ইংরেজি মাসের নাম যেভাবে এলো...
ইংরেজি মাসের নাম যেভাবে এলো
শেখ একেএম জাকারিয়া
গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ইংরেজি বর্ষ উদযাপন হয়ে থাকে। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডারের আগে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির প্রয়োগ ছিল এই পৃথিবীতে। জুলিয়ান বর্ষপঞ্জিরও পূর্বে ভ্যাটিক্যান পোপের অনুসারী খ্রিষ্টান ধর্ম সম্প্রদায়বিশেষ অর্থাৎ রোমের অধিবাসীরা গ্রিক পঞ্জিকা অনুসারে ৩০৪ দিনে বছর ধরত। যা ১০ মাসে বিভক্ত ছিল। এই সময়ের ইংরেজি বছরের প্রথম দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির জন্ম তখনও হয়নি। সে সময়ে মার্চ ছিল বছরের প্রথম মাস। পরবর্তীতে রাজা নুমা পম্পিলিয়াস খেয়াল করেন ৩০৪ দিন হিসেবে বছর ধরলে পরিবেশের সঙ্গে মিলে না। সে কারণে তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৭৯৩ অব্দে বছরের সঙ্গে যুক্ত করেন আরও ৬০ দিন। মোট হলো ৩৬৪ দিন। কিন্তু দিন বাড়ানোর পরে সমস্যা আরও বেড়ে গেল। ঋতুর চেয়ে সময় এগিয়ে আছে তিন মাস। আর সেই মুহুর্তেই স¤্রাট জুলিয়াস সিজার, ওপরে বর্ণিত সমস্যা দূর করতে নিজের মতো করে সাজালেন বছরকে। নতুন দু’মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিকে বছরের শুরুর দিকে নিয়ে এলেন। এবার দেখা যাক কীভাবে এলো এই ইংরেজি বছরের বারো মাসের নাম।
জানুয়ারি: গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির অর্থাৎ ইংরেজি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি। এ সম্পর্কে বইপত্রাদি ঘেঁটে যতদূর জানা যায় তা হলো, ইউরোপের রোম নগরীতে ‘জানুস’ নামে এক দেবতা ছিলেন। রোমের অধিবাসী এই দেবতাকে আরম্ভের দেবতা হিসেবে পুজো দিত। কোনওকিছু করার পূর্বে তারা এই দেবতার নাম খুবই সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করত। আর এ কারণেই ইংরেজি বছরের প্রথম মাসের নামটি দেবতা ‘জানুস’ -এর নামে রাখা হয়। অন্য একটি তথ্য মতে, দেবতা ‘জানুস’-এর দুটি মুখ ছিল। একটি সম্মুখে, অপরটি পশ্চাতে। রোমের অধিবাসীরা বিশ্বাস করত, সামনের মুখটি তাকিয়ে আছে আগামিকালের অর্থাৎ ভবিষ্যতের দিকে, আর পেছনের মুখটি বিগতকালের অর্থাৎ চলে যাওয়া অতীতের দিকে। কেউ কেউ মনে করেন, পূর্বোক্ত মতের সঙ্গে মিল রেখে জানুয়ারিকে ইংরেজি বছরের প্রথম মাস করা হয়।
ফেব্রুয়ারি: গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে যে বিশ্বাস মানুষের অন্তরে লালিত তা এই রকম- খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তনকারী জিশুখ্রিস্টের জন্মের ৪৫০ বছর পূর্বে দ্বিতীয় মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারির ব্যবহার ছিল। বহুকাল পূর্বে রোমের অধিবাসীরা ‘ফেব্রুয়া’ নামে মনের মলিনতা দূরীকরণ অর্থাৎ হৃদয় শুদ্ধ করার উৎসব পালন করত। ‘ফেব্রয়া’ মানে শুদ্ধ। রোমে বসবাসরত লোকজন তাই এমাসটিকে শুদ্ধতার মাস মনে করে।
মার্চ: ইংরেজি বছরের তৃতীয় মাস মার্চ। রোমান যুদ্ধ দেবতা ‘মারস’-এর নামানুসারে মার্চ মাসের নামকরণ করা হয়। যুদ্ধ দেবতার নামে এ মাসের নামকরণ হওয়াতে অনেকেই এ মাসকে সামরিক কুচকাওয়াজের মাসও বলে থাকেন।
এপ্রিল: ইংরেজি বছরের চতুর্থ মাস এপ্রিল। বছরের চতুর্থ মাস এপ্রিল-এর নামকরণ নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে। অনেকের মতে, এ মাসটি রোমানদের প্রেমের দেবী ভেনাস-এর কাছে উৎসর্গ করা হয়েছে এমন একটি মাস । ভেনাস শব্দটিকে গ্রিক ভাষায় ‘অ্যাফ্রেডাইটি’ (অঢ়যৎড়ফরঃব) বলা হয়,
যা থেকে এপ্রিল (অঢ়ৎরষ) শব্দটির জন্ম । এছাড়া অন্য মতও আছে। বসন্তের প্রবেশ পথ খুলে দেওয়াই এপ্রিলের কাজ। তাই কারও কারও ধারণা, ল্যাটিন শব্দ ‘এপিরিবি’ (যার অর্থ খুলে দেওয়া) থেকে ‘এপ্রিল’ শব্দটি এসেছে।
উল্লেখ্য, এ মাসেই পহেলা এপ্রিলে ‘এপ্রিল ফুল’ দিবস পালন করা হয়। বসন্ত-শুরুর প্রথম দিনের আনন্দনুষ্ঠানকে স্মরণ রাখতে পহেলা এপ্রিলকে ‘সব বোকাদের দিন’ বা অষষ ঋড়ড়ষং’ উধু হিসেবে পালন করার রীতি বহুকাল পূর্বে থেকেই শুরু হয়েছিল। প্রতীচ্যের এ ধারা অনুযায়ী ‘এপ্রিল ফুল’ দিবস হচ্ছে পহেলা এপ্রিলে কাউকে কৌতুক করে ঠকানো বা বোকা বানানো।
মে: ইংরেজি বছরের পঞ্চম মাস মে। ইউরোপে বসবাসরত রোমানদের দেবী ‘মায়া/মেইয়া’-এর নামানুসারে মাসটির নামকরণ করা হয় মে। এই মায়া ছিলেন গ্রিক পুরাণে বর্ণিত পৃথিবী ধারণকারী এ্যাটলাস-এর আত্মজা। ভারতীয় ইতিহাসের আনুমানিক ১১শ থেকে ১৫শ শতাব্দীতে অর্থাৎ মধ্যযুগে যুক্তরাজ্যে পহেলা মে তারিখটি একজন ‘মে-কুইন’ অভিষিক্ত করার আনন্দনুষ্ঠান হিসেবে পালন করা হতো। অন্যদিকে ১৮৮৯ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে সংঘটিত শ্রমিক আন্দোলনের স্মারকচিহ্ন হিসেবে পহেলা মে দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণির ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে পহেলা মে দিবসটি আন্তর্জাতিক ছুটির দিন।
জুন: ইংরেজি সালের ষষ্ঠ মাস জুন। জুন মাসের নামকরণের উৎস নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ‘জুনিয়াস’ নামে কোনও একটি রোমান পরিবারের নাম থেকে ‘জুন’ শব্দটির প্রকাশ। তবে এটা সত্য যে, সবচেয়ে বেশি চলিত মত হলো, ‘জুন’ নামটি এসেছে গ্রিক দেবরাজ জুপিটারের রানি জুনো-এর নাম থেকে। যাঁকে নারী, চাঁদ ও শিকারের দেবী বলা হতো। যিনি ময়ূরবাহিত চাকাযুক্ত যানে চড়ে যাতায়াত করতেন। তাছাড়া জানা যায়, অনাধুনিক রোমে জুন মাসের শুরুতে দেবী জুনোর সম্মানে আনন্দনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো ।
জুলাই: গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাস জুলাই। জুলিয়াস সিজারের নামে এ মাসের নাম রাখা হয়েছে জুলাই। এখানে রহস্যাবৃত বিষয় এটাই যে, বছরের প্রথমে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিকে স্থান দিয়ে জুলিয়াস সিজার নিজেই নিজেকে দূরে সরিয়ে দেন।
আগস্ট: গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির অর্থাৎ ইংরেজি বছরের অষ্টম মাস আগস্ট। স¤্রাট জুলিয়াস সিজারের পর রোম সা¤্রাজ্যের স¤্রাট হন তাঁরই ভাইপো অগাস্টাস সিজার। তাঁরই নামে এ মাসটির নাম রাখা হয় আগস্ট।
সেপ্টেম্বর: সেপ্টেম্বর শব্দের ব্যাকরণসম্মত অর্থ সপ্তম। কিন্তু স¤্রাট জুলিয়াস সিজার কর্তৃক বছরের মাসগুলো সাজানোর পর তা এসে দাঁড়ায় নবম মাসে। ইংরেজি বছরের এই নবম মাস, পরে আর কেউ পরিবর্তন করেনি।
অক্টোবর: ইংরেজি বছরের দশম মাস অক্টোবর। অথচ এ মাসের ব্যাকরণ-অনুমোদিত অর্থ অষ্টম। সেই মতে এটা অষ্টম মাস হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে এ মাস আমাদের বর্ষপঞ্জিতে দশম মাসে স্থান পেয়েছে।
নভেম্বর: নভেম্বর হচ্ছে গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির এগারো তম মাস। অথচ ‘নভেম’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘নয়’। সে যুক্তিতে সুদূর অতীতে নভেম্বর ছিল নবম মাস। জুলিয়াস সিজারের কারণে নভেম্বরের স্থান নয়ের বদলে এগারোতে।
ডিসেম্বর: গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির অর্থাৎ ইংরেজি বছরের দ্বাদশ বা শেষ মাস ডিসেম্বর। কিন্তু ল্যাটিন শব্দ ‘ডিসেম’ অর্থ দশম। স¤্রাট জুলিয়াস সিজারের বর্ষ সাজানোর আগে, অর্থানুসারে এটি ছিল দশম মাস। কিন্তু আজ আমাদের কাছে এ মাসের অবস্থান ক্যালেন্ডারের শেষভাগে।
উল্লেখ করা দরকার, জুলাই ও আগস্ট এ মাস দুটোর নাম পূর্বে ছিল কুইন্টিলিস ও সিক্সিলিস। অর্থাৎ পঞ্চম ও ষষ্ঠ। জুলিয়াস সিজার রোমের স¤্রাট হয়ে নিজের নামটিকে ইতিহাসের পাতায় বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য পঞ্চম মাস কুইন্টিলিস-এর পরিবর্তে নিজের নাম জুলিয়াস রাখেন। এতেও তিনি নিবৃত্ত হলেন না, আরও মাহাতœ্য বাড়ানোর জন্য ৩০ দিনের জুলিয়াস মাসকে করেন ৩১ দিন। কিন্তু বছর তো আর ৩৬৫ দিন থেকে বেড়ে ৩৬৬ দিন হতে পারে না। যার কারণে রোমান পুরোহিতরা ফেব্রুয়ারি মাসকে ৩০ দিন থেকে কমিয়ে ২৯ দিন করতে বাধ্য হলেন।
জুলিয়াস সিজারের পর রোমের স¤্রাট হন তারই ভাইপো অগাস্টাস সিজার। পুনর্বার অস্ত্রোপচার চালানো হয় ফেব্রুয়ারির ওপরে। সেই থেকে ফেব্রুয়ারি ২৮ দিনে এসে দাঁড়ায়। অগাস্টাস সিজার এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, লিপইয়ার বছরে আগস্ট মাসটিকে ৩২ দিনে গুনতে হবে। রোমে এ ব্যবস্থা চালু ছিল অনেকদিন। পরে তা ৩১ দিনে আসে। আর এভাবেই দীর্ঘ সময় এবং নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মানবজাতি পেয়েছে ইংরেজি বছরের বারোমাসের নামকরণের রোমাঞ্চকর ইতিহাস।
প্রেরক,
শেখ একেএম জাকারিয়া
কবি, প্রাবন্ধিক
মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট
সদর হাসপাতাল,
সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ।
শব্দমালা : ইব্রাহিম রাসেল
কেবল ভালোবাসার জন্য
একবার হাত ধরে যদি ফের ছেড়ে দাও
এই অন্ধকার গলিতে তবে বলো কী করে হাঁটি!
