রাষ্ট্র যা চায় ...
রাষ্ট্র যা চায়...
সাদিকুর রহমান
রাষ্ট্র কি কিংবা তার পরিচয় কি এসবের আলোচনায় না গিয়ে বরং সে কি চায় তার আলোচনাই এখানে মুখ্য। আমরা যাকে বাংলায় রাষ্ট্র বলি ইংরেজিতে তাকে স্টেট বলে। আর এই স্টেট শব্দটির উৎস হলো ল্যাটিন শব্দ স্ট্যাটাস বা অবস্থা। অর্থাৎ আজকে আমাদের দেশের যে অবস্থা, তাই হলো এই স্টেট। আর এই স্টেটের শাসক যেই হোক না কেন, তারা যা চায় তার মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই। বরং তারা ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে বা দলে বিভক্ত হয়ে একই স্বার্থ হাসিলের জন্য একই পদে আরোহন করতে চায়। আর ওই পদটিই হলো মূলত আমাদের রাষ্ট্র। তিনি সর্বদা ভীতি ছড়াতে ও শক্তিমান কিন্তু তার বিপরীত তাকে কর্দমাক্ত করে নুইয়ে দিতে চান। তিনি চান, গোলাপের সৌরভ কেবল তারই হোক। সেই সৌরভ গোলাপ ছড়ালেও আমরা যে ঘ্রাণ পাচ্ছি, তা কেবল তার বদান্যতা ও কৃপায়। তিনি চাইলে এই গোলাপের গাছকে শিখরসহ উপড়ে ফেলতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ তিনি দয়ালু, কৃপাময় ও পরোপকারী এবং বড় মনের উদার মানুষ। আমরা যে সৌরভ পাচ্ছি এজন্য তার গুণগান গাওয়ার পাশাপাশি স্বয়ং গোলাপেরই উচিত তার জন্য অধিক কাল বেঁচে থাকার প্রার্থনা করা। এই রাষ্ট্র এমন গোলাপের চারা বর্তমানে রোপণ করছে, যেখান থেকে কোন সৌরভ চড়াবার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং এই গোলাপের পেছনে অর্থ ব্যয় কোন ইনভেস্ট নয় বরং ওয়েস্ট (অপচয়)। আর এমন অপচয় রাষ্ট্র বারবার করতে প্রস্তুত। কারণ যে তাকে কাপুনি ধরিয়ে দিতে পারে কিংবা তার নড়বড়ে ভিক্তিকে সমূলে উৎপাটিত করে দিতে পারে এমন বৃক্ষের চাষাবাদ তিনি কেন করবেন? না তার কখনো এমন বৃক্ষের চাষাবাদ কিংবা রোপন করা উচিত নয়! বরং এই ধরায় বৃক্ষ যদি তার সত্তাকে ভুলে গিয়ে অন্যের মতো হয়ে বাঁচতে চাওয়ার আবেদন কে মেনে নেয়, তবেই তার চাষাবাদ উর্বর হবে। আর তাইতো এখন সব দেশেই চলছে এমন যুবকের উর্বর চাষাবাদ। যে সকালের রোদকে ঘরে প্রবেশ করতে না দিয়ে বরং কপাটকে শক্ত করে আটকে দিয়ে কম্বল মুড়িয়ে উষ্ণতা খুঁজে। অথচ তার চেয়ে আরো আরামের উষ্ণতা এই সুন্দর প্রাকৃতিক রৌদ্রময়ী সকাল তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। সে স্বাগতম পছন্দ করবে কেন? সে পছন্দ করবে কোন উর্বশী তরুণীর তাড়না। যে তাকে দুঃখ বা যন্ত্রণা দিলেও সে এই জ্বালাকে সাদরে গ্রহণ করে নিবে। যে চাওয়া তাকে বেদনা দেয়; সে এমন চাওয়া বারবার চাইবে তাতে আপত্তি নেই বরং আপত্তি যে তাকে স্বাগতম জানাবে তাকে গ্রহণ না করার। সে উর্বশী কোন তরুণীকে না পাওয়ার বেদনায় আক্ষেপ করতে প্রস্তুত, কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে কিংবা বৃহৎ উদ্দেশ্য সাধনে ঘর থেকে বের হতে রাজি নয়। বরং আমি না গেলেও চলবে; অন্য আরো অনেকে তো আছে। তারা এসে করে ফেলবে, এমন মানসিকতায় ভরপুর আজ এই দেশ। বৃহদাকার যৌবন ধারণ করা এই তরুণ যুদ্ধে যাওয়ার সকল সম্ভাবনাকে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, এখন পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে, সামান্য কায়িক শ্রম করতেও দিতে রাজি নন আমাদের পিতামাতারা। ফলে আমরা উৎপন্ন হয়েছি শোপিচ বৃক্ষে। যে দেখতে সুন্দর, পরিপুষ্ট ও নড়বড়ে। আর রাষ্ট্র সর্বদা রোপণ করে দেখতে সুন্দর, পরিপুষ্ট ও ক্ষয়িষ্ণু এমন বৃক্ষের। যে ভয় পাবে ঝড়কে এবং ঝড়ের সময় সে যেন প্রয়োজনে রাবারের মত হেলে পরতে ও নিজেকে বাঁচাতে পারে এমন কৌশল তাকে শিখিয়ে দিবে। সে এমন বৃক্ষের চাষাবাদ কিংবা রোপন করে না, যে ঝড়ের সময় সিনা টান করে দাঁড়িয়ে ঝড়কে হুংকার দিয়ে উঠতে পারে! রাষ্ট্র এখন যে তরুণের রোপণ ও চাষাবাদ করছে তাকে দিয়ে বিপ্লবের ফুল আর ফুটবে না বরং প্রেম নামক স্থুল অনুভূতি তসরুফ করে দিয়েছে যুবকের সব!
