পদবলি

পদবলি


দিনান্তের ব্যবসায়ী হিসেব
ইলিয়াস বাবর

ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে থাকে বাঁধ-
বিশ্বাসের নিগূঢ় দালানে ঢুকে শত্রুসেনা
মিথ্যের দোহাই দিতে দিতে
একদিন টুপ করে, আষাঢ়ে গল্প বুনবেনা!

তা রবীবাবু বলুন, আমার নয়
প্রতিদিনের চাহিদায় থাকে অপূর্ণ সবক-
ক্রমাগত আশ্বাসের বিফলে
সোনালী দিনে কিনে রাখি হাবিয়া-দোযখ!



অতঃপর
রেবেকা ইসলাম

যখন দিন চলে গেল রাতের পিছু পিছু
আলো নিষ্প্রাণ হল আঁধারে
ঠিক তখনই হাতে হাত ধরে
নেমে এল রূপজ্বলা তারাদের দল
এ পাড়ার ও পাড়ার, এ গলির ও গলির
ঝিম ধরে থাকা জড়াক্লিষ্ট সব ছাদে,
হিজিবিজি অন্ধকার ঘরে,
নারীর আঁচলের ঢিলেঢালা খুঁটিতে
অসুখী আবজাব নগরে।

তারপর আনন্দের শঙ্খজলে ভাসল ওরা,
ওরা কয়জনা যৌবনপূজারী
দুরন্ত চোখে যাদের স্বপ্নধরার জাল
কণ্ঠে ঘুড়িওড়া বিকেল
অতঃপর,ঠোঁটের কোণে ফেরারি সুখ নিয়ে
এক সাগর নিদ্রাকে চৃর্ণ বিচূর্ণ করে
জেগে রইল ওরা অনন্তকাল।


                                                   
দাকা-যম
বঙ্গ রাখাল
(উৎসর্গঃ তেভাগা আন্দোলনের সাঁওতাল যোদ্ধা দীনেশ মুর্মকে)

এই যে আসুন, দেখে যান ধানক্ষেত। ধানক্ষেত
যৌবনা হচ্ছে, দুধের গোলায় জমছে দুধ। ধান
থেকে জš§ নিচ্ছে অজস্রচারাগাছ। মাটি ভেদ
করে গান গাইতে গাইতে জš§ নিচ্ছে যত সব
পাতারি ধানের নীলহলুদ পাতাগাছ।

গান হয় শরীরে, মনে, হৃদয়গভীরে।
বৃক্ষপত্রে কথা হয়, নদী মিতালী খোঁজে
বীজের অঙ্কুরে।
কৃষক দাকায় তৃপ্তি খোঁজে অলসদুুপুরে হেলেপড়া রৌদ্রে।
যমের যোনী বেয়ে বের  হয়ে আসে সোনালীবাদামীভোর।
দাকাযম পেয়ে উল্লাসে সাজে কাগজের স্বেতকুকুর
গান হচ্ছে, কোথায় গান?
চোখে-মুখে একটা বিষণœসুখ
আমি অবাক
কোথাও ঝামেলা করোনা।
শহুরে মানুষ কি পারে গান শুনতে?
এ চাষাঢ়ে গান আমরা শুনি যারা গ্রামে থাকি...



ঘনীভূত শূন্যতা
বজলুর রশীদ

যুবতী চাঁদের গায়ে অমৃত ফুলের স্বাদ;
অসভ্য লালসার বেহায়া প্রজাপতির দল-
চুমু খায় বিশ্বাসের রাজত্বে।

প্রত্যাশার স্বপ্নযুগল নয়ন অবিশ্বাসের পরিসরে
পাড়ি দিয়েছি আরণ্যিক সময়;
আলোকবর্ষ থেকে অনেক দূরে
অমাবস্যার দরজায় দাঁড়িয়ে।

স্বার্থপরতার প্যাঁচে
ভোরের সিতানে অপেক্ষার পরতে পরতে
হতাশায় কেটেছে কতদিন, কতমাস,
এভাবে বছরের পর বছর।

অতঃপর অসময়ে গোধূলির রঙ মেখে
জোছনানিশি খেলা যদি খেলতে চাও
তাহলে শৈশব উল্লাস ফিরিয়ে দাও?

অতৃপ্ত বাসনায় ডুব সাগরে সাঁতার কেটে
জন্মেছে ভালোবাসার শেষকৃত্য ।
নিস্তদ্ধতার নিরিখে নিরাপদ জোছনা-তারা
কিংবা ভোরের প্রত্যুষে
চাই না  কসমেটিকস সময়ের ফেলে আসা দিনগুলো;
তোমাকে ফিরে দিলাম নষ্টজলের কাদা সাঁতারে।
আর আমায় নিঃশব্দ নিরালায়
ঢেলে যাও আরণ্যিক সময়ে;
বিপদ ঘনীভূত শূণ্যতার গ্রাস।



রাস্তাকে আঁকড়ে ধরেছি
সুজিত মান্না

ছায়াহীন দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু অচেনা লাগে
দেওয়ালগুলো বলে ওঠেÑ
যেভাবে জোনাকি ডেকে প্রেমের গল্প সাজাই
একদিন ¯্রােতে ভেসে আমি কৃত্রিম হয়ে যাবো

এভাবে বারবার এমন দেওয়াল গড়ে উঠতে দেখেছি
আমি কি দিনদিন কৃত্রিম হয়ে উঠছি ?

আমার অপেক্ষার কষ্ট একটু বেশিই’ লেখা আছে
উল্টেপাল্টে সেখানেও আশ্রয় নেয়
                                                কিছু মাকড়শার গল্প ।

আমিই সেই দূরে থেকে যাওয়া জোনাকি
রোজ পশুদেরদের জলাশয়-পরিচিতি দিই
অথচ তাদের আপন ছায়ায় উঠি না...

আমি আসলে এমনই একটা মেঘ
যাকে দেখলে শুকনো জলাশয়ও বিদ্রুপ করে ওঠে
দূর্বা ঘাস ফিরেও তাকায় না...

অফিস বেলার সকাল দুপুর, গঙ্গার বিকেল
কিংবা প্লাবনভূমির রাত্রি ধরে,
                                       আমি হেঁটে চলি তবু...
মুখ তুলে , আমার শূন্যতা দেওয়াল ছুঁয়ে নিয়েছে

হারানোর সত্যিই কি কিছু আছে ?


প্রেম
নূর নিহাল

মুখে জমানো এক দলা থু থু আমার অহংকার
চারপাশ উলঙ্গ- উদাম শরীরকেও মনে হয় শ্রেষ্ঠ পোশাক
ভাতের আগুনে পুড়ে যাওয়া কুঁচকানো মানচিত্র
দু’বেলা দুঃখ- মাংসল হাসি
রোমালে ঢেকে মুখ- আহা! আত্মার অসুখে পুড়ি

তাবৎ ফুল নরম আগুনের জাত
সমুদ্র যেমন মাটির আপন বোন
ওসব গর্দভ গৃহস্থ আমাদের নতমুখ
দূরবীনে পুড়ে যাচ্ছে দূর্বাঘাসের চোখ,
পাপই প্রেম- আঘাতই আগুনের শ্বাস
অসময়ে বেজে যাই ঘৃণার তালুতে
জাতের মুখোশে থু থু ছিটাই...


