পদাবলি : ০২
তুমিও বড্ড অবিশ্বাস করতে থাকো
রায়হান কিবরিয়া রাজু
বড্ড মৃত্যু মৃত্যু পায়...
কেমন যেন তেঁতো নিমপাতার মতো মনে হয় বেঁচে থাকা
কখনও বা মশকীর মতোই রক্তচোষা পিচাশ ভেবে ভীষণ কষ্ট হয় নিজের
আবার কখনও ভীষণ অন্যরকম মনে হয় এই বেঁচে থাকাটা
ঠিক যেন কাবাডি কাবাডি না বলে মৃত্যু মৃত্যু বলে দম ফেলা; কখনও জ্বলা নয়তো মারা পরা !
হ্যা, প্রিয়-
আজকাল প্রশ্বাসে প্রশ্বাসে পঁচা ফুসফুসের গন্ধ বেড়িয়ে আসে
প্রতিটি হৃদস্পন্দনই যেন মনে হয় মৃত আত্মার বোবাকান্না
চারপাশটাও যেন রূপকথায় শোনা ঐ মৃত্যুপুরী
অচেনা অজানা সব চেনা মুখ, সব প্রিয় কথা।
আজকাল প্রিয় রজনীগন্ধার গন্ধে ভেসে আসে মৃত্যুর প্রতিধ্বনি
বকুলের মালাটাকে ফাঁসির দঁড়ি মনে হয় আমার
মনে হয় সবকিছুই আমার সমাপ্তি রেখা
ভালবাসা, ভাললাগা, প্রেম, অপ্রেম, ঘেণœা সব কিছু
নিয়তির নিয়মেই পা রেখেছি প্রিয়,
আজ আর নিজেকে চিনতে পারি না একচুল
বড্ড অবিশ্বাস করি নিজেকে
তুমিও বড্ড অবিশ্বাস করতে থাকো-
ভীষণ অবিশ্বাস !
এই হেমন্তে তোমাকে চাই
মোজাম্মেল সুমন
তুমি যেনো ছোটগল্পের মতো করে
হঠাৎ এসেছিলে আমায় কাছে টানতে!
ডেকেছিলে ভালোবাসায় দরদ ভরে-
আমি তোমার হবো- এটা বোধয় জানতে!
তোমায় কাছে পাবার স্বপ্ন মনে রোয়া-
জানি নাকো হবে কিনা তোমায় পাওয়া!
ভালোবাসা ঐ কাশফুলের নরম ছোঁয়া-
বুঝে ওঠার আগে তোমার চলে যাওয়া!
আশায় আছি এই হেমন্তে তুমি আসবে-
আমনধানের পাশে আমার সাথে হাঁটবে,
আমার বধূ হবার রঙিন স্বপ্নে ভাসবে-
বলবে ‘ভালোবেসে সুখের জীবন কাটবে’ ।
তোমায় নিয়ে ঘর সাজাবো সবুজ গাঁয়ে-
ফসলঘ্রাণ ডাকবে সন্ধ্যার আলো শেষে,
রোজ সকালে শিশির ছোঁবো অবুঝ পায়ে—
রাত্রি নামলে জ্যোৎস্না দেখবো ভালোবেসে ।
তোমার সুখের ঘরকন্না আর মায়ার পরশ-
আমি কিষাণ নাগর তোমার গরম ভাতে,
মনের গভীর ভালোবাসায় রাখবো সরস-
আমায় আগলে রেখো তোমার নরম হাতে ।
তোমায় নিয়ে কবিতা নয় মরুমায়া-
যে রয়েছে মনে, মনেই তো তাকে পাই!
ভালোবাসার আদরসোহাগ তরুছায়া
ধানশালিকের এই হেমন্তে তোমাকে চাই ।
আমার প্রার্থনা শেষে
কাজী রুপাই
আমার প্রার্থনা শেষে- প্রকৃতির এমনি দুঃর্স্বপ্নে
একটি বিষন্ন পাখি মৃত্যু থেকে ফিরুক অরণ্যে
আধারের হ্নদপিন্ডে আলো জ্বেলে একটি বিদ্ধস্ত
জাহাজ আধার কেটে ছুটুক আলোর করোটিতে
পৃথিবীর খইরঙা হাঁসগুলি জীবনের পথে
সুগন্ধি নুপুর পড়ে সাতার কাটুক জলাশয়ে
আমার প্রার্থনা শেষে প্রান্তরের সবুজ ডানায়
অৎস্র রৌদ্রের রেনু মেলুক সোনালি ডালপালা
একটি পথশিশুর নির্জন কুটিরে ঘাসফুল
স্বপ্নের রুপালি তারা ফুটুক ঝিঝির ঐক্যতানে
আমার প্রার্থনা শেষে কাঁচভাঙা মৃত্তিকার বুকে
উড়াল মারুক সব শূন্যতার পোড়া গুল্মলতা
সমুদ্রের সাথে সব লেনদেন শেষে পৃথিবীর
মানুষেরা মহাশূন্যে উড়াক শব্দের পায়রা
ছেঁড়া ফুল
নবাব আব্দুর রহিম
সেদিন তার জানালায় মুখ বাড়িয়ে দেখলাম
মেয়েটা আপন হাতে লাগানো ফুলবনে
জবার নগ্ন রুগ্ন গাছটিতে পরম যতেœ-
তার তৃষার্ত প্রেমিকের গায়ে অমীয় ঢেলে যেভাবে উষ্ণ করে তাকে,
তেমন করে ঢালছে পানি।
আর তার প্রেমিকের মতই সুধা পানে
একদম তরুণ, শৌর্যে-বীর্যে বলবান তার প্রেমিকের মত
তরতরিয়ে জীবিত হয়ে উঠল জবার গাছটি।
অথবা বিয়ের পানি গড়াতেই যেভাবে
লিকলিকে গৃহবধূ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে।
তারপর দেখলাম, একটি জবা
প্রস্ফুটিত একটি জবা
সুবাস বিলাচ্ছে ফুলবাগানে।
আরেকদিন জানালায় মুখ বাড়িয়ে দেখি
নিষ্ঠুর কিশোরী, কখনও প্রেমিকের সাথে এমনটা করেনি
একদম গলা টিপে টেনে আনল ফুলটিকে মায়ের বুক থেকে।
আপন কানে গুঁজে আবার শুয়ে গেল প্রেমিকের সাথে।
আর সেদিন!
কেউ দেখেনি, আমিও না
মেয়েটিরও অগোচরে, তার প্রেমিক দেখেছে!
