কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম


কাজী নজরুল ইসলাম
অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী ও মানবতার কবি

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সংকটের নাম হচ্ছে মানবতা। অধিকাংশ মানুষের মুখে একটাই কথা, বিশ্বব্যাপী বিপন্ন মানবতা। মানুষের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক বৈষম্য, বিনষ্ট হচ্ছে ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি। অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার ও শাসন আজও পৃথিবীর বুকে স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এই অত্যাধুনিক যুগেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে পৃথিবীতে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে আর অকাতরে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। বর্বরতার চূড়ান্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে নারী নির্যাতন। আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়ে ছিলেন বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তি বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, সাম্যবাদী, বিদ্রোহী, প্রেম ও দ্রোহের কবি। বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা, বিরলপ্রজ বিস্ময়কর প্রতিভা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, গায়ক, অভিনেতা, সাংবাদিক, সম্পাদক ও সৈনিক। বাংলাসাহিত্যে দৃঢ়তা বা শক্তিময়তার যে অভাব ছিল, তার সৃষ্টি দ্বারা তিনি অবলীলায় তা পূরণ করেছেন। তার অনবদ্য সৃষ্টিতে বাংলা কাব্য সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতকে তিনি অনন্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নজরুলকে মূল্যায়ন করতে হলে তার অনন্য সৃষ্টি দিয়েই মূল্যায়ন করতে হবে। তিনি যেখানেই অন্যায় দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদ করেছেন। কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করেননি, এটাই তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়ে ছিলেন বিদ্রোহী কবিতা রচনা করে। এক বিদ্রোহী কবিতাই পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে কাঁপিয়ে দিয়ে ছিল। তিনি মাথা উঁচিয়ে বলেছিলেন- "বল বীর/ বল উন্নত মম শির!/ শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!/ বল বীর/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/ চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া/ খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!"
তিনি গানের বুলবুল, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কলমযোদ্ধা। তিনি দুখু মিঞা, জীবনকে দেখেছেন নিদারুণ দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে দীর্ণ-শীর্ণ হতে। সেই কারণেই হয়তো শৈশব হতেই তিনি ছিলেন বেপরোয়া এক জীবনসন্ধানী। জীবনসত্য অন্বেষণ করতে তিনি ছুটেছেন নিরন্তর। তিনি চঞ্চল, অস্থির, কখনওবা দারুণ অভিমানী। অভিমানই তাহাকে বিদ্রোহী বানিয়েছে। সে কথা তিনি নিজেও অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, "এই বাঁধনহারা মানুষটি ঘরোয়া আঙিনা পেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছে। যে নীড়ে জন্মেছে এই পলাতক, সেই নীড়কেই অস্বীকার করেছে সর্বপ্রথম উড়তে শিখেই।" কখনও যাত্রা দল, কখনও লেটোর দলের সঙ্গে ক্লান্তিহীন ছুটেছেন দেশের নানা প্রান্তে। বিদ্রোহী চেতনার দুর্নিবার এই বাঁধনহারা মানুষটি সারা বিশ্বটাকে দেখার সংকল্পে লিখেছিলেন- "থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে/ কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে/ দেশ হতে দেশ দেশান্তরে/ ছুটছে তারা কেমন করে/ কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে/ কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরন-যন্ত্রণাকে।" নজরুল তার কিশোর বয়স থেকেই নিপীড়িত ও নির্যাতিত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তার শাণিত কলম ধরেছিলেন, যা আজও এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তিনি শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি হয়ে হৃদয়স্পর্শী মানবিকতা থেকে লিখেছেন- "দেখিনু সেদিন রেলে/ কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!/চোখ ফেটে এল জল/ এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?" মানবতার সাথে সাম্যের বাণী তার সৃষ্টিতে বারে বারে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি অন্যত্র লিখেছেন- "এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই কিংবা কারো মনে তুমি দিওনা আঘাত/ সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে/ মানুষেরে তুমি যতো কর ঘৃণা/ খোদা যান তত দুরে সরে।"

নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন সাম্যবাদী। তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিপক্ষে কলম ধরে একটি অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যের পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন এবং দেখাতেন। তিনি যা বিশ্বাস করেছেন-তাই বলেছেন এবং তাই করেছেন। যে কারণে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন- "ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম।" জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে ছিলেন বলেই তিনি লিখেছেন- "গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।" বাাংলর সাধাারণ হিন্দু মুসলমান হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করে আসছে। ধর্মীয় কুসংস্কারের বাইরেও সমাজপতিরা নিজ স্বার্থে সমাজে প্রতিহিংসা ছড়িয়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি বিনষ্ট করে। তাই তাদের হুঁশিয়ার করে নজরুল অন্যত্র লিখেছেন- "হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।" আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষদের আলাদা করে দেখা হলেও নজরুল উভয়কে মানুষ হিসেবে দেখতেন। তিনি সুগভীর ভাবে উপলব্ধি করতেন, নারী মুক্তি ব্যতীত সমাজ ও দেশ এগিয়ে নেওয়া অসম্ভব। দেশের অর্ধেক জনশক্তি অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকলে দেশ ও জাতি অন্ধকারে ডুবে থাকবে। তৎকালীন সমাজে নারীদের অবদান স্বীকৃত ছিলো না। পুরুষই সর্বেসর্বা আর নারীদের দেখা হতো পরনির্ভরশীল দূর্বল হিসেবে। নজরুল বিশ্বাস করতেন, এই পৃথিবীতে যত কল্যাণকর কাজ আছে, তার সবকিছুতেই পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অবদান আছে। পক্ষান্তরে পৃথিবীতে রক্তপাত, হাসাহাসি, বেদনা, দুঃখ, কষ্টের যে স্রোত বহমান- তাতেও নারী-পুরুষ সমানভাবেই দায়ী। তাই তিনি লিখেছেন- "সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।"