কাটেনা আঁধার, দিন কেটে যায়
মাহবুবা নাছরিন শিশির

ভেতরে-বাইরে দুর্যোগ খুব পরিত্রাণের নেই উপায়
চলতে চলতে থেমে যায় গতি বেড়ি দিলো কে দু’পায়!
আষাঢ়ে বৃষ্টি,  শ্রাবণে বৃষ্টি, শরতে বৃষ্টি, নাই নিস্তার,
কার্তিকে ফের ভয় সংকেত কী করে হবো এই পথ পার!
ঘনিয়ে আসে কালো মেঘমালা আমার পথের কিনারায়
অঝর ধারায় ঝরে পড়ে জল অদৃশ্য কারোর ইশারায়।
ধোঁয়াশা জলে দ্বিধা জাগে মনে ডুবে যায় যেন কোন শঙ্কায়
ডুবে যাই জলে, ডুবে যাই ধীরে, ডুবে যাই ভীত মন-গঙ্গায়।

জীবনের পথে ঘোর মুসিবতে হাত-পা অচল আমি নিরুপায়
দিকভুলো হয়ে থমকে দাঁড়াই রঙহীন এই ম্লান-তমসায়।
ঠোঁট নড়ে কার, কোন দাদীমার সুদূরের বাণী নিকটে গড়ায়
‘কালা মেঘে নালা পানি, ধলা মেঘে গলা পানি’ শ্লোকে-ছড়ায়।
বদলে যাচ্ছে ঋতু পরিক্রমা বিপদের ঘোর ঘনঘটায়
কাটেনা আঁধার দিন কেটে যায় এক-দুই-তিন-চার ঘনায়।
মাঠ-ঘাট-ডোবা মুখরিত আজ ঝিল্লিমুখর সন্ধ্যা নামায়,
দশ দিকে দশ প্রহরণ আর ইসরাফিলের শিঙা বাজায়।

কেয়ামত কবে আসবে জানিনা এ তুফান-ঝড় স্মরণ করায়
আমাকে তবুও থাকতেই হবে একটি ভোরের অপেক্ষায়।
মেঘ কেটে গিয়ে ভরবে সেদিন সোনালি রোদের রূপালি আভায়,
এই ঘোর রাতে খোয়াব দেখেছি, তাই’তো আমায় আবার ভাবায়।
 

জলচিত্র
পরান জহির

জলছায়ায় আরো একবার
এঁকে দাও জলচিত্র,
পাঠ করো জললিপি স্বর।

সুগঠিত পল্ললে উত্তীর্ণ হোক
মৃৎ কারুকার্য,
দিগন্ত রেখা নিয়ে বাঁচুক পাঁজর।

পাতারেখার ভাজে ভাজে
বর্ণিল হও,
মৃত্যুর মৃত্যুকে ছিঁড়ে।

জয় করে নাও পৃথিবীর
মাটি ও আকাশ,
সৌকর্য ফিরুক পাখিদের নীড়ে।

গল্পটি শুনতে চেয়ো না- কিস্তি ০৭

গল্পটি শুনতে চেয়ো না- কিস্তি ০৭
  
গল্পটি শুনতে চেয়ো না
 সোহেল নওরোজ

এই পর্যায়ে এসে বেশ নির্ভার বোধ করেন হাফিজুল হক। অনেকটা গাড়ি রানওয়ের ওপর তুলে দেওয়ার মতো অবস্থায় আছেন। তিনি স্টার্ট চালু করে লাইনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য খুব বেশি তাড়া নেই। স্টেয়ারিংটা নিজের হাতে রেখে কমান্ড ঠিকঠাকমতো দিলেই হলো। গাড়ি নিজের মতো চলবে। শর্ত একটাই, কেবল নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে হবে। তিনি কি কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণ হারানোর শঙ্কায় আছেন? কখনোই যা বোধ করেননি, না চাইলেও অজানা সেই শঙ্কাটাই ঘুরেফিরে তার আশপাশে ঘুরঘুর করছে। তবে তিনি হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো মামুলি কেউ না। শুরু যখন করেছেন, শেষও করবেন এক হাতে। হাতের প্রসঙ্গ এলেই আরেকটা হাতের ব্যাপারটা তার মাথায় আসে। কেন জানি হাতটাকে তিনি অনুভব করছেন কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে পেলে একটা সুবিধা হতো, তিনি হাতটার একটা চিত্র আঁকতে পারতেন। তাতে কি খুব লাভ হতো? মানুষকে চেনার জন্য তার একটা হাত কখনোই যথেষ্ট হতে পারে না। একবার হলেও তাকে দেখতে হয়। তিনি কি কখনো অনুভূত হাতের মানুষটাকে দেখেছেন?

নাহিদ নিজের মতো চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার সিদ্ধান্তে প্রভাবক হয়ে আসেনি কেউ। না কবিতা, না তাহিয়া। নিজের চাওয়াকে মজবুত করতে কখনো কখনো দূরত্ব খুব কাজে দেয়। এই দূরত্বের ব্যাপারটা হাফিজুল হকের ক্ষেত্রেও অনেকবার ঘটেছে। তিনি নিজে যেমন দূরত্ব তৈরি করেছেন, তেমনি আবার অন্যের সৃষ্ট দূরত্বের কারণে তাকে দূরে সরে যেতে হয়েছে। নাহিদের বড় সুবিধা হলো, তার ওপর কেউ এটা চাপিয়ে দেয়নি। বরং অন্যের চাওয়ার বিপরীতে হেঁটেই তাকে এটা বেছে নিতে হয়েছে। তাতে হয়তো মন খারাপের মতো অনুসঙ্গ এসে পড়ে কিন্তু জীবনের হিসেবের কাছে ধরা দেওয়া সহজ হয়। মত আর অমতের দ্বন্দ্বের পরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব পুষে না রেখে হীনমন্যতা পাশ কাটিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলার আরেক নাম জীবনÑতা কে না জানে!

হাফিজুল হকের হাতে নাহিদের দুই নম্বর ছবি। আগেরটা শৈশবের, এটা যুবক বয়সের। বয়সের তারতম্য খুব বেশি না হলেও কিছু বদল সহজেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। তিনি দুটি ছবি পাশাপাশি রাখেন। কী কী পরিবর্তন এসেছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। অর্পা অবশ্য এ কাজটা সহজ করে দিয়েছে। ঝানু শিক্ষকের মতো পয়েন্ট আউট করে দেখিয়ে দিয়েছে ছবি দুটোর মিল-অমিল। সেগুলো একত্র করলে এমন একটা অনুসিদ্ধান্ত দাঁড় করানো যায়।
আগের ছবির সারল্যের ত্রিশ শতাংশ এ ছবিটাতে নেই। তার মানে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাহিদের ভেতর থেকে সারল্যের উপাদানগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
চেহারার মায়াবী ভাবও অনেকটা কমেছে। মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই মায়ার ওপর কাঠিন্যের একটা পাতলা আবরণ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
নিষ্পাপ হাসির স্থলে দৃঢ় একটা সংকল্প প্রতিভাত হচ্ছে। এটা বোধ হয় কাহিনির কারণেই আনতে হয়েছে। পরের অংশ হয়তো তার ভেতর মমতার চেয়ে সংকল্প বেশি দাবি করে। হাফিজুল হক তেমনটাই করতে চেয়েছেন।

