নজরুল মানস ও বাংলা কাব্যে মানবতাবাদী চেতনা
নজরুল মানস ও বাংলা কাব্যে মানবতাবাদী চেতনা
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার, চলচ্চিত্র অভিনেতা ও সাংবাদিক । বাংলা কাব্য ও কথাকলার নানা শাখায় তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। বাংলা সাহিত্যের প্রথাগত ধারার বাইরে এসে তিনি বাঙালির আবেগ অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে মনন, মেধা ও লেখনিশক্তি দ্বারা ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। মাত্র আট বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে নজরুলের পরিবার চরম দারিদ্র্যে পতিত হয়। দুঃখের সাথে সন্ধি করে চলতে চলতে তাঁর ডাকনাম হয়ে যায় ‘দুখুমিয়া’। জীবন ও জীবিকার তাগিদে নজরুলকে নানা কাজ ও পেশার সাথে পরিচিত হতে হয়। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে তিনি গ্রামের মোক্তব থেকে নি¤œ প্রাইমারি পাশ করে সেখানেই এক বছর শিক্ষকতা করেন। ছেলেবেলা থেকেই নজরুল ছিলেন অসম্ভব মেধাবী ও পরিশ্রমী। বারো বছর বয়সে তিনি লেটো নামের এক যাত্রা গানের দলে যোগ দেন এবং দলের জন্য পালাগান রচনা করেন। পরে কাজ করেছেন রুটির দোকানে। কিছুদিন বর্ধমানে ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। তবে স্কুল গ-ির বাঁধাধরা নিয়ম তাঁর ভালো লাগত না। ছেলেবেলা থেকেই নজরুল সৃষ্টিশীল সত্তার অধিকারী হয়ে ওঠেন। তিনি প্রথাগতভাবে বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করতে পারেন নি। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে প্রথম বিশ^যুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯) শুরু হয়। নজরুল স্কুল পালিয়ে ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন এবং প্রথম বিশ^যুদ্ধে অংশ নিতে করাচি যান (করাচি অধুনা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ)। নজরুলের দক্ষতা ও কর্তব্যপরায়ণতা দেখে কর্র্তৃপক্ষ তাঁকে সৈনিক থেকে হাবিলদার পদে উন্নীত করে। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ^যুদ্ধ শেষ হলে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হয়। নজরুল চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। জীবনের চরম বাস্তবতায় দুঃখের কষ্ঠিপাথরে ঘোঁষে নজরুল নিজেকে শাণিত করেছেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শি ছিলেন। জীবনের নিখাদ বাস্তবতায় পড়ে একাডেমিক ডিগ্রি অর্জন করতে না পারলেও; সৈনিক জীবনে নজরুল করাচির সেনাগ্রন্থাগারে বসে ব্যাপক পড়াশোনা করার সুযোগ পান। আরবি-ফারসি সাহিত্যের বাঘা বাঘা কবির কাব্য পড়ে তিনি সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। এভাবেই নজরুল স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন।
নজরুলের আবির্ভাবের আগেই বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ ছিল। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একটি প্রতিষ্ঠান, যুগদ্রষ্টা। বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে বিশ^-দরবারে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। নজরুলের সমসাময়িক কবিদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬), সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭), জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
১৯২০ সালের শুরুর দিকে নজরুল করাচি ছেড়ে (অধুনা ভারতের) কলকাতায় চলে আসেন এবং পরিপূর্ণভাবে সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ (১৯২০) পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি (৬ জানুয়ারি, ১৯২২) প্রকাশিত হলে তাঁর কবিখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি কবিতায় পরাধীন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ করেছেন। অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। তাই তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবি হিসেবেও সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেন। নজরুল লিখেছেন:
“বল বীর-
বল চির উন্নত মম শির !
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর-” ১
কিংবা,
“মহা-বিদ্রোহ রণ ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাশে ধ্বনিবে না
অত্যাচারির খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।”২
কবিতায় বিদ্রোহী হলেও মানুষ নজরুল ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও দরদী। কবি মানুষকে ভালোবাসতেন অন্তর দিয়ে। তাই তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, ভারতের পরাজয়ের গ্লানি, ইংরেজদের অত্যাচার এবং পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তির আশাবাদ। তিনি গণমানুষের জন্য দেশাত্মবোধক গান, মুসলমানদের জন্য ‘গজল’ ও হিন্দুদের জন্য ‘শ্যামা-সংগীত’ রচনা করেছেন। নজরুলের কবিতা এবং গান অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নজরুল শুধু যে কবিতা লিখেছেন তা কিন্তু নয়। তিনি উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও গান রচনা করে বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করেছেন। ‘নবযুগ’ (১৯২০), ‘ধুমকেত’ু (১৩২৯), ‘লাঙল’ (১৯২৫) প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আরও একটি বড় অবদান আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার। নজরুলের কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অগ্নিবীণা (১৯২২), বিষের বাঁশি (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৫), সর্বহারা (১৯২৬), ছায়ানট (১৯২৫), প্রলয়-শিখা (১৯৩০), সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৭), চক্রবাক (১৯২৯), সন্ধ্যা (১৯২৯) প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ব্যথার দান (১৯২২), রিক্তের বেদন (১৯২৪) এ দুইটি তাঁর গল্পগ্রন্থ। শিউলিমালা (১৯৩১), মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০), কুহেলিকা (১৯৩১) প্রভৃতি উপন্যাস। ঝিলিমিলি (১৯৩০), আলেয়া (১৯৩১), মধুমালা (১৯৫৯), পুতুলের বিয়ে (১৯৬৪) এগুলো নজরুলের নাট্যগ্রন্থ। যুগবাণী (১৯২২), রাজবন্দীর জবানবন্দী (১৩৩৫), রুদ্রমঙ্গল (১৯২২), দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬), ধুমকেতু (১৯২২) প্রভৃতি তাঁর প্রবন্ধ-গ্রন্থ। আমাদের অন্বিষ্ট নজরুল মানস ও বাংলা কাব্যে মানবতাবাদী চেতনা সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা উপস্থাপন করা।
কাজী নজরুল ইসলাম একই সঙ্গে বিদ্রোহী ও সমাজ সচেতন কবি। প্রকৃতপক্ষে “সামাজিক এবং রাজনৈতিক অসংগতিগুলো সম্পর্কে তাঁর সচেতনতাই তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। তবে তাঁর সমাজ সচেতনতা কোনো বিশেষ মত দ্বারা পরিচালিত নয়। তাঁর ধর্ম ছিল মানবতার ধর্ম, এবং একই মানবধর্ম দ্বারাই তিনি বিশেষভাবে পরিচালিত হয়েছিলেন। তাঁর বিদ্রোহাত্মক বা সমাজ-সংস্কারমূলক কবিতাগুলো মূলত এই মানবতাবোধ থেকেই উদ্ভূত। রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক।” ৩ অত্যচারী ও শোষনকারীকে পদানত ও পরাস্ত করে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামই ছিল তার আদর্শ, আর সেই আদর্শেরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কাব্যে। এ কারণেই তাঁর জীবন ও কবিতাকে পৃথক করে দেখার উপায় নেই। বস্তুত নজরুল “সকলকে জাগাতে চেয়েছেন মঙ্গলের জন্যে, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে, মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রাণপণ বিদ্রোহ ঘোষণার জন্যে।”৪
