতে প্রায় ২০০ বছর লেগে যাবে।
সেই গ্রহের একজন অধিবাসী এই পৃথিবীতে এসে পড়েছে। সে যে স্বেচ্ছায় এসেছে তা নয়। তাদের গ্রহের একজন খারাপ মানুষ শত্রুতা করে তাকে পৃথিবীতে ফেলে রেখে গেছে। সেই ভিন গ্রহের অধিবাসীকে নিয়েই তৈরী হবে অন্তরের গল্প।
শেষ পর্যন্ত অন্তর ভিন গ্রহের প্রাণীটিকে ঘিরে কোনো নাটকীয়তা তৈরী করতে পারবে কি না, গল্পটা শেষ পর্যন্ত গল্প হয়ে উঠবে কি না এ ব্যাপারে ওর মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সব সন্দেহ মনের মধ্যে রেখেই ও কাগজ-কলম নিয়ে বসেছে।
অন্তর যে লেখালেখি করে বা ওর ভেতর লেখক হওয়ার স্বপ্ন আছে তা নয়। ও গল্প লিখতে বসেছে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে।
ওর স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট বের হবে সপ্তাহ খানেক পরে। এই সপ্তাহ খানেক সময় ওর অবসর। তারপর তো নতুন ক্লাশ, নতুন বই। বাবা-মা চাইবে সবকিছু দূরে ঠেলে রেখে, ও শুধু বইয়ের পড়াগুলো হাপুস-হুপুস গিলুক। বইয়ের পড়া হাপুস-হুপুস করে গেলা ছাড়াও যে জ্ঞান অর্জনের আরও পথ আছে সেটা কেউ বুঝতে চায় না।
অন্তরের ইচ্ছে ছিল এই অবসর সময়টায় কোথাও বেড়াতে যাবে। ঘরে বসে থাকলেই মাথায় আসে দুঃশ্চিন্তা। রেজাল্ট কেমন হবে, কততম প্লেস থাকবে-এরকম প্রশ্ন ভেসে উঠে মনে। এই অবসর সময়টায় মাথায় লেখাপড়া বিষয়ক কোনো চিন্তা আসুক ও তা চায় না।
বেড়াতে যেতে হলে বাবাই একমাত্র অবলম্বন। অন্তর বাবাকে বলল, বাবা, চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি।
কী!
বাবা এমনভাবে ‘কী’ বলল যেন অন্তর কানো বোমা বিস্ফোরন ঘটিয়েছে। অন্তর বলল, ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। স্কুল বন্ধ। এই অবসর সময়টা.......।
বাবা হাতের বইটা পাশে রেখে সোজা হয়ে বসল। বলল, তোর স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষা আছে। ফাইনাল পরীক্ষার পর স্কুল বন্ধ হওয়ার রেওয়াজ আছে। আমার অফিসে এসব কিছু নেই। সাতশ’ ত্রিশ দিন পর রিক্রেশান লিভ পাব তখন আসিস, যাব কোথাও।
সাতশ’ ত্রিশ দিন! অন্তর মনে মনে হিসাব কষে দেখল সাতশ’ ত্রিশ দিনে হয় দুই বছর। দুই বছর পর বাবা রিক্রেশান লিভ পাবে, তখন বেড়াতে যাবে। ততদিনে ও আরও দু’টি ক্লাশ টপকে যাবে, শরীরে মাপও বাড়বে।
অন্তর বলল, তাহলে আমি এই অবসরে কী করবো?
নাই কাজ, কই ভাজ। যা খই ভাজগে।
খই ভাজা অন্তরের পক্ষে সম্ভব নয়। তার চেয়ে গল্প লেখাই ভাল।
অন্তর পড়–য়া ছেলে। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি সে গল্প-উপন্যাস পড়ে খুব। বাংলা সাহিত্যে যারা শিশুতোষ লেখা লিখেছেন বা লেখেন তাঁদের প্রায় সবার লেখাই সে কম-বেশি পড়েছে। হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল ভ্রাতৃদ্বয়ের অনেক বই ওর পড়া। তাঁদের সায়েন্স ফিকশানও পড়েছে বেশ। যা হোক, সে মনে মনে এরকম আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে যে, অন্তত একটা গল্প সে লিখতে পারবে।
গল্পের প্রথম লাইন অন্তরের মাথায় এসে গেছে। প্রথম লাইনটা হিট হয়ে গেলে নাকি পুরো গল্পটাই হিট হয়ে যায়। বড় একজন লেখকের ইন্টারভিউতে কথাটা পেয়েছিল সে।
লেখক বলেছিলেন, তাঁর যদি মনে হয় প্রথম লাইনটা মনের মত হয়নি, তাহলে তাঁর গল্প আর এগোয় না। সেই লাইনটাই মনের মধ্যে খোঁচাতে থাকে-তোমার প্রথম লাইনই তো যুতসই হয়নি, গল্প ভাল হবে কেমন করে?