নলিনীর দ্বিতীয় চিঠি
নলিনীর দ্বিতীয় চিঠি
আসহাবে কাহাফ
সকাল সাতটা বেজে উনিশ মিনিট, আমি তখনো পূজোর ঘরে শঙ্খধ্বনি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে, বাইরে থেকে কে যেন কলিং বেলটা বার বার বাজিয়ে যাচ্ছিল। তড়িঘড়ি করে পূজো শেষ করে দরজা খুলতেই দেখি ডাকহরকরা। অনেক বছর পর এই বাড়িতে আবার ডাকহরকরা এসেছে। আমার এখনো খুব ভালো করে মনে আছে; এই সেই ডাকহরকরা যিনি ২১ বছর আগে শেষবার এসেছিল। তখন তিনি মধ্যবয়সী যুবক আর আমি একেবারে তরুণ। এখন আমি হলেম মধ্যবয়সী আর তিনি বৃদ্ধ। আজ আবার নতুন করে বুঝে নিলাম, বয়স অনেক বেড়েছে, কালের অতলে হারিয়ে ফেলছি নিজের সোনালি যৌবন। তাহলে আমি কি তারুণ্য হারিয়ে ফেলেছি? ঠিক এই মুহুর্ত্বে সেটা নিশ্চিত করে বলা কিংবা কারও কাছে প্রমাণের ইচ্ছে শক্তিটুকুন আমার নেই। বৃদ্ধ মশাই দাড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবেন? কারও ডাক এসেছে? উত্তরে বাবু মশাই বলল; হরিনাথ বাবুকে? গতকাল, কলিকাতা হতে তাহার নামে একখানা ডাক এসেছে। ডাকের উপর আর্জেন্ট লিখা ছিল তাই দ্রুত নিয়ে এলাম।
বৃদ্ধ ডাকহরকরা মশাই হয়তো মনে করতে পারছেন না, ঠিক ২১ বছর আগেও তিনি আমাকে এই রকম আর্জেন্ট লিখা একটা চিঠি দিয়ে গিয়েছিল; আর সেটাই ছিল এই বাড়িতে তার শেষ চিঠি। বয়স হলে যা হয়, আমি কিন্তু ঠিকই তাকে চিনতে পেরেছি। আফসোস, এই সময় এই স্মৃতি একদিন আমারও বিলুপ্তি হবে। একদিন আমাকে দেখেও কেউ একজন স্বগতোক্তি করবে! গোপনে স্মৃতি হাতড়াবে! তিনি যথারীতি চিঠি হাতে তুলে দিয়ে প্রাপ্তিস্বীকারপত্রে সাক্ষর আদায় করে বিদায় নিলেন। আমার গৃহদ্বারে পড়ে রইললাম শুধু চিঠি সমেত আমি ও আমার পুরোনো স্মৃতির একঝাক না বলা প্রশ্ন। ভাবছি চিঠিটা খুলেই ফেলি; পড়ে দেখি ভিতরে কী লিখেছেন! কিন্তু পূজোর ঘরের কথা ভেবে রেখে দিলাম। চিঠিটা কার তা এই মুহুর্ত্বে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়; চিঠির উপর নাম লিখেছেন রাম দত্ত। পাশে ব্র্যাকেটে লিখেছেন কেউ একজনের পক্ষে। বেশ মনে ধরেছে কথাটা। এর আগেও অনেকে আমাকে এই ধরনের চিঠি লিখেছেন, তখন আমি এফএ ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। মাঝে মাঝে পত্রিকায় লিখতাম বলে, কেউ কেউ চিঠি লিখিত আর খামের উপর বিভিন্ন রসিকতাপূর্ণ শব্দ লিখত। নলিনীর বিয়ের পর লেখা-লেখিও ছেড়ে দিলাম; চিঠি আসাও বন্ধ হয়ে গেল। চিঠিটা রেখে সোজা চলে গেলাম পূজোর ঘরে।
সব কাজকর্ম গুছিয়ে বেলা এগোরোটার দিকে চিঠিটা হাতে নিলাম। খুলে দেখার আগে প্রায় বার দশেক চেষ্টা করলাম রাম দত্ত বাবুকে চেনার, কিন্তু কিছুতেই আন্দাজ করতে না পেরে অবশেষে চিঠিটা বের করলাম। চিঠির হাতের লিখা ও ভাষা বেশ পরিচিত, তবে কে লিখেছে সেটা মনে করতে একেবারে সময় লাগে নি যে তা নয়, কেননা, চিঠির ভাষা কখনই একজন পুরুষের ছিলো না, ফলে শেষ পর্যন্ত পড়তেই হল। মাঝখানে বেশ কিছুক্ষণ আমাকে থামতে হয়েছে; ফিরে যেতে হয়েছে ছাত্র জীবনের শেষ অংশে। চোখের সামনেই ভেসে উঠেছে একুশ বছর আগের লিখা নলিনীর সেই প্রথম চিঠি; যেখানে নলিনী লিখেছেন-
তাং- ১ লা জুলাই ১৯৯৫ইং
প্রিয় নাথ,