নজরুলের কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে বিদেশি বেনিয়া শাসকগোষ্ঠীর শাসনপাশ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার আকাক্সক্ষা, আবার কখনো সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শোষনমুক্ত সমাজ গঠনের চেষ্টা। তাছাড়া অন্ধ কুসংস্কার গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব বিরোধী কবিতা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম পুনর্জাগরণমূলক কবিতাতেও কবির সমাজ সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুলের কবিতা সম্পর্কে ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, “বস্তুত মানবতার মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য-ভাবনার এক প্রধান অংশ জুড়ে আছে হিন্দু-মুসলাম সম্প্রীতি কামানা। মনে রাখা দরকার, সমগ্র আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র কবিÑ যিনি দক্ষতার সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন।”৫
কবি নজরুলের উত্থান-পর্বে দেখা যায় ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে মানুষের পরাধীনতা গ্লানি, ইংরেজ সিভিলিয়ানদের অত্যাচার, শাসকবর্গের শোষণনীতি, রুশ বিপ্লব (১৯১৭-১৯২৩), প্যান-ইসলামিক আন্দোলন, তুর্কি আন্দোলন (১৯০৮-১৯০৯), অহিংস অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২), ভারতবর্ষসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, নিপীড়ত, শোষিত মানুষের উত্থান, দ্রোহ ও সংগ্রাম; যা নজরুলের রচনায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রকৃতপক্ষে, কবি মানব ধর্মে বিশ^াসী ছিলেন বলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশে^র যে কোনো প্রান্তের মানুষের মানবধর্মী ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ তাঁকে অভিভূত করেছে। নজরুলের সাহিত্যজীবন মোটামুটি তিনপর্বে বিভক্ত। মূলত তিনটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনাকে কেন্দ্র করে নজরুলের লেখায় দারুণ বৈচিত্র্য এসেছে। নজরুলেকে ‘নবযুগ’ (১৯২০) পত্রিকা প্রকাশের পূর্বে দেখি বিদ্রোহী’র ভূমিকায়, ‘ধুমকেতু’ (১৩২৯) পর্বে কবি যেন বিপ্লবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন; আর ‘লাঙল’ (১৯২৫) পর্বে সাম্যের প্রতিভূ এক মানবতাবাদী নজরুলকে পাই। “১৯২২ সালের পরে মজুর, কৃষক ও জনগণকে বাদ দিয়ে নজরুলকে কল্পনাই করা যেত না।”৬ কবির দীপ্ত উচ্চারণ:
“ঐ তেত্রিশ কোটি দেবতাকে তোর তেত্রিশ কোটি ভূতে
আজ নাচ বুঢ়ুঢি নাচায় বাবা উঠতে বসতে শু’তে
ও ভূত যেই দেখেছে মন্দির তোর
নাই দেবতা নাচছে ইতর,
আর মন্ত্র শুধু দন্তবিকাশ, অমনি ভূতের পুতে
তোর ভগবানকে ভূত বানালে ঘানি চক্রে জু’তে।”৭
জাতিভেদ প্রথা বা বর্ণভেদ প্রথার মতো সাম্প্রদায়িকতাকেও নজরুল মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চূড়ান্ত হয়ে ওঠে। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতাই চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সময়ে অর্থাৎ ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) হিন্দু-মুসলিম-প্যাকট সাম্প্রদায়িক চাপে বাতিল হয়ে যায়। “এই নাকচ করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন ‘কংগ্রেস কর্মী সঙ্ঘ’।”৮ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় মর্মাহত নজরুল সম্মেলনের জন্য যে উদ্বোধনী সংগীত রচনা করেন তা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।
“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কা-ারি আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কা-ারি বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।”৯
হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সবসময়ই নজরুলের নিকট প্রার্থিত ছিল। ফলে ধর্মীয় উন্মত্ততার দিনগুলোতে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত কবি কাছে খুবই পীড়াদায়ক ছিল। কবি উপলব্ধি করেছিলেন মানুষে মানুষে ভেদবুদ্ধি আমাদের স্বাধীনতাকে বিলম্বিত করছে। শত্রুর দুর্বল মুর্হূতই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবার প্রশস্ত সময় হিসেবে তিনি মনে করতেন; আর এজন্য দরকার জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যের সম্মিলন। নজরুল বাব বার দেশবাসীকে দুর্দিনে ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
“খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি ‘অর্জুন’ ছোঁড়ে বাণ।
জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান।”১০
১৯২৫ সালের শেষভাগে ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই-এর মুখপত্র হিসেবে ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। নারী পুরষ নির্বিশেষে সকলের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনই ছিল ‘লাঙল’ এর আদর্শ এবং উদ্দেশ্য।১১ এই ‘লাঙল’ পত্রিকাতেই নজরুলের মানবতাবাদী চেতনার কবিতাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। ‘সাম্যবাদী’, ‘ঈশ^র’, ‘মানুষ’, ‘পাপ’, ‘চোর ডাকাত’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘মিথ্যাবাদী’, ‘নারী’, ‘রাজাপ্রজা’, ‘সাম্য’, ‘কুলি-মজুর’ প্রভৃতি মানবতাবাদী চেতনার কবিতাগুলো পরবর্তীতে ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫) কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। মানবতাবাদের আদর্শ প্রচার করতে গিয়ে নজরুল চোর-ডাকাত, পাপী-তাপী, কুলি-মজুর, ইতর-ভদ্র, ধনী-গরির নির্বিশেষে সকলকে তিনি মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং মানবধর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর কাছে ধর্ম-বর্ণ, জাতিভেদ থেকে মানুষই প্রধান ছিল। মানুষকে কবি মহান হিসেবে দেখেছেন। কবির ভাষায়- “গাহি সাম্যের গান-/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।” ১২ এ সম্পর্কে নজরুল গবেষক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, “মানুষ মহীয়ান বলেই ধর্মান্ধতা কবির অপ্রিয়, ...সত্যপ্রিয়তা ও মানবতাবোধ কবিকে নারীর মর্যাদায় সচেতন করেছে; কুলি ও মজুরদের অসম্মানে তিনি ব্যথিত বোধ করেছেন। নজরুলের এই সত্যপ্রিয়তা ও মানবতাবোধ একই সঙ্গে বিশ^াস ও আবেগের দ্বারা সমর্থিত- তাই অনুভবের প্রকাশ একই সঙ্গে আন্তরিকতাও তীব্র। এই আন্তরিকতার তীব্রতাই নজরুল মানসের স্বাতন্ত্র্য।”১৩ নজরুল লিখেছেন-
“তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার
তোমার হৃদয় বিশ^- দেউল সকলের দেবতার।
কেন খুঁজে ফেরো দেবতা-ঠাকুর মৃত-পুঁথি-কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে।”১৪
মোল্লা ও পুরোহিতের মধ্য যারা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন, তারা কবির কাছে বেণে সমতুল্য। এরা ¯্রস্টার স্বরূপ বুঝতে অপারগ এবং তার মহিমা উপলব্ধি করতে অক্ষম বলেই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। ¯্রস্টা যে কেবল ধর্মগ্রন্থের মাঝেই সীমাবদ্ধ নন, তাঁকে খুঁজতে হবে মানুষের মাঝে, সত্যের মাঝেÑ নজরুল এ বিষয়টি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
“কে তুমি খুঁজিছ জগদীশে ভাই আকাশ-পাতাল জুড়ে?
কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি-দরবেশ,
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
ডুবে নাই তারা অতল গভীর রতœ-সিন্ধুতলে,
শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে।”১৫
পৃথিবীতে নানা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র আছে। বিভিন্ন ধর্মের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক ধর্মগ্রন্থ। মানুষ ধর্র্মগ্রন্থগুলোকে খুবই শ্রদ্ধা করে, ধর্মের জন্য জীবন পর্যন্ত বাজি রাখে। কিন্তু নিরন্ন অসহায় মানুষকে সামর্থ্য থাকার পরও অন্ন দান করে না। মন্দিরের পুরোহিত কিংবা মসজিদের মোল্লা সাহেবও এরূপ হৃদয়হীন কাজ করে থাকেন। মানুষের চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। অথচ অনেকেই মানুষকে হেয় করে। মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেয় না। ধর্মকে ব্যবহার করে এক শ্রেণির মানুষ নিজ স্বার্থ হাসিল করে মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা করছে। কবি এরূপ স্বার্থান্বেষী মহলের প্রতি তীব্র ধিক্কার জানিয়ে মানুষের জয়গান গেয়েছেন।
“আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় প্রভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে ঊহৃ করোনি প্রভু!
তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।”১৬
সমাজের বিভিন্ন স্তরে পাপী, চোর ডাকাত, মিথ্যাবাদী সবাইকে মানবিক দিক বিবেচনা করে কবি মানুষ হিসেবে দেখেছেন। তাদের ধর্ম-কর্ম কোনোটাকেই প্রধান্য দেননি। চুরি, ডাকাতি গর্হিত কাজ। সমাজের চোখে যেমন তা অপরাধ, ধর্মীয় দৃষ্টিতে তা পাপ। কবি চুরি, ডাকাতিকে ঘৃণা করলেও চোর বা ডাকাতকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন। তাছাড়া যে সমাজে কম-বেশি সবাই চোর; সেখানে তাদেরকে ঘৃণা করার অধিকার কারও নেই। দরিদ্রের সম্পদ লুট করে ধনীর ঐশ^র্য, প্রজার রক্তের উপর নির্মিত হয় রাজার প্রাসাদ। অসহায়, নিরন্ন মানুষকে ঠকিয়ে মালিকপক্ষ গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় উচ্চশ্রেণি কর্তৃক নিম্মবর্গীয় মানুষকে নির্যাতন এবং তাদেরকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার দিকটি উঠে এসেছে।
“দেখিনু সে দিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?”১৭
‘কুলি-মজুর’ কবিতায় কবি বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মানবসভ্যতার যথার্থ রূপকার সাধারণ মানুষের অধিকারের পক্ষে কলম ধরেছেন। যুগ যুগ ধরে কুলি-মজুরের মতো লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে আজকেই সভ্যতা। কিন্তু সভ্যতার আসল কারিগরেরাই উপেক্ষিত। এক শ্রেণির হৃদয়হীন, স্বার্থান্ধ মানুষ শ্রমজীবীদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু মানবতাবাদী কবি নজরুল দরিদ্র মানুষের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছে। মেহনতি মানষের জন্য শুভ দিনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে লিখেছেন:
“আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।”১৮
‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় কবি সমাজের অস্পৃশ্য ও অবহেলিত নারীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। নারী জাতির প্রতি কবি সংবেদনশীল হয়েছেন এবং নারীদের পুরুষের সমতুল্য বলে ঘোষণা করেছেন। ‘নারী’ কবিতায় কবি নর ও নারীর সাম্য ও সমঅধিকারের কথা তুলেছেন। সভ্যতা বিনির্মাণে নারী-পুরুষের সমান অবদানের কথা উল্লেখ করে কবি নারীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
“সাম্যের গান গাই-
আমার চোখে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশে^ যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”১৯
নজরুল ছিলেন গণমানুষের কবি। শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের কথা তাঁর কাব্যে সাবলীল ভঙ্গিতে চিত্রিত হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্র্ণ ও শ্রেণিবৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে কবি আমৃত্যু মানবতাবাদের চর্চা করেছেন। রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের পাশাপাশি সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার প্রতিও নজরুল বিদ্রƒপবাণ নিক্ষেপ করেছেন। সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব নিয়ে স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত নজরুল সমাজের সব অন্যায় আর অসংগতির বিরুদ্ধে কবিতাকে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সমাজের অবহেলিত এবং নিম্মবর্গীয় নর-নারীর স্বপ্ন ও সংগ্রামকে পরম মমতায় কাব্যরূপ দিয়ে তিনি শ্রমজীবী মানুষের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। সুতরাং এ কথা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, নজরুল সাম্যবাদী কবি, তবে তাঁর সাম্যবাদ অনেকাংশেই মানবতাবোধ দ্বারা পরিচালিত ছিল।
সহায়কগ্রন্থ:
১। রফিকুল ইসলাম প্রণীত ‘নজরুল জীবনী’
২। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘কল্লোল যুগ’
৩। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দতীনের ‘যুগ¯্রষ্টা নজরুল’
৪। মুজফ্ফর আহমদের ‘নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’
৫। শামসুন্নাহার মাহমুদের ‘নজরুরকে যেমন দেখেছি’
৬। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’
৭। সুফী জুলফিকার হায়দারের ‘নজরুল-জীবনের শেষ অধ্যায়’
৮। হায়াৎ মামুদ ‘নজরুল ইসলাম: কিশোর জীবনী’
তথ্যসূত্র:
১। “বিদ্রোহী”, ‘অগ্নিবীণা’, নজরুল রচনাবলী, প্রথম খ-, কেন্দ্রীয় বাঙালা উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা, ১ম প্রকাশ:
১১ই জ্যেষ্ঠ ১৩৭৩, পৃ: ২৬
২। “বিদ্রোহী”, ‘অগ্নিবীণা’, নজরুল রচনাবলী, প্রথম খ-, কেন্দ্রীয় বাঙালা উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা, ১ম প্রকাশ:
১১ই জ্যেষ্ঠ ১৩৭৩, পৃ: ২৮
৩। মাহবুবা সিদ্দিকী, আধুনিক বাংলা কবিতায় সমাজ সচেতনতা, প্রথম প্রকাশ জ্যৈষ্ঠ ১৪০১; মে ১৯৯৪ বাংলা
একাডেমী, ঢাকা, পৃ: ৭৮
৪। ড. আনিসুজ্জামান, নজরুল ইসলাম ও তাঁর কবিতা, নজরুল সমীক্ষণ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সম্পাদিত,