বিছানায় শুকনো, জীর্ণ জবাটি আর্তনাদও করল না।
জবাটি তখন মৃত।
পদাবলি : ০১
একজন লোক
তমসুর হোসেন
একজন লোক প্রতি রাতে শহরের রাস্তাঘাট অলি গলি ঘুরে বেড়ায়
একান্ত মনোযোগে মনের অনবরত অজান্তে খোঁজে সে আপনাকে
দ্রুতবর্ধিষ্ণু ইটপাথরের চাপায় আবাল্যের সব স্বপ্ন হারিয়ে
এখন সে নিঃস্ব জড়মানবে পরিণত হয়ে গেছে।
এখন যেখানে মানুষে ঠাসা চৌরাস্তার বাতি ঝলমল মনুমেন্ট রেস্তোরা
সেখানে ছিল দীঘল পাতার সুপুরি আর রসভরা আমলকি বাগান
আরও পশ্চিমে উচু পাচিলের চকচকে আলিশান সার্কিট হাউসের ¯œানে
শ্যাওলা জড়ানো অতল পুকুরে রুই কাতলা শাল বোয়াল চিতলের ঘাঁই।
শহর তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিন্দাযোগ্য দূর্গন্ধময় বস্তিতে ফেলে দিয়েছে
আদরের মেয়েরা বুকের রেহেলে ধরে রাখতে পারেনি ওস্তাদের তালিম
একমুঠো অন্ন আর বয়সের দাবি মেঠাতে তারা পথ ছেড়ে বিপথে চলে গেছে
ধর্মভীরু বাবার কবরটাও হারিয়ে গেছে আকাশছোঁয়া ইমারতের তলদেশে।
লোকাটা পা দিয়ে গোটা শহরটাকে মেপে মেপে নিজ ভিটে উদ্ধার করতে চায়
স্বপ্ন নয় জীবনের জাগ্রত ভ্রমে খ-িতস্বত্তা জরা নিয়ে আবারও সে জন্ম নেয়
আবারও শুরু থেকে শেষের দিকে প্রাপ্তি থেকে বঞ্চনায় ঘুরপাক খায় চেতনা
মনুমেন্টের পিচ্ছিল দেয়ালে মুখ ঘষে প্রয়াত জনকের সাহচর্য আঁচ করতে চায়।
রাত শেষ হয়ে যায় দূরগামী হাওয়ার সুগন্ধে অবশ হয়ে আসে রুগ্ন অস্তিত্ব
নেড়ি কুকুরের অতৃপ্ত শব্দে দিবসের ফ্যাকাসে আলোয় সে হারিয়ে যায়
জীবনের অসংখ্য অতৃপ্তির যন্ত্রণা কাঁধে করে অনাহার আর ক্রন্দনের দেশে
এ শহরে কিছু মানুষের লোভ আর পাপিষ্ট ইচ্ছের পদভারে পিষ্ট হয় স্বপ্ন।
ভিন্ন প্রেমিক
কিশলয় গুপ্ত
চোখের দৃষ্টি সাজিয়ে রাখো ফুলদানিতে
কদরবাজী ? জানলে তুমি ভুল জানিতে
মনমানিতে কাটছে আমার অনন্ত কাল
তর্জমাতে লটকে থাকুক ফালতু সওয়াল
কাল কি হবে ভাবতে গেলে নিদ্রা-গত
আজকেই তাই শব্দ সাজাই সাধ্য মতো
পদ্য গুলো সদ্যজাত- বিস্ময়ী চোখ
অভ্যাগত প্রেম বানানের তর্জমা হোক
আসন কেমন শাসন করে প্রেম বাবাজী
মনটা কোথায়- সবটাই তো কদরবাজী!
মেয়েটা ভালোবাসতে পারে না
মিসির হাছনাইন
এবং আমি বুঝতে পরেছি মেয়েটা গন্ধে ভালোবাসে। পোড়া শরীর খুলে দিলে ঝাপটে ধরে গন্ধ শুঁকতে থাকে, চুমু খায়, যেমন করে রক্ত চোষে ছাড়পোকার দল; মনে হচ্ছিল পুরো শরীরটা খেয়ে ফেলতে পারবে এক চুমুকে।
হ্যাঁ, মেয়েটার গায়ে বেলীফুলের গন্ধ ছিল। মেয়েটা নাকি পুরুষের গন্ধ খেয়ে বাঁচে। জ্যোৎস্না রাতে মেয়েটা ফুল হয়ে ফোটে হিজল বিজলের বনে।
তারপর!!!
পুরুষ’রা মাতাল হয়ে জ্যোৎস্না দেখে, দেখে চাঁদের গায়ে কত শত ক্ষত। কত লক্ষ কোটি তারা ফুটে আছে ফুলের মতন।
হ্যাঁ, খোলা আকাশের নিচে মেয়েটার কাঁচা দেহখানি যখন জ্যোৎস্নার আলোয় লাফাতে থাকে; চাঁদের ক্ষত মুছে দিতে নেমে আসে হায়েনার মতন একদল মেঘ।
আহ্....!
মেয়েটা পুরুষের শরীর ভালোবাসে। গন্ধ খেয়ে বাঁচে।
শুধু ভালোবাসতে পারে না।
শুধু, ভালোবাসতে পারে না ।
রমাগত বিভ্রান্তি
জেলী আক্তার
ঐ যে চোখ আর,
ঐ চোখের কাজলের কোলাহল-
বয়সের সঙ্গে বেড়ে চলে।
নিস্তব্ধ লকলকে যন্ত্রনা,
কপালে শূন্যতার রেখায়-
ভাঁজ একে কথা বলে।
সবাই ইশারায় বলে ঐ যে ভাঁটফুল,
আমি বলি সব ভুল আর ভুল।
ঝরে যাওয়া বুনোফুল
ঝরে যাওয়া
বুনোফুল
যাহিদ সুবহান
সকাল থেকে গফুরাবাদ স্টেশনে কেমন যেন হইচই আজ একটু বেশী। প্রায় নির্জন এই লোকাল স্টেশনটা সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। যেন মরা গাছ কেটে কেউ সেই কাঠের গুড়ি ফেলে রেখেছে। একটিমাত্র লোকাল ট্রেন এই স্টেশনে থামে। আর সব ইন্টারসিটি ট্রেনগুলো থামে না। শুধু বাঁশি বাঁজিয়ে হই হই করে ছুটে চলে যায়। যাবার সময় বা হাতের বুড়ো আঙুলটা যেন খুব করে দেখিয়ে যায় স্টেশনকে। ভাবখানা এমন খুব তাড়ায় আছি ভাই; সরে যা সরে যা যেতে দে।
ব্রিটিশ আমলে তৈরী গফুরাবাদ স্টেশনে কোনো প্লাটফর্ম নেই। স্টেশন মাস্টারের অফিসটাও জরাজীর্ন। পুরোনো দালানগুলো ভগ্নদশায় পড়ে আছে। চারিদিকের পরিবেশ আর আয়তন দেখে বোঝা যায় এই স্টেশনটা একদিন খুব রমরমা ছিলো। হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত হতো এই স্টেশন। ট্রেন আসার খবর হলে স্টেশন মাস্টারের অফিসের সামনে ঝোলানো ৫ ফুট লম্বা লোহার রেলিংটাতে আরেকটা লোহা দিয়ে টুংটাং শব্দ করা হয়, সবাই জানতে পারে ট্রেন আসবে। এখনো এলাকার মানুষের একমাত্র ভরসা এই লোকাল ট্রেন। অনেকের জীবন জীবীকার একমাত্র উপায়ও এই লোকাল ট্রেন। আকাশ-নদী-জল আর পাখির মতই এই এলাকার মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে এই স্টেশন। স্টেশনের আশেপাশের কয়েকটি বড় কড়ই গাছ গফুরাবাদ স্টেশনের প্রাচিন নিদর্শন ঘোষনা করছে।
আজ সকাল থেকেই পশ্চিম পাশের বড় কড়ই গাছটার নিচে বেশ জটলা দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে কারো কারো কথা বেশ স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, ‘আহারে! অসহায় মেয়েটার এই সর্বনাশ কে করলো।’ কেউ কেউ বলছে, ‘বেশ্যার মিয়ে মরুক, ওইয়ের মরাই দরকার। ও মরলেই বাঁইচে যায়।’
একটু এগিয়ে গেলেই বোঝা যাবে যারা আহারে আহারে করছে তারা এই এলাকার মানুষ নয়; অনেক দূরের গ্রামের মানুষ। তারা কেউ লাবনীকে চেনে না। লাবনীর কষ্ট দেখে তারা সহ্য করতে পারছে না; আস্ফালন করছে। লাবনী নামের ষোড়শী মেয়েটা আজ সকাল থেকেই এই কড়ই গাছটার শেকড়ের কাছে অহস্য পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছে। বছরে দুয়েকবার স্টেশনে আসা অপরিচিত মানুষগুলোই লাবনীকে দেখার জন্য উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ভীড় করছে সেখানে।
গফুরাবাদ স্টেশনের আশেপাশের মানুষগুলো খারাপ নয়। পাথর হৃদয়ও যে তাদের তাও নয়। লাবনীর প্রতি কোন ঘৃণার কারণে তারা লাবনীর কাছে যে আসছে না তাও নয়। লাবণীর প্রতি তাদের কোন অভিযোগ-অনুযোগও নেই। লাবনীর সাথে এই এলাকার মানুষের সম্পর্ক এমন নয় যে ঘৃণা করার মত কোন ব্যপার ঘটবে। বরং এই এলাকার মানুষগুলোই লাবনীকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। লাবনী যে তাদের তাদের চোখের সামনেই এত বড় হয়েছে। অনেক বছর ধরে লাবনীর কষ্ট এই এলাকার মানুষ দেখতে দেখতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। লাবনীর কষ্ট দেখে এই এলাকার মানুষেরই বেশী পোড়ে। লাবনীর এই কষ্টের শেষ কোথায় তা এই এলাকার মানুষ জানে না। হয়তো মৃত্যুই এর শেষ সমাধান। তাই মানুষ ভাবে ওর মরণই ভাল। গফুরাবাদ এলাকার মানুষের প্রশ্নগুলোর উত্তর বিধাতাও দেন না। সত্যিই কি মানুষ মানুষ বিধিাতার কাছে প্রশ্নের উত্তর পায়? তাই তো মানুষ বলে ওঠে, ‘বিধাতার খেলা বোঝা বড়দায়!’
আজ থেকে ঠিক ষোল বছর আগে স্টেশনের মসজিদের পাশে মোল্লাবাড়ীর বড় খড়ের গাদার কাছে গোয়ালঘরের পাশে এক অর্ধমৃত মহিলাকে আবিষ্কার করেছিলো এলাকার মানুষ। মহিলাকে দেখা গেল একটি ফুটফুটে মেয়ে প্রসব করেছে সে। খড়ের গাদায় ময়লা-আবর্জনায় জড়িয়ে সদ্যপ্রসব করা শিশুটি শুধু চিৎকার করছিল। মহিলা কোথা থেকে এসেছে তা কেউ আবিষ্কার করতে পারে নি। তবে তার নামটি যে লাইলী তা জানা গিয়েছিল। সেদিন জন্ম নেওয়া শিশুটিই লাবনী।
মায়ের সাথে জন্ম থেকেই এই লোকাল স্টেশনটাতেই লাবনীর ঠাঁই হয়। চার বছর বয়সে মাকে হারিয়ে একদম অসহায় হয়ে পড়ে সে। এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক মহিলা তাকে কোলে তুলে নেয়। স্টেশনের পাশে পলিথিন আর খড়কুটো দিয়ে বানানো খুপরি ঘরে তারা বাস করে। এই লোকাল স্টেশেন গড়ে ওঠে লাবনীর জগৎ। স্টেশনে খালি জায়গা যেন ওর খেলার মাঠ। এই স্টেশনের গাছগুলো যেন ওর খেলার সাথী। এই এলাকার মানুষগুলো যেন তার পরম আত্মীয়। ছোটবড় সবাই লাবনীকে খুব ভালবাসে। লাবনী স্টেশনের চায়ের দোকানগুলোতে পাশের টিউবওয়েল থেকে কলসি ভরে পানি এনে দেয়। বিনিময়ে কলসি প্রতি এক টাকা করে পায় সে; এটা বাধা রেট। সারাদিন এই স্টেশনটাতে দাঁপিয়ে বেড়ায় লাবনী। ছুটোছুটি করে। চঞ্চল মেয়েটার মুখে হাসি যেন লেগেই থাকে। এই হাসি ওর অতীতের সকল ইতিহাসকে ঢেকে দেয়। ঢেকে দেয় আকাশে তুলোমেঘ হয়ে উড়ে বেড়ানো ওর জন্মের ইতিহাস। এই স্টেশনটা লাবনীকে ভুলিয়ে দেয় ওর মায়ের কথা; বাবার কথা।
আজ লাবনী খুব অসুস্থ। প্রচন্ড পেটে ব্যথা তার। ব্যথায় কাতর হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করছে সে। ওর আত্মচিৎকারে আশপাশ ভারী হয়ে উঠছে। লাবনীর পেটের আকার বলছে সে গর্ভবতী। অবিবাহিত মেয়েটার এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা নিয়েই আশেপাশের মানুষের কৌতুহল। এখানে জড়ো হওয়া মানুষেরা লাবনীর এই অবস্থা দেখে আস্ফালন করে বলছে, ‘আহারে, অসহায় মেয়েটার এই সর্বনাশ কে করলো!’
রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে লাবনীর চেহারা কেমন যেন হয়ে গেছে। চামড়ায় ময়লার আস্তর পড়ে গেছে। চুলগুলো উসকো খুসকো। তবুও ওকে অপরূপ সুন্দর লাগে। প্রকৃতির নানা প্রতিকূলতা আর অযত্ন লাবনীর সৌন্দর্যকে একটুও ম্লান করতে পারে নি। তবে লাবনীর মুখের অবয়ব আর শারিরীক গঠন দেখলে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, সামান্য যত্ন আর একটু তেল সাবান শরীরে পরলে লাবনী হতো অপূর্ব সুন্দরী। তখন লাবনীর সৌন্দর্য ক্লিউপেট্টাকেও হয়তো হার মানাতো। অনেক সুদর্শন যুবক লাবনীর সৌন্দর্যের প্রেমে পড়তো। পড়ে নি তাও নয়। বছরখানেক আগে মোল্লাবাড়ীর ছোট ছেলে সাগর লাবনীর প্রেমে পড়েছিলো। সারাদিন শুধু স্টেশনে ঘুরঘুর করতো লাবনীকে এক নজর দেখার জন্য। লাবনীও সাগরকে দেখে মিটমিট করে হাসতো। মোল্লা সাহেব জানতে পেরে সাগরকে খুব মারধর করেছিলেন। শাসন করেছিলেন খুব।
সকাল থেকে মেয়েটা এভাবে পড়ে আছে। ওকে একটু হাসপাতালে নেওয়ারও কেউ নেই। কে-ই বা নিয়ে যাবে; ওর তো কেউ নেই! ওর সাথে যে বুড়ি থাকে সেও তো সেই ভোরে ভিক্ষা করতে চলে গেছে। সবাই বলাবলি করছে মেয়েটাকে অন্তত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসছে না। সবাই যার যার মত ব্যস্ত।
লাবনীর চিৎকারের আঁওয়াজ বাড়ছে। কয়েক ঘন্টা পর দেখা গেল লাবনীর চিৎকার থেমে গেছে। কী হল কোন ঠাওর করা গেল না। কেউ হয়তো ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। কিন্তু কড়ই গাছের শেকড়ের কাছে মানুষের জটলা রয়েই গেছে। দেখা গেলা ধূলোয় পড়ে আছে লাবনীর নিথর দেহ। কেউ কেউ বলছে, ‘আহারে! অসহায় মেয়েটার এই সর্বনাশ কে করলো। মেয়েটা মরেই গেলো!’ গফুরাবাদ স্টেশনের স্থানীয় লোকজন বলতে লাগলো, ‘বেশ্যার মিয়ে মরেছে ভাল হইছে, ও মইরেই বাঁইচে গেল!
পাবনা
পলাতক
পলাতক
রফিকুল নাজিম
কেমন আছো, আবীর?’ নাকি জিজ্ঞেস করবে ‘কিমুন আছোত,অকবি?’ আবীরের সামনে গেলে প্রথম কি দিয়ে শুরু করবে; এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে সুদীপা। খুব শীতল গলায় নাকি কটকট করে জিজ্ঞেস করবে- আয়নার সামনে চললো কয়েকবার রিহার্সাল। আজ সুদীপার মনের অর্ধেকটা ফাগুনের রঙে রাঙানো আর বাকিটায় শোনা যায় শীতের ঝরাপাতার শব্দ। এখন সুদীপা যাচ্ছে আজিজ সুপার মার্কেট। এখানে বইঘরে দুজনের কেটেছে কতগুলো মিষ্টি বিকেল, পাখিদের নীড়ে ফেরা সন্ধ্যা। ঘরমুখো মানুষের ব্যাকুলতাকে উপেক্ষা করে ওরা বসতো বইঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে। রঙ চা আর সিগারেটের ধোঁয়ায় আবীর আঁকতো কবিতার শরীর আর নিমগ্ন পাঠকের মতো চুল ছেঁড়া বিশ্লেষণ করতো সুদীপা। আহা! সেই দিনগুলো কি দুর্ধর্ষ ছিলো। ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে সেই জীবনে ছিলো কত রঙ, কত প্রেম ছিলো, মান অভিমান ছিলো। আবার অহেতুক অট্টহাসিতে ফেটে পরার পাগলামিও ছিলো।
দীর্ঘ তেরো বছর নয় মাস তেইশ দিন পর গত পরশু ঢাকায় সুদীপা পা রাখলো। ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর সাথে গাঁটছড়া বাঁধার পর টরেন্টোতেই গড়েছিলো স্থায়ী আবাস। আর এই শীতল শহরের ভেজা বাতাসে হু হু করে উল্টে গেলো অনেকগুলো ক্যালেন্ডার, অনেকগুলো পাতা। এয়ারপোর্টে নেমেই সুদীপার চোখজোড়া খুঁজছে প্রিয় মানুষটাকে। শহুরে বাতাসে নাক রেখে খুঁজছে পরিচিত শরীরের সেই ঘ্রাণ।
বটতলা বসে বাদামের খোসা ছাঁড়তে ছাঁড়তে সুদীপাকে আবীর জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘আমি যদি কোন ক্লান্ত দুপুরে পুকুরের জলে ডুবে যাওয়া পাথরের টুকরোর মতো ডুবে যাই- তুই কি করবি?’ সুদীপা হাসতে হাসতে বলেছিলো, ‘আমিও টুপ করে জলে ডুব দিমু। তোর কলার চাইপ্পা ধইরা পুকুর থেইকা তুইল্লা আনমু আর কিলামু।’ পরক্ষনেই কি যেন মনে করে আবার সুদীপা বললো, ‘নাহ। তোকে জল থেকে তুলমু না। আমরা দুজন পুকুরের তলদেশে গড়ে তুলমু প্রেমের সাম্রাজ্য। জলকেলি করমু জলে জলে।’
আবীর আবার বললো, ‘আচ্ছা ধর, একদিন যদি আমি এই মায়ার শহরের জনসমুদ্রে হারিয়ে যাই- কি করবি তুই?’ সুদীপা এবার ক্ষেপে গেলো, ‘কি হচ্ছে এসব!’ ‘নাহ, বল, প্লিজ- কাতর গলায় বললো আবীর। সুদীপা আবীরের কাঁধে হাতটা রেখে বলে, ‘এই পাগলটার শরীরের ঘ্রাণটা শুঁকে শুঁকে অকবিটাকে খুঁজে বের করবো।’ কথাটা শুনে আবীরের বুকটা হঠাৎই প্রশস্ত হয়ে গেলো। শিনা টানটান করে হাঁটতে লাগলো সে টিএসসির দিকে। সুদীপা আলতো করে নিজের মাথাটা এলিয়ে দিলো আবীরের বিশ্বস্ত কাঁধে।
এলিফ্যান্ট রোডের জ্যামে আটকে আছে গাড়ি। কালো গ্লাসের কাচে টকটক করে নক করছে একটা আট নয় বছরের মেয়ে। কাঠিতে ঝুলছে অনেকগুলো বেলি ফুলের মালা। সুদীপা গ্লাসটা নামিয়ে- বনে মেয়েটাকে দেখছে। ঠিক লতার মতোই চেহারা। ক্যাম্পাসের দিনগুলোতে লতা প্রতিদিন আবীরকে একটা করে বেলিফুলের মালা দিতো। কখনো টাকা নিতো না। আর আমি একটা ফুল নিলেই টাকা চাইতো-বলতো,‘আফা, আপ্নে বড়লোক মানুষ। ভাইয়ার সব ট্যাহা তো আমগো খাতা কলম জামা কাপড় কিন্নাই শেষ হইয়া যায়। আমগোরে গাছতলা লেহাপরা করায় কত কষ্ট কইরা। ভাইয়া অনেক ভালা মানুষ। তাই ভাইয়ার কাছেত্তে ট্যাহা নেই না।’ কথাগুলো শুনে সুদীপার বুকটা তখন গর্বে ফুলে উঠতো। অবশ্যই তা বরাবরই গোপন ছিলো। তবে মাঝে মাঝে হিংসাও হতো।
প্রায় বিশ মিনিট হয় গাড়িটা জ্যামে আটকে আছে। সুদীপা ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে মোবাইলে কথা বলছে ।
-রাতুল ভাই, কেমন আছেন? আমি আপনার দোকানে আসতেছি। আপনাকে পাবো তো?
ওপাশ থেকে কি বললো বুঝা গেলো না। তবে মন্দ কিছু নয় এটা বুঝা গেলো। ছয় মাস হয় সুদীপা হঠাৎ ফেসবুকে রাতুলকে পায়। তারপর ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। রাতুলও একসেপ্ট করে। এভাবেই আবার দুটোপথ এক হওয়ার আয়োজন চলে। আবীরের খোঁজ খবর নিয়মিত নিতে থাকে সুদীপা।
সুদীপা খুব অস্থির হয়ে আছে আবীরকে দেখার জন্য। উত্তেজনা তার চোখে মুখে স্পষ্টতই দৃশ্যমান। সময় যেন কাটছেই না। এবার গাড়িতে রাখা একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতায় চোখ বুলাতেই পেয়ে গেলো কবি আবীর রুদ্রের কবিতা ‘বর্গাচাষী’। অকবিটা চমৎকার লিখেছে। ওর লেখার হাত বরাবরই ভালো। তবে ওর পাগলামি ও বাউ-ুলেপনা তাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। কখনোই সিরিয়াস হলো না অকবিটা।
একবার সকাল ৭টায় সুদীপার হল গেইটে দাঁড়িয়ে আবীর অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে। চোখ কচলাতে কচলাতে সুদীপা হল গেইটে আসতেই আবীর খপ করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সুদীপা কোনোরকম নিজেকে ছাড়িয়ে আশপাশটা দেখলো। নাহ কেউ দেখেনি।
-এই কি হইছে তোর? আজকা এত্তো খুশি কেন?
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটা দৈনিক পত্রিকা এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘নে।পড়। আমার কবিতা ছাপাইছে রে, টুনটুনি। তরে কইছিলাম না, আমার কবিতা ছাপাইবোই। দেখছোত! ‘সুদীপা পত্রিকাটা বুকে চেপে ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে পাগলটার দিকে। কি সহজে একটা মানুষ এতোটা খুশি হয়! খুব অল্পতেই খুশি ছিলো আবীর। হঠাৎ সুদীপা খেয়াল করে আবীরের দু’পায়ে দু’রঙের স্যান্ডেল। সুদীপা মুচকি হেসে বলে, ‘হইছে, অকবি। এবার হলে যা। হুম, মানলাম- আপ্নে অনেক বড় কবি হইয়া গেছেন। এখন গিয়া হলে যা।’
স্মৃতিটা মনে করে সুদীপা একা একা হু হু করে হাসতে হাসতে দেখে আজিজের সামনে গাড়িটা চলে এসেছে।
বইঘরের সামনে যেতেই রাতুল সুদীপাকে এগিয়ে নিয়ে গেলো ভিতরে। সুদীপা দোকানে ঢুকতে ঢুকতে খেয়াল করে উত্তর পূর্ব কর্ণারে দুটো টুল আজো পাতা আছে। যেখানে বসে আবীর আর সুদীপা প্রেমের নোঙর করতো। শব্দ টিপে টিপে কবিতার টেরাকোটা বানাতো আবীর। আর তাতে মুগ্ধ হতো সুদীপা।
-সুদীপা, কি খাবে? ব্ল্যাক কফি চলবে?
-না, রঙ চা খাবো। রাতুল ভাই,পাগলাটা কি জানতো আমি আসবো?
-হুম। জানতো। মনে প্রাণে বিশ্বাসও করতো।
-তাই?
-হুম।
বলতে বলতে চা আর সিঙ্গারা চলে আসলো।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সুদীপা রাতুলকে জিজ্ঞেস করলো, কাসেম মামা এখনো আছে?
-হ্যাঁ। তবে কেমনে বুঝলে!
-এই যে চা। এই চা তো আর কেউ বানাতে পারবে না।
-হুম। ভালোই মনে রেখেছো সবকিছু।
-কি যে বলেন, রাতুল ভাই। আচ্ছা রাতুল ভাই, ক্ষ্যাপাটা এখন কই? কখন আসবে এখানে?
রাতুল কোন উত্তর না দিয়ে ট্রয়ার হাতড়ে বের করে তেরোটা খেরোখাতা। সুদীপাকে দিয়ে বলে, দেখো। সুদীপা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টায়। প্রতিটা খাতার উপর সাল লেখা আছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের খাতাও আছে। এগুলো তো বইঘরের আয়ব্যয়ের খাতা। খাতার শেষদিকে ৩০/৪০ টা করে কবিতাও আছে। মাঝে মাঝে পাগলার হাতের আঁকিবুঁকিও আছে। কোথাও কোথাও শূন্যস্থান পূরণ খেলা। ও একা একাই খেলতো।
-এগুলো দিয়ে আমি কি করবো, রাতুল ভাই? আর আবীরই বা কোথায়? প্লিজ বলেন কিছু। আমি ওকে একবার দেখবো শুধু। আর একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করবো, ‘সেদিন কেন সে পালিয়ে গিয়েছিলো?’
-রাতুল এবার একটা নীল খাম এগিয়ে দিয়ে বললো, আবীর তোমাকে খাতাগুলো আর খামটা দিতে বলেছে।
রাতুলের ডান চোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রু। আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। তবুও টুপ করে জলটা নিচে পড়লো।
সুদীপা কাঁপা কাঁপা হাতে ছিঁড়লো খামটা। আবীরের চিরকুটে লেখা-
প্রিয় টুনটুনি,
তুইও ভালো নেই- জানি আমি। আমি কিন্তু বেশ আছি। দেখ, সপ্তর্ষির পাশে ঐ যে বড় তারাটা দেখছিস, ওটাই আমি। তুই আর আমি অনেকদিন একত্রে তারাগুলো গুনেছি। কতকগুলো তারা আমাদের সাথে কথাও বলতো। মনে আছে? আমি জানতাম তুই ফিরবি। তবে আমি সেদিন থাকবো না-এটা আমি খুব মানতাম।
আজ তাই তো হলো। তুই এলি, আর আমি নেই। তোর সাথে করা আমার পাগলামির স্মৃতিগুলো আমাকে তিলে তিলে খুন করেছে। জানিস তোর মতো আর কেউ আমাকে বুঝতো না রে। আমার পাগলামিগুলো সহ্য করার মতো একজনকেই স্রষ্টা আমার কাছে পাঠিয়েছিলো। চাল চুলাহীন অকবি আমি। তাইতো তোকে ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের কাছে সম্প্রদান করে পালিয়ে গিয়েছিলাম সেইরাতে। আর বেঁচে গেছিস তুই। আমি আবারো পালাইলাম রে।
ওহ, শোন, মনে করে একবার খেয়াটা দেখে যাস। ছোট ছোট সোনা মুখগুলোকে আদর করে যাস। ভালোবাসাগুলো ভালো থাক রে।
ইতি
তোর অকবি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই গাছটায় এখনো ঝুলে আছে সাইনবোর্ড। বড় করে লেখা-‘খেয়া’। গাছতলায় ব্ল্যাকবোর্ড ঝুলিয়ে পড়াচ্ছেন একজন তরুন, পাশেই বসা লাস্যময়ী এক তরুণী। হয়তো আবীর সুদীপার মতো ওরাও খেয়ায় স্বপ্ন আঁকে। সুদীপা দ্রুত হাতে চকোলেট, কিছু নতুন জামাকাপড়, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে পালাতে চাইছে। সুদীপার খুব চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মাথা থেকে সানগ্লাসটা চোখে নামিয়ে রাখে। কাঁচা পয়সার মতো চকচকে চোখটা আড়াল হয়। আড়াল হয় সুদীপা আর আবীর। তবুও আবীর মাখানো সন্ধ্যার নিয়ন আলোয় ঠুকরে কাঁদে শহুরে রাস্তা। কালো পিচঢালা রাস্তাটা শোককে বুকে ধরে রাখবে আজীবন। শুধু এই শহরটা জানবে না আজ সুদীপার বুকে কতোটুকুন মেঘ জমেছে!
শ্যামলী আবাসিক এলাকা,
মাধবপুর, হবিগঞ্জ।
বাংলা সাহিত্যের নীললোহিত : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বাংলা সাহিত্যের নীললোহিত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে পৃথিবীর সকল বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক ধরে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে খুব জনপ্রিয় একজন কথাশিল্পী হিসেবে নিজের একটা পাকাপোক্ত জায়গা নিয়ে রেখে ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লেখালেখির জগতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন। কখনো ‘নীললোহিত’, কখনো ‘সনাতন পাঠক’ আবার কখনো ‘নীল উপাধ্যায়’ ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি ‘নীললোহিত’ ছদ্মনামে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্যের নীললোহিত হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নিলেও সাহিত্য অঙ্গনে একজন ভারতীয় বাঙালী লেখক হিসেবে পরিচিত। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রতি তিনি বরাবরই একটা অকৃত্রিম টান অনুভব অনুভব করতেন। বাংলাদেশের লেখকদের সাথে তাঁর ছিল খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। দুই বাংলার লেখকের মাঝে একটা সুন্দর মেলবন্ধন সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আধুনিক বাংলাকে এবং ভারত ও বাংলায় শিল্পায়নের প্রভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। গ্রামীণ এবং নগর জীবনের ছোট-বড় নানা সমস্যা তিনি তাঁর গল্পে, উপন্যাস ও কবিতায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি সচেতন ছিলেন। আর সে কারণেই তার সৃষ্টিকর্মে প্রেম কিংবা সামাজিক সমস্যা শক্তিশালীরূপে ফুটে উঠে। এছাড়াও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদি। স্বনামে ও নানা ছদ্মনামে লেখনীর অসাধারণ জাদুশক্তি দিয়ে তিনি এপার-ওপার বাংলার সাহিত্যপ্রেমীদের গল্প, কবিতা, উপন্যাসের রসে মাতিয়ে রেখেছিলেন। বহুমাত্রিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন যেমন একজন অসাধারণ লেখক, তেমনি ছিলেন দয়ালু এবং সেইসাথে উষ্ণ হৃদয়ের একজন প্রাণবন্ত আড্ডাবাজ মানুষ। ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ এবং ১৯৬৬ সালে প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। তারপর তিনি কবি, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গোয়েন্দা সিরিজ, ঐতিহাসিক, ভ্রমণকাহিনী, শিশুতোষ গল্পসহ দুশোরও বেশি বই লিখেছিলেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম বাংলাদেশের বৃহত্তর ফরিদপুরের (বর্তমানে মাদারীপুর জেলা) মাইজপাড়া গ্রামে ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে। তাঁর পিতার নাম কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় ও মাতার নাম মীরা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি জন্মের পর মাত্র চার বছর বয়সেই পিতামাতার সাথে কলকাতায় চলে যান। সেখানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, দমদম মতিঝিল কলেজ ও সিটি কলেজে লেখাপড়া করেন। কলেজের পাঠ চুকানোর পর ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি নেন। এরই মধ্যে লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে সুনীলের। তবে এর পেছনেও আছে একটা গল্প। ছাত্র জীবনে সুনীলের পিতা তাকে টেনিসনের একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতিদিন এখান থেকে দুটি করে কবিতা অনুবাদ করবে। এটা করা হয়েছিল এই জন্য যে, তিনি যেন দুপুরে বাইরে যেতে না পারেন। বন্ধুরা যখন সিনেমা দেখত, বিড়ি ফুঁকত, সুনীল তখন পিতৃ-আজ্ঞা শিরোধার্য করে দুপুরে কবিতা অনুবাদ করতেন। অনুবাদ একঘেয়ে হয়ে উঠলে তিনি নিজেই লিখতে শুরু করেন। মূলত সেই থেকে লেখালেখির জগতে হাতেখড়ি নেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তার সম্পাদনায় প্রকাশ হতে থাকে সাহিত্য পত্রিকা কৃত্তিবাস। আর এই পত্রিকাই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে নতুন কাব্যধারার অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সেই সময় ভারতে ‘হাংরিয়ালিজম’ নামের সাহিত্য আন্দোলনে যারা যুক্ত হয়েছিলন, সুনীল ছিলেন তাদেরই একজন। ১৯৫৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর ইউনেস্কোর বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে কাজ শুরু করলেও মাত্র তিন মাসের মাথায় তিনি সেখানে ইস্তফা দেন। ওই বছরই নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্স কোম্পানিতে ট্রেইনি অফিসার হিসেবে যোগ দিলেও কিছু দিনের মধ্যেই কাজের ধরণ পছন্দ না হওয়ায় সেটাও ছেড়ে দেন। এরপর শুরু হয় প্রাইভেট টিউশনি। টিকে থাকার সংগ্রামে দীর্ঘদিন ছাত্র পড়িয়ে উপার্জনই ছিল তাঁর একমাত্র আয়ের উৎস। এরপর ১৯৭০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় সাব-এডিটর হিসেবে সাংবাদিকতার জীবন শুরু হয় এই কথাশিল্পীর। সর্বশেষ তিনি ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে স্বাতী বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ওই বছরই তাদের একমাত্র সন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম।
কবিতা ছিল তার প্রথম প্রেম, তবে অনেক বেশি পাঠকপ্রিয় হয়েছেন কথাশিল্পের ‘জাদু’ দেখিয়ে। পেশায় ছিল সাংবাদিকতা, লিখতে হয়েছে প্রবন্ধ-কলাম। এক জীবনে যখন যাই করেছেন, কবিতাই ছিল সুনীলের অনেকটা জুড়ে। সে কথা তিনি লিখে গেছেন তাঁর কবিতায়। সুনীল বলেছেন, ‘শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম/ শুধু কবিতার জন্য কিছু খেলা/ শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা/ ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য।’ কবিতাকে মানুষের মুখের ব্যবহারের ভাষার কাছাকাছি নিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। প্রেম, বিরহ, হৃদয়ের জটিলতা, আবেগ, উচ্ছ্বাস, প্রকৃতি ও সময়ের সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন তিনি তার কবিতায়। ইতিহাস এবং ইতিহাসের নানা ঘটনাকে আশ্রয় করে সুনীলের লেখনী শুধু পাঠক হৃদয়কেই আন্দোলিত করেনি, সমাজ সচেতনতাও তৈরি করেছে ব্যাপক পরিসরে। তাই বাংলার আকাশে, পূর্ব-পশ্চিমে সুনীল চিরদিন উজ্জ্বল থাকবেন। তাঁর রক্তে যেন কেউ প্রেমের বীজ বুনেছে কৈশোরেই। জীবনে আসা প্রেমিকাদের কথা লিখেছেনও নানাভাবে। নীরা তো মিথ হয়ে আছে সুনীল সাহিত্যে। নীরাকে নিয়ে তাঁর আবেগ ও উচ্ছ্বাসের কোন কমতি ছিল না। নানাভাবে তাঁর সেই আবেগ ও উচ্ছ্বাসের প্রকাশ করতে তিনি লিখেছিলেন, ‘নীরার অসুখ/ নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে/ সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয়/ নীরা আজ ভালো আছে?’ এছাড়াও ‘মিনতি’ কবিতায় কবি প্রেমিক ও প্রেমিকার সম্পর্ককে অমলিন রাখার জন্য প্রকৃতির কাছে আহবান জানিয়েছেন। প্রেমিকা যখন তার প্রেমিকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে, তখন ঝড়-বৃষ্টির আগমনে পরিবেশ যেন কলুষিত না হয়। একটা বিষয় পরিষ্কার, কবির প্রগাঢ় মানবতাবোধ ছিল। ‘উত্তরাধিকার’ কবিতায় কবি গরিব পরিবার ও রাস্তায় বাস করা অসহায় শিশুদের প্রতি তাঁর অপার স্নেহ ব্যক্ত করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি উত্তরাধিকার নামক উপন্যাসও রচনা করেছেন। তিনি তাঁর কথা রেখে গিয়েছিলেন পাঠকদের কাছে কিন্তু অগত্যা কথা না রাখার অনেক অভিযোগ ছিল সুনীলের মনে। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই শুরু করে সারাটা জীবন জুড়ে তাঁর মনে অনেক কিছুই না পাওয়ার হতাশা ছিল। সেই হতাশা থেকেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’। এই কবিতার শেষাংশে ব্যর্থ প্রেমিকের অনুযোগে লিখেছিলেন, ‘বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল/ যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে/ সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!/ ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি/ দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/ বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম/ তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ/এখনো সে যে-কোনো নারী/ কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলোর মধ্যে ‘সুন্দরের মন খারাপ’, ‘মাধুর্যের জ্বর’, ‘সেই মুহূর্তে নীরা’, ‘স্মৃতির শহর’, ‘সুন্দর রহস্যময়’, ‘আমার স্বপ্ন’, ‘আমি কি রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘ভালোবাসা খ-কাব্য’, ‘নীরা হারিয়ে যেও না’, ‘অন্য দেশের কবিতা’, ‘ভোরবেলার উপহার’, ‘সাদা পৃষ্ঠা তোমার সঙ্গে’, ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ কাব্যগ্রন্থগুলো এখনো পাঠকপ্রিয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তিনি আলোচনায় চলে আসেন। প্রথম উপন্যাসেই সাহিত্য অঙ্গনে ও পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দেন। আক্রমণাত্মক ও সোজাসাপ্টা কথা বলার ঢংয়ের কারণে সে সময় বেশ বিতর্কের জন্ম দেয় এই উপন্যাস। সুনীল পরে নিজেও স্বীকার করেন, বিতর্কের মাত্রা দেখে আতঙ্কে তিনি কয়েক দিন কলকাতার বাইরেও কাটান সে সময়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তরুণ ‘সুনীল’ একজন ভবঘুরে। কলকাতায় বেড়ে ওঠা এই ব্যতিক্রমী চরিত্রের তরুণকে ঘিরেই গড়ে ওঠে উপন্যাসের জমিন। নীললোহিত, নীল উপাধ্যায় আর সনাতন পাঠক ছদ্মনামে লিখেছেন অসংখ্য গল্প, উপন্যাস ও নাটক। তবে তাঁর নীললোহিত ছদ্মনামটিই বেশি বিখ্যাত। নীললোহিত নামে তিনি যে উপন্যাস বা গল্পগুলো লিখেছেন, সেগুলোর অধিকাংশের নায়ক নীললোহিত নামে সাতাশ বছরের এক তরুণ। যার পায়ের তলায় শক্ত মাটি নেই, অনিশ্চিত তার ভবিষ্যত ও গন্তব্য। সে জীবনকে দেখে খোলা চোখে, খোলা মনে। অনেকেই হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত হিমু চরিত্রের সাথে নীললোহিতের মধ্যে কিছুটা সাদৃশ্য খুঁজে পান। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীললোহিত চরিত্রটি থেকেই হুমায়ূন আহমেদ হিমু চরিত্র সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং বাঙালি জাতির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা পালন করেছেন অনন্য চারটি ক্ল্যাসিক উপন্যাসের মাধ্যমে। ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’, ‘একা এবং কয়েকজন’ এবং ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসের মূল পটভূমি পশ্চিম বাংলা হলেও বাঙালির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের ধারা এতে পরিস্ফূট হয়েছে। তাঁর ‘সেই সময়’ উপন্যাসে ১৮৩০-১৮৭০, ‘প্রথম আলো’তে ১৮৭০ থেকে বিশ শতকের প্রথম দশক, ‘একা এবং কয়েকজন’- এ ১৯২০-১৯৫০/৫২ এবং ‘পূর্ব পশ্চিম’-এ ১৯৫০-বিশ শতকের আশির দশকের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। চারটি উপন্যাসেরই মূল নায়ক সময়। সময়ের গতিতে ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজ উপন্যাসগুলোর মূল উপজীব্য। একা এবং কয়েকজন ছাড়া অন্য তিনটি উপন্যাসে ইতিহাসখ্যাত মানুষরা এসেছেন উপন্যাসের চরিত্র হয়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাভাষী পাঠকের হাতে উপহার দিয়েছেন ক্ল্যাসিক সাহিত্য থেকে তুলে আনা কয়েকটি কাহিনীর নিজস্ব ভাষ্য। প্রাচীন কাহিনীর সৌরভ সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন রেখে তিনি তাতে দিয়েছেন ভিন্ন ব্যঞ্জনা। এই ধারায় লেখা তার উল্লেখযোগ্য বই হলো, ‘রাধাকৃষ্ণ’, ‘শকুন্তলা’, ‘স্বপ্ন বাসবদত্তা’ ও ‘সোনালি দুঃখ’। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে সুনীল লেখেন ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী’। ঐতিহাসিক পটভূমি নিয়ে ‘শাজাহান ও তার নিজস্ব বাহিনী’ এবং ‘আলোকলতার মূল’ নামে দুটি গল্পগ্রন্থও রচনা করেছিলেন। ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ ও ‘রাশিয়া ভ্রমণে’ তুলে এনেছেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। সুনীলের বিখ্যাত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। আর লালনকে নিয়ে লেখা সুনীলের ‘মনের মানুষ’ এর চলচ্চিত্রায়ন করেছেন গৌতম ঘোষ। অপর্ণা সেনের ‘ইতি মৃণালিনী’ চলচ্চিত্রে গান হয়ে দর্শকের কানে বাজে সুনীলের কবিতা ‘স্মৃতির শহর’। কাকাবাবু সিরিজের দুটি কাহিনী নিয়েও চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।
ভারতের জাতীয় সাহিত্য আকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সাহিত্যে সার্থকতার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮২ সালে বঙ্কিম পুরস্কারের পাশাপাশি ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে দুই বার আনন্দ পুরস্কার পান। ২০১১ সালে দ্য হিন্দু লিটারেরি পুরস্কারসহ জীবনভর বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন সুনীল। বরেণ্য এই কথা সাহিত্যিককে ২০০২ সালে অতি সম্মানজনক পদ ‘কলকাতার শেরিফ’ হিসাবে নিয়োগ দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সুনীল নানাভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছেন। বাংলাদেশ-ভারতের নানা ইস্যুতে সুনীল বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছিলেন। এমনকি তার মুখে ভারত সরকারের প্রতি উচ্চারিত হয়েছে, ‘বাংলাদেশ যা চায়, তা-ই দিয়ে দাও’। এ থেকে বোঝা যায় তিনি বাংলাদেশের কতো বড় স্বজন ছিলেন। ২৩ অক্টোবর ২০১২ সালে হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ২৫ অক্টোবর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
এই কথাটা আমাদের জন্য নির্মম বাস্তব সত্য, তিনি আমাদের মাঝে আর নেই। সুনীল বিহীন সাতটি বছর কেটে গেছে চোখের পলকে। তবে তাঁর অনন্য সৃষ্টি গুলোর মাঝে আমরা তাঁকে বারবার ফিরে পাই। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)