স্পর্শের সুখটুকু শিখিয়ে যদি দেয়াল তুলে দাও
ভালোবাসার এই কাঙাল বলো কী করে বাঁচি!
নীলিমা! পাথরের বুকে সবুজ বাগান করে
ফের কেন পাথরেই ফিরিয়ে দাও!
এই অবুঝ অনুভূতিকে লাই দিয়ে দিয়ে স্ববুঝ করে
আজ কেন গলা টিপে শ্বাস রুদ্ধ করতে চাও!
চেয়ে দ্যাখো এখনও রয়েছি দাঁড়িয়ে একা নিঃস্ব
অন্ধকার সেই অচেনা গলিতে
তোমার তোলা দেয়ালের কার্ণিশে কাঙাল এক,
এই স্ববুঝ অনুভূতিরা আজ আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।
কেবল ভালোবাসার জন্যই এই আকুতি
এর জন্যই তোমার কাছে হেরেছি বারবার।
তোমার হাতের জাদু
নীলিমা! তোমার কাননের ফুল জানে
তোমার হাতের জাদু, তোমার স্পর্শের গভীরতা;
ওফুলের দিকে তাকিয়েই বলে দিতে পারি
একবার তুমি ছুঁলে পরে কী হয়, কী উর্বরতা
ছড়িয়ে পড়ে শিরায় শিরায়, মুকুলে-মুকুলে।
যেখানেই তুমি রেখেছ হাত, ফুটেছে গোলাপ
ফুটেছে জুঁই, চামেলি, হাসনাহেনা, গন্ধরাজ;
মরতে বসা গাঁদা গাছেও তোমার স্পর্শের পরে
গাছময় ফুটেছে হলুদ গাঁদা, একটি দুটি ফুল ধরা
অপরাজিতা গাছও ভরে উঠেছে ফুলে ফুলে।
নীলিমা! একটিবার যদি ওহাতে আমায় ছুঁয়ে দিতে
পৃথিবীতে আমিও হতে পারতাম সুন্দর কোনো ফুল।
মহাজীবন
নীলিমা! কেবল একটি গোলাপের প্রত্যাশা ছিল,
তোমার কাছে হাত বাড়িয়ে চাইতেই
পৃথিবী অবাক করে দিয়ে এত্ত এত্ত ফুলে ফুলে
ভরিয়ে দিলে আমার দু’হাত, আমার আঙিনা
পা ফেলে আমার হাঁটার পথ, আমার বসত ভিটা
যে দিকেই যতদূর চোখ যায় যেন ফুলের অরণ্য।
এক আঁজল জল চাইতেই দিয়েছ এক মহাসমুদ্র
একমুঠো জোছনার বাসনায় দিয়েছ মধুপূর্ণিমা।
একটি মুহূর্ত চেয়েছি কেবল ভালোবাসার জন্য
অনন্ত জীবন তুমি নিরঙ্কুশ সপেছ আমায়।
এতোটুকু স্বস্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছি বলে
এ অধমকে দিয়েছ তুমি এক মহাজীবন।
লাজ-লজ্জাহীন প্রেমিক; বেশরম প্রেমিক একটা !
লাজ-লজ্জাহীন প্রেমিক; বেশরম প্রেমিক একটা !
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
সেই কাকপাখির কথা ভেবে ভীষণ আক্ষেপ হয় আমার । কিন্তু এক সময় হিংসে হতো; গা জ্বলা হিংসে । তোমার জানালার পাশে যে পেয়ারা গাছটা ছিল ঠিক সেইখানটায় বসত কাকপাখি । খুব ভোরে তুমি উঠতে কাকে ডাকে । স্বভাবত’ই আমরা মানুষ ভোরে কাকের ডাক শুনলে বিরক্ত হই; ভেবে বসি- এই বুঝি আজ কোনো সর্বনাশ হবে । সত্যি কথা বলতে; কাকপাখি আর সর্বনাশের সাথে কোনো রকম সম্পর্ক আদৌ আছে কিনা; ছিল- জানতে পারিনি আজও । যাক সেকথা । তারপর তুমি; কাকপাখিটাকে মৃদু-মন্দ হাসিতে ফেটে পড়তে । তোমার সেই অন্যরকম ভালোলাগাটা আমার ভেতর তৈরি করত ধোঁয়াশা । বুঝতে পারিনা কিছু। এভাবে বেশকিছু সময় পার হলো । তুমি বদলাওনি তখনও । তবে আমার ভেতর বটবৃক্ষের মত এত্ত বড় একটা হিংসের জন্ম হলো । অবশ্য এর কোনো উৎস খুঁজে পাচ্ছিলাম না বললেই চলে । মাঝে মাঝে নিজেকে মিছেমিছি শান্ত¡না দিয়েছি এই ভেবে; আমি একটা প্রেমিক; বদ্ধ প্রেমিক, পাগল প্রেমিক । যদিও তুমি আমার প্রেমের কোনো মানে বুঝোনি কোনোদিন; চেষ্টা করোনি বোঝার । আমার নিজেরেও অতটা ইচ্ছে হয়নি বোঝানো তোমাকে ।
কাকপাখি আর তোমার অসম প্রেম দেখে দেখেই পার করলাম ক’টা দিন । আর ইচ্ছেও করল না তোমাদের ওসব দেখার । সিদ্ধান্ত নিলাম; তোমাকেও আর দেখবো না; দেখতে যাবো না তোমাদেরও।
সপ্তাখানিক পর নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলাম । বুঝো তো; প্রেমিক বলে কথা । লাজলজ্জাহীন প্রেমিক; বেশরম প্রেমিক একটা। এই আক্ষেপের অধ্যায়টা শেষ হলে যা থাকে; তা কেবল’ই দুঃখ । আর এই দুঃখগুলো লেগে থাকে শরীরে; মননে...
শুধু দুঃখগুলো লেগে থাকে শরীরে
শুধু দুঃখগুলো লেগে থাকে শরীরে...
তোমাকে দেখবো;
এই ভেবে কাটে দিন- অর্ধেক রাত;
তোমাকে আর দেখা হয়না আমার ।
তোমার অভিমান; তোমার আড়াল-
আমার চোখে অশ্রুস্নাত শোক;
কি দারুণ উচ্ছ্বাসে; বেঁচে থাকি-
দেখবো বলে’ই কেমন
ভালো থাকি; সুস্থ থাকি । তুমি-
তোমাকে নিয়ে’ই ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত।
আর ব্যস্ততায় ঢাকা পড়ে যাই আমি...
.