কলেজের প্রথম দিনগুলো নাহিদের দুঃসহ লেগেছে। বারবার মনে হয়েছে জীবনের এ পর্যায়ে এসে সে বড় একা এবং নিঃসঙ্গ। অনিকেতের মতো কেউ পাশে থাকলে তার পথচলায় এমন নিঃসঙ্গতা জুড়ে বসত না। অনিকেত একাাই তাকে আগলে রাখত। অনিকেত না হয়ে কবিতা এবং তাহিয়া বা তাদের দুজনের যে কেউ থাকলেও এই অনুভূতির হেরফের হতে পারত। তারাও মায়ার অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে রাখত। অনিকেতকে পাশে পাওয়া সম্ভব নয়, কিংবা সে হয়তো পাশে না থেকেও প্রবলভাবেই আছে! কিন্তু কবিতা? আর তাহিয়া! তারা যে পাশে থেকেও নেই! জীবনের কিছু পথ একাই চলতে হয়। বোধ করি নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যই একাকীত্বের পথ ধরে চলতে হয় কিছু দূর, বেশ কিছু দূর! কতদূর তা এ মুহূর্তে নাহিদের জানা নেই।

শুরুর অস্বস্তি দ্রুতই কাটিয়ে ওঠে নাহিদ। পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য কয়েকটা টিউশনি আর একটা কোচিংয়ে ক্লাস নেয়। তার পরিশ্রম হয়, তাল মেলাতে কষ্ট হয়ে যায়, তবু দিনশেষে এক ধরনের মানসিক স্বস্তি সঙ্গী হয়। এটাই তাকে বেশ কিছুটা প্রশান্তি দেয়।
যে মেসে থাকে সেখানে নাহিদ সবার ছোট। এ বিষয়টা তার পক্ষে গেছে। সবার ¯েœহের ভাগ যেমন পেয়েছে তেমনি বাড়তি কিছু দায়িত্ব থেকেও তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। প্রথম তিন মাসে তাকে একদিনও বাজারে যেতে হয়নি। খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নেয় সবাই। তার পড়ার টেবিল ছোট হলেও আলাদা। পড়ার সময় অন্যরা পারতপক্ষে তার রুমে আসে না। রুমমেট মমিন ভাই তাকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখে। কিছুদিন আগে একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছে। সময়ের মূল্য সবচেয়ে বেশি। এই ঘড়িটা সে কথায় তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে বলে মমিন ভাইয়ের বিশ^াস। পারিবারিক যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি তাকে সম্পৃক্ত করেন। সামনে তার ছোট বোন মোহনার বিয়ে। মমিনের কিছু দায়িত্ব নাহিদের ওপরেও এসে বর্তেছে। সে এতে যারপরনাই খুশি হয়েছে। ভেতরে এখন থেকেই একধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।

কয়েকদিন যাবৎ একটা বিষয় লক্ষ করছে নাহিদ। কলেজের কিছু বড় ভাই তাকে বেশ সমাদর করে। সেটা বিশেষ কারণে। তারা প্রত্যেকেই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একেকজন একেক দলে। তাকে নিজেদের দলে ভেড়াতেই তারা নানা কৌশল অবলম্বন করেছে। দু-একজন ইতিমধ্যেই নানা প্রলোভন দেখিয়েছে। নির্বাচিত হলে ভালো পদ দেওয়ার কথা বলেছে। স্যারদের বেশি নম্বর দিতে বাধ্য করার কৌশলের কথা জানিয়েছে। অবিশ^াস হলেও সে বিশ^াসের ভঙ্গিতে সব কথা শুনেছে। হ্যাঁ-না কিছু বলেনি। ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগে কাউকে কথা দেওয়া উচিৎ নয়। মমিন ভাইকে কথাগুলো বলেছে। তিনি তাদের থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। পড়াশোনায় ক্ষতি করতে পারে এমন কিছু না করাই শ্রেয়। সে সেটা বোঝেও। তবে নাহিদের চিন্তা অন্যখানে। চাইলেই কি সে তাদের থেকে দূরে থাকতে পারবে? একবারে ‘না’ বলতে পারবে? তারাও কি তাকে এমনিতেই ছেড়ে দেবে? ভালো ছাত্রের তকমা লেগে যাওয়ার কিছু সুবিধা যেমন আছে, তেমনি মারাত্মক কিছু সমস্যাও রয়েছে। সে তেমন একটা অসুবিধার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