প্রারম্ভে ভক্তি নাথের চরণে; অতপর আমার প্রাণ নাথের কদমে। প্রাণ নাথ, আজি বড়ো ব্যথা বক্ষে লইয়ে তোমাকে পত্র লিখিতে বসিলাম। পাশাপাশি থাকি বলিয়া কোনদিন আমাদিগের চিঠি লিখিয়া মনের কথা বলিতে হয়নি। আজিই প্রথম ; হয়তো আজিই শেষ! প্রাণের শৈশবসঙ্গী বলিয়া যাহারা তোমার আমার সম্পর্ক চাপিয়ে যাইতেছে তাহাদের কি বলিয়া অভিশাপ দিব তাহা আমার জানা নেই। তবে কি বলিয়া এই মুহুর্ত্বে তোমার আমার বিচ্ছেদ টানিয়া লইব সেই চেষ্টা করিতেছি। প্রাণ নাথ, গত দুই তিন রাত্রিকাল যাবত, আমি কিছুতেই নিদ্রা যাপন করিতে পারছি না। যখন দেখি পরিবারের সবাই কলিকাতার ভদ্রপতির সহিত আমার বিবাহের কথা বলাবলি করিতেছে। আমরা একত্রে বড় হইয়াছি, খেলাধুলা করিয়াছি তাহা সকলে দেখিয়াছে ঠিকই কিন্তু আমাদিগের মনের মিলন কেহ দেখিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে না। আমরা একে অপরকে কতটা নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছি তাহা কেহ বিশ্বাস করিবে না, কেহ যদিও বিশ্বাস করিবে বলিয়া মনে হইয়াও থাকে তবে এই কথা সত্য যে, এমতাবস্থায় আমি অথবা তুমি কাহারও সম্মুখে, সম্পর্কের কথা তুলিয়া ধরিবার মত যোগ্যতা অর্জন করিনি। এখনো আমি আর তুমি সবেমাত্র এফএ ক্লাসে পড়িতেছি। এই অবস্থায় যেকোনো পিতা-মাতা আমাকে তাহার পুত্রবধু করিয়া লইতে আপত্তি না করিলেও এফএ ক্লাসের একজন ছাত্রের সহিত মেয়ের বিবাহ দিতে আমার মাতা-পিতা ঠিকই আপত্তি জানাইবেন। তোমাকে শুধুমাত্র এফএ ক্লাসের ছাত্র ও বেকার বলিতে আমার কেনো জানি সংকোচবোধ হইতেছে, তুমিতো ইতোমধ্যে লেখা-লেখি শুরু করিয়াছ, পত্র-পত্রিকায়ও তোমার কিছু কিছু লিখা ছাপাইতেছে। তারপরও তুমি তাহাদিগের কাছে কর্মহীন, কেনন, এই সমাজে নগদ অর্থ ব্যাতিত কারও প্রতিভার মর্ম বুঝিতে পারিবে এমন মনমানসিকতা সবার তৈরী হয়নি। প্রাণ নাথ, তাই আমি অনেক ভাবিয়া দেখিলাম কলিতার ভদ্রপিতকে বিবাহ করিয়া লওয়াই উত্তম হইবে। আরেকটি কথা বলিয়া লই, আমি হয়তো কথাগুলি খুব সহজেই বলিয়া লইতেছি দেখিয়া তুমি অবাক হইবে! আমাকে লইয়া নানা খাটো কথা মনে মনে উচ্চারণ করিয়া থাকিবে। তারপরও হে প্রাণনাথ, এই কথায় সত্য যে; আমি তোমার সহিত যা করিয়াছি তার পুরোটাই ছিলো আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ওখানে বিন্দুমাত্র ত্রুটি কিংবা ছলনা ছিলো না। প্রাণনাথ, আজি এই কথাগুলো তোমাকে বলিতে পারিলেও নিজের ভিতরে যে কারবালর রক্তক্ষরণ বহিয়াছে তাহা আমি দেখাইয়া বুঝাইতে পারিব না। আগুনে সব কিছু জ্বলিয়া যাইবার পরে আগুনের যে স্তুপ হয় সেখানেও আগুনের একটা দহন থাকে; যা কেহ দেখিতে পারে না। সেই একইরকম আগুনের তীব্রতা আজি আমার বুকে। প্রাণনাথ, আমি হয়তো মরিতে পারিলেই বাঁচিয়া যাইতাম ; কিন্তু আরও অনন্তকাল তোমার ভালোবাসার বিরহে প্রজ্জ্বলিত হওয়ার স্বাদ গ্রহণের জন্য বাঁচিবার ইচ্ছে জাগে। হয়তো পৃথিবীর কোনো একজায়গায় বসিয়া নিরবে তোমার স্মৃতি মন্থন করিয়া দুফোটা চোখের জল ফেলিয়া আরও শত বছর বাঁচিয়া থাকিব। প্রাণনাথ, আমাকে এই চিঠির প্রতিত্তোর করিবে না। এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌছাবে তখন আমি অন্যের ঘরণী। আমার জন্য দুঃখ না করিয়া, তোমার জীবনকে জীবনের পথে বয়তে দিও। বাঁচিয়া থাকিলে কোনো দিন তোমার সম্মুখে আসিব না, আবার জীবন থাকিতে তোমাকে এক মুহুর্ত্বের জন্যও ভুলিয়া যাইব না। প্রাণনাথ, বিদায় জেনো।
ইতি
নলিনী ব্যানার্জী।
আমি অবশ্যই তখন এক প্রকারে বাকশক্তিহীন হয়ে পড়েছিলাম। নলিনীও বিয়ে করে কলিকাতা চলে গেলো। সেই যে গেলো আর কেউ কারও সাথে কখনো যোগাযোগ করিনি। আজ ২১ বছর পরে এসে, আবার নলিনী আমার চোখে জল এনেছে! মনের আকাশে কালো মেঘ, সেই মেঘ হতে বৃষ্টিপাত! অতপর ভালোবাসার গন্ধ মেখে আখি জলে স্নান। এটা নলিনীর দ্বিতীয় চিঠি; প্রায় তিন তিনটা রাত জেগে সে আমাকে লিখেছে-
তাং-১২/০৭/১৭ ইং
প্রিয় নাথ,
প্রারম্ভে প্রণাম রইল। হয়তো কিছুটা বেগ পাইতে হইবে এই চিঠির কারণ বিষয় প্রেরক ইত্যাদি খুঁজিয়া পাইতে। তবে নিশ্চয় জানিবে, এই চিঠি নারী জাতির কোনো একজন লিখিয়াছে; যে কিনা যৌবনকালে আপনাকে ভালোবাসিয়াছিল। শুনিয়াছিলাম আপনি বিবাহ করেননি। সেটাই উত্তম করিয়াছেন। আমি বিবাহ করিয়াও সেই আপনার ভালোবাসাটা ভুলিতে পারি নাই। ইতোমধ্যে আপনার প্রকাশিত বেশকিছু বই আমি পড়িয়াছি। আমার সাহেবও আপনার লিখার দারুণ ভক্ত। সেই হিসেবে আপনার বই পড়া। প্রায় তিন রাত জাগিয়া আপনাকে এই পত্র লিখিতেছি, একবার লিখে ভুল হয় ভাবিয়া আবার লিখি। আমার স্বামী আড়াল হইতে দেখে আর হাসে। সে আপনার আমার বিষয়ে সব জানিয়াছে; হয়তো আমি মরিবার পরে সে এই চিঠিটা তোমার কাছে পৌছাইয়া দিবে। আমি মরিলে আপনাদের বাড়ির সম্মুখের পুকুরে, আমাকে মনে করিয়া একখানা লাল গোলাপ ছুড়িয়া মারিবেন। আজি ২১ বছর পরে আসিয়া এই চিঠি লিখিবার পিছনে একটিই কারণ রহিয়াছে, যাহার জন্য আপনি মনে মনে আকুল হইয়া উঠিয়াছেন! আমার বড্ড জানিতে ইচ্ছে করে- আপনি বিবাহ করেননি কেন? আমাকে ভালোবেসে নাকি অভিমানে? উত্তর করিতে হইবে না। কেবল আপনার নিজের কাছে উত্তর করিলে হইবে। কেননা, এই চিঠি যখনি আপনার হাতে পৌছাইবে, তখন আমি গত হইব। প্রাণ নাথ, ভালো থাকিবেন।
ইতি
নলিনী রাম দত্ত
কলিকাতা, ভারত।
পাঠান্তে, ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। এবার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম, এই একাকী জীবনের কারণটা কি নলিনীর ভালোবাসা নাকি চাপা অভিমান? কোনো প্রতিত্তোর নেই হৃদয়ের গভীরে। কেবল চোখে বেয়ে নিচে নেমে এলো কয়েকফোঁটা জল।
পদাবলি
ডুবুরী হওয়ার গল্প
আশরাফ চঞ্চল
কতটা গভীরে গেলে ছুঁয়া যায় জল
মাপা যায় গভীরতা
নদীর অতল?
সাঁতার জানো না তাতে ভয় কী
সাহস রেখে নেমে পড়ো
হাত নাড়াও
পা নাড়াও
একদিন সব শিখে যাবে।
বেশিক্ষণ দম থাকেনা?
তবে শোনো-
প্রমথেই ডুব দিওনা
ওপরে ওপরে ঘুরো
হাত চালাও
ঠোঁট চালাও
ঢেউয়ে ঢেউয়ে সব জল ঘুলিয়ে দাও
শৃঙারে শৃঙারে ডুব দিয়ে ওর পতন ঘটাও
পারো যদি নিয়মিত দুধ কলা খাও
মাঝে মধ্যে ডিম
কালোজিরা
মধু
কস্তুরী
হেকিমি শা¯্রে এগুলো নাকি শক্তি বাড়ায়!
একটি কাজ একইভাবে বারবার করোনা
প্রতিবার কাজে নতুনত্ব আনো
শুধু দক্ষিণে কেনো
উত্তরেও যাও
পূর্বে
পশ্চিমে গেলে
কেঁপে কেঁপে উঠবে সমস্ত জল
নদীতে জোয়ার আসবে
স্রোত বইবে।
এভাবেই তুমি একদিন দক্ষ সাঁতারো হবে
অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই
ডুবুরী হয়ে ছুঁয়ে আসবে নদীর পাতাল
বউ বলবে, তুমিই শ্রেষ্ঠ পুরুষ
ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট!
ঘুমের মৃত্যু
জয়িতা চট্টোপাধ্যায়
একটা শব্দে মৃত্যু হল সমস্ত ঘুমের
যে শব্দ ছিল হত্যার
বুকের উঠোনে, দিগন্ত রেখায়
কালো রং ছড়িয়ে যাচ্ছে
কে যেন ভালোবাসা পুড়িয়ে দিল আগুনে
সুরঙ্গে লুকোনো ছিল পুরোনো বারুদ
নিমেষেই চিতাভস্ম ছড়িয়ে গেলো
শীতের প্রবাহিত খরগ, ছিন্নভিন্ন মেঘ
ইতিহাস হারা সমস্ত গল্প,
গুহার ছবির মতো ভেঙে গেল
মুখের চেনা ধ্রুবতারা
কালশিটে পড়া শীত কালের অবসান হল।
এতো সহজে ভোলা যায় না
জহিরুল হক বিদ্যুৎ
এতো সহজেই কী ভুলে থাকা যায়?
