আমাদের গৌরবময় বিজয়
আমাদের গৌরবময় বিজয়
তাজওয়ার মুনির
মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। আর স্বাধীন থাকতেই পছন্দ করে। কেউ ইচ্ছে করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে চায়না। খাঁচায় বন্দি থাকা পাখিটাই বুঝে স্বাধীনতার মর্ম। আমৃত্যু হাপিত্যেশ করে জিঞ্জির ভেঙে বের হওয়ার জন্য। নিঃসীম নীল আকাশে তার ডানা দুটি মেলে ধরার জন্য। নিজের ইচ্ছেমত জীবন ধারনের জন্য।
স্বাভাবিকভাবে পখির মত মানুষকে খাঁচায় আবদ্ধ করা হয়না। মানুষের পরাধীনতার ধরনটা একটু আলাদা। স্বাধীনভাবে অধিকার ভোগ করায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়াই মানুষের পরাধীনতা। স্বাধীনভাবে মনের ভাব ব্যক্ত করার অধিকার খর্ব হওয়াই পরাধীনতা। মোদ্দাকথা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও নিজের কাজ কর্ম করতে না পারাই পরাধীনতা।
বাঙালির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশির আ¤্কাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায় এদেশের শেষ স্বাধীন নবাব, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজ বেনিয়াদের হাতে পরাজয় বরণ করেন বাংলার এই বীর সন্তান। তারপর কেটে যায় প্রায় দু’শো বছর। এ দু’শো বছর ইংরেজ বেনিয়ারা এদেশের মানুষদেরকে গোলামে পরিনত করে। সবিশেষ ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। জন্মলাভ করে দুটি স্বাধীন দেশ। ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান, আর ১৫ আগস্ট ভারত। আজকের বাংলাদেশ সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান। অর্থাৎ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বর্তমান বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ করা হয়। ক্ষমতার পালাবদল হলেও ভাগ্যের চাকা বদলায় না বাঙালির। ইংরেজদের হাত থেকে ক্ষমতা বদল হয়ে হাতে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানের জিন্নাহ সরকারের।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের জনগন আশা করেছিল পাকিস্তানে তাদের আশা আকাঙ্খা পূর্ণ হবে এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নেমে আসবে সার্থকতার উজ্জল আলোক। কিন্তু পাকিস্তানের কূট রাজনীতি এবং রাজনৈতিক স্থবিরতার কারনে সব ধুলিমলিন হয়ে যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ববাংলা প্রদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশকে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিনত করার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। একের পর এক চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠী বাঙালিদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালায়। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাঙালিদের বঞ্চিত করা হয়। আমাদের জাতীয় জীবনের সমুদয় মূল্যবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এমনকি আমদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে চায়। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মেহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঘোষণা দিল ’উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬% বাঙালি জনগনের মুখের ভাষার পরিবর্তে জোর করে ৮% জনগনের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়।
আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুগে যুগে এতদাঞ্চলের নেতৃস্থানীয় সাহসী ব্যক্তিরা জনসাধারণকে সাথে নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ইতিহাসে, ইশা খাঁ থেকে শুরু করে হাজী শরিয়তুল্লাহ, ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বাঘা যতীন, সূর্যসেন তার জ্বলন্ত প্রতিক। তাঁদের উত্তরসূরি বাঙালিরা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলে। মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন হয়। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি নিজের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় বাংলার দামাল ছেলেরা। আন্দোলনের তীব্রতায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হকচকিয়ে যায় এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তখন থেকেই মূলত বাঙালির বিজয় শুরু...
এরপর, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৭ সালের স্বাধীকার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন সবগুলোতেই সফল ভুমিকা পালন করে বাঙালি জনগন। ৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকচক্র নির্লজ্জভাবে শাসন ক্ষমতা অর্পনে অস্বীকৃতি জানান। ইতোমধ্যেই বাঙালিরা ছয় দফা মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং বাংলার আনাচে কানাচে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। তখন ছয় দফা দাবি রূপ নিল এক দফা দাবিতে। সেই এক দফা হলো, দেশকে স্বাধীন করার দাবী। বঙ্গবন্ধু আন্দোলন অব্যাহত রাখলেন। ঐদিকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ভুট্টোর সঙ্গে আতাত করে ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার উপর ২৫ শে মার্চ কালো রাতে হত্যা নির্যাতন শুরু করে দেয়। কিন্তু ঐদিনের পূর্বে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তাঁর অমর ভাষণে জাতিকে নির্দেশনা দিয়ে স্বাধীনতার পথ সুগম করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জনগনের উপর ঝাপিয়ে পড়লে ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। কয়েকজন নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। কিন্তু চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সমস্ত জাতি ঝাপিয়ে পড়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে। নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি সৈনিক এবং মুক্তিসেনা যোদ্ধারা। শেষে পাকিস্তানী বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে নেয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নব্বই হাজার সৈন্য বাংলাদেশ ও ভারতীয় যৌথবাহিনীর কাছে আতœসমর্পণ করে। এই দিনটিতে বাঙালি প্রায় শোয়া দু’শো বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করে। ইতিহাসে এই দিনটিই বিজয় দিবস হিসেবে পরিচিত।
পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, কর্ণফুলিবাহিত আমাদের বাংলা ব-দ্বীপ তথা বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশের ইতিহাস যদি হয় হাজার বছরের, তবে সেই ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় দিন ১৬ ই ডিসেম্বর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশকে শত্রুমুক্ত করার মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটেছিল এ দিনটিতে। এ দিনটি পৃথিবীর মানচিত্রে একটা নতুন সার্বভৌম দেশের নাম চিরকালের জন্য এঁকে দিয়েছে। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম ও ত্রিশ লাখ শহীদের তাজা রক্ত ও অগণিত মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এ দিনে আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছি। বিজয়ের এ সুখস্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার নয়। আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে যুগ যুগ ধরে এ দিনটি আমাদের প্রেরণা যোগাবে। বহু ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে ১৬ ডিসেম্বরকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়। বিজয় দিবস যে কোন জাতির জন্য অতি মহান ও তাৎপর্যপূর্ণ দিবস। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। কিন্তু বিজয় দিবসের গুরুত্ব কমেনি এতটুকু। এই দিনটির মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মকে ও বিশ্ব কে বার বার মনে করিয়ে দেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, শহীদদের কথা। দিনটি মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশ নামে একটি দেশের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের কথা, যা প্রতিটি বাঙালি তার হৃদয়ে ধারণ করে আছে।
পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জাতীয় দিবস রয়েছে বিভিন্ন উপলক্ষ, কারণ ও তাৎপর্য অনুযায়ী। সেই উপলক্ষ ও তাৎপর্য জাতিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু ভিক্টরি ডে বা বিজয় দিবস এর তাৎপর্য সব দেশে একই। এই দিনে দল-মত নির্বিশেষে সমগ্র জাতি এক হয়ে জাতির কোন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে জয়লাভের স্মৃতিচারণ করেন। একদিকে যেমন গৌরবে তাদের বুক ফুলে উঠে, উল্লাসে ফেটে পড়ে, অপরদিকে দেশের এই গৌরব এনে দিতে যারা প্রাণদান করেছেন, তাঁদের স্মৃতিচারণ করেন, এবং অংশগ্রহণকারী যারা সেই গৌরবের যুদ্ধের পর এখনো বেচে আছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
মুক্তিযোদ্ধারা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা হাজার বছরের সংগ্রামের পরিণতি। তাঁদের বীরত্বের কাহিনী বাঙালি হৃদয়ে সর্বদা জাগ্রত থাকবে। তাঁদের আতœত্যাগের ফসল নষ্ট হয়নি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধসহ স্বাধীকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব বীর শহীদদের বীরত্বগাথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। দুখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রকৃত চেতনাকে আজ আমরা হারাতে বসেছি, ভুলতে বসেছি। নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাস বিস্মৃত হতে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরউন্নত রাখা ও নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঠিক চিত্র তুলে ধরা একান্ত অপরিহার্য। এই চেতনা ও বিজয়ের আনন্দ পৌছে দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে...
স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ৪৮ বছরের এ পথপরিক্রমায় সে স্বপ্ন পূরনের হিসাব মেলাতে চাইবে সবাই। এর মধ্যে আমাদের অনেক চড়াই-উতরাই মোকাবেলা করতে হয়েছে। রাজনীতি এগিয়েছে অমসৃণ পথে। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনাকাঙ্খিত ঘটনায়।
ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মহান বিজয় দিবস। পেয়েছি স্বাধীনতা। এ দিন উদিত হয় আমাদের আকাশে নতুন সূর্য। এ স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে। আমাদের কাজ সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। বিজয় দিবস শুধুই আমাদের বিজয়ের দিন নয়, এটি আমাদের চেতনা জাগরনের দিন। তাই এদিনে প্রতিটি বাঙালি নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় দেশকে গড়তে, বিশ্ব সভ্যতায় আমরাও যেন সবার সামনে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারি। যেন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি। অথনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারি। অশিক্ষা ও দারিদ্র থেকে দেশকে মুক্ত করে একুশ শতকের অগ্রযাত্রায় সামিল হতে পারি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যেমন স্বাধীনতা পেয়েছি, তেমনি রক্ষা করতেও প্রয়োজনে আরও এক সাগর রক্ত দেবো। প্রতিবছর আমরা বিজয় দিবস পালন করি শুধু বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়। এ বিজয়কে সত্যিকার অর্থে কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।
বিজয়ের পদাবলি : ০১
দেশ
কাদের চৌধুরী
এ কেমন দেশ, যেখানে রুগ্ন নদীর স্তনে মায়ের কবরে
ফনী মনসার মত ভেদ করে উঠছে বহুতল শহর।
এ কেমন দেশ, মূর্খ মোল্লা ধূর্ত পুরোহিত
অস্পৃশ্য আমলা, ছিচকে রাজনীতিক, সরকারী সাহিত্যিক
তৃতীয় শ্রেণীর অধ্যাপক, বেকার সাংবাদিক
দিনে দুপুরে গড়ছে অনৈতিকতার নহর।
হারামখোর পিতার অনুমতি নিয়েই।
এ কেমন দেশ, জন্মের আগেই নিস্পাপী মৃত্যুর মহড়া
এ কেমন দেশ, বাপের হাতে মেয়ে ধর্ষিতা
ছেলের হাতে বৌ’য়ের হাতে বৃদ্ধা মা লাঞ্ছিতা
রাষ্ট্রের অগ্নিচোখে একাত্তরের নাগরিকরা দিশেহারা।
এ কেমন দেশ, যেখানে মুক্তবুদ্ধির প্রাণীরা বিকলাঙ্গ বা বোকা
হিটলারের নিঃশ্বাসে যুক্তির ঝর্না স্তব্ধ
বিবেকের তৃণভূমি যেন বধ্যভূমি,
বিশ কোটি মানুষ যেন ঝিঁঝিঁপোকা।
এ কেমন দেশ, যেখানে আকাশ আজ পরাধীন
মানুষ হাঁস মোরগ গাছ মাছ মৌমাছি সবাই পরাধীন
ম্যানুয়ালি বা ডিজিটালি।
নদী শুষিত
হাওড় হজম
বায়ু বিকৃত
পাহাড় পেটে
তা দেখে,
এমন বাঘ নেই, হুঙ্কার দেবে: ‘এবারের সংগ্রাম...’
কোন বেত্তমিজ কবিও নেই, লিখবে: ‘এখন যৌবন যার ...’
কিংবা, ‘সুখ দে হারামজাদা ...’ ।
মনোযোগ দিয়ে দেখুন -
মনুষ্যত্ব নিখোঁজ বা খুন।
উপর থাকে নীচে।
সুখ কোথায় আছে?
উন্নয়নের কাছে?
গাঁও-গেরাম শহর-বন্দর মাঠ-ঘাট নদী পাহাড়
এ সবই এখন এক জাতীয় কারাগার ।
গন-দাসত্বের চিৎকার যেন দেশাত্মায় নিমজ্জিত আদর্শ।
এ দেশে ব্যবসায়ীক ধর্মশালা এখন ধর্ষণশালা
শিশুর শেষ নিঃশ্বাস, মেধাবী তরুনের রক্তাক্ত কান্না
ধর্ষিতার চিৎকার বধিরের কাছে বিপ্লবী প্রার্থনা
ঈশ্বরপিতা উৎখাতের প্রার্থনা
সমাজপিতা উৎখাতের প্রার্থনা
কে শুনবে যার তার প্রার্থনা ?
এ দেশে, জগৎপিতার কোষে কোষে অসভ্য চেতনা ।
একাত্তরের ধ্বংসাবশেষে ।
বিজয় তোরণ
সিত্তুল মুনা সিদ্দিকা
হে
অগ্রহায়ণ,
করেছি বরণ
শিশির ভেজায় চরণ
ডিসেম্বরের বিজয় তোরণ
লাল সবুজে বাঁচি দীপ্ত চেতনায়।
টুপ্টাপ্ শেফালী ঝরে এই নিরালায়
খেঁজুরের রসের গন্ধ পাই পূবের জানালায়
কুয়াশায় সোনালী রোদ উঁকি দেয় অবলীলায়!
আমারা বাঁধা পড়েছি আমৃত্যু দায়ে, প্রজন্মের ঋণে;
লক্ষ শহীদের রক্তে উষ্ণতায় নিয়েছি এ স্বদেশকে চিনে
ভাসাই এবার আশার ঘুড়ি এমনি এক স্বপ্নময় দিনে
লালিত স্বপ্ন সুখের আবেশ ছড়ায় মনের গহীনে
তাই বাঁচি দেশপ্রেমের আনন্দ অশ্রু জলে,
বিজয়ের আলেখ্য ঐ জনতার ঢলে!