গল্প- ঋণ

গল্প- ঋণ


ঋণ
ফাহমিদা বারী

আওয়াজ টা ভেসে আসছে এদিক থেকেই। একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ। গগনবিদারী চিৎকার। মাসুম শিশুর বুকফাটা আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস।
ময়লা কুড়ানোর পলিথিনটাকে মুখের কাছে গিঁট দিয়ে পেটিকোটের ফিতার সাথে শক্ত করে বেঁধে নিয়েছে করিমন। এভাবে বাঁধলে হাঁটতে সুবিধা হয়। এবড়োথেবড়ো পথটাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র নুড়ি, ভাঙা শামুকের খোল...বাবলার কাঁটাযুক্ত ঝাড়। পা কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে করিমন নেসার। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে সে হেঁটে চলেছে শব্দ লক্ষ্য করে। তার বুকের মধ্যে যেন ঢাক পেটাতে শুরু করেছে সেই শিশুর কান্না।
পড়ে থাকা একটা বড় গাছের ডাল সরাতেই চোখে পড়লো একটা লাশ। ছিন্নভিন্ন। মাথার খুলি থেকে বেরিয়ে এসেছে বেশ কিছুটা মগজ। চোখ সরিয়ে নিলো করিমন। আরেকটু দূরে পড়ে রয়েছে আরো গোটা পাঁচ ছয়েক এমনি ছিন্নভিন্ন লাশ। বোঝা যায় বেশ কয়েকদিনের পুরনো। লাশের গায়ে পচন ধরেছে, গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। সারাদেশই এখন এমন হাজার হাজার লাশের ভাগাড়। কত লাশ সরাবে মানুষ!
শিশুটির কান্না এখনো থামেনি। তবে এখন কাঁদছে কিছুটা বিরতিতে, থেমে থেমে। করিমন নেসা হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিলো। সামনে একটা ভাঙা পোড়ো ইটের ঘর দেখা যাচ্ছে। কান্নাটা ভেসে আসছে ওদিকটা থেকেই।
দিনের এই ঝকঝকে আলোতেও ঘরের ভেতরটাতে আলো আঁধারির খেলা। সেই আবছা আলোতেও করিমন দেখতে পেল মেঝেতে পড়ে রয়েছে ফুটফুটে একটা শিশু। শরীরে সদ্য পৃথিবীতে আসার চিহ্ন এখনো পরিষ্কার। দেখে বুঝলো শিশুটি মেয়ে। করিমন তার শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে শিশুটিকে ঢেকে নিলো। করিমনের দু’বছরের সন্তান এখনো বুকের দুধ খায়। বুকে তাই দুধ জমা আছে। শিশুটিকে বুকের কাছে তুলে নিলো সে। তৃষ্ণাকাতর শিশুটি প্রবল বেগে খুঁজে নিলো দুধের উৎস। চোঁ চোঁ করে টানতে লাগলো।
এদিক সেদিকে তাকিয়ে শিশুটির মাকে খুঁজতে লাগলো করিমন। বেশিক্ষণ লাগলো না খুঁজে পেতে। ঘরের এককোণায় রক্তমাখা ছিন্নভিন্ন শরীরে পড়ে আছে একটা শরীর। বুকের কাছে বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত বিভৎসতা। সন্তান জন্মদানের চিহ্নস্বরূপ পরনের শাড়িটি রক্তে মাখামাখি। চোখ দুটো খোলা, প্রাণহীন।
শিশুটিকে বুঝি বুক খুলে স্তন্যপান করাতে চেয়েছিল। হারামজাদারা তাই বুকজোড়াকেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। শিশুটিকে রেখে গেছে দয়া দেখিয়ে নয়, নিষ্ঠুর পরিহাস করতে।
করিমন এগিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দিল নারীটির চোখের পাতা। আঁতিপাতি করে দেখতে লাগলো তার রক্ত জবজবে শরীরটা। তারপরে কিছু একটা খুঁজে পেয়ে খুশি হয়ে উঠলো সে। রেখে দিল নিজের আঁচলে গিঁট দিয়ে।
তারপরে বাচ্চাটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে এদিক সেদিকে আরেকবার দেখে নিয়ে ফিরে এলো নিজের ডেরায়। তার সন্তানটি তখন ক্ষুধায় কাতর হয়ে মাটিতে শুয়ে কাঁদছে।
করিমন শিশুটিকে শুইয়ে দিল নিজের সন্তানের পাশে। যতœমাখা হাতে পরিষ্কার করে দিতে লাগলো তার শরীরের রক্ত আর পিচ্ছিল আঠালো পদার্থ।
তার বাচ্চাটি তখন কান্না ভুলে বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে এই নতুন আগন্তুকের দিকে। করিমন স্বচ্ছ হাসিতে চারদিক আলোকিত করে বললো,
‘তোর বুইন। হ্যার নাম দিলাম আন্না।’ তারপরে ছড়া কাটতে লাগলো সুর করে,
‘এন্না পাতা ভেন্না পাতা...চিরল চিরল গা...ভেন্না পাতায় বসত করে ছোট্ট সোনার ছা...
চল্লিশ বছর পরে
এ্যানা ক্লান্তিহীন পায়ে হেঁটে চলেছে। মাঝে মাঝে থেমে যে একটু পানি খেয়ে নেবে সেই সময়টুকুও যেন তার নেই। প্রতিটি মুহুর্তকেই সে কাজে লাগাচ্ছে। আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সে খুঁজে চলেছে একটি নাম। আর সেই নামের পেছনে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষকে।
দশ বছরের সুলতান মহা বিরক্ত হয়ে তাকে অনুসরণ করছে। শুরুতে সে যতোটা আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল, তার সেই উত্তেজনা ফুরিয়ে যেতে সময় লাগেনি। মনে করেছিল, মেম সাহেব দুদিন খুঁজবে। খুঁজে পাবে না জানা কথা। আর তারপরই খোঁজখুঁজিতে ক্ষ্যান্ত দিয়ে ফিরে যাবে। মাঝখান থেকে সে নিজে কিছু মোটা অঙ্কের টাকা কামিয়ে নিতে পারবে। কারণ, সফল না হলেও তো আর টাকা না দিয়ে যাবে না! এইসব বিদেশী লোকজন খুব ভালো হয়। এরা সহজে ঠকায় না।
কিন্তু তার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে বেশি সময় লাগেনি। এই মেমসাহেব নিজেও পাগল, তাকেও এই ক’দিনে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে। যেখান থেকে যে তথ্য পাচ্ছে, তার পিছনেই ছুটে চলেছে। সুলতানকে রেখেছে পথঘাট চিনিয়ে দেবার জন্য। সুলতান মাঝে মাঝে তাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়েও ক্ষ্যান্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইনি যেন পণ করে এসেছেন, দেখা না করে ফিরবেন না।
এ্যানা এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তার গার্ডিয়ান মিসেস সুজানা ক্লিভস তার মৃত্যু শয্যায় তাকে একটা আংটি আর একটা ঠিকানা ধরিয়ে দেয়। কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,