ধরে’ই নাও, তোমাকে একটু দেখতেই
আমার যত বাড়াবাড়ি, হাঁটাহাটি-
আমার প্রতি তোমার কেমন অভিমান;
তোমার অভিমান বুকে তুলে ঘুম নামাই;
আর তোমাকে দেখে’ই শুরু আমার সকাল ।
২
প্রতিদিন অফিস বের হয়ে কালুচাচার দোকানে এককাপ চা না খেলে যেন আমার দিন উষ্ণতাহীন কেটে যায়। কালুচাচা মানুষটা খারাপ না; তার সাথে যতদিন হলো পরিচয়; তাতে বোঝা যায় মানুষটা প্রচুর গল্পবাজ; রশিক। আর আমি এমন একটা মানুষের সাক্ষাৎ পেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি ভীষণ। কেননা; এই সময়ে এমন গল্পবাজ মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। মামাকে প্রশ্ন করলামÑ ‘চাচা; জীবনে কোন জিনিস প্রতি আপনার আক্ষেপ রয়ে গেছে এখন ? কালুচাচা লম্বা একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়ল । তার দীর্ঘশ^াসের অর্থটা এমন দাড়াল যে; তার এই জীবনের পুরোটাই যেন আক্ষেপে ভরপুর।
-আমার আক্ষেপ যে কত কিছুর প্রতি; তা তো তুমাকে বইলা শেষ করতি পারব না। তারপরও তুমারে বলি খানিক; ‘ভালোবাসছিলাম আমি একজনকে; তারে নিয়া কক্সবাজার যাতি চাইছিলাম; একসাথে সমুদ্র দেখতি চাইছিলাম কিন্তু সেইটা আর কপালে হয় নাই; তারেও পাই নাই’; হায়রে ভালোবাসা; হায়রে সমুদ্র ।
কালুচাচা এমন নীল আক্ষেপের কথা বলে থেমে গেল । বুঝতে পারলাম; তার পুরোনো অধ্যায়টাকে স্মরণ করাটা আমার ছোট খাটো নয়; বড় ধরনের একটা অপরাপ করে ফেললাম । তবে বুঝতে পারলাম; প্রতিটি মানুষের আলাদা একটা গল্প থাকে; যা কেবল ভালোবাসা ঘিরে; কিংবা সমুদ্রকে ঘিরে।
আড়শী অথবা সমুদ্রের গান
সমুদ্রের সাথে কথা হয়েছে আমার-
সমুদ্রের নামে বদনাম ছড়িয়েছ বাতাশে;
গাঙচিলও শুনেছে কালকথা; আমি দেখছি-
তুমি হেঁটে হেঁটে নষ্ট করছো সমুদ্রের শরীর ।
সমুদ্র চুপচাপ; তুমিও চুপচাপ-
বিরহে আমার ঠোট বাঁশি; দেখছি তোমাকে,
ঢেউয়ে রোদের হাঁটাহাঁটি; তুমি হাঁটছো-
তোমার হাঁটাহাঁটি শেষে সমুদ্র যাবে বাড়ি;
তারপর— কিছু কবিতা তুলে রাখবো ছিঁকোয়;
তুমি এসে ডুবিয়ে দিও জলে;
কেউ জানবে না; আমি শুধু তোমার জন্য হবো সমুদ্র ।
৩
আমি সব সময়’ই একা মানুষ । আর একা মানুষের গল্প একটা বেশি থাকে; দুঃখবোধ একটু বেশি থাকে । কারণ পৃথিবীর নিবিষ্টে কত রঙের; কত ঢঙের মানুষ আছে; তার ধারাপাত খুঁেজ পাওয়া কঠিন । আমার আমিত্বের অর্থটা তো শুধু আমি’ই জানি; আমার আমিত্বের দুঃখবোধটা শুধু তো আমার’ই । এক আজলা জল দিয়ে হবে তার প্রতি কোনো দরদ হয় না কারো; এই অচল অভ্যেসের নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি ।
তুমি অথবা আমি বিষয়ক
তোমাকে বোঝার ইচ্ছে হলে— ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস;
জানার ইচ্ছে হলে বন্ধ করি চোখ;
আর দেখার ইচ্ছে হলে পাগল হয় মন-
অথচ কেমন তুমি; ঢেকে রাখো মায়ামুখ সারাদিন !
জানা হয়না; বোঝা হয়না; দেখাও হয়না-
আহ! দেখা হয়না তোমার মায়ামুখ !
তোমার চোখে এক’শ সমুদ্র-
আমার চোখে কয়েকটা আকাশ;
এই চোখ ছুঁয়েছে তোমার চোখ; এই চোখ জুড়ে শুধু তুমি-
দেখি; শুধু দেখি... আমাকে বুঝতে চেয়ে
কুড়িয়ে ফেলেছো তিনটা বিকেল- হয়ত জানো না;
তোমার সুন্দর মেহেদী রাঙা হাতে জমা আমার সকাল;
আমি তো চাই; খুব চাই- তোমাকে দেখে দেখে
ভালো কাটুক প্রতিদিন; খুব ভালো কাটুক আমার দিন ।
আড়ালে থাকো— আড়ালে রাখো; আড়াল রাখো-
এদিকে আমার ভারি হয়ে যায় বেদনার পাপ !
জল খাই; জল খেতে যাই; পাখি দেখি- তোমাকে দেখি;
পাখি আর তুমি এক- চোখ বোঝ না; বোঝো না মন;
আজকাল তোমাকে দেখে কবিতা বলি; কবিতা লিখি-
তুমি কেমন হয়ে যাচ্ছো আমার কবিতার প্রাণ ।
৪
আশ্চর্য বিষয় বটে যে; আজকাল মানুষকে নিয়ে খুব বেশি ভাবতে শিখেছি; প্রয়োজনের জন্য যত ছোটাছোটি করি না কেন; কিংবা ভালো থাকার জন্য যত হাওয়া আবৃত্তি করি না; মানুষকে নিয়ে আমার ভাবনা চিরদিনের । এই মানুষের ভীড়ে আমার স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে; এই মানুষের ভীড়ে আমি ছোট হয়ে আছি; বড় হবো বলে। আমার ভালো থাকা; ভালো লাগা; কিংবা ভালোবাসা সব বিকিয়ে দেবো; শুধু আমি আমাকে নিয়ে একা থাকব; ভীষণ একা থাকব। কারো সংস্পর্শে যেতে চাইনা; আর আমিও চাই কেউ আমার সংস্পর্শে আসুক; সবাই ভালো থাকুক; খুব ভালো থাকুক । শুধু আমি আমার দুঃখবোধ নিয়ে বেঁচে থাকবো মৃত্যু পযর্ন্ত ।
স্থিরচিত্র
একদল সিগারেটের ধোঁয়ামিছিল; তুমি দিলে দৌড়-
আলোর বর্শিতে ছিড়ে গ্যালো বাতাশের গাল;
আমি আমাকে পুড়িয়ে নিলাম আগুনে আর তুমি
ফুঁ দিলে নিভিয়ে দিলে বিকেলের জীবন ।
আদর্শ ঈগল যতটা ছিড়ে খায় মেঘ—
কিংবা মিঠাপুকুরে ডুবে মরে যত বৃদ্ধমাছ; দেখছি;
ভীষণ দেখছি; তুমি পুতুলচোখে বেশ রাখো খোঁজ—
আর আমি দিনভর কবিতাহীন— স্বভাবের চরমপত্র ;
দ্যাখো একবার; উড়ে যেতে আটকে গেছি তোমাতে।
পৃথিবীর সব গল্পেরই শ্রেষ্ঠ চরিত্র ‘আমি’
পৃথিবীর সব গল্পেরই শ্রেষ্ঠ চরিত্র ‘আমি’
হাসান মাহাদি
প্রায় একবছর হতে চললো। গল্পটা লিখব লিখব করে আর লিখা হয়ে উঠেনি। ব্যস্ততা, অজুহাত, অলসতা ইত্যাদি কারণেই লিখা হয়ে উঠেনি। দু’য়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেলে রেখেছিলাম। এমন অনেক লিখা, লিখব লিখব করে আর লিখা হয় না। ভুলে যাই। কিন্তু এ গল্পটা ভুলিনি। এটা আমাকে লিখতেই হবে। কারণ এটা জীবনের গল্প। আমার জীবনের গল্প। নতুন দিনের সূচনা লগ্নে একটি ভয়ানক রাত্রি শেষে দিক ভ্রষ্ট নাবিক যেমন সূর্যোদয় দেখে দিকের দিশা পায়, এই গল্পটাও আমার সকালের দিক নির্ণয়ের দিকদর্শন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু হয়েছে। নতুন শহর, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ, নতুন অভিজ্ঞতা। তার উপর আঠারো উনিশ বছরের বেপরোয়া আর রঙ্গীন বয়স। কত অনুভূতি কত উপলব্ধি! তা আর ব্যাখ্যা করা যাবেনা। ফার্স্ট সেমিস্টার সবে শেষ হয়েছিল। জীবনের সবচেয়ে বাজে সময় যাচ্ছিল। ইনফেচুয়েশনাল এক্সিডেন্ট সাথে মধ্যবিত্তের সংগ্রাম। এই বয়সে মারাত্মক এক্সিডেন্টই বটে। সামলাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বেশি সময় একা একা থাকতাম। সন্ধ্যার পর সদরঘাটে চলে যেতাম। মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতাম। নিজের সকল চিন্তা, চেতনা, বেদনাকে একঘরে করে দিয়ে মানুষের বৈচিত্রে নিজেকে খুঁজতাম।
একদিন সম্ভবত আট নম্বর গেইটে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখলাম কয়েকটা ছেলে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটা ছেলে রেলিংয়ের উপর বসে একটা বই হাতে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অভিনয়ের ভঙ্গিতে সবাইকে পড়ে শুনাচ্ছে। সবাই পথশিশু । কৌতুহলবশত এগিয়ে গেলাম। কী পড়ে শুনাচ্ছে তার শুনতে গেলাম। একটা জোকসের বই। পাতলা একটা বই। ছেলেটা বইয়ে বর্ণিত চরিত্র অনুযায়ী কণ্ঠস্বর বদল করছে। সবাই হাসছে এবং সে নিজেও হাসছে। শেষ হওয়া পর্যন্ত আমিও জোকস শুনলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। শেষ হওয়া মাত্রই ছেলেটাকে ডাক দিয়ে নাম জানতে চাইলাম। বললো, আব্দুল্লাহ। এখানেই থাকে। লঞ্চে পানি বিক্রি করে । কাছের একটা পথশিশু স্কুলে যায় । পড়ার আগ্রহ আছে। লালনকে পছন্দ করে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর কেউ একজন ডাকলো। ছেলেটি বললো ,ভাই এখন যাইতে অইবো।
বললাম, যা। আর শুন? কাল সন্ধ্যা সাতটায় আসতে পারবি?