অস্তিত্ত্বের চিহ্ন রয় এই ধরাতলে
সবাই পায়ে পায়ে চলে।
এদেশের স্বরূপ,
কি অপরূপ
রে!
দুর্গম পথের যাত্রী
পৃথ্বীশ চক্রবর্ত্তী
কাকে নিয়ে স্তুতি-গান, কার আজ শুনি জয়ধ্বনি
উপাস্য দেবতা কে সে, কার ধ্যান করছে ধরণী
কার কাছে নত বিশ্ব, মহাবিশ্ব, অজানা প্রকৃতি
এত গর্ব অর্জিছে কে, পেয়েছে কে দুর্জয় স্বীকৃতি
দিগি¦জয় কে করেছে-এ যুগ চায় আজ কাকে?
দুর্গম পথের যাত্রী বলি তাকে।
এক এক করে চালাচ্ছে কে, দুঃসাহসী মহাভিযান
কে সে আজ উড়ে চলছে, সৃষ্টি করে মহাকাশযান
নতুন নতুন পথ করে ছুটতেছে কে, কিছু অন্বেষণে
এভারেস্টে যাচ্ছে কে সে, যাচ্ছে কে সে সাগর লঙ্ঘনে
আঘাত হানছে বুকে বার বার রহস্যকে কে?
দুর্গম পথের যাত্রী বলি তাকে।
ভয়হীন বীর কে সে, কার কাছে মৃত্যু কৌতূহল
জরা,ব্যধি জয় করে, চিকিৎসায় কে আজ সফল
জীবন পশরা নিয়ে, কে সে এলো পৃথিবীর মাঝে
বসুন্ধরা কে সাজাচ্ছে নতুন এবং আধুনিক সাজে
বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক কলে, দুর্লভ সুলভ করছে কে?
দুর্গম পথের যাত্রী বলি তাকে।
ঝোপঝাড় কেটেছে কে, মেরেছে কে কুসংস্কারে কূপ
জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে কে দিতেছে পৃথিবীরে প্রাত্যহিক রূপ।
মানে না কে শাস্ত্রগ্রন্থ, মানে না কে সামাজিক প্রথা
দুর্দম, দুর্বার বেশে ছুটে চলছে কে সে যথাতথা
অজানাকে জানতে ও অদেখাকে দেখতে যাচ্ছে কে?
দুর্গম পথের যাত্রী বলি তাকে।
স্বর্গের বাগান থেকে কে এনেছে পারিজাত ফুল
জীবনের প্রয়োজনে কার কাছে ধরিত্রী আকুল।
গ্রহ হতে গ্রহান্তরে পাড়ি দিচ্ছে কে সে রোজ রোজ
নতুন নতুন প্রযুক্তিতে কে করছে অমৃতের খোঁজ
দুর্গম পথ সুগম করে অসাধ্যকে সাধন করছে কে?
দুর্গম পথের যাত্রী বলি তাকে।
সভ্যতার মুখোশ
ওহাব মণ্ডল
জিপার খুলে দাঁড়িয়ে মুতে দেয় সভ্যতা।
পতিতার ঠোঁটে সুখ খোঁজে কামুক সমাজ।
তারা সজ্জিত রাত শেষ হয়ে আসে।
স্টেশনের পাগলি গুলোর পোঁয়তি হওয়ার গল্প সমূহ
থেকে যায় অরচিত।
সোডিয়াম বাতির আলোয় ভিজে যাওয়া
পোড়ামাটির রঙ্গমহলে
দৈনিক চলে সভ্যতার সঙ্গম।
কর্পূরের শোকে পৃথিবী শক্ত পাথরে পরিণত হয়েছে।
আমি আদিম!!
দরবার আতরের খুশবোতেই সীমাবদ্ধ
আমার রোজ জীবন।
সোনালী বিজয়
খায়রুল আলম রাজু
কবিতা বা গল্প নয়,
সু-দীর্ঘ উপন্যাস তুমি!
তুমি হৃদয়ের নীল রঙ, আকাশের নীলিমা;
তুমি জ্যোৎস্না মাখা রাত্রি, চাঁদের প্রেয়সী তুমি!
তুমি শীতের সকাল, ভোরের পাখি;
ঘন কুয়াশার চাদরে এক চিলতে হাসি তুমি ।
সোনালী সূর্যোদয়ে তুমি নীলাভ আকাশ:
দিগন্ত মাঠে ‘সবুজ শাড়িতে তুমি কচি ঘাস;
তুমি সুখের বালুচর, সুখের কোষাগার!
তুমি মা, তুমি বাবা, তুমি ভাই, তুমি বোন,
তুমি আমার ‘সোনালী ইতিহাস’;
তুমি রক্ত-আগুন, বুলেট-বোমা,
আর্তনাদ পেরিয়ো, তুমি বিজয়!
‘তুমি আমার লক্ষ ভাইয়ের লাল বৃত্ত’!
সবুজ শাড়ির ঠিক মাঝখানে রক্তের পূর্ণ চাঁদ!
তুমি আমার গর্জে উঠা সোনালি সকাল,
তুমি আমার পতাকা, তুমি আমার সোনালী বিজয়!
স্বাধীনতা
শিরিন আফরোজ
স্বাধীনতা তোমায় পেতে
কতো-কতো-মা যে সন্তান হারা হয়েছিলো!
কতো-কতো-সন্তান মাকে বলে গিয়েছিলো
মা বিদায় দাও, স্বাধীনতা অর্জন করে তবেই ফিরবো,
ফিরেছে কয়জন, ফিরে নাইও কতোজন?
ছেলের শোকে বৃদ্ধ রহিমা চাচী আজো গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে,
শফিক চাচা বয়সের ভাড়ে নইয়ে পড়েও সংসার চালাতে দ্বারে দ্বারে কাজ খুঁজে।
স্বাধীনতা তোমায় পেতে
কতো-কতো- নারী হারিয়েছে তাদের ইজ্জত,
হায়েনার লালসার শিকার হয়ে হারিয়েছে প্রাণ, হারিয়েছে মানসম্মান ।
স্বাধীনতা তোমায় পেতে
ঝড়েছিল কতো শতো তাজা প্রাণ,
সে সব প্রাণের বিনিময়ে আসলো স্বাধীনতা,
রক্ষা হলো দেশের মান।
বিজয়ের পদাবলি : ০২
তুমিই আমার বিজয়
সুমন আহমেদ
বাবা নেই ভাবতেই এলোমেলো হয়ে যাই আমার পুরো পৃথিবী,
আজ কতদিন দেখিনা আমার আকাশে তোমার প্রতিচ্ছবি।
বাবা তুমি নেই- তবুও তুমি আছো বিজয়ের লাল-সবুজের চিত্রে-
বাংলার আকাশে-বাতাসে বঙ্গ মানব দেহের শিরা-উপশিরা
বিন্দু-বিন্দু রক্তকণিকায়- বিজয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে।
বড্ড বেশি ভালোবাসতে দেশকে; তাইতো দেশও দেশের
মানুষের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছো...
জানো বাবা, সাদা শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে মা আজও কাঁদেন,
জানি তুমি ফিরবে না; তবুও নিরাশার বালুচরে আশার প্রদীপ
জ্বালিয়ে তোমার ফেরার মিথ্যে আয়োজনে দীর্ঘ প্রতীক্ষার
বাঁধ ভাঙেন রোজ; বাবা, তুমি আমার গর্ব; তুমিই আমার বিজয়।
মানচিত্র
সোহেল রানা
যদি ভালোবাসতে চাও
ভালোবাসো সবুজ;
যদি ভালোবাসতে চাও
ভালোবাসো লাল;
যদি ভালোবাসতে চাও
ভালোবাসো লালে লাল আর সবুজে সবুজ।
তাহলে পেয়ে যাবে অজস্র ভালোবাসার সমাহার:
সবুজ বৃক্ষ, সবুজ তৃণ, সবুজ সুশীতল
লাল কৃষ্ণচূড়া-লাল গোলাপ-লাল জবা
পেয়ে যাবে এদের মতো যারা-
তোমার অজস্র ভালোবাসার সমাহার,
ভালোবাসার সাগর আর ভালোবাসার প্রশান্তি।
আর যদি নিজেকে ভালোবাসার আগুনে ঝালিয়ে নিতে চাও
ভালোবাসা খাঁটি গৌরবান্বিত করতে চাও
তাহলে ভালোবাসো বাংলার আকাশের রক্তিম সূর্য!
বাংলার মানচিত্র- বাংলার লাল সবুজ পতাকা-
তাহলে পেয়ে যাবে বাংলার জনক-জননী, ভাই-বোন
প্রেমিক আর প্রেমিকার গৌরবমন্ডিত ভালোবাসা।
তোমার ভালোবাসা শহীদের রক্তের আগুনে পুড়ে খাঁটি হবে !
তোমার ভালোবাসা গৌরবের হবে !
তোমার ভালোবাসা প্রশন্ত হবে !
তোমার ভালোবাসা অম্লান হবে।
ষোলোই ডিসেম্বর
শরিফুল ইসলাম
বিজয় মানেই অট্টহাসির মুখ বাঁকা ঐ সুখ,
বিজয় মানেই তোমার প্রেমের মন ব্যামো ঐ রোগ!
বিজয় মানেই মন কাড়া ঐ নোটন নোটন ছড়া,
বিজয় মানেই মুখের কথায় নতুন স্বপ্ন গড়া।
বিজয় মানেই রাজ্যসভায় আমরা সবাই রাজা,
বিজয় মানেই রুক্ষ সমাজ নেই তো কোনো প্রজা,
বিজয় মানেই রক্ত হলির একাত্তুরে কবর,
বিজয় মানেই স্বাধীন দেশের ষোলোই ডিসেম্বর।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি
মোজাম্মেল সুমন
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি মুয়াজ্জিনের মুগ্ধকরা সুমধুর সুরের তালে,
কিংবা বিজয় দেখি সকালের সূর্যের আলোতে যখন ছোঁয় বাঙলা মায়ের গালে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি শঙ্খের ধ্বনিতে যার ধ্যান, চৈতন্য, আনন্দ আছে,
কিংবা বিজয় দেখি পবিত্রতার নীরব প্রার্থনাতে যা পৌঁছে দেয় মহান ¯্রষ্টার কাছে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি সোঁদামাটিতে মোহনিয়া ঘ্রাণময় পল্লী গাঁয়ে,
কিংবা বিজয় দেখি কিশোরীর হাতের মেহেদিতে আর আলতা রাঙা দুটি পায়ে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি দালানকোঠায় সুসজ্জিত ব্যস্ত সমস্ত শহরে,
কিংবা বিজয় দেখি কলকারখানার কর্মীদের শ্রমের পরেও বিশ্রাম পহরে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি লাউয়ের ডগায়, বাঁশঝাড়ে, মাছভরা পুকুরে,
কিংবা বিজয় দেখি রাখালের বাঁশির সুরে উদাসকরা রোদেলা দুপুরে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি খালেবিলে নদনদীতে ধ্যানী বকের সারিতে,
কিংবা বিজয় দেখি ভাওয়াইয়া গানের তালে ছুটেচলা মহিষের গাড়িতে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি শিশুকিশোরের প্রাণখোলা হাসির মায়াতে,
কিংবা বিজয় দেখি মাঝির বৈঠা হাতে নৌকার প্রতিচ্ছবি জলের ছায়াতে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয়দেখি সবুজ অরণ্যে পাখপাখালির কলতান সভায়,
কিংবা বিজয় দেখি কলমিশাকে, শাপলাফুলে, রজনীগন্ধায় আর জবায় ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি কৃষকের প্রিয় একজোড়া লাল গরুর মাঝে,
কিংবা বিজয় দেখি কাদামাখা দেহে লাঙল জোয়াল নিয়ে ফিরতে সাঁঝে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি লাল সবুজের পতাকা ওরে যখন আকাশে,
কিংবা বিজয় দেখি শীতে গ্রীষ্মে বর্ষায় শরতে হেমন্তে আর বসন্তের বাতাসে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি রাজপথের স্লোগানে বাংলা বর্ণমালায়,
কিংবা বিজয় দেখি প্রতিটি গৃহে, শিক্ষালয়ে, কর্মালয়ে আর ধর্মশালায় ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি মা-বাবা আর ভাইবোনের মায়া মমতায়,
কিংবা বিজয় দেখি গণতন্ত্রের সংবিধানেতে সরকার ও জনগণের ক্ষমতায় ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ পদ্যে,
কিংবা বিজয় দেখি সহজসুন্দর বাঙালিদের সহজসরল জীবনের গদ্যে ।
আমি স্বাধীনতার বিজয় দেখি শহিদদের জন্যে ডিসেম্বরের ষোল তারিখে,
কিংবা বিজয় দেখি বিশ্ব যখন বাঙালিদেরকে ভালোবাসে শ্রদ্ধায়, তারিফে ।
বিজয় দিবসের বিশেষ গল্প : সুরবালা
সুরবালা
রফিকুল নাজিম
চা বাগানের ৬নং লাইনে একটা লাশ পড়ে আছে। ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধার লাশ। চা শ্রমিকেরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে সেদিকেই ছুটছে। পুরো বাগানে শোকের মাতম পড়েছে যেনো। সুরবালা আর নেই। ঘাসের উপর পড়ে আছে তার শূন্য খাঁচা। সুরবালার মুখের কাছে ভনভন করছে কয়েকটা মাছি। মুহূর্তেই বেশ লোকের জমায়েত হয়ে গেলো। হরিদাসী একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,‘বুড়িটা মরেই বাঁচলো গো!’ নৃপেন কয়েক ঢোক চোলাইমদ পেটে চালান দিতে দিতে গান ধরলো, ‘ওলো সই, তোর যা ছিলো নিলাম কেড়ে/ওলো সই, আয় ঘর বানামু বাগান ছেড়ে।’ সকালের আয়ু বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আসছে পুলিশ, সাংবাদিক ও প্রশাসনের হর্তাকর্তারা। আজ শুধু সুরবালার দিন। একজন পুলিশ লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বার্ধক্যজনিত মৃত্যু। তবুও পোস্টমর্টেম করা জরুরি। তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। সুরবালা এই প্রথম চা বাগানটা পেছনে রেখে চলে যাচ্ছে। চা গাছগুলো কেমন নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে! আহা রে জীবন!