অন্তরের প্রথম লাইনটা হল-একদিন চন্দ্রার বনে।
একদিন চন্দ্রার বনে কী? এরপর কী লিখবে তা সে জানে না। নিজে কোনোদিন চন্দ্রার বনে যায়ওনি। তারপরও সে এমন একটা লাইন দিয়ে গল্প শুরু করল কেন?
তবে লাইনটা লিখে সে মোটামুটিটি তৃপ্ত। এরপর যাই লিখুক গল্প এগিয়ে যাবে ভালভাবেই। আর ভিন গ্রহের প্রাণী নিয়ে গল্প লিখতে গেলে বন-বাদার দিয়ে শুরু করাই ভাল।
দ্বিতীয় লাইন লেখার আগেই দরজায় খটখট। খটখট বেশ জোরে।
গল্প লেখার সময় দরজায় খটখট অবশ্যই বিরক্তিকর ব্যাপার। বাসায় সবাইকে বলে নেয়া উচিত ছিল, আমি এখন গল্প লিখতে বসব, কেউ অন্তত ঘন্টা দু’য়েক দরজায় খটখট করবে না।
তবে তা বললে বোধহয় ব্যাপারটা আরও ঘোলাটে হয়ে যেত। মা বলত, ওমা! আমার বাপধন দেখি লেখক হয়ে যাচ্ছে। লেখক হুমায়ুন আহমেদ।
তারপর তার কৌতুহল আরও বেড়ে যেত। গল্পটার বিষয় কী, ছোট গল্প না বড় গল্প এরকম নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলত।
মা’র চেয়েও বেশি ঝামেলা করত মাজেদা। মাজেদা ওদের বাসার কাজের সহায়ক মেয়ে। কিন্তু বাবা ওকে বলে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। ও না থাকলে নাকি এই বাসা চলত না। বাবা-মা’র কাছে মাজেদা গুরুত্বও পায় খুব।
মাজেদার একটা বদ অভ্যাস হল, তাকে যা করতে নিষেধ করা হবে সে তা হাজার বার করবে। সে এসে বলত, ভাইজান, পাওটা উঠায়ে বসেন, ঝাট দিব।
ঝাট দিয়ে চলে যাবার পাঁচ মিনিট পর এসে বলত, ভাইজান, টিস্যু পেপার হবে? নাক দিয়া খুব সিনাত ঝরতেছে।
টিস্যু পেপার নিয়ে যাবার পাঁচ মিনিট পর এসে বলত, ভাইজান, গল্প লেখা বাদ দেন। নাটক লেখেন। টিভিতে কী সব হাবিজাবি নাটক দেয়, প্রেম-টেম ঠিক জমে না।
আর বাবা কী বলত বা করত অন্তর তা ভাবতে পারে না।
তৃতীয় বারের মত খটখট। অন্তর উঠে গিয়ে দরজা খুলল। তাকে পাশে ঠেলে দিয়ে বাবা ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকে খাটের ওপর দুই পা তুলে বসে পড়ল। বললেন, কী করছিস?
গল্প লিখছি-এরকম একটা উত্তর দেয়া ঠিক হবে কিনা অন্তর তা বুঝতে পারল না। তাই সে সত্যটা চেপে গিয়ে বলল, কিছু না বাবা।
কিছু না? কিছু একটা তো অবশ্যই করছিলি।
তারপর বাবা তাকাল টেবিলে। সেখানে খাতা-কলম খোলা। চশমা নামানো। বাবা খাতাটা টেনে নিয়ে পড়ল, একদিন চন্দ্রার বনে।
তারপর বাবা চোখ বড় ও গোল করে তাকাল অন্তরের মুখে। বললেন, একদিন চন্দ্রার বনে কী? সেখানে কি ফ্লাইং সসার নেমেছিল? ভিন গ্রহের কোনো প্রাণী এসেছিল?
বাবার কথায় অন্তর খুশি হল। কারণ, সে গল্পের প্রথম প্লট পেয়ে গেছে। সে চন্দ্রার বনে ভিন গ্রহের প্রাণীকে নামাবে। অন্তর বলল, গল্প লিখছি বাবা।
গল্প লিখছি! গল্প লিখছি মানে কী?
গল্প লিখছি মানে গল্প লিখছি।
তোর কি লেখক হবার পরিকল্পনা আছে? জানিনি তো কখনো।
না, সেরকম কোনো পরিকল্পনা নেই।
তাহলে?