ছেলেটি বললো , না ভাই কামে থাকুম।
-তাইলে আটটায়?
-হ ভাই।
-ঠিক আছে যা।
পরদিন দশ মিনিট আগে আমি পৌছে গেলাম আট নম্বর গেইটে। ঠিক আটটা নাগাদ আব্দুল্লাহ আসলো। ওর পায়ে জুতো ছিলো না। ওর জুতো নেই ।
বললাম , চল।
বললো, কোথায়?
-আমার সাথে চল ।
টার্মিনালের বাইরে ফুটপাথ থেকে জুতা কিনে দিলাম। প্রথমে লজ্জায় নিতে চাচ্ছিলো না। আমি অবাক হলাম। একবার ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে আমরা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা মিলে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে পথশিশুদের নিয়ে সদরঘাটেই একটা প্রোগ্রাম০ করেছিলাম। খাওয়ার ও ব্যবস্থা ছিলো। গান আবৃত্তি ইত্যাদি শেষে যখন বিরিয়ানির প্যাকেট বের হলো এক ভয়ানক কা-! সেই দিক থেকে আব্দুল্লাহর সংকোচবোধে একটু অবাকই হচ্ছিলাম। দু’জন হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে ফিরে আসলাম। একটা লঞ্চে উঠে গেলাম। ছাড়তে অনেক দেরি। তাই ভাবলাম, ছাদে বসে ওর সঙ্গে কিছুটা সময় গল্প করা যাক। মাত্র কিছুটা সময় ছেলেটার সাথে থেকে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম রঙ্গীন স্বপ্ন ভঙ্গ কিংবা আশাহত হওয়ার বেদনা। ভুলে গিয়েছিলাম কয়েকদিন বাড়িতে ফোন দিয়ে মায়ের সাথে একটু কথা হয়না। ভুলে গিয়েছিলাম সংকীর্ণ বেড শীটে বেডমেটের নিরব বিরক্তির উপহাস। ভুলে গিয়েছিলাম পেঁপেভাজি আর বেগুন-ডিমের অদ্ভুত তরকারি সমেত মেসের খাবারের মেন্যু । টিউশনি নেই, কথা শেয়ার করার মতো ভালো বন্ধু নেই, অসম্ভব মানসিক চাপ সব মিলিয়ে আমি ভুলে গিয়েছিলাম জীবনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র। জানি হয়তো অনেকেই আমাকে ইমোশনাল ফুল বলবেন। কিংবা বলবেন মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু যাই বলুন না কেনো বাস্তবতা এটাই ছিলো যে, সময়টা আমার খারাপ যাচ্ছিলো। আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম।
-আব্দুল্লাহ বললো, ভাই, আমার মনটা আজ ভালো নেই।
-কেন, খাবার খাসনি?
-খাইছি ভাই। তবে একবেলার খাওন খাইতে না পারার কষ্টের চাইতে সামনে থেইক্যা খাওন কেউ হালায়া দিলে বেশি কষ্ট লাগে ।
-তর সাথে কেউ কিছু করেছে?
-না ভাই। মজুন ভাইয়ের কথা কইতেছিলাম।আহ!
-কি হয়েছে তর মজনু ভাইয়ের?
-লঞ্চে ঝাল মুড়ি বেচতো। লঞ্চের ক্যান্টিনের লোক থাইক্যা একটা পুলিশ ট্যাহা খাইয়া মজনু ভাইয়ের সব নদীতে হালায়া দিছে।
-পুলিশ টাকা নিছে তুই দেখছিস?
-হ ভাই। নিজ চোহে দেখছি। আল্লাহর কসম!
ছেলেটার চোখ তখন ছলছল করছে। আমার খুব মায়া লাগলো।
-ভাই আমি বড় হইয়া পুলিশ হমু। সৎভাবে চলমু। জানেন ভাই, এইখানে কত দুই নাম্বারি চলে? আমার থেইক্যা ছোডো ছোডো পোলাপাইনে বিড়ি খায়, নেশা করে। এমনকি নেশা বেচেও!
-তুই নেশা করিস?
-আল্লাহর কসম ভাই ! বিড়িও খাই না। জানেন ভাই পুলিশ এইসব দেইখ্যাও দ্যাহেনা। দ্যাহে শুধু মজনু ভাইয়ের মতো মানুষদের। আর ঘাডের লোকেরাও আমাদের কাছে থেইক্যা ট্যাহা তুলে। হেল্লাইগ্যাই পুলিশ হমু। কিন্তু কি করমু? সমস্যার অভাব নাই। বাপে ইস্কুলে যাইতে দেয়না। ওই যে আমনেরা কন পথশিশু নাকি? আমি কিন্তু হেই পথশিশু না।
আমি চুপচাপ শুনছিলাম ওর কথা গুলো । ভাবছিলাম আমি ব্যর্থ প্রেমের বিরহে শোক পালনে ব্যস্ত। আর অন্যদিকে এই ছেলেটা আশে পাশের জীবনকে দেখে দেখে উপলব্ধি করে নিজের জীবনের লক্ষ্য স্থির করছে। সে বাস্তুহীন কিন্তু স্বপ্নহীন নয়। তার কাছে সুযোগ নেই কিন্তু স্বপ্ন আছে। আমার কাছে তো থাকার মতো একটা বিছানা আছে । হউক না গাদাগাদিময়। মাথার নীচে বালিশ নেই তো কি হয়েছে? গোঁজার মতো একটা পুরনো কম্বল আছে। দু’বেলা খাবার আছে হউক না বিদঘুঁটে পেঁপেভাজি অথবা বেগুন তরকারি । কিন্তু ওর কাছে তো কিছুই নেই। তবুও স্বপ্নবাজ। আহা জীবন! কত বৈচিত্র!
আমাকে উদাস দেখে ছেলেটা বললো, ভাই একটা কথা কমু?
-বল।
-আমার কাছে স্বপ্ন মানে কি জানেন?
-কী?
-আমার কাছে স্বপ্ন মানে একটা বাজি। ডর ভয়হীন একটা বাজি। ধরেন বিল্টু আমার লগে বাজি ধরলো যে, আব্দুল্লাহ তুই বুড়িগঙ্গা সাতরাইয়া এপাড় থেইক্যা ওই পাড়ে যাইতে পারলে তরে পুরস্কার দিমু। এখানে আমার স্বপ্ন লক্ষ্য কি জানেন?
-বিল্টুর পুরস্কার?
-না ভাই। ওই পাড় যাওন। আমার সাঁতরানোর ক্ষমতা আছে এবং সাহস আছে এইডা প্রমাণ করা। বুড়িগঙ্গার পানি ভালা না? ময়লা ? গন্ধ? এগুলো সব সমস্যা। যদি এইসব মাথায় রাহি ওই পাড় যাওন ওইবো না। বিল্টুর কাছে বাজিডা হারমু। হারমু আমার ক্ষমতার কাছে, আমার স্বপ্নের কাছে।
স্বপ্নের কি অসাধারণ দার্শনিক ব্যাখ্যা! ওর কথা শেষ হতেই ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, সাবাশ!
ওইদিন বাসায় আসার পথে আব্দুল্লাহর প্রত্যেকটা কথাই কানে বাজতে ছিলো। এখনো বাজছে। ওইদিন নিজের উপর খুব রাগ লাগছিলো। শপথ করেছিলাম, বিল্টুদের চ্যালেঞ্জের কাছে হার মানা যাবেনা। স্বপ্নের পথে সব সমস্যাই বিল্টুদের উপহাসের চোখে ছোড়া চ্যালেঞ্জ মাত্র।
ভাবছিলাম একটা স্বপ্নের কথা। একটা গল্পের কথা। প্রতিদিনই গল্পের সৃষ্টি হচ্ছে। কারো গল্পের চরিত্রে আমি আবার আমার গল্পের চরিত্রে অন্যেরা। সদরঘাট থেকে ফিরে সোজা চলে গেলাম ক্যাম্পাসে। ক্যান্টিনের বারান্দায় বসে সিঁধু মামার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবলাম আমি কি গল্পটা লিখতে পারব? আব্দুল্লাহর স্বপ্নের সারথি হতে পারব?