০২.
২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেদিন অনেকে মায়ের আঁচল ছেড়ে ধরেছিলো থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রেমিক তার হাতের ফুল ফেলে ধরেছিলো এলএমজি। সেদিন কৃষক লাঙ্গল ছেড়ে ধরেছিলো স্টেইনগান। সেদিন ছাত্ররাও কলম ছেড়ে হাতে নিয়ে ছিলো বন্দুক। শিক্ষকের হাতেও ছিলো চকের পরিবর্তে গ্রেনেড। সেদিন চা শ্রমিক সুসেনও দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি ফেলে হাতে তুলে নিয়েছিলো অটোমেটেড রাইফেল। হ্যাঁ সুসেন বাড়ুঐ। ১৬ বছরের টগবগে কিশোর। প্রাণ চাঞ্চল্যে সুসেন যেনো বন্য হরিণের মতোন। যুদ্ধে যাবার রাতে সুরবালার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সুসেন বলেছিলো, ‘তুই পালারে সুরবালা। শুন, ভোরে জলেশ্বরীরাও চলে যাবে ওপার বাংলায়। তুইও চলে যাস সাথে।’ সেইরাতে সুরবালা কোনো মায়ার বন্ধনে কিংবা চোখের জলে আটকাতে পারেনি সুসেনকে। চোখের জলেই বিদায় দিয়েছিলো তাকে। সেইরাতে সুসেন ৬নং লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিলো। সুরবালা সেই দৃশ্য একা দেখেছিলো।
০৩.
নভেম্বর, ১৯৭১। বাগানে ভটভট করে এগিয়ে এলো কয়েকটা জলপাই রঙের জিপগাড়ি। খাকি পোশাক পরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। বড়বাবুর ডাক বাংলোয় স্থাপন করলো ওদের ক্যাম্প। লেফট রাইট করতে করতে ওরা হাঁটে। ওদের খেদমতে জহির মোল্লা নিজেকে উৎসর্গ করেছে স্বর্গ পাওয়ার আশায়। বাগান প্রায় জনশূন্য। লাইনগুলোও ফাঁকা। চায়ের কচি পাতাগুলো বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে অযতেœ। সুরবালা ছোটবাবুর বাংলোয় টুকটাক কাজ করে। ঘর ছাড়ু দেয়। ধোয়ামোছা করে। ছোটবাবুর ঘরেই ঠাঁই হয়েছে মা বাপহীন সুরবালার। ছোটবাবুর কাছেই বর্ণের সাথে পরিচয় হয় তার। সুরবালা গোপনে আড়ালে চিরকুটটা পড়ে আর একলা একা হাসে। এক সন্ধ্যায় ছোটবাবুর চায়ের নিমন্ত্রণ রাখতে মেজরসহ চার পাঁচজন সৈন্য এলো। চা পর্ব শেষ করে চলে যাওয়ার সময় কি জানি মনে করে মেজর সাব উনুনঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন সুরবালাকে। তেরো বছরের সুরবালা। মেজর চিৎকার করে বললো, এহি খুব সুরুত লাড়কি হে। সুরবালাকে টেনে হিঁচড়ে নিতে চাইলে ছোটবাবু পায়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো, হুজুর, এহি ছোটকা আদমি হে। ছোড় দো, হুজুর। মেজরের ইশারায় ছোটবাবুর বুকে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করলো অপর দুই সৈনিক। জোর করে জিপগাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সুরবালাকে। সদ্য জবাই করা মুরগির মতোই ভয়ে থরথর করে কাঁপছে আর কাঁদছে সুরবালা। তারপর সুরবালার এই ছোট্ট শরীরের উপর সারারাত চললো নির্যাতন। ক্ষতবিক্ষত যোনি থেকে ঝরছে রক্ত। সেই রক্তে ভিজে গেলো মাটি। বাগানের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হলো সুরবালার আর্তচিৎকার।
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ক্যাম্পের এখানে সেখানে কুকুরের মতো পাক হানাদারদের সারি সারি লাশ পড়ে আছে। অর্ধমৃত সুরবালা টলতে টলতে বের হয়ে আসে ক্যাম্প থেকে। তখনো থেমে গুলি হচ্ছিলো। সুরবালা ৬নং লাইন ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। সামনেই দেখে একটা লাশ পড়ে আছে। লাশটা উল্টিয়ে সুরবালা সুসেন বলে প্রচন্ড এক চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর থেকেই সে পাগল। অর্ধনগ্ন হয়ে সারা বাগান একা একা হাঁটতো। সবচেয়ে বেশি ৬নং লাইনে বসে বসে কাঁদতো আর বুক চাপড়াতো। আমৃত্যু সে আর কারো সাথে কোনো কথা বলেনি।
০৪.
উপজেলা চত্বরে একটা কফিনে শুয়ে আছে সুরবালা। জাতির সবচেয়ে দামী জিনিসে আজ মোড়া সে।জাতীয় পতাকায় ঢাকা তার ৪৮ বছরের অর্ধনগ্ন শরীর। একজন বীরাঙ্গনাকে পুলিশ সদস্যরাও রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর জন্য প্রস্তুত। এদিকে প্রস্তুত ক্যামেরা হাতে টিভিওয়ালারা ও খবরের কাগজওয়ালারা। দামী দামী ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে চিৎকার করে উঠে সুরবালার আত্মা!
ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশ্বেষ অন্ধকার : পর্ব ০২
অনিঃশ্বেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ
[গত সংখ্যার পর]
৩.
এক রাতে কথা বলতে বলতে নিলয় বলল, সুমাইয়া, তোমাকে একটা কথা বলবো বলে ভাবছিলাম।
একটা কথা ! কত কথাই তো বলছেন এতদিন ধরে।
কিন্তু আসল কথাটা যে বলি বলি করেও বলা হয় নাই। গান আছে না-কত কথা যাওগো বলে কোনো কথা না বলে।
কেন, বলা হয়নি কেন ? বলেন আপনার আসল কথা।
তুমি আবার কিভাবে নিবা.....।
কিভাবে নিবো মানে ?
কিছু যদি মনে করো ?
আরে নাহ ! আপনি যা বলার বলুন। আমি কিচ্ছু মনে করবো না।
সুমাইয়া, অনেক আগে থেকেই-তুমি যখন সেই সিক্স/সেভেনে পড়ো তখন থেকেই তোমাকে আমার পছন্দ। কিন্তু কথাটা বলার সুযোগ পাই নাই। আর তুমিও তখন ছোট ছিলা। তো ফোনে কথা বলতে বলতে সহজ হয়ে যাওয়াতে.....। আমি তোমাকে ভালোবাসি সুমাইয়া। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ ভেরি মাচ।
নিলয় ভাই !
সে ফোন কেটে দিল। তার বুকের ভেতর ভীষণ ধরপর করছে। তার শরীরটাও যেন কাঁপছে। জীবনে কারও কাছ থেকে এরকম একটা কথা কখনো শুনবে তা সে কল্পনাও করেনি।
সে পানি খেলো এক গ্লাস। পানি খেয়ে খাটের উপর শান্ত হয়ে বসলো। চোখে ভেসে উঠল নিলয়ের মুখ। ফর্সা, গোলগাল মুখ। মাঝারি গড়ন। জেল দিয়ে খাড়া করে রাখা চুল। জিন্স আর টি-শার্ট পরনে। হাতের কব্জিতে ব্রেসলেট কয়েকটা। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। ভীষণ স্মার্ট ছেলে! মফস্বল তো অনেক পরের কথা, ঢাকা শহরে এমন ছেলে খুব কম দেখা যায়। সে অস্ট্রেলিয়া যাবে। অস্ট্রেলিয়া মুখের কথা না। তার সমস্ত অস্তিত্বে অন্যরকম একটা পুলক খেলে গেল। তার মনে হল, নিলয়ের কাছ থেকে এই শব্দটা শোনার জন্য সে কতদিন অপেক্ষা করে আছে। নিজেকে কেমন স্বার্থক মনে হতে লাগলো। কেউ যদি কোনোদিন ‘ভালোবাসি’ কথাটা না বললো তাহলে জীবনের কী স্বার্থকতা ?
সে আরেক গ্লাস পানি খেল। তারপর নিলয়কে ফোন করল। ফোন ঢুকলে নিলয় ফোন কেটে দিল। সে তাই করে। ফোন কেটে দিয়ে সে নিজে ফোন করে। এ ব্যাপারটা তার জানা। কিন্তু আজ তার মনটা কেমন যেন করে উঠল। মনে হল-কেন সে আমার ফোন কেটে দিল? কেন?
নিলয়ের রিটার্ন ফোন এলে সে অনুযোগের সুরে বলল, আমার কল কেটে দিলেন কেন?
আমি তো সব সময় তাই-ই করি। তোমার ব্যালেন্স আমি খরচ করবো কেন?
আমার ব্যালেন্স তো আপনিই দেন।
আমি দেই অন্যের সাথে কথা বলার জন্য। শোন, তখন তুমি হঠাৎ লাইন কেটে দিলা কেন?
কখন?
আমার কথাটা শোনার পরেই তো তুমি লাইন কেটে দিলা।
ও, মা ডেকেছিল।
মিথ্যা বলাটা এতদিনে তার কাছে খুব সহজ হয়ে গেছে। উপস্থিতভাবে চমৎকার সব মিথ্যা এসেও পড়ে। প্র্যাকটিস মেকস এ্যা ম্যান পারফেক্ট।
নিলয় বলল, তাই বলো, আমি আবার ভাবলাম মাইন্ড-টাইন্ড করলা কিনা।
আরে না, মাইন্ড করবো কেন?
মেয়েদেরকে তো সব সময় বোঝা যায় না। আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো, তোমাকে ভালবেসে কি আমি ভুল করেছি?
ভুল করবেন কেন?
আমি কি তোমার ভালবাসা পাবার যোগ্য না?
যোগ্য হবেন না কেন?
তুমি কি আমাকে ভালবাসো?
নিলয় ভাই, অন্য কথা বলেন।
অন্য কথা বলবো কেন? শোন, আমি এক হাতে তালি বাজাতে চাই না। আমি তোমাকে ভালবাসি, তুমি যদি আমাকে ভাল না বাসো তো স্লামালিকুম। ঐ ফ্যাচর ফ্যাচর করার স্বভাব আমার নাই।
ফ্যাচর ফ্যাচর কি নিলয় ভাই?
মানে ঘ্যানর ঘ্যানর। তুমি আমাকে ভালবাসবে না, আর আমি তোমার ভালবাসা পাবার জন্য তোমার পিছে পিছে ঘুরে মরবো, ওরকম বান্দা এই নিলয় না। বলো, আমাকে কি ভালবাসা যায়? ইয়েস অর নো।
কেন যাবে না ?
তাহলে মুখ ফুটে বলো-আই লাভ ইউ।
মেয়েরা মুখে এভাবে বলে না।
তাহলে কিভাবে বলে ?
মনে মনে বলে।
তুমি মনে মনে বলেছো ?
বলেছি, বলেছি, বলেছি, হাজার বার বলেছি, হলো তো?
হয়েছে। ফেসবুক কবি আব্দুল কুদ্দুসের একটা কবিতা পড়েছিলাম-
তুমি
নীরব থাকলেই বুঝতে পারি-
আমাকে তুমি ভালোবাসো। কেননা-
নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ
তুমি
সরব হলেই আমার হৃদকম্প বেড়ে যায়
ক্ষীপ্রগতি মেইল ট্রেনের মতো। কেননা-
বাজাতে বাজাতে ঢোল শেষ অবধি
ফেটেই যায়। আর ফাটা ঢোল নিয়ে
তখন কি করে বাদক ?
ফেলে দেয়া ছাড়া আর তো
কোনো গত্যন্তর থাকে না
তাই
তোমার নীরবতাই আমার কাম্য
ভালবাসা সরব হতে পারে না
সাইলেন্স ইজ গোল্ড
কবিতাটা আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু তাকে ফেসবুক কবি বলছেন কেন?
অন্য কোনো জায়গায় ভাত নাই, তাই ফেসবুকে কবিতা লেখে।
তারপর থেকে তাদের কথা আর এক/দেড় ঘন্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রায়ই তারা সারা রাত কথা বলে। বই-পত্র টেবিলে এলোমেলো ছড়ানো থাকে। রাতের শেষ প্রহরে ঘুমাতে গিয়ে তার আর সকালে ঘুম ভাঙে না। স্কুলের সময় বয়ে যাচ্ছে বলে মা তাকে ডাকতে গিয়ে তাকান টেবিলে। টেবিলে বইয়ের এলোমেলো অবস্থা দেখে তিনি ধরে নেন, মেয়ে তার সারা রাত পড়েছে। তার হৃদয় থেকে মমতা ঝরে পড়ে শীতের শিশিরের মতো। আহারে! থাক, আজ না হয় স্কুলে নাইবা গেল।
এভাবে প্রায়ই স্কুল কামাই হয়। একদিন মা বলেন, তুমি তো সারা বছরই নিয়ম মতো লেখাপড়া করেছো, তাই না?