খই ভাজতে পারি না বলে একটা গল্প লিখতে বসলাম।
এরকম টাইম পাসের উদ্দেশ্যে গল্প লিখতে গিয়ে শেষে দেখবি ফেঁসে গেছিস।
ফেঁসে গেছিস মানে?
পৃথিবীতে অনেক বিখ্যাত লেখক আছেন, যাদের এইম ইন লাইফ ছিল অন্য রকম। কোনো কারণে কিছু লিখতে গিয়ে শেষে লেখক হয়ে গেছেন। লেখক হয়ে গেলে কিন্তু জীবন ত্যাজপাতা হয়ে যাবে। যে যত বড় লেখক তার জীবন তত বড় ত্যাজপাতা।
কেন, ত্যাজপাতা হবে কেন?
রাস্তা-ঘাটে বের হতে পারবি? পেছনে লেগে থাকবে সাংবাদিকের দল। তার সাথে থাকবে ভক্তবৃন্দ। আরও থাকবে প্রকাশকের দল। ইন্টারভিউ দাও, ছবি দাও, অটোগ্রাফ দাও, পান্ডুলিপি দাও। শুধু দাও আর দাও। ঠিক মত খেতে পারবি না, ঘুমাতে পারবি না, বাথরুমটাও সারতে পারবি না। তুই ভাত বাম হাত দিয়ে মুখে তুলিস, না ডান হাত দিয়ে মুখে তুলিস, পানি গিলে খাস, না চিবিয়ে খাস, বাসায় লুঙ্গি পড়িস, না পাজামা পড়িস সব বিষয়েই থাকবে তাদের সীমাহীন কৌতুহল। অটোগ্রাফ শিকারির কথা আর কী বলবো। একবার ঘেরাও করে ধরলে......। তুইও ফাঁসবি, আমাকেও ফাঁসাবি।
তুমি আবার ফাঁসবে কেন?
খুব বড় লেখক হয়ে গেলে সাংবাদিকরা কি আমাকে ছেড়ে কথা বলবে? বিখ্যাত লেখকের বাপ। ধর, আমি বাজার থেকে ফিরছি। ধরে বসল সাংবাদিক, আপনার ছেলের এতবড় লেখক হয়ে ওঠার পেছনে কোন জিনিসটা বেশি কাজ করেছে দয়াকরে বলবেন কি? আমিও বলতে শুরু করে দেব, বাড়িতে প্রথম থেকেই লেখালেখির আবহ ছিল। এটা আমাদের বংশগত। নজরুল, রবীন্দ্র, মানিক, বিভূতিভূষন সবাই তো আমাদের বাড়িতে ছিলই...
[ক্রমশ]
পলান সরকার নিবেদিত পদাবলি
আলোর ফেরিওয়ালা
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
বই হাতে নিয়ে মাইল পেরিয়ে মাইল
আলো হয়ে যায় যাবতীয় পথরেখা
যে ঘরে গেছে তারাই হয়েছে মানুষের
হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে প্রতিকূলে
রোজ রোজ দেখা নতুন নতুন পৃথিবী
প্রতি পৃথিবীতে অভাব অভাব হাওয়া
তবু দেখি ছেলে পড়াতে পড়াতে মাতাল
মন্ত্র দিয়েছে আলোর ফেরিওয়ালা ।
প্রান্তরের আলোকবর্তিকা
এইচ এম সিরাজ
একজন মানুষ
বয়সের ভারে ন্যূব্জ হয়ে গিয়েছেন প্রায়
দাঁত পড়ে গেছে তার, চুল পেকে গেছে বয়সের ভাটায়
চামড়ায় পড়ে গেছে হাজার রকমের ভাঁজ!
একজন মানুষ
কী বিদঘুটে তার চেহারা, কৃষ্ণ গায়ের রং!