একটা গল্প, একটা স্বপ্ন । একটা গল্প রাস্তায় উদাস গন্তব্যহীন পথিকের অলীক চিন্তার প্রশান্তির মঞ্জিল। গল্প শুধু শব্দমালা কিংবা বাক্যমালার সমাহার নয়। প্রতিক্ষা, ছলমল আবেগ, চাপা জেদ, কান্না, হাসি, আনন্দ আর দুঃখসহ আরো অনেককিছু। গল্প, গল্পকারের মধ্য রাত্রিতে হঠাৎ জেগে উঠে ঘুম ঘুম চোখে সদ্য ভাঙ্গা কাঁচা স্বপ্নের বর্ণ-শব্দ-বাক্যদিয়ে গড়া এক অনন্য স্কেচ। আর সবশেষে নির্ঘুম রাত্রিকে ভুলে গিয়ে সুবেহ সাদিকে পাখির কিচিমিচি আর মোয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠের সাথে একটা প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস, ঠোটে এক চিলতে হাসি আর চোখের কোণে একবিন্দু অশ্রুসমেত প্রভাতকে বরণ করা। গল্প একটা দিনের সূচনা। গল্প, গল্পকারের পিতৃত্ব গুণে এক আধা স্বপ্নের পূর্ণতা। কোনো নতুনত্বরে দার উন্মোচিত হওয়া ।
জানিনা আমি সেই গল্প কখনো লিখতে পারবো কিনা। জানিনা মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে স্বপ্নের স্কেচে জীবনের চিত্র আঁকতে পারব কিনা। সব হতাশা বিলীন হয়ে গেছে স্বপ্নের চড়াবালিতে। আমার ইচ্ছে পথে পথে হাটি জীবনকে দেখি। রাতের মধ্য প্রহরে হঠাত ঘুম ভেঙ্গে যাবে । সমুদ্রের মাতাল ঢেউয়ের মতো, কাল বৈশাখির দুমড়ে মুছড়ে ফেলা তুফানের মতো আমার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ আন্দোলন করে বেড়িয়ে আসবে। আমি গল্প লিখব। পথের গল্প, সদরঘাটের সেই স্বপ্নবাজ আব্দুল্লাহর গল্প। আমি সিঁধু মামাদের গল্প লিখব। নারিন্দার লালমোহন সাহ স্ট্রিট, শরৎগুপ্ত রোড কিংবা কলতা বাজারের পুরণো দালানের পরিত্যক্ত শেওলা আর খয়ে যাওয়া ইট-সুরকিদের গল্প লিখব। বাহাদুর শাহ পার্কের বেদিতে বসে জীর্ণ কামিজ পরিহীতা বালিকা, যে রঙ্গীন স্বপ্ন দেখা প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য মলিন হাতে বকুল ফুলের মালা গাঁথে আমি তাদের গল্প লিখব। গোলাপ শাহ মাজারের আশে পাশের কিংবা এই শহরের সকল চেনা-অচেনা পথের উদ্বাস্ত মানুষের নির্ঘুম জালে বোনা ব্যর্থ-অব্যর্থ, জানা-অজানা স্বপ্নের গল্প লিখব। মধ্যবিত্তের লজ্জ্বায় হাত না পাতা চাপা সংগ্রামের গল্প লিখব। উচ্চবিত্তের শান-শওকতের বাঁধানো দেয়ালের ওপারের বুক ফাঁটা খামোশ চিৎকারের গল্প লিখব। আমি জীবনের গল্প লিখব।
যখন লেখার জন্য কোনো প্লট খুঁজে না পাই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যাই। অতি নিখুঁত ভাবে নিজেকে দেখি । বেসিনের আয়নায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জল আর কুয়াশার ন্যায় ইষৎ ঝাপসা আবরণের ওপাশের আমিটাকে দেখি। পানির প্রতিটা ফোঁটায় ফোঁটায় গল্পের প্লট খুঁজে ফিরি। ঐ তো গল্প! অসংখ্য অগণিত গল্প। আয়নায় বিন্দু বিন্দু জলের মতো সারা আমিতেই তো কত শব্দ, কত বাক্য, কত গল্প। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শুধু ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করে একটু তপস্যার পালা। মস্তিষ্কের শূণ্য অক্ষরেখা বরাবর শুধু আমি, জীবন ও আমার গল্প। সমস্ত বিক্ষিপ্ততা আর হিঝিবিঝি জটিলতার বাঁধন ছিঁড়ে একটা গল্পের জন্ম নেয়। জীবনের গল্প। আর বাথরুমের উন্মোক্ত দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে শ্যাম্পুর স্নিগ্ধতা অনুভব করতে থাকা তপস্যারত মুনী হয়ে উঠেন গল্পকার। পৃথিবীর সব গল্পেরই শ্রেষ্ঠ চরিত্র ‘আমি’।
স্নাতক (সম্মান) ২য় বর্ষ,
লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
পদাবলি
তোমার নাম চন্দ্রবিন্দু
মাসুদ পারভেজ
তোমার নাম চন্দ্রবিন্দু
শুধু এতটুকুই আমি জানি,
আর কোন নাম আছে কিনা, তুমি কি কর, কি তোমার পরিচয় কিছুই জানি না;
কবে থেকে আমার ফেসবুক বন্ধু হয়ে আছো তাও জানি না ।
একদিন তুমি মেসেঞ্জারে লিখে পাঠালে- আট নাম্বার রোডে কি করেন, টং দোকানের চা ভালো লাগে?
সেই থেকে শুরু- আট নাম্বার রোড আর টং দোকান।
দিন, সপ্তাহ মাস এভাবে এক বছর।
কখনোই তোমাকে আমি দেখিনি, অথচ প্রতিদিন তুমি আমাকে দেখেছ।
তোমার চোখের গভীরে কেমন স্বপ্ন লুকোচুরি খেলে
চুলের সাথে গভীর আঁধারের সখ্যতা কেমন
রক্তকমলের মত তোমার ঠোঁটে কেমন রং ছড়ায়
কিংবা তোমার চলার পথে বাতাস কত উতলা থাকে আমি কিছু দেখেনি,
শুধু তুমি জানিয়েছিলে-
তুমি নাকি থ্রি-পিছ তার উপর হিজাব আর রোদ চশমা লাগাও।
তোমাকে একবার চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলাম
তুমি বলেছিলে কফিই তোমার পছন্দ,
তোমাদের অভিজাত কফি হাউসগুলো আমাকে দেখে মিটমিটিয়ে হাসে।
তবুও অনেক সাহস নিয়ে তোমাকে বলেই ফেললাম চলো কফি খাবে।
তুমি জানালে আমার চাকরি-বাকরি না হলে কফি খাবে না।
তারপর আর কখনোই তোমাকে আমি পাইনি।
দু’বছর হল আমার চাকরির বয়স।
অনেক কিছুই বদলে গেছে এরই মাঝে
আট নাম্বার রোডে নতুন অনেক বিল্ডিং পাশে আরো নতুন দোকান,
শুধু বদলায়নি আমার আট নাম্বার রোডে আসা যাওয়া আর টং দোকানটা।
দোকানি করিম চাচা মারা গেছে ছ’মাস হল এখন তার ছেলে বসে, মানিক তার নাম, খুব মিশুক ছেলেটা; আমি নাকি তার বাপের আমলের কাস্টমার।
আট নাম্বার রোডে হিজাব পরে রোদ চশমা চোখে অনেকেই হেঁটে যায়, আমি জানি না এখানে কোনটা তুমি চন্দ্রবিন্দু ?
আমি জানি না, এখনো তুমি আমাকে দেখো কিনা আমার অগোচরে,
এখনো আমার পিংক রংয়ের শার্ট তোমার বিরক্ত লাগে কিনা।
এখনো তোমার জানালা ছুঁয়ে রোদ আমার বোকামি হাসি ছড়ায় কিনা।
এখনো তুমি আমার নিরর্থক অপেক্ষার কারণ খোঁজ কিনা,
আমি জানি না তুমি কেমন আছো!
আর মাত্র বছর কয়েক পরে এখানে একটা কফি শপ দেবো-
তার নাম হবে ‘শুধু চন্দ্রবিন্দু’।
মধ্যবিত্ত-২
সাগর আহমেদ
সুখের সন্ধ্যানে একজোড়া চোখের
সংষ্কার চলছে অপারেশন থিয়েটারে,
হাতের মুঠোয় পোরে কাগজের জীবন
প্রতিনিয়ত ছোটে চলি বিস্তীর্ণ শহরে।
নতুন ভোরের আশায় রাত জেগে জেগে
গল্প সাঁজাই নিভন্ত জোনাকির আলোয়,
ক্ষুধার ক্রোধে অন্তহীন হাঁটছি তপ্ত রোদে
অবিরাম চিত্তে নিত্য করে সহস্র কল্পনা।
দারিদ্র্যের রঙিন ক্যালেন্ডারে মধ্যবিত্তরা
সুখের ক্ষণ গুনে মগজের হিসেবমেশিনে,
কংক্রিটের তপ্ত পিচে রক্তগুলো ঘামের
ফোটা হয়ে মিশ্রিত হয় নগরের ধুলিকণায়।
তবুও চলে স্বপ্নবোনা থেমে নেই প্রহর
রিফু করা বুক পকেটে জমা চকচকে নোট
প্যাডেলের জোড়ে ছেলে বিদ্যাসাগর হবে
বাবার স্বপ্ন ধুলিজমে ক্রমশ হয় নিশ্চিহ্ন।
নদীরা এমন কেন?
রাকিবুল হাসান রাকিব
নদীরা এমন কেন?
যেথায় যায়; মিশে যায়।
কোথাও কাঁদামাটি;
কোথাও বেলেমাটি;
কোথাও এটেল মাটি;
সবখানে মিশে যায়।
সাগরে গেলে সাগরের সাথে
গঙ্গায় গেলে গঙ্গার সাথে
যেখানে নদীর সঙ্গে;
কালো, সাদা, নীল পানি আছে;
সেখানে তাদের সনে মিশে।
কোথাও উঁচু আর ঢালু-
তবুও নদী চলে যায়।
কভু প্রবাহমান গতি হারালে;
শেওলা জন্মায় তার বুকে-
তবুও নদী চলে।
কখনো জলপ্রপাত হয়ে;
পাহাড়ের সাথে মিশে-
উপর থেকে ঝরে পড়ে।
কেউ নদী কিনারে এলে;
যে বর্ণ হোক সে,
নদী তার রূপ ধারণ করে।
নদীরা এমন কেন?