জি মা।
তাহলে এখন সারা রাত জেগে পড়ার দরকার কি? এভাবে পড়লে শরীর খারাপ করবে যে।
আর সারা রাত পড়বো না মা।
বারোটা থেকে একটার মধ্যে শুয়ে পড়বে।
তাই করবো মা।
কিন্তু বারোটা থেকে একটার মধ্যে তার শোয়া হয় না কখনোই। কথা শুরু হলে এই পৃথিবীতে ঘুম, ক্ষুধা, তৃষ্ণা বা অন্য কিছু আছে বলে তার মনে থাকে না। নিলয় ভাইটা এত মজা করে কথা বলতে পারে!
কথা বলতে বলতে নিলয়কে তার দেখতে ইচ্ছা হতে লাগলো। সেই এক বছর আগে দেখেছিল। এক বছর মানে ৩৬৫ দিন, ৮৭৬০ ঘন্টা, ৫২৫৬০০ মিনিট, ৩১৫৩৬০০০ সেকেন্ডে। ভালবাসার মানুষকে এতটা সময় না দেখে থাকা যায় ?
একদিন সে বলল, আপনি তো অনেক দিন আমাদের বাসায় আসেন না?
সময় কোথায় বলো? শুধু কি লেখাপড়া করি? বাপের ব্যবসাও দেখতে হয়। এখন আবার অস্ট্রেলিয়া যাবার জন্য দৌড়-ঝাপ শুরু করেছি।
হয়েছে, ব্যস্ত মানুষরা কি আর বেড়ায় না? আপনার কি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না?
ইচ্ছা করে না আবার? প্রতি মুহূর্তে তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হয়। মনে হয়, সব সময় তুমি যদি আমার বুকের সাথে মিশে থাকতে!
বাজে কথা বলবেন না।
এইটা বাজে কথা? ভালবাসার মানুষকে বুকের কাছে পেতে চাওয়া বাজে কথা?
আপনি সময় করে একবার বেড়িয়ে যান দুই/চার দিন। সত্যি আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
তুমি যখন বলছো তখন আসবো।
কবে আসবেন?
দিন-তারিখ দিতে পারবো না, তবে আসবো-খুব তাড়াতাড়িই আসবো।
এই মাসের মধ্যে আসবেন?
এই মাসে না পারলেও আগামি মাসে আসবো। অস্ট্রেলিয়া যাবার ব্যাপারে একটা মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে হবে কিনা।
তাহলে আগামী মাসে আসবেন তো?
আসবো-অবশ্যই আসবো।
না এলে......।
না এলে কি?
আমি আর আপনার সাথে কথা বলবো না।
সেটা তুমি পারবা না।
পারবো।
বললাম তো, পারবা না।
পারবো।
পারবা না।
পারবো-পারবো-পারবো।
পারবা না-পারবা না-পারবা না।
৪.
বাবা-মা বের হয়ে গেছেন। সে স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক তখন নিলয় এসে হাজির।
এত সকালে? এত সকালে কেমন করে? এই প্রশ্ন দুইটা কয়েক সেকেন্ড পর পর এমনভাবে তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে, যেন প্রশ্ন দুইটা তার ভেতরে রেকর্ড করা ছিল। রেকর্ড কেউ চালিয়ে দিয়েছে।
নিলয় বলল, নাইটকোচে এসেছি।
তাই বলে এত সকালে ?
আরও সকালে আসতে পারতাম। পথে বাসের চাকা পাংচার হয়ে যাওয়াতে......। খুব ক্ষিধা পেয়েছে। সব বিস্ময় তোমার স্কুল ব্যাগে রেখে দিয়ে কিছু খেতে দাও।
সে স্কুল ব্যাগ ছুড়ে ফেলে দিল টেবিলের উপর। ফ্রিজ থেকে পাউরুটি আর ডিম নিয়ে গেল রান্না ঘরে। কুলসুমকে অস্থির করে ফেলল-পিঁয়াজ কাট, মরিচ কাট, তেল আন, লবন আন, কড়াই আন।
পিঁয়াজ-মরিচের সাথে ডিম গুলে নিয়ে তাতে পাউরুটি মাখিয়ে কড়াইতে ভাজবে। কাজটা কঠিন কিছু না। কিন্তু সে চিৎকার, তাড়াহুরো করে কাজটাকে কঠিন করে তুলল। পিঁয়াজ কাটতে গিয়ে কুলসুম আঙুল কেটে ফেলল। সে চুলায় অতিরিক্ত গ্যাস ছেড়ে তাতে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি ছুড়ে দিতেই দপ করে আগুন উপরে উঠে গেল। সে লাফ দিয়ে সরতে গিয়ে ফেলে দিল এক গামলা পানি। আরও কিছু অঘটনের পর সে পাউরুটি ভাজা শেষ করল।
খাবারটা যে খুব সুস্বাদু বা সবার প্রিয় তা নয়। তার নিজের কাছে খাবারটা প্রিয় বলে সে মনে করে খাবারটা সবার কাছেই প্রিয়। এ ছাড়া আছে আপেল, মালটা, কলা। নিলয় পাউরুটির পুরো একটা টুকরো একবারে মুখে চালান করে দেয়। ব্যাপারটা তার কাছে আরেকটা বিস্ময়। সে বলে, একবারে পুরোটা মুখে দিয়ে ফেললেন ?
তুমি কিভাবে খাও ?
আমি চামচ দিয়ে কেটে......।
এই আবার চামচ দিয়ে কাটতে যাব! আটার রুটি আছে না? একেকটা এর চারটার সমান। আমি সেই রুটি একেকটা রোল বানিয়ে একবারে মুখে দিয়ে দেই।
বলেন কি !
খেতে বসে পুতুপুতু করার সময় আমার নাই।
এই শব্দটা আপনি খুব বেশি ইউজ করেন।
আর ভাত খাই কিভাবে জানো ?
কিভাবে ?
প্রতি তিন মিনিটে এক প্লেট শেষ। প্রতিবার তিন প্লেট।
আপনার স্বাস্থ্য দেখে কিন্তু তা বোঝা যায় না।
সকাল-বিকাল দুই কিলোমিটার দৌড়াই। সপ্তাহে দুই দিন জিমে যাই। আমার পেশি দেখবা?
নিলয় টি-শার্টের হাতা গুটিয়ে পেশি দেখাল। হাত ভাঁজ করতেই পেশিটা ফুলে উঠল ডিমের মতো।
নিলয় বলল, ঘুষি মারো তো। তুমি ব্যথা পাবা, আমার কিচ্ছু হবে না। মারো ঘুষি।
খাওয়া শেষ হলে দু’জন কফি নিয়ে বসল। শুরু হল গল্প। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সে কুলসুমকে নির্দেশ দিতে লাগল-গরুর মাংস ভুনা করবি। ডালের ভেতর টমেটো দিবি। আলাদা দুইটা ডিম ভুনবি। শাকে শুকনা মরিচ দিবি। আরও অনেক রকম নির্দেশনা।
গল্প। গল্প। আর গল্প। সারা সকাল। সারা দুপুর। সারা বিকেল।
সন্ধ্যার কিছু আগে মা এলেন। এতদিন পর বোনের ছেলেকে দেখে তিনিও অনেক খুশি। তার অনুপস্থিতিতে মেয়ে নিলয়কে যতœ করে খাইয়েছে এ জন্য মেয়েকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন। তারপর তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন রাতের খাবার তৈরীর কাজে।
রাতে এলেন বাবা। সবাই মিলে খেতে বসে অনেক গল্প হল। হাসাহাসি হল। খুব আনন্দঘন পরিবেশ।
খাবার পরেও অনেক রাত পর্যন্ত ওরা দু’জন গল্প করল। তারপর নিলয় গেল গেস্ট রুমে। নিলয় যে রুমে থাকবে সে রুম, বিছানাপত্র সে নিজের হাতে গুছিয়ে রেখেছিল।
নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে খুব অবাক হল। নিজের এতটা আনন্দে ঝলমলে মুখ সে যেন এর আগে আর কখনো দেখেনি। মনের মধ্যে কি যে ভাল লাগা! যেন হাজারটা রঙিন প্রজাপতি মনের মধ্যে পাখা মেলে দিয়েছে। হাজার রকমের পাখি গাইছে নানা সুরের গান। এতটা ভাল লাগা সে যেন আর কোনোদিন অনুভব করেনি। পৃথিবীর সব ভাল লাগা তার কাছে এল কেমন করে? এরা এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল?
তার মনে হল-ইস! সারা রাত যদি নিলয় ভাইয়ের সাথে বসে গল্প করা যেত। বারান্দায় অথবা ছাদে।
কথাটা মনে হতে সে নিজেই যেন একটু লজ্জা পেল। শব্দ করেই বলে উঠল, ধ্যাৎ! তা কি করে সম্ভব ?
সে এদিক-ওদিক তাকাল। তার কথাটা কেউ আবার শুনে ফেলল কি না। তাহলে যে তাকে পাগল ভাববে। কোন কিসিমের পাগলেরা যেন একা একা কথা বলে?
বাবা বলেন, স্বপ্নবাজ পাগলেরা একা একা কথা বলে। মনের মধ্যে তাদের হাজারটা স্বপ্ন। একাকী মুহূর্তে সে হারিয়ে যায় স্বপ্নের ভূবনে। কখনো হয় কবি, কখনো শিল্পী, কখনো অভিনেতা, কখনো রাজনীতিক। সে কখন নিজের মত গান গায়, হাসে, অভিনয় করে, বক্তৃতা করে। যে পাগল রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে সে কিন্তু নিজেকে বড় এক ট্রাফিক পুলিশ মনে করে। মনে করে, তার কাঁধে বিশাল এক দায়িত্ব।
সেও কি স্বপ্নবাজ হয়ে যাচ্ছে? কি স্বপ্ন দেখছে সে? নিলয়কে নিয়ে কোনো স্বপ্ন?
রাত দুইটা। সে বিছানায় শুয়ে আছে। ঘুম আসেনি চোখে। সারা রাতেও বোধহয় আসবে না ঘুম পরীরা তার কাছে। সে একটু চিন্তিত হল। তাহলে যে সকালে ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। নিলয় ভাইয়ের নাস্তা তৈরীতে তদারক করা হবে না। নাস্তা খেতে বসে গল্প করা হবে না। সে কোলবালিশ টেনে নিল কাছে। চোখ বন্ধ করল। তাকে ঘুমোতে হবেই। আর তখনই তার স্মার্ট ফোনটা বেজে উঠল। দেখল নিলয় ফোন করেছে। কিন্তু কেন? ওঘর থেকে এত রাতে ফোন কেন? সে ফোন রিসিভ করল। নিলয় বলল, সুমাইয়া, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও প্লিজ।
পানি দেইনি?
না।
জগ ভরে পানি আর গ্লাস না রেখে এলাম?
কই, দেখছি না তো।
সে বুঝল, ভুলটা তারই হয়েছে। সে এক গ্লাস পানি নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে পা বাড়াল।
গেস্ট রুমে ডিম লাইটের হালকা নীল আলো। সে দরজায় পা রেখেই দেখল সাইড টেবিলে জগ নামানো। সে ভাবল, হয়তো জগ আগে থেকেই ছিল, তাতে পানি নেই। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে সে বলল, এই যে পানি।
নিলয়ের কোনো সাড়া-শব্দ নেই। এরই মাঝে ঘুমিয়ে পড়ল? বেশ ঘুম কাতুরে মানুষ তো। সে আবার বলল, আশ্চার্য ! এত ঘুম মানুষের?
তার মনে পড়ল বায়েজীদ বোস্তামীর গল্পটা। সারা রাত গ্লাস হাতে মায়ের বিছানায় দাঁড়িয়ে ছিল। সকালে চোখ খুলে মা আর বুঝতে পারে না, ছেলে কেন গ্লাস হাতে তার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সেও কি সারা রাত নিলয়ের মাথার কাছে পানি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে? ধ্যাত! তা কি করে সম্ভব? সে বলল, এই যে আমি পানি রেখে গেলাম।
সে পানির গ্লাস রেখে যেই পেছন ফিরেছে অমনি আচমকা তার হাতে প্রবল এক টান। সে নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে হুমরি খেয়ে গিয়ে পড়ল নিলয়ের বুকের উপর। মুহূর্তে নিলয় তাকে কঠিনভাবে বুকে চেপে ধরল। সে দু/তিন বার অস্ফূট স্বরে বলেছিল-আহ! কি করছেন? ছাড়–ন তো? বেশ বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
তারপর চুপ।
প্রায় পনেরো মিনিট পর নিলয়ে বুকের ভাঁজ থেকে ছাড়া পেয়ে সে ফিরে এল নিজের ঘরে।
তার শরীরে ভীষন কাঁপন। তার চেয়েও বেশি কাঁপন বুকে। সে এক গ্লাস পানি খেল। শরীরের কাঁপন কিছুটা কমলেও বুকের কাঁপন কমে না। সে কাঁপন থেকে শিরশির করে সমস্ত অস্তিত্বে ছড়িয়ে যেতে লাগল অদ্ভূত এক ভাল লাগা। প্রথম ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শুনতে যেমন লেগেছিল, প্রথম স্পর্শ তার চেয়েও অনেক বেশি মোহনীয়। সে মনে মনে বলল, এরকম স্পর্শ না থাকলে ভালোবাসার কোনো মূল্য আছে? নিলয় ভাইটাও এমন পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিল.....!