পরনে লুঙ্গি, পায়ে ছেঁড়া পাদুকা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ
একবার তাকালে সৌন্দর্য পিয়াসী কারও
তার দিকে আরেকবার তাকানোর রুচি জাগে না
অথচ তিনি আমাদের দিকে হাজারবার তাকিয়েছেন
লক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তাকিয়েছেন
আমাদের নিয়ে ভেবেছেন, সমাজের আঁধার নিয়ে ভেবেছেন
আর হাতে হাতে নিঃস্বার্থে তুলে দিয়েছেন প্রদীপ সম বই
এভাবেই ফেরি করে চলে গেছে তার জীবনের দিনগুলো
একজন মানুষ
আঁধার কালো হয়েও প্রান্তরে প্রান্তরে ধূলিমাখা পথে
দেহের কষ্ট উপেক্ষা করে হাসিমুখে বিলিয়েছেন আলো
তার বিলানো আলোয় আঁধার সরে গেছে আমাদের
সমাজের গহীন ভেতরে পড়েছে নিখাদ আলোক-রশ্মি
একজন মানুষ
যার জন্য পথের ধুলো সাক্ষী হয়ে থাকে
সাক্ষী হয়ে থাকে কাল-মহাকাল, সূর্যের আলো
যার অবিস্মরণীয় অবদানে ভরে গেছে আমাদের চারপাশ
তিনি সবার হৃদয়ের মানুষ, চেতনার মানুষ
প্রান্তরের আলোকবর্তিকা পলান সরকার
আলোর ফেরিওয়ালা
ইব্রাহীম রাসেল
এমন মানুষ সত্যিই বড়ো দরকার
যেমন ছিলেন পলান সরকার
হাতে করে কাঁধে করে বাড়ি-বাড়ি
পায়ে হেঁটে গাঁয়ের পর গাঁ ছাড়ি
পৌঁছে দিয়েছেন জ্ঞানের আলো
বইয়ের পসরা যতো আছে ভালো।
শত শত বই কিনে নিজের টাকায়
অসীম স্বপ্ন বুকে সে হেঁটে যায়
গাঁয়ের পিছিয়ে পড়া মানুষ আছে যতো
তাদের জন্য বুকে তার ব্যথার ক্ষত
মানুষের মতো মানুষ হবে তারা
সেই আশে বুকে তার স্বপ্নধারা।
ত্রিশ বছর ধরে এই মানুষের তরে
বই নিয়ে গিয়েছেন সকলের ঘরে
দেহ ত্যাগ করেও অমর এক বইওয়ালা
যুগে যুগে দৃষ্টান্ত আলোর ফেরিওয়ালা।
আলোর ফেরিওয়ালা
খায়রুল আলম রাজু
পৃথিবীতে কিছু নিয়ম আছে, আছে অনিয়মও!
সেই নিয়মে সবাই এই ধরায় আসে।
তবে চলে যাওয়াটা হয় নিয়মহীন!
তখন ছোট-বড়, কিংবা বয়সের হিসাব হয়না।
পৃথিবীতে থাকাকালীন আলোর মশাল হাতে;
কেউ ছড়িয়ে দেন আলোর বাতি।
আমরা থাকে বলি ‘আলোর ফেরিওয়ালা’...
তুমিও এক ‘আলোর ফেরিওয়ালা’...
এই বই বিমুখ পৃথিবীতে।
‘পলান সরকার’ শুধু একটি নাম নয়;
এ যেনো একটি সুদীর্ঘ উপন্যাস!
তোমার জ্বলে রাখা এই আলোর বাতি,
নিভবে না কভুও, নিভতে দিবোও না আমরা...
ফাগুনগাছ অথবা আগুনফুল
ফাগুনগাছ অথবা আগুনফুল
সাদিক আল আমিন
আজকের দিনে রোদ ঝলমলে হয়ে উঠেছে পুরো জগত। স্নিগ্ধ বাতাসের মৃদু দোলায় শিমুলের ফুল কি মোক্তারের বহু বছর ধরে না ধোয়া চুলের বিন্যাস নড়ে উঠছে খুব কমই। অপরাধহীন মাজার শরীফের সামনের অবস্থানরত বেলগাছটা লাল সুতোর শত শত বাঁধনে নিজের আড়ষ্টভাব ফুটিয়ে তুলছে। মোক্তারের আজ শুক্রবার হওয়ায় খুব খুশির দিন। প্রতিনিয়ত যেমন কয়েকঘণ্টার নিরলস ফ্যাকাসে দৃষ্টি নিয়ে ধর্মভীরুদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মাত্র দুয়েক টাকার মতো জমা হয় তার পুরনো পিতলের প্লেটে, আজ শুক্রবার হওয়ায় তাদের তুলনামূলক বেশি আগমনের ফলে মোক্তারের প্লেটে খুচরো টাকার পুঁজি বাড়তে থাকে। এরি ফাঁকে একটা বিড়ি কিনে এনে খাবে কিনা চিন্তা করতেই প্রায় বড়লোক বলা চলে এমন এক মধ্যবয়সী মহিলা তার ভ্যানিটি থেকে একশ টাকার একটা চকচকে নোট বের করে দেয় পিতলের প্লেটে। মোক্তার ধ্যানাভাবে চোখ বুজে থাকলেও টাকার গন্ধে চোখ কিঞ্চিৎ অসাড় হলে সে এই দৃশ্য দেখে। দরগাশরীফের বড় পীরদের অনুমতিক্রমে এখানে নিয়তই বসা মোক্তারের মনে প্রশ্ন এবং চিন্তার ধোঁয়া নেশার মতো বাড়তে থাকে। খুব বেশি হলেও চল্লিশের বেশি বয়স তার হবেনা ঠাওর করে মোক্তার ভালোভাবে তার পিঁচুটি ভরা চোখ ধীরে ধীরে খুলে তাকাতে চেষ্টা করে। তবে স্বাভাবিক মানুষের মতো দেখার প্রথমেই কোনো অভিপ্রায়ে লিপ্ত হয়না মোক্তার। যেন বহু বছর অন্ধকারে থেকে হঠাৎ আলোতে এলে যেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায় পুরো চেতনা, তেমনি দীপ্তমান ঔজ্জ্বল্যে নিজের নির্লিপ্ত চোখদুটো মেলে সে একই আবেগ অনুভব করে। ভদ্রমহিলার পুরো শরীর শাড়িতে ঢাকা। বাম চোখের নিচের কাটা দাগ নজর কাড়ে মোক্তারের। যেন কেউ ইচ্ছে করেই ছুড়ি চালিয়ে এমন দাগ করেছে, ধারণা করে সে। তবে সেই দাগকেও ছাপিয়ে ফুটে ওঠা বর্ণনাতীত সুন্দর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের অতিশয় পরিচিত কৈশোর আর যৌবনের কথা মনে পড়ে যায় মোক্তারের। হঠাৎ যেন ঝটকা খায় নিজেই- না, ওসব কথা সে ভাবতে চায়না আর। অনিচ্ছা স্বত্বেও ভাবার চেষ্টা করতেই বহু বছরের ব্যবহারহীন মগজে স্মৃতি হাতরানোর যন্ত্রণা চেপে বসে। একবার চিনচিন করে উঠেই সব চকচকে আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। সেই আয়নাই আবার ভাঙতে উদ্ধত হয় নিজের ওপর হওয়া প্রচন্ড আক্ষেপে।
খুব বেশি মেধার অধিকারী না হলেও পড়াশোনা শেষে করে খাওয়ার মতো একটা যোগ্যতা রাখার যোগ্য সে ছিলো ঠিকই, তবে এখন যেমন মাগনা কিছু টাকা আর দরগা থেকে রোজ দুবেলা খাওয়া পায়, এটাকেও মন্দ মনে হয়না তার। ভার্সিটির গন্ডি পর্যন্ত উঠতে পেরেছিল বলে সেই সম্বন্ধীয় সব আবেগ-অনুভূতি তার জানা। আজও দরগায় কোনো ছাত্র মানুষকে দেখলে তাদের মুফতে দোয়া করে দিয়ে এক ধরণের প্রশান্তি’ই অনুভব করে সে। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে মা-মরা তরুণটির একমাত্র অবলম্বন রিক্সাচালক বাবাও যখন মায়ের পাশের কবরটিতে নিজের জায়গা করে নিলেন, তখন মোক্তারের টনক নড়লো। পরিজন বলতে কেউ কেউ থাকলেও একমাসের বেশি কেউ আর সাহায্য করতে চাইলো না। অথচ এমনটা হওয়াই যে স্বাভাবিক তা তখন নিরীহ অনুভূতিতে উপলুব্ধ হয়নি। বন্ধু-বান্ধবরা একথা জানলে তারা মনের বিপরীতে একান্তই কর্তব্য সহানুভূতি দেখালে মোক্তার কিছুটা আশা ফিরে পেলো। কিন্তু হঠাৎই নিষ্প্রভ বাতির মতো তা কখন যে মিলিয়ে গেলো সে টের’ই পেলোনা। এক বান্ধবী অবশ্য তাকে সাহায্য করতে চাইলেও ভীষণ রহস্যময় নারীর মনের ব্যাপারে উদাসীন মোক্তার নিজের হিম্মতকে শূন্য আবিষ্কার করলো।
ভীষণ বিষণœতায় কাটা আরো ছটা মাসে সিগারেটের নেশা পেয়ে বসলেও সেই বস্তু কতোটা বিষণœতা কমাতে পেরেছে তা আজকের দমে যাওয়া শুকনো চেহারার দিকে তাকালে টের পাওয়া যায়। অবশ্য উপায়ান্তর না দেখে বাবার পেশাটাকে ধরতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত আর কুলিয়ে উঠতে পারলোনা। পড়াশোনাটা ছেড়ে দিতে হলো তখনি। এমনকি একবেলা খাওয়া পর্যন্ত দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। না পারলো