জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নান্দনিক উপমা ও চিত্রকল্প
রাহাত রাব্বানী
বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ মানেই নান্দনিক উপমার বিশাল এক সমাহার। রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভবের এক জগৎ ফুটে আসে। গ্রাম বাংলার প্রকৃতির যে ছবি তিনি কবিতায় এঁকেছেন, তার তুলনা তিনি নিজেই। আর এই প্রকৃতির সাথে মিশিয়েছেন অনুভব আর বোধ; যা একত্রে কবিতা অনন্য এক শিল্প হয়ে ধরা দিয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বৈশিষ্ট্য ‘চিত্ররুপময়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, জীবনবাবু সম্পর্কে প্রথম মন্তব্য করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৫ সালে ষোলো বছরের জীবনানন্দ কিছু কবিতা পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি রূঢ় হলেও এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যে জীবন বাবুর কবিতায় নতুনের ছোয়া ছিলো।
‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে।’
উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক সৃজন, রঙের ব্যবহার, অনুভব সব মিলিয়ে জীবনানন্দ তৈরি করেছেন অপ্রতিম কবিভাষা। তাঁর ব্যবহৃত উপমাগুলো প্রতিষ্ঠিত অন্য কবিদের থেকে ব্যতিক্রম। এছাড়াও নান্দনিকতাঋদ্ধ এসব উপমা জীবনানন্দ দাশের কবিতা বিশেষভাবে শনাক্ত করতে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
জীবনানন্দ দাশের অন্যতম পাঠকপ্রিয় কবিতা ‘বনলতা সেন-এ বলেছেন:
‘...পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’
পাখির নীড়ের সাথে চোখের তুলনা! কী অদ্ভুতভাবে ভেবেছেন কবি। পাখি যেমন তার নিজ বাসায় শান্তি পায়, আনন্দ পায় ঠিক তেমনি বনলতার চোখে আনন্দ, শান্তি। এই শান্তির চোখের কথাই অসাধারণ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন ‘পাখির নীড়’ উপমায়। কখনো কখনো চোখের উপমা ‘বেতের ফল’ হয়ে ধরা দিয়েছে। ‘তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে! (হায় চিল)
আবার ‘রাত্রিদিন’ কবিতায় দেখা যায় জীবনের স্বচ্ছতা বাড়াতে ‘শিশির’ উপমা হিসেবে এনেছেন। জীবনের স্বচ্ছতা শিশিরের মতো। লিখেছেন:
‘একদিন এ জীবন সত্য ছিলো শিশিরের মতো স্বচ্ছতায়।’
কখনোবা শিশিরের জল তাঁর কবিতায় ‘কাঁচের গুঁড়ি’, আবার কখনো ‘বরফের কুচি’ হয়ে দেখা দেয়। আবার স্বচ্ছতার উপমা বুঝাতে ‘নক্ষত্র’-ও এসেছে। একই শব্দের উপমায় একেক জায়গায় একেক নতুন শব্দজুড়ে দিয়েছেন কবি।
সন্ধ্যা নামার দৃশ্যে কবি এঁকেছেন পেঁচার পাখা;
‘দামামা থামায়ে ফেল- পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক
রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ!’
পেঁচার পাখা ছাড়াও কবি অন্ধকারকে আলোর রহস্যময়ী সহোদর বলেছেন ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায়। শিশিরের শব্দের মতন মনে হয়েছে কখনও-বা।
জীবনানন্দ দাশ কত সূক্ষ্মভাবেই তাঁর কবিতা কেবল উপমার প্রকাশ দিয়েই অন্যমাত্রায় নিয়েছেন। ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতাটির প্রায় অংশজুড়েই পরাবাস্তবতার ছাপ। পরাবাস্তবতা লিখতে গিয়েও জীবনানন্দ চিত্রকল্প তৈরি করেন:
ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পা-ুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্ত থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।
‘শিকার’ কবিতায় কবির চোখে ভোর আর ভোরের আকাশে তারার উপমা এসেছে নান্দনিকরূপে ভোর;
আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল:
চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।
একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে:
পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো।
তাছাড়াও সূর্যকে সাজিয়েছেন নানান ভাবে। কখনো আবার সূর্য নিজেই হচ্ছে অন্যের অলংকার। যেমন:
‘সোনার বলের মতো সূর্য’
-এখানে কবি সূর্যকে দেখছেন সোনার বলের মতন করে। আবার এই সূর্যই হচ্ছে প্রেয়সীর সুন্দর বর্ণনার সাজসরঞ্জাম, ‘সূর্যের রশ্মির মতো অগণন চুল’। রোদ-ও এসেছে এখানে শরীরের রঙ বুঝাতে রৌদ্রের বেলার মতো শরীরের রঙ।
অন্যক্ষেত্রে কবি রোদের রং বর্ণনা করেছেন, রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নদীর কথাও এসেছে বারবার
‘মধুকুপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির
কালীদহে ক্লান্ত গাংশালিখের ভিড়’
কিংবা
‘পৃথিবীতে ম্রিয়মান গোধূলি নামিলে
নদীর নরম মুখ দেখা যাবে-’
বা
‘বিকেলের নরম মুহুর্ত;
নদীর জলের ভিতর শম্বর’
কোনো কবিতায় নদীর এ ঢেউ গোলাপী বর্ণ লাভ করে। কখনোবা প্রিয়তমার সাথে গভীর মিল খুঁজে পেয়েছেন তিনি। নদী-নক্ষত্র জীবনান্দ দাশের কবিতায় প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে। প্রিয়ার অপেক্ষায় বসে কবি শোনান, ‘বসে আছি একা আজ, ওই দূর নক্ষত্রের কাছে।’ এছাড়া ফুলের বন্দনাও করেছেন জীবনানন্দ দাশ। এখানেও তিনি অন্য কবিদের থেকে আলাদা। তিনি গোলাপ, জুঁই, হাস্নাহেনায় মাতাল হননি। তিনি মাতাল হয়েছেন চালতা, ভাঁট, চাঁপা, কাঁঠালীচাপা, অপরকজিতা, মচকা, করবী, সজিনা ফুল- এ। রজনীগন্ধা তাঁর কবিতায় ব্যথিতা কারো জন্য উৎসর্গ করেন। নারকেল ফুলের সুন্দরও দেখেন তিনি।
নদী, ফুল, গুল্ম, লতা ছাড়াও জীবনানন্দ দাশ চিত্রকল্প সৃষ্টিতে লক্ষ্মীপেঁচা, চিল, ইঁদুরকেও ব্যবহার করেছেন সফলতার সাথে। তাঁর এমন নান্দনিক উপমা প্রয়োগ এবং চিত্রকল্প সাধারণ পাঠকের কাছে ধরা দেয় অসাধারণত্ব নিয়ে। আর জীবনানন্দ হয়ে ওঠেন আধুনিক মন ও মননের প্রতিভূ।