ঢাকা, ১ম প্রকাশ, ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৯, পৃ: ১৭০
৫। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, “নজরুল ইসলাম ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক”, নজরুল সমীক্ষণ, পূর্বোক্ত, পৃ: ৬১
৬। মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল প্রসঙ্গে, প্রথম প্রকাশ কলিকাতা, ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৬, পৃ: ৮৫
৭। ‘ভুত ভাগানোর গান’, বিষের বাঁশী, নজরুল রচনাবলী, প্রথম খ-, কেন্দ্রীয় বাঙালা উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা, ১ম প্রকাশ: ১১ই জ্যেষ্ঠ ১৩৭৩, পৃ: ৭১
৮। মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল প্রসঙ্গে, পূর্বোক্ত, পৃ: ১০৫
৯। “কা-ারি হুশিয়ার”, ‘সর্বহারা’, নজরুল রচনাবলী, দ্বিতীয় খ-, কেন্দ্রীয় বাঙালা উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা, ১ম প্রকাশ: ১১ই জ্যেষ্ঠ ১৩৭৪, পৃ: ৩৭
১০। “হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ”, ফণিমনসা, পূর্বোক্ত, পৃ: ৮৯
১১। মাহবুবা সিদ্দিকী, আধুনিক বাংলা কবিতায় সমাজ সচেতনতা, পূর্বোক্ত, পৃ: ৯২
১২। “মানুষ”, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, দ্বিতীয় খ-, পূর্বোক্ত, পৃ: ৭
১৩। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, “প্রেম ও সৌন্দর্যের কবি নজরুল”, নজরুল সমীক্ষণ, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৯৫
১৪। “সাম্যবাদী”, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, দ্বিতীয় খ-, পূর্বোক্ত, পৃ: ৫
১৫। “ঈশ^র”, ঐ, পৃ: ৬
১৬। “মানুষ”, ঐ, পৃ: ৭
১৭। “কুলি-মজুর”, ঐ, পৃ: ২০
১৮। “কুলি-মজুর”, ঐ, পৃ: ২০
১৯। “নারী”, ঐ, পৃ: ১৪
*অনন্ত পৃথ্বীরাজ, এম. ফিল গবেষক, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়, গাজীপুর।
নষ্ট মেয়ে
নষ্ট মেয়ে
মৃধা মুহাম্মাদ আমিনুল
নষ্ট মেয়ে নাম বিছানা থেকে, অসভ্য জানোয়ার চোখের সামনে থেকে সর। দুর হ বে* মা* (রেগেমেগে কথা বললেন আমার স্বামী) আজকেই আমাদের বিবাহ হয়েছে আজকেই বাসর। বাসর রাত জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ রাত হিসেবে জানতাম, বাসর রাত নিয়ে ধনী গরীব সবাই আলাদা আলাদা স্বপ্ন থাকে। এই রাত নিয়ে আমার হাজারো কল্পনা জমা ছিল, এ রাতটা আমার জন্য খুব স্পেশাল রাত হবে ভেবে রেখে ছিলাম।
সত্যি খুব স্পেশাল রাত হয়েছে, বাবার ৩ কন্যার মাঝে আমিই বড়, বাবা মেয়ে সন্তান পছন্দ করত না, তবুও ভাগ্যর নির্মম পরিহাস আমাকে তার ঘরেই পাঠালেন সৃষ্টিকর্তা। আমার জন্মের পর বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন, মায়ের সাথে সমস্ত সম্পর্ক বাতিল করে দেয়, অভাব-অনটনে বড় হয়েছি আমি, সাজুগুজু করার খুব শখ ছিল আমার। খেলা ধুলা, নাচ গান, গাছে চড়া আমার শখের বাহিরে নয়।
আমার বয়স যখন ৯ বছর তখন বাবা বাড়িতে আসেন, মায়ের কাছে অনুনয়-বিনয় করে ক্ষমা চায়, মা তাকে থাকার জন্য সম্মতি পোষণ করেন। কিন্তু বাবা আমাকে একদম সহ্য করতে পারতেন না। অথচ তার ২য় বউয়ের একটা ছেলে ছিলো তাকে সব সময় আগলে রাখতেন। ছেলেটাকে রেখে ওর মা এক ভ্যান চালকের সাথে পালিয়ে গিয়েছে।
তখন এসব বুজতাম না, এখন বুজতে পারছি সব, দিন দিন সমাজ কত ধ্বংসের পথে চলছে, দেখতে দেখতে আমার বয়স এখন ১৮ বছর। আর আজকেই আমার সাথে এমন আচারন করছে আমার স্বামী।
আমার বিবাহ হয় মামার পছন্দ করা ছেলের সাথে, ছেলে কৃষি কাজ করে, আমি বিবাহে হ্যাঁ বা না সম্মতি পোষণ করার কোনও সুযোগ পাইনি। মামা মায়ের কাছে বলেছে আর মা আমাকে বলছে তোর পলাশের সাথে বিয়ে। গ্রামের বিবাহ গুলো কত নাচ গান হয় আমার বিবাহে একটা কাকও নাচলো না।
আশা ছিলো বাবার বাড়ি সারাজীবন কষ্ট করেছি, স্বামীর সাথে সুখে অমরন কাটিয়ে দিব। কিন্তু তা আর হলো কই.? আমার জামাই বাসর রাতেই আমাকে সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করলেন।আমি নাকি বে* শ্যা। আমার সতীত্ব নাকি আমি বিলিয়ে দিয়েছি।
তার কথা গুলো চুপচাপ শোনা ছাড়া আমার কিছুই করার ছিলো না আর। আমি নারী আমি জন্ম থেকেই অবহেলিত। সমাজে কি আমার মূল্য কখনও দিবে না ইসলামের মত করে কেউ।
ইসলামের মহান বানী সুরাতুন নুর এর ২৬ নং আয়াত কি মানুষ জানে না যেখানে আল্লাহ নিজে বলেছেন " দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্যে; দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্যে; সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্যে এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্যে। লোকে যা বলে এরা তা হতে পবিত্র; এদের জন্যে আছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা।"
মূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে যে, পবিত্র ও চরিত্রবতী নারী পবিত্র ও চরিত্রবান পুরুষের জীবন সঙ্গী হবে। আর বদ চরিত্র পুরুষের জন্য বদ চরিত্রের অধিকারী জীবন সঙ্গীনী হবে। আমার জামাই কি জানে না সে পবিত্র নাকি অপবিত্র। সে পবিত্র হলে তো আমিও পবিত্র।
আল্লাহর শপথ আমি সত্যি পবিত্র, তবে কি এই সমাজের মানুষ প্রথম মিলনে রক্ত পাত না হলে আমাকে পতিতা-দের সঙ্গে তুলনা করবে.? বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে এটা বলা কতটুকু যৌক্তিক আমার বোধগম্য নয়।
মানুষ এখনও পরে আছে এনালগ যুগে। তারা জানে না এসব অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই, হাইমেন (সতীপর্দা) আপনা-আপনি ভাবে অপসারিত হয়ে থাকে, যেমন ব্যায়াম করলে, সাঁতার কাটলে, বাইসাইকেল চালালে, গাছে চড়লে, এমন কি ঘোড়ায় চড়লেও। হাইমেন বা সতীচ্ছদ নামের পর্দা যে কোন ভারী কাজ করলেও আপনা থেকেই ছিঁড়ে যেতে বা উধাও হয়ে যেতে পারে, এমন কি নাচানাচি করলে কিংবা মাসিক চলাকালীন সময় ট্যাম্পুন ব্যবহার করলেও।
এই সংবাদ আমার জামাইয়ের কর্ণকুহরে সাময়িক সময়ের জন্য ও কখনও পৌঁছে নাই। আমার অশ্রুসিক্ত নয়নে কেঁদে কেঁদে বললাম বিশ্বাস করুন আমি আমার সতীত্ব আমানত হিসেবে সংগ্রহে রেখেছি। চুপ কর বে* ( চোখ রাঙিয়ে বললেন আমার স্বামী) আমি আর কিছু বলার সাহস করলাম না, সে একা একা বলতে লাগলেন। আসছে তিনি সৎ। যদি সৎ হইত এই সাদা বিছানার চাদরে রক্ত নাই কেন.?