যেথায় বিরাজ করে;
সেথায় যায়, মিশে।
অভিনয়ের হাসি
জোবায়ের জুবেল
আমার ভেতরে বহমান এক মহাসমুদ্র; অবারিত ¯্রােতধারা প্রবাহিত আঁখিযুগলে।
দু ইঞ্চি বুকের ভেতর গর্জে উঠে অগ্ন্যাশয়-
পুড়তে থাকি; কেউ দেখে না।
কষ্ট পাহাড়ের চূড়াটা ব্যাকরণে অনুপস্থিত; শুধু যোগ হয় বিয়োগ নেই।
পাঁচ ফুট শরীরে সবকিছু লালিত, ক্ষয় ধরেছে যন্ত্রাংশে; বাহিরের পৃথিবী দেখে অভিনয়ের হাসি।
পদাবলি : ০২
একটি জলের ছবি
লুনা রাহনুমা
সারাদিন বাড়িতেই থাকছে স্যাম
কোরোনার কারণে খুব প্রয়োজন ছাড়া
কেউ বাড়ির বাইরে যায় না আজকাল।
এখন শীতকাল বলে
ঘরের ভেতর হিটিং চলছে।
বাইরে শীতের বিলেতি বৃষ্টি
শুরু হয়েছে সকাল থেকে।
রেডিওটরের গরম আর বাইরের ঠান্ডায়
বেডরুমে বড় জানালার কাঁচে
কুয়াশার মতন মেঘ জমে ঘন হয়ে আছে।
স্যাম ওর ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে
জানালায় ছবি আঁকছে খুব মন দিয়ে।
ছবিতে একটি সাত আট বছরের ছেলে
একটি নদীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে,
নদীতে একটি নৌকা ভাসছে,
নৌকার ছৈয়ের ভেতর থেকে
মুখ বাড়িয়ে আছে একজন মহিলা-
ছবির পাশে স্যাম লিখলো, মাই মম।
ছবির আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ
ঠিক যেমন স্যামদের এলাকাতে বৃষ্টি পড়ছে এখন।
জানালার ঠান্ডা কাঁচে নাক লাগিয়ে
স্যাম বাইরের রাস্তার দিকে তাকায়
একটি ছেলে বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে
সবুজ রেইনকোট পড়ে।
ছেলেটিকে খুব আনন্দিত লাগে স্যামের চোখে।
ছবিতে স্যাম নৌকার উপর মায়ের পাশে
আরেকটি মুখ আঁকলো এবার।
মুখটির পাশে লিখলো, মাই ড্যাড।
মনে মনে বললো, আই মিস ইউ ড্যাড।
এমন সময় পেছন থেকে ডাক আসে:
- স্যাম, খেতে আসো।
- আসছি মম।
যাবার আগে স্যাম এতক্ষন ধরে আঁকা
বাষ্পের ছবিটির দিকে তাকায়।
তারপর ছবির দ্বিতীয় মুখটিকে মুছে ফেললো
কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলে।
স্যাম জানে,
বাবা এখন ওদের থেকে আলাদা থাকে।
স্যামের মতোই বাবার এখন আরেকটি
ছেলে আছে রাস্তার ঐ ছেলেটির মতো
সেই ছেলেটি এখন স্যামের বাবার হাত ধরে হাঁটে।
রান্নাঘরে মায়ের সাথে স্যামের টুকুর টাকুর
গল্পের আওয়াজ, হাসি আনন্দে ভরে গিয়েছে ঘরটা।
বেডরুমে জানালার কাঁচে কুয়াশার মতো ছবিটিতে
স্যামের বাবা বৃষ্টির জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে স্যামের মনে
শৈশবের ভুলে যাওয়া স্মৃতির বিস্মৃতিতে।
আমাদের একজন হারকিউলিসের প্রয়োজন
রাতিক হাসান রাজীব
একজন হারকিউলিসের খুব প্রয়োজন এ দেশে-
ঘুম থেকে উঠে পত্রিকায় চোখ বুলাতে গেলে ধর্ষণের খবর!
এখানে ধর্ষণ, ওখানে ধর্ষণ!
এ যেন প্রতিযোগিতার মাঠ,
বিচার- সে তো সোনার হরিণ,
জজ সাহেবের কলমে ধরেছে জং,
আমাদের একজন হারকিউলিসের খুব প্রয়োজন।
শিশু বলো আর যুবতী বলো
ধর্ষিতা হচ্ছে বৃদ্ধাও!
কখনো দল বেঁধে, কখনো একা
ধর্ষণ করছে রোজ শুয়োরেরদল,
অথচ রাষ্ট্র আমাদের নিরব দর্শক,
আমাদের একজন হারকিউলিসের খুব প্রয়োজন।
বাতাসে ভাসছে শত শত আর্তনাদ,
নিরাপত্তাহীনতায় আমার বোন, তোমার বোন
রাস্তায় বের হলে শিয়ালের ভয়,
আমাদের কেবল মোমবাতি হাতে দাঁড়ানো দায়,
আমাদের একজন হারকিউলিসের খুব প্রয়োজন।
জ্যোৎস্না ভরা রাতে তুমি আসমানী
মিসির হাছনাইন
কেন? জানি না! আমি তোমার কতটুকু চেনা?
হেমন্তের শিশির ভেজা জলে ভোরের রোদ্দূর
নকশিকাঁথায় মুড়ানো পায়ে নূপুরের কেমন তাল..!
আমি তোমার কতটুকু জানি?
কেমন করে হয়ে গেছে রাতটা এখন দিন
পানির তলায় রাজতুমারী জিনিয়াস মীন
কোন শ্মশানের ঘাটে ভীড়ে ভীনদেশী নাও,
ভুলতে গেলে কেমন লাগে? কেমনে ভুলে যাও ?
জ্যোৎস্না ভরা রাতে তুমি আসমানী...
যদি ফিরে আসে বার বার ফেলা আসা দিনগুলো
তোমার চোখে পৃথিবীর রোদ্দুর, তুমি কত সুন্দর..!
মাঘের খড় পোড়া আগুনে কুকুরের ওম
তুমি ঘুমিয়ে গেলে আমি দেখি তোমার পায়ের তাল..!!
রাত জাগা ভোরের রোদ্দুর, তোমার ছায়া...
আমি তোমার কতটুকু জানি?
মন পোড়া নদী ও উড়াল পাখির গল্প !
মন পোড়া নদী ও উড়াল পাখির গল্প
নূরে জান্নাত
মন খুইল্যা কান্দিব্যার গেলিও
সাউস নাগে।
পরিবেশ নাগে, নাগে একখান
বিশ্ব্যাইস্যা বোক।
আমার এইগুনালের কিছুই নাই।
ঝিঁগিরি হোইর্যা যহন পেরথম মাসের
ব্যাতন পাইছিল্যাম...
সক কইর্যা একখান খাঁচা কিনছিল্যাম
হাতে একখান ময়ন্যাও কিনছিল্যাম।
কততো আপন আছিলো আমার!
কাম শ্যাষে বাড়ি ফির্যা কতা কইত্যম
আদর কইরত্যাম, খাওনও দিত্যাম।
ম্যালা দিন পর...
একদিন খ্যেয়ালে আইলো পাহি হান
বন্দ খাঁচায় ছটফট ছটফট হোইরত্যাছে!
আমি ঠিক কইরল্যাম খাঁচার দুয়ার খুইল্যা দিমু
হোইরল্যামো তাই!
একদিন যায়, দুইদিন যায়, তিনদিনের দিন
পাহি হান আর গরে ফেরে না!
খোঁজ নিয়্যা দেইকল্যাম যে বাড়িত থেইক্যা কিনা আনছিল্যাম
পাহিহান ঐ বাড়িতই ফির্যা গ্যাছে!
দুদের নাহাল দলা ফরফরা মিয়্যা নোকের
সিঁন্দুর রোইঙ্গ্যা ঠোঁটের শব্দে শব্দ মিলাইয়্যা
দিব্যি কইয়্যা যেইত্যাছে তার আওরাইন্যা বুলি গুলা!
আমার পিচ পিচ পাহিহান ফির্যা আইলো..
আমার কান্দন দেইহ্যা পাহিহানও কান্দিলো
কোছিলো.. আর কুনুদিন অন্য কুনাহানি
যাইবোনা ও পাহি!
হের পরের থন মালিকের বাড়ি কামে গেলি
আমার আতে আর কাম ওটে না!
ছুইট্যা ছুইট্যা ফির্যা আসি বাড়িত।
পাহিরে চোহে চোহে রাহি!
কামে যাতি দেরি অয়- আগের মতো
গোছাইয়্যা কামও হোইরব্যার পারি ন্যা।
এর পর পাহিহান পর পর চাইর বার উইড়্যা গ্যালো, ফির্যা আইলো!
হাতে আমার কামহানও গ্যালোগা।
কামের সুযুক আর ফিরলোইন্যা!
শ্যাষবার, মানে পাঁঁচ বারেরবার যহন
পাহিহান উইড়্যা গ্যালো..
আমার চোক তহন কোটোরে ঢুইক্যা গ্যালো।
আমি খাঁচা হান আলগুসতে নিয়্যা
গঙ্গাত ডুব দিল্যাম..