মৌন রাতের অবগুণ্ঠন সরিয়ে
যে চোখের পাতায় নেমে এলো কবিতা
জলের গানে স্নিগ্ধ প্রভাত হলো লীন
চায়ের কাপে মায়া ছড়ালো যে ওষ্ঠের চুম্বন
ঠুনকো অভিমানে কী ভুলে থাকা যায়?
হয়তো আবেগের ছলে বেহিসাবি ভুলে
মনখারাপ নিয়ে শুধুই ভুলপথে ছুটে চলা-
মায়ার শেকড় ছড়িয়ে আছে গভীরে,
বিস্তৃত প্রান্তর, রয়ে যায় জন্ম-জন্মান্তর
যেখানে মায়া নেই
সেখানে ভালোবাসাহীন ধূধূ মরুভূমি।
মায়ার কাটা বিঁধেছে যে বুকে
সে বুক তুমিহীনা মরে ধুঁকে ধুঁকে।
এক পলক দেখে যাওয়া
আদনান আল মিসবাহ
সেদিন
আলাপনের শুভ্রতা প্রদীপের মতো ছিল না
সিঁড়ির শেষবিন্দুতে উপনীত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে
কোলাহলের বিরক্তিকর শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছে
নাতিদীর্ঘ পথ পেরিয়ে তোমার
এক পলক দেখে যাওয়া
বাঁ দিকের গলি থেকে উদ্ভাসিত
প্রেয়সীর মুখ
চোখাচোখি হওয়ার মত বাহারি দৃশ্য ছিল না
নদীর মতো নিরবধি বয়ে যাওয়া বিস্ময়ের মাথা
কুঠারাঘাতের নির্মমতায় থমকে দিয়েছে
ভ্রুকুঞ্চিত শ্রীমান মুখাবয়বে তোমার
এক পলক দেখে যাওয়া
সময়ের পরিসীমা
বাঁধন ছিন্ন করার মতো তীব্র বেগবান ছিল না
অসংখ্য প্লেটের ঝনঝনানি
কোনরূপ পূর্ব সংকেত ছাড়া আচমকা মরে গেছে
এমনকি-
মিনিট সেকেন্ডের অমোঘতাকে হত্যা করতে পারে
কৌতুহলী মননের মৃদু তাড়নায় তোমার
এক পলক দেখে যাওয়া
ক্ষনিকের ম্রীয়মান কথকতা
খুব বেশি রসালো আবেগপূর্ণ ছিল না
বাক্য শেষ হওয়ার আগেই প্রশ্ন চিহ্ন
শরীরের লোমগুলো দ-ায়মান
যেনো ডিসেম্বরের কুচকাওয়াজ
আতঙ্ক, ত্রাস, হুমকির মতো ভয়াবহতা ছড়িয়েছে
ঈর্ষান্বিত রক্তচক্ষু নিয়ে তোমার
এক পলক দেখে যাওয়া
শিক্ষিত নপুংসকের কবলে
রেজা কারিম
কিছু শিক্ষিত নপুংসককে আমার চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখি
খুব রাগ হয় আমার
বুকের ভেতরটা রাগে গজগজ করতে থাকে।
আমার ধারণা এরা এমন ছিল না
এদের পুরুষত্ব ছিল
কিন্তু কিছু দায়িত্বের কারণে
কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে
এরা আজ পুরুষত্বহীন।
কী ভাবছেন?
এরা কি আসলেই ফিজিক্যালি অক্ষম?
না, মোটেই তা নয়।
এরা নামে পুরুষ কামে পুরুষ
ঘামে পুরুষ পামে পুরুষ
আক্ষরিক নয় ভাবার্থে ভাবুন
প্রত্যক্ষ নয় পরোক্ষভাবে দেখুন
খুঁজে পাবেন আমার কবিতার সত্যতা।
এদের হৃদয় নেই
বিবেক ঘুমন্ত কিংবা মৃত
বাইরে চাকচিক্যময়
ভেতরে শূন্য, মহাশূন্য
মাকড়শার জালের মতো এরা আমায় আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে রেখেছে
একদিন আমিও এদের মতো নপুংসক হব
আমার কাপুরুষোচিত আচরণ তারই ধ্রুব বহিপ্রকাশ।
তবু হৃদয়ের কোথায় যেন এদের জন্য আমার সীমাহীন ঘৃণা রয়েছে
আসলে আমরা অনেক কিছুই মেনে নেই
কিন্তু মনে নেই না।
অদৃষ্ট মঞ্চ
রহিত ঘোষাল
এখন খুব নিরিবিলি চারিদিক,
এখন সূর্যের তেজ কমে এসেছে,
ভেড়ার পাল বাড়ি ফিরছে,
গাঁয়ের মুরুব্বিদের ভিড় সাঁঝেরবেলা
চায়ের দোকানে, ওরা বলাবলি করে,
দেশে কি মানুষ আছে গো!
মানুষ নেই, সব এক একটা জানোয়ার!
আরো কত সাতপাঁচ কথা,
এইসব দশা ছেড়ে উঠে আসি
আমাদের জৈব পাঁজরে সংকট
নিকটতম অক্ষমতা জন্ম দেয় উগ্রপ্রকৃতির
দিগন্তপ্লাবী আমাদের এই জৈবনিক দ্বন্দ্ব
ত্রসরেণু হয়ে ইহজন্মের সকালে পরিণত হয়।
তিতাসের মেয়ে
নাঈমুর রহমান
তিতাসের মেয়ে মিস দেবনাথ,
তোমার শরীরে এখনো বয় তিতাসের জলের ঘ্রাণ?