নজরুল সমাজচেতনা ও রাজনৈতিক জগতের সর্বোত্তম কবি, যিনি গণমানুষের সঙ্গে সাহিত্যের যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। তিনি ছিলেন কর্মে ও চিন্তায় স্বাধীন। দাসত্বের বন্ধন মুক্তি ও প্রাচীন সংস্কারের শৃঙ্খল ভঙ্গ করার সংগ্রামে উচ্চকণ্ঠ। তার সৃজনশীল কর্মে এসব প্রকাশ পেয়েছে পরতে পরতে। তার কাব্যের বাণী, গানের কথা কিংবা ক্ষুরধার লেখনী বুলেটের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যজীবনে তিনি বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন পর্যন্ত বিপুল প্রেরণা জুগিয়েছে তার গান, রচনাবলি ও কবিতা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি 'বিদ্রোহী কবি' এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে 'বুলবুল’ নামে খ্যাত। নজরুল তার সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। এ কারণে ব্রিটিশ সরকার তার বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে। এমনকি কারাদণ্ডেও দণ্ডিত করা হয়। তারপরেও তিনি দমে যাননি। বরং এতে আরও বেশি উৎসাহ  পেয়েছেন। রাজবন্দীর জবানবন্দী এবং প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করে ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। এই জন্যেই তাকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানান নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নজরুল যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য তাকে উৎসর্গ করেন। এ ঘটনায় উল্লসিত হয়ে কাজী নজরুল জেলখানায় বসে লেখেন তার অনুপম কবিতা 'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে'। সমকালীন অনেক রবীন্দ্রভক্ত ও অনুরাগী কবি-সাহিত্যিক এই বিষয়টি ভালো চোখে দেখেননি। কেউ কেউ অভিযোগ করলে রবীন্দ্রনাথ তাদের নজরুল-কাব্যপাঠের পরামর্শ দেন এবং বলেন, "যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।" নজরুল বাংলা গজল গানের স্রষ্টা। গণসঙ্গীত ও গজলে যৌবনের দুটি বিশিষ্ট দিক সংগ্রাম ও প্রেমের পরিচর্যাই ছিল মুখ্য। নজরুল গজল আঙ্গিক সংযোজনের মাধ্যমে বাংলা গানের প্রচলিত ধারায় বৈচিত্র্য আনেন। তার বেশিরভাগ গজলের বাণীই উৎকৃষ্ট কবিতা এবং তার সুর রাগভিত্তিক। আঙ্গিকের দিক থেকে সেগুলো উর্দু গজলের মতো তালযুক্ত ও তালছাড়া গীত। নজরুলের বাংলা গজল গানের জনপ্রিয়তা সমকালীন বাংলা গানের ইতিহাসে ছিল তুলনাহীন। ইসলামী সঙ্গীত তথা বাংলা গজল রচনারও পথিকৃৎ তিনি। এছাড়াও তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় তিন হাজার গান রচনা এবং সুর করেছেন। যেগুলো নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।

ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা এবং সাংবাদিকতা করলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই খ্যাতিমান। ব্যক্তিত্বের অনমনীয় দৃঢ়তায় নজরুল যেমন সাম্রাজ্যবাদ ও অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, ঠিক তেমনি সমকালীন সমাজের হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নিজের জীবন ও সাহিত্য দিয়ে বিদ্রোহ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তার মতো অসাম্প্রদায়িক মানুষ পাওয়া বিরল। ১১ জৈষ্ঠ্য  ১৩০৬ বঙ্গাব্দে (২৫ মে ১৮৯৯ সাল) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১ ফেব্রুয়ারি 'একুশে পদকে' ভূষিত করে। ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে (২৯ আগস্ট, ১৯৭৬) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছিলেন, "মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।" জাতীয় কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করে সাহিত্য সমালোচকরা অকপটে স্বীকার করেন, নজরুল কট্টর ভাবে ব্রিটিশ বিরোধী অবস্থান না নিলে সাহিত্য বিষয়ক পৃথিবীর প্রায় সকল তকমা তার নামের পাশে শোভা পেত। তবে নজরুলকে কোন তকমা দিয়ে নয়, বরং তার অমর সৃষ্টি দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে।