হাতথন ছেইড়্যা দিল্যাম খাঁচাহান।
আমি যুদি আর উপুরে উইঠপ্যার না পেরল্যামনি!
যুদি মিশ্যা যেইব্যার পেরল্যামনি গঙ্গার পানির হাতে!
আমার মরা দেহখান মাছেরা ঠোক পেইর্যা ঠোক পেইর্যা যুদি খাইলোনি!
আমি আক্কাশ বিলা ফির্যা চেইল্যাম
আল্লাহকে কোইল্যাম..
তোর খ্যালা বোজা বড়ো দায়!
জানি এসব হোইবোনা!
বাঁচায়া যহন রাইখছোস..নিশ্যাষ নিব্যার মতো
এল্লা শক্তি দুক্কা দে?
মন দন সব থেইক্যা বড়ো দন
হেই দন আমাই হারাইলাছি..
এতা কেও না জানলিও তুইতো জানোস আল্লাহ!
আল্লাহরে..
আমার কুনু নালিশ নাই- না পাহির পোতি
না তোর পোতি!
পাহি হান যানি বালো থাকে।
ম্যালাদিন পর...
ঘুইটঘুইট্ট্যা আন্দার রাইত ফাইল্যা দিয়া
আক্কাশ জুইড়্যা খিলখিলাইয়্যা চাঁন উইটছে।
আমার ছনের গরের মাটির বারান্দাত
বাঁশের আড়ে হুকাইব্যার দেওয়া আধপুরান
শাড়িহান বাতাসে দুইলত্যাছিলো!
যে শাড়ির কোচে হৈর্যা মালিকের বাড়িত থন
চুরি হোইর্যা ফল আনছি খাওন আনছি
পাহিরে খাওয়াইছি..!
শড়িহান কেব্যা জানি বেশিই দুইল্যা উইঠলো!
আমি হেরিকেন আরো বাড়াইয়া দেইকল্যাম
পাহিহান ফির্যা আইছে!
আসতে আসতে পাহি হান একজন মরদ নোক হোইয়্যা মাটিত পাউ থুইলো!
আমার দুই পাউ যেইপ্ট্যা ধোইর্যা ক্ষ্যামা চাইলো!
আমি হাত উঁচাইয়্যা মাটির বারান্দাত থন এল্লা দূরে উঁচা মাটির ভিট্যা হান দেহাইয়্যা দিল্যাম!
দুবলা গাস দহল হোইর্যা নিছে আমার কবর হান।
আমিতো হেই কবেই মোইর্যা গেছি গা..
মরা পর আবার ক্যান মোইরত্যাছি?
ক্যান; ক্যান!!
পদাবলি : ০৩
আমার সখী
মেহেরুন ইসলাম
আমার সখী রাতের বুকে জ্বলজ্বলে এক তারা,
রোজ রাতে সে আমায় ডেকে হয় গো পাগলপারা।
আমার সখী দিনের রবি ঝিলিক মারা আলো,
এক নিমিষে মনটা আমার দেয় করে দেয় ভালো।
আমার সখী রঙিন বিকেল রংধনুর ওই ভাঁজে,
হাত নাড়িয়ে ডাকে আমায় হরেকরকম সাজে।
আমার সখী কলমিলতা থাকে গাছে গাছে,
আমায় দেখে হাওয়ায় দোলে তাধিন তাধিন নাচে।
আমার সখী ছোট্ট ময়না মিষ্টি মুখের বুলি,
সুরের পরশ দিয়ে ভোলায় আমার দুঃখগুলি।
আমার সখী নদীর বুকে ঢেউ খেলানো পানি,
উঁচুনিচু ঢেউয়ের তালে দোলে হৃদয়খানি।
আমার সখী মাঝি ভায়ের পালতোলো ওই নাও,
নায়ে চড়ে এ মন ভাসে সুদূর কোনো গাঁও।
আমার সখী সবুজ পাতা, পাতায় মোড়া বাঁশি,
পাতার প্রেমে ব্যাকুল হৃদয়, পরে গলায় ফাঁসি।
আমার সখী মা জননীর দুষ্টুমিষ্টি গালি,
পড়তে বসে ফাঁকি দেওয়া, নষ্ট কলম-কালি।
আমার সখী স্নেহের বাবা, মনের মতো মানুষ,
যার আকাশে দস্যি এ মন উড়ায় স্বাধীন ফানুস।
পেয়েছি এই খোঁজ
মো. পারভেজ হুসেন তালুকদার
নাম না জানা সাদা রঙের ফুল,
রাঙিয়েছে পথের দু’টি কূল।
বনটি পাশেই নয়তো বেশি দূর,
ভেসে আসে পাখির মধুর সুর।
কল্পনাতে ভেবেছি যা রোজ,
আমার গাঁয়ে পেয়েছি এই খোঁজ।
ছন্দের তালে জীবন
মাহতাব উদ্দিন
প্রমিত জীবন ধ্বনির মতন দোলে-
মুক্তাক্ষরের আদলে,
ছন্দের ভাঁজের সাথে যেনো তা সংবৃত,
রাগ-বিরাগে অবনী-মাঝে প্রকাশ্যে বিবৃত।
কখনো সহাস্যে স্বরবৃত্তে কিংবা মাত্রাবৃত্তে,
আবার কখনো অক্ষরবৃত্তের মতো ধীর-লয়ে চলে।
জীবন কখনো সমচরণ বা মিশ্রচরণ ছন্দের মতো,
প্রস্বর দিয়ে তাকে লয় বা গতির চালে গড়তে হয়।
অন্ত্যানুপ্রাসের মিলন জীবনকে সুন্দর করে,
প্রতি পর্বে প্রতি পদে তা হয় সমৃদ্ধিপূর্ণ।
উপমা বা তুলনাতে নয়, অলংকারেই জীবন,
দামালি পাঁচালি কিংবা পয়ার-মহাপয়ারে নয়-
জীবন তো এক কাব্যিক দ্যোতনা।
প্রিয়তমার শেষ স্পর্শ
প্রিয়তমার শেষ স্পর্শ
তারেকুর রহমান
আম্মু, আম্মু, কই তুমি?
কিরে এত চেঁচাচ্ছিস কেন?
চেঁচাবোনা? তুমি এখনো রেডি হওনি। কখন আমরা বিয়েতে যাবো।
আচ্ছা রেডি হচ্ছি। তোর আব্বুকে ফোন দিছোস? অফিস থেকে বের হয়েছে?
ফোন দিছি, আব্বু বের হচ্ছি, বের হচ্ছি বলছে এক ঘণ্টা যাবত।
তার কি এসবের খেয়াল আছে? সারাদিন থাকে শুধু অফিস নিয়ে।
সালেহা বেগম তার মেয়ে নিতুর সাথে কথা বলছে। নিতুর এক চাচাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবে। রেডি হতে দেরি হচ্ছে দেখে নিতুর শাসানি শুনছে। মেয়ের আদুরে শাসন সালেহা বেগমের বেশ ভালো লাগে। সচরাচর বিয়ের অনুষ্ঠানে তার যাওয়া হয়না। সংসার সামলাতে সামলাতে আর সামাজিকতা রক্ষা করা হয়না। তাছাড়া নিতুর বাবা এত বেশি ব্যস্ত থাকে তাদের আর কোথাও যাওয়া হয় না। দ্রুত রেডি হতে হবে না হয় মেয়ের বকা শুনতে হবে। সালেহা বেগম একটা লাল রঙের শাড়ি পরলো। এটা সম্ভবত কোন এক বিয়ে বার্ষিকীতে নিতুর বাবা গিফট করেছিলো। সালেহা বেগমের এখন আর সেই ইচ্ছা ও নেই। আগে তার খুব সাজতে ইচ্ছে হতো। খুব ইচ্ছে হতো একটু সেজেগুজে কোথাও ঘুরতে যেতে। কিন্তু স্বামীর ব্যস্ততার কারনে সব ইচ্ছার জলাঞ্জলি দিতে হয়ছে। কখন যে তার ইচ্ছেগুলো মেঘে ঢেকে গেছে তা টেরই পায়নি। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মেকআপ ঠিক করছেন তিনি। নিতু এসে ধমকের সুরে বললো,
আম্মু রেডি হয়েছো?
এইতো শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আম্মু তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
তোর মা তো তাই বলছিস।
না আম্মু, সত্যিই সুন্দর লাগছে। ও তুূমি ফিংগার রিং পরো নাই?