সারা রাত তার ঘুম এল না। শুধুই এপাশ-ওপাশ। শধুই ছটফটানি। শুধুই ভাবনা-যেভাবে বুকের সাথে চেপে ধরেছিল যেন তার বুকের সাথে লেপ্টে ফেলবে। এমনভাবে ঠোঁট দুটি নিজের মুখের মধ্যে পুড়ে নিয়েছিল....! এসব ভাবতে ভাবতে তার শরীরে অজানা এক শিহরণ ঢেউয়ের মত অবিরাম আসতে থাকে।
সকালে দু’জনেরই ঘুম ভাঙে দেরিতে। মা ডাকতে চেয়েছিলেন। স্কুলে যাবে কি না জানতে চেয়েছিলেন। বাবা বললেন, থাক, ডেকো না। ঘুমাক।
মা-ও ডাকলেন না। সারা দিন সারা রাত শুধুই লেখাপড়া। দু’দিন না হয় স্কুলে নাই বা গেল। এতদিন পর খালাতো ভাইটা এসেছে, তার সাথে না হয় একটু গল্প করুক-আনন্দ করুক।
মা নিজেই সকালের নাস্তা তৈরী করলেন। পরাটা। গরুর মাংস ভুনা। পায়েশ। দই-মিষ্টি, আর ফল তো ঘরে আছেই। নাস্তা সেরে বাবা-মা দু’জনেই বের হয়ে গেলেন।
সে ঘুম থেকে উঠে দেখে নিলয় তখনও ঘুমিয়ে। সে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজেকে দেখে সে চমকে উঠল। সারা শরীরে নানা রঙের জরি লেগে আছে। মুখটা কেমন ঝিকমিক করছে। কোত্থেকে এল এসব?
পরে মনে পড়ল, নিলয়ের টি-শার্টের কথা। তার টি-শার্টের বুকে জরির কাজ। কি টি-শার্ট কিনেছে যে জরি উঠে যাচ্ছে? ভগ্যিস বাবা-মা কেউ দেখেননি। দেখলে প্রশ্ন করতেন-শরীরে এসব এল কোত্থেকে? তাতে খুব বেশি সমস্যা যে হত তা সে মনে করে না। মিথ্যা বলতে বলতে ইদানিং সে এ ব্যাপারে এক্সপার্ট হয়ে গেছে। উপস্থিতভাবে চমৎকার মিথ্যা বলতে পারে। সত্যকে হার মানায় সে মিথ্যা। পরক্ষণেই মনে পড়ল, এ ব্যাপারে পার পাওয়া যেত না। নিলয়ের টি-শার্ট দেখলেই তো সব খোলসা হয়ে যেত। কি বিশ্রী ব্যাপারই না হয়ে যেত! যাক বাঁচা গেছে। সে গোসল করে জামাটা পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল।
গোসল সেরে বের হয়েই সে দেখে নিলয় দরজা ভিড়িয়ে তার ঘরে বসে আছে। সে একটু চমকে উঠল যেন। বলল, আপনি এখানে বসে আছেন যে?
বাথরুমে যাব।
এ বাসায় আর বাথরুম নাই বুঝি?
আছে।
তাহলে?
আমার যেটায় যেতে ভাল লাগে সেটায় যাব।
রাতে আপনি এমনটি করলেন কেন?
কী করলাম ?
এরকমটি করা ঠিক হয়নি।
তাহলে কি হাত জোর করে ক্ষমা প্রার্থনা করব?
তা বলিনি।
অপরাধ করেছি, ক্ষমা চাইব না?
ক্ষমা করে দিয়েছি।
রাগ করোনি তো?
আরে না......!
শোন, এরই নাম ভালোবাসা। পৃথিবীর কেউ এসব অতিক্রম করতে পারেনি। সেদিন একটা বই পড়লাম-খুব বিখ্যাত এক লেখকের লেখা। নাম-ভালোবাসা ভালোবাসা। ভালোবাসা দুইবার কেন বলোতো? সেখানে দুই ধরনের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছেন। একটা মনে, আরেকটা শরীরে। খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছেন-একটা ছাড়া আরেকটা অর্থহীন।
হয়েছে, আর লেকচার না দিয়ে বাথরুমে যান।
তোমার খোপা থেকে গামছাটা দিয়ে যাও।
সে খোপা থেকে গামছাটা খুলতেই তার ভেজা চুল ছড়িয়ে পড়ল পিঠ অবধি। নিলয় বলল, সত্যি তোমার শরীরে ভরা যৌবনের ঢল নেমেছে। বুক দু’টো যা বানিয়েছো........। দু’টোর মাঝে এক আঙুলও ফাঁক নেই।
ছি! কিভাবে কথা বলেন? এত বাজে বকতে পারেন।
বাজে বকলাম ? তোমাদের তো জাহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসটা পাঠ্য আছে। পড়েছো সেটা? এক শীতের সকালে আম্বিয়া গোসল করে এলো। মন্তু চোরা চাহনী দিয়ে আম্বিয়াকে দেখল। সেখানে আম্বিয়ার আঁটসাঁট দেহের বর্ণনা দেয়া আছে। তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে উথলে উঠছে যৌবন। তা দেখে মন্তু আম্বিয়াকে বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। হাসান আজিজুল হকের সাবিত্রী উপখ্যান পড়লাম। সেখানে সাবিত্রীর রূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন। বুকের কথাটা আমি সেখান থেকেই নিয়েছি। সেখানে বলেছেন, সাবিত্রীর স্তন দুটি সুস্পষ্ট, সুডৌল, সুদৃঢ়-যেন শ্বেত পাথরের তৈরী। এমন নিবিড়ভাবে সে স্তন দুটি নিবদ্ধ যে, তাদের মাঝখানে এক আঙুলও ফাঁক নেই। আমার মাথায় এরকম কথা আসবে কেমন করে বলো? লেখকরা বললে দোষ নেই, সেটা শিল্প, দোষ আমি বললে। শেষ বার যখন তোমাকে দেখি তখন তুমি সেভেন না এইটে ছিলে।
নাইনে ছিলাম। আপনি না গত বছরের প্রথমে একবার এলেন।
ও এই এক বছরেই......।
আর আপনিও এ সময়ে প্রচুর বকতে শিখে গেছেন। যান, বথরুমে যান।
ওরা এক সঙ্গে নাস্তা খেল। তারপর মুখোমুখি বসে কিছুক্ষণ গল্প করল। গল্প করতে করতে প্রস্তাবটা তুলল নিলয়। বলল, চলো, বাইরে ঘুরে আসি।
কোথায় যাব ?
ঢাকা শহরে ঘুরতে যাবার জায়গার কি অভাব? পার্কে ঘুরবো, দুপুরে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাব, বিকালে পিজা-টিজা......।
তার মানে সারাদিন!
অসুবিধা কী? পড়ায় ক্ষতি হবে? সারা বছর কিছু পড়ো নাই? দুই দিন না পড়লে একবারে ডাব্বাকাত হয়ে যাবে?
না না, তা হবে কেন? ঠিক আছে, চলুন যাই।
সারা দিন তারা এক সাথে কাটালো। গল্প। হাসি-তামাশা। খাওয়া-দাওয়া। আর অনেক ধরনের খাবার বাসায় পার্সেল করে নিয়ে এল। রাতে বাবা-মা’র সাথে বসে সে সব খেতে খেতে আবার গল্প, হাসি-আনন্দ। বাবা-মাও অনেক খুশি। দু’জন কর্মজীবী। একমাত্র মেয়েটাকে সময় দিতে পারে না। কোথাও বেড়াতে নিতে পারে না। খালাত ভাইয়ের সাথে যদি দু’টো দিন বেড়ায় তাহলে মনের রিলাক্স হবে।
রাত অনেকটা পর্যন্ত গল্প করে নিলয় গেস্ট রুমে যাবার সময় নিজের সেলফোনটা তার টেবিলের উপর ফেলে রেখে গেল মনের ভুলে। সে সেটা খেয়াল করেও বলল না-আপনার ফোন নিয়ে যান। ভাবল-রেখে যাওয়াই ভাল। শেষে আবার রাত দুপুরে ফোন করে বলবে-সুমাইয়া, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও তো।
শোয়ার আগে সে নিলয়ের স্মার্ট ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় গেল। বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে ফোনটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। ফোনের ব্যাপারে তার আগ্রহ অনেক বেড়ে গেছে। কোন ফোনের ফাংশন কেমন, কী কী কনফিগারেশন আছে তা জানতে তার ভাল লাগে। তা ছাড়া মেমোরিতে স্টক করা ছবি, গান এ সবের প্রতিও তার আগ্রহ অনেক। এটা-ওটা দেখতে দেখতে সে গেল ইমেজ ভিউয়িং-এ। নিলয়ের ছবি। কত রকম পোশাক পরে, কত বিচিত্র ভঙ্গিতে, কত বিচিত্র প্রকৃতির মাঝে সে ছবি তুলেছে! সত্যিই খুব স্টাইলিশ ছেলে! ঘোরাঘুরিও তো কম করেনি। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল সবই তো দেখে ফেলেছে। তাদের দু’জনের ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো একটা ছবিও সেভ করে রেখেছে। কি আশ্চার্য ছেলেরে বাবা! কেউ দেখে ফেললে? সে ভাবল, ছবিটা ডিলিট করে দেবে। ডিলিট করতে গিয়েও আবার করল না। নিজের মতোই বলল-থাক। কে দেখবে?
তারপর ভিডিও। মাধুরী, ঐশ্বরিয়া, কাজল, রানী মুখার্জি, শাররুখ, আমির, সবাই আছে। বলিউড পেরিয়ে হলিউড। জাস্টিস বিবার, তার চেয়ে বয়সে বড় প্রেমিকা সেলেনা গোমেজ, ব্রায়ান এডামস এবং আরও অনেকে। আবার বাংলা গানও রেখেছে। শ্রীকান্ত, কবির সুমন, বন্যা, আনুশেয় এরাও আছে। আছে অনেক রবীন্দ্র সংগীত। তার মানে তার সব দিকেই রুচি আছে।
সে বেছে বেছে কিছু গান শুনল। গান শুনছে আর ফোল্ডার থেকে ফোল্ডারে যাচ্ছে। একটা ফোল্ডারের নাম স্পেশাল ভিডিও। স্পেশাল শব্দটা সবাইকে টানে। তাকেও টানলো চুম্বকের মতো। সে গান বন্ধ করে সেই ফোল্ডার ওপেন করল। প্রথম ভিডিওটা প্লে করেই তার হাত-পা অবশ হয়ে যাবার দশা। তার মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ। সেই প্রথম নারী-পুরুষের জৈবিক ক্রিয়া তার স্বচক্ষে দেখা। সে একটার পর একটা দেখতে লাগল। কানে হেডফোন লাগিয়ে শব্দ সহকারে দেখে আরও বেশি আকর্ষণ বোধ করল। তারপর যেটা তাকে খুব বেশি আকর্ষণ করল সেটা সে শেয়ারের মাধ্যমে নিজের স্মার্টফোন মেমোরিতে নিতে থাকল। কখন রাত শেষ হয়ে গেছে তা সে জানে না। দরজা বন্ধ না করেই দু’টো ফোন বালিশের পাশে রেখে সে ঘুমিয়ে গেল।
সকালে নিলয় ঘুম থেকে উঠে কুলসুমকে বলল, সুমাইয়া উঠে নাই?
না ভাইজান।
দশটা বেজে গেছে.....।
আমি তিন বার ডাকছি, উঠে নাই। কোনো নড়াচড়াই নাই। মরা মানুষের মতো পইড়া আছে। সারা রাইত ক্যান পড়তে অইবো আপনেই কন ভাইজান? কতজন তো দেখি ২/৪ ঘন্টা পইড়াই ফাস কিলাশ পাস দেয়।
তুই আবার ডাক।
ডাকলে কোনো লাভ নাই। বিশ্বাস না হইলে আপনে ডাইকা দেখেন।
নিলয়ের মনে পড়ল তার সেলফোনের কথা। সে পা বাড়াল তার ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকে একটু থমকে দাঁড়াল। সে বড্ড এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। বুকে ওড়না নেই। জামাটা অনেকটা উপরে উঠে আছে। পরক্ষণেই ভাবল, কোনো ব্যাপার না। সে ফোনটা পেল তার বালিশের পাশে। ফোনটা হাতে নিয়ে ডাকল, কি ব্যাপার নাস্তা করবা না?
কয়েক বার ডাকার পর তার একটু চেতনা ফিরে এল। গোঙানির মত করে বলল, আপনি নাস্তা করেন, আমি একটু পরে উঠব।
সারা রাত এভাবে লেখাপড়া করতে হয়? এটা কি ডিভিশনের যুগ যে ফার্স্ট ডিভিশন পেতে জান বের হয়ে যাবে? এক/দেড় ঘন্টা পড়েই তো কত জন গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে যাচ্ছে। এটা প্রশ্নফাঁসের যুগ। একটু চেষ্টা থাকলে লেখাপড়া না করেও.....।
আপনি যান তো। আমি চোখ মেলে তাকাতে পারছি না।
তার ঘুম ভাঙল বেলা বারোটার সময়। ঘুম থেকে উঠে গোসল করল। গোসল করার পর অনেকটা ফ্রেস হল। নিলয় একটু বিরক্ত। সকাল থেকে একা একা বসে আছে। দুপুরে খাবার খেতে বসে নিলয়ের খেদোক্তি-ভেবেছিলাম, আজ সকালেই বের হব, অথচ এখন খাবার খেতে হচ্ছে বাসায়। সারা রাত লেখাপড়া করতে হয় বলো তো?
কী করবো? কাল সারা দিন তো আপনার সাথে ঘুরে পড়তে পারলাম না।
তার মানে আমার জন্য তোমার লেখাপড়া ডিসটার্ব হচ্ছে? ঠিক আছে, আমি এখনই চলে যাচ্ছি।
আমি কি তেমন কথা বলেছি?
আপনার সাথে ঘুরে পড়তে পারলাম না-এ কথার মানে কি?
ধ্যাৎ! এমনি মজা করলাম।
তাহলে আজ বের হবে না ?
বের হব না কেন? একটু পরেই বের হব। আজ ফিরব একেবারে ডিনার করে।
আমি আরেকটা অফার করতে চাই।
কী?
একটু শপিং-এ যাব।
শপিং-এ কেন ?
তোমাকে কিছু কিনে দিতে চাই। উপহার ছাড়া ভালবাসা পূর্ণ হয় না।
উপহার লাগবে না।
কেন, সমস্যা আছে কোনো?