শরৎ ও শুভ্রতা

শরৎ ও শুভ্রতা


শরৎ ও শুভ্রতা
হাসান মাহমুদ বজ্র
দু-বছর পূর্বে আমি এখানে এসেছিলাম পূজার ছুটিতে। বেশ কদিন  বন্ধ পাওয়ায় বেড়ানোর জন্য ছুটে আসি এখানে। বাড়ি থেকে অনেক দুরে,দুর সম্পকের এক খালার বাড়িতে। তখন এই নদীর দু-কূলে ছিলো ঘন কাশফুলের ছড়াছড়ি। যেন কারো যতনে চাষ করা করেছে এ ফুল। প্রথম যখন এখানে আসি, তখন এক  বিকেলে একা একা এই নদীর তীরে হাটতে এসেছিলাম। আমরা যারা চট্টগ্রামের তারা নিতান্তই পাহাড় দেখায় অভ্যস্ত, তাই স্বভাবতই আমাদের নদীর তীরে হাটতে ভালো লাগে। দু-তীরের ঘন কাশবনে ঘেরা নদীর দু-কূল ও নিকটের প্রান্তর নিতান্তই নির্জন। এ যেন বিধবার বুকের নির্জনতা। মাঝে মাঝে সেই নির্জনতার বুক ছিঁড়ে বিধবার বুকের দীর্ঘ শ্বাসের মতো শব্দ করে বাতাস ছুটে আসে । সেই হাওয়া ঝাপটে গুঞ্জরন তুলে কাশের বনে। দুলে উঠে কাশফুল,জলধির তরঙ্গের মতো করে। সেই কী রূপ, এ যেন প্রিয়ার আঁচল। হাওয়া সনে কাশবনের এই সন্ধি মিলন দেখে জেগে উঠে প্রেম ফুঁসে উঠে কবিত্ব। উঠে কবিতার পস্রব বেদনা । ছটপট করছে জন্ম যন্ত্রনায়। এখনি হবে জন্ম একটি কবিতার, ভালো লাগা কিছু শব্দের সনে হবে শব্দের বাসর। ছন্দের চুম্বনে বাক্য পাবে পূর্ণতা। একটু খালি জায়গা দেখে আমি নদীর দিকে মুখ করে বসি শব্দের সনে শব্দের মিলন ঘটানোর প্রয়াসে। নদীটি বড় নয়,তবে নিতান্ত ছোট ও নয়। কিন্তু গভীর তাতে সন্দেহ নেই। কবিরা গভীরতা পরখ করতে পারে অনায়াসে। জীবনের গভীরতা, ভালো লাগার গভীরতা, সম্পর্কের গভীরতা, প্রেম প্রীতি বন্ধন সব গভীরতা কবির চোখে ধরা দেয়। তাইতো কবিরা শব্দের সনে শব্দের মিলন, জীবনের সনে জীবনের মিলন এত সহজে ঘটাতে পারে। এই নদীর জল কাশফুলের মতো নিতান্তই সলিলতার দাবিদার। আকাশের ওই মেঘের মতো সচ্ছ। আকাশের খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলা গুলো নদীর জলের বুকে করে লুকোচুরি খেলা। মাঝে মাঝে পরম আদরে চুম্বনও একে দেয় তার বুকে। আর এই তরঙ্গিণী লজ্জায় মুখ লুকায়। সেই দৃশ্য শুধু কবিই দেখে, আর দেখে দুলে উঠা কাশফুল। হাতের কাছে কিছু নুড়ি পড়ে আছে যৌবন হারানো বৃদ্ধের মতো। প্রেম আর মিলনের এই শুভক্ষণে এই যে বড়ই বেমানান। ছুটে দিই তারে নদীর বুকে। যদি সে পারে ভরা যৌবনের নদী থেকে কিছু প্রেম হাসিল করতে। একে একে সব গুলো নুড়ি ছুটে দিই অথই তটিনীর বুকে।

হঠাৎ চমকে উঠি। ধমকে জাগে হিয়া। পাশে কে মোর? পাশে এ কোন প্রিয়া? রূপে তার চমক ভারী। পলকে মন নিয়েছে কাড়ি। কাশফুল নিতে এসে প্রিয়া করেছে কবির মন চুরি। আহা, যৌবনে মাদল বাজ, কি করি মরি লাজে। কাশফুল দিয়ে মেয়ে সাজাও বাসর, জমিয়ে বসাব আজ প্রেমের আসর।

গাঁয়ের এক চঞ্চলা কুমারী। করতে আসছে কাশফুল চুরি। সাদা কাশের বনে নির্জন প্রান্তরে যেন সাদা ডানার কোন হুর পরী। গায়ের জামা নীল আকাশের নীল রঙে রাঙানো। আর তার উপর সাদা উড়নাটা  নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ। মেঘের ভেলার মতোই হালকা বাতাসে উড়ে তা। শরতের রূপের বর্ণনা দেওয়া নিতান্তই সহজ হলেও নারীর রূপের বর্ণনা বড়ই দুর্বোধ্য। আমার কাছে শুধুই দুর্বোধ্য নয় রীতিমত অসাধ্য। এ রূপে বর্ণনার  হয়না। রূপের ভিতর এ আরেক রূপ । স্বর্গের পরী আদৌ কি এমন। যদি এমন হয় হে বিধাতা আমার আজই স্বর্গে তুলে নাও। এই স্বর্গ কুমারী আমি ছুঁয়ে দেখতে চাই। তার টানা চোখ দুইটি বড়ই স্থির। এ যেন রূপ কথার মায়াবী হরিণীর চোখ। সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো তার ঠোট। টানা দুটি ভ্রু যেন পূর্ব-পশ্চিমের  দু' দিগন্ত ছুয়েছে। আর এসব দেখে কবি হারিয়েছে চেতনা।

দিন যেতে যেতে পরিস্থিতিটা এমন হয়েছিলো যে, আমি ও শুভ্রতা কেউ কাউকে ছাড়া কিছুই যেন ভাবতে পারি না। সেই কাশবনে প্রথম দেখার পর শুভ্রতাকে আমি বহুকষ্টে জয় করেছিলাম। যদিও শুভ্রতা প্রথম দেখাতেই আমার মন প্রাণ দেহ সবিই জয় করে নিয়েছে প্রথম পলকেই। এসব দু-বছর আগের কথা। কাশবনে আমাকে দেখেই মেয়েটা তখন ফিরে যাচ্ছিলো। সে খুবই বিস্মৃত হয়েছিলো আমাকে দেখে। আসলে এই নির্জন প্রান্তরে এ সময় সে কাউকে  আশা করেনি। আর কেউ এদিকে তেমন একটা আসেও না। এমন সময় অপরিচিত কাউকে দেখে যে কেউই একটু অবাক হবে। শুভ্রতাও অবাক হলো। ভয় যে পায়নি তাও নয়। আমাকে দেখে সে দ্রুত ফিরে যাচ্ছে। আর  আমি অানমনে তাকে অনুসরন করি । এ যেন মেঘের ভেলার পিছনে ছুটা। ছুঁতে চাইলেও ছোঁয়া যায় না। আনমনে হাটতে হাটতে আমার হলো কাল। একেবারে কাঁদা পানিতে ডুবাডুবি। কাঁচা রাস্তার মাঝে তৈরী হওয়া গর্ত আমাকে সাঁতার কাটিয়ে ছাড়লো। সবই কোপাল। ততক্ষণের সখি আমার দৃষ্টির বাহিরে।

যত দুরে যাও মেয়ে, নিস্তার নেই। তোমায় আমার হতেই হবে।এরপর প্রায় দিন দশেক ধরে রাজ্য জয় করার মতোই সাধনা করে আমি শুভ্রতার মন জয় করেছিলাম। এরপর আমি বাড়িতে ফিরে যাই। শুভ্রতার সাথে তখন থেকে আমার ফোনে আলাপ হতো নিয়মিতই। শুভ্রতা লুকিয়ে  কল দিতো আমায়। প্রতিদিনই কথা হতো। আর একদিন মিস হলে নিদ্রা আমাদের ছুটি দিতো। শুভ্রতারতো ক্ষুধাও পালাতো।  প্রথম বার শুভ্রতার এলাকা হতে চলে যাওয়ার পর আমার  আর শুভ্রতার সাথে দেখা হয়নি। তবে আলাপ হতো নিয়মিত।
-শুভ্রতার সাথে আমার পরিচয়ের দু-বছর পর একদিন শুভ্রতার বড় ভাই বিষয়টা জেনে যায়। ফলে পুরো পরিবার শুভ্রতার সাথে কর্কশ আচারণ করতে শুরু করে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর শুভ্রতা আমাকে ফোন করে বলেছিলো আর কথা হবে না। এরপর শুভ্রতার সাথে আমার এক মাস যাবৎ কথা হয়নি। মন চাইতো শুভ্রতার কাছে উড়ে চলে যেতে, কিন্তু একদিকে পরিক্ষা অন্যদিকে পরিবার উপেক্ষা করে যাওয়াটা ছিলো অসম্ভব। আর মানসিক সাহসেরও ছিলো যথেষ্ট অভাব । যদি পরিবারের উপেক্ষা করতে পারতাম তাহলে পরিক্ষা না দিয়ে হলেও চলে যেতাম প্রিয়ার কাছে, কিন্তু মা বাবার অনুমতি ছাড়া পরিক্ষার মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার সাহস হয়নি। যদি না জানিয়ে যেতাম তাহলে সব তছনছ হয়ে যেত। পরিবারের ছোটছেলে বলে কথা।  আমি জানতাম শুভ্রতা আমার সাথে কথা না বলে ভালো নেই। শুভ্রতা আমার সাথে কথা না বলে একদিন ও থাকতে পারতো না। তবে পরিস্থিতিটা ছিলো এমনই কোন ভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে আমি প্রতিদিনই শুভ্রতার বাড়িতে ফোন করতাম। সহ্য করতাম তার পরিবারের অকথ্য গালি-গালাজ। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই পরিক্ষার শেষ করেই বাড়িতে না বলে আমি শুভ্রতার বাড়ি যাবো। সেখানে আল্লাহ যা করে তাই হবে। কারণ আমি এবং শুভ্রতা কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচার চিন্তা ও যেন করতে পারি না। আমার শেষ পরিক্ষার আগের দিন রাতে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে শুভ্রতা কল করে। ফোন ধরে শুভ্রতা  কাঁদতে থাকে।  কাঁদার জন্য কথা বলতে পারে না সে। শুধু এটুকুই বলে "একবার দেখতে চাই তোমায়"। লাইনটা কেটে যায়। এরপরে এই নাম্বারে কল করে শুভ্রতাকে আর পাইনি। এর  কিছুক্ষণ পরে শুভ্রতার বাবা আমাকে কল করে কাঁদতে থাকে। শুভ্রতা খুবই অসুস্থ, আমাকে দেখতে চাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে সেখানে যেতে। দীর্ঘদিন মানসিক বিপর্যয়, অনিদ্রা ও খাবার অনীহা হেতু শুভ্রতা মারাক্তক ভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। আমি আর থাকতে পারিনি,  যদি আমার ডানা থাকতো তাহলে উড়ে যেতাম শুভ্রতার কাছে। কিন্তু তাতো অসম্ভব। আমি ইমারজেন্সি টিকেট কেটে বাড়িতে না বলেই শুভ্রতার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাওয়ানা হই। পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরের দিন সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমি এখন সেখানেই বসে আছি, যেখানে আমার আর শুভ্রতার প্রথম দেখা হয়েছিলো। নদীর কিনারের কাশফুল গুলো ঝুপসে গেছে। এই কিনারা যেন আগের চাইতে আরো বহুগুনে নির্জন। যেন পৃথিবীর সকল নির্জনতা এসে ভিড় করেছে এখানে। নদীর কুলকুল শব্দ আর কানে আসছে দক্ষিণের শীতল বায়ুর সাথে। পাখিরা যেন আজ ডাকতে ভুলে গেছে। ঝিঁঝিঁ পোঁকার ডাক ক্রমশ বাড়ছে।এখন রাত, আকাশের চাঁদটা আজ কেন যেন হাসছে না। নিথর হয়ে যেন আকাশের বুকে কাঁদছে। তার  বোবা জোছনা যেন এই প্রান্তরকে আরো ভীষন শীতল আর নিরব করে দিয়েছে। জোনাকী পোকা গুলো কাশের ঝাঁড়ে নিরবে কাতরায়।আর আমি বসে আছি আমার প্রিয়ার পাশে, শুভ্রতার খুব কাছে। দোষটা হয়তো আমার ছিলো শুভ্রতা। এতো অভিমান কেন করলে শুভ্রতা? কেন আমায় এত ভালোবাসলে? ভালোবাসলেই যখন আর একটু অপেক্ষা কেন করলে না ? আমি এসেছি শুভ্রতা, দেখ তোমার খুব কাছে। নিরব কবর হতে কোন উত্তর আসে না। রাত গভীর হতে থাকে,  আর চারদিক ভারী  হয়ে উঠে এক অতৃপ্ত প্রেমিকের আর্তচিৎকারে।