‘আমি এর কাছ থেকেই তোমাকে এনেছিলাম। আমি তাকে সামান্য কিছু অর্থ দিয়েছিলাম। সে তা রাখতে চাইছিল না। কিন্তু তার স্বামী টাকাটা রেখে দেয়। সে ছিল একজন অতি দরিদ্র মহিলা। ময়লা আবর্জনা ঘাঁটতো আর সেখান থেকে বিক্রি করার মতো কিছু পেলে সংগ্রহ করে দোকানে বিক্রি করতো। সে এই ঠিকানাতে থাকতো। আমি জানি না, এখনো সে সেখানে আছে কী না। সে আমাকে তোমার সম্পর্কে সামান্যই বলেছিল। তুমি যার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলে সে তোমার জন্মের পরেই মারা যায়। তুমি জন্মেছিলে সে দেশের যুদ্ধের সময়। আর এই আংটিটা তোমার মা’র কাছে ছিল। সেই মহিলা তার স্বামীর কাছ থেকে এটাকে লুকিয়ে রেখেছিল। তুমি বড় হলে তোমাকে দেবে এই আশায়, তোমার মৃতা মায়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।’
সুজানা ক্লিভসের কাছ থেকে আংটি আর ঠিকানাটা নেয় এ্যানা। সেখানে বাংলাদেশ নামের একটি দেশের ঠিকানা লেখা। ঠিকানাটি ইংরেজীতেই লেখা। তাই সে বুঝতে পারে।
এ্যানা সুজানাকেই তার মা’র মতো মনে করেছে। তিনি ছিলেন সন্তানহীনা। এ্যানাকে বড় করেছেন নিজের সন্তানের মতোই। কিন্তু তার কাছে তিনি সত্য গোপন করেননি কখনো, যেটা চাইলেই করতে পারতেন। বিবেকের একটা কোনো টানে তিনি এ্যানাকে জানিয়েছিলেন, তিনি এ্যানার প্রকৃত মা নন। তার মা বাংলাদেশ নামের একটা ছোট্ট দেশের মানুষ। সেই দেশের জন্মলগ্নে এ্যানার জন্ম হয়েছে।
এ্যানা সুপ্রতিষ্ঠিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় ল’ফার্মের সে একজন নামকরা লইয়্যার। তার স্বামীও একজন লইয়্যার। ওদের ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে। এ্যানার স্বামী মার্কিন। তার কাছে এ্যানার প্রকৃত পরিচয় গোপন ছিল না। তিনি সব জেনেশুনেই এ্যানাকে তার জীবন সঙ্গী বানিয়েছিলেন।
এ্যানা তার স্বামীকে জানায়, সে বাংলাদেশ যেতে চায়। হয়তো তার মা’র পরিচয় সে বের করতে পারবে না, কিন্তু যে মানুষটি তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে তাকে সে একবার দেখতে চায়। তার হাত ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে চায়। এ্যানার স্বামী সংবেদনশীল মানুষ। তিনি না করেননি।
বাংলাদেশে নেমে এ্যানা প্রথম যে সমস্যাটি বোধ করে তা হচ্ছে ভাষা। সে মোটেও বাংলা জানে না। তবে এ্যানা বুদ্ধিমতী। সে জানে কীভাবে অপরিচিত দেশে অজানা ভাষায় টিকে থাকতে হয়। সে প্রথমেই যোগাযোগ করে আমেরিকান এ্যাম্বেসীর সাথে। তারা তাকে ভালো কিছু গাইড সাজেস্ট করে। এ্যানা দুদিনেই বুঝতে পারে এদের কাউকে দিয়েই তার আসল কাজ হবে না। সে যা চাচ্ছে তা তো মোটেও সহজ কিছু নয়। কোনো গাইডই তাকে ঢাকা শহরের অলি গলি বস্তি এত সময় নিয়ে দেখাবে না। তারা ব্যস্ত। এত সময় তাদের কারোরই নেই। তখন সে এদের একজনের কাছেই এই সুলতানের সন্ধান পায়।
সুলতান খুব চালু ছেলে। ইয়েস নো ভেরি গুড টাইপের অল্প বিস্তর ইংরেজিও জানে। এ্যানা’র মনে হয় তার কাজের জন্য এই ছেলেই উপযুক্ত।
যেটুকু তথ্য এ্যানা’র কাছে আছে তা যৎসামান্য। একটা বস্তির ঠিকানা আর সেই মহিলাটির নাম। এ্যানা সেই ঠিকানাতে প্রথমেই হাজিরা দিয়েছে। সেখানে এখন সুউচ্চ ভবন। এ্যাপার্টমেণ্ট। সেই এ্যাপার্টমেন্টও নাকি তৈরি হয়েছে দশ বছর আগে। এ্যানা এ্যাপার্টমেণ্টের বিল্ডার্স কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করে। তারা এ্যানার কথা শুনে হাঁ হয়ে বসে থাকে। একজন ভুলভাল ইংরেজীতে বলে,
‘ম্যাডাম, সম্ভাবনা খুবই কম আপনি যাকে খুঁজছেন তাকে আদৌ খুঁজে পাবেন। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের কথা। সেই মহিলা বেঁচে আছে কী মরে গেছে কে জানে! আপনার গার্ডিয়ান কাদের মাধ্যমে বাচ্চাটির সন্ধান পেয়েছিলেন তাদের খোঁজ জানা গেলে ভালো হতো।’
ভালো প্রস্তাব। এটা বেশ মনে ধরে এ্যানার। একটা চ্যারিটি মিশনারীর মাধ্যমে এ্যানার গার্ডিয়ান সুজানা ক্লিভস এ্যানার সন্ধান পেয়েছিলেন। এটার নাম তিনি এ্যানাকে আগেই বলেছিলেন। এ্যানা তাদের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু তারাও খুব বেশি কিছু উপকার করতে পারেন না। সব শুনে বলেন,
তখন যিনি এই চ্যারিটি মিশনারীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি মারা গেছেন। তারা যুদ্ধের সময়ে ও পরে জন্ম নেওয়া বেশ কিছু শিশুকে সন্তানহীন এবং দত্তক নিতে ইচ্ছুক দম্পতিদের কাছে দত্তক দিয়েছিলেন। এ্যানা হয়তো তাদেরই একজন।
কিন্তু এ্যানার জিজ্ঞাস্য ভিন্ন। তাকে যে মহিলাটি এখানে নিয়ে এসেছিলেন তার কোনো সন্ধান তাদের জানা আছে কী না। তারা একটা বড় রেজিস্ট্রার খাতা খুলে বসেন। আশাহত হতে হয়। সেখানে ১৯৭৪ এর পরে থেকে তথ্য সংগ্রহ করা আছে। এ্যানা প্রচণ্ড নিরাশ গলায় জানতে চাইলো,
‘এর আগের কোনো রেজিস্ট্রার নেই?’
এ্যানার ব্যাকুলতার কারণেই হয়তো তারা আরো খুঁজে দেখতে সম্মতি জানান। এ্যানা অপেক্ষা করতে থাকে। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। একসময় তাকে জানানো হয়, খুঁজতে একটু সময় লাগছে। পুরনো কাগজপত্র অনেক নীচে চাপা পড়ে আছে। এ্যানা একদিন পরে যোগাযোগ করলে তাদের জন্য সুবিধা হয়।
এ্যানা তিন সপ্তাহের ছুটিতে এসেছে। ইতিমধ্যেই একসপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। আর আছে মোটে দুই সপ্তাহ। এর মধ্যে সন্ধান না পাওয়া গেলে এ্যানাকে হয়তো ব্যর্থ হয়েই ফিরে যেতে হবে। সে তাদের কাছে অনুরোধ জানায় একটু দ্রুততার সাথে খুঁজে দেখার জন্য।
মাঝের এই একদিনেও বসে থাকে না এ্যানা। যুদ্ধশিশু বা যুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের তৎকালীন সমাজকল্যাণ বিভাগের মাধ্যমে বাইরে বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসেবে পাঠানো হতো যা বর্তমানে ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর’ নামে পরিচিত। বেশ কিছু তথ্য সে পায় এ্যাম্বেসীর মাধ্যমে। সেখানে গিয়েও খোঁজ নেয় এ্যানা। করিমন নেসার কোনো সন্ধান তারা দিতে পারেন না। যেসব শিশুকে মিশনারীজ অফ চ্যারিটির মাধ্যমে দত্তকায়ন করা হয়েছে তাদের কোনো তথ্য সেখানে নেই।
পরদিন এ্যানা আবার ফিরে আসে সেই চ্যারিটি মিশনারীতে। তারা এ্যনাকে এবার পুরোপুরি হতাশ করে না। করিমন নেসা নামক একজন মহিলা একটি শিশুকে একবার তাদের কাছে নিয়ে আসে। সেটা যুদ্ধের প্রায় দুই বছর পরে। তার নাম এবং ঠিকানা তাদের কাছে নথিবদ্ধ আছে। একটা অতি পুরাতন ফাইলে।