সমস্যার কিছু নাই।
তাহলে? সামনে তোমার পরীক্ষা। পরীক্ষা উপলক্ষেও তো আমি কিছু দিতে পারি।
পরীক্ষা দেরি আছে। এখনো টেস্ট হল না।
আগেই দিয়ে রাখি। আবার কবে আসতে পারি না পারি।
আচ্ছা দিবেন।
তারপর দু’জন কিছু সময় নীরবে খেতে লাগল। হঠাৎ নিলয় বলল, আচ্ছা, আমার ফোনটা তো তোমার টেবিলে রেখে এসেছিলাম। তোমার মাথার কাছে গেল কিভাবে?
আপনি আমার ঘরে ঢুকেছিলেন!
ঘরে না ঢুকলে ফোন আনলাম কিভাবে? তোমাকে ডাকলাম কিভাবে?
আমাকে ডেকেছিলেন?
তোমার দেখছি কিছুই মনে নাই। বেহুশ ছিলা নাকি? আমার ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করো নাই তো?
ছবি-টবি দেখলাম। যা স্টাইলিশ আপনি!
আর কী করলে ?
গান-টান শুনলাম।
ভিডিও দেখ নাই?
দেখেছি, আমির খানের গান দেখেছি।
স্পেশাল ফোল্ডারে গিয়েছিলা?
চুপ করেন তো।
আহ! গিয়ে থাকলে বলো। দোষের কী আছে?
আপনি এসব জমা করে রেখেছেন কেন?
সব কিছুই রাখতে হয়। এটা একবিংশ শতাব্দী। এখন এক হাতে থাকবে রবীন্দ্রনাথ, আরেক হাতে থকবে গবীন্দ্রনাথ। এক হাতে বাঁশের বাঁশরি, আরেক হাতে ইলেক্ট্রনিক গীটার।
গবীন্দ্রনাথ কে?
তুমি চিনবা না। তুমি তো কুয়ার ব্যাঙ। বাইরে মেলামেশা করলে বুঝতা।
আমার অতো বোঝার দরকার নেই।
তোমার বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করে দেখো, তারা সবাই এসব দেখেছে। আজকাল সিক্স/সেভেনের ছেলেমেয়ের ফোনেও এসব থাকে।
হয়েছে, চুপ করে খান।
খাওয়া তো শেষ।
ঐ বড় হাড়টা বসে বসে চিবান।
আচ্ছা।
নিলয় আরও দুই দিন ছিল। দুই দিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি, বাইরে খাওয়া, শপিং এই সব হয়েছে। যাবার সময় নিলয় তিন হাজার টাকাও দিয়ে গেছে। সে নিতে চায়নি। নিলয় বলেছে, অসুবিধা কী? একটা ড্রেস কিনে নিও।
না, লাগবে না। ড্রেস তো কিনে দিলেনই।
তুমি মনে হয় আমাকে সত্যিকারে ভালোবাসো না।
কি যে বলেন! মিথ্যা করে ভালোবাসা যায়?
যায়। অনেকেই দুই/তিনটা নৌকা রেডি রাখে। যেটায় সুবিধা মনে করে সেটায় উঠে।
কি যে আবোল-তাবোল বলেন।
তাহলে আমার কাছ থেকে টাকা নিতে সমস্যা কি তোমার?
উপহার দিয়েছেন। নগদ টাকা কেন?
আমার দেয়াগুলো সেরকম ভালো নাও হতে পারে। আমি মেয়েদের ড্রেস তেমন বুঝি? তুমি নিজের পছন্দ মত কিনে নিও। টাকাটা নাও, আর মুখটা আগাও, একটা বিদায়ী......।
টাকা নিতে পারি, কিন্তু মুখ আগাবো না।
কেন?
আপনি সহজে ছাড়তে চান না?
আচ্ছা, তুমি যখন চাইবে তখনই ছেড়ে দেব। যত দোষ নন্দ ঘোষ, নিজেই আমাকে আটকে রাখে।
হয়েছে! এই কয়দিনে আমার সব লিপস্টিক আপনার পেটে গেছে।
ডাক্তার দিয়ে আবার পেট ওয়াশ করতে না হয়।
হি হি হি।
[চলবে...]
মোহমিলন
মোহমিলন
এ আই জাজাকী
তখন আমি নিউ ইয়র্কে থাকতাম। পড়তাম স্ট্যান্ডার্ড ফাইভে। বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। অভিনয়ের প্রতি আমার ঝোঁক ছিল খুব বেশি। ছোট ছেলেমেয়েরা নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে কাজ করত দেখে আমারও শখ ছিল টিভিতে কাজ করার। উন্নত স্কুল হওয়ায় সম্পূর্ণ পাঠদান কার্যক্রমই ছিল মাল্টিমিডিয়া সিস্টেমের। একদিন কালচারাল টিচার এসে ডিসপ্লেতে একটি বিজ্ঞাপন দেখাল। যেখানে একটি টিভিসির জন্য শিশু চাওয়া হয়েছিল। শর্ত ছিল শিশুটির চেহারা ও বাচনভঙ্গি হতে হবে আকর্ষণীয় ও সাবলীল। যেহেতু এ সবগুলো গুণই আমার মধ্যে ছিল তাই আমি দাঁড়িয়ে বললাম, টিচার আমি কাজ করতে চাই। টিচার একটু হাসি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। ক্লাস শেষে আমার ডেস্কে এসে দেখা করে যেও। এমনিতেই এ টিচার ক্লাসের ছেলেদের খুব কেয়ার করতেন। এবং সবচেয়ে বেশি কেয়ার করতেন আমিসহ আরও দু-চার জনকে, যাদের চেহারা একটু বেশি কিউট। তবে টিচার আমাকে সবার চাইতে আরেকটু বেশিই কেয়ার বা আদর করতেন সেটা বুঝতে পারতাম। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেই আমার নাম নিয়ে এটা সেটা বলতেন। আমার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতেন। হাঁটাচ্ছলে আমার গালে চিমটি কেটে দিতেন। আমার রাহুল কাটিং রেশমি চুলে বিলি কেটে দিতেন। এবং তা তিনি খুব কৌশলেই করতেন। যাতে অন্যদের চোখকে ফাঁকি দেয়া যায়। সেটা আবার আমার চোখে ধরা পড়ত। তবে অন্য কেউ যে তা খেয়াল করত না তা নয়। আমার দু-একজন বন্ধু কয়েকবার বলেছেও যে এ টিচার আমাকে বেশি আদর করে। উত্তরে আমি কিছু বলতাম না। কারণ আমিও এটা জানতাম। তবে এ আদর বা কেয়ারিংটাকে আমি নেহায়েৎ টিচারের আদরই মনে করতাম। এ আদরের পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে তা আমার মাথায় কখনোই আসত না। তাছাড়া সেই বয়সে অন্য কিছু মাথায় আসার কথাও না।
যথারীতি সেদিন ক্লাস শেষে কালচারাল টিচারের ডেস্কে গেলাম। টিচার তার সামনের চেয়ারটি দেখিয়ে বসতে বললেন। টিচার একটা ফাইলে কী যেন লিখছিলেন। তবে তিনি খুব ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলেন তা বুঝতে পারছিলাম। টিচার বললেন, তুমি একটু বসো, আমি হাতের কাজটা সেরে নিই। তোমার কিছু স্ন্যাপ নিতে হবে। আমিও চেয়ারে বসে দুই পা দোলাতে লাগলাম। আমি সবসময়েই একটু চটপটে স্বভাবের। তবে কারও সামনে পা দোলানো যে বেয়াদবি তা আরও বড় হয়ে বুঝেছিলাম। টিচার লেখার ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। আমিও টিচারের দিকে তাকিয়ে হাসছিলাম। এরই মাঝে ছুটির ঘণ্টা পড়ে যায়। টিচারের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেমেয়েগুলো লাইন ধরে বের হচ্ছে আর দু’জন সিকিউরিটি একে একে তাদেরকে স্কুলবাসে অথবা ড্রাইভারের হাতে তুলে দিচ্ছে। এদিকে রুমের সবগুলো ডেস্ক খালি হয়ে গেছে। সব টিচারেরা বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। রুমে শুধু আমি আর কালচারাল টিচার। জানালা দিয়ে আবার নিচে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের লাল গাড়িটা দাঁড়ানো। বাবা প্রতিদিন আমাকে স্কুলে আসা যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠায়। অন্যান্য ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই স্কুলবাসে চড়ে যাওয়া-আসা করে। শুধু আমার বাবার মতো অতি কেয়ারিং বাবারা কয়েকজন তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য গাড়ি পাঠায়। আমি বললাম, টিচার নিচে আমার জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। টিচার এবার ফাইলটা রেখে উনার দামি আইফোনটা বের করলেন। আমাকে পজিশনে বসিয়ে একটি ছবি নিলেন। তারপর তিনি আমার দিকে এসে বললেন, বাঁকা হয়ে বসেছো ডিয়ার সান। তারপর আমার বাহুতে ধরে একটু সোজা করার ভঙ্গি করলেন। আমার মনে হলো টিচার আমার দুই বাহুতে তার হাতে চাপ দিলেন। তিনি আবারও একটা ছবি নিয়ে বললেন, তুমি আবারও বাঁকা হয়ে বসেছো ডিয়ার। তিনি আবার এসে আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, এভাবে বসো ডিয়ার সান, এভাবে। আমার মনে হচ্ছিল আমি সোজা হয়েই বসেছিলাম। তারপরও আমি সোজা হয়ে বসার ভঙ্গি করলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম টিচার আবারও আমাকে চুমো খাওয়ার জন্য দু’হাতে আমার গালে চেপে তার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রুমের দরজায় এসে বাইন্ডার আঙ্কেল দাঁড়ালেন। টিচার চুমো না খেয়ে আমার ঘাড় সোজা করার ভঙ্গিতে বললেন, এভাবে থাকো ডিয়ার সান। বাইন্ডার আঙ্কেল বললেন, স্যার বের হবে না? দরজা লক করব। ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে। টিচার বললেন, হ্যাঁ এখনই বের হব। তুমি একটু নিচে গিয়ে আদির ড্রাইভারকে বলো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। বাইন্ডার আঙ্কেল চলে গেলে টিচার যেন পাগল হয়ে ওঠলেন। আমাকে জোরে তার বুকে চেপে ধরলেন। উনার এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে আমি কিছু আন্দাজ করতে পারছিলাম। আমি গুড টাচ্ এবং ব্যাড টাচ্ সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিলাম। আমার আম্মু অনেক আগেই আমাকে টাচ্ সম্পর্কে শিখিয়েছিল। আমি নিজেকে টিচারের বুক ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। টিচার যেন আরও উন্মত্ত হয়ে গেলেন। আমাকে তো ছাড়ছেনই না বরং আরও জোরে বুকে চেপে পিঠ চাপড়াতে থাকলেন। জোর করে আমার গালে আর কপালে অনেকগুলো চুমো খেলেন। হঠাৎ টিচারের হাত আমার নিতম্বে চলে গেল। সেখানেও তিনি চাপ দিতে লাগলেন। আমি এবার আর সহ্য করতে না পেরে সিকিউরিটি আঙ্কেল বলে চিৎকার করলাম। টিচার আমাকে ছেড়ে দিয়ে গালে একটা চড় মারলেন। আমি কোনো কথা না বলে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। চোখ ফেটে পানি বের হতে চাচ্ছিল। অনেক কষ্টে আটকে রেখেছি। গেইট দিয়ে বের হয়ে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ড্রাইভার তার আসনেই বসেছিল। আমি সবসময় ড্রাইভারের পাশের সিটে বসি কিন্তু আজ পেছনের সিটে বসলাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কী ছোট সাহেব আজ পেছনে বসলেন যে? আমি বললাম, এমনি। ড্রাইভার বলল, বাইন্ডার জানাল আপনার নাকি কিছুক্ষণ দেরি হবে, তাহলে এত দ্রুত চলে আসলেন কীভাবে? আমি তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম, যান। গাড়িতে বসে আর কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। শ্রাবণের ধারার মতো অঝোরে চোখ বেয়ে জল নেমে এলো। ড্রাইভারকে বললাম, আঙ্কেল সামনে থেকে টিস্যু বক্সটা দিন তো। ড্রাইভার গাড়িটা রাস্তার পাশে থামিয়ে টিস্যু বক্সটা আমাকে দিয়ে বলল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো আঙ্কেল? আমি কিছুই বললাম না। সে আবারও জানতে চাইলে আমি একটু রেগেই বললাম, আপনি গাড়ি চালান তো।