আংটি কোথায় রাখছি তাওতো মনে নাই।
তাড়াতাড়ি খুঁজে পরে নাও।
আচ্ছা ঠিক আছে।
সালেহা বেগম আংটি খুঁজতে লাগলেন।
এই ড্রয়ার, ওই ড্রয়ার খুঁজতেই আছে। ইদানীং তার কোন কিছুই মনে থাকেনা। অবশ্য ইদানীং বললে ভুল হবে আগে থেকেই সে একটু ভুলোমনা ছিলো। অনেক্ষণ পর আংটির বাক্সটা পেলো। এই বাক্সে তার নানারকম আংটি রয়েছে। সালেহা বেগম খুঁজতে লাগলেন কোন আংটিটা পরবেন। একটা আংটি হাতে নেয়ার সাথে সাথে তার বুকের ভেতর মোছড় দিয়ে উঠলো। এতদিন পর এই আংটি হাতে নেয়ার পর তার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। এই আংটির একটা ইতিহাস আছে। এটার সাথে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি।
পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি করার খুব ইচ্ছে ছিলো। চাকরি পাওয়াটা খুব কঠিন ব্যাপার। এদিকে নানান জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসছে। মেয়ে শিক্ষিত, ফ্যামেলি ভালো হওয়ায় অনেক ভালো ভালো জায়গা থেকে প্রস্তাব আসতে লাগলো। একটা প্রস্তাব আসলো, ছেলে শিক্ষিত তার ফ্যামেলিও শিক্ষিত। বাবা মসজিদের ইমাম। ছেলে একটি বেসরকারি চাকরি করে। ছেলের সব পছন্দ হয় কিন্তু তার যে চাকরি তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হবে। ছেলেটাকে সবার পছন্দ হয়, সালেহা বেগমের ও পছন্দ হয়। মানুষ যা চায় সবতো পায়না। কিছু কিছু জায়গায় ছাড় দিতে হয়। মা এসে বললো, সালেহা দেখ হয়তও ছেলেটার ইনকাম কম কিন্তু সেতো শিক্ষিত, ভদ্র, তাছাড়া ফ্যামেলিও ভালো মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় এখানেই আত্মীয়তা করা ভালো হবে। সবার মতামতের ভিত্তিতে বিয়ে হয়ে গেলো। ফাহিম হলো সালেহার স্বামী। বাসর রাতে ফাহিম অনেক কান্না করে। মধ্যবিত্তের টানাপড়েনের কারনে লাইফের কোন কিছুই তার পাওয়া হয়নি। সালেহাই ফাহিমের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। বাসর রাতে ফাহিম সালেহাকে একটা আংটি গিফট করে। এই আংটি কিনতে অনেক কষ্ট হয়েছে এ গল্প অবশ্য সালেহা বিয়ের কয়েকদিন পর জানতে পেরেছে।
দুজনেই সংসার শুরু করলো। একদম শূন্য থেকেই শুরু হলো তাদের সংসার। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া কিছু জিনিস নিয়ে তারা নতুন বাসায় উঠলো। ছোট বাসা হলেও বেশ সুন্দর বাসা। বাসায় কোন খাট ছিলোনা। ফ্লোরিং করেই দুজন ঘুমাতো। জানালায় পর্দা হিসেবে সালেহার ওড়না আর গামছা ব্যাবহার করতো। আস্তে আস্তে তারা সংসার গোছাতে লাগলো। অল্প আয় দিয়ে খুব হিমসিম খেতে হতো। কোনো এক মাসে বাসার জন্য কোনকিছু কিনলে সে মাস তাদের অনেক কষ্টে যেতো। স্ত্রীকে কোন কিছু দিতে না পারার কারনে ফাহিমের মধ্যে অনেক আফসোস কাজ করতো। তারপর ও এই টানাপড়েনে অল্প কিছু হলেও স্ত্রীকে কিনে দেয়ার চেষ্টা করতো। প্রথম যেদিন তাদের সংসারে খাট আসে সেদিন তাদের আনন্দকে দেখে। আস্তে আস্তে বাসায় ফ্রিজ ও এলো। ফাহিম বাজার করে আনলে সালেহা সব কিছু ভাগ করে রাখতো। দুই পিছ করে মাছ ভাগ করে রাখতো। এক কেজি মাছ দিয়ে অনেকদিন চলে যেতো। ফাহিমের খুব শখ ছিলো স্ত্রী যেন সবসময় সেজেগুজে থাকে। সালেহা ছিলো বরাবরের মতো এসবে উদাসীন। সালেহা ভুলোমনা টাইপের ছিলো। অন্যদিকে ফাহিম ছিলো সিরিয়াস টাইপের। তার সব কিছু মনে থাকতো। কর্মক্ষেত্রে ফাঁকি দিতোনা। বাসায় আসলে অবশ্য সে অলস হয়ে যেতো। এ নিয়ে সালেহার সাথে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও হয়েছে। সালেহাকে বাপের বাড়ি ে যেতে দিতোনা। ফাহিম বলতো, সালেহা চলে গেলে এই একলা ঘরে সে থাকতে পারবেনা। একাকীত্ব নিয়ে তার অনেক ভয় ছিলো। দু’জনের ভালবাসার কমতি ছিলোনা। সালেহা তার সারাজীবন এত কষ্ট করেনি যতটুকু কষ্ট করেছে এই সংসার নিয়ে। সে কখনো অভাব দেখেনি। কিন্তু এখানে অভাব নিত্যসঙ্গী। মাঝে মাঝে সে হাঁফিয়ে উঠতো। এরকম টানাপড়েনে থাকতে আর ভালো লাগেনা। কি এক তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তাদের ঝগড়া হয়। সালেহা রাগের মাথায় অনেক কথা বলে ফেলে। সালেহার কথা শুনে ফাহিম ভেঙ্গে পড়ে। এই হতাশাই যে তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আজ যে তার স্ত্রী এই যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দিলো। ফাহিম হু হু করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার মৃত্যু ছাড়া তোমার কোন মুক্তি নাই। যদি মরে যাই তবে তুমি এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি পাবে। দুজনের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো। রাতে সালেহা ফাহিমের কাছে ক্ষমা চায়। ফাহিম ও ক্ষমা চায়। ফাহিম সালেহাকে বললো।
-সত্যি আমি যদি মরে যাই কষ্ট পাবে?
-এসব কথা না বললে হয়না?
-বলোনা কষ্ট পাবে কিনা?
-কষ্টতো পাবোই। ওই কষ্ট সইতে পারবোনা।
-কিন্তু লাইফের এই গ্লানি থেকে তো মুক্তি পাবে। হা হা...
-আবার এসব? আমি কিন্তু কথাই বলবোনা।
-আচ্ছা ওসব বাদ, ওকে?
-ওকে...
মাঝেমাঝে ফাহিমের প্রচ- বুকের ব্যাথা উঠে। সম্ভবত গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা। বুকের ব্যাথায় সে সারারাত ঘুমাতে পারেনা। সালেহা উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। ফাহিম তাকে চিন্তা না করার জন্য বলে। এটা নেহায়েত গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা অন্য কিছু না। দুই তিন মাস পর একদিন মধ্য রাতে ফাহিমের বুকের ব্যাথা উঠে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ফাহিম কেমন যেন হয়ে গেলো। সে সালেহাকে ধরে কাঁদতে থাকে। সালেহা কি করবে বুঝতে পারছেনা। সালেহার কোলে মাথা রেখে হঠাত ঘুমিয়ে গেলো ফাহিম। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সালেহা ফাহিম ফাহিম বলে চিৎকার করছে। ফাহিম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তার নিথর দেহ পড়ে আছে সালেহার কোলে। এত দ্রুত একজন মানুষ হারিয়ে গেলো। ফাহিমের মৃত্যুর পর সালেহা বাপের বাড়িতেই আছে। তার অনেক শখ ছিলো বাপের বাড়িতে বেড়ানোর। এখন সে শখ পূরণ হচ্ছে। যে মানুষটা একা থাকতে চাইতোনা। সে কিভাবে সবাইকে ছেড়ে একা একা থাকছে? সালেহা বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ফাহিমের মৃত্যুর পরের পৃথিবীটা আরো অনেক কঠিন হয়ে গেলো সালেহার জন্য। সবাই কেমন যেন করুণার দৃষ্টিতে দেখতো। সালেহার আবার বিয়ে হয়ে গেলো। বেশ বড়লোকের সাথে। বয়সে অনেক ফারাক থাকলে ও তার টাকার অভাব নাই। আগে এক বিয়ে করেছেন। স্ত্রী রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। স্ত্রীর দুঃখে অনেক দিন বিয়ে করেননি। সালেহার দুঃখ গুলো গুছতে লাগলো। তার সব চাহিদা পূরণ হয়ে গেলো। আগের কষ্টের স্মৃতি গুলো ভুলেই েেগছে। ফাহিমের কথা তার তেমন মনে পড়েনা। এত সুখের মাঝে অতীতের দুঃখকে মনে রাখার কি দরকার। তবে এখানে অনেক কিছু থাকলেও ভালবাসার বড্ড অভাব। সারাদিন স্বামীর ব্যস্ততা সালেহাকে কষ্ট দিতো। সে স্বামীকে একটু কাছে চাইতো কিন্তু স্বামী শুধু ব্যবসা নিয়েই পড়ে থাকতো। বাপের বাড়ি গিয়ে মাস খানেক থাকলেও কিছু বলতোনা। সালেহা নিজ থেকে না গেলে তাকে নিয়ে যেতোনা। সালেহার খুব ঘুরতে ইচ্ছে করতো, সাজতে ইচ্ছে করতো। এইসব ইচ্ছের দাম তার স্বামীর কাছে নাই। সুখের জন্য যতটাকা লাগবে সে দিতে প্রস্তুত। স্ত্রীকে সময় দেয়ার মতো সময় তার নাই। সালেহার কোলজুড়ে আসে মেয়ে নিতু। নিতুকে নিয়েই তার পৃথিবী। এত টাকাপয়সা এত কিছু, একটা সন্তানের শখ তাও পূরণ হলো তারপর ও কি যেন নাই সালেহার জীবনে। হয়তও মানসিক সুখ। মানসিক সুখটারই অভাব তার জীবনে। অথচ ফাহিমের টাকা ছিলোনা আর সবই ছিলো। ভালবাসার কমতি ছিলোনা। টাকাই কি সুখ দিতে পারে? সালেহা উত্তর খুঁজে পায়না।
-মা তাড়াতাড়ি চলো।
মেয়ের কথা শুনে সালেহা বেগম দ্রুত চোখের পানি মুছে নিলো। ফাহিমের দেয়া আংটিটা পরেই বের হলো। আর কখনোই হয়তও এই আংটি পরা হবেনা। শেষবারের মতো স্মৃতিটুকু স্পর্শ করলো সালেহা বেগম।