কথা গুলো এভাবেই লেখা ছিলো ফেরিওয়ালা মামার ঝোলা থেকে পরে যাওয়া লাল টুকটুকে এই ডাইরির প্রথম পাতা থেকে শুরু করে। আমি সবটা পড়ে অবাক হইলাম।
পদাবলি
ধানশালিক
জীবন রাজবংশী
একটি ধান শালিকের সঙ্গে আমার অন্তরে অন্তরে ভাব হয়েছিল খুব।
বড্ড মিষ্টি পাখি জোর আসতো আমার পাকা ধানের ক্ষেতে, খুটিয়ে খুটিয়ে ধান খেতো আর নানান বেশ মজার অঙ্গ ভঙ্গি করত।বড়ো ভালো লাগতো ।
এখন অনেক, দিন হয়ে গেল, আর দেখা হয়নি ।
শেষ যেদিন দেখা হয় সিতার অলঙ্কারের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল সোনালী পাকা ধান। আর কয়েকটি না বলা শুকনো ডানা।
আজও ধান পাকলে ক্ষেতে য়ায়, খুঁজি তাকে। বাতাসে নাচে রুনু ঝুনু তালে সোনালী ধান।
অনেক পাখি আসে, সে আর ফিরল না ,
তার দিকেই আমার টান।
তুমি খুঁজলেই মেঘের নৃত্যে বৃষ্টি হয়
মিসির হাছনাইন
তোমাকে খুব করে চাই দেখা হোক,
প্রিয় কথা শুনি ভালো থাকার শোক।
আরো কত অবসরে মনে পড়ে হৃদয়,
তুমি খুঁজলেই মেঘের নৃত্যে বৃষ্টি হয়..।
আমাকে ভেবো না আমি অসহায় ফুল
ঝরে পরা তোমার চুলে কতগুলো ভুল,
ফুলরে পাপড়ি খোলা বুকরে হুলুস্থুল
পাড় ভাঙা নদীটা’র হারানো এক কূল;
আরো বরিহে হারানো মেঘকাব্য লিখে,
হৃদয়ে হৃদয়ে কথা হয়; ধর্যৈবদ্যিা শিখে
অতরিক্তি রাগী সমুদ্র মিথ্যেবাদী মাছের
সংসার; খোলস পাল্টে শাড়িপরা অরণ,
আরো উপরে হরিণীর চোখের মধ্যে দেখো-
তুমি খুব করে খুঁজলেই মেঘের নৃত্যে বৃষ্টি হয়..।
অ-সুখ
সানাউল্লাহ বিপুল
দুঃখের সমান আকাশ
আকাশের ওপাশে সমুদ্র
সমুদ্রে জল নেই
শুধু লবন আর বালি
চৈত্রে চৌচির নদীর তলি।
রৌদ্রে শুকোয় ক্ষুধার রুটি
নিয়ে দৌড়ায় তৃষ্ণার্ত কাক
জলের মধ্যে জেলে
বৃষ্টির অপেক্ষায়
লবনবিহীন পানির আশায়।
নদী ভাঙনের শব্দ
কলিজা শুকোয় তীরে
নির্ঘুম রাত আকাশে চাঁদ
কলকলানো শব্দে
কারো হৃদয় জুড়ায়।
ক্লান্ত শ্রান্ত জীর্ণ দৃষ্টি
অসীমে চোখ শূন্যে মেলায়।
একই ডালে দুটি মুকুল
সোহেল রানা
একই ডালে দুটি মুকুল
তাকে আলাদা করি কী করে!
আত্মীয় পরিজন কিংবা বন্ধু
কে নাই কার? তাই তো
আমরা শালিক পাখির মতো একই মাঠে
উড়ে উড়ে বসি
গা ঘেঁষাঘেঁষি করি, খাবারের খোঁজ করি
আমাদের ছোট নদী - হড়াই
তার মতো আর কেউ নাই -
ছোট ছোট ঢেউ - যেন মায়ের মতন
তার পরিধিও অনেক
তেমনই আমাদের মাঝে বন্ধন সুতোর মতো,
জড়ানো। সুপ্রাচীন।
আটদাপুনিয়া, সান্দিয়ারা- ফুটে আছে দুটি ফুল
আমি আমিই আছি
মোহাম্মদ আবদুর রহমান
আমাকে দেখলে কি তোমার ভিখারী মনে হয়?