বাসায় ফিরে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলাম। আম্মু কারণ জানতে চাইলে বললাম, কালচারাল টিচার মেরেছে। অ্যামেরিকার আইনে শিশুদের গায়ে হাত তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ। আম্মু এটা শুনে তো রেগে আগুন। আম্মু বলল, তোমাকে টিচার কেন মেরেছে? আমি সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললাম। রাগে আম্মুর চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। আম্মু আর কিছুই জানতে চাইল না। আমাকে খাইয়ে সাথে সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। কোথায় কী কী করল আমি কিছুই জানি না। পরদিন থেকে নতুন আরেকজন কালচারাল টিচার আমাদের ক্লাস নিত। কিন্তু টিচার ওইদিন কেন এমন করেছিল সেটা আমি এখন খুব পরিষ্কারভাবে বুঝি। সত্যিকার অর্থে, সেই টিচার ছিলেন ‘পেডোফিলিয়া’ নামক এক ভয়ানক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। যদিও এটিকে অনেক মনোবিদরা ‘ন্যাচারাল ইনফ্রাকশন’ বলে থাকেন। সেই হিসেবে কালচারাল টিচার দোষী ছিল না। তবে অতিসভ্য এ সমাজের কাছে কোনো পুরুষের এ ব্যবহার চরম ঘৃণার, নিন্দার এবং লজ্জার।
ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : পর্ব ০২
ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন
[গত সংখ্যার পর]
বহুদিন ধরে ট্রেনে চড়া হয় না। সেই যে কবে ট্রেনে সিলেট গিয়েছিলাম, তা ভুলেই গিয়েছি। মুক্ত জীবন পেয়েও যদি অবহেলা করি, তা বড় অন্যায় হয়ে যাবে। শালবনে আসার সুযোগ যখন হাতে এল, তখন ঠিক করলাম, এবার ট্রেনে চড়ার ইচ্ছে পূরণ করব। শেষ রাতের ট্রেনে চড়ে সকালে এই স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। সবুজের সমারোহে সাজানো গোছানো ভাওয়াল শাল-গজারি বন। ট্রেন চলে যাবার পর স্টেশনটি আগের মতো শান্ত নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আশেপাশে মানুষজনের তেমন দেখা নেই। বনের পথ দিয়ে হাঁটছি। এ বনের ভেতর আমার দাদাজানের বাংলো বাড়ি।
স্টেশনে একজনের আসার কথা ছিল, তিনি বাংলোবাড়ির কেয়ারটেকার। আব্বুর কাছ থেকে লোকটার চেহারার বর্ণনা শুনেছি। স্টেশনের আশপাশে তাকিয়ে আমি তেমন কাউকে দেখতে পেলাম না। অপেক্ষা না করে আব্বুর দেয়া ঠিকানা ও কিছু ল্যা- মার্ক অনুসরণ করে দাদাজানের বাড়িটি খুঁজতে লাগলাম।
দাদাজানকে আমি স্বচক্ষে কখনো দেখিনি। তাঁর মৃত্যুর পর আজই প্রথম এ বাড়িতে যাচ্ছি। দীর্ঘ সতের বছর ধরে নির্জন পড়ে আছে বাড়িটি। একজন কেয়ারটেকার যিনি আছে, তার দায়িত্ব শুধু রাতে পাহারা দেয়া। আব্বুর কাছে শুনেছি, দোতলা বাড়িটির নিচ তলার একটি ঘওে রাতে এসে লোকটা থাকে। তার বাড়ি পাশের গ্রামেই।
অবশেষে বাড়িটি খুঁজে পেলাম। বাড়ির সামনের বুনো বাগান পেরিয়ে টিনের বেড়ার গেট টেনে ভেতরে ঢুকলাম। উঠোন ভর্তি ঘাস, শরতের শিশির বিন্দু প্রতিটি ঘাসের ডগায় স্থির। সূর্যালোক এখনও ওদের গায়ে আঁচড় কাটেনি। সামনে পা বাড়াতেই চোখে পড়ল দূরে ছোট্ট একটি নাম না জানা লিকলিকে সাপ, সামনের দিকে ছুটছে। হয়তো টিনের শব্দে ভয় পেয়েছে তাই পালিয়ে যাচ্ছে। সাপের আতঙ্ক আমার মধ্যে নেই। তাছাড়া ব্যাগে তো কার্বলিক এসিড আছেই, এখানে থাকার প্রস্তুতি হিসেবে নিয়ে এসেছি।
সুনসান নিরবতা। ঘড়িতে দেখলাম ভোর ছয়টা বাজে। কেয়ারটেকারকে কল দিলাম। ঘরের ভেতর কল বাজছে শুনতে পেলাম। লোকটা এখনো ঘুমাচ্ছে। অথচ গতরাতে কথা হয়েছিল, আমাকে ভোরে স্টেশন থেকে এগিয়ে নিতে আসবে। কল বেজেই চলেছে, লোকটার ঘুম এত গভীর? দু’তিন বার কল দেবার পর রিসিভ করল।
আমিই প্রথম কথা বললাম, হ্যালো, এখনো ঘুমাচ্ছো? আমি তোমার ঘরের সামনে।
কী বলেন, স্যার। আমি উঠতাছি।
লোকটা হন্তদন্ত হয়ে দরোজা খুলে বাইরে এল। স্টেশনে যেতে পারেনি বলে, তার আফসোসের শেষ নেই। আমি তাকে থামিয়ে বললাম, দোতলার ঘরগুলো ঠিক আছে?
লোকটা আমতা আমতা শুরু করল। ইয়ে, মানে, পরিষ্কার করা হয়নি।
কেন? আমি খানিকটা অবাক হয়ে সামান্য উত্তেজনা প্রকাশ করলাম।
লোকটা বলল, বড় তালাটা খুলতে পারিনি স্যার। অনেক চেষ্টা করেছি, সম্ভব হয়নি। জং ধরে এমনভাবে আটকায়া আছে, চাবি পর্যন্ত বাঁকা হইয়া গেছে। অনেক বছর ধইরা খোলা হয় না, তো।
আচ্ছা, তোমার নাম কী?
মিজানুর আলী। সবাই মিজান মিয়া কইয়া ডাকে।
মিজান মিয়ার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে বলে মনে হয়। তার চোখে-মুখে এখনো রাতের ঘুম লেগে আছে। বোধ করি সে আরো কয়েক ঘণ্টা পর ঘুম থেকে জাগত। আমি চলে আসাতেই সেই রুটিনে ব্যাঘাত ঘটেছে।
আমি বললাম, মিজান মিয়া, তালাটা খোলা সম্ভব না হলে ভেঙে ফেলো।
স্যার, গতকালকেই, ভাঙতে চাইছিলাম। কিন্তু চিন্তা-ভাবনা কইরা ভাঙ্গি নাই।
মিজান মিয়ার কথার প্রতি আমার ততটা আগ্রহ ছিল না। অন্যকিছু জিজ্ঞেস না করেই বললাম, যতদ্রুত সম্ভব তালাটা ভেঙে ফেলো, আমার থাকার পরিবেশ তৈরি করো। ততক্ষণে আমি বাইরে থেকে এক কাপ চা, খেয়ে আসি।
বাইরে যাবার আগে অল্পসময়ের জন্য উপরে গেলাম। দু’তলায় তিনটে ঘর। আব্বুর মুখে শুনেছি, একেবারে দক্ষিণপাশের ঘরটিতে দাদাজান থাকতেন। পাশের ঘরদুটিতে কিছু ভাঙা চেয়ার-টেবিল ও কাঠ ধূলি অন্ধকারে ভরে আছে। পুরো উপরতলায় একটিবার দৃষ্টি ফেলে বাড়ি থেকে বের হলাম।
বনের পথ পেরিয়ে কিছুটা দূরে চায়ের দোকান, সেখানে বসে চা খেলাম। মক্তবে আরবি পড়তে আসা এলাকার ছেলে-ছোকরারা খানিকটা দূরে জটলা বেঁধে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গ্রামে একটি অপরিচিত মুখ দেখে ওদের মধ্যে কৌতূহলের উদ্রেক হচ্ছে। কিংবা আমার পরিহিত প্যান্ট-শার্ট, কোট অথবা দামি জুতোজোড়া আগ্রহ নিয়ে দেখছে। হয়তো ভাবছে লোকটা কোথাকার কে? তবে সাহস সঞ্চয় করে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করতে এগিয়ে আসেনি। বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার দাদাজানের বাড়ি, যে বাড়িটির বর্তমান মালিক আমি। বাড়িটি তিনি আমাকে কেন লিখে দিলেন, তা আমি জানি না। সঙ্গত কারণেই, এ লেখায় দাদাজানের নাম উহ্য রাখছি। বলে রাখা ভাল, তিনি এ দেশের একজন স্বনামধন্য গণিতবিদ। সারাজীবন কাটিয়েছেন গণিতের সাধনা-সমাধান করে। বীজগাণিতিক রাশি নিয়ে তিনি নতুন কিছু ধারণাও দিয়েছেন। দিনরাত দিস্তার পর দিস্তা খাতা জুড়ে কেবল অঙ্ক কষেছেন। দাদাজানের লেখা গাণিতিক গ্রন্থ দেশে-বিদেশে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ঢাকা শহরে তাঁর নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ করেছিল এক প্রকাশনা কোম্পানি। তিনি তা গ্রহণ করলেও, সেখানে কখনো বসবাস করেননি। নিরিবিলি পরিবেশ তাঁর পছন্দ, একা থাকার উদ্দেশ্যে শালবনের ভেতর এই বাড়িটি কিনেছিলেন। দাদাজান সারাজীবন খাপছাড়া জীবন যাপন করেছেন, চিরকুমার থেকেছেন। কেউ কেউ বলে কিশোর বয়সে তিনি একটি প্রেম করেছিলেন। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়, তারপর দাদাজান পরিবার ছেড়ে দেশান্তরী হন। বছর দুয়েক পর ফিরে এসে জানতে পারেন, মেয়েটি বসন্ত রোগে মারা গেছে। এ কথা শুনে হাউ মাউ করে কেঁদেছিলেন। তারপর আবার নিরুদ্দেশ। দাদাজান তাঁর বাবা-মার মৃত্যুর সময়ও উপস্থিত ছিলেন না। তাঁর বয়স যখন ত্রিশ বছর, তখন তিনি আমার আব্বুকে পুত্র হিসেবে দত্তক নেন। তখন তিনি থাকতেন পদ্মার পাড়ে একটি ভাড়া বাড়িতে। আব্বু কিছুটা বড় হবার পর, দাদাজান তাকে শহরে পাঠিয়ে দেন পড়াশোনার জন্য। প্রকাশনা কোম্পানির দেয়া ফ্ল্যাটটিই তখন থেকে আব্বুর ঠিকানা। এদিকে তিনি পদ্মার পাড়ে একাগ্র চিত্তে গণিত সাধনায় মনোনিবেশ করেন।
আব্বু কখনো কখনো পিতৃস্নেহ পাবার আশায় দাদাজানের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দাদাজান তা স্পষ্টভাবে অগ্রাহ্য করতেন। কারণ হিসেবে বলতেন, বিরক্তিবোধ করেন। তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কাজ করলে, বরাবরই রাগারাগি করতেন। শালবনের ভেতর এ বাড়িটি তিনি কিনে রেখেছিলেন অনেক আগে, একদিন হুট করে কাউকে কিছু না জানিয়ে স্থানান্তরিত হলেন। অনেকদিন ধরে এখানে তিনি নির্জন বাস করে যাচ্ছিলেন। আব্বু দেখা করতে এলে, সামান্য সময় কাটিয়ে ভেতরে চলে যেতেন। বুড়ো বয়সে একটা সময় তাঁর মধ্যে খিটখিটে মেজাজও তৈরি হয়। যাক সে কথা, পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনে চলে এলাম।
মিজান মিয়া দোতলার দক্ষিণপাশের ঘরের তালা ভাঙছে, শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমি অবাক হলাম, একটা তালা ভাঙতে এত সময় লাগে? তড়িধড়ি দোতলায় ওঠলাম। আমাকে দেখেই মিজান মিয়া হলদেটে দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল, প্রায় শেষ স্যার।
সত্যিই হাতুড়ি দিয়ে কয়েকটা আঘাত করতেই তালাটা ভেঙে গেল। মিজান মিয়াই প্রথম ঘরের ভেতর প্রবেশ করল। দাদাজানের মৃত্যুর পর এই প্রথম তাঁর ঘরে এলাম। হাতব্যাগটা টেবিলে রেখে, মোবাইল ফোনে টর্চের আলো জ্বেলে ঘরটাতে চোখ বুলালাম। পুরো ঘর অন্ধকার, মাকড়সার জাল, কালি-ঝুলিতে ভরপুর, মরিচা ধরা দরোজা-জানালা বন্ধ, চেয়ার-টেবিলে দু’ইঞ্চি পরিমাণ ধূলির স্তর জমে আছে। সেই সাথে ঘর জুড়ে একটা ভোঁটকা পুরনো ধাঁচের গন্ধ! আলমারিগুলোর দরোজা বন্ধ, সেখানে নিশ্চয়ই বই-খাতাগুলো ঠাসাঠাসি করে রাখা। আমার পক্ষে বেশিক্ষণ ঘরটিতে অবস্থান করা সম্ভব হয়নি। দ্রুত হাতব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। টেবিলের সামান্য ধূলির আস্তরণ হাতব্যাগের নিচের দিকটা দখল করে নিয়েছে। মিজান মিয়া সেটা ঝেড়ে পরিষ্কার করে দিলো।
মিজান মিয়াকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, বাজার থেকে একটি তালা কিনে আনো, তারপর ঘরটি আগের মতো বন্ধ করে রাখো। আমি আপাতত নিচতলায় তোমার ঘরটিতে থাকব। আর এ কয়েকদিন তোমাকে রাতের বেলা পাহারা দেবার প্রয়োজন নেই। বাড়িতে গিয়ে থাকবে, দিনের বেলা এখানে ডিউটি করবে।
এ বাড়িটিতে আসার পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। দাদাজানের উইল করা দলিল কিছুদিন আগে আমাদের হাতে পৌঁছে, তাঁর এক বন্ধুর মাধ্যমে। দাদাজানের মৃত্যু সংবাদ আমরা প্রথম জানতে পারি মিডিয়ার নিউজ দেখে। কারণ দাদাজানের সাথে আমাদের কোনো প্রকার যোগাযোগ ছিল না। তিনি মোবাইল ব্যবহার করেননি, চিঠি পাঠালে খুলেও দেখতেন না। কারো সাথে সাক্ষাত করার আগ্রহ তাঁর ছিল না, আব্বুকে অনেকবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। উইলটি দেখে আব্বু কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, তোর দাদাজান তোকে কোনোদিন দেখেনি, অথচ শেষ সম্বলটুকু তোকেই দিয়ে গেল। একটিবারের জন্য বাড়িটির অবস্থা দেখে আয়। স্মৃতি বলতে শুধু এ বাড়িটিই রয়েছে, তাঁর একটি ফটোগ্রাফ পর্যন্ত নেই। যা, বাবা। একটু ঘুরে ফিরে দেখে আয়।