খেতে, না পারলো পড়তে। প্রায় জীবন্মৃত অবস্থায় একদিন যখন মানতে এলো মাজারে, বাইরে বসা রঙিন পোশাকধারী সাধু যেন পলকেই তার দুর্দশা চোখের অভিজ্ঞতায় বুঝে নিলো। এরকম আত্মমর্যাদাহীন ভিক্ষার কাজ মোক্তারের দ্বারা সম্ভব নয়, একথা আকারে ইঙ্গিতে সাধুবাবাকে বোঝাতে চাইলে তিনি আর কিছু বললেন না। উপায়ান্তর না দেখে এটাকেই পেশা করে হাত-পা বেঁধে রাখা বেলগাছটাকে নিত্যদিনের সঙ্গী করে এখানে বসবাস শুরু করে দিলো। বসবাস বলা ঠিক ভুল হবে। কারণ বহুদিন তার গোসল হয়না। দাড়ি-গোঁফ সেই ভার্সিটি লাইফেই শেষ কেটেছিল। সবাই তাকে ‘পাগল’ আখ্যা দিলেও আদতে যে সে পাগল নয় তা কেবলমাত্র তার ঘুণেধরা মস্তিষ্ক’ই জানে। এখানে মাজার শরীফের সামনে অলস হয়ে বসে থেকে দুটো পয়সা কামাই করে যদি বিড়ির টাকাটা অন্তত জুটে, কোনো আপত্তি নেই তার। শুধু কেউ চিনে ফেলে এই ভয়ে দিন গোজরান হয় মোক্তারের। আত্মমর্যাদা বহু উঁচুতে নিয়ে গিয়ে ধপ করে ফেলে দিয়েছে তাকে। কবিতা লেখার সুনাম ছিলো ফাস্ট ইয়ারে। পত্রিকায় ছাপতো দেখে বন্ধুমহলে কিছুটা ব্যতিক্রম এবং অন্যদের থেকে একটু হলেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সাবিত করতে পেরেছিল নিজেকে। এখন যেন সবকিছু ঘন ধোঁয়ার মতো মনে হতে থাকে তার। ধোঁয়া সরে গেলেই সবকিছু আবার শূন্য।
মাঝবয়সী যেই মেয়েটা একশ টাকার একটা চকচকে নোট তার থালার দিকে বাড়িয়ে দিলো এই আশায় যে তাকে একটু দোয়া করে দেবে, সে আর কেউনা ফারজানা ছাড়া। পনেরো বছর আগে বাবা মারা যাবার পর যেই বান্ধবীটি নিঃস্বার্থভাবে তাকে আর্থিক সহযোগিতা করতে চেয়েছিল সেই ফারজানা। এখন তার শরীরে জননীর ছাপ স্পষ্ট এবং সেটা প্রমাণ করতেই পরিপাটি হয়ে সাজা দশ বছরের একটা ছেলে ভীতু ভঙ্গিতে এসে মায়ের পেছনে দাঁড়ায়। বড় বড় দাড়ি-গোঁফ-চুল দেখে শিশুমনে ভয়ের সঞ্চার হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় তবে মোক্তারের দিকে তাকিয়ে আর কোনো পাগলের থেকে তার কোনো ব্যতিক্রম আছে কিনা ছেলেটি তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে খুঁজতে থাকে। নিশ্চয়ই হয়তো পরদিন স্কুলে গিয়ে মোক্তার সম্পর্কে অল্প-বিস্তর বর্ণনা তার সহপাঠীদের শোনাবে! ময়লা হাতে চোখের পিঁচুটি পরিষ্কার করে মোক্তার পিতলের থালায় রাখা চকচকে নোটের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ধর্মকর্ম একদম পছন্দ করেনা এমন উদ্দমপরায়ণ এক ব্যক্তি, নিশ্চিত বোঝা যায় সেটা ফারজানার স্বামী, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ফারজানার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলে লোকটা যে ভীষণ অত্যাচারী আর তার কঠিন নির্যাতনে ফারাজানার দিন গোজরান হয় এবং চোখের একটু নিচের যে কাটা দাগ, তা সেই নির্যাতনেরই প্রকাশ- স্পষ্ট করে দেয় পুরো ধারণা। নির্বোধ মগজে জোর দিয়ে মোক্তার এটা ঠাওর করতে পারে যে তাকে বিয়ে করলে হয়তো ফারজানা এমন দুঃখী হতোনা। তবে তাকে কি গ্রহণ করতো ফারাজানা? কিংবা তার সর্বদা সেটেল্ড একটা ছেলে খোঁজা চিন্তিত পরিবার? কখনোই না। তবে এখন তার কাঁদো কাঁদো চেহারা দেখে বোঝা যায় খেয়ে না খেয়ে থাকলেও