নিমফুল
নিমফুল
নেহাল অর্ক
রিক্সা থেকে নেমেই পুথি নিজের ব্যাগ থেকে একটি বিশ টাকার নোট চালককে দিলো ; ততক্ষণে ভিজে জবুথবু অবস্থা তার। ক’দিন ধরে বৃষ্টিতে নাকাল নগরবাসী। সারা শহর খানাখন্দে পরিপূর্ণ, ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। আষাঢ় তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই হাজির হয়েছে প্রকৃতির মাঝে; যদিও মানুষ এবারের বর্ষা বন্দনার কথা ভুলেই গেছে। তবে কিছুদিনের বৃষ্টিতে বর্ষা আসবে আসবে ভাব। প্রকৃতি কখনও বঞ্চিত করে না মানুষকে; নিজের নিয়মেই সবসময় উদারভাবে দিয়ে যায় তার দান, আমাদের বুঝতে ভুল হয় কেবল। এসব ভাবনার মাঝেই ভেজা কাপড় নিয়ে ঘরে ঢুকে পুথি নিজের রুমে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে। পুথির মা তখন এককাপ চা নিয়ে এসে বলে,
“তোকে বলেছিলাম আজ বাহিরে না যেতে কিন্তু কে শুনে কার কথা!” একটা অভিমান নিয়ে পুথির মা চায়ের কাপটা রেখে চলে যাবে এমন সময় পুথি তার মাকে জড়িয়ে ধরে,
“সরি মা, রাগ করো না। রাতুলের একটা সমস্যা ছিলো তাই যেতে হলো।”
“সমস্যা কি শেষ হলো?” পুথির মা জানতে চায়।
শেষ হয়েছে, তবে ওদের এই বাসা থেকে চলে যাওয়া ছাড়া এই সমস্যা চলতেই থাকবে; পুথির জবাবের পর আরও কিছু কথোপকথনের মাঝে কোনো রাকডাক না রেখে মা পুথিকে বলেই ফেললো,
“তুই কি তাহলে রাতুলকেই বিয়ে করবে?
জানি না মা, আমি কারো উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই না; যদি কেউ নিজে থেকে আমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তবেই আমি তার হতে রাজি। আমি রাজার মতো নিতে পছন্দ করি, মা। সেটা দূর্বাঘাস হলেও আমার কাছে তার ঢের মূল্য আছে কিন্তু ভিখারির মতো রাজ্য নিতেও আমার বাধে। এসব কিন্তু আমি শিখেছি তোমার শিক্ষা আর বাবার ব্যক্তিত্ব থেকে; বলেই পুথি মাকে একটু মৃদুহেসে জড়িয়ে ধরে। অনেক সময় নিজের কষ্টগুলো প্রবল হলেও মানুষ তার আপনজনদের উপর আঁচ লাগতে দেয় না; সে কেবল নিজেই পুড়ে ছারখার হয়। পুথির কথায় একটু ধাক্কা খেলো মা; পুথির কাছে তার স্বামী সম্পর্কে শুনেই হয়তো এমনটা হলো। ঠিক আছে তুই বিশ্রাম কর, বলেই মা পুথির রুম হতে বের হয়ে গেলো।
তখনও সন্ধ্যা হতে কিছুটা বাকি; বৃষ্টির ফোঁটা গাছের পাতা ছুঁয়ে মাটিতে পড়ছে; পাতা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আকাশের দান আগলে রাখতে চেয়েও পারছে না, গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে নীচে। আসলে, যার গ্রহন করার ক্ষমতা যতটুকু এর বেশি সে ধরে রাখতে পারে না। প্রকৃতি তার প্রতিটি পরতে পরতে আমাদের জন্য তার কতো মূল্যবান শিক্ষা সাজিয়ে রেখেছে; এর কোনো শেষ নেই। উদাসীন বৃষ্টির ভাবনার সাথে পুথির মনে একটা হাহাকার এসে যোগ হয়। রাতুলের কথা মনে পড়ে খুব; আজ এতো বছর রাতুল আর আমি বন্ধুত্বের আবরণে নিজেদের সম্পর্কের গভীরতায় ডুব দিয়েছি কিন্তু তা এখনও নির্ভরতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি। মনের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া এতোসব প্রশ্ন ঝড়ের পূর্বাভাস দেয়। ভাবনার গভীরতার মধ্যেই দিনের আলো নিভে যায়; নিয়ন বাতির আলোক রশ্মি ভেদ করে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আরও বড় হয়ে দ্বিগুন বেগে মাটির বুকে পড়ে পড়ে ক্ষত তৈরি করছে; মাটি তার আপন নিয়মেই এই ক্ষতগুলো আড়াল করে ভেতরের ক্ষত পুষে রাখছে; যেনো এক অসীম বেদনার ভার বয়ে চলছে জীবনভর!
কলিং বেলের শব্দে পুথির ভাবনার জগতে একটা চির ধরে; ব্যালকনি থেকে সরতে চাইছে না পুথি; তাই মা-ই দরজাটা খুলে দিলো। একটা বিস্ময়ের বলিরেখা পুথির মায়ের চোখে মুখে দেখা দিলো। চিরচেনা ঘরের পরিবেশটা বদলে গেলো একমুহূর্তে।
পুথির মা কিছু বলতে পারলো না মুখে; পাথরের মতো শুধু দরজায় দাড়িয়ে রইলো। কি হলো মা? কে এলো? কিছু বলছো না যে? একসাথে এতগুলো প্রশ্ন ছুড়ে দিতে দিতে মায়ের কাছে এলো পুথি। এসেই দরজায় দাড়ানো একজন পুলিশ অফিসারকে দেখে পুথি কিছু বুঝতে পারছিলো না। বাড়িতে পুলিশের আগমনে পুথি বিস্মিত হওয়ার সাথে সাথে কৌতুহলী হয়ে উঠলো।
ভেতরে আসতে বলবেন না? পুথির মাকে লক্ষ্য করে এই প্রশ্নটা করলো পুলিশ অফিসার। পুথির মা কোনো জবাব দিতে পারলো না, কেবল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। বাহিরে ভারি বৃষ্টি; আকাশের বুক খালি করে বৃষ্টির ফোঁটা মাটির সাথে যে তাল তৈরি করছে কেবল সেই হাহাকার পুথির মায়ের কানে আসলো, আর কোনো শব্দ তাকে ছুঁতে পারেনাই। যেনো পৃথিবীর সমস্ত আয়োজন এক লহমায় নিরব হয়ে গেলো। বিধাতা কোনো কোনো সময় তার সৃষ্টিকে নিয়ে খুব খেলতে ভালোবাসে, তাই নিজেই মাঠ প্রস্তুত করে দিয়ে দর্শক সেজে বসে থাকে।
“অবশ্যই, ভেতরে আসুন’ বলেই পুথি তার মাকে দরজা হতে একটু সরিয়ে নিতেই পুলিশ অফিসার ভেতরে প্রবেশ করলো। পুলিশ অফিসার ঘরের ভেতরে ঢুকেই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ পুথির বাবার ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ালো। ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ছবিটা খুব যতœ করে পুথির মা আগলে রেখেছে প্রায় বারো বছর ধরে। পুথির বয়স যখন আট বছর, তখন এমনই এক বৃষ্টিস্নাত ঝড়ের রাতে বাহির হতে তার বাবা আর ঘরে ফিরে আসেনি। আজও তার বাবার কোনো খোঁজ পায়নি তারা। দীর্ঘ বারোটি বছর পুথির মা বুকের ভেতর পাথর বেঁধে মেয়েকে আগলে ধরে বেঁচে আছে।
পুলিশ অফিসারকে দেখে মা এমন অস্বাভাবিক হলো কেন? এর আগেও অনেক পুলিশ অফিসার বাসায় এসেছে তার বাবার মামলার তদন্ত করতে ; তার মাকে যথেষ্ট সহায়তা করতেও দেখেছে সে কিন্তু আজ এই অফিসারকে দেখে তার মা কেমন হয়ে গেলো; কোনো হিসাব মিলাতে পারছে না পুথি। মাকে ড্রয়িংরুমে রেখে পুথি নিজেও সোফায় বসলো মায়ের সাথে। এমন সময রাতুল পুথির মোবাইলে একটা কল দিলো।
“তুমি আসো, আমি আসছি’ বলে পুথি ফোন কেটে দিলো। বেশ কিছু কথাবার্তার মাঝে পুলিশ অফিসার পুথির নামসহ আরো কিছু জিজ্ঞাসা করলে পুথি তার জবাব দিলো।
মা, আমি একটু যাবো আর আসবো। রাতুল আসছে; জাস্ট দেখা করেই চলে আসবো।
‘ঠিক আছে তাড়াতাড়ি চলে এসো’; অনেকক্ষণ পর এই ক’টি কথা পুথির মায়ের মুখ হতে বের হলো।
ঠিক আছে মা, আমি আসছি বলে দ্রুতই বেরিয়ে গেলো পুথি।
শুনশান নিরবতা ঘরময় বিরাজ করছে; বাহিরে বৃষ্টির উলঙ্গ নৃত্য কিছুটা কমেছে। জানালার ফাঁকে বাতাসের সাথে বৃষ্টির নিমগ্ন খেলা প্রত্যক্ষ করছে পুথির মা। মুখোমুখি বসে আছে দুজন মানুষ তবু পিনপতন নিরবতায় নিঃসঙ্গ বেদীর তলে অজানা আশঙ্কার স্রোতে তীর ভাঙ্গা ঢেউয়ের মতো পুথির মা’র হৃদয় ভেঙে চলছে অবিরত।
কে আগে কথাটা শুরু করবে তা আর ঠিক করতে পারছিলো না কেউ। হঠাৎ পুলিশ অফিসার নিরবতা ভেঙ্গে বলে ফেললো, ‘মেয়েটা কি তোমার, শালিনী ?’
হ্যাঁ, একমাত্র মেয়ে; কেমেস্ট্রিতে অনার্স করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
‘সুখেই আছো তাহলে, শালিনী! এতোদিন পর্যন্ত একবারও আমার খবর নিতে মন চায়নি?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহুল কথাটা বললো।
শালিনী কোনো উত্তর না দিয়ে নতশিরে কেবল মেঝের উপর জীবনের ¯্রােতর ধারা বয়ে যাবার অগণিত রেখা গুনছে; এভাবে নিজের একটা অসম্পূর্ণ অতীত সামনে বসে থেকে নিজের মনের গভীরে চাপা পড়ে থাকা বেদনাকে খুড়ে খুড়ে তুলবে তা ভাবতে পারেনি শালিনী ।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শালিনী জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কেমন আছো, রাহুল?
আছি, যতটুকু থাকলে আমার আমিকে চেনা যায়, ঠিক ততটুকু ; রাহুলের কথাটা শেষ না হতেই শালিনী আবার জানতে চাইলো,
‘তোমার স্ত্রী কি করে? ছেলে মেয়ে ক’জন? ওরা কি তোমার সাথেই থাকে?
একটা অট্টহাসি দিয়ে রাহুল বললো, এতোসব প্রশ্ন একসাথে করলে কোনটার যে আগে উত্তর দেই তা বুঝতে পারছিনা। শালিনী অনেকদিন পর রাহুলের এই অকৃত্রিম হাসিটা চুরি করে একনজর দেখার সুযোগ পেলো। পৃথিবীর বুকে এমন কিছু সৌন্দর্য মাঝে মাঝে এসে হাজির হয়; তাকে সরাসরি দেখতে পারলেও লুকিয়ে দেখার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ থাকে; সেটা কেবল মনের গহীনে শান্ত ¯্রােতের মতো বয়ে যায়। তার কোনো তান্ডব নেই, তবে এটিই নদীর প্রাণে জল সিঞ্চন করে। কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে বাদাম খাওয়া, কথার ছলে রাহুলের প্রায়শই হেসে ফেলা; এইসব ভাবতে ভাবতে শালিনী এক নস্টালজিয়ায় ডুব দিলো।
কিছু ভাবছো শালিনী? মনে মনে ভাবছো তোমার সুখ নষ্ট করতে কেন আবার এলাম? ভয় পেয়ো না আমি তোমার সুখ নষ্টের কারণ অতীতেও ছিলাম না বর্তমানেও হবো না। রাহুলের মুখে কথাগুলো শুনে একটা নাড়া খেয়ে শালিনীর চেতনা ফিরে এলো।
‘কি হলো; কিছু বলবে না বুঝি?’ রাহুলের কাছে উল্টো শালিনী আবার আগের প্রশ্নটার উত্তর জানতে চায়। তোমার যদি বলতে বাধা থাকে দরকার নেই; শালিনীর এই জিজ্ঞাসায় একটা অভিমান আছে সেটা বুঝতে পারে রাহুল।
আমার এমন কিছু নেই যে বলার মতো। আমি খুবই একা; বলেই রাহুল কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলো।
একটা বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস শালিনীর বুকের ভেতরে নোঙর ফেলা দীর্ঘ তেইশ বছরের সংসারের ভিতকে একমুহূর্তে টলিয়ে দিয়ে গেলো। কিছু বলতে পারছে না একটা তীব্র অভিমান আর ঘৃণায় নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো তার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শালিনী আবার বলতে লাগলো-
একা কেন? বিয়ে করোনি! এখানে কবে এলে? তারপর, আমার ঠিকানাই বা পেলে কীভাবে? এমন আরও কিছু কৌতুহলী প্রশ্নের মাঝে কথোপকথন চলতে থাকে দুজনের। গঙ্গা যমুনার সঙ্গমস্থলে যেমন তীরভাঙ্গা ঢেউয়ের এক অনুরণন বাজে; তেমনি বহুদিন পর দেখা হওয়াতে এক পোড়া অতীত খুড়ে খুড়ে দুজনেই বেদনার মাঝে সুখ খুঁজতে থাকলো। শালিনীর মনে পুথির ফিরে আসার এক আশংকা মাঝে মাঝে উঁকি দেয়; তবুও কথোপকথনের প্রবাহে কোনো ছেদ পরেনি।
তোমার ঠিকানা খুঁজে পাওয়া অনেকটা নাটকীয় বলতে পারো, শালিনী। থানায় মামলার সব পুরনো ফাইল খুঁজতে খুঁজতে এই ফাইলটাকে আমার কাছে অনেকটা রহস্যজনক মনে হলো। লোকটা মিসিং এতোদিন কিন্তু কোনো তদন্ত হয় নাই; এই ঘটনার সুত্র ধরেই এই বাড়িতে আসা। আমি জানতাম না ভদ্রলোক তোমার স্বামী; এসে তোমার মুখোমুখি হতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।
শালিনী খানিকটা চুপ রইলো; কোনো জবাব দিলো না; খানিক পরে মাথা তুলে বললো, হ্যাঁ, কোনো তদন্ত হলো না কেন বুঝলাম না! আমি ও পুথি এটি নিয়ে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছি কিন্তু কুলকিনারা পাইনি।
আচ্ছা শালিনী, বলোতো যখন উনাকে পাওয়া যায় নাই তখন তো তুমি উনার ফোনে কল দিয়েছিলে? তখন যে লোক ফোনটি ধরেছিলো; তুমি কি লোকটিকে চিনতে পেেেরছিলে?
না রাহুল, চিনতে পারলে তো অনেক আগেই জট খুলতো এই রহস্যের।
ঠিক আছে, এতো বিচলিত হইও না ; যেহেতু আমি এখানে আছি এর রহস্য উন্মোচিত হবেই।
তারপর পুলিশের নিজস্ব কৌশলে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের মাঝে সময় কিছু কেটে গেলো। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে শালিনী উঠে এসে দরজা খুলে দিলো। ঘরে ঢুকেই পুথি পুলিশের কাছে গিয়ে তার বাবার হারানোর রহস্য নিয়ে বিস্তারিত অনেক কথা বললো।
পুথি, কোনো চিন্তা করো না আমি এর রহস্য উন্মোচন করবোই; এবং এর শাস্তি নিশ্চত করবো। মা, তুমি স্যারকে কিছু আপ্যায়ন করো নি?
ঠিক আছে আপনারা বসুন, আমিই ব্যবস্থা করছি। পুথি উঠে গেলে শালিনী তার ডাগর দুটি চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে রাহুলের দিকে। কী এক বেদনা ভরা অসাহায়ত্ব নিয়ে শালিনী তার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা রাহুল বুঝতে পারে। রাহুলের মনের ভেতর তোলপাড় চলছে; মনে হচ্ছে একবার জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিয়ে শালিনীর কোমল চুলগুলোতে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে একটু আদর করে। নিয়তি তার নিষ্ঠুর খেলায় সারা জীবন মানুষকে জীবনের অংক সহজভাবে করতে দেয়নি; তাইতো মানুষ আজীবন তার দাস হয়ে আছে।
শালিনী তোমার দীঘল-কোমল চুলগুলি কি এখনও মাঝে মাঝে ছেড়ে দাও? এখনো কি বৃষ্টির দিনে গোলাপি শাড়ি পড়ে চুলগুলো খোঁপা বাঁধো; যা তোমার মরাল গ্রীবার একাপাশ ছুঁয়ে ছ্ুঁয়ে শোভা ছড়ায়? এরকম হাজরো প্রশ্ন মনে তোলপাড় করছে রাহুলের কিন্তু বলতে পারছে না; কোথায় যেনো বাধা। কিছু ঢেউ এমনিতে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই আসে; তীর ভেঙ্গে জমি, ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কেবল পড়ে থাকে চিহ্ন। আজ অনাহুত তীব্র ঢেউয়ে রাহুলের সব যেনো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে; এখনও ঢেউয়ের তা-বলীলা শেষ হয় নি। জলের মধ্যে ভাসছে কেবল সাদা সাদা সফেন। খানিকপরে রাহুল নিজেকে সামলে নিয়ে অনেক প্রশ্নোত্তর শেষে বললো, ‘তোমার সব কথাই শুনলাম, শালিনী; কিন্তু যতীনকে তো আমার কাস্টডিতে নিয়ে এসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলাম।’
একটা বজ্রপাতের আওয়াজ যেমন কানের ভেতরে প্রবেশ করলে তার শব্দের ব্যপকতা নিরুপণ করা যায় না; যতীনের নামটা শালিনীর কানে আসতেই কানের ভেতরটায় এমন বিকট শব্দ হলো। কোনো উত্তর নেই, কেবল শালিনীর চোখ গড়িয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়তে লাগলো।
‘আমার কোনো উপায় ছিলো না, রাহুল। মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে এর কোনো বিকল্প ছিলো না’ বলেই শালিনী হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো।
মায়ের কান্নার শব্দ শুনে পুথি দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দিতে লাগলো; কিছু সময়ের মধ্যে শালিনী নিজেকে সামলে নিয়ে পুথিকে আপ্যায়নের কিছু নিয়ে আসতে বললো। পুথি চলে যাবার পর শালিনী রাহুলকে উদ্দেশ্য করে বললো, আমার অপরাধের যা শাস্তি হবে তা মাথা পেতে নেবো। তুমি সঠিক তদন্ত রিপোর্ট দাও; এ বিষয়ে আমার কোনো আর আপত্তি নেই। কিছু আত্মসমর্পণের ভেতর লুকিয়ে থাকে এক তীব্র অভিমান, শুধু অনুভুতি দিয়েই কেবল এর বিচার চলে। আদালতের কাঠগড়ায় তার বিচার করা যায় না।
সম্পর্কের যোগবিয়োগ কোনো কোনো সময় নিজের দায়িত্বটুকুর প্রতি চরম অবহেলা বয়ে নিয়ে আসে; এর থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। রাহুল শালিনীর মুখ হতে ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনে নিজেও খানিকটা আবেগাপ্লুত হয়ে গেলো।
ঠিক আছে শালিনী, এই ফাইল আর কোনোদিন কেউ খুঁজে পাবে না; আমি এই ব্যবস্থা করবো। তুমি এ নিয়ে কোনো টেনশন করো না।
শালিনীর চোখ দিয়ে কেবল জল গড়িয়ে পড়তে থাকলো। কোনো শব্দ নেই তার। আসলে, কিছু ভাঙার কোনো শব্দ থাকে না; কেবল অনুভব হয়।
কিছুক্ষণ পর পুথি একটি ট্রেতে করে খাবারের রকমারি আয়োজন নিয়ে এসে পুলিশ অফিসারের সামনে দিলো। অফিসার কিছু নিলো, সাথে পুথিও। কথাপকথনের শেষ অংশে শালিনী রাহুলের মোবাইল নাম্বারটা চাইলো। রাহুল মোবাইল নাম্বারটা শালিনীকে দিয়ে বিদায় নিলো। গাড়ি পর্যন্ত মা-মেয়ে দুজনই রাহুলকে এগিয়ে দিয়ে আসলো।
শালিনী ঘরে ফিরে এসে দেখে সারাটা ঘর যেনো ফাঁকা; একটা তীব্র ঝড়ে সবকিছু উলাট পালট করে দিয়ে গেলো। আসবাবপত্র, বিদ্যুতের আলোতে আগের মতোই শোভা ছড়াচ্ছে কিন্তু আগের সেই প্রাণ নেই। রাহুল এসে এতো বছরের একটা অজানা আশঙ্কার শেষ করলো ঠিকই কিন্তু প্রাণটা কেড়ে নিয়ে গেলো।
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ব্যাঙ ডাকছে আপন মনে আরও বৃষ্টির তৃষ্ণায়, সাথে ঝি ঝি পোকার ডাক; এক অভিমানী রাতের তীব্র দহনের মাঝে শালিনীর অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ পথহারা পথিকের মতোই ঠিকানা খুঁজে ফিরছে। রাতের অন্ধকারে নিয়ন বাতির আলোতে গাছের পাতার ভেজা উপরিভাগে শালিনী নিজের জীবনের প্রতিবিম্ব দেখছে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। সাদা সাদা বুদবুদের মতোই চিন্তারা জাগছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা পর তার মোবাইলে একটা কল এলো। শালিনীর নামটা ধরে ডাকতেই জড়ানো কণ্ঠে সে বলে উঠলো ‘আবার কবে আসবে রাহুল..?’
পদাবলি
এই শহরে
আহমাদ সোলায়মান
এই শহরের প্রেম বাঁচে না প্রসবকালেই মৃত্যু হয়
এই শহরের অন্ধকারে রাত্রিগুলোর করুণ ভয়
এই শহরের উচু দালান হৃদয়গুলো করছে জয়
এই শহরের মানুষ যারা সবাই গভীর পরাজয়।
এই শহরের নিয়ন বাতি ঠিক হৃদয়ের অনুরূপ
এই শহরের কুকুরগুলো রাত্রি হলেও থাকে চুপ।
এই শহরের প্রেমিক বুকে স্মৃতি পঁচার গন্ধ খুব
এই শহরের ঠোঁটে ঠোঁটে পাতা আছে মৃত্যু টুপ।
এই শহরের শব্দগুলো বুক ফাঁটানো কথা কয়
এই শহরের আলো-বাতাস মহামারির বন্ধু হয়
এই শহরের অন্তরের লাশ রাস্তাঘাটে পড়ে রয়
এই শহরের রাত্রিগুলো লক্ষ তারার বন্ধু নয়।
এই শহরের এমন দশা খুব পুরনো এমন নয়
যখন তুমি বদলে গেছো তখন থেকে এমন হয়।
সম্পর্ক
মো. রাজিব হুমায়ুন
সম্পর্কে অনেক দ্রুত পচন ধরে যায়।
খুব সহজে পতিত হয় ঝরা ফুলের মতো,
পচন রোধে সম্পর্কে ফরমালিন ছিঁটায় কেউ কেউ!
ফরমালিন যুক্ত সব সম্পর্ক সতেজ হয়
এই টাটকা সম্পর্কে-
আড়াল থেকে বিষিয়ে তুলে সর্পাঘাত।
তাই সম্পর্কটা চাই-
ফরমালিন মুক্ত তাজা হৃদয়ের বন্ধনে বাঁধা সম্পর্ক।
আরতি ভেঙেছে রণে
মাহতাব উদ্দিন
আকাশের বিয়ে আজ
চারিদিকে দেখি সাজ
চাঁদ বর সাজে
বাজে বীণ বাজে
যাবো সেথা ফেলে কাজ।
নিভৃতে উদলা পায়ে
চলে যাই দূর গাঁয়ে
নিখিলের পানে
চারুতার টানে
চলি সততার নায়ে।
বাহারি হিজলবনে
হরিতের আবরণে
শতফুল ফোটে
মধুকর ছোটে
আরতি ভেঙেছে রণে।
মালিকানা
সুস্মিতা ঘোষ
কিছু স্মৃতির গলিতে আবেগের একটা বাড়ি থাকে।
বাইরে একটা প্রায়-প্রয়াত সম্পর্কের রঙচটা নেমপ্লেট,
ঘূণ ধরা দরজার কড়ায় মরচে পড়া তালা ঝুলছে,
উপন্যাস না হয়ে কিছু টুকরো টুকরো গল্প গড়েছে ঘর ।
পলেস্তারা খসা বাড়ির দেওয়াল,
অতীতে কত না সৌন্দর্যে হয়েছিল আশ্রয়।
সুখ-সংসার-পিছুটান অভিজ্ঞতায় জমেছে মাকড়সার জাল ।
দেওয়ালের দক্ষিণে টাঙানো আলোকচিত্র ,
লালচে কমলা সূর্যাস্ত বুকে ঘর ফেরা পাখি দুটো ক্ষণিক স্তব্ধ হল;
যেন সকৌতূহলে চেয়ে আমার চোখের শূণ্যস্থানের দিকে।
উৎসবমুখর কোনো এক সন্ধ্যায় হঠাৎ ফ্ল্যাশব্যাক...
যেন এক গামলা দুধে কেউ ঢেলে দিয়েছে এক বিন্দু গাঢ় নীল রঙ !
সমস্ত বিস্ময় চিহ্ন বিস্মিত হয়ে চেয়ে আছে,
বাকরুদ্ধ ঠোঁট ক্রিয়াহীন এক পল।
এক নিমেষে চোখের সাদা জলমগ্ন বন্দর,
ঠোঁট ঠেলে তবু হাসির ঢেউ।
স্মৃতির গলিতে বাড়ি কিনে নিঃস্ব হয়েছি,
হয়েছি মালিক প্রয়াত সম্পর্কের, আবেগের।
মুক্তোর বিলাপ
তারানা নাজনীন
ভালোবাসি... ভালোবাসি... তোমাকেই ভালোবাসি...
বিশাল সাগরের বুকে তাইতো ঠাঁই নিয়ে আছি
কতশত বছর ধরে সয়েছি ঝড় জলোচ্ছ্বাস সুনামি
কখনোই ভাবিনি তোমাকে একদিন ছেড়ে যাবো আমি।
হঠাৎ করেই এক মাঝির জালে জড়িয়ে গেলাম
নাম না জানা মাছের ভীড়ে নিজেকে খুঁজে পেলাম
চুপটি করে খুব যতনে
আমাকে রেখে দিলো মাঝি অতি গোপনে।
প্রতিদিন প্রতি রাতে, ঝিনুকটি তুলে দুহাতে
মুক্তো আছে জেনেও মাঝি নেয়নি তার প্রাণ
ভাঙ্গেনি তার শক্ত আবরণে ঢাকা খোলসের সান।
মুক্তো হাসিয়া বলে; তবুও সর্বনাশ!
হীরার টুকরো মাঝির কাছে বন্দী বারো মাস।
কথা হোক
অসীম মালিক
কথা হোক,
মাটি-জলে
বীজ-মাটি
ফুল-ফলে।
কথা হোক মুখোমুখি,
মেঘ-রোদ চোখাচুখি।
ডালপালা
দোলাদুলি।
ঝড় এলে
কোলাকুলি।
কথা হোক মাটি মূলে,
ভোর হোক ফুলে ফুলে।
জনে জনে
মনে মনে
দেশ কাল
সীমা ভুলে।
কথা হোক,
পাখি-মনে।
ঘুড়ি সুতো
দুই জনে।
কথা হোক ওড়াউড়ি,
সীমাহীন ঘোরাঘুরি।
ডানা মেলে,
সীমা ভুলে।
পাখি ওড়ে
সুতো ভুলে।
কথা হোক স্বাধীনতা,
মেঘ, রোদ- মানবতা।
ঘুড়ি থেকে
পাখি হয়ে।
ডানা মেলি
ঝড় সয়ে।
কথা হোক,
সাঁঝতারা,
রাতপাখি
শুকতারা।
কথা হোক খেয়াঘাট,
জোছনার মাঠঘাট।
রাতজাগা,
শুকসারি।
লালপরী,
নীলপরী।
কথা হোক জানালায়,
খোলা দু’টি দরজায়।
ঘরে ঘরে,
দোরে দোরে।
রাতজাগা,
পাখি সুরে।
কথা হোক,
ভালবাসা,
হাতে হাত
আলো আশা।
কথা হোক পাশাপাশি,
ভালবাসা হাসাহাসি।
অনুরাগে,
অভিমানে।
ক্ষোভ ভুলে
গানে গানে।
কথা হোক খোলামনে,
পৃথিবীর কোণে কোণে।
বেলিফুলে,
জুঁই ফুলে।
কথা হোক
মাটি-মূলে।
ওরা ভেজে বৃষ্টিদিনে
সাদিক আল আমিন
সমূহ বৃষ্টির উপগান নিয়ে লিখছি কবিতা
আর ভিজে যাচ্ছে আমার শুকনো পাতাদের শরীর
ওরা বলতে চেয়েও পারছে না বলতে কোনো লুকোনো গোপন
অথবা কোনো ছেড়ে আসা জলপদ্মের আত্মগ্লানি
ওরা শুধুই ভিজতে থাকে কাকভেজা বৃষ্টিদুপুরে
মুছে ফেলতে থাকে ঘোর অনুতপ্ততার অভিশাপ
কেবল জড়াতে থাকে দেহে মেঘশিলা অথবা কোনো
অবহেলায় পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার হিম-লাল
বৃষ্টির উপগান লিখে লিখেই
ভিজছে আমার হলুদ খড়, গলে যাওয়া জৈব-গবর
ভিজছে বাঁশঝাড়, শীর্ণ পাটকাঠি, খড়িঘর, নড়বড়ে মাচাঙ
ওরা সবাই ভিজছে লুকিয়ে লুকিয়ে, চাইছে হতে
কচুপাতা, কলাপাতার মতো; যাতে
দুঃখ ঝেড়ে ফেলা যায়...
আমি কি কখনো চেয়েছি দুঃখ ঝেড়ে ফেলতে?
বৃষ্টিধারা সব লুকিয়ে বলে তোমার কানে কানে
বোনের ঘরে সিঁদ কেটেছি
কামাল আহমেদ
আর কোনদিন বলিস্ না মা করতে গোসল;
তুইনা যদি পুত হবি।
তোর প্রশ্রয়েই সাদা হাতে কালি মেখেছি,
লক্ষ বোনের যোনিঘরে সিঁদ কেটেছি!
-সে কালি আর মুছব না;
তুই যদি মা মোড়লিপনার লোভ-না ছাড়িস্।
যোনি চোরের লালন করে লাভ কি রে তোর?
তুই না রোজ স্বপ্ন দেখাস্ আকাশজুড়ে ডানা মেলে,
সাত সমুদ্দুর সেতু বেঁধে,
আঁধার পথে আলো জ্বেলে ?
উড়তে আমি চাইনা মা আর
ডিঙ্গিতেই সাগর দেবো পাড়ি
এমন আলোর চেয়ে কালোই ভালো।
দোহাই মা তোর, কালিমাখা হাত কেটে নে...
এহাত আমার রাখবোনা !
ঘেন্না লাগে আপন কাজে!
সিঁদ কেটেছি! ছি !!
দিনের আলোয় কেমন করে মুখটা দেখাই? ছি !!!
মদিরাক্ষী সিরিজ : রাবাত রেজা নূর
মদিরাক্ষী সিরিজ
রাবাত রেজা নূর
১
সুঁইচোরা উড়ে যায় পূবের
বাতাসে সাকিনের গভীরে
আমার ঘরের বাস্তুসাপ
পূঁজা দেয় মদিরাক্ষীমন্দিরে
দূরের পথ ধরে আরো দূরে
যাওয়া যেখানে গভীর বন
তুলোর পাতায় গাঢ় হাওয়া-
ধূলোর উজানে নদী তীরে
পটোলের ক্ষেতে হলুদপাখি
বিরহ বাতাসে উড়ে মথ-দেবী
হৃদয়ের নৈবেদ্য কোথায় রাখি?
মদিরাক্ষী মন্দিরে জড়ানো লতা
পূবে আমার মেটো ঘরবাড়ি-
সুরধুনীনদী অন্ধ প্রেমপূজারি
কত জলকত নদীগন্ধবণিক
ভেড়ায় তরী পারসিয়া বন্দরে
আমার তরী বেরহম হাওয়ায়
আটকে গেছে মদিরাক্ষী মন্দিরে!
২
ভেড়াদের খুরের হাওয়া
সূর্যের বিপরীতে ধূলি
আচমকা ছুটে আসা তীর
বালিতে সাপের ঝুনঝুনি
এই যে কাফেলা- হাওদায়
বসে থাকা চাঁদ- বেদুইন
তার ছেড়ে দেয় গলাসান্দ্র
হাওয়ায় আঁটকে যায় রাত
মরুজোছনায় তারাফুল
মালাবালি ক্যাকঁটাসে
জোছনায় পায়ের ছাপ
রেখেকে যায় কে আসে?
আজানের ধ্বনি পাগড়ি
নুয়ে পড়ে ভেড়াদের ভীড়ে
এই যে কাফেলা চিরপ্রেম
ক্যারাভেন পৌঁছাবে তীরে?
৩
ফুলের পরাগে মাখামাখি ঠোঁটে
মৌটুসী অতসীফুলের আয়ু
পৃথিবীর সেরা ফুল ফোটায়
মায়ের জরায়ু। কসমগাভীন
জমিন ঘোড়াদের লোহাখুর
দেহবড়শিতে আটকায় মীন
সমুদ্রসঙ্গমে জরায়ু কতদূর?
পুরুষীপুরাণের বয়ান কসম
প্রেয়সীর শেষ চুম্বনচিরচেনা
পথনিশাচর দীর্ঘশ্বাসে উড়ে
যায় ইশকের কবুলিয়া মথ
পাজরের হাড় খুলে প্রেয়সী
মুহব্বতের সুতা ধুনকামসুর
ভেসে আসে আরশে আজিম
থেকে দেহরাঙা বলি ফাগুন
ছুরি বিনা চাহনিতে- পুরুষী
করে ধীরে ধীরে আদমকে খুন
‘লা তাকরাবা হাজিহিশ শাজারাত’
ঐ বৃক্ষের নিকটে যেও না খেয়ো
না তার ফলগন্দম বৃক্ষের গহীনে
আগুনফুটে ফুল প্রেমের নাজাত
‘লা তাকরাবা হাজিহিশ শাজারাত’
৪
স্মৃতির আলপথ ঘেঁষেবক
উড়তেছে তোমার কার্ণিশে-
স্বর্পগন্ধা ফুলে একাকার
হৃদয় দিয়েছি কাঠবার্ণিশে
একটা হরিণ দূরে হাটে একা
সিনায় ঘাসের উতলিগন্ধ
কে কবে দেখেছে চাঁদরুপ
আমি তো জন্ম থেকেই অন্ধ-
নদীতে জল আসে মিটিমিটি
ঢেউ ছুড়ে দেয় কোমলপেয়ার
একটা কাক দূরে ভিজে একা
ছিল না কিছু তোমাকে দেওয়ার
লাউডুগি জড়িয়ে ধরে মায়ের
আঁচল উড়ে যায় মেটেঘুঘু-
আমার জমিনে হৃদয়কাটা
পোকাদের বাস ফসলশূন্য ধূ ধূ
একটি কলমের আত্মকাহিনী !
একটি কলমের আত্মকাহিনী
সরোয়ার হোসেন
কলমই সব, কলম ছাড়া এ পৃথিবীর কোন কিছুই লিপিবন্ধ করা সম্ভব নয়। কথাটা শুনলে অবাস্তব মনে হলেও এটাই পরম সত্য কথা। শহরের পিচঢালা রাস্তা থেকে শুরু করে বড়-বড় অট্টালিকা তৈরির পেছনে এ কলমের অবদান রয়েছে। কারণ, এ কলম দ্বারা আগে ঐ সব অট্টালিকার চিত্র অঙ্কন করা হয়, তারপর সে অট্টালিকার কাজ শুরু হয়।
তেমনি যারা আজ বিভিন্ন রাষ্ট্র পরিচালনায় রয়েছে তারাও এ কলমের কাছে ঋণী। কেননা তারা যে বড় বড় বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করেছে; সে মহা মূল্যবান বইগুলোও কলমে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল।
ছোট্ট একটা খেলনা থেকে শুরু করে পারমাণবিক তেরির ক্ষেত্রে এ কলমের ভূমিকা অপরিসীম।
একবার ভাবুন, এ কলম ছাড়া কী চলে। এ জগতের কিছুই কলম ছাড়া চলে না। সকল ধর্মের বড় বড় ধর্মগ্রন্থ গুলোও আগে কলমে লেখা হত।
রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে সকল কাজে কলমের গুরুত্ব অপরিসীম।
কলম আবার বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। কোনটা শুধুমাত্র নাম লেখার জন্য, কোনটা সর্বত্র লেখার জন্য আবার কোন-কোন কলম আছে যেটা লেখার জন্য নয়। সেটা সারা জীবন কোনো স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য। আর এই কলম যে স্মৃতি বহন করে বেড়ায়, পৃথিবীর কোন কিছুই যেন তা বহন করতে পারে না।
কারণ, প্রেমিক যদি তার প্রেমিকাকে একটি চিরকুটও লেখার মনোভাব প্রকাশ করে, সেখানেও কলমের উপস্থিতি সর্বাপেক্ষা।
আর আজকাল প্রেম ভালোবাসা এগুলোকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। দেখবেই না বা কেন? এ জগতে ভালোবাসার মানুষ হয়তো অনেকই খুঁজে পাওয়া যাবে তবে সংসার করার মত মেয়ে বা মন জয় করবার মত মেয়ে খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন।
প্রত্যেক মানুষের মনেই তাহার ভালোবাসার মানুষের ছবি অংকিত আছে। আর সে সেই অংকিত রূপকে চিরজীবন খুঁজে বেড়ায়। যদি সে তার ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পায় তবে তার জীবনটা যেন স্বর্গ সুখে ভরে যায়। তেমনি কেউ যদি তার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলে তবে তার জীবনটা যেন মেঘের ছায়ার মত ঢেকে যায় অন্ধকারে।
সাঁঝের বেলা বাইরে ঝিমঝিম বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘরের টিনের চালের উপর বৃষ্টির ফোটাগুলো মনে শিহরণ জাগিয়ে তুলল। বৃষ্টির সময়টুকু লিখতে যেন মনের মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আপনা-আপনি মাথার মধ্যে হাজারো ছন্দমালা ঘুরপাক খায়।
বারান্দার ওপাশে ছোট্ট একটা ঘর করেছি, আর সেটাকে বই সাজিয়ে পাঠাগার করেছি। ইচ্ছা হলেই সেখানে গিয়ে বই পড়ি, কিছু লিখি। এ সময় হয়তো সেখানে গিয়ে লিখতে মন্দ লাগবে না।
সন্ধ্যা হয়নি, বাকিও নাই। ধীরে-ধীরে পাঠাগারে দিকে এগিয়ে গেলাম। মন দিয়ে লিখতে শুরু করলাম। শব্দের মিলন যেন মাথায় সহজেই আসছিল। আর আমি গভীর মনোযোগী হলাম কাব্য রচনায়।
সহসা দরজা খোলার শব্দ পেয়ে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। কলম থমকে ওদিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম । তুলি আজ তার সাদা শাড়িটা পরেছে, কপালে ছোট্ট করে টিপ দিয়েছে। মাঝে মধ্যে তুলি তার এ শাড়ি পরে তাকে দেখতে চমৎকার লাগে শাড়িতে। কেননা আমি তাকে বলেছি, এ শাড়িতে তাকে অসম্ভব সুন্দরী লাগে। আজ অনেক দিন পর ঢাকা থেকে এসেছি, তাই হয়তো তুলি আমাকে সারপ্রাইজ হিসাবে এটা পরেছে।
কিছুটা মোহ নিয়েই তার দিকে তাকালাম। কেননা সে তো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া আমার লেখালেখির রুমে আসে না। বিশেষ করে পাঠাগারে থাকলে সে তো ডাকবেই না।
তুলি মিষ্টি করে হেসে বলল,
-আমি কী বিরক্ত করলাম।’
তুলি খুবই ভালো মনের একজন মানুষ। বিয়ের পর একটা মেয়ে তার স্বামীর কাছ থেকে যতটা আবদার থাকে তুলির আবদার তার চাইতেও কম। সে আমার মনের অবস্থাটা বুঝে সকল আবদার করে। কোনো বিষয় নিয়ে কখনো বাড়াবাড়ি করে না। সে জানে লেখালেখি আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। তাই যখন লেখালেখিতে গভীর মনোযোগ থাকে তখন সে একাকীই বসে থাকে। এ গুলো নিয়ে যেন তার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। সে অল্পতেই অনেক খুশি থাকে। যে মেয়ে অল্পতেই অনেক খুশি থাকে এমন একটা বউ পেলে কে না সুখী হয় ।
তেমনি তুলিকে নিয়ে আমি যেন এ পৃথিবীর মহাসুখী একজন মানুষ।
আমি বললাম,
-না, না, বিরক্ত করবে কেন? আসো বসো!
আমার পাশের চেয়ারে বসল, আমার দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকাল। বুঝতে পারলাম সে কিছু একটা বলতে চায়।
আমি বললাম,
-কিছু বলবে কি?’
সে মৃদু হেসে বলল,
-তুমি কী আমার জন্য কখনো কলম এবং চুড়ি কিনেছিলে, না-কী দিতে মনে নেই তোমার।
তুলির মুখে হঠাৎ এমন আজব প্রশ্ন শুনে অবাক হলাম! হেসে বললাম,
-না তো! হঠাৎ এ কথা কেন?’
-না মানে, তোমাকে না বলে, তোমার ব্যক্তিগত ওয়ারড্রবটা পরিষ্কার করতে গিয়ে আমি ভাঙা কাচের চুড়ি আর একটা কলম পেয়েছি।
তুলির কোনো কথাই যেন আমার মাথায় ঢুকছে না সে সময়।
-কি বলো এসব চুড়ি আর কলম? কোথা থেকে আসল।
তুলি হেসে বলল,
-আরে আমি কী মিথ্যাটি বলছি, নিজেই দেখে এলাম।
-কি বলো এসব আমার তো মনে পড়ছে না, চলো তো দেখি ।
তুলি হেসে বলল,
-না, না তোমার যেতে হবে না। তুমি বরং বসো, আমি নিয়ে আসছি।
তুলি ওর ঘরের দিকে রওনা হল; আমি বসে রইলাম । বিষণœ ভরা মন নিয়ে।
তুলি কী বলছে, তুলির এমন কথা শুনে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। ওর জন্য বিয়ের প্রথম দিকে কত উপহার হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু কত দিন হয়ে গেল ওর জন্য বিশেষ কিছুই কিনা হয় না। ওর প্রতি ভালোবাসাটা হয়তো আগের চেয়ে বেশিই আছে। তবুও বেশি কিছু আনলেও পাগলিটা রাগ করে।’
বলে কেন বাজে খরচ কর, পাগলিটা বেশি কিছু চায় না। একটা ফুল পেলে সে মহাখুশি। পাগলিটা ফুল পেয়ে যতটা খুশি হয় ততটা কোন কিছুতেই হয় না। অবশ্য তাকে আমি মাঝে মধ্যে বলি, আমি বাড়ি আসলে যেন। তোমার হাতে মেহেদি, কাচের চুড়ি, পায়ে আলতা আর শাড়ি পরা দেখি। সে ঠিক তাই করবে। আমার বাড়ি আসার কথা শুনলেই আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এগুলো পরতে ভুলে না কখনো। তাইতো এগুলো কিনে দেওয়ার জন্য সে বিশেষ আবদার করে বসে। তার এ আবদারও আমি পূরণ করি সব-সময়। কেননা সে আমার জন্যই আবদার করে। সে যখন হাতে মেহেদি চুড়ি, পায়ে আলতা আর ধবধবে গায়ের বসনে নিজেকে শাড়ি দিয়ে আবৃত করে আমার সামনে বসে, তখন মনে হয় হাজার বছর আমার কলম দিয়ে তার রূপের বর্ণনা করলেও শেষ হবে না।
বসে বসে এগুলো ভাবছিলাম। তুলি আবারও ফিরে এল। তার হাতে ধুলোমাখা আমার একটি ছোট্ট থলে আছে। সে ঝেড়ে-মুছে তা আমার সামনে রাখলো। সেটা দেখে তো আমি অবাক! এটা তো কত বছরের পুরোনো থলে। ঢাকায় যাওয়া আসার জন্য কিনেছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে এসব আসবে কোথা থেকে?
তুলিকে বললাম ,
-দেখি।’
এরপর থলের ভেতর থেকে তুলি একে একে বের করল, তা দেখে তো আমি অবাক! এটা! তবুও আবার তুলির হাতে। না জানি কি মনে করে তুলি। এটা তো কত বছরের পুরোনো। এখনো আছে। আর থাকবেই না বা কেন? আমি তো স্মৃতি জমাতে ভালোবাসি। কোনো স্মৃতিই আমি মুছে ফেলতে চাই না। তুলির হাতের ওগুলো দিকে আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলাম।
তুলি বলল,
-এগুলো কার?’
আমি যেন চোখেমুখে কিছু লুকাতে চাইছিলাম। তুলি তা বুঝতে পারল।
বলল,
-কোন সমস্যা কি?’
আমি আসলে তুলিকে কখনো মিথ্যা বলি না। তাই এ বিষয়ে মিথ্যা বলতে পারছি না। আমতা-আমতা করে বললাম,
-এগুলো তোমার জন্য আনিনি। বহু পুরনো এগুলো।
-তাহলে কার জন্য এনেছিলে বল।
-তুলি সে অনেক কথা, থাক না ওসব।’
তুলি মায়াবি মুখ করে বলল,
-তবুও আমি শুনবো!’
পাগলিটা শুধু ক্ষণে ক্ষণে ছোট মানুষের মত ছোট ছোট মিষ্টি বায়না ধরে। আমি তার বায়না ফেলতে পারি না।
সে বলল,
-আমি জানি এগুলো আমার জন্য আনেনি, তুমি এগুলো স্মৃতি হিসাবে রেখে দিয়েছ। কিন্তু এগুলো কিসের বা কার স্মৃতি বহন করছে সেটা আমাকে বলবে।
তুলির মুখখানা তুলে বললাম,
-সে অনেক কথা, শুনলে রাগ করবে না তো?’
তুলি মিষ্টি হেসে বলল,
-তোমার কোন কথায় কখনো রাগ করেছি কি?
তখন আমিও চিন্তা করলাম। সত্যিই তুলি তো কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আমার উপর রাগ করেনি,তুলিকে বিয়ে করেছি বছর ছয় হয়েছে। এত গুলো বছরের মধ্যে তার সাথে আমার কোন কথা-কাটাকাটি হয়নি। হ্যাঁ অভিমানের খুনসুটি হয়েছে অনেক। কারণ, যেখানে অভিমান নেই, সেখানে ভালোবাসা নেই।
তাকে নিয়ে যখন ঢাকায় থাকতাম, মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফিরতে অনেক দেরি হত। যদি এতটুকু দেরি তুলিকে ফোন করে না বলি তাহলে অভিমান শুরু করে দেয় আমার উপর। আমি জানি সে আমার উপর অল্পতেই অভিমান করে বসে আর সে অভিমানটা ভাঙাতেও যেন সময় লাগে না আমার। সে চকলেট খেতে খুবই ভালবাসে। দু চারটা চকলেটেই নিমেষেই তার অভিমান ভেঙে যায়। সে অভিমান ভেঙে আবারও মাথা লুটিয়ে দেয় আমার বুকে।
আমি এসব ভাবছি। তুলি বলে উঠল,
-কি হলো বলবে না?’
আমি তাকিয়ে দেখলাম, তুলি অধীর আগ্রহে আমার সামনে বসে আছে। এই ভাঙা চুড়ির টুকরো আর গোলাপি রঙের কলমের আত্মকাহিনি শুনতে। আমি আর দেরি করলাম না। যদিও গল্পটা বিষাদে ভরা, তবুও তুলি আমার সামনে থাকায় সে বিষাদটুকু যেন ঢাকা পড়ে গেল। বলতে লাগলাম ।একটি কলমের আত্মকাহিনি যে কাহিনিটা বিষাদে ভরপুর।
আমি এই কলমটির আত্মকাহিনি বলছিলাম, আর মাঝে মাঝে দেখছিলাম তুলির কী মনোযোগ আছে নাকি মনোযোগ হারিয়েছে। সেটা জানার জন্য মাঝে-মাঝে তাকে প্রশ্নও করছি।
-তুলি তোমাকে তো মায়ার কথা সবি বলেছিলাম।
-হ্যাঁ,
-সব শুনেছি, মায়ার সঙ্গে তো আর তোমার আর যোগাযোগ হয়নি।
-হ্যাঁ,
এটা সত্য। তবে আজকের এই ভাঙা চুড়ির টুকরো, কয়েকটা বরইয়ের বিচি আর এই একটা কলমের কল্পকাহিনির সাথেও মায়া ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে।
তুলি যেন আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে বলল,
-তাই!’ বলো শুনি, সেসব কথা।
তখন আমি তুলিকে সব খুলে বললাম। এর আগে আমি তুলিকে চুড়ি আর বরইয়ের বীজ এর গল্পটা বলেছিলাম সেটা তুলি শুনেছে, তবে হয়ত তার খেয়ালে নেই। তুলিকে বললাম,
-এই চুড়ি হলো সেই চুড়ি যে চুড়ি আমি মায়াকে নিজ হাতে পড়িয়েছিলাম।
তুলি বলল,
-মায়াকে যদি চুড়ি পড়াবেই তাহলে চুড়িটা তোমার কাছে আসলো কিভাবে! তাহলে কি মায়া চুড়ি ফেরত দিয়েছিল।
তুলির বোঝার সুবিধার্থে তখন আমি আরো কিছুটা বললাম তাকে। মায়া যখন চুড়ি আর আলতা চেয়েছিল তখন তার জন্য আমি এসব কিনলাম। আর সেগুলো মোড়াই করার আগে চারটা চুড়ি আমি বাহিরে রেখেছিলাম মায়াকে নিজ হাতে পড়িয়ে দিব বলে। যখন যমুনার ঘাটে কালো পাথরে দুজন বসে ছিলাম আর মনোস্তাব করলাম মায়াকে চুড়ি পড়াবো। মায়া কিন্তু ফোনে আমাকে মানা করেছিল যে আমি চুড়ি পড়ালে সে চুড়ি নিবে না। কিন্তু আমি জানতাম আমি বললে সে কখনো নিতে মানা করবে না।
আমি চুড়িটা হাতে পড়িয়ে দিব বলার সঙ্গে সঙ্গেই মায়া মুচকি হেসে সায় দিল আমাকে। তখন আমাকে আর কে বাঁধা দেয়। আমার ব্যাগেই রেখেছিলাম চুড়িগুলি। ব্যাগে হাত দিতেই বুঝতে পারলাম ২ টা চুড়ি ভেঙে গেছে। বাকি দুটো মায়ার কোমল হাতে পড়িয়ে দিলাম। চুড়ি দুটো পেয়ে যেন মায়া খুবই খুশি হয়েছিল। তার সেদিনের হাসিটা আমার চিরজীবন মনে থাকবে। মায়া যদিও আমার ভুলের কারণে ভালোবাসাটা বোঝেনি। তবুও যে সে বন্ধুত্বের খাতিরে বহু ভালোবাসত আমাকে।
আবেগে কথাগুলো বলতেই তুলির দিকে তাকালাম। তুলি না জানি কি ভাবছে!
তুলি আবারো মৃদু হেসে বলল,
-তারপর!
তখন আমি আবারও বলতে লাগলাম।
-বাড়িতে আসলাম। মনে যেন কিছুতেই শান্তি আসলো না। মায়া তো আমার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। মনে মনে ভাবছিলাম হয়তো মায়ার সঙ্গে এটাই শেষ দেখা হবে! মায়ার কোনো স্মৃতিই তো আমার কাছে জমা নেই। বহু আগে একটা চাবির রিং দিয়েছিল। খুব যতেœ রেখেছিলাম । তা তবে সময়ের ফোঁকরে সেটাও যে কোথায় হারিয়ে ফেলেছি, জানি না। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেটা হারিয়ে।
আসলে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে যৎ সামান্য উপহারই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার।
তখন মনে মনে ভাবলাম এ চুড়ি তো মায়াকে দিয়েছি, তবে সেগুলোর বাকি জোড়ার ২ টা ভাঙা চুড়িই না হয় আমার কাছে মায়ার স্মৃতি হয়ে থাকলো। কারণ এগুলো তো ওকেই দেওয়ার জন্য নিয়েছিলাম। আর তখন থেকেই এ ভাঙা চুড়ির টুকরো গুলো আমার ব্যাগে রেখে দেই। কত বছর হয়ে গেছে। হয়ত মায়াকে উপহার দেওয়া সে চুড়িগুলোও ভূপৃষ্ঠের তলায় জমা হয়েছে। তবে সে চুড়ির টুকরো গুলো শুধু আমিই রেখে দিয়েছি।
এগুলো বলতে যেন খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার।আমি একে একে প্রশ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছিলাম আর তুলি আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
তুলি আবারো বলল,
-এবার এই বরইয়ের বীজ?
আসি হাস্যসরে বললাম,
── এটার কথা আর তেমন বেশি না। খুবই যৎ সামান্য।
তুলি বলল,
── তবুও আমি শুনব!
- মায়া যে আচার টুকু আমাকে দিয়েছিল তা তো তোমাকে বলেছিলাম।
তুলি বলল,
── হ্যাঁ, শুনেছিলাম।’
──তার অল্প একটু মাকে দিয়েছিলাম। আর বাকিটা নিজেই সাবাড় করেছিলাম। বিশ্বাস করো তার হাতের সে আচরটাতে যে আমি এত মজা পেয়েছিলাম যা আজো মনে পড়লে জিহ্বায় জল এসে যায়। হয়ত, সেটার মজা ততটাও ছিল না। কিন্তু সে তো নিজ হাতে করেছিল এটা! তবে আমি তার প্রেমে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম যে এমনটা মনে হয়েছিল! আসলে, প্রেমিকার হাতের যে কোন কিছুই অনেক মজার হয়ে থাকে। সেটা হোক খাবার বা অন্য কিছু। মনে মনে ভাবছিলাম মায়ার হাতের তো কোনো কিছু কোনদিন খেতে পারবো না, আর এ আচার তো চিরজীবনের জন্য রেখেও দেওয়া যাবে না। তাহলে কয়েকটা বরইয়ের বীজ না হয় রেখে দেই। কোনকালে যদি দেখা হয় তাকে দেখানো যাবে এগুলো!
আমি ভেবেছিলাম তাকে হারিয়ে হয়ত কখনো আর বাড়ি ফেরা হবে না! আবেগে কথাগুলো বলছিলাম আর তুলি তা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।
তুলি হাস্যসরে বলল,
-তাহলে বাড়ি আসলে যে!
আমিও হেসে বললাম,
-যে আমাকে বোঝেনি, ভালোবাসা তো দূরের কথা, মন ভরে ঘৃণা করেছে, তার জন্য দেশান্তরি হব! তাছাড়া বাবা মা ছিল যে! তাদের পিছু টানেই দেশান্তরি হতে পারিনি।
তুলি বলল,
-দেশান্তরি হলে কি করতে?’
-কি করতাম, কাব্যের ঝুলি নিয়ে ঘুরতাম। তোমার মত পাগলিকে খুঁজে নিতাম ।
আমার কথা শুনে তুলি মিষ্টি করেরে হাসলো। বলল,
-তারপর?’
-তারপর আর কি?’ মায়ার আচারের স্মৃতিকে ধরে রাখতে সে থেকেই বরইয়ের বীজ গুলো ব্যাগে রেখে দেই।
কথাগুলো শুনে তুলি উচ্চ স্বরে হেসে উঠল। তার হাসির কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
-হাসো কেন?’
সে বলল,
-দুটো গল্পই কিন্তু আমার ভাল লেগেছে আর মনে রাখার মত গল্প। সত্যিই তুমি অনেক ভালবেসেছিলে মায়াকে। কেন যে বোঝেনি সে।
আমি তুলিকে বললাম,
-সত্যিকারের ভালোবাসা প্রেমিকারা কমই বুঝে।
তুলি বলল,
-তবে পরেরটার জন্যই কিন্তু আমি আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। না শুনে আমি ছাড়ছি না তোমাকে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-পরেরটা কি?’
তুলি বলল,
-কেন কলম?’ আমি তো অনেক কলম দেখেছি, তুমিও আমাকে উপহার দিয়েছে। তবে আজকের কলমের রঙ, ঘ্রাণ আর কোমলতা যে হিংসা করার মত। বলো তো কেন এমন ডোরাকাটা করে রেশমি সুতোয় লিখেছিলে ‘মায়াবিনী’। আর কেনই বা এটা এত যতেœ রেখেছ!
কলমের কথাটা শুনে হৃদয়ে যেন খুবই নাড়া দিয়ে উঠল। কারণ, এ কলমটা যে কতটা বেদনার স্মৃতি বহন করছে, তা এ পৃথিবীতে শুধু আমিই জানি। যদিও এ কলমের আত্মকাহিনীটা আরেক বিষাদসিন্ধু পরিমাণ কষ্টের ছিল। তবুও তো তুলিকে বলতে হবে।
তুলিকে বললাম,
-এক গ্লাস পানি দিতে। সে আমার পুরো গল্পটা শুনবে বিধায় তড়িঘড়ি করে পানি এনে দিল । আমি তা পান করলাম। তুলি বলল,
-এখন বল,
তুলি জানে না, আমি যে প্রতিটি লাইন তাকে বলছি আর আমার মনের মাঝে হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছে। সে হাহাকার যে আমি তুলিকে বোঝাতে পারছি না। তাকে মুখ-ফুটে বলতেও পারছি না। কত দিন পার হয়ে গেছে। নিজের ঘরে এ স্মৃতিগুলো স্মৃতি হিসাবেই পড়ে ছিল। তেমন মনেও ছিল না আমার। জীবন সংসারে আমি যে এক হাল ভাঙা নাবিক, জীবন সংসার বইতে বইতে এ কলমের আত্মকাহিনীটি ভুলেই গিয়েছিলাম।
আজ কেনই বা তুলি এগুলো বের করল আর কেনই বা বুকের হাহাকারটা বাড়িয়ে দিল। কারণ মায়ার কথা যে আমি ভুলে থাকলেও ভুলতে পারি না। যখন মায়ার সঙ্গে জড়ানো কোনো স্মৃতি সামনে এসে হাজির হয়, তখন মায়ার প্রতিবিম্বটা সামনে এসে কথা বলে, লেখক, ভুলে গেলে আমাকে?’
হয়ত বর্তমানে তুলিকে পেয়ে তাকে ভুলে গেছি তবে একসময় যে মায়ার অজান্তে ঘুম ভাঙতে তার ছবি দেখে। মন খারাপ থাকলে মন ভালো হত তার কল রেকর্ড শুনলে, আজ সে নেই। তবে তার স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে তার উপস্থিতি। কেউ পাশে না থাকলেও তার যদি কোন স্মৃতি পাশে থাকে তবে যেন তার উপস্থিতি উপলব্ধি করা সম্ভব।
তুলির অধীর আগ্রহের জন্য তখন আমি কলমের কাহিনিটাও বলতে শুরু করলাম।
তবে কাহিনিটা মায়াকে চুড়ি দেওয়ার খুব অল্প সময় পরেরই কথা।
একটা সময় মায়া আমার কাছে খুবই আবদার শুরু করল, যে বন্ধুরা মিলে অনেক দিন হলো আড্ডা হয় না। তুমি একটা ভোজনের আয়োজন করো যাতে সকলে মিলে সেখানে উপস্থিত হই। আর সকলে মিলে মজার একটা সময় কাটানো যায়।
আমি মায়ার কোন কথা কখনো ফেলি না। সেটাও কেমন করে ফেলে দেই । তাছাড়া মায়ার সাথে সময় কাটাব সেটা তো খুশির খবর। হয়তো মায়াও সেটাই চাচ্ছে?
মায়ার কথা মতো একসময় দিন তারিখ ঠিক করা হলো, আমি কেমন জানি অগ্রিম জেনে গিয়েছিলাম যে, মায়ার সঙ্গে হয়তো এ দেখাই শেষ দেখা। কেননা সামনে টানা দুটো ঈদ। এর এক ঈদেই হয়তো মায়ার বিয়ে হয়ে যাবে। কারণ, সে তো আমার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। বিয়ে হতেই বা বাকি কতক্ষণ! সেখানে তো যাওয়ার সাধ্য আমার নেই।
আমি মায়ার অতীত সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি, সেগুলো আমি মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু মায়া আমার অতীতকে ঢেকে আমাকে গ্রহণ করতে পারেনি।
আয়োজনের ঠিক কিছুদিন আগেই মায়াকে কল করলাম। বললাম,
-মায়া আমার কাছে কি তোমার শেষ কিছু চাওয়ার আছে?
মায়া বলল,
-কি সব পাগলের মত কথা বলো। কি চাইব?’ তোমার কাছে। আমি তোমাকে কিছু একটা দিতে চাই কারণ, তুমি তো আমাকে কত কিছু দাও।
আমি হাস্যকর ভাবে বললাম,
-কি দেবে আমাকে।
-কী নিবে বলো!
-পাঞ্জাবি দিও।
মায়া হাসছিল তখন। বলল,
-ঠিক আছে আমি তোমাকে সুন্দর দেখে একটা পাঞ্জাবি দেব। তবে কিছুদিন পরে।
আমি কিন্তু মায়ার সেই পাঞ্জাবি পাওয়ার আশা করিনি। সে যে বলেছে তাতেই আমার মনটা ভরে গেছ।
দেখতে দেখতে আমাদের বন্ধু বান্ধবদের আড্ডার তারিখটা ঘনিয়ে আসল। আমি নানান কিছু চিন্তা করতে লাগলাম কি দেব মায়াকে। তাকে আমি কয়েকটা শাড়ি দেখিয়ে ছিলাম। বলেছিলাম,
-নিবে নাকি?’
সে লজ্জায় কিছু বলল না। হয়তো সে মনে মনে শাড়ি গুলো পছন্দ করেছিল; কিন্তু আমাকে মুখে বলতে পারেনি।
সে নিবে কি না, তাই আমিও বেশি জোর করতে পারিনি।
আমি জানি যদি তার জন্য কিনে নিয়ে যাই সে অবশ্যই গ্রহণ করবে সেটা। কিন্তু সেদিন যে বন্ধুরা থাকবে। তাদের সামনে কেমন করে দেই এটা! ভেবেছিলাম মায়া পছন্দ করলে অর্ডার করে দেব। সবার অজানাতেই মায়া সেটা হাতে পাবে। কিন্তু মায়ার মনটা বোঝা বড়ই মুশকিল। পাগলিটা সব কথাই হেসে হেসে বলে। তাই কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে মিথ্যা বোঝা বড় দায়।
দিনরাত চিন্তায় রইলাম মায়াকে কি দেব। শহরে গিয়েছিলাম অনেক কিছুই তো পছন্দ হয় তবে সাধ্য যে নাই তা কেনার। প্রিয়জনকে কিছু দিলে দামি টাই দিতে হয় যে।
একেতে অসময় ছুটি নিয়েছে তার মধ্যে পকেটটা পুরো ফাঁকা। বড় বোনের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিলাম ছুটিতে যাওয়ার জন্য।
যখন মায়ার জন্য কিছু কিনতে একদম দিশেহারা হয়ে গেলাম তখন যেন এক শিল্পীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমার।
তুলি বলল,
-শিল্পী কিসের শিল্পী! সে কী গান গায়?’
মৃদু হাসলাম আমি।
-না রে পাগলি, সে ছিল সুতোর শিল্পী। সুতোর কারিগর। সুতা নিয়েই তার খেলা। এমন কিছু নাই যে সে সুতা দিয়ে তৈরি করতে পারে না।
তুলি বলল,
── তখন তুমি কি করলে?’
── তখন আমি সে শিল্পীর সাথে তার বাসায় গেলাম। গিয়ে তো আমি অবাক। নিপুণ হাতের কারিগর সে। তার রুমটা সাজিয়ে রেখেছে নানান নকশায়। সবকিছুই আমি দেখলাম। তবে তার মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগল কি জানো?
-কি?
-হাতে নকশা কেটে, কলমে নাম লেখা।
-তারপর কি করলে?
-তারপর কি করবো! তাকে দিয়ে এই কলমটা তৈরি করায়ে নিলাম। সময় খুব অল্প ছিল, তাই তাকে বলেছিলাম খুব শীঘ্রই দিতে হবে। সে রাজি হয়ে গেল আর সাতদিনের মধ্যেই সে চমৎকার একটা কলম উপহার দিল আমাকে। কলমটা দেখে যেন আমি অবাক হয়ে গেলাম।
গোলাপি সুতোর উপর নীল সুতো দিয়ে মায়াবিনী লিখতে বলেছিলাম তাকে। সে যেন নিপুণ হাতে তা লিখেছে; তাকে যেন সত্যই গুনি একজন শিল্পী মনে হলো। তার হাতের নিপুণ কারুকার্যে আমার মনটা ভরে গেছে। মায়া নিশ্চয় কলমটা পেলে অনেক খুশি হবে। এ কথা ভেবে সেই শিল্পীকে আমি কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলাম। আর কলম নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
তুলি আবারও মনের প্রশ্ন উদয় করল আমার সামনে। বলল,
-কিন্তু এটা তো মায়ার কাছে থাকার কথা তোমার কাছে কেন?’
সে কথা বলতে গেলে যে আরো কিছুটা সময় খরচ হবে ।
তুলি বলল,
── সমস্যা কি? কাজ নেই, তাই তোমার গল্প শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।
তুলির আগ্রহ দেখে তখন আমি বাকি গল্পটা বললাম তাকে।
একদিকে অফিস থেকে ছুটি নিলাম। অপরদিকে বন্ধুদের সাথে যে আয়োজনের কথা ছিল সেটাও বাতিল হয়ে গেল। মায়াকে সব বললাম,
সে বলল,
-বাড়ি আসো ঘুরে যাও।
আমি যেন রাগান্বিত হয়ে গেলাম। কেননা এর দ্বারা আমি দুটো জায়গায় ক্ষতিসাধন অনুভব করলাম।
আবার ছুটি পাবো অনেক পরে। মায়ার সাথে দেখা হবে কি? না সন্দেহ রয়ে গেল আমার মনের ভেতরে।
ছুটি যখন নিয়েছি বাড়ি তো যেতেই হবে। বাড়িতে ও গেলাম। কিন্তু মায়ার সাথে দেখা করা সম্ভবপর হয়ে উঠল না। মায়া যেন এই দুই দিনেই অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেল।
তুলি বলল,
-কেন?’
-আমি জানি, মায়ার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া তো দূরের কথা, একটু মন খুলে কথা বলারও সুযোগ ছিল না। একসময় মায়াকে কত কথা বলতাম, সেও বলত, কিন্তু আজ যে দুজনের বিশাল ব্যবধান গেছে।
এই তো সাতদিন আগেই সকল বান্ধবীরা যখন বলেছিল, তারা আসবে না। তখনো কিন্তু মায়া বলেছিল, কেউ না গেলে সে একাই আসবে। আমি খুশি হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ মায়ার এতটা পরিবর্তন আমাকে নিঃশেষ করে দিল।
আমি মায়াকে কল করলাম, ধরল না। ভাবলাম হয়ত ব্যস্ত আছে পরে কল করবে। কিন্তু না পুরো দিন চলে যায় মায়া কল করে না। এদিকে আমি নিরালায় বসে বসে তাকে লেখা চিরকুটটি পড়ছি আর হতাশে যেন মনটা ভরে যাচ্ছে। কলমটি আমি কত যতœ করে রঙিন কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে নিয়েছি তাকে দিব বলে। রঙিন কাগজটাও যেন দুদিনে মলিন হয়ে গেল, তখন আমার সন্দেহ হলো মায়ার সাথে আমার হয়তো দেখা হবে না।
তুলি বলল,
-তারপর কি সত্যিই দেখা হয়নি।’
আমি বললাম,
-‘ না।’
মায়ার সাথে আমার দেখা হয়নি। তাকে বারবার কল ও ম্যাসেজ দেওয়ার পর একবার ধরল। আমাকে বলল, সমস্যা কী তোমার! দেখছ না কল ধরছি না। কেন বারবার দিচ্ছ।
আমি মায়ার রাগান্বিত কথাগুলো শুনে সত্যিই অবাক হলাম। একদা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ম্যাসেজে, ফোন কলে কথা হতো, আর আজ এতটাই বিরক্তের পাত্র আমি। খুবই কষ্ট পেলাম কথাগুলো শুনে। কারণ তার প্রেমে হয়তো আমি কিছুদিন আগে পড়েছি, তবে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা বহু পুরোনো। আমি জানতাম যে মায়ার জীবন থাকতে ও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে না! প্রত্যেক মানুষই সকল ভুল ক্ষমা করতে পারে না। আমি হয়তো একজনকে খুন করলেও মায়া ক্ষমা করত তবে সে আমার ভেতরে যে ভুলটি দেখেছে তা যে হাজারটা খুনের চাইতেও ভয়ংকর। আর সে কেনই বা রাজি হবে! আমার যে তখন তাকে দেওয়ার মত কিছু ছিল না। তারপরও অতীতের এত বড় একটা ঘটনা। সবকিছুই কি মেনে নেওয়া যায়!
আমি মায়াকে বললাম, মায়া আমার সঙ্গে একবার দেখা করো তুমি!
সে আমাকে বলল, তুমি আমার কে! যে তুমি যখন-তখন তখন বলবা আর আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব ।
মায়ার কথা শুনে সত্যই তখন হৃদয়টা কেঁপে উঠেছিল আমার। জীবনে প্রেমে পড়েছি অনেকবার, তবে জানি না প্রত্যেকেই আমার মাঝে কি পায় যে সর্বদা অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই পাই না তাদের কাছ থেকে। অবশ্য মায়ার অবজ্ঞা করার পেছনে তার কিছুটা স্বার্থ আছে। কেননা সে জানতো, যত অবজ্ঞা করবে তত তাড়াতাড়ি আমি তাকে ভুলে যাব, কল দিব না, কথা হবে না। সে নতুন করে ঘর বাঁধবে, অন্য কারও ঘরনি হবে।
কয়দিন আগেও মায়াকে বলেছিলাম, বাড়ি গেলে তোমার কাছে এতটা আবদার থাকবে রাখবে।
মায়া বলেছিল,
-‘কি?’
আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বলেছিলাম,
-যমুনার পাড়ে তোমার হাত ধরে একটু ঘুরব! ধরতে দিবা ।
মায়া বলেছিল,
-কেন?’
আমি বললাম,
-কেন সেটা জানি না, তবে খুব ইচ্ছা হয়েছে। মায়া হেসেছিল কিছু বলেনি। আমি ভেবেছিলাম নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।
তুলি বলল,
-পরে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি, আবারও বলতে লাগলাম তুলিকে।
পাঁচদিন ছুটি দেখতে দেখতেই যেন শেষ হয়ে গেল। ছিল মাত্র দুইদিন বাকি। আবারও কল করেছিলাম মায়া তবুও কল ধরল না। অনেক অনুরোধ করার পরও আসার জন্য রাজি হলো না। তাকে যতবার কল দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলাম, জীবনে আমি কাউকে এতটা অনুরোধ করিনি।
আমার বড় শখ ছিল। তার ঐ মায়ামাখা মুখখানা শেষবারের মত একবার দেখব। তার ঐ মুখের দিকে যে কত তাকিয়েছি যার হিসাব নেই। তবে সামনে যে আর সময় নেই। এটাই হয়তো শেষ তাকিয়ে দেখা তাকে।
আমি মায়াকে বললাম, হয়তো তোমার সঙ্গে আমার এটাই শেষ দেখা হতে পারে।
মায়া মুখে আনন্দ প্রকাশ না করলেও তার কথাবার্তায় যেন আমি আনন্দ বুঝতে পারলাম। আমার সাথে আর দেখা হবে না জেনে সে ভীষণ খুশি। যেন বিরাট ঝামেলা থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে।
তখন আমি আর তাকে ভালোবাসার কোনো মহত্ত্ব খুঁজে পেলাম না। যে আমাকে চায় না, তাকে কি জোর করে আপন করা যায় বলো! আমি আর তাকে জোর জবরদস্তি করলাম না।
তাকে বললাম,
-যাক দেখা করতে হবে না, তবে বাড়ির সামনে দাঁড়াও আমি ঐ কলমটা তোমাকে দিয়েই চলে আসব। অবশ্য এখানে আমার তাকে দেখার প্রবল ইচ্ছাও ছিল।
কিন্তু মায়া তাতেও রাজি হলো না। তখন আমার ভীষণ রাগ হয়ে যায়। কিছু কটু কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু মায়াকে যে কখনো আমি কটু কথা বলিনি! অভিমান হয়েছে অনেক ওর সঙ্গে তবে রাগ করা হয়নি।
তুলি বলল,
-মায়া তো ঠিকই জানত তুমি কলম দিতে এনেছ, তবে কেন নিল না?
-সেটা হয়তো আমার প্রতি ঘৃণার পরিপ্রেক্ষিতে নেয়নি।
রাতে আমি হতাশ মন নিয়ে সব কাপড়চোপড় গোছালাম, ছুটি শেষ তাই। সকাল থেকে মায়াকে একের পর এক কল দিয়ে গেলাম, কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। তাকে কলমটা দেব আর একবার চোখ-মেলে তাকে দেখব সেটাও যেন সম্ভব হলো না। তার মুখটা দেখার জন্য যে মনটা তখন কেমন ছটফট করছিল তা তাকে বোঝাতে পারিনি!
বিকেলে যখন ঢাকা চলে আসব তখন মায়াকে কল করলাম সে ধরল। তাকে বললাম, দুই মিনিটের জন্য বাড়ির সামনে আসো!
সে বলল,
-কেন?’
-কলমটা দিয়ে আসব।’
মায়া একগাল হেসে দিল,
-বলল, ওটা আমাকে দিতে হবে না। তুমি তো লেখালেখি করো, ধরো আমাকে দিয়েছিলে সেটা তোমাকে আমি গিফট করলাম তুমিই ব্যবহার করো ওটা।
আমি তখন বুঝলাম মায়াকে আর বুঝিয়ে লাভ হবে না। সে যখন মানা করেছে, তাহলে এটা হবে না।
তুলি বলল,
-তখন কি করলে?’
তখন আর কি করবো মনে বড়ই কষ্ট লেগেছিল, তবুও মায়াকে বলতে পারিনি। কারণ তার ঐ পাষাণী মন যে কিছুই বুঝবে না। সে শুধু আমার দোষটাই দেখেছিল মনের ভালোবাসাটা দেখেনি! তখন শুধু তাকে আমি হাসিমুখে বলেছিলাম,
-ভালো থেকো, বিয়ে করে নিও আর হয়তো দেখা হবে না।
আমি তখনো চাচ্ছিলাম মায়া আমাকে পিছু ডাকুক! কিন্তু না, সে পিছু ডাকল না, আনন্দ ভরা মন নিয়ে বলল,
-তুমিও ভালো থেকো।’
আমি বুঝলাম সে আমাকে চায় না! তবুও বললাম, তোমার শেষ কিছু কী চাইবার আছে আমার কাছে ।শেষবারের মত যা চাইবে তোমাকে আমি তাই দেব ।
মনে করেছিলাম মায়া বলবে,
-তোমাকেই চাই? কিন্তু সে কথা যে কভু তার মুখে বের হবে না।
সে বলল,
-কিছু চাইবার নেই, ভালো থেকো এটাই চাই।
আমি মায়াকে বললাম,
-দোয়া কইরো । ভালো যেন থাকতে পারি ভুলে যেন থাকতে পারি, আর হ্যাঁ, যদি কখনো সময় হয়ে বলিও কলমটা তোমার জন্য রেখে দিলাম! কথাগুলো বলতে যেন হৃদয়টা কাঁপছিল আমার।
তুলি বলল,
-আচ্ছা মায়ার কাছে কি তোমার কিছু চাইবার ছিল। শেষ ইচ্ছা ছিল।
তুলির দিকে তাকালাম। মেয়ে মানুষ শিমুল তুলোর মত অনেক নরম আবার থানার পুলিশের মত সন্দেহভাজন। এদেরকে সব কথা বলতে নেই! কখন কি করে বসে। আমিও সেটা বললাম না। তবে মনে মনে ভাবলাম, হ্যাঁ মায়ার কাছেও শেষবারের মত আমার কিছু চাইবার ছিল, তবে সেটা মায়াকে বলতে পারিনি, মায়াও জানতে চায়নি আমার শেষ ইচ্ছা কি! তার বিয়ের আগ পর্যন্তও সে ইচ্ছাটা মনে লুকায়ে রেখেছিলাম যে সে বললেই চাইব তার কাছে। কিন্তু শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে কখনো বলেনি মায়া।
তুলিকে বললাম,
-না তেমন কিছু শেষ ইচ্ছা ছিল না আমার।
তার সাথে কথাগুলো বলতে আমি অনুভব করলাম যে, আমার চশমার ফাঁক দিয়ে কিছুটা অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। তুলির মনটাও খারাপ যেন হয়ে গেল। সে সহসা আমার চশমাটা খুলে তার শাড়ির আঁচলে সে জলটুকু মুছে দিল।
আমাকে বলল,
-আমি হয়ত তোমাকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেললাম তাই না।
আমি খানিকটা হেসে বললাম,
-কই না তো?’
আসলে আমি জানতাম না যে তোমার এই কলমের পেছনে এত বড় বিষাদ-মাখা কাহিনি জড়িয়ে আছে। তাহলে জানতে চাইতাম না! কিছু মনে করো না তুমি তুলিও যেন আমার ব্যথায় ব্যথিত হলো।
তুলির কাছে যেন নিজেকেই অনেক ছোট মনে হলো। সব দোষ আমার, তবুও সেই ক্ষমা চাচ্ছে।
তুলি বলল,
-এত কিছু থাকতে মায়াকে কেনই বা কলম দিতে চাইছিলে আর কেনই বা তাতে মায়াবিনী লেখা।
আমি একগাল হেসে দিয়ে বললাম,
-মায়াকে অনেক আগে একটা ডায়েরি দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কলমটা দিয়ে তার মনের জমানো কথা ডায়েরিতে লিখবে। কলমটা হারিয়ে গেলেও তার ভেতরের রক্তবিন্দু ডায়েরির পাতায় জমে থাকবে।
আর মায়াবিনী কেন লিখলাম সেটা শুনবে?’
তুলি বলল,
- কেন?’
মায়া আমাকে একটা উপন্যাস লিখতে বলেছিল, আর তার নাম সে নিজেই রচনা করল। নাম দিল মায়াবিনী। তাই আমি এ কলমটির পৃষ্ঠেও একই নাম লিখলাম‘‘মায়াবিনী’’
আমার মুখের সাজানো গুছানো কথাগুলো শুনে তুলি মোহ ভরে আমার দিকে তাকাল আর বলল, তোমার কি এখনো মায়ার কথা মনে পড়ে ।
আমি তুলিকে নিজের বুকে আলতো করে জড়িয়ে নিলাম। বললাম,
-কি বলো এসব মায়াকে আমি ঠিকই অনেক ভালোবাসলাম তবে সে তো আর আমাকে ভালো-বাসতো না। আর মায়া তো অতীত। আমি অতীত নিয়ে ভাবতে ভালবাসি না। বর্তমানটা কে প্রাধান্য দেই। এখন তুমিই আমার আরেক পৃথিবী!
কারণ, অতীত নিয়ে ভাবতে নেই, অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।
তুলি বলল,
-মায়া কিন্তু ভীষণ বোকা ছিল। না হয় তোমার এতটুকু ভুলই ছিল, তার জন্য তোমাকে ফেলে যাওয়া ঠিক হয়নি তার! সে একটা মহা মূল্যবান মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে। যে তাকে অনেক ভালোবাসত। আসলে বন্ধুত্ব থেকে যে ভালোবাসা প্রেম অবধি নিয়ে যায় সে প্রেমটা অনেক খাঁটি হয়।
তুলিকে বললাম,
-তবে মায়া যে দোয়া করেছিল ভালো থেকো! সে দোয়া কিন্তু ঠিকই সত্য হয়েছে জানো?’
তুলি বলল,
-কীভাবে?’
-এই যে তোমার মত একজন ঘরনি পেয়েছি তাই।
তুলি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে দিল।
বাইরে ঝিমঝিম বৃষ্টি বয়েই যাচ্ছিল।
তুলি বলল,
-বাদ দাও এসব কথা, তোমার জন্য আমি খিচুড়ি রান্না করেছি। চলো খাবে।
আমি ভাবলাম,
-তুলি হয়তো রাগ করেছে! বললাম, তুলি রাগ করলে নাকি
-নাহ্ !’ রাগ করব কেন?’ তুমি কি আমার কাছে কিছু লুকাও! যে রাগ করব। এখন চলো খাবার খাবে আজ দুজনে মিলে আজ অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করব।
তুলি এমনই। আমাকে না বললেই আমার পছন্দের জামা কিনবে, খাবার রান্না করে। তুলি যেন ওর জীবনের চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসে। আর আমার মুখে কবিতা শুনতে সে বেশ আগ্রহী।
আমি মৃদু হেসে বললাম,
── তুমি ঠিকঠাক করো, আমি লেখাটা শেষ করে আসছি।
তুলি আর কথা বাড়াল না। সে আমার কপালে ভালোবাসার আলতো ছোঁয়া এঁকে দিলো আর বলল, এই নাও তোমার মায়াবিনী! সে মৃদু হেসে চুড়ির টুকরো আর বরইয়ে বীজ টেবিলে রাখলো আর কলমটা আমার হাতে দিয়ে চললো তার ঘরের দিকে। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তুলি সত্যই অবাক করা মেয়ে। এ যুগে এত ভালো মানুষের সন্ধান মিলে! সে যে আমাকে কতটা ভালোবাসে তা আমার কাছেও অজানা।
আবার লেখালেখিতে মন দিলাম। কিন্তু ততক্ষণে সব ছন্দ যেন বিলীন হয়ে গেছে মন থেকে।
বাইরে ঝিমঝিম বৃষ্টি হচ্ছে। আমি চাদরটা ঠিক করে এগিয়ে গেলাম জানালার দিকে। বাইরে তাকাতেই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ার প্রতিবিম্বটা। তাকে তো ভুলেই ছিলাম। হঠাৎ তুলি মনে করিয়ে দিয়ে কষ্টটা যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল। মনকে সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। কলমটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম। সহসা ঠুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। সে বোবা কান্না যেন থামার নয়। সাঁঝের বেলা আসলে একটা কথা আমার মনকে ভীষণ নাড়া দেয়। তা হলো মায়ার কথাটি!
‘তুমি এখনো ঘুমাচ্ছে! সন্ধ্যায় কেউ ঘুমায়!’
চশমাটা খুলে চোখের জল মুছলাম। কিন্তু মনের জল কীভাবে মুছবে! যে মায়ার প্রতিটি পদচারণ আমার হৃদয়ে গাঁথা ছিল, সে আজ আমার নেই দূরের কারও ঘরনি হয়ে সুখেই আছে হয়তো। আজ আমিও দুঃখে নেই, তবে এই সাঁঝের বেলা যে তাকে ভীষণ মনে পড়ে গেল। নদীর জলকে বাঁধ দিয়ে আটকানো যায় কিন্তু চোখের জলকে পৃথিবীর কোনো নিয়মে আটকানো যায়! বৃষ্টির জলের সাথে সঙ্গেই যেন সে কলমটা হাতে নিয়ে বোবা কান্না শুরু করলাম আমি মায়া, মায়া বলে। আমার সে কান্না হয়তো দরজার ওপাশ থেকে তুলি লক্ষ্যে করেছিল।
জানি না মায়া কেমন আছে! বহু বছর হলো দেখা হয় না। অন্যের ঘরণি হয়ে হয়তো ভালোই আছে সে। আমিও যে তুলিকে নিয়ে খারাপ আছি তা নয়, তবে মনে মাঝে, অনেক সময় নাড়া দেয় মায়ার প্রতিচ্ছবিটা।
প্রতিদিনই তো নতুন সূর্য ওঠে তবে মনটা নতুন হয়ে জেগে উঠল না। আগের কোনো কথা মনে পড়লেই ভীষণ কান্না পায়।
আমার প্রস্তাবে মায়া যখন রাজি হলো না তখন খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু মুখে বলতে পারিনি। কাকে বলবে এ কথা! সেটা কি বলার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে যে আমি মায়ার প্রেমে পড়ে যাব সে কথা যেই শুনুক না কেন আমাকে চরিত্রহীন ছাড়া কিছুই বলত না।
আজ মায়া নেই, তবে তাকে উপহার দেওয়ার জন্য যে কলমটি কিনেছিলাম। তার রঙ আজো মনে করিয়ে দিচ্ছে মায়াকে। আমি চোখের জল মুছলাম আর সে কলমটির দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে দেখছে তাতে এখনো লেখাটি স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে ‘মায়াবিনী!’
সিরাজগঞ্জ