একটি চাঁদের মালিক হয়েও আঁধারে আছি
আসলে আমার এখন কৃষ্ণপক্ষ চলছে
শুক্ল পক্ষে অবস্থান করার সময় অজ¯্র আলো দান করেছি।
তুমিও একটু আলোর জন্য চাতকের মত আর্তনাদ করেছিলে
তোমার শরীরে আলোর মিছিল গড়ে তুলে ছিলাম
কিন্তু ভুলে গেছো সেই দিনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত
গাছের পাতা গুলো হয়তো নতুন
তবে গাছের শাখা প্রশাখা গুলো আজও মনে রেখেছে
নীরবে স্মৃতির স্তুপের মাঝে খুঁজবে নাটকের সেই দৃশ্য গুলো
আসলে তুমি দারুন পালটে গেছো
আমি কিন্তু আমিই আছি।
ফিরে যাবার সনদ
আবু হানিফ জাকারিয়া
নিশ্বাস সমান দুরত্বে দু’জন মানুষ
নিস্তব্ধতা করে রেখেছে তাদের গ্রাস।
মৃদুসুর তুলে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে,
নিঃশব্দে ছাড়া তাদেরই গভীর শ্বাস।
আগন্তুকের মত তৃতীয় কোন প্রাণী
টিকটিক শব্দে জানান দেয় অস্তিত্ব।
ক্ষণস্থায়ী জীবনের সেই শুধু সাক্ষী
আজকের নীরবতা কিংবা নিস্তব্ধতার।
আষ্টেপৃষ্ঠে তাদেরকে জড়িয়েছে
বোবাকান্না, আতংক, মৃত্যুভয়।
দু’জন দু’জনকে অনুভব করে,
হৃদয়ের গহীনেও তাদের বসবাস।
একটু আগেই যে জেনে গেছে তারা
ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় আর বেশিদিন নয়।
কম্পিউটারে ছাপানো সাদা কাগজ
যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যাবার সনদ।
কেউ সুখে নেই
শাহাব উদ্দিন ভূঁইয়া
কেউ সুখে নেই নিজ স্থলে কিংবা কর্মস্থলে,
কেউ দুখে নেই স্ব-শরীরে যত দুঃখ লোকালয়ে।
মানুষ বিলাসিতার চাদরে ঘুমিয়ে রয়, নিজের মৃত্যু ভুলে।
কত-শত চন্দ্রারাত স্বপ্ন আঁকা উঁচু-নিচু ভবন,
সেসব চার দেয়ালে আবার হাজারও বিচ্ছেদের সুর।
কত ভালবাসা-বাসি, কত আহাজারি অশ্রুপাতে শেওলা ভরা দেয়াল।
আসলে কেউ সুখে নেই।
কেউ সুখে নেই নিজ ঘরে কিংবা কবরে,
কেউ দুখে নেই পরিপাটি-গোছানো ঘর, জরাজীর্ণ মন।
দুনিয়ার সমীকরণ কষা-কষি জবাব চলে পরপারে।
হিসাব-নিকাশের ব্যস্ততায় চলে যাবে যুগ-যুগান্তর কিংবা মহাকাল।
তবুও জরাজীর্ণ দেহ পড়ে রবে বেহিসাবে অপরিপূর্ণতায়।
আসলে ইহকাল আর পরকাল কোনো কালেই সুখ নেই, কেউ সুখে নেই।
সুখ বলতে কিছুই নেই, কিছুই নেই।
আমি এক অথৈ দরিয়ার মাঝি
কৃষাণ দ্বিরেফ
নিকষ ভূতূড়ে আঁধারের আলিঙ্গনে
আমি এক অথৈ দরিয়ার মাঝি
যার কোনো একাডেমিক সিলেবাস নেই
সার্টিফিকেটের লোভ দেখিয়ে লাভ নেই
পার্থিব পরীক্ষা দিতে অনিচ্ছুক।
কাউকে বুঝতে; বোঝাতে চাই না আর
ভেতরে জমেছে তরল এসিড
এন্টাসিড প্লাস খেয়ে যুক্ত করে ক্ষার
পানি করে দিচ্ছি কাউকে পাওয়ার সুখ
কারা কাচপোকা সংসারে উৎসুক?
বোঝাপড়া সেরে সাব্যস্ত করার মতো
অতিকায় জ্ঞান অর্জনে অভ্যস্ত
আমি কখনও হতে পারেনি নিশ্চয়
কাউকে লালন করা— আমার স্বভাবে
কখনো যায় না; আমিও তটস্থ।
তরল শরাবে সরল স্বভাবে চলি
নিয়ত দুর্যোগে দুর্বিপাকে ন্যস্ত
কাউকে চাইনি বোঝাতে-বুঝতে আর
চারপাশ ঘিরে আছে অথৈ পারাবার
ফেনিল সলিলে হয়েছি বিন্যস্ত।
জীবনটা দাবার গুটি !
জীবনটা দাবার গুটি
সাহেদ বিপ্লব
মাহবুব সাহেব একটি সরকারি ব্যাংক থেকে সহকারী পরিচালক পদ থেকে অবসর নিয়েছেন প্রায় দশ বছর হলো। এখন তিনি গ্রামে থাকেন। বাবার রেখে যাওয়া জমি এবং তিনি চাকরির সুবাদে বেশ কিছু কিনেছেন এই সবের উপর ভর করে ভালো ভাবেই সংসার চলে যাচ্ছে তার।
মাঝে মাঝে অতিতের কথা মনে পড়ে, আজ একটু বেশি মনে পড়ছে। কি বিলাসিতার জীবন। সরকারি বাড়ি, কাজের লোক, সরকারি গাড়ি। আলিশান অফিস। কি নেই সেখানে। বলা চলে হাত বাড়িয়ে দিলেই হাতের কাছে সব কিছু। জীবনকে যেভাবে আনন্দময় করতে চাই, সেই ভাবে আনন্দময় করা যায় এখানে। বিদেশ ভ্রমণ। সেরাটোনে শিল্পপতিদের আমন্ত্রণ সহ অনেক কিছু।
অবসর নেওয়ার পর মাঝে মাঝে অফিস থেকে ডাক আসতো। স্যার একটু অফিসে আসতেন তাহলে ভালো হতো। এই কাজটা ভালো করে বুঝতে পারছি না। বলেই গাড়ি পাঠিয়ে দিতো এখন আর তা হয় না।
ছেলেমেয়ে সবাই বিদেশে। তাই ভাড়া বাসায় না থেকে এক সময় সিদ্ধান্ত নিলো আর ঢাকাতে নয় গ্রামে চলে যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। একদিন সকল কিছু গুছিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসলেন মাহবুব সাহেব।
এখন তিনি গ্রামে থাকেন। প্রথম প্রথম একটু কেমন লাগতো। এস,এস.সি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকাতে পা রেখেছেন। বলা চলে লেখাপড়া চাকরি সব কিছু ঢাকাতে। যাকে বলে জীবনের সোনালী দিনগুলো ঢাকাতে কাটিয়েছেন।
এক সময় মনে হলো অনেক বছর ঢাকাতে যাওয়া না। একবার ঘুরে আসি কবে পৃথিবী থেকে চলে যাই, তা তো আর বলা যায় না। সেই ইচ্ছা নিয়ে মাহবুব সাহেব ঢাকাতে আসলেন। অনেক স্থানে ঘুরলেন। যেখানে সোনালী দিনগুলো কেটেছে। দেখছেন আর ভাবছেন দশ বছরে ঢাকা শহর কতো পরিবর্তন হয়েছে। যেখানে ছিলো শুধু ধানের খেত সেখানে আজ আলিশান বাড়ি বলেই একটা দীঘশ^াস ছাড়লেন।
অনেক ঘুরে ফিরে এক সময় গিয়ে হাজির হলেন তার সেই ব্যাংকে। যেখান থেকে তিনি সহকারী পরিচালক পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। ব্যাংকের ভিতরে গিয়ে পরিচিত তেমন কাউকে পেলেন না। সকলে তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাকে দেখে কেউ একবার উঠে সালাম দিলো না। একদিন এই অফিসে আসতেই সালামের উপর সালাম। স্যার কেমন আছেন, শরীর ভালো আছে কি-না ইত্যাদি ইত্যাদি আজ তার কিছুই নেই।
অনেক ঘুরে ফিরে বর্তমান সহকারি পরিচালক এর রুমে গিয়ে ঢুকলেন মাহবুব সাহেব।
এটা সেটা নিয়ে কথা হলো কিন্তু বর্তমান সহকারি পরিচালক তাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। এক সময় মাহবুব সাহেব বললেন, আপনি কতো দিন এই চেয়ারে বসেছেন?