পৌঁছায় কি তোমার কানে আজও
ভরা যৌবন তিতাসের আহ্বান?
অথচ তিতাস এখন ছোট, ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।
আর বেড়ে গেছো তুমি, তোমার ঘাড়ে পরা চুল থেকে
এখন আর ঝরেনা টুপটুপ তিতাসের জল
সে চুল ছুঁয়েছে এখন নিতম্ব।
তিতাস পাড়ের কাদা-বালি মাখা পা দুটো
করছে পদচারণ শহর রংপুর, জেনিস সু তে।
তিতাসের কিনারায় এসে আজও জড়ো হয় বকের ঝাঁক
আছে কিছু মাঝি-মাল্লার চিৎকার।
কিন্তু কেউ আর তোমার মতো দেখেনি
বলেনি কেউ করছো কি, তিতাস যে ছোট হয়ে হয়ে যাবে।
হয়ত তখন ছোট ছিলে, খুব ছোট
যখন বলেছো তিতাস আমার বাড়ি, তিতাস মা।
তুমি ছেড়েছো তবে তিতাসের পাড়, ভুলেছো তার স্বর
তিতাস তোমায় রেখেছে মনে তার প্রতি আর্তনাদে।
তিতাসের মেয়ে মিস দেবনাথ,
তুমি ফিরবে কি তিতাসের কোলে একবার?
নব প্রবাদ
মোহাম্মদ আবদুর রহমান
হাসনা তোমার হৃদয়ের কিউ আর কোড নিয়মিত স্ক্যান করতে থাকি
রক্তের ও গ্রুপ হয়ে নিংড়ে দিতে থাকি অসীম প্রেম
চেক করে দ্যাখো তোমার হৃদয়ের অ্যাকাউন্ড।
বন্ধন সৃষ্টির সময় ফেবিকুইক দিয়ে জুড়ে দিয়েছিলাম দুটি অন্তঃকরণ
আমি পৃথিবীর মত ঘুরতে থাকি হৃদে জেগে থাকা জ্যোতিষ্কের চারিদিকে।
জোনাকি হলেও অন্ধকার হতে দিইনি জীবনের পাঠশালা
প্রাণদ্বয় মিশে তৈরি হয়েছে একটি নব যৌগিক পদার্থ
গগন বক্ষে উড়বে নব প্রবাদ
মৃত্যু প্রহর
এম সোলায়মান জয়
কিছু মানুষ বা কিছু শহরের মরে যাওয়া উচিত
পুনরায় বেঁচে থাকবে কিংবা অন্ধকারে আসক্ত হবার জন্য
অনুভূতি নিঃস্ব হয়ে গেলে কুয়াশাচ্ছন্ন হয় রাজার প্রাসাদ
কোথায় যাচ্ছো? এমন প্রশ্ন করার অধিকার হারিয়ে যায়
যখন তুমি চলে যাও সাথে করে নিয়ে যাও নিজের আলো
ছায়া চলে গেলে আলোর প্রয়োজন থাকে না শরীরের
মায়া মরে গেলে কোন অন্তরের প্রয়োজন থাকে না
বন্যার শেষে ভেলার মতো যেন সবকিছু অযথা হয়ে যায়
পরাজিত রাজার মতো সময় তখন মৃত্যুর প্রহর গুনে।
তোমার হোক
আব্দুল্লাহ আল আম্মার
[উৎসর্গ : আমার বড় খালা]
এই পুষ্প বৃক্ষের ফাঁক গলে আসা রূপোলি চাঁদের কিরণে,
সান্ত¡না খুঁজে পাইনি
অজস্র নিহারের এ সজীবতার মাঝে আমার চির পরায়ণ,
তবু সান্ত¡না খুঁজে পাইনি
দুঃসাধ্যকে মেনে নেয়ার পৃথিবীতে কভু অবগাহনের তুষানলে পুড়ে ছাই
মায়াবদ্ধ হৃদয়েরও সীমাবদ্ধতা আছে টের পেয়ে অস্তিত্ব হারাই,
নিঠুর বাস্তবতাকে মানতে না পারা দুফোঁটা অশ্রুর স্রোতে
ব্যর্থ মন রথে তবুও রয়ে যাওয়া
দূর থেকে বহুদূর
স্বপ্ন বয়ে আনা অজস্র নিহারের মাঝে এই সুখটুকু
আমার না হোক,
তোমার হোক
এই ঘুমন্ত শহরের নিঝুম রাত্রির জেগে থাকা শোভান্বিত তারাগুলোর শোভাটুকুও
তোমার হোক
সুবাসিত এই পুষ্পবাটিকার নিষ্পাপ পাপড়িগুলো,
তোমার পরে উৎসর্গিত হোক
সুবাসটুকু তোমার হোক
তোমার হোক।
শুভ্র মেঘের মানুষ
গাজী তৌহিদ
কখনো কখনো হাতের মুঠ খুলে-
সবকিছু ছেড়ে দিতে হয়,
যে যাওয়া সে তো যাবেই।
শরতের শুভ্র মেঘের মতো,
গভীর সমুদ্রে আশা জাগানিয়া জাহাজের মতো,
টুপ করে ডুবে যাক,
নিমিষে মিলিয়ে যাক,
খোঁজ নেওয়ার দরকার নেই;
বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে আপন মানুষ ডেকে আনা যায় না।
দাঁতে দাঁত চেপে ভুলে থাকা শিখতে হয়,
গ্রানাইট পাথরের মতো,
কিউ কার্বন পদার্থের মতো,
হৃদয়টা শক্ত করে মানতে হয়-
হাতের মুঠ খুললে স্বাধীন হওয়া মানুষ,
অজুহাতে শরৎ শুভ্র মেঘে মিলিয়ে যাওয়া মানুষ,
কখনো আপন মানুষ হয় না।
পানির অভাবে রক্ত খাবে
হিলারী হিটলার আভী
পানির অভাবে রক্ত খাবে
এটা একদিন কবিতার লাইন হবে!