এ্যানা সেই ফাইলটি খুলে দেখে। হুবহু এই ঠিকানাটিই তার হাতেও ধরা রয়েছে। তবে একটা নতুন জিনিস খুঁজে পায় সে। প্রায় হলদে হয়ে আসা একটা সাদাকালো ছবি। সেখানে একজন মহিলার কোলে একটা ছোট্ট শিশু। দেড় দু’বছর বয়স। মহিলাটির পাশে একজন লোক। সম্ভবত তার স্বামী। ছবিটির উপরে তারিখ দেওয়া। শুধু সালটা বোঝা যাচ্ছে, ১৯৭৩।
এ্যানা তাদের কাছে অনুরোধ জানায়, এই ছবিটি তাকে দেওয়ার জন্য। প্রথমে মৃদু আপত্তি করলেও একসময় তারা ছবিটি এ্যানাকে দিতে রাজী হন।
চ্যারিটি মিশনারী থেকে বেরিয়ে এ্যানা কিছুটা আশান্বিত হয়। অন্ততঃ তার কাছে এখন একটা ছবি আছে। যদিও দীর্ঘ পুরনো সেই ছবির মানুষকে এখন আর বাস্তবে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, তবু আশা ছাড়তে রাজী নয় এ্যানা। এই আশাটুকুই তো তাকে নিয়ে এসেছে এত দূরে...এত বছর পরে।
আরো আগে আসতে পারতো এ্যানা। কিন্তু সুজানার মৃত্যুর পরেই সে যেন প্রথম উপলব্ধি করে জীবনের তাৎপর্য। বেঁচে থাকার মর্মার্থ। আর এই বেঁচে থাকাটা সম্ভব হয়েছে যে মানুষটির কারণে, তার ঋণের ভার সে যেন আর বইতে পারছিল না। তার হাত ছুঁয়ে একবার সে শুধু তার প্রাণভরা কৃতজ্ঞতা জানাতে চায়।
এ্যানা সুলতানকে ছবিটা দেখায়। কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না তার। না হওয়ারই কথা। এই জনবহুল শহরে এমন হাজার হাজার করিমন নেসার বাস। তাদের বহু অতীতের কোন ছবি দেখে বর্তমানের কোনো কিশোরের মনে কোনো রেখাপাত হওয়ার কথা নয়।
সুলতানের ধৈর্য শেষ। তার বোঝা হয়ে গেছে যে সে এক মহা গাট্টায় পড়েছে। তার স্টকের সেরা ইংরেজী বের করে সে এ্যানাকে বলে,
‘নাইস মিট। নাউ আই গো। মাই মানি।’
এ্যানা সুলতানের মনোভাব মুহুর্তেই বুঝে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে,
‘নো নো প্লিজ স্টে। অকে আই উইল গিভ ইয়্যু মোর মানি...’
বলে সুলতানের হাতে ধরিয়ে দেয় কয়েকটি পাঁচশো টাকার নোট। সুলতানের চোখ চকচক করে ওঠে। মন ভরে ওঠে খুশিতে। নিজের মনকে সান্তনা দেয়, হোক একটু ত্যাড়া। মানুষ ভাল আছে। সুলতান থেকে যায়। আবার খোঁজ শুরু হয় এই বস্তি থেকে ঐ বস্তি।
দেখতে দেখতে চলে যায় আরেকটা সপ্তাহ। শেষ সপ্তাহের আজ দ্বিতীয় দিন। এ্যানা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, তাকে হয়তো ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হবে। তাকে এক মহা ঋণের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে একজন মানুষ এই পৃথিবীর বুকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। যার কাছে সে আজীবনের ঋণী। তার মা তাকে জন্ম দিয়েছে, এই মানুষটি তাকে দিয়েছে জীবন।
ধীরে ধীরে সুলতানও জানতে পেরেছে, এই মেমসাহেব এই দেশেই জন্মেছেন। যুদ্ধের সময়ে। তাকে যে বাঁচিয়েছিল, সেই মানুষের খোঁজেই তিনি এখানে এসেছেন। সেই মানুষটার নামও তিনি ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারছেন না। ক্রেমন্নিসা...এই নাম শুনে বস্তির কোনো মানুষ তার সন্ধান দিতে পারছে না।
মনে মনে কেমন একটু কষ্ট লাগে মেম সাহেবের জন্য। আহারে! মা নাই...বাপ নাই...কারা বাপ-মা তাও জানা নাই! তার তো তবু বাপ-মা আছে। রাতে কাজ শেষে ঘরে ফিরে গেলে মায়ের স্নেহের আঁচলটুকু আছে। তার টাকা নাই এই মেমসাহেবের মতো, তবু মা বলে ডাক দেবার মানুষটা তো আছে!
একদিন খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে ভরদুপুরবেলা বস্তির পাশের পথের ধারেই বসে পড়ে এ্যানা। টিপটপ আধুনিক পোশাক পরিহিতা এক মহিলাকে এভাবে পথের ধারে নোংরা পরিবেশে বসে থাকতে দেখে লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে।
এক রিক্সাওয়ালা কাছে এসে হর্ণ বাজাতে থাকে। সুলতান হাঁক ছাড়ে,
‘যাইবো না। ফুটেন।’
রিক্সাওয়ালা তবু ফুটে না। সুলতানের কাছেই জানতে চায়,
‘ঐ কী হইছে?’
‘হেইডা দিয়া আপনের কী?’
‘ঐ ক কইলাম। দিমু নাইলে এক থাবড়া...’
সুলতান তবু চুপ করে থাকে। রিক্সাওয়ালা ক্রিং ক্রিং করতে করতে চলে যায় একসময়।
এ্যানা অশ্রুসজল চোখে তার ব্যাগে হাত দিয়ে মোটা বাণ্ডিলটার অস্তিত্ত খুঁজে পায়। আগামীকাল সকালে তার ফ্লাইট। চলে যেতে হবে তাকে। তার নতুন দেশ, যা তাকে পরিচয় দিয়েছে সেখানে তাকে ফিরতে হবে। কিছু টাকা এনেছিল করিমন নেসার জন্য। কে জানে কেমন অবস্থায় আছে এখন! হয়তো কিছু কাজে লাগতো! এটা তার ঋণের কিছুমাত্রও লাঘব করতে পারবে না এ্যানা জানে...তবু তার মন কিছুটা শান্তি পেত।
অল্প কিছুক্ষণ ভাবে এ্যানা। তারপরে টাকার মোটা বাণ্ডিলটা প্যাকেটসহ তুলে দেয় সুলতানের হাতে। সুলতান বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এ্যানা তার চুলে হাত বুলিয়ে আদর করে। তারপর সুলতানের মতো করে বলে,
‘গো স্কুল। রিড... ওকে? আই গো মাই হোম...’
সুলতান তাকিয়ে থাকে এ্যানার চলে যাওয়া পথের দিকে। বাড়িতে ফিরে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে,
‘মা...দাদী...বাপজান...’
সুলতানের চিৎকারে ছুটে আসে সবাই। ওদের পরিবারটি অনেক ঠিকানা পাল্টে গতমাসেই এই ঝুপড়িতে এসে উঠেছে। এখনো কেউ ওদের তেমন একটা চেনে না। সুলতান প্যাকেট খুলে টাকাগুলো মেলে ধরে প্রত্যেকের হাঁ হয়ে থাকা মুখের সামনে। সবিস্তারে খুলে বলে তার টাকা প্রাপ্তির গল্প আর সেই মেমের ক্রেমন্নিসা কে খুঁজে বেড়ানোর ইতিহাস।
সুলতানের দাদী করিমন নেসা ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে আসে সামনে। টাকাগুলো হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে। নাতির গল্প শুনে তার ছানি পড়া চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু।
হোটেলে বসে এ্যানা তখন তার ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। হলদে হয়ে আসা করিমন নেসার ছবিটাকে সে পরম যতেœ তুলে রাখে ব্যাগের বুক পকেটে।
যেন ওর নিজেরই বুকের গহীনে...গভীর মমতায়।

কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে অনির্ণীত গদ্য

কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে অনির্ণীত গদ্য

কাইয়ুম চৌধুরীকে নিয়ে অনির্ণীত গদ্য
অলাত এহ্সান

‘জাতির জীবনের শিল্পশিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন জয়নুল আবেদিন। শিল্পশিক্ষার অভাবে আমাদের রুচি গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি দেশপ্রেম। যে শিক্ষা উৎসের দিকে মুখ ফেরাতে সাহায্য করে, যে শিক্ষা মাতৃভূমিকে ভালোবাসতে শেখায়, যে শিক্ষা মেরুদণ্ড সোজা করে পৃথিবীর পানে তাকাতে শেখায়, সেই শিক্ষার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পেরে আমি সত্যি গর্বিত।’
আজকের দিনে মুদ্রণশিল্পের প্রসার কিংবা গণমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধির কল্যাণেই হোক, চারুকলা বাণিজ্য যখন বৈশ্বিক রূপ ধারণ করেছে, মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে লেখা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ওই কথাটুকুর মতো কতজন শিল্পী ভেবেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশেও চারুকলার বিপুল উল্ফনের পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য।
ঢাকায় এখন চলছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে পাঁচ দিনব্যাপী ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। গত বছর ঠিক এই সময়ে, এই উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানে বক্তৃতারত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। গতকাল বেঙ্গলের ধ্রুপদী মিউজিক্যাল উৎসবে বসে আমার বারবারই মনে হয়েছে, আগত দর্শককে জিজ্ঞেস করি, তাদের এই সংগীত শুনতে শুনতে কাইয়ুম চৌধুরীর কথা মনে পড়ছে কি না? আমরা এতটাই বিস্মৃতিপ্রবণ, অনেক ক্ষেত্রে অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্নও বৈকি যে এই গুণী মানুষকে ভুলে যাওয়া বিচিত্র কিছু মনে হয় না।
এ বছরের ৯ মার্চ, যখন প্রথম কাইয়ুম চৌধুরী মৃত্যুর পরবর্তী জন্মদিন উপলক্ষে দৈনিকের সাময়িকীর আয়োজনে তাকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন বা লেখাগুলো হলো, তখন আমার মনে হয়েছে, তার অধিকাংশই স্মৃতির চাদরে ঢাকা। এটা হতেই পরে, ৮২ বছর বয়সে একজন গুণী মানুষের প্রয়াণ হলে, চারপাশে তার স্মৃতি গুঞ্জরন তৈরি হবেই। অনেক সময় এই ধরনের লেখায় কাইয়ুম চৌধুরীর আলোয় নিজেকে আলোকিত করার চেষ্টা, কিংবা সময়ের রেখায় তার পায়ের ছাপ খোঁজার দোষে দুষ্ট। কিন্তু আমার মনে হয়, অনেক আরো গুণী মানুষের মতোই, এই দীর্ঘ জীবনে তাকে ঘিরে যতটা ঘ্যাঙর নৃত্য হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে আবার তাকে ঘরানা বা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণও হয়েছে, বাস্তবিক অর্থে তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন হয়নি। আমার এই লেখা সেই শুষ্ক নদীতে স্রোত বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো নয়ই, এত স্বল্প পরিসরে ও সাধ্যে আমার তা সম্ভবও নয়, কিন্তু সূচনা সূত্র খোঁজা মাত্র।
ফ্রান্সপ্রবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, কিংবা তাকে নিয়ে লেখা থেকে জানতে পারি, বিশ্বে আলোচিত শিল্পীদের মধ্যে তিনি বিশেষভাবে সম্মানীয় এ কারণে যে, তিনিই সম্ভবত একমাত্র শিল্পী যিনি দেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং শিল্পকলাও সফল হয়েছে। বিষয়টা দারুণভাবে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। প্রসঙ্গত মনে করা যায়, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় গঠিত চারু ও কারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি তুলে এনেছেন ক্যানভাসে, মুক্তিযুদ্ধের ধারা করেছেন সম্প্রসারিত। মাথায় গামছা বেঁধে গেরিলা যোদ্ধাদের বলিষ্ঠ এগিয়ে যাওয়া তার মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকৃতি। আবার তার আঁকা কৃষকের দৃশ্যের সঙ্গেও এর মিল পাওয়া যাবে। আসলে এর একটা গূঢ় দিক হলো, আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ যতটা দলীয়করণ হয়েছে, সেই অর্থে সাধারণ মানুষের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের কথা হারিয়ে গেছে। কাইয়ুম চৌধুরীর ছবিতে অন্তত তার বলিষ্ঠ স্বীকৃতি সব সময়ই দেখা যায়। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং তার চিত্রকর্ম মূল্যায়নের জন্য তাকে কি আমরা বৈশ্বিকভাবে উপস্থাপনে যথাযথ সচেষ্ট হয়েছি?
এখানে প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, ’৫২-র সেই উত্তাল দিনগুলোতে তার সহপাঠী আমিনুল ইসলাম,  মুর্তজা বশীরসহ অনেকেই ছিলেন প্রতিবাদী আয়োজনের নিরলস কর্মী এবং সকল মিছিলের পুরোভাগে। স্বভাবে অন্তর্মুখী হলেও কাইয়ুম চৌধুরীও সম্পৃক্ত ছিলেন তাতে। ষাটের গণ-অভ্যুত্থানে মুখরিত সংগ্রামের শক্তিতে তার চিত্রকলা হয়ে উঠেছে বাঙ্ময়। কোনো প্রতিরোধই তাকে অবরুদ্ধ করেনি। যেখানে যে প্রয়োজনটুকু আবশ্যক, তা করতে এতটুকু পিছপা হননি। যে কারণে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে শিল্পী-সাহিত্যিকরা যখন নিজেদের বিভিন্ন দলভুক্ত করে বিভিন্ন সুবিধা নিতে উৎসাহী হয়েছেন, সেখানেও তিনি নিজেকে বাইরে রেখেছেন। সে কারণে হয়তো, আমার কাছে মনে হয়, আমরা কাইয়ুম চৌধুরীকে বিশ্বে তুলে ধরিনি। আবার এ কথা ভাবাও নিশ্চয়ই অবাস্তব হবে না যে, যে অর্থে তার চিত্রকর্মকে আমাদের দেশে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা অনেক সময় জাতীয়তাবাদী ও স্থূল। ফলে চিত্রকলার আবিষ্কৃত নতুন নতুন ফর্ম ও ধারণা নিয়ে তার যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছিল তা অনেক সময় হয়ে ওঠেনি। যে কারণে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান নিজের অনগ্রসরতার ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই কাইয়ুম চোধুরীকে বাংলাদেশের শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিনিধি করার চেয়ে, জাতীয়তাবাদের ঘানিই বেশি বহন করিয়েছে।
বাংলাদেশে চিত্রকলা এবং সাহিত্যে একই সঙ্গে যে দুজন দারুণ সক্রিয়, তারা হলেন মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরী।  ব্যাপারটা ঠিক বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বে এর উদাহরণ বেশি নেই। মুর্তজা বশীরের ছোটগল্প ও প্রবন্ধগুলোর সাহিত্য মান এবং  প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দুই-ই আছে। আর কাইয়ুম চৌধুরীর কবিতাগুলো, একটা বিশেষ ধরন তো বটেই, সাহিত্যেরও মার্গ বহন করে। দৈনিকের পাতায় প্রচলিত কবিতার উন্মাদনার চেয়ে অনেক বেশি সেগুলো সমৃদ্ধ। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই দুজনকে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার বাইরে দাঁড়িয়ে যথার্থ মূল্যায়ন জরুরি। প্রচ্ছদশিল্পে দুজনের অবদান অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরীর উৎকর্ষ সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তুল্য ও স্বতন্ত্র।
আর্ট ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করেন কাইয়ুম চৌধুরী। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসানকে। তার চিত্রকালায় এই দুই মহান শিল্পীর প্রভাব সুস্পষ্ট। ১৯৫৭ সালে তিনি নিজেও ঢাকা গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে প্রফেসর হিসেবে অবসর গ্রহণের পরও ২০০২ সাল পর্যন্ত চারুকলা ইনস্টিটিউটে পাঠদান কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি শিল্পচর্চায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন (১৯৬১-৬২)। ওই বছর লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিল্পকলা প্রদর্শনীতে ‘বটম’ শীর্ষক চিত্রকলার জন্য প্রথম পুরস্কার পান। তিনি আরো সম্মানিত হন এর চার বছর পরে পঞ্চম তেহরান বিয়েনালে রাজকীয় দরবার পুরস্কার লাভ করে (১৯৬৬)। স্বীকৃতি অর্জনের এই ধারায় তিনি লাভ করেন শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৭), একুশে পদক (১৯৮৬), ২০১০ সালে সুফিয়া কামাল পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা। ২০১৪ সালে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদকে ভূষিত হয়েছেন।