অন্তত সুখে থাকতো ফারজানা। দশ বছর বয়সী ছেলেটা বাবার কান্ডে কি করবে বুঝতে না পেরে মাথা নীচু করে বাইরের দিকে চলে যেতে লাগলো। চকচকে একশ টাকা যে তারই স্ত্রীর দেওয়া বোঝার পর লোকটা সেটা তুলে নিয়ে আরেকটা চড় বসিয়ে দিলো স্ত্রীর গালে। দ্বিতীয় চড়টার কারণ জানলেও প্রথম চড়টার কারণ জানতে পারলোনা ফারজানা। প্রতিবাদও করলোনা এতোটুকু। ভার্সিটিতে দেখে আসা নিশ্চুপ ভদ্র সেই মেয়েটির অবকাঠামোগত পরিবর্তন হলেও অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন একেবারেই হয়নি; মোক্তার সচক্ষে তার প্রমাণ পেলো। ফারজানার স্বামী তার হাত ধরে নিয়ে গেলে সুবোধ বালিকার মতো সেও তাতে সায় দিয়ে চলে গেলো। এমনকি কিছুক্ষণ আগে মোক্তারের কাছে খুব কম কথা বলা শান্ত ঠোঁট দ্বারা ব্যক্ত প্রার্থনাগুলো পরিপূর্ণ হবে কিনা তা জানারও আগ্রহ প্রকাশ করলোনা একবার অন্তত পেছনে ঘুরে। পরিপূর্ণ হবে কিনা মোক্তারও জানেনা। সে চেয়েছে তার স্বামীর মৃত্যু। কারো মৃত্যু কামনা করে মোক্তার কোনোদিন দোয়া করেনি। তবে ফারজানার জন্য দুহাত তুলে খোদার কাছে দোয়া করলো। এতে খোদা তার ওপর নারাজ নিশ্চয়ই হবে, জানে মোক্তার।
দুপুরবেলা একথালি ডালভাত আর রাতে গমের বাসি রুটিতে দিন কাবার মোক্তারের পেটও বেশিকিছুর চাহিদা করেনা। তবে মাঝে মধ্যে ভালো কিছু হলে আপত্তিও করেনা। কিন্তু কখনো কখনো ক্ষুধার চেয়েও নিজের লজ্জা আর আত্মমর্যাদা নিজেকে বেঁধে ফেলে শক্ত বেষ্টনীর মতো। মাজারে তারি সাথে ভার্সিটিতে পড়া বন্ধু যখন শিরনী দিতে এসে তার দিকে তাকিয়ে নিজের তীক্ষœ মস্তিষ্কে জোর দেয় চেনা চেনা লাগা গোঁফ-দাড়িঅলা লোকটা তার সহপাঠী মোক্তার কিনা, তখন নিজেকে ঢাকতে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে মোক্তার। খাওয়া এবং ভিক্ষা করার একই পিতলের থাকিতে মুখ নামিয়ে আনে নিজের। আত্মসম্মানবোধ দ্বীপশিখার মতো জ্বলতে থাকে তখন। বোকা বন্ধু তার তীক্ষœ মস্তিষ্কে জোর খাটিয়েও যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনা, তখন এক খাবলা খিচুড়ি মোক্তারের থালায় ঢেলে রোমন্থনের হাল ছেড়ে দেয়। সেই খাদ্য নিজের কাছে বিষাক্ত অনুদান মনে হতে থাকে মোক্তারের। পুরনো সহপাঠী চলে গেলে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে যায়। মাথাভাঙ্গা ডালপাতাহীন বেলগাছটায় হেলান দিয়ে নিজের পুরো শরীর এলিয়ে দেয়। বিড়ির কড়া ধোঁয়া তার ফুসফুস হয়ে মগজে পৌঁছায়। লাল-হলুদ রঙের বিভিন্ন সুতো বেলগাছটার সাথে তাকেও যেন বেঁধে ফেলতে চায়! আর নয় এই জীবন; সিদ্ধান্ত নেয় মোক্তার। অপরের মৃত্যুকামনা করার জন্য অথবা পরিচিতদের চোখের নিশানা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য কিংবা সবার করুণার প্রার্থী হয়ে রোজ দুবেলা খাওয়ার জন্য তার এ জীবন নয়। এর চাইতে বরং মরে যাওয়া ভালো। সর্বহারা হওয়ার পর যখন কোনো পেশাতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলোনা, যখন দরগায় বসে অপরের করুণার ওপর নির্ভরশীল ভিক্ষাকেই বেছে নিলো একমাত্র পেশা হিসেবে, তখন নিজের কাছে খুব প্রিয় মনে হলেও আজ মাত্রাধিক বিষাক্ত মনে হচ্ছে তার। আর যাই করুক, দরকার হয় মরে যাক, এখানে আর থাকবেনা। কঠিন সিদ্ধান্তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মোক্তার।
মোক্তার দ্রুপ পদক্ষেপে দরগা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর বের হয়ে যায় মহল্লা থেকে। তারপর পুরো গ্রাম থেকে। তারপর শহর থেকে। তারপর দেশ থেকে। তারপর বিশ্ব থেকে। ক্রমাগত হাঁটতেই থাকে মোক্তার। দিনের পর দিন যায়, রাতের পর রাত। মোক্তারের হাঁটা আর থামেনা। যেন পুরো বিশ্বজগত হেঁটে শেষ করে ফেলবে; শেষ করে ফেলবে পুরো ধরণী। পেটের ভেতর ক্ষুধার প্রজনন বাড়তে থাকলে পেটে বাড়ি মারে মোক্তার। ফারজানার দশ বছরের অবুঝ ছেলের মতো রাস্তাঘাটের ছেলেরাও তাদের পরিচিত পাগলটার সাথে মোক্তারকে মেলাতে থাকে। কিছু কিছু লোকও তার সহপাঠীর মতো মোক্তারের চেহারায় তাদের হারিয়ে যাওয়া আপন কাউকে খুঁজে পায় কিনা ভেবে খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখে। মোক্তার বিড়ির ধোঁয়ায় পুরো পৃথিবী কুয়াশা করে তোলে। তারপর সেই কুয়াশার ভেতরে হারিয়ে নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন আঁকে। আবোলতাবোল কি যে আঁকে কেউ বুঝতে পারেনা সে ছাড়া। ছেড়ে আসা দরগায় একলা পড়ে যাওয়া নাড়িয়া বেলগাছটা সুতোর শক্ত বাঁধনে নিজেকে আরো একা এবং বন্ধী ভাবতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে ঘর্ষিত পায়ের চামড়া ছিলে গেলে রক্ত বের হয়ে যায়। পায়ের মাংস বেরিয়ে এলে ধুলোর সাথে তা লুটোপুটি খায়। তিন-চারটে কুকুর সেটাকে সুস্বাদু মনে করে খাওয়ার ধান্দায় মোক্তারের পিছু পিছু ছুটতে থাকে। খিদার চোটে নাড়িভুড়ি বের হয়ে গেলে ধোঁয়াশা চোখে জন্মের সময় হারানো কোনোদিন না দেখা মায়ের মুখটা দেখতে পায় যেন। বাবার মরে কঙ্কাল হয়ে যাওয়া মুন্ডুটাতে পুরনো ত্যালত্যালা গামছাটা বাঁধা আছে কিনা তা খুঁজতে থাকে মোক্তার। এক সময় একটা ইটের সাথে হোঁচট খেয়ে পাথরে থুবড়ে পড়ে মাথা ফাটালে সব বয়সের মানুষ তাকে দেখতে এসে ভিড় জমায়। যেন সে কোনো সার্কাসের জোকার! কুকুরগুলো তার গলগলিয়ে বের হওয়া রক্ত চেটেচেটে খায়। অর্ধেক বের হয়ে যাওয়া মগজ নিয়ে একটা কুকুর আবার কাউকে ভাগ দেবে না ভেবে সেটা মুখে নিয়ে দৌঁড় দেয়। মোক্তারের পুরো শরীর যেন সেঁটিয়ে যাচ্ছে। কেউ যেন শক্ত বাঁধনে বাঁধছে তার শরীর! তার দোয়ার পর হয়তো ফারজানার স্বামী মারা যাবে। নতুন স্বামীর সাথে সে হয়তো সংসার করবে সুখের। তার সংসার জীবনটা যে ভালো চলবে আর শিরনী দেয়া সেই সহপাঠী আজ বাসায় গিয়ে তার কথা ভেবে ভেবে যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে, একথা জানে মোক্তার। শুধু জানেনা নিজের জীবনের করুণ সারমর্মটুকু। ফুলে ফুলে ভরে আসে তখন সকল গাছপালা। সূর্য ফেরার কথা ভেবে বিদায় নিতে চাইলে পাখির কাকলী কুহুদল ঘরে ফেরে। সন্ধ্যা নেমে আসে পুরো বসুন্ধরায়। কাছ থেকে ভেসে আসা আজানের তীব্র ধ্বনি ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসে মোক্তারের কানে।
শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নয়নপুর, সদর, দিনাজপুর
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)