কালো চশমায় রঙিন স্বপ্ন!

কালো চশমায় রঙিন স্বপ্ন!


কালো চশমায় রঙিন স্বপ্ন! কাজী তানভীর

সম্ভাবনার এক  টগবগে তরুণের নাম সাজিদ।
মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সাজিদ সবার বড়। পড়া-শোনার ফাঁকেফাঁকে পরিবারের অনেকটা কাজ বাবার সাথে তাকেও জোগান দিতে হয়।  ছোট থেকে-ই বিশাল বিশাল স্বপ্ন নিয়ে মনোরাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। বাবার অপ্রচুর আয়ে আর কতই বা কী স্বপ্ন দেখা! বাবার সীমিত আয়ে বিরাট একটি পরিবারের ভরণ-পোষণ। কতই না কষ্ট বাবার।  কালো চমশমায় রঙিন স্বপ্ন দেখে কী হবে আর! আখের আগামীটা কালোময় দাঁড়াবে।
এত সবের পরেও সাজিদের স্বপ্ন দেখতে কোন প্রকার অলসতা নেই! সাজিদের ভাবনা, স্বপ্ন দেখতে তো আর টাকা লাগে না! দেখতে থাকি, হয়তো একদিন স্বপ্নের দোরে সফলতা কড়া নাড়বে! ভাবারি কথা। কারণ, পড়া-শোনায় সাজিদ অনেক ভালো। চিন্তা চেতনাও সবার চেয়ে আলাদা। বন্ধু-পড়ার সবার ফিউচার প্লেন, কেউ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কিছু। কিন্তু সাজিদের ইচ্ছে সে একজন ভালো মানোবিজ্ঞানী বা চিত্ত বিজয়ী একজন মহান মানুষ হবে । যার দ্বারা মানুষের মনের রাজা হতে পারে, মানুষের চিত্ত জয়ী করতে পারে, মানুষকে সত্যের সন্ধান দিয়ে অসৎ এর রাজ্য থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।   তাই সে নাস্তার টাকা জমিয়ে গল্প,উপন্যাস,কবিতা,ছড়া ইত্যাদি বই বাজার থেকে সদায় করে আনতো। বাবা-মা না দেখে মত কাপড়ের ভেতরে করে নিয়ে গিয়ে রেখে দিতো ডেক্সের ভেতর।  সদা তালা লাগিয়ে রাখতো ডেক্সে, যাতে কেউ দেখে না ফেলে।
এসব বই পড়ার সময় কই!  সবসময় পরিবারের কাজে! ভালো করে কলেজের পড়াগুলো পড়ার সুযোগ মিলে না। সাজিদ খুব একটা মজার ফন্দি করেছে। "হুম। সুযোগ পেয়েছি, রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে যাবে, তখন বাড়ির অদূরে বাঁশ বাগানের খোলা মাঠটিতে চলে যাবো, আর সেখানেই পড়বো। নিঝুম রাত, জোছনাভরা আকাশ। হৈচৈহীন পরিবেশ। সব মিলে বাঁশতলার  রাতগুলো প্রকৃতির দারুণ পরিবেশন। মজার মজার গল্প, উপন্যাস, ছাড়া,কবিতাগুলো পড়তে কতই না মজার! পরিবেশটাতে সাজিদে অন্ত্যরাজ্য বয়ে যাচ্ছে প্রফুল্লতার আভা। খোরাক মিলছে বই পিপাসাক্ত হৃদের। ভুলে গেল পেছনের সমস্ত গ্লানি। আজ বেশ আনন্দমনা সাজিদ। বই পড়া শেষে ফের বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
এভাবে সুখময় রাত পার করছে সাজিদ। তার দৌড়হীন কলমে স্বচ্ছতা জোগাচ্ছে প্রতিদিন। লিখে যাচ্ছে রোজ নামচা, গল্প, কবিতা। প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে!  লিখনির ছোঁয়ায় কেড়ে নিচ্ছে পাঠকের মন-প্রাণ। পাঠকরা মত্ত হচ্ছে তার মনমুগ্ধকর লিখনিতে। সব যখন ঠিকঠাক চলছে, ঠিক তখনি মাথার উপর বয়ে যেতে শুরু করল ব্যার্থতার ধমকা হাওয়া। আটিয়ে উঠতে দিলো না সাজিদকে। পাঁও মুচড়ে ফেলে দিল ব্যার্থতার গর্তে।
সাজিদের বাবার মাথায় টাকা-কড়ির ভূত চেপে বসছে।
অবশেষে তাকে পড়ি জমাতে হলো ভূ্ঁই ছেড়ে বিভুঁই পানে। তার এখন প্রবাস জীবন।  এখন সাজিদ পরের গোলামী করছে। গ্রামের সেই বই পড়ার সুযোগ আর হয় না। সারাবেলা কাজ। এই সবের ফলাফল সরুপ। হেরে যেতে থাকে তার প্রতিভা। হেরে যায় তার পুষ্পময় মন-মানসিকতা! হেরে যায় তার সবই-সব!  আহ!

এমন হাজারো সাজিদের মত সম্ভাবনাময় তারুণ হেরে যাচ্ছে আর্থিক স্বচ্ছলতার কাছে। হেরে যাচ্ছে পরিবারের কাছে। হেরে যাচ্ছে নিজের কাছেও। কেন তোমরা কি নজরুলের নানরুটির দোকানে চাকরি করার মত সাড়াজাগা গল্প শোননি? তোমরা কি নজরুল যুবকের অনুসারী নয়? সে নজরুল যুবকই হলো সবুজঘেরা বাংলার জাতীয় কবি। তাই না! 
এসো আমরা আমাদের কাজকে ভালোবেসে করি, দৃঢ়তার সাথে করি। তার উপর পরিপূর্ণ আস্থাশীল হই!  ইনশাল্লাহ সফলতা আসবে।

এডমিট কার্ড

এডমিট কার্ড


এডমিট কার্ড
অনন্ত পৃথ্বীরাজ

পত্রিকা খুললে আজকাল দুঃসংবাদই বেশি চোখে পড়ে। ডেঙ্গুর মহামারি আকার ধারণ, রোহিঙ্গাদের মানবতর জীবন সংগ্রাম, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্রয় কেলেংকারিসহ শত শত নেতিবাচক খবরে সংবাপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ভরপুর। সত্তর উর্দ্ধ বয়সে এখন বেঁচে থাকার আশা ম্লান হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দূর-দুরন্ত থেকে দু’একটি চিঠি আসে। পড়ে আনন্দ পাই। পুরনো দিনগুলো তখন হাতছানি দিয়ে ডাকে। নস্টালজিক হয়ে পড়ি। হারোনো দিনগুলো ফেরত পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ফেলে দিন কখনোই ফেরত পাবার  নয়। আজ অনেক দিন পর ধূসর খামে ভরে একটি চিঠি এসেছে। চিঠিটি লিখেছে আবির নামের এক পুরনো ছাত্র। এক সময় শিক্ষক ছিলাম। এখন আর নেই। রিটার্মেন্টের প্রায় একযুগ পূর্ণ হয়ে গেল। ছেলেটি এখন মিনিস্ট্রিতে চাকরি করছে। এডিশনাল সেক্রেটারি। সরকারি আমলা। আরও দু’ একজন চিঠি লেখে। মাঝে মাঝে ফোন করে। এই চিঠিগুলো আমাকে খুব আশা জাগায়। যতœ করে রেখে দিয়ে বারবার পড়ি। ভালো লাগে। হারানো সময় কলমের কালো অক্ষরে রাঙা হয়ে ওঠে। বাসায় আমরা দুই বুড়োবুড়ি-ই থাকি। ছেলেমেয়েরা তাদের সংসার করে। ব্যস্ত সময়। যে যার মত আলাদা। সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করে। করুক ! এখন আর তেমন কেউ দেখা করতে আসে না। শরীর ভেঙ্গে পড়ছে। মন বিষণœ থাকে। শিক্ষক হিসেবে অনেকেই এখন আমাকে চেনে না। চার দেয়ালে মধ্যেই আমাদের দিন রাত চলে যায়। তারপরও ভালো আছি। তবে মাঝে মাঝে দু’একটা চিঠিপত্র এলে মনে ভরসা পাই। এ যেন আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। অতীতের সাথে বর্তমানকে মেলাতে গিয়ে মোক্তার স্যার নস্টালজিক হয়ে পড়লেন। তিনি হারিয়ে গেলেন ত্রিশ বছর আগের কোনো এক দিনে।
 
আজ রবিবার। আগামীকাল থেকে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হবে। সপ্তম শ্রেণির ক্লাসটিচার মোক্তার স্যার আজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এডমিট কার্ড বিতরণ করবেন। হেড মাস্টারের কড়া নির্দেশ এডমিট কার্ড ছাড়া কাউকে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এ্যাসেম্বিলির পর প্রথম পিরিয়ডের ক্লাস। হাজিরা খাতা, মার্কার, ডাস্টার, বই, পাঠ উপকরণসহ মোক্তার স্যার এ্যাসেম্বিলি গ্রাউন্ডের দিকে যাচ্ছেন। পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলায় মেইল টিচার্স ডরমেটরি। মোক্তার স্যার সিঁড়ি বয়ে নিচে নামবেনÑ এমন সময় পিয়ন জুলফিকারের সাথে দেখা।
আস্লামুলাইকুম। কেমন আছেন স্যার ?
ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো জুলফিকার ?
জ্বি স্যার, ভালো আছি। হিসাব শাখা থেকে এই কাগজটি আপনার কাছে পাঠিয়েছে।
ঠিক আছে । তোমাকে ধন্যবাদ জুলফিকার।