এই তো দুই বছর হলো।
ও আচ্ছা।
অনেক দিন কাটিয়ে দিলেন।
তা বলতে পারেন বলেই বর্তমান সহকারি পরিচালক বললেন, আপনি আগে কি করতেন?
এবার মাহবুব সাহেব বলার সুযোগ পেয়ে বললেন, আপনার এই চেয়ার এমন কি এই অফিস থেকে দশ বছর আগে অবসর নিয়েছি। আপনার পিছনের বোর্ডে পাঁচ নাম্বারে যে নামটা দেখছেন মোঃ মাহবুবুর রহমান আমি সেই লোক।
এবার বর্তমান সহকারি পরিচালক একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, তাই নাকি স্যার।
মাহবুব সাহেব একটু মাথা নাড়ালেন।
বর্তমান সহকারি পরিচালক বেল বাজিয়ে চায়ের অর্ডার দিলেন। তারপর বললেন, এখন অবসর জীবন কেমন লাগছে স্যার?
একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বললেন, প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। এতো বড় চেয়ার, চারিদিকে রাজকীয় জীবনযাপন তা থেকে হঠাৎ করে ছিটকে পরলে কি আর ভালো লাগে?
মাহবুব সাহেবের এমন কথা শুনে একটু ভাবনা এলো মনে।
তিনি আবার বললেন, জীবন কি অদ্ভত। ঠিক দাবা খেলার মতো। যখন গুটিকে কোটের উপর সাজানো হয় তখন রাজার কতো দাম। উজির, সেনাপতি, সৈনিক কিন্তু খেলা শেষে যখন সবাইকে এক কৌটার ভিতর রাখা হয় তখন সবাই সমান। আপনি যখন অবসরে যাবেন তখন আমি আপনি সবাই সমান। একটু থেমে আবার মাহবুব সাহেব বললেন, এই চেয়ার ধরে রাখার জন্য জীবনে কতো কিছু করেছি কিন্তু একদিন সব কিছু ছাড়তে হয়। যাদের জন্য আয় করেছি তারা এখন অনেক দূরে, কেউ আমেরিকায়, কেউ কানাডায় আমার খবর রাখার সময় তাদের নেই। আজ ভাবি কাদের জন্য এতো কিছু করলাম?
কথাটা শুনে বর্তমান সহকারি পরিচালক একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়লেন।
আজ আসি। অন্য একদিন আসবো বলেই মাহবুব সাহেব উঠে চলে গেলেন। বর্তমান পরিচালক অবাক হয়ে মাহবুব সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং তার জীবনের উত্তর খুঁজতে লাগলেন।
প্রকাশক
টইটই প্রকাশন
বাংলাবাজার মাদ্রাসা মার্কেট,ঢাকা-১১০০
স্বাধীনতার গল্প
স্বাধীনতার গল্প
শফিক নহোর
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের রাত। আনুমানিক ২ টা বাজে। আমি তখন ঘুমে। বেডের পাশে টেলিফোনটি বেজে উঠল। ফোনটি রিসিভ করলাম, অপর প্রান্ত থেকে পরিচিত একটা কণ্ঠ বলল, ‘মিনু, আমি জয়নাল বলছি।’
আমি অবাক হলাম! এতো রাতে তোমার ফোন?
মিনু,খবর ভালো নয়। এইমাত্র খবর পেলাম পাকিস্তানি মিলিটারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় ইপিআর এবং ঢাকায় অন্যান্য জায়গায় আক্রমণ চালিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে অসংখ্য লোক মারা গেছে খবর পাচ্ছি। আমি একটু পরে খবর জানাচ্ছি, বলেই ফোন রেখে দিল।
জয়নালের কথা শুনে, আমি প্রচ- ধাক্কা খেয়ে উঠে বসলাম। শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল। ঘরে ডিম লাইট জ্বলছে, তবুও কেন জানি মনে হচ্ছে আমি এখন অন্ধকার কোনো কবরের ভেতরে বসে আছি।
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করলাম, নিয়ন আলোতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বুলেটের শব্দ কানে আসতে লাগল। আমার গলা শুকিয়ে আসতে লাগল, পাশের রুম থেকে এক গেলাস পানি ভরে মুখে দিতেই হাত থেকে ছুটে পড়ল গ্লাসটি।
এদিন রাতে ঘুমাতে পারলাম না। মেয়েটা আমার পায়ের কাছে ঘুমিয়ে গেছে। কলেজ বন্ধ, সারা রাত-দিন বাড়িতে একা কোথাও যাবার জায়গা নেই। বাহিরে বের হলে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে যদি ধরা পড়ে ভয়ে কোথাও তেমন বের হতে দেই না ।
মমতার বাবা নারায়ণগঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তা। আমি মেয়ের মাথার চুল নেড়ে দিচ্ছি আর গভীর ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছি জানালার দিকে তাকিয়ে।
সেরাতে উড়ে গেল অতিথি পাখির মতো আমার ঘুম। সকাল পর্যন্ত বসে রইলাম।
তারপর থেকে আমার আর কখনো কথা হয়নি জয়নালের সঙ্গে।
মমতার বাবা ছিল সৎসাহসী একজন দেশ প্রেমিক পুলিশ অফিসার। বঙ্গবন্ধু ছিল তার একমাত্র নায়ক। যিনি স্বপ্ন দেখতেন দেশ স্বাধীন হওয়ার। এ দেশের মানুষ পেট ভরে খেতে পারবে। সবসময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সে ভাবত যে, মানুষ বড়ো হয় সে ছোটোবেলা থেকেই বড়ো বঙ্গবন্ধু ও মহান হৃদয়ের মানুষ ছিলেন।
পরের দিন সন্ধ্যায় পাকসেনা আমাকে এবং আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। আমি মমতাকে নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। আমাদের ভাগ্যে তাই ঘটে গেল। আমাকে চোখ বেঁধে অন্য জায়গায় নিয়ে গেল।
আমি বুঝতে পারছি আমাদের হয়তো বাঁচিয়ে রাখবে না। মমতা হারামিদের কাছে মাথা নত করিস না। মা, আমরা বাঙালি কারও কাছে কখনো মাথা নত করব না। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে মরে যাব, তবুও মাথা নত করবো না। পাকসেনাদের ক্যাম্পে আমাকে নিয়ে যাবে ঠিক এমন সময় এক পাকসেনা বলল,
‘লারকি কো মার ডালো!’