খাদ্যের অভাবে মানুষ মানুষকে কামড়ে খাবে
এটাও একদিন কবিতার লাইন হবে!
স্বার্থের মোহে নীতির বিসর্জন দিবে
এটাও একদিন কবিতার লাইন হবে!
‘একজনও ভালো মানুষ নেই’
এটাও কেয়ামতের আগে কবিতার বাস্তব লাইন হবে!
সব যান্ত্রিক কল’ই একদিন বিকল হবে
এটা আজ থেকেই আমার কবিতার লাইন হলো!
নিঃসঙ্গ, বড় একা
আহমদ সাইফ
দিনশেষে নীড়ে ফেরা পাখি একাকিত্ব বোঝে না!
সারি সারি বৃক্ষকেও একাকিত্ব পায় না।
লক্ষ কোটি নদীর ঢেউ কখনো একা হয় না,
পাহাড়ের সীমাহীন উচ্চতা আকাশ ছুঁতে চায় ;
মরুভূমির ধূ-ধূ বালু অসীম দৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যায়!
গাঁয়ের মেঠোপথ সাপের মতো এঁকে বেঁকে হেঁটে যায়।
মাঠের আলে জন্মানো দূর্বাঘাসও দলছুট হয় না!
শুধু-
মানুষ নিঃসঙ্গ-নিরবতায়-একাকিত্বে যাপন করে শতাব্দীর পরিসংখ্যান!
দিনশেষে মানুষ ফেরারি আসামীর মতো নিঃসঙ্গ, বড় একা!
দূরত্ব
ইয়াসিন আরাফাত
বিস্তৃীর্ণ মরুভূমির বুকে
খা খা রোদ্দুরে
যাযাবর বাতাসের পাঁকে
ক্লান্ত পথিক
তৃষ্ণার্ত পথিক
ভুল করে পথ হারালে-
সে জানে
নির্মম দূরত্ব কাকে বলে!
গণতান্ত্রিক প্রেম
ফাহাদ আজিজ
আমাদের প্রেমটা হয়েছিল গণতান্ত্রিক নিয়মে;
যেখানে তুমি ছিলে একজন চতুর নেতা, আর-
আমি ছিলাম রাজনীতিতে ব-কলম, সহজ-সরল
সামান্য এক ভোটার। তুমিই তো স্বপ্ন দেখিয়েছিলে না?
কিন্তু আমিতো বুঝি নি;
গণতন্ত্রের সবকিছুই মিথ্যা।
এখানে আশ্বাসকে বিশ্বাসে পরিনত করার কোনো নীতি নেই।
তবে এখন বুঝি;
গণতন্ত্র কেবল স্বপ্নই দেখাতে পারে
স্বপ্ন পূরণের সাধ্য গণতন্ত্রের নেই।
এক টুকরো ভগ্ন দর্পণ
এক টুকরো ভগ্ন দর্পণ
সুশান্ত কুমার দে
অনেক দিন আগের কথা আজও মনের ভেতর প্রতিধ্বনিত অনু কম্পিত ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়ের গভীরে মোচড় দিয়ে ওঠে। আজও গাঁয়ের সেই ফেলে আসা দিন গুলোর কথা মাটির দেয়ালের ঘর গোলপাতার ছাউনী, নারা পল গুঁজে চালের মটকা মেরে ঘরটিতে থাকতে হতো।
অভাব অনটনের সংসার, তবুও সুখের ঘাটতি দেখা যায়নি।
ঘরের আসবাবপত্র আলমারি, আলনা, টিভি , ফ্রিজের কোন হদিস ছিল না।
মাটির তৈরি মেটের মধ্যে নতুন কাপড় চোপড় রাখতে হতো।
ঘরের খোলা বারান্দায় একটা মাদুর পেতে ঘুমাতে হতো। তীব্র গরমের সময় একটা তালপাতার পাখা ছিল গরম নিবারণের একমাত্র অবলম্বন।
তবে এখনকার মতো তখনকার দিনে গরমটা বুঝি অনেক কম ছিল। বাড়ির চারপাশে আম কাঁঠালের বাগ বাগিচা, খেজুর, তাল লিচু, বেল গাছের ছায়া পড়তো ঘরের চারপাশে, সবসময় শীতল হাওয়া প্রবাহিত হতো, এখন মতো বিদ্যুতের পাখা ছিল না তবুও গরমের অনুভূতি ততটা ছিল না।
এখন পৃথিবীর তাপমাত্রা কের্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, কলকারখানার ধোঁয়ায় এবং নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে বায়ু দূষণের মাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
দাদুর কথা গুলো শুনে, কণা যেন একেবারেই থ মেরে গেল।
-তুমি সত্যিই বলছো দাদু?
-তখনকার দিনে তোমরা খুব কষ্টে ছিলে তাই না দাদু?
-না না দিদি ভাই, আমরা খুবই ভালো ছিলাম।
তখনকার দিনে কত আরাম আয়েশে দিন কাটতো, খেলার সময় খেলা পড়ার সময় পড়াশোনা।
রাতের বেলা সবাই মিলে যাত্রা গান শুনতে যেতাম।
বায়োস্কোপ এ সিনেমা দেখেছি, বেদেদের সাপ বানরের নাচ দেখে কতো মজা করতাম।
-তোরা পালকি দেখেছিস?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ দাদু, বইতে পড়েছি, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পালকির গান কবিতা পড়েছি, পালকি চলে, পালকি চলে।
-হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, ঐ পালকিতে চড়েই আমার বিয়ে হয়েছিল।
-হাঁ হাঁ দাদু, আমাকে একটু পালকিতে চড়াবে ?