দাদাজানের মৃত্যুর পর আব্বু মাত্র একবার এ বাড়িতে আসে। কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে ফিরে যায়। পরবর্তীতে আসতে চাইলেও, আম্মুর বারণ ছিল। আম্মু বলত, বাড়িটা ভুতুড়ে ধরনের, ওখানে না যাওয়াই ভাল। যদিও আম্মু কখনো এ বাড়িটি দেখেনি। আব্বু ভুতুড়ে বিষয় একদম বিশ্বাস করত না। কিন্তু আম্মুর নিষেধাজ্ঞাকেও আগ্রাহ্য করতে পারেনি। কারণ আম্মু বহু বছর ধরে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বিছানায়। উইলটা হাতে পাবার পর আব্বু আমাকে অনেকটা জোর করে এখানে পাঠিয়েছে। আমিও আব্বুর কথা ফেলতে পারিনি।
দুপুরে রেলস্টেশনের একটি হোটেলে লাঞ্চ করলাম। তারপর শেষ বিকেল অবধি বন্যপথে ঘুরে বেড়ালাম। রাতে মিজান মিয়া রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করল। আমি রাতের খাবার দেরিতে খাই বলে, তাকে সন্ধ্যা রাতেই বিদায় দিলাম। রাত এগারোটায় খাবার খেয়ে নিলাম। ভাবলাম জামা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে ঘুমুতে যাব। গতরাতে ট্রেনে অবশ্য ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি। ঘুমিয়েছি দু’ঘণ্টা। সাধারণত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার দু’আড়াই, সর্বোচ্চ চার ঘণ্টার বেশি ঘুম হয় না। তবে আজ সারাদিনের একটা ক্লান্তি জড়িয়ে রেখেছিল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেলাম। কখন লোডশেডিং হলো জানি না। মাঝ রাতে উপর তলার ঘরে কিছু একটার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে আমার প্রচ- যন্ত্রণা হয়। অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলাম না। দোতলার ঘরটায় ক্রমাগত চেয়ার-টেবিল নড়াচড়ার মতো শব্দ হচ্ছে। একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরল আমায়। বিরক্ত হয়ে মোবাইল ফোনের টর্চটা জ্বেলে উপরে গেলাম। সিঁড়ি ভেঙে করিডোরে পা দিতেই স্পষ্ট দেখলাম, দেয়ালের দিকে কারোর ছায়া দ্রুত সরে যাচ্ছে। আমাকে দেখে কেউ সাবধান হয়ে গেল। আমি নির্বিঘেœ সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, শব্দটার উৎস খোঁজার জন্য কান খাড়া রেখেছি। না, চারপাশ এখন স্তব্ধ! রাতের স্বাভাবিক নিরবতা।
ছায়াটা আমাকে কৌতূহলী করে তুলল। হাতেনাতে চোর ধরার ইচ্ছে অ্যাডভেঞ্চার মনে উঁকি দিচ্ছিল। নিঃশব্দে পা ফেলে করিডোর ক্রস করে সোজা দাদাজানের ঘরের কাছে গেলাম। মিজান মিয়া ঘরের দরোজায় নতুন একটি তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হলো, এ ঘরটাই ঐ বিশ্রী শব্দের উৎস। চোরের কথা মনে করে ভাবলাম, ঘরটাতে প্রবেশের একটাই উপায় তালা ভেঙে ভেতরে যাওয়া। দরোজায় তালা ঝুলতে দেখে চোর সংক্রান্ত সন্দেহ দূর হলেও, একবার ইচ্ছে হলো জানালা দিয়ে চোখ বুলাই। আমি টর্চের আলো ফেলে ভেতরে তাকালাম। কেউ নেই। দেখলাম, দিনের বেলার সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটা আর আগের মতো নেই, এখন পুরো ঘরটাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বুঝতে বাকি রইল না, এটা কেয়ারটেকার মিজান মিয়ারই কাজ। বিকেলে সে চুপি চুপি ঘরটা ধুয়ে-মুছে গুছিয়ে রেখেছে। হয়তো বাইরে থাকতে তার অসুবিধা, তাই এ ঘরটা প্রস্তুত করে আমাকে এখানে পাঠাতে চায়। এছাড়া উপায় কি! হুট করে তার ঘরটা দখল করে বসেছি, বেচারা সইতেও পারছে না কিছু বলতেও পারছে না। ছায়া ভাবনা ও চোর ধরার অ্যাডভেঞ্চার ইচ্ছা আমার মনে বেশিক্ষণ টিকল না। যাক, এবার ঘুমুতে যাওয়া দরকার। হাত ঘড়িতে দেখলাম রাত দুটো বাজে।
অবাক করা ব্যাপার, হঠাৎ অত্যধিক গরম অনুভূত হচ্ছে। সারা গা বেয়ে দর দর ঘাম ঝরছে। দ্রুত নিচে নেমে এলাম। ঘুমানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। মনে হচ্ছিল পুরো বাড়িটা গরমে ফেঁপে ওঠেছে। তড়িধড়ি কলতলায় গিয়ে ইচ্ছে মতো গায়ে পানি ঢাললাম। অনেকটা প্রশান্তি খুঁজে পেলাম। গোসল শেষে মনে পড়ল, এখনো ব্রিফকেস খোলা হয়নি, জামা-কাপড় ওটার ভেতরেই। ভেজা কাপড়েই ঘরে ঢুকে ব্রিফকেস খুলতে গেলাম। তখনই আবিষ্কার করলাম চাবিটা কোথাও হারিয়ে ফেলেছি।
নিজের প্রতি প্রচ- বিরক্তি তৈরি হলেও শান্ত হয়ে বসে আছি। শুধু একবার ভাবলাম, আলসেমির কারণে বিকেলে জামা চেঞ্জ করা হয়নি, হয়তো আরো আগেই জানতে পারতাম, চাবিটা হারিয়ে গেছে। তখন মিজান মিয়াই একটা উপায় করে ফেলত। কাল সকালে মিজান মিয়া এলে বলব ব্রিফকেসটা ভাঙতে হবে, এছাড়া জামা-কাপড় বের করার কোনো উপায় নেই।
বিদ্যুৎ চলে এল। ঘরের বাতি জ্বেলে দিলাম, ফ্যানের সুইচটা আগেই অন করা ছিল। ভগ্নমনে ভেজা কাপড়েই শুয়ে পড়লাম। ঠা-া মাথায় ভাবতে লাগলাম চাবিটা কোথায় হারিয়েছি। ট্রেনে একবার ব্রিফকেস খুলে আপেল খেয়েছিলাম, তারপর চাবিটা ঠিকঠাক মতো পকেটেই রেখেছি। এখানে পৌঁছার পর চায়ের দোকানে যাওয়া হয়েছে, টাকা বের করার সময় দেখেছি তখনও চাবিটা পকেটেই। বাড়িতে আসার পর মিজান মিয়াকে দিয়ে তালা ভাঙানোর কথা মনে পড়ল। যতদূর মনে পড়ে দাদাজানের ঘরে গিয়ে হাতব্যাগটা টেবিলের উপর রেখেছি, মানিব্যাগ বের করে মিজানকে টাকা দিয়েছি নতুন তালা কেনার জন্য। তখন চাবিটা কি টেবিলের উপর হাতব্যাগের পাশে রেখেছি? হয়তো।
আচ্ছা, একবার উপরতলাটা দেখে এলে কেমন হয়?
বিছানা ছেড়ে উপরে দাদাজানের ঘরের কাছে গেলাম। টর্চ জ্বেলে জানালাটা খুলতেই দেখলাম, চাবিটা টেবিলের উপরে। চাবির পাশেই চোখে পড়ল, লাল বর্ডারের একটি ডায়েরি, যার মাঝখান থেকে পাতা খোলা। কেউ যেন চেয়ারের বসে ডায়েরিটা পড়ছে বা কিছু লিখছে। খানিকটা খটকা লাগল, এক ঘণ্টা আগেও এ ঘরটা দেখে গেলাম। তখন টেবিলের উপর তেমন কিছু চোখে পড়েনি, চাবির রিং ক্ষুদ্র বলে অগোচরে থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ডায়েরিটা এলো কোত্থেকে? এটা আপনা আপনি হতে পারে না, নিশ্চয়ই ঘরে কেউ আছে। চিৎকার করে ওঠলাম, কে আছিস ঘরে? কী চাস এখানে?
আমার চিৎকারের কোনো সাড়া নেই। বরং দূর থেকে আমার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনিই ফিরে এল। ভাবলাম, যেহেতু মিজান মিয়ার কাছে এ ঘরের চাবি, সে না এলে তালা খোলা সম্ভব না। সুতরাং ফিরে যাওয়াই ভাল। ফিরে এসে ঘুমালাম।
ঘুম থেকে জাগলাম বেলা নয়টায়। ওঠে বসলাম, কিন্তু ঘুম ভাঙা ক্লান্তি আমাকে জাপটে ধরে আছে। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন এখনো চোখ থেকে সরাতে পারছি না। আমি দাদাজানকে সরাসরি কোনোদিন দেখিনি বটে, তবে আব্বুর বর্ণনা ও পত্রিকায় ছাপা রিপোর্ট থেকে মনের ভেতর কল্পনার রঙ তুলিতে একটি ছবি এঁকে রেখেছি। লম্বা চুল, সাদা দাড়িতে ভরা মুখ, চোখে চশমা, কপালে চিন্তাশীল ভাঁজ, দার্শনিক প্রজ্ঞাবান ভাব। ভাবনার সে মানুষটাই স্বপ্নে দেখা দিলো। সমকোনী ত্রিভূজের মতো চেয়ারে বসে একটানা অঙ্ক কষে চলেছেন। সংখ্যাগুলো পরিচিত হলেও অঙ্কের কোনো ফর্মূলা আমার মাথায় ঢুকছে না। দাদাজান দিস্তার পর দিস্তা খাতায় লিখে যাচ্ছেন। তাঁর ব্যাখ্যাহীন লেখার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। দাদাজান হেসে কাছে ডাকলেন। আমি ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম। বললেন, তোর চোখ দেখেই বুঝেছি জটিল গাণিতিক লেখাগুলো তোকে কৌতূহলের দরিয়ায় ফেলে দিয়েছে। তাই না?
আমি কিছুই বললাম না, দাদাজানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
সোম, এটা হলো ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা। একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক ও চতুর্মাত্রিক জগতের গোপন সূত্র। এ জগতগুলোর রয়েছে নিজস্ব কিছু সমীকরণ, যা সমাধান করার জন্য প্রয়োজন এই ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা। এ ফর্মূলা ভেদ করতে পারলে একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক ও চতুর্মাত্রিক জগতের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। এমনকি সময় ভ্রমণকারীরা এক জগত থেকে অন্য জগতে সফলভাবে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।
আমাকে চুপচাপ দেখে দাদাজান বললেন, একটু মনোযোগ দিলেই বুঝতে পারবি। কিন্তু সে মনোযোগ দেয়া আর সম্ভব হয়নি। ঘুম ভেঙে গেল। যতদূর জানি স্বপ্ন মানুষের অবচেতন মস্তিষ্কের কল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। তদ্রুপ আজকের এ স্বপ্নটাও আমার দীর্ঘক্ষণ গাণিতিক বিষয় ও দাদাজানকে নিয়ে ভাবনার ফসল।
ততক্ষণে মিজান মিয়া চলে এসেছে। তাকে দেখেই আমি ভেজা বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলাম।
দ্রুত, চলো উপর তলায়।
আমার কথা শুনে মিজান মিয়া হকচকিয়ে গেল।
কেন? কী হয়েছে?
আরে, গতকাল ওখানে চাবি ফেলে এসেছি।
মিজান মিয়া আর কথা না বাড়িয়ে উপর তলায় এল। দাদাজানের ঘরের দরোজা খুলতেই ভেতরে ঢুকলাম। টেবিলের উপর থেকে চাবিটা তুলে নিলাম বটে, কিন্তু ঘরের অবস্থা দেখে আমি চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ঘরটি সেই আগের মতো অন্ধকার, ধূলি-কালিতে ভরপুরই আছে। তাহলে গতরাতে যা দেখলাম তা কি মিথ্যে?
না, আমার সেন্স তো ঠিক আছে। যা দেখেছি ঠিকই দেখেছি। টেবিলের উপর একটা ডায়েরি দেখেছিলাম, কোথায় সে ডায়েরি? না, নেই। কিছুই তো নেই। লাল বর্ডারের ডায়েরিটা কি কেউ সরিয়ে ফেলেছে। চুরি হয়ে যায়নি তো?
পুরো ঘরটা ভালভাবে ঘুরে দেখলাম। একটি মাত্র দরোজা, দুটি জানালা। এখানে দরোজা ভাঙা ব্যতীত কারোর প্রবেশ বা প্রস্থান কোনোটাই সম্ভব নয়। যুক্তি দিয়ে কিছুই মেলাতে পারছি না। ঘর পরিচ্ছন্ন হবার ঘটনাটি যদি চোখের ভ্রম হিসেবে ধরে নিতে পারি, তবে ডায়েরির আবির্ভাব ও উধাও হওয়ার ঘটনাটি রহস্যজনক। ডায়েরিটি এখানে আগে থেকে ছিল না, এখনও নেই। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মিজান মিয়ার উপর আমার সন্দেহ হলো। সন্দেহটা প্রকাশ না করে বললাম, দ্রুত দাদাজানের ঘরটা পরিষ্কার করো। মিজান মিয়া আরো দু’জন লোক নিয়ে এসে কাজ শুরু করল। দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু তদারকি করলাম। তারপর ঘরে তালা আটকিয়ে চাবিটা আমার পকেটে রাখলাম।
[চলবে...]
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)