ব্যঙ্গের হাসি আমার কানে সিসার মতো ঢুকতে লাগল, একজন আমার শরীর ছুঁয়ে বলছে,
‘না কালী কো দেখী না গোরী কো দেখী
পিয়া জিস কো চাহে সোহাগন ওহী হ্যায়।’
মমতা আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে! ওর চোখ দিয়ে হয়তো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীটা আমার কাছে বীভৎস অন্ধকার মনে হচ্ছে! জয়নালের মুখাবয়ব আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, ‘মমতা তোকে একবার দেখত ইচ্ছে করছে। আমার এত কাছে তবুও তোকে দেখতে পাচ্ছি না।’ এক ধরনের কাপড় দিয়ে মায়ের চোখ বাঁধা ছিল।
তখন আমাদের চিৎকার চোখের জলের ¯্রােতধারা আবেগের কোনো মূল্য অমানুষ পশুদের কাছে ছিল না। মনের ভেতরে বিশ্বাস ছিল আমরা একদিন স্বাধীন হব বঙ্গবন্ধুর মতো আদর্শবান মহান নেতা কখনো হারতে পারে না।
বুলেটের শব্দ আমার কানে বারবার ধ্বনিত হতে লাগল। জানোয়ারগুলো মাকে খুন করল। আমি পাথরে পরিণত হলাম সেদিন ।
মায়ের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিলাম, ওরা আমাকে দেখতে দেয়নি।
শতবার চিৎকার করে মাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে চাইলাম, জানোয়ার অমানুষগুলো আমাকে দেখতে দিলো না। সেদিন রাতেই আমাকে বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করল। আমি প্রাণভিক্ষা চাইলাম! ওরা কি মানুষ ছিল! জানোয়ার ছিল।
‘পাকিস্তানের সেনাপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী তোমাদের মুখে আমি প্র¯্রাব করে দিলাম।’
মাকে খুন করবার দিনই তো আমি মরে গেছি, তোরা একটা মৃত মানুষের সঙ্গে শত বার যেনা করছিস, কুত্তার বাচ্চা। নিজেকে তখনও অসহায় মনে হয়নি। বেঁচে থাকার একটা স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন হবে আমরা প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেব।
আমাকে ক্যাম্পের পাশে একটা বাড়িতে বেঁধে রাখতো, কোনো কোনো দিন তিন-চারজন আমাকে নিয়ে আদিম খেলায় মেতে উঠত, ‘আমি চিৎকার করতাম আকাশের পাখিগুলো হয়তো কেঁদে উঠত, ঠিক তখন জানোয়ারগুলো হেসে উঠত।’
আমি তখন তিন মাসের পোয়াতি, আমাকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। আমি আত্মহত্যার রাস্তা খুঁজে নিতে ব্যস্ত। এ জীবন দিয়ে কী হবে। পরক্ষণে ভেবেছি, আমি একা মরলে কী হবে। দেশের মানুষ যদি ভাল থাকে। তাদের যদি উপকার করতে পারি, তাহলে হয়তো মরেও শান্তি পাব। রাস্তা পরিবর্তন করে নিজেকে প্রস্তুত করলাম।
মানিকগঞ্জ থেকে নদী পথে আমি বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। বাবার পরিচয়টা আমাকে দারুণ কাজে দিয়েছিল। আমি নিজে যুদ্ধে যোগ দিলাম। যুদ্ধ করলাম। দেশের জন্য মানুষের জন্য। বিভীষিকাময় সেদিনগুলির কথা মনে হলে বড্ড কষ্ট হয়।
নিজের কাছে ভালো লাগে, দেশের জন্য কিছু একটা করতে পেরেছি। আমি শারীরিকভাবে দিন-দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছি; আমার পেটের ভেতর জানোয়ারের বাচ্চা বড়ো হতে লাগল। আমি ৭নং সেক্টরে চলে আসলাম। বাবার অনেক বন্ধু, পরিচিত লোকজন ছিল। রফিকুল ইসলাম বকুল নামে আমার সঙ্গে একজনের পরিচয় হলো, তিনি আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে শিখতে বললেন, একজন নারীর জন্য তখন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে যুদ্ধ করা খুব কষ্টের বিষয় ছিল।
আমি সবসময় ভেবেছি, আমার তো পৃথিবীতে কেউ নেই। বাঙালি যারা আছে তারাই তো আমার মা-বাবা, ভাই ও বোন আমার পরিবার। নিজের ভেতরে একটা প্রতিশোধের নেশা কাজ করেছিল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। বকুল কাকার বিভিন্ন পরামর্শ মতো আমি কাজ করতে লাগলাম ।
বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশে খোঁজখবর নিয়ে দিতাম। বাংলার দামাল ছেলেরা রাতের অন্ধকারে পাক সেনাদের চারদিকে ঘেরাও করে, বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র উদ্ধার করত। ওদের গোপন সংবাদ আমি বিভিন্ন কৌশলে নিয়ে দিতাম।
আমি সুজানগর চলে আসলাম, আমার এক দূর সম্পর্কের ফুফুর বাড়িতে। আমি সেখানে কিছুদিন থাকতে লাগলাম। তার কিছুদিন পরে, প্রচ- গোলাগুলি এক দুপুরে। সুজানগর থানার সাতবাড়িয়া এলাকা জুড়ে রক্তের নদী ভেসে যেতে লাগল। পাকিস্তানি সেনারা সেদিন সাতবাড়িয়াসহ আশেপাশের গ্রামের হিন্দু-মুসলমানসহ প্রায় দুইশত জনের মতো মানুষকে হত্যা করে। একটা সময় যুদ্ধ থেমে গেল।
তার কিছুদিন পরেই আমি মৃত সন্তান প্রসব করলাম! আমি তবুও নিজেকে সুখী মনে করছি। আমার মতন লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে পাকসেনা খেলেছে। অপশক্তির দল এখনো গোপনে-গোপনে পাকসেনাদের দালালি করে। মন বলে মুখের উপর থু-থু ছিটিয়ে দেই।
বুকের ভেতর ঐ একটা স্বপ্ন নিয়েই বড় হয়েছি সেটা হলো বঙ্গবন্ধু। মা বাবা মারা গেল, তাদের কবর থাকে আমার মা-বাবার কোন কবর নেই! কোথায় গিয়ে দু'ফোঁটা অশ্রু ফেলব। বেতারের ফ্রিকোয়েন্সি হঠাৎ সজীব হয়ে উঠল। বেতারে ভেসে এলো স্বাধীনতার ঘোষণা।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মজিব। মার্চ মাসের সেই ভাষণ আমাকে জাগিয়ে তুলে। আমাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়।
দেশ এগিয়ে চলছে, যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখতেন এদেশের মানুষ সুখে থাকবে। এদেশ এগিয়ে যাবে পৃথিবীর সব দেশকে ছাড়িয়ে। স্বাধীনতার গল্প মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু তুমি সমস্ত পৃথিবীর অহংকার।