আমার খুব বিস্ময় লাগে, কাইয়ুম চৌধুরী ও কামরুল হাসান সম্পর্ক। শুধু শিল্পকর্ম নয়, ব্যক্তিজীবনেও কাইয়ুম চৌধুরীর ওপর পটুয়ার প্রভাব অনস্বীকার্য। মনে করা যেতে পারে, কামরুল হাসান কিশোর সংগঠন মুকুল ফৌজ-এর কর্মী ছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি এর প্রধান হন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি চারু ও কারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। কাইয়ুম চৌধুরীও মুকুল ফৌজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন শৈশবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চারু ও কারুশিল্পীদের সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তত দিনে এ দুজন সহকর্মী ও সুহৃদ হয়ে উঠেছেন। যে কারণে আমরা দেখি স্বাধীনতার পরে কামরুল হাসান যখন বাংলাদেশের বুটিকস শিল্পের দায়িত্ব নেন, তার আহ্বানে কাইয়ুম চৌধুরী কিছুদিনের জন্য যোগ দিয়েছিলেন সেখানে। আশির দশকের আগে ও পরে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারিপনার বিরুদ্ধে দুজনেই সক্রিয় ছিলেন। কি বিস্ময়কর! কামরুল হাসান মারা গেলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়ে। কাইয়ুম চৌধুরীও মারা গেলেন সংগীত উৎসবে বক্তৃতা দেওয়ার সময়। দুজনের মৃত্যুর মিল কাকতালীয় হলেও বন্ধুত্ব ও সংগ্রামের মিল ছিল একই মূল থেকে উৎসরিত। সেই মিল দর্শনের।
কামরুল হাসান বরাবরই কমিউনিজনের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। সরাসরি পার্টির কর্মী ছিলেন। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়া কাইয়ুম চৌধুরীও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্রজীবন থেকে। তার চিত্রে লোকশিল্প তুলে আনার প্রেরণা এই কামরুল হাসান। তার হাতেই কালো রং দাপুটে শিল্পে ঘুরে বেড়ায় ক্যানভাসে। সেই কালোও চারপাশের ঔজ্জ্বল্য আরো বাড়িয়ে দেয়। এও ঠিক, দর্শনগত দৃঢ়তা না থাকলে কাইয়ুম চৌধুরীর মতো দৃঢ়ভাবে কেউ এ দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আগলে রাখতে পারেন না।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আজকের দিনে আমাদের দেশে শিল্পী নিজেও যেমন, তাকে নিয়ে লেখালেখি ও মূল্যায়নেও তেমন, তার চিন্তা-দর্শন একপ্রকার নেই করে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়। যা শুধু লেখাই নয়, ওই ব্যক্তি সম্পর্কের বোধের জায়গাটাও ধোঁয়াশাপূর্ণ হয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, কাইয়ুম চৌধুরীকে বুঝতে গেলে, মূল্যায়ন করতে গেলে আমাদের তার দর্শনও বুঝতে হবে।  কিন্তু এ ধরনের মূল্যায়ন আমাদের দেশে খুব বেশি নেই।


অণুগল্প- নিঃশব্দ

অণুগল্প- নিঃশব্দ



নিঃশব্দ
তাসনিম মিসমা
জানালার শিক দু’হাতে শক্ত করে ধরে স্নেহা বিছানায় বসে আছে। রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। দু চোখে ঘুম নেই তার। প্রায়শই এমন হয় তার সাথে। ঘুম আসেনা।বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে এক দু ফোঁটা তার মুখে এসে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতি বারবার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মেয়েটিকে অঢেল চিন্তার জগৎ থেকে ফিরে আসার আহবান করছে।
কিন্তু স্নেহা তাতে বিন্দুমাত্র সায় জানাতে নারাজ। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তার কাঁধে হাত রাখলো । অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠতো কিন্তু স্নেহা অতি মৃদু কন্ঠে বলল, ‘আমি ঠিক আছি মা। তুমি গিয়ে শুয়ে পরো। কাল আবার রবির স্কুল আছে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।’ মা স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,‘কাল শুক্রবার । স্কুল নেই ওর...। তুই রাতে কিছুতো খেলি না। আমি খাওইয়ে দি..?’ ‘ নাহ, থাক আমার খিদে নেই। দেখলেতো বাহিরের দুনিয়ার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ’ই নেই...কবে কোন দিন যায় তাও জানি না। বড় বেমানান হয়ে গিয়েছি দুনিয়ার সাথে। তোমাকেও অনেক কষ্ট দিই আমি। আর সহ্য হয় না। অই দিন মরে গেলেই ভালো হতো; তাইনা, মা..?’ এই বলে সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো যেন অনেক দিন পর পাহাড়ের বুক চিরে অঝোরে পানি বইতে লাগল। মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনে মাও কাঁদতে শুরু করলো আর বলল, ‘কে বলেছে তুই বেমানান, আমাকে কষ্ট দিস, তুই আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে সুন্দর উপহার। তুই না হলে আমি আর তোর ভাই আজ বেঁচে থাকতাম না। দু’বছর আগে যদি তুই আর তোর বাবা নিজের জীবনের বাজি না রেখে বাস এক্সিডেন্টের সময় বাঁচাতি আমাদের তাহলে আজ হয়ত আমরা সবাই তোর বাবার মতোই অকালে মারা যেতাম। তোরা দুই ভাই-বোন আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। খবরদার আর কখনো এমন বাজে কথা বলবি না।’ এতোক্ষণে স্নেহার কান্না থেমে গিয়েছে । পনেরো ষোলো বছরের এই স্বল্প জীবনে যেন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি কিছু দেখে ফেলেছে সে। যখনই সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে হয় কিছুটা পিছুটান অনুভূত হয় তার। মন থেকে একটা আওয়াজ আসে যে, তার অনেক কাজ বাকি। এভাবে হাল ছাড়লে চলবে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায়, যে মেয়ের একটা পাই নেই সে আর কতোটুকুই বা সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করতে পাড়বে। বাস এক্সিডেন্টের সময় প্রাণে বেঁচে গেলেও সে, মা-বাবা আর রবি আহত হয়েছিল। তার বাম পা প্রচুর আঘাত পেয়েছিল ফলে পরে তার পা টা কেঁটে ফেলতে হয়েছিল। তার সাথে প্রিয় বাবাকেও ডাক্তাররা বাঁচাতে পারেনি।  সে দিনের কথা স্নেহার মনে পড়লেই সারা শরীর শিউরে উঠে। লাগে যেন দেহটা শক্ত হয়ে আসছে।আর সহ্য করা সম্ভব নয়। তবুও হার মানা চলবে না।বাবা তাকে কখনো হার মানতে শেখায়নি। যেখানে আশার বিন্দুমাত্র আভাস পাবে সে ছুঁটে যাবে; তাকে যেতেই হবে।
দু’বছর ধরে নিজেকে সে ঘরে বন্দি করে রেখেছে। মার দিকে তাকিয়ে স্নেহা বলল,
‘আমাদের সাথেই কেন এমন হলো মা? আমাদেরতো কতো সুখী ছোট্ট পরিবার ছিল। কি অপরাধ ছিল আমাদের? কেনোই বা সৃষ্টিকর্তা এতো বড় শাস্তি দিলো? বলো না, মা?’ মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, ‘সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।তিনি আমাদের সহনশীলতার পরীক্ষা নিচ্ছেন। নিশ্চয়ই আগামীতে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। হতাশ না হয়ে তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এই বলে স্নেহার মা চোখ মুছতে মুছতে অন্য রুমে চলে গেল। স্নেহা জানে যে, কিছুই আর আগের মতো ঠিক হবেনা। সে তার বিছানার বালিশের নিচ  থেকে ডায়রীটা বের করে লিখতে বসে পড়লো সারা দিনের সব কথা।ডায়রীটাই যেন এখন ওর সবচেয়ে আপন; যা স্নেহার প্রতিটা অনুভূতি,রাগ-দুঃখ নিঃশব্দে, নির্দ্বিধায় বিনা কোনো প্রতিবাদে নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখে।