ছায়া
গ্রাফিক্স : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ছায়া
শিশির খান
আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। ইট বিছানো রাস্তা ধরে তিন চাকার পায়ে প্যাডেল করা একটি ভ্যান যাত্রী নিয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে। ভ্যানের যাত্রীরা বেশ শান্ত শুধু বুদু মিঞার কপালে বেশ চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। বেলা যে গড়িয়ে এলো, সন্ধ্যে হতে বেশি দেরি নেই। বুদু মিঞা শহরের ননী মজুমদারের গোডাউনে কাজ করে। প্রতিদিন আরও সকাল সকালই সে বাড়ি ফেরে কিন্তু আজ হঠাৎই দুপুর বেলায় চার ট্রাক মাল আসায় আনলোড করতে তার দেরি হয়ে গেলো। এখনও প্রায় নয় মাইল পথ গেলে ত্রিমোহনীর ঘাট। ঘাটে নেমে নদী পাড় হয়ে আরও পাঁচ মাইল পথ পাঁয়ে হেঁটে তার বাড়িতে যেতে হবে। বুদু মিঞা ভ্যান চালককে তারা দিয়ে বললো :
“হ্যারে নজু, একটু তাড়াতাড়ি পা চালানা ভাই! এখুনি মাগরিবের আজান পড়বে যে! সন্ধ্যে হয়ে এলো”।
নজু একটু বিরক্তির স্বরে বললো :
“পারবো নে, এর চেয়ে জোরে পারবো নে।
এতই যখন তারা ছিল, তখন বিমানে চরে গিলেই পারতি। ভ্যানে উঠিছিস কিজন্যি ? ”
পাশাপাশি গাঁয়ের মানুষরা একে অপরকে চেনে, আর সমবয়সিদের মধ্যে তুই-তুকারি চলে।
নজুর এমন কথা শুনে বুদু মিঞা চুপ করে গেল ঠিকই কিন্তু তার মনের বিচলিত অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটলো না। একটু পরেই মাগরিবের আজান পড়ে গেলো। পশ্চিম আকাশে গোধুলীর রক্তিম সূর্য অস্ত যেতেই সন্ধ্যা নামলো।
ভ্যানটি তখনও হারিকেনের আলোয় মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে। ভ্যানটি যখন ত্রিমোহনীর ঘাটে এসে পৌঁছালো, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমেছে। বুদু মিয়াকে ঘাটে নামিয়ে ভ্যানটি অন্য দুই যাত্রীকে নিয়ে নদীর পাড় ঘেষে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। জনমানব শূণ্য ঘাটে দাঁড়িয়ে বুদু মিঞা নদী পারাপারের উপায় খুঁজতে লাগলো। সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। গ্রামের নৌকাগুলো তাদের শেষ যাত্রীদের নিয়ে সন্ধ্যা নামতেই ওপারে পাড়ি দিয়েছে। নদীর এপারে অর্থাৎ বুদু মিয়া যেপারে দাঁড়িয়ে আছে সে পারে একটি ডিঙ্গি যদিও বাঁধা আছে কিন্তু তার মাঝি নেই। মাঝিকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষীণ আশায় বুদু মিয়া চারিদিকে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগলো। হঠাৎই তার চোখে পড়লো নদীর পারের ওপরে একটি বুনো ঝোঁপের আড়ালে একজন লোকের মাথা বেড়িয়ে আছে। বুদু মিয়া বুঝতে পারলো, লোকটি সেখানে বসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। টর্চের আলো পড়তেই লোকটি বিরক্তির স্বরে বলে উঠলো :
“ওই মিঞা টর্চ মারো কেন ? খারাও আসতাছি।”
লোকটি আসলে এই ডিঙ্গিটার মাঝি। সে বুদু মিঞাকে একা নদী পাড় করতে পারবে না, সাফ জানিয়ে দিল।
“না না বাপু আমি একজন নিয়ে নাও ভাসাতে পারব নে, আমার তাতে পোষাবি নে।”
বুদু মিঞা কণ্ঠে হতাশা নিয়ে বললো, “বুঝেছি তোমার বেশি ভাড়া চাই। তা কতো হলি নৌকা ভাসাবে বলো দিকিনি ? ”
মাঝি বুদু মিয়ার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে একটুও কার্পণ্য করলো না। বললো :
“বিশ টাকা দিতি হবি, এক পয়সাও কম হলি আমি পারবো নানি।”
“দু’ টাকার ভাড়া বিশ টাকা” বলেই চমকে উঠলো বুদু মিঞা। অসহায় বুদু মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অগত্যা রাজি হয়ে গেল। রাতের শান্ত নদীর অন্ধকার জলের বুক চিরে বৈঠার আঘাত করতে করতে ডিঙিটা বুদু মিঞাকে নিয়ে এগিয়ে চললো নদীর ওপারের দিকে। কিছুক্ষণ পর নৌকাটি বুদু মিঞাকে নদী পাড় করে ঘাটে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে গেল। বুদু মিঞা নদীর পাড় বেয়ে উঠে ফসলের মাঠের মাঝের কাঁচা রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললো। এই যে চোখের সীমানা পেরিয়ে বিস্তির্ণ ফসলের মাঠ সে হেঁটে চলেছে একে স্থানীয়রা চিতলবেরীর বিল বলে। মস্ত এ চিতলবেরীর বিলের দু’ধার ঘেষে বয়ে গেছে বাড়নই নদী আর তার জন্য দুইপাশে ছোট ছোট তিনটি গ্রাম এর মধ্যে উত্তরের পারবিশা গ্রামে বুদু মিঞার বাড়ি। বুদু মিঞা টর্চের আলো ফেলে দ্রুত বেগে চিতলবেরীর মাঠের কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে চললো । এখনও প্রায় পাঁচ মাইল পথ তাকে হেঁটেই অতিক্রম করতে হবে, এই নির্জন চিতলবেরীর বুক চিরে।
এখন হেমন্তকাল, আকাশে মেঘ নেই। তার পরিবর্তে চাঁদ ও তারাদের হাট বসেছে। মাঠের চারিদিকে ধান ও গমখেত। জ্যো¯œার আলো চুঁইয়ে পড়ছে। সে আলোতে চিতলবেরীর বিলের প্রান্তর বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শুধু জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো একটু অন্ধকারের আড়াল তৈরী করেছে। মাঝে মাঝে দক্ষিণা হাওয়া এসে শরীর শিরশিরে অনুভূতি জাগাচ্ছে। এ সময় ধান পাকতে শুরু করে। অনেক সময় শক্রর হাত থেকে ধান রক্ষার জন্য কৃষকের দল রাত জেগে ধান পাহারা দেয়। বুদু মিঞার অনুসন্ধিতসু চোখ সেরকম কোন কৃষকের দলকে আশে-পাশে খুঁজতে লাগলো। কিন্ত না, কোথাও কেউ নেই। হয়তো আর কয়েকদিন পর থেকে তারা পাহারায় বসবে। কেমনজানি একটু ভয় করতে লাগলো। বুদু মিঞার থেকে পাহারায় বসবে। এই চিতলবেরী বিলের অনেক গল্পই সে শুনেছে তার গ্রামবাসীর কাছ থেকে। সেসব কথা তার মনে পড়ে যেতে লাগলো। ভয়ে তার শরীরের রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই নির্জন রাতে এই মেঠো পথে যদি কোন অশরীরী তার সঙ্গী হয়।
এইকথা ভাবতেই তার গলা শুকিয়ে এলো। সে কোনমতে ঢোক গিলে আরও দ্রুতবেগে পা বাড়াতে লাগলো। তিন ব্যাটারীর টর্চের জোরালো আলো তার সামনের পথকে একদম পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে। এই আলোতে পথে পড়ে থাকা সামান্য ঘাসের শুকনো টুকরোটাও নজর এড়াচ্ছে না। তাই পথ চলতে তার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। এভাবে সে প্রায় দুই মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে, সে কথা পথের ধারে বা’দিকে দাঁড়িয়ে থাকা পর পর তিনটি তালগাছ দেখেই সে বুুঝতে পারলো। এই তিনটি তালগাছের সমষ্টিগত স্থানকে লোকে তালপট্টি বলে। ত্রিমোহনী ঘাটের এপাড় থেকে এই তালপট্টির দূরত্ব যে দুই মাইল সেটা তার জানা ছিল। সেই সাথে বহুদিনের পুরোনো আরেকটি কথাও তার মনে পড়ে গেলো। বহুবছর আগে তখন বুদু মিঞা যুবক ছিল, এখন সে মাঝবয়সী। সেসময় বুদু মিঞা তার এক প্রতিবেশী বন্ধুর কাছে এই তালপট্টির এক ভয়ংকর ঘটনা শুনেছিল। বহুদিন পর আজ সে ঘটনাটি মনে পড়তেই ভয়ে তার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতলস্রোত বয়ে গেল। গলা শুকিয়ে এলো পথ চলার ক্লান্তিতে নয় বরং ভয়ে ¯œায়ুবিক উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার ফলে। ঘটনাটি শোনা থাকলে আর এই নির্জন রাতে এই নি:সঙ্গ একা এই রহস্যময় তালপট্টিতে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো প্রায় সবারই এই এ অবস্থা হবে। ঘটনাটি হলো এই :
বুদু মিঞার এক বন্ধু মানিক একবার তার বাড়ির গাছের ল্যাংড়া আম শহরের আঁড়তে বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা হাতে পেলো। টাকা হাতে পেয়ে তার সখ হলো সিনেমা দেখবে। শহরের ছাঁয়াবিথী সিনেমা হলের ইভিনিং-শো যখন ভাংলো তখন রাত নয়টা। ত্রিমোহনীর ঘাটে এসে নৌকা না পেয়ে উদ্দ্যমী সাহসী যুবক মানিক সাঁতরে নদী পাড় করে এপারে পৌঁছে আবার হাঁটতে শুরু করলো চিতলবেরীর সেই মেঠোপথ ধরেই। রাত তখন প্রায় ২টা হাঁটতে হাঁটতে সে যখন এই তালপট্টিতে পৌঁছালো, তখন ক্লান্ত হয়ে মাটির দিকে তাঁকিয়ে অবনতমস্তকে হাঁটছিলো সে। হঠাৎই তার বা’পাশ থেকে কে যেনো তার নাম ধরে ডাক দিল :
“ওরে মানিক একটু দাঁড়া”।
কণ্ঠস্বরটি মানিকের পরিচিত নয়। অত্যন্ত ভারি মোটা বজ্রের মতো কণ্ঠস্বর। মানিক সে ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলো। কে তাকে ডাকছে, তা দেখার জন্য ঘাড় ঘুরাতেই যে দশ্য সে দেখলো তাতে তার চোখ এতো বড় হলো যেনো গোলাকার চোখ দুটি কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে। ভয়ে শিহরীত হয়ে তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ভয়ার্ত চিৎকার। আর তৎক্ষনাৎ সে পিছে একধাপ দিতে গিয়েই বসে পড়লো। সে দেখলো দুটি তাল গাছের কান্ডে দুই পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রকান্ড এক জি¦ন। তার প্রকান্ড লোমশ দেহটা চাঁদের আবছা আলোতে কালো ঘন ত্রিমাত্রিক ছাঁয়ার মতো দেখাচ্ছে। তার প্রকন্ড দেহের ভারে তাল গাছ দুটি দুদিকে কিছুটা বেঁকে গেছে।
সে জি¦নটি তার বজ্রকণ্ঠে আবার বলে উঠলো :
“এ সময় আমার আহার শেষে বিশ্রামের সময়। এতো রাতে তুই কেনো আমাকে বিরক্ত করতে এপথে যাচ্ছিস ? ”
মানিক হাওমাও করে কেঁদে উঠে বললো :
“মাফ করে দেন, এবারের মতো মাফ করে দেন।”
আমি আর কখনও রাইতে এ রাস্তায় আসবো নে।
“আল্লাহর দোহায় আমাকে মাফ করে দেন!”
জি¦নটি এবার বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বললো :
আহ্ যখন উনার দোহায় দিলি তখন যা, এবারের মত তোকে ছেড়ে দিলাম।
কিন্তু আর কখনো............
তার কথা শেষ না হতেই মানিক উঠে দাঁড়িয়ে
“আর আসপোনে আর আসপোনে”
বলতে বলতে হাত করজোড়ে মিনতি করতে করতে এগিয়ে চলল। তারপর বাঁকিটা পথ দৌঁড়ে পরে কি মরে এই অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিল। পরদিন সকালে এ ঘটনা গ্রামশুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে আর মানিকের কাছেই বুদু মিঞা নিজ কানে শুনেছিল। তার স্মৃতিচারণ শেষে হঠাৎই চমকে উঠে সে তালপট্টির চারিদিকে দ্রুত দেখে নিল। না, আজ কোথাও কেউ নেই। বুদু মিঞা দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে তালপট্টিটি পেরিয়ে গেল। কিছুদুর যাবার পর সে মনে মনে বললো “যাক বাবা, খারাপ জাগাতো পার হয়ে আইসি। আর ভয় নাই।” এবার সে শান্ত মনে স্বাভাবিক গতিতে তার পা বাড়াতে লাগলো। কিছুদুর যাওয়ার পর পথটাকে তার বড় চেনা মনে হলো। হ্যাঁ, সে প্রতিদিনই এ পথ ধরেই শহরে যাতায়াত করে। তাই পথটা তার চেনা হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এ চেনা সেই চেনা নয় বরং তার মনে হলো এই একটু আগেই তো সে এ পথ অতিক্রম করে এসেছে। টর্চের আলোতে ভাল করে লক্ষ্য করতে করতে সে আরও কিছুটা পথ এগিয়ে গেলো। হঠাৎই তার মনে হলো এটা সে কোথায় এসে পৌঁছেছে! এটাতো সেই তালপট্টি! ঐতো ঐ..... যে সেই তালগাছ তিনটি দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু এবার তারা বুদু মিঞার বামে নয় ডানে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তেমনিভাবে যেমনটি গ্রাম থেকে ত্রিমোহনী ঘাটের দিকে যেতে গেলে দেখা যায়। কি আশ্চর্য, সে আবার কেনো ফিরে এলো এখানে ? সেতো কখনো ফিরে দাঁড়ায়নি। সেতো সোজা হেঁটে চলছিল গ্রামের দিকে। তবে সে উল্টো এখানে কিভাবে ঘুরে এসে পৌঁছালো। এবারও সে চারদিকে তাঁকিয়ে দেখলো। না, কোথাও কেউ নেই। আর কিছু না ভেবে সে দ্রুতপায়ে তালপট্টিকে পিছনে ফেলে গ্রামের দিকে পা বাড়ালো কিন্তু একি ? কিছুদূর যাওয়ার পর আবার সে ঐ তাল পট্টিতেই ফিরে এলো। কি আশ্চর্য! সে বার বার কেন সেই তালপট্টিতেই ফিরে আসছে ?
তবে কি সে এক অলৌকিক অদৃশ্য জ¦ালে আটকা পড়েছে ? এবারও বুদু মিঞা ভয়ার্ত চোখে চারদিকে দেখলো, নাহ্ কোথাও তো কেউ নেই তবে এমন কেন হচ্ছে ? সে আবার জোর কদমে তার গাঁয়ের দিকে এগিয়ে চললো। কিছুদুর যেতেই সে লক্ষ্য করলো তার সামনে একটি ছাঁয়া পড়েছে। সে ভাবলো, হয়তো কোন মানুষ তারই মতো টর্চের আলো ফেলে তার পিছনে হেঁটে আসছে। আর সেই টর্চের আলোতে তার নিজের ছাঁয়া তার সামনে পড়েছে। বুদু মিঞা আনন্দিত হয়ে তাকে দেখার উদ্দেশ্যে পিছনে ফিরে তাঁকিয়ে দেখলো, না তার পিছনেতো কেউ নেই! হঠাৎ বুকটা ধরাক করে উঠলো, সে এবার সামনে ফিরে আবার তাকিয়ে দেখলো ছাঁয়াটা তার সামনে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। বড় অদ্ভুত ব্যাপার, এই নিশুতি রাতে অন্ধকার পথে তার এমন জোড়ালো ছাঁয়া পড়লো কেমন করে ? টর্চের আলোতে সেই ছাঁয়া আরও তীব্র কালো বর্ণের দেখা যাচ্ছে। আমরা সকলেই জানি যে উজ্জ্বল আলোকরশ্মি কোন বস্তুতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ছাঁয়ার সৃষ্টি করে কিন্তু বুদু মিঞার পেছনে বা উপরে তো কোন আলো পড়েনি তবে, ছাঁয়া এলো কোথা থেকে ? বুদু মিঞা এবার টর্চের আলো নিভিয়ে দিল। জ্যোৎ¯œার মৃদু আলোতেও সে দেখলো সেই ছাঁয়াটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে আবার টর্চের আলো জ¦ালালো। ভাল করে লক্ষ্য করলো, একি, যে যাকে তার ছাঁয়া ভাবছিল আসলে সেটি তার নিজের ছাঁয়া নয়! কারণ নিজের ছাঁয়া হলে ছাঁয়ায় পা আর তার পা একত্রে মিলে যেতো। কিন্তু এই ছাঁয়া তার থেকে দূরে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে ভয়ে বুদু মিঞার সমস্ত শরীর বেয়ে ঘর্ম¯্রােত বয়ে গেলো। হেমন্তের দক্ষিণা শীতল প্রবাহিত বায়ু তার এই ঘর্ম¯্রােতকে আটকাতে অক্ষম। সে টর্চের আলো সামনে ফেলে উর্দ্ধশ^াসে ছুটতে লাগলো তার গাঁয়ের দিকে। কিন্তু একি ? সেই ছাঁয়া মুর্তিটাও তার সামনে সামনে তার সাথেই চলতে লাগলো। বুদু মিঞা ভয় পেয়ে আরও জোরে ছুটতে লাগলো। তবুও সে ছাঁয়া মুর্তিটাকে পেছনে ফেলা সম্ভব হলো না। বুদু মিঞা এবার দাঁড়িয়ে পড়লো, ছাঁয়া মূর্তিটাও দাঁড়িয়ে পড়লো। বুদু মিঞার শরীর থর থর করে কাঁপছে, তার শ^াস ফুলতে শুরু করেছে। সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এবার সে লক্ষ্য করলো এতক্ষণ যে ছাঁয়া মূর্তিটা তার দিকে পিঠ করে তার আগে আগে চলছিলো, সেই ছাঁয়া মূর্তি এবার আস্তে আস্তে তার দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়ালো। সেই সঙ্গে সে ছাঁয়াটি আর মাটিতে পড়ে নেই। সে এখন পুরোপুরি একটা পুরুষ অবয়ব নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। তার চেহারায় প্রবল হিং¯্রতা স্পষ্ট। তার চোখ দুটি আগুনের শিখা প্রজ্জ্বলিত করে জ¦লে উঠলো। ছাঁয়া মূর্তিটি বড় হতে প্রকান্ড আকার ধারণ করলো। এমন ভয়ানক ও রক্তহীন দৃশ্য দেখে বুদু মিঞা “আ.........আ.......” আত্মচিৎকার করে উল্টো দিকে দৌঁড়ে পালাতে লাগলো। কিছুটা দৌঁড়েই সে হোঁচট খেয়ে পড়লো মাটিতে। প্রচন্ড শব্দে ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠলো সে।
সে চিৎকার ছিল ভয়ংকর আর্তনাদের বহি:প্রকাশ। তার সেই গগনবিদারী আর্তনাদ চিতলবেরির প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়লো। ভেসে ভেসে প্রান্তর শেষে নি:শেষ হয়ে গেলো।
তারপর ভয়ংকর সে রাতের পরিসমাপ্তি ঘটলো। ভোরের আলো ফুটলো, কৃষকেরা একে একে তাদের জমিতে কাজ করতে মাঠে আসতে শুরু করলো। হঠাৎ কিছু কৃষক লক্ষ্য করলো তারপট্টির মেঠোপথে একজন লোক উপুর হয়ে পড়ে আছে। কাছে এসে লক্ষ্য করে দেখলো তার ঘাড় ঘুরে পেছন দিকে মুখ করে পড়ে আছে। মুখ হা করা আর চোখ দুটো কোটর থেকে বেড়িয়ে আছে এবং সে মৃত। কৃষকদের সবাই এমন ভয়ানক চেহারার অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলো। তাদের একজন বলে উঠলো “আরে এরে তো আমি চিনি, ওযে উত্তরের পাড় বিশার বুদু মিঞা”।
নিরুপায় নীলঞ্জনা
গ্রাফিক্স : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ্
নিরুপায় নীলঞ্জনা
শফিক নহোর
তখন আমার নিগূঢ় প্রণয় চলছে মৌমিতার সঙ্গে। মৌমিতা খুব আবদার করে বলতো, ‘তোমার দেশের বাহিরে যাবার কী প্রয়োজন? দেশেই ভালো একটা চাকরি করতে পারলে আমাকে রেখে তুমি যেও না। তুমি দেশের বাহিরে চলে গেলে বাবা, আমাকে অন্য জায়গায় পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিবে।
‘তোমাকে বিয়ে দিবে কেন, আমি আছি না?’
আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করতো। ওর আবদার ছিল একটু শিশুসুলভ। এত অভিমানী মেয়ে অল্পতেই চোখের কোণায় জল গড়িয়ে পড়ত। আমার উপর রাগ করে কখনো কখনো রাতে ভাত খেত না, সকালে খেত না। আমাকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিতো আজ সারাদিন না খেয়ে আছি; আমি বিভিন্ন অসিলায় মিথ্যা অজুহাতে ওর সঙ্গে দেখা করতাম। ওকে খাইয়ে দিতাম উষ্ণ আলিঙ্গনে। আমি অনেকটা লজ্জায় ওকে এড়িয়ে চলতাম। আমার নিজের কাছেই মনে হতো, আমি ভীষণ ছেলেমানুষ, লাজুক কোয়ালিটির মানুষ।
এক বছর পরে আমি মিডলইস্ট চলে আসি চাকরির জন্য। এখানে এসে নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন পরিবেশ, নতুন লোকজন। সবকিছু কেমন যেন অগোছালো অচেনা। আমার ফ্লাইট হয়েছিল এসবি-জিরো এইট। বিমানে আমার সফরসঙ্গী হিসেবে যিনি ছিলেন তিনি পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার। ওনার সঙ্গে আলাপচারিতায় জেনে নিয়েছিলাম অনেক কিছু। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছিলেন। অমায়িক একজন মানুষ প্রচন্ড মিশুক টাইপের। সাত ঘণ্টার জার্নিতে উনাকে অনেক আপন মানুষ মনে হয়েছিল। বিমান থেকে নামার পর উনি বললেন,
অযু করে নিন। আমরা নামাজ পড়ব।
একজন অ্যারাবিয়ান ছেলে অজুর সময় আমার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম।
হায় আল্লাহ! এরা কোন ধরনের মানুষ? এদের ভদ্রতা বলতে কিছু নেই? একজন অতিথির সঙ্গে এরকম অভদ্রতা করে! এ দেশে শিক্ষার এই অবস্থা! আমার সফর সঙ্গী ডাক্তার আমার দিকে চেয়ে আছে। আমাকে ইশারায় বোঝাতে চাইলেন এদেশের তরুণ ছেলেরা একটু দুষ্টু। আমি খুব সহজে বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি ওদের ভাষা না বোঝায় অনেকটা নিরুপায় ছিলাম। নামাজের পর আমরা যথারীতি কাউন্টারে চলে গেলাম। বিশাল মনিটরে দেখছি কোন ফ্লাইট কখন কোথায় যাবে।
রিয়াদ এয়ারপোর্ট থেকে আভা প্রদেশ এক ঘণ্টা পনের মিনিটের ফ্লাইট। ডাক্তার আমাকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
‘‘যেমন, খুব সহজেই কারো সঙ্গে রেগে যাবেন না। খুব সহজেই কাউকে আপন মনে করবেন না। কেউ কিছু খাওয়াতে চাইলে সহজেই খাবেন না। মানুষকে দেবেন বেশি নেবেন কম। এবং না বলাটা শিখতে হবে। অপরিচিত কারও সঙ্গে খুব বেশি আন্তরিকতা, অভদ্রতা দেখানোর প্রয়োজন নেই। এদেশের স্থানীয় ভাষা দ্রুত শেখার চেষ্টা করবেন। এ দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। অন্যায় করবেন না, সৎ থাকার চেষ্টা করবেন। প্রবাস জীবনটা আপনার ভালো কাটবে। তাছাড়া আপনি তো ভালো হাতের কাজ পারেন। আশা করছি আপনার তেমন কোন সমস্যা হবে না।’’
আভা বিমানবন্দর থেকে আমরা খামিছ মোশায়েত চলে এলাম। তারপরে এখানকার লোকাল বাজার থেকে উনি আমার জন্য আপেল, বেদানা, কলা, নাম না জানা বেশ কিছু ফল ফলাদি কিনে দিলেন। মোবাইল নাম্বারটা সেভ করে রাখলাম। যেহেতু আমার বাংলাদেশি সিম কার্ড ছিল। ওই দেশের কোন নাম্বার ছিল না। আমি উনার নাম্বারটা রেখে দিলাম। আমি ফোন নিয়ে আপনাকে কল দেবো। তারপর দীর্ঘদিন ডাক্তারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে যোগাযোগ হয়নি। বিভিন্ন সময় আলোচনা হতো, পরামর্শ দিতেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে ডাক্তার আমার খুব ভালো একজন বন্ধু হয়ে গেলেন। বৃহস্পতিবার রাতে অফিস শেষ করে ডাক্তারের বাসায় চলে যেতাম। অ্যারাবিয়ান খাবার, রাত ভরে আড্ডা গল্প, ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে যেতাম, তারপর জুমার দিনে উঠে ব্রাশ করে নামাজ পড়তে চলে যেতাম। তারপর হোটেলের খাবার খেয়ে বিকেলে বাঙালি মার্কেটে গিয়ে বাঙালির ঝাল মুড়ি তারপর সন্ধ্যায় বিদায় নিয়ে চলে আসতাম। ডাক্তারের সঙ্গে একটা মিষ্টি সম্পর্ক ঠিক ভাইয়ের মতো।
নতুন কাজের পরিবেশে আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে মালিক পক্ষ আমাকে অন্য একটি জায়গায় নিয়ে গেল। সেখানকার ইকামা পাইনি বিধায় বাহিরে অনেক সময় পুলিশের ভয়ে বের হওয়া যেত না। পাসপোর্ট তখন আমার কাছে নেই, ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমান্বয়ে কমে আসতে লাগল। আর যাওয়া হয়নি। ফোন দেবো দেবো করে অনেকদিন ফোন দেওয়া হয়নি। হঠাৎ করে একদিন ফোন দিলাম। অযাচিত একটি কণ্ঠস্বর! আমি একটু আঁতকে উঠলাম।
কে? ডাক্তার বলছিলেন?
আপনি কাকে চান?'
ওপাশ থেকে অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসল। আমার মনের ভেতর সাতপাঁচ চিন্তা হতে লাগল।
ডাক্তার সাহেবকে চাচ্ছিলাম, এটা উনার নাম্বার না?
হ্যাঁ, এটা ডাক্তারের নাম্বার ছিল! উনি রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
‘ইয়া হাবিবি’ বলে পিছন থেকে একজন বেদুইন ডাক দিলো আমাকে। আমি চোখের জল মুছে দ্রুত তার নিকট গেলাম।
আমার মালিকের ছেলে মাঝেমধ্যে হাইলাক্স গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার আমার জন্য নিয়ে আসতো। গাড়ীর পিছনের সিটে বসা একজন বোরকা পরা সুন্দরী রমণী। চোখ দেখে মনে হচ্ছিল ফিলিপাইন অথবা ইন্দোনেশিয়ান। আমাকে খাবারগুলো দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মালিকের ছেলে গাড়ি নিয়ে আমার ওখান থেকে প্রস্থান করল। মেয়েটি হাতের ইশারা দিয়ে আমাকে কী যেন বুঝাতে চেয়েছিল। আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
এখানে খামারের কাজ করছি অনেকদিন। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ধূ-ধূ মরুভূমি। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করলে শুধু নীল আকাশ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। এর ভেতরেই বিনা তারে কথা হয় প্রিয় মানুষের সঙ্গে, কথা হয় মৌমিতার সঙ্গে। আমি বুঝতে পারি ও খেয়েছে কিনা, কি করছে; অনেক কিছুই কাকতালীয়ভাবে সবসময় মিলে যেত। আমাকে টিটকারি করে দৈবিক বলে ডাকত।
চলে আসবার দিন মৌমিতার হাত ধরে বলেছিলাম,
‘আমার আমানত তুমি এবং তা তোমার নিকট রেখে গেলাম, তাকে অবিশ্বাসের অনলে পুড়িয়ে নষ্ট করো না প্লিজ!’
চিঠির পর চিঠি দিয়েছি মৌমিতাকে, একটারও জবাব পাইনি।
‘চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়।’ কথাটি ধ্রুব সত্য। মৌমিতার প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস ও অন্ধের মতো ভালোবাসা ছিল বোকামি। আমাকে সহজেই বিক্রি করে দিয়েছে বোকার আড়তে। আমি আর চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম না।
অতিরিক্ত স্বাধীনতার মূল্য মানুষ কীভাবে দেয়, তা আমি বুঝতে পারি এখন। মনে মনে ভেবে নিয়েছি, সে হয়তো এখন সুখের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
একদিন আমার কফিলের ছেলে এসে আমাকে বলল,
তোকে এখানে কাজ করতে হবে না। আমার সঙ্গে চল।
কিছুক্ষণ পর আমার লাগেজ নিয়ে বের হয়ে আসলাম। গাড়িতে বসে মারুর সঙ্গে আমার পরিচয়। মারু মালিকের বাড়ির হাউজ ওয়ার্কার। আমি মালিকের বাসার নিচের নতুন বাগালায় দোকানের কর্মচারী হিসাবে যোগদান করেছি। মারু মাঝেমধ্যে বাগালায় আসতো বিভিন্ন জিনিসপত্র নিতে। আমার চোখের দিকে চোখ পড়লে, মারুর মায়াময় চোখ হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত, যা আমাকে প্রচন্ড ভাবে ভাবিয়ে তুলতো। আমি ডিউটি শেষ করে, মারুকে নিয়ে ভাবতাম। মেয়েটি আমাকে দেখে কান্না করে কেন? মনে মনে ঠিক করলাম মারু আবার বাগালায় আসলে অনেক কথা বলব। মালিকের বউ বজ্জাত মহিলা, মারুকে প্রায়সময় বিভিন্ন কাজে আটকিয়ে রাখতো। ভোর হতে রাত দু’টা পর্যন্ত কাজ। ফজরের নামাজ পড়ে ছেলেমেয়ে মাদ্রাসায় যাবে; তাদের ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া থেকে শুরু, জামা কাপড় পরিষ্কার থেকে টয়লেট পরিষ্কার, কোন গাড়িতে যাবে সে ড্রাইভারকে ফোন করা, দুপুরে কী রান্না হবে তার বাজার লিস্ট করা, ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করা। তারপর ফিরে এসে দুপুরের রান্না করা। একই পর্ব চলে রাতের বেলা। সন্ধ্যায় মালিকের আত্মীয় স্বজন আসে। তাদের গাওয়া, বিভিন্ন পদের নাস্তা, বিভিন্ন দামি খাবার তৈরি করা। ঘরের মধ্যে চলে নাচানাচি, কেউ কেউ কুত্তার মত বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে। জোর করে কেউ বুকে হাতও দিতে চায় মারুর। সেদিন বাগালায় মারুর সঙ্গে কথা বললাম,
হাবিবি ইন্তা মালুম?
ঈশ মালুম?
কফিল হায়ওয়ান, ওয়া ওয়লাদ হারামি কাবির।
লেশ?
লাহাম এমসিক, গুল মাফি মুশকিল। আনা মালুম হাদি হারাম?
মারুর সঙ্গে কথা বলে সব বুঝতে পারলাম। ওর সঙ্গে চলে যৌন নির্যাতন, শারীরিক অত্যাচার। নিরুপায় মারু কোনো প্রকার কথা বললে চলে বিভিন্ন হুমকি ধামকি। প্রবাস জীবন যারা কখনো পার করেনি, তারা কখনো বুঝবে না। সবকিছু মুখে বলে বুঝানো সম্ভব না। জ্বলন্ত নরকে সুখ খুঁজে মারু প্রতিনিয়ত।
খুব মিহি স্বরে আমাকে বলল,
ইন্তা হব্বোক আনা?’
আমি বোকার মত মারুর দিকে চেয়ে রইলাম। আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। স্মৃতিপটে ভেসে আসলো মৌমিতার ছলনাময়ী মুখ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা অনেক দূরের ব্যাপার এমনও হতে পারে মৌমিতা কখনো আমাকে মন থেকে ভালোই বাসেনি। তার কুটিল হৃদয় বুঝবে না সহজে। নিজের প্রতি আমার প্রচন্ড ঘৃণা হয়, এটা কোনো জীবন হলো? প্রবাসে কেমন একটা কুত্তার লাইফ কাটাচ্ছি; কাউকে কিছু বলতে চাইলে শুনতে চায় না। প্রথমেই বলবে কিছু টাকা ধার দে বন্ধু; ‘প্রবাসীদের সঙ্গে দেশের মানুষের সম্পর্ক শুধু একটাই, টাকার সম্পর্ক। তাছাড়া মনে হয় না কোনো সম্পর্ক আছে। বাড়ির পরিবেশ একই টাকা না দিলে বাবা দেখি মোবাইলে ফোন ধরায় কেমন যেন অলসতা দেখায়। সাত সতেরো মানুষের কাছে গল্প শুনি, মা আমার জন্য না খেয়ে থাকে, আমার পছন্দের আমসত্ত, আমি বিদেশ আসার পর মা মুখে দেয়নি। এরকম অনেক প্রিয় জিনিস মা না খেয়ে থাকে। শুধু এই মানুষটার সঙ্গে কখনো সম্পর্ক খারাপ হয় না আমার। মায়ের চাঁদের মতো মুখখানি ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
দৃষ্টি ফিরে তাকাতেই দেখি মারু আমার চোখের আড়াল হয়ে গেছে।
আবু সাদ আমার পুরনো কাস্টমার। তবে ইদানীং খেয়াল করলাম আমার দিকে তার অন্য রকম চাহিদা। আমি প্রচ- লজ্জা পেলাম! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
আবু সাদ, আনা মুসলিম।
মালে, ইয়া রেজ্জাল।
মুখ মলিন করে বাগালা থেকে প্রস্থান করল।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। আবু সাদ বিচ্ছিরি টাইপের মানুষ। তার কথা শুনে আমার বমি আসে।
একজনকে টাকা পাঠিয়েছি অনেকদিন হলো। ফোন দিয়েছি কয়েকবার, এখন ফোন ধরছে না। টাকা পেয়েছে কি-না তাও তো বলতে পারছি না। বাড়িতে বাবা আমার উপর মনে হয় রাগ করে আছে। প্রবাস জীবনে এসে না কাউকে সুখী করতে পারলাম, না কারো মন ভরাতে পারলাম।
আপন লোকজন সবসময় অভিযোগ দিয়েই গেল শুধু। কারো মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম না। তার বিশেষ কারণ হলো মানুষ যা চায় আমি তাদের মনের মতো কিছুই দিতে পারছি না। আমি এখন সবার কাছে অপ্রিয়। প্রতিদিন রাতে মায়ের ছবিখানা বুকে ধরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি বেমালুম তা ভুলে যাই। এ পৃথিবীতে মা ছাড়া কেউ নিঃস্বার্থ ভালবাসতে পারে না। মৌমিতা প্রায়ই স্বপ্নে আসে চুপিচুপি কথা কয়, আমারে জড়িয়ে ধরে। আমি ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠি। রুমের লোকজন মনে করে আমার জিন অথবা পরীতে আছর করছে; পানি পড়া খাওয়ায়, দোআ দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দেয়। তারপরও কোনো কোনো রাতে মৌমিতার সঙ্গে কথা বলে চিৎকার করে উঠি।
গ্রাফিক্স : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ্মারু প্রতিদিন আমার খবর নেয়, বিশেষ দিনে আমাকে আগে থেকে জানিয়ে দেয়। আজ মার্কেটে যাবে অথবা ব্যাংকে যাবে। আমি যেন তার সঙ্গে যে করেই হোক দেখা করি। ঠিক প্রেমে পড়া নয়। এক ধরণের ভালোলাগা, অথবা খুব ভালো বন্ধুত্বের জের ধরেই আমি এগিয়ে যাই, মারু আমাকে তার সম্পর্কে সবকিছু বলে। আমার তার প্রতি বিশেষ কোনো দুর্বলতা ছিল না। একটা সময় আমরা খুব ভালো বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু মারু কখনো আমাকে বন্ধু মনে করেনি। মারু সত্যিকার অর্থে আমাকে প্রচ- ভালোবাসে বিয়ে করতে চাইত। তার বেতনের একটা অংশ আমাকে জমা রাখতে বলতো। আমার সঙ্গে এ নিয়ে অনেকবার মনোমালিন্য হয়েছে ।
একটা সময় মারু আমাকে চাপ দিতে থাকে তাকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে।
ছয় মাস পরে!
মারু তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা পেটের বাচ্চা মারুর কফিলের না-কি তার ছেলের, এমন কঠিন প্রশ্ন সামনে এসেছিল মারুর। সে বাড়িতে মারু ছিল হাউজওর্য়াকার, শুধু তাই নয়; ছিল যৌনদাসী। অঢেল প্রাচুর্যের অহংকারে বাবা সস্তান মিলে অমানবিক, হৃদয়হীন বিবেকবোধ কাজ করেছে দিনের পর দিন। এখানে গরিব মানুষের জন্য কোনো বিচার নেই। নিরুপায় কোনো মানুষের কথা পুলিশ বিশ্বাসও করে না। বিবেকবোধ কখনো তারা করেনি অমানুষদের। নিরুপায় মারুকে তখন সাত পাঁচ বুঝিয়ে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
ওকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
চিন্তা করো না মারু, তোমার অনাগত সন্তানের পিতা আমি হব। আমি তোমাকে সারা জীবনের জন্য প্রেমের সুতোয় বেঁধে রাখতে চাই। সে কথাটি বলা হয়নি, তার আগেই আমি কারাবাস ভোগ করি, সুদূর প্রবাসে কফিলের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে। ঊনচল্লিশ দিন পর আমি দেশে চলে আসি, সঙ্গে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। বিমানের ভিতরে মানুষের কাছে হাত পেতে দশ রিয়াল বিশ রিয়াল দিয়েছে, তা দিয়েই বাড়ির মানুষের জন্য কিছু কিনেছি, এতদিন বিদেশ থাকার পরে খালি হাতে বাড়ি গেলে মানুষ কী বলবে।
অলৌকিক ভাবে মৌমিতা আমাকে এয়ারপোর্ট রিসিভ করতে এসেছে, আমি নিজেই জানতাম না আজ আমি দেশে আসব। মৌমিতাকে দেখে পুলকিত হলাম। আমি কোনোভাবেই মিলাতে পারছি না কীভাবে মৌমিতা জানল, আমি আজ দেশে আসব। কেমন করে সে আজ এয়ারপোর্টের গেটে আমার অপেক্ষায়! কুটিল পরিবেশে মানুষ হয়েছে মৌমিতা, নিরুপায় হয়েই আমার থেকে দূরে ছিল। বিচ্ছেদের বেদনায় নীল পাথররূপে জন্ম হতো আমার হৃদয়ে তবুও তার গভীর আনাগোনা ছিল আমার হৃদয়ে, চোখ ভিজে উঠত সোনালি স্বপ্নে। আজ মারুকে খুব মনে পড়ছে, মারুকে আমি প্রথম দিকে নীলাঞ্জনা বলে ডাকতাম। বেচারি নিরুপায় ছিল সত্যি।
‘‘প্রবাসে সব মেয়েরা নিরাপদে থাকে না, সবাই থাকতেও পারে না। প্রবাসে কেউ কেউ থাকে নীলাঞ্জনার মত নিরুপায়।’’
মৌমিতার হাতে ফুল থাকার কথা, এতদিন পর আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে এসেছে; গায়ে কী বিচ্ছিরি গন্ধ! এমন লাগছে কেন?' আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলছে,
স্যার পাঁচটা টাকা দিন।
আমি অবাক! অপলক দৃষ্টিতে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আমি কিছুই মিলাতে পারছি না। মৃদু কন্ঠে বললাম,
আমি তোমার পারভেজ, আমাকে চিনতে পারছো না?
আমার অশ্রু সিক্ত দুচোখের জল ছিল দু’রকম। মৌমিতার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল, গ্রাম্য এক ডাক্তারের কাছ থেকে ভুল চিকিৎসায় এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খেয়ে দৃষ্টি শক্তি ও কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে । নরম তুলতুলে হাত দিয়ে আমার মুখ ছুঁয়ে দেখছে অবুঝ বালিকার মত। অনাশ্রয় পরিবার কোথায়ও বিয়ে দিতে পারেনি। পাশের বাড়ির মানুষের দৃষ্টি ছিল মৌমিতার শরীরের দিকে। নিজেকে বাঁচাতেই একদিন রাতে পালিয়ে শহরে চলে আসে। মানুষ আসলে জীবন থেকে পালিয়ে ভালো থাকতে পারে না। জীবনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে বেঁচে থাকার নামই বেঁচে থাকা।
পদাবলি
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
মুখোশ
অলোক আচার্য
ঈশ্বর, তুমিও আজ ঢেকেছো মুখ মুখোশের আড়ালে
চিনতে পারিনি মন্দিরে তাই, হেঁটে গেছি যতদূর
ফিরেছি আবার ফুটপাত ধরে, নগ্ন পায়ে
প্রার্থনার করুণ সুরে
আমিও চেষ্টা করেছি তোমার কৃপা পেতে।
আমিও তো পরেছি মুখোশ, তোমাকে দিয়েছি যতটা
অনেক বেশি নিয়েছি চেয়ে। ভেবেছি পেয়েছি সব
ওদিকে শূণ্যের পাহাড় জমে জীবনের একপাশে।
মুখোশের দল আজ সবখানে, সব রাস্তায়, বিজ্ঞাপনের আড়ালে
বাজারের অলি-গলিতে মুখোশের বেচাকেনা-
লাভ যত হয়, ভাবি তার চেয়ে বেশি
সেই ক্রেতার ভিড়ে বুঝি তুমিও আছো! আমারই পাশে?
মায়ানগর
রহিম উদ্দিন
পৃথিবীতে নেমে আর যা যা দেখলাম
অদ্ভুত সুন্দর! ছন্নছাড়া কিছু আত্মার সংগ্রাম
অবিরাম বয়ে চলা আর ভেঙ্গে যাওয়ার গল্প
স্বপ্নিল মানুষেরা উড়ে উড়ে হয় কুৎসিত দাঁড়কাক
যেখানে ভুল গলিতে ঝুলে প্রেমের রঙিন কাগজফুল
সাপুড়িয়ার বীণ শুনে ঘরের বাইরে এলেই
চোখে পড়ে— হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা
মুখ ও মুখোশের মায়ার নগর।
স্বপ্নছায়া হাঁটে
রজব বকশী
হাঁটছি ঘড়ির কাঁটা জীবন প্রবাহ
কত কথা বলি লিখি কিংবা এঁকে যাই
আসলে তো এই জীবনকেই খুঁজে ফিরি
অনন্ত হে অতলান্ত ভাবনার ঢেউ
ভাঙচুরের বিচূর্ণ নিয়ে জেগে ওঠো অহর্নিশ
বহুমাত্রিক বৈভবে দৃশ্য দৃশ্যান্তর
প্রতিটি ভোরের বুকে শুয়ে থাকে
আঁধার রাত্রির
উপাখ্যান
একফোঁটা শিশিরের মধ্যে খুঁজি সমুদ্রের ঢেউ
আলোজলের আয়না জীবনকেই প্রস্ফুটিত করে
ধূলি¯্রােতের আবহ শূন্যতার ডানা মেলে ওড়ে
জানি হৃদয় বিছানো পথ ও প্রান্তর
দুহাত বাড়িয়ে ডেকে যায়
বিদগ্ধ প্রাণের স্পর্শে
সবকিছুর ভেতর বাইরে স্বপ্নছায়া হাঁটে
প্রত্যাশার হাতে হাত ধরে দূরে কাছে
চৈতন্যের পাশ ঘেঁষে হৃদ্যতার ব্রিজ তৈরি করে
চড়ুই
রায়হান কিবরিয়া
যে চড়ুই
ঘরের চাঁলে বাঁধে প্রাণ প্রতিদিন।
সেও যায় উড়ে -
যখন জানতে পারে
ফুঁটো হয়ে গ্যাছে ঐ ঘরেরও টিন।
সেও খোঁজে ঘর, হয়ে যাযাবর।
নতুন ঘর যদি পেয়ে যায়-
ফেলে আসে ঘর, হয়ে স্বার্থপর!
নিজের জন্য বাঁচে! ভীন্ন বাসায়!
এ শহর ঘুমায় না
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
বুকের উপর ঘুম পাড়িয়ে শহরকে, তুমি যখন
একা একা বিড়ালটাকে খেতে দিয়েছ মাছ;
ডোরাকাটা রিকশাটা কি অভিমান করে চলে গেল
তারপর বৃষ্টি হলো- মাদার তেরেসা কাঁদছিল ভীষণ !
পায়ের উপর বৃষ্টির লাশ- দেহটা উষ্ণ উষ্ণ;
কি রকম এক সন্ধ্যে এলো গড়াতে গড়াতে; একই
রকম এক ডজন শেয়ালের ডাকে ঘুম গেল শহরের
তুমি নখ কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেললে আঙ্গুল;
ভাদ্রদিন- গলিরমোড়ে কুকুরের শরীরীয় প্রেমে শরীর হাসে-
আমি কি সস্তা দামে বেঁচে দেই জীবন,
আরেকটা শহর তোমাকে নিয়ে নষ্ট হলো;
নষ্ট হলো আরেকটা জন্ম; উষ্ণ ওমে প্রভাতফেরীর নাম
তারপর যখন আমি তুমি পথে হাঁটতে নামি
তখন এ শহর চেয়ে থাকে, হাসে- এ শহর ঘুমায় না !
মিউচুয়াল সেপারেশন
শম্পা মনিমা
একটি ঘর থাকার কথা ছিলো। কথা ছিলো, কথা বলার লোক ছিল, অবশ্য শুনতে পেতো। মন্তব্য করতো ইচ্ছা হলে, অথবা বক্তব্য পেশ।
একটা রোদটানা দুপুর দড়িতে মেলা ছিলো, সন্ধ্যেবেলার হাওয়ায় গা-ধোয়া সিফনের ওড়াওড়ি ছিলো, মেঘেদের ফাগুন জলসীমায় জলন্ত সিগারেট ঠোঁট পেতে আদর দিতো!
এসপ্ল্যানেট, যাদাবপুর, রাসবিহারী মোড় ছিলো; টিউশন ছিলো, ঘন্টাতিনেক পরিচয়ের গল্প ছিলো, কাব্য ছিলো, রঙ্গহাসি ছিলো, বেশ অর্ধেক জীবনের সঙ্গ ছিলো...
সবচেয়ে বড়ো কথা একটা ঘর ছিলো, চোখ কাছাকাছি মনের কাছে ঘরদোর ছিলো। অনর্গল ঘোরের শোর ছিলো, দিনের শেষে রাতের কাছে খোলামেলা শরীরের মন-গল্প ছিলো, হয়তো অজুহাত মাত্র, পুরোপুরি ছিলো রাতযাপন।
রাত উড়িয়ে, চোখেমুখে লেগে থাকে কালচে রক্তের দাগ। তাৎক্ষণিক আনন্দের অপেক্ষাগুলো চেপে ধরে, চলমান সময়রেখা উড়ে বেড়াচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি দেখতে পাচ্ছি বিদ্রুপের ভঙ্গিমা,
রক্তচোষা মুখ নিয়ে বিচ্ছেদের হাত
স্বাভাবিকভাবেই কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না এইসব সজীব প্রাণে। উত্তেজিত হয়ে নাড়িয়ে দিচ্ছো হাত, ফিরিয়ে নিচ্ছো মুখ, কিন্তু
এদের নিয়েই একটা ঘর থাকার কথা ছিলো।
তবুও তুমি ভালো থেকো
রাসেদুল হাসান রাসেল
আমার এই শ্বাশত জীবনের-
একুশটা রঙিন বসন্ত তোমায় দেবো,
দেবো বসন্তের বাসন্তী শাড়ি।
একুশটা বর্ষা দেবো তোমায়,
কালো খোঁপায় গুঁজে দেবো বৃষ্টি ভেজা নরম কদম।
একুশটা শরৎ দেবো,
দুজনে মিলে ঘুরে বেড়াব কাশফুলের বনে।
আরো দেবো
একুশটা গোলাপ,
একুশতম বয়সের একুশ রকমের হাসি।
তুমি না হয়
তোমার একুশ বছরের একুশ রকমের দুঃখ গুলো আমায় দিও।
তবুও,
তুমি ভালো থেকো।
ধ্যানের বেদী
মাজরুল ইসলাম
চেতনায় নয়, শুধু ছাঁট মালে গাঁথলে
ধ্যানের বেদী।
নোনা এখন কুরে কুরে খায়
সেই ইমারতের ভিত।
দেওয়ালে ফাটল দেখা দিলে
মধুকর ফিরে যায়
মধুখালীর নব বনগাঁ।
বিদীর্ণ দেওয়ালের ফাঁক ঠিকরে বেরোয় এখন
বিরহের গুঞ্জন।
ছাঁট মালে ধ্যানের বেদী
গাঁথা শুধু সার ?
জুয়ার তাস কিংবা প্রেমিক জীবন
যাহিদ সুবহান
হরতন-রুহিতন কিংবা ইস্কাবনের মারপ্যাঁচে
সাধক বনে যায় মাতাল জুয়াড়ী
আর চালের তাস হয়ে যায় টাকা
জুয়ার টাকা গাছের পাতার মতো
কী নেশায় মতে ওঠে জুয়াড়ী
কী রাজা, কী রাণী, কিইবা গোলাম
এ নেশা শুধু জয়ের নেশা
আমার সমস্ত নেশা তুমি জুঁই
আমি তোমার জন্য প্রতি মুহূর্ত
বাজী রেখে খেলে যাই জীবনের জুয়া...
নদীগুল্ম
দ্বীপ সরকার
যে নদী জরাগ্রস্তÑমনে করো তাকে নারী
নাব্যতার চরে হাসনাহেনা-
নৌকোর ছই, দুলদুল ঘোড়া
ঘাটের নৌকো-পড়ে থাকা কাঠ
ঘাটের কোণে ইটভাটার ধুঁয়ো
অথচ গেলো বছরে গনগনে সাঁতার এখানে
অথচ কী যে হয়ে যাচ্ছে
কী কী হতে হচ্ছে নদীকে
নদী কখনো নারী
কখনো হাসনাহেনা চাষের ভূঁই
এ দেশের নদীগুল্ম বুড়ো আঙুল দ্যাখায়
কে তাকে ঠ্যাকায়
শুকনো বালুচরে এখন রাখালরা রাজা
প্রজ্ঞার জল নেইÑআছে বাওড়ী বাতাস
তুমি যাকে নদী ভাবো-সে স্ত্রী
স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলে বোঝা যায়
ওখানে নদীর ইতিহাস কতো কতো আগের
আত্মহনন
শাদমান শরীফ
দীর মতো বেঁকে বসে আছে নারী
ঢেউয়ের জিভ বহন করে তাড়নার ক্ষুধা
এ নারীর কোলে মৃতশোয়া জনৈক পুরুষ
তার দৃশ্যের ভেতর ঝুলে আছে দুপুরের রোদ
অথচ উঠোনজুড়ে হননের হাহাকার
সে ভেবেছিল-
বাগানে এক চিলতে রোদ টানিয়ে রেখে অবসরে যাবে
ভেবেছিল, গুটিকয়েক সমব্যথী আঙুল বাড়িয়ে দেবে
সঙ্গীনির বুকে মাথা রেখে শান্তি নেবে
অতঃপর সংগীতের রিনিঝিনি, কামনার জলকেলি।
আর-
প্রিয়তমা তাকে বারবার ঠেলে দেবে
ঈশ্বরের ভয়ংকর আজাবের দিকে।
শ্রী সূর্য সেন
নটরাজ অধিকারী
শ্রী সূর্য সেন, আমার বাল্যবন্ধু।
তাড়াহুড়ো ছুঁয়ে
বড্ড সাহসী ছেলেটা, ভীতুদের পাশে
হারিয়ে গেছেন!
বহুকাল একা উদাসীন ;
এইখানে ভিটা পড়ে আছে - ঘরহীন।
আমার মনঘরে সে, তবু আসে
যায় প্রতিদিন।
বাল্যহাসি
গ্রাফিক্স : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
বাল্য হাসি
আসিফ আহমদ
অষ্টম শ্রেণিতে বইয়ের ভাঁজে পাওয়া সেই ছোট্ট চিরকুট স্মৃতি, এই পরিণত বয়েসে এসেও নিদারুণ দিশেহারা করে তুলে তাকে। অথচ সেই চিরকুটে তেমন কিছুই ছিলো না লেখা, গোটা গোটা অক্ষরে একটি বাক্য ছাড়া।
(তোমার হাসিটা খুব সুন্দর সাহিদা ভানু)!!
এযাবৎ কালে এহেন কথা কেউ বলেনি তাকে, এমনকি বিয়ের পর স্বামীও নয়।
চিরকুট্টি পাওয়ার পরমুহূর্তেই দম তাঁর প্রায় রুখে আসছিলো, হাত পা যুগল কেঁপে উঠছিলো কী এক অজানা অদৃশ্য ভয় আতংকে।
হৃদ মনে দৃশ্যমান কল্পনা জেঁকে বসে ছিলো তাঁর। এমন উড়– চিরকুট বুঝি রোজি আসবে,
এরপর দেখা যাবে চলতি পথ এঁটে আচমকা কোনো যুবা প্রেম-প্রস্তাব করে বসবে তাঁকে।
অকস্মাৎ বিস্মিত করে তাঁকে, তেমন কিছুই ঘটলো না। পরবর্তীতে গুঁজে দিলো না কেউ বইয়ের ভাঁজে চিরকুট। চলতি পথ এঁটে আচমকা কোনো যুবা প্রেম-প্রস্তাব করলো না। বললো না সাহিদা তোকে আমি বড্ড ভালোবাসি রে, নে এই চিঠি খানা রাখ।
অথচ কোনো এক অদ্ভুত কারণে আড়ালে আবডালে এমনটা চাইতো সে। কেউ একজন বলুক তাকে, ভালোবাসি তোমায়। কাছে চাই ভিষণ ভাবে খুব!
এর কিছুদিন পরেই, বিয়ে হয় সাহিদা ভানুর, সরকারি চাকুরে আনিসের সাথে। সেও সব ভুলে মননিবেশ করে স্বামী সংসারে।
কিন্তু সাহিদা ভানু বুঝতে অক্ষম, ইদানীং কালে সেই প্রৌঢ় স্মৃতি খানা এতো সজীব প্রাণবন্তন হয়ে উঠার কারণ!
কেনোই বা বারংবার তাড়া করে ফিরছে এই বাল্য স্মৃতি?
ধূসর স্মৃতিটা এমন প্রকট স্বচ্ছ হয়ে উঠার কারণই বা কি?
শোয়া থেকে উঠে সোজা দর্পণ সামনে দাঁড়ালো সাহিদা ভানু, দৃশ্যমান হলো তাতে তাঁর প্রৌঢ় অবয়ব। চর্ম কুঁচকে খানিক দোলানি দিচ্ছে বয়স ভারে। আঁখি দ্বয় কোটরে চলে গেছে কিঞ্চিৎ অগোচর ক্রন্দনে। তবুও সে কৃত্রিম হাসলো মুচকি হাসি, হাসি মুচকি।
নিজের হাসি দেখে সে হতবাক না হয় পারলো না, কিছুটা ঈর্ষাকারও অনুভব করলো আনমনে। তাঁর কি করে এমন চমৎকার বিস্মিত হাসি হতে পারে? আসলেই কি এটা তাঁর নিজ হাসি, নাকি দর্পন ওপারের সাহিদা ভানুটা অন্য কেউ? এনিয়ে খানিক সন্দিগ্ধ সে! তা পরখ করতে পুনরায় হাসি দিলো তার শ্রেষ্ঠতম বাল্য হাসি।
সাহিদা ভানু এতকাল বেখেয়ালি ছিলো নিজ সম্পর্কে, তাঁর বিস্মিত চমৎকার হাসি সম্পর্কেও ছিলো অজ্ঞাত।
রাখতে খেয়াল ও জ্ঞাত থাকতে, স্বামী সংসার ও ছেলে পুলের কথা।
অনেক হয়েছে আর না, এবারে নিজ সম্পর্কে খেয়াল জ্ঞাত হবে সে।
তাঁর মুচকি হাসিটি প্ররিণত হলো এবার বিস্তৃত হাসিতে, আসলেই সাহিদা ভানুকে দেখাচ্ছে এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়–য়া চৌদ্দ বছরের বালিকার ন্যয়।
শুধু একটা স্কুল ড্রেসের কমতি মাত্র, তাহলেই বনে যেতো সেই চিরচেনা সাহিদা ভানু।
সাহিদা ভানুর হৃদ গহ্বরে জেঁকে বসলো,
যদি আমি আমার এই স্বগোপনিত প্রশমিত ইচ্ছের কথা পুত্র জ্যেষ্ঠকে বলি, তাহলে ভাববে কি সে, এও যদি বলি রুঢ বা বায়না স্বরে, যে আমার একটি স্কুল ড্রেস লাগবে। তখন যদি পুনরায় প্রশ্ন তুলে,তা সেই স্কুল ড্রেস দিয়ে করবেটা কি তুমি শুনি? আবার তখন এর উত্তরে কি বলবো? বলবো যে আমি হাসলে চমৎকার বিস্মিত সুন্দর দেখায়। একেবারে সেই অষ্টম শ্রেণিতে পড়–য়া বালিকার ন্যয়, আর একটা স্কুল ড্রেস গায়ে জড়ালেই পুরোদমে বনে যাবো অষ্টম শ্রেণিতে পড়া সেই ফুটফুটে বালিকা সাহিদা ভানু !
এসব শুনে, ব্যপারটা নিশ্চয়ই সে ভালোভাবে নেবেনা। আনমনে ভাববে হয়তো বয়স ভারে তন্মনের সাথে মাথাটাও বুঝি গেলো এবার। অতি শীঘ্রই পাবনা পাঠাবার বন্দবস্ত করতে হবে!
না দরকার নেই খামাখা জ্যেষ্ঠকে বলে খাল কেটে কুমির ডাকার।
সে নিজেই গিয়ে কাপড় কিনে দর্জি দিয়ে বানিয়ে নিবে। এই ভাবতেই পূনরায় হেসে উঠলো সে, ভূবণ ভুলা চির উচ্ছাসিত ভঙ্গিমায় চমৎকার বিস্মিত হাসি!
সাহিদা ভানু ঠিক করলো সে এখনি বের হবে কাপড় কিনতে এবং তা সেলাতেও দেবে দর্জিতে।
এরপর থেকে সেই ড্রেস গায়ে দর্পন পানে দাঁড়িয়ে রোজ হেসে উঠবে অষ্টম শ্রেণিতে পড়–য়া চৌদ্দ বছরের বালিকার ন্যয়!
হা... হা... চৌদ্দ বছরের বালিকা।