পিয়ন জুলফিকার চলে গেলে মোক্তার স্যার সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে কাগজটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বকেয়ার হিসাব। বেশ লম্বা লিস্ট। সব মিলিয়ে অন্তত হাজার পঞ্চাশেক টাকার কেস। কাগজটির এক কোণে পেন্সিল দিয়ে লেখা, ‘বকেয়া পরিশোধ ব্যতীত কাউকে এডমিট কার্ড দেবেন না।’ মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল শিক্ষকদের এই এক জ্বালা। এখানে শিক্ষকদের কেরানি থেকে আদায়কারী পর্যন্ত সব কাজই করতে হয়। মোক্তার স্যার তাই মনে মনে বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়েও পারলেন না। মুখে যতই কঠোর ভাব দেখান না কেন মোক্তার স্যারের মনটা বড্ড নরম। তাছাড়া তিনি  কোনোদিন কারও ওপর রাগ করে থাকতে পারেন না। আর কেউ না জানুক তার শিক্ষার্থীরা সবাই এ কথা জানে।

এখন আষাঢ় মাস। বর্ষাকাল। কিন্তু বৃষ্টি নেই। বাইরে রোদের তাপে ভ্যাবসা গরম। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শহরের বাতাসে যেন আগুন ঝরে। সকালে সবার অফিসে যাবার তাড়া। কিন্তু এ সময়; হয় কলে পানি থাকে না ; না হয় চুলায় গ্যাস নেই অথবা ঘরের ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। সব সম্ভবের দেশে রাজ্যের সমস্যা ! রাস্তায় বের হলেই নিত্য ট্রাফিক জ্যাম । অফিসে সময়মত পৌঁছানোর তুমুল যুদ্ধ হয় প্রত্যহ। তারপরও  অভিভাবকেরা চেষ্টা করেন অফিসে যাবার পথে ছেলেমেয়েকে স্কুলে ড্রপট করে দিতে।
সপ্তাহে তিনদিন স্কুলের মাঠে এ্যাসেম্বিলি বসে। স্কুল ড্রেস পরে ছাত্রছাত্রীরা যখন সারিবদ্ধভাবে এ্যাসেম্বিলিতে দাঁড়ায় তখন দেখতে কী যে ভালো লাগে ! না দেখলে লিখে বুঝানো যাবে না। মনে হয় যেন আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরীরা নেমে এসে নীরবে প্রার্থনায় দাঁড়িয়েছে। জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও শপথ বাক্য পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলা, সততা, দেশপ্রেম ও আদর্শ মানুষ হওয়ার মন্ত্রণা লাভ করে।
এখন সকাল ৮:০০ টা। এসেম্বিলি শেষে মোক্তার স্যার এখন ক্লাসে ঢুকেছেন। তিনি বাংলা শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের হাজিরা নেওয়ার পর তিনি এখন এডমিট কার্ড বিতরণ করবেন। তবে তার আগে বকেয়া টাকার হিসেবটা কষে নিলে সুবিধা হয়। অনেকের টিউশন, পরীক্ষার ফি পরিশোধ হয়নি। ক্লিয়ারেন্স দেখে এডমিট কার্ড বিতরণ করতে হবে। নাম, রোল ডেকে মোক্তার স্যার এডমিট কার্ড বিতরণ করছেন। বকেয়া  পরিশোধ না করেই এ সময় এডমিট কার্ড পাওয়ার জন্য কেউ কেউ কাকুতি-মিনতি করতে শুরু করল। মোক্তার স্যার খেয়াল করলেন বকেয়া পড়া ছেলেমেয়েদের অনেকের বাবা ব্যবসায়ী, কেউ কেউ বাড়িওয়ালার ছেলে, অন্যদের অভিভাবক  বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এবার মোক্তার স্যারের কঠোর হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না ! সবাইকে এডমিট কার্ড দিতে না পারায় স্যারের মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
মোক্তার স্যার যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সেটি একটি প্রাইভেট স্কুল। শহরের ধনী, টাকা-পয়সাওয়ালা লোকের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়াশোনা করে। আসলে পড়াশোনা নামে মাত্র। নিরাপদে সময় কাটানোর জন্য আসা যাওয়া করেÑ এই আর কী ! চটকদার বিজ্ঞাপন, বাইরের চাকচিক্য আর ভেতরের তকমা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আদলে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গরিবের ছেলেমেয়েদের পড়ার জায়গা এটা নয়। বাবা মায়ের মন তা বোঝে না। প্রত্যেক বাবা-মা’ই চান তার ছেলেমেয়ে ভালো পরিবেশে, ভালো স্কুলে লেখাপড়া করুক। তাদের জীবন আর ক’দিন। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, খেয়ে না খেয়ে সন্তানের লেখাপড়ার জন্য খরচ জোগান তারা। ভালো রেজাল্ট করে কোনো একদিন এই ছেলেমেয়েরাই তাদের মুখ উজ্জ্বল করবেÑ এই আশায় বুক বেঁধে থাকেন। এ যেন সব থার্ড ক্লাস সেন্টিমেন্ট। সামান্য আয় অথচ সংসারে রাজ্যের খরচ। অল্প রোজগারে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংগ্রাম করে আর পেরে ওঠেন না। স্কুলে বকেয়া পড়ে যায়। মাসে মাসে তা ক্রমেই বাড়তে থাকে। নিমিষেই মোক্তার স্যারের চোখের সামনে তখন ভেসে ওঠে এক হতদরিদ্র বাবার মুখচ্ছবি। যিনি ছেলেকে পরীক্ষা দেয়ানোর জন্য হেডমাস্টারের কামড়ার সামনে মাথা ঠুকছেন। হেডমাস্টার সাহেব সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘বকেয়া শোধ করে দিতে না পারলে ছেলেকে পরীক্ষা দেওয়াতে পারবেন না। প্রয়োজন মনে করলে টিসি নিয়ে যান। অন্য কোথাও ফ্রি পড়ান গিয়ে। দাতব্য খুলে বসলে আমাদের চলে না।’
ছেলেদের চিৎকারে মোক্তার স্যার সংবিৎ ফিরে পেলেন। ক্লাসের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে চুপচাপ বসে আছে আবির নামের এক ছাত্র। ওর দিকে চোখ পড়তেই মোক্তার স্যার একটু বিব্রত হলেন। আবির মেধাবী ছাত্র। কিন্তু ইদানিং একদম পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। গায়ের পোশাক-পরিচ্ছদ তেমন পরিপাটি নয়। চুলে ঠিক মত চিরুনি লাগায় না। কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে,  আর কাঁদে। ওর বাবা ছিলেন একজন দিন মজুর । কিন্তু গত কয়েক মাস তিনি আর স্কুলে আসেন না। কী এক অজ্ঞাত কারণে আবিরের বেশ ক’মাসের টিউশন ফি বাকি। তিনি এ ব্যাপারে আবিরকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। মনে এক ধরনের চাপা কষ্ট নিয়ে মোক্তার স্যার ক্লাস শেষ করে চলে গেলেন।
সন্ধ্যায় মোক্তার স্যার সাধারণত বাসাতেই থাকেন। প্রাইভেট টিউশন প্যাক্টিসে তিনি যান না। যা পড়ানো তিনি তা ক্লাসেই সম্পন্ন করে দেন। ফলে অন্তত তার বিষয়ে ছাত্রছাত্রীরা স্যারদের পিছনে দৌড়ানোর হাত থেকে রক্ষা পায়। তাঁর আরও একটি গুণ আছেÑ তা হলো তিনি শিক্ষার্থীবান্ধব। মোক্তার স্যারের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। তিনি কলটা রিসিভ করলেন। এক ভদ্র মহিলার ফোন। ও পাশ থেকে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলছেন। ‘‘স্যার, আমি আবিরের মা বলছি। আমরা এখন খুব বিপদের মধ্যে আছি। গত দুই মাস আগে আবিরের বাবা মারা গেছেন। আমাদের পরিবারে উপার্জন করার মতো দ্বিতীয় আর কেউ নেই। এদিকে রাজ্যের ধার-দেনা; স্বামীর মৃত্যুর পর সবাই একসাথে চাপ দিয়েছে। আমি এখন সামাল দিয়ে উঠতে পারছি না ! একটু দয়া করুন, আমাকে কিছু দিনের সময় দিন। আমি বিদ্যালয়ের সব পাওনা পরিশোধ করে দেব। রক্ত বিক্রি করে হলেও, স্কুলের সব দেনা পরিশোধ করে দেব, স্যার।’’
পুনশ্চ : আবির পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিচ্ছে। মোক্তার স্যার খাতা সই করতে এসেছেন। স্যারকে দেখে আরিব পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার জন্য নিচু হতেই মোক্তার স্যার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বললেন, “পড়াশোনার খরচের টাকার জন্য আর কোনো দিন চিন্তা করবি না। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবি। বড় হয়ে মাকে দেখিস। তুই ছাড়া তোর মায়ের আর কেউ নেই।’’
লেখক কথাসাহিত্যিক ও এম. ফিল গবেষক ।