-দূর বোকা পালকি কি এখন আর দেখা যায়?
-এখন পালকি দেখতে যাদুঘরে যেতে হবে।
-আমাকে একদিন যাদুঘরে নিয়ে যাবে দাদু?
-হ্যাঁ অবশ্যই নিয়ে যাবো।
-আরও মন দিয়ে শোন, আগে আমরা খবর শুনতাম রেডিওতে।
তাও আবার এক সাথে অনেক লোক একত্রে বসে।
-কেন, কেন দাদু?
-রেডিওর তখন অনেক দাম ছিল, যে কেউ কিনতে পারতো না।
আর চিঠি পত্রের মাধ্যমে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে হতো।
-চিঠি পৌঁছাতে কতো দিন সময় লাগতো দাদু?
-ধর, এক সপ্তাহের বেশি।
-তখন কতো কষ্ট করতে হতো তাই না দাদু?
-হ্যাঁ, ঠিকই তো, আমরা সাত আট মাইল পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। স্কুলের পড়া না করলে মাস্টারমশাই ভীষণ জোরে মার ধোর করতেন। আর এখন তোরা দিব্যি আরামে আছিস। রাত দিন মোবাইল ফোন নিয়ে সময় নষ্ট করিস।
এখন শুনছি অনলাইনে ক্লাস করতে ইন্টারনেট ল্যাপটপ লাগবে।
হায়রে আমার কপাল, এই শেষ বয়সে এসে কতো কিছুই নতুন করে দেখছি ! এখন নাকি ডিজিটাল বাংলাদেশ। আগের দিনে আমাদের অসুখ বিসুখ হলে কোন ওষুধ পত্তর খেতে পারতাম না।
এক হোমিওপ্যাথি না হয় কবিরাজী ওষুধ খেয়ে অসুখ বিসুখ সেরে যেত। সর্দি জ্বর হাঁচি কাশি হলে মা, গাছ গাছালির ছাল বাঁকড়ের রস করে খেতে দিতো। তাতেই সব অসুখ সেরে যেত।
আবার অনেকেই ঝাড় ফুঁকে বিশ্বাসী ছিল। আগের দিনে মানুষের বিশ্বাস ঝাড় ফুঁক দিয়ে অসুখ বিসুখ সারানো যায়, আবার ভূত পেত তাড়ানো যায়।
-দাদু, তখনকার দিনেও কি ভূত ছিল?
-ভূত পেত নিয়ে আমি দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছি, দিদি ভাই? তবে আমি অনেক বার ভূতের মুখোমুখি হয়েছি। আমি ভূত বলে কখনো মানিনি, তবু ও আমাকে কয়েকবার ভূতে তাড়া করেছে।
-দাদু আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে, ভূতের গল্পটা এখন থাক?
-ও তাই নাকি, আচ্ছা ঠিক আছে আমি আর বলছি না?
-হ্যাঁ এখন যাও, স্কুলের সময় হয়ে গেল আর একদিন বাকি গল্প গুলো না হয় বলবো?
-দাদু এতকাল তোমরা ছিলে অন্ধকার জগতে, কতো কষ্টে তোমাদের দিন কেটেছে। আর এখন আমরা আলোর সন্ধানে ছুটে চলেছি।এখন আমরা কতটা সুখী বলো দাদু?
-না না কণা, তখনকার দিনে আমরা সব সময় টাটকা শাকসবজি ফলমূল খেয়েছি। কোনো খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল কিংবা কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়নি। বিনা সারে কিংবা একটু আধটু জৈব সার প্রয়োগ করে ভালো ফসল পেয়েছি। আর এখন তোরা বিষাক্ত রাসায়নিক যুক্ত ভেজাল খাদ্য খাচ্ছিস? নিত্য নতুন অজানা রোগে দিন দিন কতো মানুষ অকালেই ঝরে যাচ্ছে। এখন দূষিত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ফেসবুক, ইউটিউব ভিডিও গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠেছে , এতে করে উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েদের চোখের বারোটা বেজে যাচ্ছে। এসব কি ভালো লক্ষণ মনে করেছিস কণা? তোরা এখন এতটুকু বয়সে মোবাইল থেকে কিছুটা দূরে থাকার চেষ্টা কর।
-হ্যা দাদু, তোমার কথা আমি মনে রাখবো। আমি আর মোবাইল ফোনে গেম খেলবো না, কার্টুন দেখবো না? আমি এখন নিয়মিত পড়াশোনা করবো, খাওয়া দাওয়া করবো, খেলাধুলা করবো অযথা মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকবো।
-এই তোমার মাথা ছুঁয়ে দিব্যি কাটছি। তবে দাদু, তুমি আমাকে কিন্তু জাদুঘর দেখাবে, আমি পালকি, ঢেঁকি, বায়োস্কোপ এ সব গুলোই দেখবো। আর একদিন পোড়াবাড়ীর ভিটেতে ভূত দেখাতে নিয়ে যাবে।
দাদু বলল, ঠিক আছে দিদি ভাই, যতটা সম্ভব আমি তোমাকে সব দেখাবো।
কণা আনন্দে নাচতে লাগলো, খুব মজা হবে, খুব মজা হবে। আমি এবার স্কুলে যাই দাদু!