প্রেমের অনুকাব্য

প্রেমের অনুকাব্য


প্রেমের অনুকাব্য 
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

১।
তুমি আমার সুখ নও, তুমি যে সুখের উপমা 
তুমি আমার কষ্ট নও, তুমি যে বুক চাপা কান্না 
তুমি আমার স্বপ্ন নও, তুমি যে আমার সাধনা 

২।
তুমি আমার, মনের বাগানের বুশরার গোলাপ 
তুমি আমার, রাতের আকাশের রূপালী চাঁদ 
তুমি আমার, রক্তিম আভাতে প্রথম সুপ্রভাত

৩।
তুমি যখন হেঁটে যাও, আমি ছায়া হয়ে পাশে রই
তুমি যখন চলে যাও, আমি স্মৃতি হয়ে কথা কই
যুগে যুগে যুগান্তরে, আমরা যুগলবন্দি হয়ে রই।

৪।
তোমার হাতের স্পর্শে, আমি প্রাণ ফিরে পাই
তোমার হাতের স্পর্শে, আমি প্রেমের গান গাই
তুমি যখন হাত সরিয়ে নাও, আমি মৃত হয়ে যাই
চিরকাল ওগো বন্ধু, হাতের উপর হাতের পরশ চাই।

৫।
কিছু সম্পর্ক, বেঁচে থাকার প্রাণশক্তি জোগায়
কিছু সম্পর্ক, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জাগায়
কিছু সম্পর্ক, স্মৃতির পাতায় থাকে চির অম্লান
কিছু সম্পর্ক, গেয়ে যায় ভালোবাসার জয়গান।

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সম্পাদক, আমাদের গল্পকথা
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা