পাখি-পরিধি !
পাখি-পরিধি
মো. আরিফুল হাসান
শূণ্যে উঠে যায় নিয়াজ। এক হাত, দুই হাত করে ছাব্বিশ হাত উপরে উঠে সে ঘুড়ির মতো ভাসতে থাকে। লোকেরা তাজ্জব হয়ে তার দিকে তাকায়। তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। মাঠের আল থেকে, ইরিধানের সাঁড়ির ফাঁকে উবু হয়ে নিড়ানি দিতে দিতে, মাঠের মাছখানের হিজলগাছটার ডালে উঠে, এমনকি তিন-চার কোঠা ক্ষেত দক্ষিণে কালু মিয়ার পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে অসংখ্য, নারী-বৃদ্ধ শিশু ও যুবক-যুবতীরা মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দৃষ্টি উঁচু করে নিয়াজের দিকে চায়। মাঠের কৃষকের হাটের মুঠোয় নিড়ানির ঘাসগুলো থেকে জল-কাদা চুইয়ে পড়ে, এক সময় তাদের মুঠো শিথিল হয়ে পড়ে যায় কাস্তে ও আঁচড়া। লোকেদের তন্দ্রা ভাঙে না। নিয়াজও উপর থেকে নিচে নেমে আসে না।
লোকেরা তখন নিয়াজকে প্রশ্ন করে, -অ নিয়াজ, তুমি এতো উপরে উঠলা ক্যামনে?
-আমার ভেতর একটা পাখি হৃদয় বাস করে, -দূর থেকে উত্তর দেয় নিয়াজ।
লোকেরা বলে, -নিয়াজ, নিচে নেমে এসো।
নিয়াজ বলে, -নামতে পারছি না।
তখন নিয়াজকে নামাতে লোকে বড় বড় বাঁশ একত্র করে টাউয়ারের মতো একটা কিছু তৈরি করে এবং নিয়াজের সমান উচ্চতায় গিয়ে তাকে পেড়ে আনতে চায়। কিন্তু সাধারণ বাঁশের ভর নেবার মতো অংশ ষোলো সতের হাতের বেশি থাকে না। তাই তারা বাঁশের পরে বাঁশ জোড়া দিয়ে মিনার বানাতে চায়। কিন্তু বাঁশের এই জোড়া দেয়া মিনারে কে চড়বে? সবারই জীবনের ভয় আছে। নিয়াজের ভাইকে প্রশ্ন করলে সে সোজাসুজি না বলে দেয়। তবু গ্রামের মুরব্বীরা নিয়াজের জন্য টান অনুভব করে এবং তাকে নামাতে তৎপর হয়।
কেউ বলে, মন্দবাগের বাঁশ আনলে হবে। ওগুলো লম্বায় তিরিশ বত্রিশ হাত পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্ষাকালে জেলেরা মন্দবাগ থেকে বাঁশ এনে খালের পানিতে জাল পাতে। একে বলে খরো জাল। পুরো খালটি তখন মিহি সুতার মরণফাদে পরিণত হয় মাছেদের জন্য। কিন্তু এখন তো বর্ষাকাল নয়। মন্দবাগ থেকে বাঁশ কিনে নিয়ে আসবে কীভাবে? বর্ষায় ভাটার জলে বাঁশের ভেলা বেঁধে ভাসিয়ে দিলেই হলো। বাঁকে বাঁকে ঘুরতে ঘুরতে বাঁশ একসময় ঘাটে এসে ভিড়বে। কিন্তু এখন এই সাড়ে সাতমাইল দূরে মন্দবাগ বাজার থেকে বাঁশ কিনে আনাটা দুঃসাধ্য। তবু বাঁশ আনতে হবে; নিয়াজকে নামানো প্রয়োজন। কিন্তু এই গাড়ি-ঘোড়াহীন অজপাড়াগাঁ থেকে মন্দবাগ যেতেও তো দুই আড়াই ঘন্টা সময়ের দরকার। এতক্ষণ কি নিয়াজ ঝুলে থাকবে? মুরব্বীরা দরদী কণ্ঠে ডাক দেয়-
-নিয়াজ, অ নিয়াজ!
নিয়াজ উপর থেকে জবাব দেয়- জী, বলেন?
-তোমার এখন কেমন লাগছে?
-অনেক ভালো।
-আমরা তোমাকে নামাতে পারছি না।
-দরকার নেই।
-দরকার নেই মানে?
-আমি পাখি হয়ে ভালো আছি।
লোকেদের বিস্ময় আরো জমে উঠে। তারা তাগড়া তাগড়া যুবকদেরকে মন্দবাগ পাঠায়। তারপর আবার ডাকে-
নিয়াজ!
জি বলেন।
আমরা তোমাকে নামানো ব্যবস্থা করছি।
নিয়াজ কোনো উত্তর দেয় না। পাখির মতো হাত দুটোকে শূণ্যে ভাসিয়ে রাখে। নিচের দিকে মাথা নিচু করে চায়। গ্রাম ভেঙে মানুষেরা জড়ো হয়েছে। সবাই দেখছে তাকে। এ বিষয়টা নিয়াজ একেবারে গুরুত্বহীন চোখে দেখে। তার মনে হয়, সে এমনিভাবে প্রতিদিন পাখি হয়ে ভেসে থাকে আর এমনি করেই প্রতিদিন লোকেরা তাকে দেখতে আসে।
-নিয়াজ, নিয়াজ! -লোকেরা আবার ডাকে।
নিয়াজ জবাব দেয়, -হু।
-তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
-হু, জবাব দেয় নিয়াজ।
-আমরা তোমাকে নামাতে মন্দবাগ থেকে বাঁশ আনতে পাঠিয়েছি।
নিয়াজ আবার কোনো জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। লোকেরা তখন আবার বলে।
-আমাদের গ্রামের সবচেয়ে শক্তিশালী যুবকদেরকে পাঠিয়েছি। তারা ঝরের মতো যাবে আর উল্কার মতো ছুটে আসবে। নিয়াজ, অ নিয়াজ, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
-হ্যা, শুনতে পাচ্ছি, বলুন।
-এই কিছুক্ষণ, ধরো তোমার যুবক বন্ধুরা আসতে যে দুই তিন ঘন্টা সময় লাগবে ততক্ষণ কি তুমি ঝুলে থাকতে পারবে? তোমার কোনো কষ্ট হবে কি?
-না কোনো কষ্ট হবে না।
-তুমি কি খুব একাকীত্ব অনুভব করছো নিয়াজ?
নিয়াজ আবার চুপ করে থাকে। শূণ্যে ভাসমান বাতাসের সাথে তার দীর্ঘশ্বাস হয়তো মিলিয়ে যায়। অথবা হয়তো তার ঠোঁটের কোনে কোনো গোপন হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে যায়, দূরত্ব ও বাড়ন্ত রোদের তেজে হয়তো তা দেখা যায় না।
Ñনিয়াজ! গ্রামের লোকেরা ডাকে। -তুমি কি আমাদেরকে চিনতে পারছো উপর থেকে? আমি মতলব চাচা।
নিয়াজ আবার চুপ করে থাকে। কালু মিয়ার পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে রমনীরা চোখ মুছে কাঁদে। শিশুরা তাদের আঁচলে জড়িয়ে জড়িয়ে বিস্ময়মাখা চোখে দেখতে থাকে ঝুলন্ত নিয়াজকে।
এমন সময় হঠাৎ পুকুরের উত্তর পাড়ের পশ্চিম অংশ থেকে চিৎকার আসে, সাপ সাপ! রমনীরা যে যার মতো দৌঁড়ে জীবন নিয়ে পালায়। দুটো গোখরো বেরিয়ে এসেছে মুর্তার বনের আড়াল থেকে। শিশুরা চিৎকার করতে করতে তাদের মায়েদের পেছনে ছুটে। মাঠ থেকে কয়েকজন কৃষক পাজুন হাতে করে দৌঁড়ে আসে পুকুর পাড়ে। এসে দেখে এই সাপদ্বয় পাজুন দিয়ে মারার মতো নয়। তখন তারা চিৎকার করতে থাকে, চল্, চল্, চল্ চাই। তখন মাঠ থেকে আরো দুয়েকজন, হিজল গাছ থেকে চারপাঁচজন যুবক নেমে নিজেদের বাড়ির দিকে দৌঁড়ায়। লৌহশলাকা নির্মিত তীক্ষè ধারালো অস্ত্র চল্ আনতে হবে। লোকেরা দৌড়াদৌড়িতে অর্ধেক মানুষ কমে যায়। যুবকেরা যারা চল্ আনতে গ্রামের ভেতর গিয়েছিলো তারা এখনো ফিরেনি। পুকুরের পাড়ে সাপ দুটো ফোঁৎ ফোঁৎ ফণা তুলে আতংক সৃষ্টি করছে। মাঠের যে জায়গাটায় নিয়াজ ভেসে আছে তার নীচে এবং বিশ ত্রিশ শতাংশজুড়ে এখনো জনা বিশেক মানুষ দাঁড়ানো। তারা মনে করে যুবকেরা চল্ নিয়ে ফিরে আসলে সাপদুটিকে তাদের দশবারো জনেই হয়তো মেরে ফেলতে পারবে। কিন্তু তাদের নিয়াজকে ফেলে গেলে চলবে না। নিয়াজ ভাসছে আকাশে। মাটি থেকে ছাব্বিশ হাত উপরে পাখির ডানার মতো দুহাত শূণ্যে বিছিয়ে। নিঃসঙ্গ, অসহায় নিয়াজ ভেসে আছে।
লোকেরা কপালে উপর হাত রেখে গ্রামের দিকে চায়। কী করছে যুবকেরা এতক্ষণ? গ্রাম থেকে চল নিয়ে ফিরে আসতে বড়জোর দশ মিনিটের ব্যপার? কিন্তু মিনিটটা যেনো চলে না। তাদের মনে হতে থাকে মহাকাল ধরে তারা নিয়াজকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আর মহাকাল আগে যুবকেরা ফিরে গেছে গ্রামে চল আনতে। তাদের আরও মনে হয়, এক মহাকাল ধরে সাঁপ দুটো মূর্তা বন থেকে বের হয়ে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় গ্রামের ভেতর থেকে চিৎকার আসে, Ñআগুন, আগুন। মাঠের মানুষেরা তরিতে সচকিত হয়ে দেখে গ্রামের উপর দিয়ে লেলিহান শিখা কালো ধোয়া ছেড়ে আকাশ ঢেকে দিচ্ছে। তখন তারা নিয়াজকে ফেলে গ্রামের দিকে ছুটে। কতক্ষণ জানা নেই, নিয়াজ ভাসতে থাকে। আর ওদিকে পুড়তে থাকে গ্রামের কারো ঘর। গ্রামের মানুষেরা কলসি দিয়ে জল এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। বালতি মগ বদনা, যে যেটা দিয়ে পারছে জল এনে ছুড়ে মারছে আগুনের দিকে। এতোগুলি সম্মিলিত মানুষের প্রয়াস অতঃপর বিজয়ী হয়। মোট তিনটি খড়ের গাঁদাসহ নোয়াব আলীর রান্নাঘর পুড়ে আগুনে। তবু সবাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে যে, বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আগুন নেভানো গিয়েছে। অতঃপর তাদের হঠাৎ করে খেয়াল হয় নিয়াজের কথা। তারা তাগড়া যুবকদের ফিরে আসার অপেক্ষা করে। কেউ কেউ বলে, নিয়াজকে এতক্ষণ একা ফেলে আসা কি ঠিক হলো। কেউ কেউ বলে, যারা মন্দবাগ গিয়েছিলো তারাই বা এতক্ষণে ফিরে আসছে না কেনো? ফিরে আসে অবশেষে যুবকেরা। মন্দবাগ থেকে বাঁশ এনে হেইয়ো বলে গ্রামের পথে ফেলে। মুরব্বীরা বলে, আর রেখে লাভ নেই, মাঠের দিকে চলো। সবাই তখন হৈ হৈ করতে করতে মাঠের দিকে ছুটে। কিন্তু, কোথায় নিয়াজ? সে যেখানে ভেসেছিলো সেখানে এখন শুধুই শূণ্যতা। সবাই হায় হায় করে উঠে। তখন দৃষ্টিশক্তিপ্রখর কয়েকজন মানুষ দেখায় যে, দূরে, দূর থেকে দূরে নীল আকাশের কাছে নিয়াজ যেনো পাখি হয়ে ভেসে যাচ্ছে।
পদাবলি : ০১
লজ্জাবদ্ধতা
হাফিজুর রহমান
লজ্জা দিও না আমাকে
নিচু মাথা নুইয়ে পড়বে, অনলে পোড়া মোমের মতো!
লাজুক আমার এই মস্তক, দাঁড়াতে পারে না স্থির হয়ে
দেখতে পারে না উঁচু মস্তকে ভূপৃষ্ঠ, সবুজ পৃথিবীর!
কারণ, আমার লজ্জিত মাথার মেরুদ- নেই।
কষ্ট দিও না আমাকে লজ্জা দিয়ে
কষ্ট রাখার জায়গা নেই আমার, কষ্টের গুদামঘরে!
কষ্ট নিতে আসে না কেউ, দিয়ে যায় সকলে
তবে, কী করে করি সে কারবার?
লজ্জা নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা নেই, আমি ভাসছি -
লজ্জাবদ্ধতায় আটকে গিয়ে, পারি না নির্লজ্জ হতে।
সাম্যবাদ
মুহাম্মদ ইয়াকুব
পুঁজিবাদী জুয়ার টেবিলে
কেউ জীর্ণশীর্ণ, কেউ পাল্লা দেয় ঐরাবতে
ব্যবধান; আকাশ সমান
কী পেটে, কী মাথায়, কী শরাবের পাত্রে
এসো, মানুষের বিবেকে রোপণ করি সম্মানের চারা
সৌন্দর্য ভালোবাসি বলে
বাগানের উঁচু-নিচু এলোমেলো গাছ কেটে
ছেঁটে সমান করি সব মাথা
পুঁজির দেবতা ভেঙে সাজাই সর্বহারা দেহ।
কুয়াশা বেচা হয় রোদের হাটে
জহুরুল ইসলাম
আঁধার কেটে গেলো বৃষ্টির সাথে,
মেঘ কাটেনি।
কু-ুলি পাকিয়ে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
সোনালিরোদের মুখে।
বেড়াভাঙ্গা রোদ বেরিয়ে আসে
চঞ্চল কিশোরীর মতো।
বাঁশ পাতার আড়ালে ঝলমল করে।
চালতার মরা ডালে একটা দোয়েল এসে শিস দেয়।
এখন কুয়াশা বেচা হয় রোদের হাটে।
কুসুমবাগে প্রজাপতি নাচে।
মধ্যরাতের পদ্ম
রোমানুর রোমান
মধ্যরাতের পদ্মপুকুর ঘুম দেবেনা প্রেম দাও!
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নচূড়ায় বুকের ভেতর বেল দাও।
কথা দাও, কষ্ট দাও, হস্ত দাও, স্বপ্ন দাও,
মধ্যরাতের পদ্মপুকুর প্রেম দেবেনা ঘুম দাও।
নিয়ন আলোয় একলা একা মোবাইল দেখা,
শূন্য ঘরে অকপটে নীল বেদনার গান লেখা!
দুঃখ দেখা, জল দেখা, পেটের সমতল দেখা,
মধ্যরাতে পদ্ম দেখা! এক খেয়ালে চিরঞ্জীব।
কখনো আসেনি সে
অলোক আচার্য
কখনো আসেনি সে
শ্রাবণের বৃষ্টিতে-
ভিজে থাকা এক নিঃসঙ্গ শালিক
অপেক্ষায়,
গুণছে প্রহর-
প্রহর শেষের শরতের আকাশ ভেঙে
নেমে আসা হেমন্তের সন্ধ্যায়,
নবান্নের ধান ভানা রাতে
হৃদয় ভাঙার শব্দ
শেষ প্রহরে ভেসে আসে লক্ষী প্যাঁচার ডাক।
পদাবলি : ০২
এই সময়
মাজরুল ইসলাম
নোনা জলের বিশাল ঢেউ, ঢেউয়ের তীব্র ¯্রােত
ঢেউয়ের ফেনা খেতে খেতে
এক এক করে সব তারা ঝরে পড়ছে
ইতিহাসের কৃষ্ণগহ্বরে।
তোমার দিশাহীন পথচলায় বহুমাত্রিক দ্যোতনা বারে বারে
বাঙ্ময় হয়ে উঠলে
দুর্ভিক্ষের ছায়া দীর্ঘ হয়।
দেশনায়কের নোনা জলের প্রেম,
লোকসাধারণের মন ভুলানো কথায় শুরু হয়ছে
নোংরা দেশপ্রেম।
এমনটা হবে কে আর ভেবেছিলথ-
ওই লোকটা এখন উপোসি
যে নিজের ভোগ বিলাস ত্যাগ করে
অন্যকে পুষ্ট করেছে।
এখন পুষ্টি ভান্ডার শেষ হওয়ায়
অপুষ্টি অতি নিকটে !
চিন্তা করো না
দিশাহীন পথচলা শেষ
এখন তোমার ফেনাবিদ্যা দেখে সময় হাসাহাসি করছে।
ডুবজাল
বনশ্রী বড়ুয়া
পাতা ঝরা বিকেল
সোনামুখি সূর্যের বিদায়
বিষাদ নদী গোমড়া হয়ে
ফিরে যায় পাহাড়ের কোলে।
এক থালা জোনাকি
জীবনের পরতে ছড়ায় মুক্তো
থেমে যেতে যেতে
কাঁচা ভোর মাখে শিউলির গন্ধ।
ফের নদী বয়ে চলে
সোনালী মাছের মায়া সংসার
নুন তেলে পোড়া
স্বাদ নেয় অভিশপ্ত জীবন।
দূরে যেয়ো না
গোলাম রববানী
দূরে যেয়ো না
অতো দূরে যেতে নেই, যেতে নেই
যতো দূরে গেলে নয়ন ক্ষয়ে যাই ও-কি সহা যাই
বলো হৃদয়ের দাগ কী আদৌও মুছে যাই
ততো দূরে যেতে নেই
কভু তো মানাও নেই
কাছে এসো না
পাশে থেকো না
ভুল পথে ভুল বুঝে আরো দূরে যেয়ো নাকো
মনের কাছে মনের প্রশ্ন করে দেখো আরো
ভুল বুঝে যেতে নেই,
ভুলে আসতেও তো মানা নেই
দ্যাখো পথ থেমে নেই,
পথ থেমে নেই, নেই নেই
পথের মাঝে দ্যাখো কতো ভালোবাসা লুকিয়ে
আকাশের দিকে তাকাতে তো মানা নেই, হৃদয়ে
দূরে যেয়ো না কাছে এসো না পাশে থেকো না
অতো দূরে যেতে নেই দিতে নেই হৃদয়ে ব্যথা
মানচিত্র
আহমাদ সোলায়মান
ঘুম ঘুমানো রাতে জ্বলন্ত আমার দিয়ে ফিরে তাঁকায়নি কেউ
তুমি তো নিজেকে চাঁদের থেকেও সুন্দর ভেবেছ!
হৃদয়ে যে চাওয়া ছিল, আজ তা অক-৪৭এর আঘাতে বিক্ষত-
জীবন শুধু অশ্লীল মিথ্যা পেতেই ব্যস্ত
আকাশের হৃদয়ে আর ফোটেনা হাসি।
মধ্যরাতের নামে যে অন্ধকার আছে
তাকে তুমি কাজল সাজিয়ে চোখে লাগাও
আর, আমি তা দেখে হই নেশাগ্রস্থ
অথচ, এ অন্ধকার প্রতিনিয়ত আমাকে খুন করে।
একটি রোগ ছিল, ভেবেছিলাম দু’জনে রোগী হবো
তুমি ছিলে চতুর, তুমি চোখের পাপড়ি ডুবিয়ে সমুদ্রে যাও;
বলো, ওখানে একটা মানচিত্র আঁকা আছে
আমি দেখতে যাই, আগুনে হারাই,
মিথ্যের জলের মত ওখানে কোন মানচিত্র নেই।
যে গল্পটা লেখা হয়নি....
যে গল্পটা লেখা হয়নি....
হাসান মাহাদি
আচ্ছা কোলাহল ছাড়া গল্প হয়? যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নেই সেখানে গল্প নেই। যেখানে প্রাণ আছে সেখানে কোলাহল আছে। প্রাণের অস্তিত্বের নিরবতাও কোলাহল। নিরব কোলাহল। হয়তো লেখক নেই নয়তো পাঠক নেই। শব্দের পদচারণা আছে সবখানেই, হয়তো নেই শব্দের সাথে নিঃশব্দের আরাধনা। হয়তো কখনো কখনো লেখকের অভাব নেই। অভাব শুধু গল্প আর জীবনের মেলবন্ধনের। হয়তো সেই মেলবন্ধনে সুর থাকে, থাকেনা স্বরাগমের সঠিক ব্যাকরণ।
আমি সন্যাসী নই, আমি কোলাহল খুঁজি। আমি লোকালয় খুঁজি। শত শত মানুষের রেখে যাওয়া ভীড় নিস্তব্ধ নয়। মিছিল শেষে রাজপথগুলো স্লোগানহীন নয়। গুলিস্তানের ‘একশো, একশো’ বলে দর হাকানো হকারের চিৎকার, পুরান ঢাকার অলিগলিতে লোহার দোকানগুলোর টুংটাং বিচ্ছিরি আওয়াজসহ এই শহরের যন্ত্র কিংবা মানবের অসংখ্য শব্দদূষণ রাতের আঁধারেও মিলিয়ে যায় না। দিনের বেলাতে মোটরের ধোঁয়ার কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো সেই শব্দদূষণ থেকে যায় এই শহরের বায়ুমন্ডলে। আমি শূণ্য মাস্কে সেই কার্বন ডাউ অক্সাইডে আক্রান্ত হতে মাঝ রাতে বেরিয়ে পড়ি। নিঃশব্দে শব্দের খোঁজ করতে। এ শহর আমাকে শুনায় সফলতা আর ব্যর্থতার গল্প, স্বপ্ন পূরণের গল্প, স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। সে আমাকে শুনায় সংগ্রামের গল্প। ব্যস্ততা আর বাস্তবতায় ঘিরে থাকা জীবনে যে গল্পগুলো শুনার সময় হয় না, সেগুলো এ শহর আমাকে বলে। জীবিকার তাড়নায় কত মানুষের কত রাত বিনিদ্রা আর হাহাকারে মিশে একাকার হয়ে গেছে তার হদিস শুধু লিপিবদ্ধ আছে এই শহরের খামোশ শুনানিতে।
আচ্ছা অন্যের গল্প খুঁজে কি লাভ? আমারো অনেক গল্প এই শহরের বোবা আর্কাইভে জমা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গল্প লিখেই কি লাভ? কিছুদিন পর ব্যর্থ হলে অন্যের সমবেদনাও আমাকে স্পর্শ করবে না। স্বপ্নের পেছনে ছুটছি আমিও। সফলতার সন্ধানে আমিও আছি। এই শহরের ছুটন্ত প্রত্যেকটা জীবনই জানে ব্যর্থতার গল্প কেউ শুনতে চায় না। ব্যর্থতার সবগল্পই দূষিত শহরের ধূলোর আর্কাইভে ঢাকা পরে যায়। শুধু সফলতার গল্পগুলোই কোলাহলের বিলবোর্ডে বিউগল হয়ে বাজতে থাকে।
দিন শেষে গল্প সেগুলোই যেগুলো মানুষ শুনতে চায়। আমি গল্পকার নই। কাউকে শুনানোর মতো নিজের সেই গল্পটা এখনো লিখতে পারিনি।
ভিক্টোরিয়া পার্ক, পুরান ঢাকা।
শব্দমালা : শোয়াইব শাহরিয়ার
শব্দমালা
শোয়াইব শাহরিয়ার
প্রেম
নদীর পাশে জীবন
পাখির কিচিরমিচির
আহবান-
এসো, নত হও।
তারপর-
ভেতরে প্রবেশ
উপচে পড়ে ঢেউ
আহ্লাদে মেতে ওঠে উপাসনালয়।
তথাপি, উষ্ণতা- শীৎকার- আহ, উহ, আহ!
তথাপি, জীবন- পতন্মুখ- ইশ, ইয়াহু...ইশ!
তথাপি-
হৃদয়ের নিভৃত কোণে প্রতিধ্বনিত হয় প্রেম!
সাক্ষী
আমি বৃক্ষ হয়েছি
পাড়ার কেউ জানে না
পাখি, তুমিও জানো না
উড়াল শেষে
ফিরবে বলে
বৃক্ষ হয়েছি;
ব্যাধিগ্রস্থ জেনেও
ফিরবে বলে
মহাকালের সাক্ষী হয়েছি...
দংশন
টিনের বুকে
বৃষ্টি পড়ার শব্দ
হাতুড়ি পেটার মতো
নীরবে সহ্য করে প্রেমের দংশন;
আজকাল,
হাতুড়ি পেটার শব্দে তোমার কথা মনে পড়ে!
সম্পর্ক
সেতু গড়েছি সম্পর্কের সুতোয়
একটু-একটু করে
সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা-রাতে
যখনি পেয়েছি সময়,
গড়েছি কী ভীষণ উৎসাহে!
আজ দেখি সেতু আছে
সুতো আছে
প্রবাহিত নদী আছে
নেই কেবল তুমি আর আমি...
অমুসলিমদের প্রতি উদারতা বিশ্বনবীর অনন্য দৃষ্টান্ত...
অমুসলিমদের প্রতি উদারতা
বিশ্বনবীর অনন্য দৃষ্টান্ত
মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন
মানবজাতির আদর্শ ও মডেল হিসেবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন। তিনি শুধু মুসলমানদের জন্য নয়,অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সহ সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ। এক্ষেত্রে আল্লাহ রাববুল আলামীন কুরআনে ঘোষণা করেছেন- ‘‘হে নবী আপনি নীতি-নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত’’। আর মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আদর্শ তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ২১)।
আল কুরআনে এসেছে, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত করে পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ১০৭)।
আল কুরআনে আরো আছে, ‘আপনিই সেই মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যাকে আমি বিশ্বমানবতার জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ তা জানে না।’ (সুরা সাবা : আয়াত ২৮)। সংখ্যালঘু অমুসলিমদের প্রতি ভালেবাসা কিংবা উদারতা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)।
ইসলামে কোনো অমুসলিমকে জিহবা বা হাত পা দিয়ে কষ্ট দেয়া, গালি দেয়া এমন কি গীবত করাও অবৈধ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তারা আল্লাহ তা‘আলার বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালি দিয়ো না, নইলে তারাও শত্রুতার কারণে না জেনে আল্লাহ তা‘আলাকেও গালি দেবে, আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই তাদের কার্যকলাপ সুশোভনীয় করে রেখেছি, অতঃপর সবাইকে একদিন তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে, তারপর তিনি তাদের বলে দেবেন, তারা দুনিয়ার জীবনে কে কী কাজ করে এসেছে’। (সূরা আল আন‘আম, আয়াত : ১০৮)
দুর্রুল মুখতারে আছে, “তাকে কশঝট দেয়া থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব এবং তার গীবত করা মুসলমানের গীবত করার মতোই হারাম।” (৩য় খন্ড, পৃঃ. ২৭৩-২৭৪)
অমুসলিমদেরকে জোর প্রয়োগ করে ইসলামে দীক্ষিত করার কোনো বিধান নেই। আল্লাহ বলেন, ‘দ্বীন সম্পর্কে জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা কখনো ভাঙবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৬)।
ইসলাম অমুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করেছে। ধর্মপালনের পূর্ণ স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন , ‘তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আমার দ্বীন আমার।’ (সুরা : কাফিরুন, আয়াত : ৬)। তবে অমুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মুসলিমদের অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই। হযরত উমার (রা) বলেন, তোমরা আল্লাহর দুশমনদের উৎসবগুলোতে অংশগ্রহন থেকে বেঁচে থাকো। (আসসুনানুল কুবরা ১৮৮৬২) অন্য বর্ণনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাসূল (সা) থেকে বর্ণনা করেন, যারা বিধর্মীদের মত উৎসব করবে, কিয়ামত দিবসে তাদের হাশর ঐ লোকদের সাথেই হবে। (আসসুনানুল কুবরা, হাদিস ১৫৫৬৩)
উমার ইবনে খাত্তাব বলেছেন “তোমরা মুশরিকদের উপসনালয়ে তাদের উৎসবের দিনগুলোতে প্রবেশ করোনা। কারন সেই সময় তাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হতে থাকে। (বায়হাক্বী)।
মুসলিম জনপদগুলিতে অমুসলিমদের যেসব প্রাচীন উপাসনালয় থাকবে, তাতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। উপাসনালয় যদি ভেংগে যায়, তবে একই জায়গায় পুননির্মাণের অধিকারও তাদের আছে। তবে নতুন উপসনালয় বানানোর অধিকার নেই। (বাদায়ে, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১১৪; শরহু সিয়রিল কবীর, ৩য় খন্ড, পৃ. ২৫১)
ব্যবসায়ের যেসব পন্থা মুসলমানদের জন্য যা নিষিদ্ধ, তা তাদের জন্যও নিষিদ্ধ। তবে অমুসলিমরা শুধুমাত্র শূকরের বেচাকেনা, খাওয়া এবং মদ বানানো, পান ও কেনাবেচা করতে পারবে। (আল-মাসবূত, ১৩শ খন্ড, পৃ. ৩৭-৩৮)
কোনো মুসলমান কোনো অমুসলিমের মদ বা শূকরের ক্ষতি সাধন করলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। র্দুরে মুখতারে আছেঃ “মুসলমান যদি মদ ও শূকরের ক্ষতি করে তবে তার মূল্য দিতে বাধ্য থাকবে।” [৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৭৩]
তবে এব্যাপারে ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, “যেসব জনপদকে মুসলমানরা বাসযোগ্য বানিয়েছে, সেখানে অমুসলিমদের নতুন মন্দির, গীর্জা ও উপাসনালয় বানানো, বাদ্য বাজানো এবং প্রকাশ্যে শূকরের গোশত ও মদ বিক্রি করার কোন অধিকার নেই।
ওাসুলুল্লাহ (সা) অমুসলিমদের ওপর জুলুম করতে নিষেধ করেছেন, তিনি বলেন, ‘তোমরা মজলুমের বদ-দোয়া থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফির হয়। কারণ তার (মজলুমের) মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা থাকে না। অর্থাৎ তার বদ-দোয়াও দ্রুত কবুল হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমাদ)।
বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) অমুসলিমদের সুরক্ষা এবং জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধ ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি, হাদিস : ২৯৯৫)।
আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবী বাকরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
‘যে ব্যক্তি চুক্তিতে থাকা কোনো অমুসলিমকে অসময়ে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’। [আবূ দাঊদ : ২৭৬০; নাসাঈ : ৪৭৪৭)।
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রাসূল (সা) নিজের কোনো বাহিনী যুদ্ধে প্রেরণ করলে বলতেন, ‘তোমরা গির্জার অধিবাসীদের হত্যা করবে না।’(ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ : ৩৩৮০৪; কিতাবুল জিহাদ)
হাদীসে শরীফে এসেছে, ‘সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব।’ (আবূ দাঊদ : ৩০৫২)।
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ ও মানবিক আচরণ প্রদর্শন মহানবী (সা) এর অন্যতম নির্দেশনা। হাদীস শরীফে এসেছে, একদিন সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) ও কায়েস ইবনে সাদ (রা.) কাদেসিয়াতে বসা ছিলেন। তখন তাঁদের পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে কিছু লোক অতিক্রম করল। তাঁরা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাঁদের বলা হলো, লাশটি অমুসলিমের। তাঁরা বলেন, মহানবী (সা.)-এর পাশ দিয়ে একসময় একটি লাশ নেওয়া হয়েছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁকে বলা হলো, এটা তো এক ইহুদির লাশ। তখন তিনি বলেন, ‘তা কি প্রাণ নয়?’ (বুখারি, হাদিস : ১২৫০)।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একদা এক বেদুঈন মসজিদে প্রসাব করলো। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। মহানবী (সা.) বললেন, তার প্র¯্রাব বন্ধ করো না। তারপর তিনি (সা.) এক বালাতি পানি আনলেন এবং পানি প্রস্রাবের ওপর ঢেলে দেয়া হল।’ (সহীহ বোখারী, কিতাবুল আদব)।
অমুসলিম প্রতিবেশী বিপদগ্রস্থ হলে মুসলমানদের উচিত তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি তাদের সঙ্গে মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)।
সাহাবায়ে কেরামগণের জীবনী থেকেও অমুসলিমদের প্রতি সহযোগিতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
(১) সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর ঘরে একদিন একটি বকরি জবাই করা হল। খাবার রান্না হলে তিনি তার গোলামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীকে কি এ খাবার দিয়েছ?’ এরপর তিনি বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, প্রতিবেশীর বিষয়ে জিবরাইল আমাকে এত উপদেশ দিচ্ছিলেন, আমি মনে করছিলাম, তিনি হয়ত তাদেরকে ওয়ারিশই বানিয়ে দেবেন।’ (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৯৪৩)
(২) হযরত উমর (রা.) তখন খলীফাতুল মুসলিমীন। একদিন এক ইহুদি বৃদ্ধকে দেখলেন মসজিদের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে বেড়াতে। তখন তিনি ইহুদিকে লক্ষ করে বললেন, আমি আপনার ওপর ইনসাফ করতে পারিনি যদি আপনার যৌবনে আমি আপনার নিকট থেকে জিয়্যা গ্রহণ করে থাকি আর আপনার বার্ধক্যে আপনাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেই। এরপর তিনি তার জন্যে বায়তুল মাল থেকে প্রয়োজনীয় ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। (কিতাবুল আমওয়াল, ইবনে যানজূয়াহ্, ১/১৪৩, হাদীস ১৭৯)।
অমুসলিমদের সাথে আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবার আদান-প্রদান পরিচালনা করতে কোনো বাধা নেই।
ইমাম নববী বলেন, জিম্মি (মুসলিম দেশে মুসলিম সরকারের জিম্মা বা নিরাপত্তায় থাকা অমুসলিম) এবং অন্যান্য কাফেরের সাথে পারস্পারিক লেনদেন ও আদান-প্রদান বৈধ-যদি এর সাথে সাথে এমন কিছু না থাকে যা হারাম হওয়া সুনিশ্চিত। কিন্তু হারবি (মুসলিমদের সাথে যুদ্ধরত কাফির) এর নিকট অস্ত্র এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম বিক্রয় করা নাজায়েজ।
হাদীস শরীফে এসেছে, আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সা) যবের বিনিময়ে তাঁর বর্ম বন্ধক রেখেছিলেন।” (সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৪০/ বন্ধক, হা/১৫৭৬)
হাদীস শরীফে আরও এসেছে, আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা) জনৈক ইহুদির কাছ হতে নির্দিষ্ট মেয়াদে খাদ্য শস্য খরিদ করেন এবং নিজের বর্ম তার কাছে বন্ধক রাখেন।” (সহীহ বুখারী (তাওহীদ) ৪৮/ বন্ধক (كتاب الرهن), পরিচ্ছেদ: ৪৮/২. যে ব্যক্তি নিজ বর্ম বন্ধক রাখে। হা/২৫০৯)
হাদিসে আরও বর্ণিত হয়েছে, দীর্ঘ দেহী এলোমেলো চুল ওয়ালা এক মুশরিক এক পাল বকরী হাঁকিয়ে নিয়ে এলো। নবী করীম ( সা) জিজ্ঞেস করলেন: বিক্রি করবে, না উপহার দিবে? সে বলল, না, বরং বিক্রি করব। অত:পর নবী করীম ( সা) তার নিকট হতে একটা বকরী কিনে নিলেন।” (সহীহ বুখারী (তাওহীদ) ৫১/ হিবা ও এর ফযীলত৫,পরিচ্ছেদ: ৫১/২৮।)
অমুসলিম রোগীকে দেখতে যাওয়াও সুন্নত। নবী করীম (সা.) অমুসলিম রোগীদের দেখতে যেতেন এবং তাদের ঈমানের দাওয়াত দিতেন। তাদের সেবা করতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইহুদি নবী (সা.)-এর খেদমত করত। সে অসুস্থ হলে নবী (সা.) তাকে দেখতে গেলেন। তার মাথার দিকে বসে নবীজি বলেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো। তখন সে তার পিতার দিকে তাকাল। পিতা বলেন, তুমি আবুল কাসেমের (নবীর) অনুসরণ করো। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করল। তখন নবী (সা.) এই বলে বের হলেন, ‘আল্লাহর শুকরিয়া, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ১২৯০)
সব ধর্মের মানুষ প্রতিবেশী হতে পারে। প্রতিবেশী যে ধর্মেরই হোক প্রতিবেশী হিসেবে তাদের প্রতি সদয় আচরণ, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনে কোনো প্রকার ত্রুটি করা যাবে না। প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষায় বিশ্বনবী (সা) অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে শর্ত হল, কোন হারাম কাজে যুক্ত হওয়া যাবে না বা হারাম কাজে সহায়তা করা যাবে না। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।’ (সূরা মায়িদা: ২)
ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জিবরাঈল (আ.) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অবিরত উপদেশ দিচ্ছিলেন, এমনকি আমি ধারণা করলাম যে, আল্লাহ তাদের ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৬৬৮; মুসলিম, হাদিস : ৬৮৫৪)
আত্মীয় অমুসলিম হলেও সম্পর্ক রক্ষা করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার মাতা-পিতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মানবে না, তবে পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে বসবাস করবে সদ্ভাবে।’ (সুরা : লোকমান, আয়াত : ১৫)।
আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, রাসুলের যুগে আমার মা আমার কাছে এলেন মুশরিক অবস্থায়। তখন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মা এসেছেন, তিনি অমুসলিম। আমি কি তাঁর আত্মীয়তা রক্ষা করব? নবী (সা.) বলেন, হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করো। (বুখারি, হাদিস : ২৪৭৭)
তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রে একজন মুসলমান যেমনি বাক স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা এবং মতামত ও বিবেকের স্বাধীনতা ভোগ করে, অমুসলিমরাও তেমনি স্বাধীনতা ভোগ করবে। এ ব্যাপারে যেসব আইনগত বিধি নিষেধ মুসলমানদের ওপর থাকবে, তা তাদের ওপরও থাকবে।
মিথ্যে কথার শহরে !
মিথ্যে কথার শহরে
আহাদ আদনান
একবার এক হাতে বানানো কাগজের উড়োজাহাজ খেলায় মেতেছিল এক রূপসীর মনের সাথে। ‘আমরা দুজনই উড়ব হাওয়ায় হাওয়ায়। বাঁক নিব নাইট্রোজেন অণুর সাথে সাথে। গতিবেগ পালটাবে প্রতি সেকেন্ডে। দেখি, কে বেশি দিক বদলাতে পারে’।
এই গল্পটা আমি প্রায়ই টেক্সট করতাম শারলিন’কে। পাল্টা টেক্সট আসত, ‘তুই একটা জাজমেন্টাল’। সাথে ‘অ্যাংরি’ চেহারা’র একটা স্টীকার।
মাঝরাত। সারা শহরে চলছে তীব্র লকডাউন। লোকজন এমনিতেই কম। পুলিশ চেকপোস্টে আমরা ক’জন ডিউটি করছি। মাঝেমাঝে কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স, কিছু মিডিয়ার গাড়ি, অক্সিজেন সিলিন্ডার বাহন চলাচল করছে। ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এই এলাকার আকাশচুম্বী অট্টালিকার জঙ্গলে দাঁড়িয়ে খুব মনে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়ের সেই উড়োজাহাজের গল্প।
শারলিন’কে আপনারা চিনেন। একটা টিভি চ্যানেলে রাত নয়টা-দশটায় টকশো উপস্থাপনা করে। ওর ভাষায় ‘হোস্ট’। জাঁদরেল জাঁদরেল বোদ্ধাদের কুপোকাত করে দেয় প্রশ্নবাণে। এখনও যখন কথা হয় আমাদের ভিডিও কলে, আর আমি ভুলে যাই ওর চ্যানেলের নাম, রাগ করে খুব। বেশি রাগলে বলি, ‘তাও তোমার চেয়ে ভালো। বয়ফ্রেন্ডের নাম’টা মনে থাকে না, আবার বড় বড় কথা’। দুম করে কল’ই কেটে দেয় মেয়েটা। ওদের বিল্ডিঙটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ডিউটি করছি। মনে না পড়ে উপায় আছে?
এটা ওর বিল্ডিং, কিছুদিন আগেও জানা ছিল না আমার। হ্যা, আমি জানতাম ওর বর, মানে টিভি নাটকের ক্রেজ রুপম এই এলাকায় থাকে। এখন অবশ্য ক্রেজ একটু কমতির দিকে। তবে জনপ্রিয় হলেই কি তার ঠিকানা মুখস্ত রাখতে হবে নাকি? হোক সে এক্স গার্লফ্রেন্ডের ‘হাবি’ (এই শব্দটা শারলিন ফেসবুকে খুব ব্যবহার করত), আমার কি এসে যায়? এখন শহরের অনেক লোকই নাকি এই বিল্ডিঙটা চিনে গেছে।
‘বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন মিডিয়া সেলেব্রেটি শারলিন’। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে খবরটা চোখে পড়তেই আমি আঁতকে উঠেছিলাম। করোনা আক্রান্ত হয়ে আমি তখন বাড়িতে আইসোলেশনে। ডিউটিতে থাকলে আরও আগেই জানতে পারতাম। এরপর ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা নিউজ পোর্টালে খবরের বেসাতি। টিভি’তে ভাঁড়ামি পর্যায়ের রিপোর্টিং। হাইব্রিড খবরের ভিড়ে সত্যটা জানা হয়নি আর। শুধু জানি, রুপম এখন কারাগারে। শারলিন সুস্থ হয়ে উঠেছে।
এই নড়বড়ে দাম্পত্যের মাঝেই একদিন একটা টেক্সট।
‘হায়, সেলেব্রেটি কপ। খুব দেখছি তোমায় আজকাল টিভি’তে’?
আমার কি কোন রিপ্লাই করা উচিত? আইনের যুক্তি বলছে, আপদ হতে সাবধান। মন বলছে অন্যকিছু।
‘হ্যালো, সেলেব্রেটি হোস্ট। তোমাকে দেখছি না আজকাল, কী যেন চ্যানেলটা’?
‘আমাদের চ্যানেলের নাম মনে রাখা কিন্তু তোমার জেনারেল নলেজের মধ্যে পড়ে’।
‘প্রেমিককে দেওয়া কথা ভুলে যাওয়া বুঝি স্মার্টনেসের অংশ’?
‘কে বলল, ভুলে গেছি? ভার্সিটির একেবারে প্রথমদিন, প্রথম বেঞ্চে কে ছিল মনে আছে। সাদা চেক শার্ট, নীল জিনস। সিনিয়র এক পাতি নেতা এসে আগডুম বাগডুম করছিল। এক ঘুষিতে নাকের হাড় কে ভেঙে দিয়েছিল এখনও ভুলিনি’।
‘সেটাই। আর বিয়ে করবে বলেছিলে? গুঞ্জন ছিল টাটকা। চ্যানেলে ডাক পাচ্ছিলে খুব। আর সেই ছেলেটাও একটু আধটু নাম করছে। তখন তুমি বেশি করতে সকালের অনুষ্ঠান। নতুন একটা ছেলের সাক্ষাৎকার নিবে, এটাই বলেছিলে না? তলে তলে প্রেমও ছিল? কই, আমাকে তো বলোনি’।
এরপর কথা চলতে থাকে রোজ। নিউজ পোর্টালে ওদের ডিভোর্সের গুঞ্জন ভাসতে থাকে। কি ভেবে যেন আমি ‘লাভ রিয়েক্ট’ করে ফেলি। রাত একটায় ওর বিল্ডিঙের নিচে দাঁড়িয়ে উড়োজাহাজের গল্প ভাবি। এটাকে যেন উসকে দেয় আমার ‘টেলিপ্যাথি’।
‘কী, আমার কথা ভাবছ কেন? ডিউটি কর ঠিকমতো’।
‘মানে কি? কোথায় ডিউটি’?
‘এই যে, আমার বাড়ির সামনে। একটা মোটরসাইকেল গেল। কি জিগ্যেস করলে থামিয়ে’?
‘ওহ, ওটা তোমাদের গোত্রের। তা আমায় দেখছ বুঝি? তোমার ফ্ল্যাটের আলোতো নেভানো। আমি ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছ। চৌদ্দ তলার উপর থেকে চিনলে কেমন করে’?
‘তোমার সারা মাসের রোস্টার আমার কাছে আছে। বুঝেছ আমার লিংক কতদূর’?
‘তো এতক্ষণ কেন নক করোনি? এই এক’টায় মনে পড়ল’?
‘ব্যস্ত ছিলাম’।
‘কীসের এত ব্যস্ততা’?
‘আচ্ছা, তুমি আমাকে একটা উড়োজাহাজের গল্প করতে মনে আছে’?
মেয়েটা প্রতি মুহূর্তে আমাকে অবাক করার তালে আছে দেখছি।
‘আছে। কী হয়েছে উড়োজাহাজের’?
‘একটা পরীক্ষা নেব তোমার। আমি তোমাকে একটা চিঠি লিখেছি, কাগজে। হয়ত টেক্সট করতে পারতাম, সাহসে কুলায়নি। কাগজটা দিয়ে একটা উড়োজাহাজ বানিয়েছি। চৌদ্দ তলা থেকে ছুঁড়ব। ধরতে পারবে’?
নিস্তব্ধ রাত। আমরা আটজন মাত্র লোক এই সুনসান পথে। হাওয়া বইছে মৃদু মন্দ। হাওয়াতে ভাসছে একটা কাগজের উড়োজাহাজ, একটা চিঠি। ডানে, বামে, সামনে, পিছনে। রীতিমত দৌড়তে হচ্ছে আমাকে। আমার সহকর্মীরা অবাক তাকিয়ে আছে। মজা করে ভিডিও করছে একজন। ওরা জানেনা, এই চিঠিটা আমার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারে এক টুকরো কাগজ। মাটিতে পড়ার আগেই ছোঁ করে ধরে ফেলি উড়োজাহাজ।
‘রুপম ছাড়া পেয়েছে সন্ধায়। এতক্ষণ ওর সাথে ছিলাম। এক বিছানায়। এখন শয়তানটার কাছে ম্যাসেজ এসেছে আরটি পিসিআর ফর কোভিড পজিটিভ। আমার ভিতরেও হয়ত ঢুকিয়ে দিয়েছে ভাইরাস। এই চিঠির কাগজেও হয়ত চলে গেল কয়েকটা কোভিড নাইনটিন ডেল্টা। এই শহরের বাতাস খুব বিষাক্ত। কাল থেকে তোমার নতুন পোস্টিং। আর ডিউটি করতে হবে না এই মিথ্যে কথার শহরে। ভালো থেকো। পারবে, ভালো থাকতে’?
পদাবলি
ঘূর্ণায়মান ইঙ্গিত
মো. রতন ইসলাম
পোড়া বাঁশের বাঁশিতে ঢেলেছি হর্ষের ¯্রােত-সুর
শূন্যতার চূড়া ছুঁতে আড়ালে মেলেছি হৃদডানা,
ডালিম ফলের মতো ওপরে সবুজে ভরপুর
ভেতরে আলাদা চিত্র প্রগাঢ় রক্তাভ প্রতিদানা!
অপেক্ষার মরুপ্রান্তে উপেক্ষার লু-হাওয়ায় দংশে
মুখ ফেরায় তটিনী তার তটে আঙুল বাড়াতে,
ক্লেশ হতে শ্লেষ বেছে নেয় সময়ের রাজহংসে
অবশিষ্ট জেল্লাটুকু চায় ক্লিষ্ট-আঘাতে তাড়াতে!
পদতলে চাপা পড়ে তবু চাঁপা সুবাস বিলায়
যদি সেই পথচারি সুদূর গিয়েও পিছু ফেরে,
রাত্রি ভেঙে রাঙারবি সাড়া দেবে আকাশ-নীলায়
ঘূর্ণায়মান পৃথিবী এটাই বোঝায় চক্ষু নেড়ে।
একচোখে স্বপ্ন পুষি একচোখে পুষি বাস্তবতা,
পোড়া দেয়াল বেয়েও বেড়ে ওঠে কত গুল্মলতা।
কবি ও কবিতার রাজ্য
হিলারী হিটলার আভী
আমি মন্ত্রী কিংবা এমপি কিংবা সচিব বুঝি না!
আমার রাজ্যে আমিই রাজা!
ঠিক সৌরজগতের সমান’ই আমার একটি মনন রাজ্য আছে-
আমার রাজ্যের নাম- ‘কবি ও কবিতার রাজ্য’
তিনটি কবিতা
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
মৃত্যুউৎসব
কফিনের শুভ্র ঘ্রাণ নাকে লাগে
সাদা ধবধবে সুতির থানকাপড়
আতর লোবানের সুবাস মিশে আছে
সমবেত নি®েপ্রহ নিরুত্তাপ চোখে করুণ বৃষ্টি-
আজ কোনো মাদকতা নেই ।
কলঙ্কঅধ্যায়
রাত্রির অন্ধকারে ঘিয়ে ভাঁজা লুচির স্বাদ;
পররমণীর দেহ সম্ভোগের মতো মনে হয়
অভিশপ্ত নগরীতে জন্ম নেয় পাপের সন্তান,
কেউ কেউ পিতৃপরিচয় ছাড়াই বড় হয়
‘৭১ দুই লক্ষ মা-বোনের কলঙ্ক অধ্যায়।
কবিতার আত্মহত্যা
বিউটি বোডিংয়ে দুপুরের নাস্তা সেরে
যে ছেলেটি একখানা কবিতা লিখবে
বলে ভেবেছে,
তার কাছে খবর পেলুন-
নিষিদ্ধ জার্নালে একটি নিউজ এসেছে
অনাগত কবিদের নামে হুলিয়া জারি করা হবে
বাংলা কবিতা নাকি আত্মহত্যা করেছে !
একা
রুশো আরভি নয়ন
একা থাকতে শেখো প্রিয়
হঠাৎ করে দেখা হলে,
একটি নীল পদ্ম দিও।
অপেক্ষাটুকু দিয়ে আমায়
অভিমান গুলি নিও,
হঠাৎ করে আজ তুমি
একা থাকতে শেখো প্রিয়।
নদীর ঢেউয়ের রঙে তুমি
মেঘলা আকাশ দিও,
আবছা আলোই আমায় তুমি
আনমনে একেঁ নিও।
তৃষ্ণাটুকু দিও আমায়
সুখটুকু তুমি নিও,
এবার থেকে একটু তুমি
একা থাকতে শেখো প্রিয়।
বৃষ্টিতে হৃদয় রক্তক্ষরণ
আজই হতে দিও,
আমার চোখের নোনাজল
বুঝে তুমি নিও।
প্রেমের বিষে মেরো তুমি
ভালোবাসা তুমি নিও,
কষ্ট করে আজ না হয়
একা থাকতে শেখো প্রিয়।
অভিশাপ দিচ্ছি
রফিকুল নাজিম
আমি অভিশাপ দিচ্ছি
তুমি শত চেষ্টা করেও আমাকে ভুলতে পারবে না,
আমি অভিশাপ দিচ্ছি
আমাকে ছাড়া তুমি অন্য কোনো আকাশ চিনবে না
অন্য কোনো পাখি, নদী, ফুল, পাহাড় কিংবা দীঘল পথ
বেমালুম ভুলে গিয়ে জিবে কামড় বসাবে লজ্জায়!
আমি আরো অভিশাপ দিচ্ছি
তুমি হঠাৎ আমাকে ছেড়ে চলে গেলেও
তোমাকে ফিরে আসতেই হবে; সহাস্যে।
আমি এমন অভিশাপ দিচ্ছি যে
আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে তুমি ভালোবাসতে ভুলে যাবে
শুধু আমাকে নিয়েই তুমি ভাবনার জগতে ডুবে থাকবে।
আমাকে তুমি ভালোবাসতে বাসতে
একদিন ভালোবাসার সব কলাকৌশল রপ্ত করে
তুমি কেবল আমাকেই ভালোবাসবে।
কবি ও পাঠকে সংঘাত !
কবি ও পাঠকে সংঘাত
আকিব শিকদার
কবিদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ বোদ্ধা পাঠক নেই, তাই তাঁর কবিতা যথার্থ মূল্যায়িত হয় না। কবিতা বোঝার দরকারি প্রস্তুতি, সক্ষমতা ও বিদ্যেবুদ্ধিও নেই এ-কালের পাঠকদের।
পাঠক বলেন - কবিতা এখন এমন যে, রান্না করা গোস্ত যা হাতদিয়ে ছেঁড়া যায় না, দাঁত দিয়ে কাটা যায় না। সব পাঠকের পক্ষে সেই কবিতা গিলাও সম্ভব না, হজম হওয়া তো পরের কথা। আমি যদি রবি-নজরুলকে বুঝতে পারি, তাহলে হালের নবু-সবুর কবিতা বুঝবো না কেন?
কবি বলেন - সব যুগেই এমন কিছু পাঠক থাকেন, যারা নিজের যুগটিকে ঊষর, অনুর্বর, পশ্চাৎপদ মনে করে। বর্তমানে আমরা যে অতীত সময়ের গুণগানে পঞ্চমুখ, সেই সময়েও এমন কিছু লোক ছিলো, যারা সেই সময়টিকে নিষ্ফল কলিরযুগ বলে আখ্যায়িত করতো। আসলে দেখার জন্য একটি দূরত্বের প্রয়োজন, যেমন পৃথিবীতে বসে কখনো বুঝা যায় না- পৃথিবী গোল এবং ঘূর্ণয়মান।
কবি ও পাঠকের এই পারস্পরিক দোষারোপ চিরন্তন। কবি কামনা করেন ঋদ্ধ, শানিত পাঠক,আর পাঠক চান বোধগম্য জীবনবাদী রসোত্তীর্ণ কবিতা। কবির দূর্বোধ্য জটিল কাব্যকলার রসাস্বাদনে পাঠক যখন হিমসিম খায়, তখন কবির অভিযোগ,পাঠকের প্রস্তুতি যথার্থ নয়। এই দ্বন্দ্বের পরিনতিতে কবি আর পাঠক ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। হাজার হাজার কবিতার বই প্রতি বছর প্রকাশিত হচ্ছে কিন্তু দুই চারজন কবি কিনলেও বিশাল পাঠক তার ধারে কাছেও যাচ্ছে না।
কোন কোন কবি মনেকরেন তাদের কবিতা এই যুগে নয়, আগামী প্রজন্মের কাছে গুরুত্ব পাবে। সমকাল গ্রহণ না করলেও সুদূর ভবিষ্যৎ তাঁদের স্বীকৃতি দেবে। বেশিরভাগ কবিই তো মৃত্যুর পর মূল্যায়িত হয়। তাই যুগের প্রয়োজন মেটাতে এবং পাঠকের মন-মানসিকতা ও বোধগম্যতাকে প্রশ্রয় দিয়ে কবিতা-কর্মে ব্যাপৃত থাকার দরকার কী!
পাঠক বলেন - কোনও সময়ের একশো-দুশো কবির মধ্যে থেকে মৃত্যু-পরবর্তী খ্যাতি বজায় থাকে হাতে-গোনা এক বা দুজনের। যারা মৃত্যুর পর মূল্যায়িত হয় তাদের অধিকাংশের ভালো লেখাগুলো প্রকাশিতও হয়েছে মৃত্যুর পর। আর বর্তমান কবিদের অধিকাংশ কবিতা লেখার পর-পরই ফেইসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। অতএব পরবর্তী কোন যুগে যে মূল্যায়িত হবে তার গ্যারান্টি কী? কবিতা সমকালের চেয়ে এগিয়ে থাকা শিল্প, এ কথা ঠিক, তবে সমকালও তার ঔজ্জ্বল্যের আলো টের পায়।
কবিতায় বাক্যের মাধ্যমে অন্ধকে চক্ষু দানের মতো কাজ করেন চক্ষুমান কবি। কবিতা রচনায় কল্পনা এবং অনুভব শক্তির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কবিতা পড়ার জন্য পাঠকদেরকেও অবশ্যই কল্পনা শক্তি সম্পন্ন হতে হবে। কল্পনা শক্তি যার যত দুর্বল কবিতা পড়ে সে তত কম আনন্দ পায়। কবিরা তাদের সুন্দর সুন্দর ভাষা দিয়ে হৃদয়ের আবেগ কে মিশিয়ে কবিতাকে তুলে ধরেন। সাধারণ মানুষের ধারণা একেবারেই ভিন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কবিতা প্রিয় পাঠকদের কাছেও কবিতার বেপারে গোলমেলে ধারণা পাওয়া যায়।
ছন্দকে কোন কোন কবি কবিতার প্রাণ মনেকরেন, কেউ কেউ ছন্দ না জেনেই কবিতা লেখেন। কবিরা অনেক সময় নিজস্ব স্টাইল তৈরি করতে গিয়ে বিদঘুটে শব্দ বা বাক্য তৈরি করে আজগুবি কবিতা লেখেন, যা তার বিরুদ্ধে পাঠকদেরকে ক্ষ্যাপিয়ে তুলে, যুদ্ধ ঘোষণা করতে প্রলুব্ধ করে। রেগেমেগে পাঠক বলেন - জনগণের কাছে যার কোন চাহিদা নেই ,তা হচ্ছে কবিতা। আর পদতলে স্থান বলে কবিতার আরেক নাম পদ্য! পাঠকের কী ঠেকা পড়েছে আবর্জনা ঘেটে দূর্গন্ধ ছড়ানোর!
কবি কবিতাকে জীবন্ময় করে তুলতে পারছেন না। অন্যদিকে পাঠক কবিতায় মন বসাতে পারছে না। কবিতার দেহ-বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন, প্রকাশ ভঙ্গি খানিকটা দুর্বোধ্য হওয়া ও শব্দচয়নে অসতর্কতা, কবিতা সাম্প্রতিক পাঠকের হৃদয়গ্রাহী হচ্ছে না। কবিরাই কবিতাকে নির্জন দ্বীপে বসবাস করতে বাধ্য করেছে।
ভালো কবিতার সমালোচক ভালো কবিতা লেখক নাও হতে পারেন, ক্রিকেট টিমের একজন ভালো কোচ যেমন একজন ভালো খেলোয়াড় নন। কোন কোন কবি গোয়ারের মতো বলেন, কেউ কবিতা বুঝুক, আর না বুঝুক প্রকৃত কবির কলম থেমে থাকে না। পাঠপ্রিয়তা না পেয়ে কেউ-কেউ আবার বলেন, তাঁরা নিজের জন্যই লেখেন। অথচ তাঁরাই আবার পত্র-পত্রিকায়, অনলাইন মাধ্যমে ও পুস্তকাকারে লেখা প্রকাশে কুণ্ঠিত নন। কী স্ববিরোধিতা!
পাঠক বলেন - যে লেখক পাঠকের মনমতো লেখা লেখতে পারে না, সে যতই বই প্রকাশ করোক, সেটা মুলত তার নিজের জন্যই লেখা। পাঠকের যদি ভাল না লাগে, তাহলে বই প্রকাশ করে কি লাভ, আর নিজের জন্য লিখলে তো ডায়রীর পাতা ভরালেই হয়।
কেউ কথায় পিছিয়ে থাকতে চায় না। সবাই রাজা,শুধু প্রজার অভাব। যেসব কবি অনেক লম্ফঝম্প করেও আলোচনায় আসতে পারছেন না, তাঁরা আবার নিজেকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে বলেন, জীবনানন্দ দাশ ও তো জীবদ্দশায় অবহেলার পাত্র ছিলেন। কত সাহিত্য সম্পাদক তার লেখাকে নিয়ে কবিতা হয়নি, ভুলে ভরা কবিতা ইত্যাদি বলে নির্দয় রসিকতা করতো। আর এখন তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শুদ্ধতম কবি।
এ বেপারে পাঠকের মন্তব্য - ও কবি... আপনি কি জানেন, জীবনানন্দ জীবদ্দশায় দুটি পুরস্কার পেয়েছিলেন? তার কবিতা নিয়ে সমসাময়িক সাহিত্যবোদ্ধাদের মাঝে তুমুল আলোচনার ঝড় উঠেছিল। সে যুগে কিন্তু টাকার বিনিময়ে বা রাজনৈতিক হল্লা দেখিয়ে পদক দেওয়া হতো না। হেলাল হাফিজ কেন স্বল্প সংখ্যক কবিতা লেখে এতো জনপ্রিয়? তাঁর ভাষার কাঠিন্য কম এবং বোধগম্য। কবিতা হওয়া উচিত আম-জনতার টেম্পোরাল ভাষায়। তা হলেই একজন কবি গণমানুষের কবি হতে পারবে।
তবে পাঠককেও মনে রাখতে হবে, পাঠকের আগ্রহের উপর কবিতার ভালোলাগা নির্ভর করে। শুরুতেই ভালো মন নিয়ে, পজিটিভ চিন্তা নিয়ে কবিতা পড়া শুরু করলে দুর্বল-অস্বস্তিকর কবিতাও ভালো লাগে। কবিতা পড়ার জন্য জানা থাকতে হবে ইতিহাস, দর্শন পৌরাণিক গল্প, কাহিনী-চরিত্র। কবিতা নিয়ে পাঠককে রীতিমতো সময় ব্যয় করে, গবেষণা করে মর্ম উদ্ধার করতে হবে।
অনেকে বলে কবিতা নাযিল হবার বিষয়, জোর করে লেখা যায় না। শুধু এই ধারণাটির জন্যই কত উঠতি কবির যে অকাল মৃত্যু হল, তা বলে বুঝানো ভার। নাযিল হবার অপেক্ষায় বসে না থেকে, কাব্য লক্ষ¥ীর প্রতিক্ষায় সময়ক্ষেপন না করে বরং লিখার চেষ্টা করাটাই উত্তম।
কবির লেখা যা তা মার্কা কবিতাকেও অনেক সময় কিছু তেলবাজ সাহিত্য-সমালোচক তোষামোদ করে বেদবাক্যের মত উচ্চতায় নিয়ে যায়। ফলে সাফাই গাওয়া তোষামোদকারীদের পাল্লায় পড়ে কবি বুঝতেই পারেন না কোনটা কবিতা, আর কোনটা অকবিতা। বরং নিজের লেখা অকবিতাটাকেই জোর গলায় কবিতা বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
কবি লেখে, পাঠক বিচারক। শিল্প অনুধাবনের জন্যে অবশ্যই একটা মানসম্মত বোধ প্রয়োজন। এ-যুগের কবি তাঁর সময়টি বুঝবেন এবং পাঠকের অন্তর জয় করবেন --এটাই কাম্য।
ফিরে পাওয়া...
ফিরে পাওয়া
মো. আরিফুল হাসান
রাত তিমির। কুয়াশার চাদর ভেদ করে দুজন মানুষ চলছে। হেমন্তের রাতে তাদের পায়ের নিচের ভেজা পাতাগুলো মচমচ করে ভাংছে না। তবু সামান্যতম শব্দে তারা চমকে চমকে উঠছে।
করিমের বৌকে ভাগায় নিয়ে যাচ্ছে রহিম। রহিম এ বাড়ির কাজের ছেলে। করিম বিয়ে করেছে আজ ছয় বৎসর হলো। কোলে ছেলেপুলে নেই। গেরামের ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে আমেনাকে। কিন্তু কাজ হয়নি। আসলে ওষুধ উল্টো জাগায় পড়েছে। অসুখটা করিমের।
করিম মুন্সি এ গায়ের জমিদার। হ্যা, জমিদারই বলা চলে। তবে ইতর জমিদার। গ্রামের প্রায় অধিকাংশ জমিজিরাত করিমের নিজের নামের। বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের আমলে কী করে যে এত জাগা-সম্পদ তাদের হাতে চলে এসেছে তা কেউ জানে না। তবে বুঝতে শিখে, করিমকে দেখে তারা বুঝতে শিখে কী করে ধন-সম্পদ বাড়াতে হয় এবং রক্ষা করতে হয়। ছাব্বিশ দোন ক্ষেত করিমের। অথচ কোনোদিন দোকানে বসে এক কাপ চা পর্যন্ত খায়নি। ধান পেকে গেলে, যখন কামলারা সবাই দুই হাতে ধান কাটে করিমের ক্ষেতের, তখন করিম পিছা হাতে তাদের পেছনে পেছনে ঝাড় দেয়। মাটিতে লুকিয়ে থাকা পাখিদানাটুকুও করিম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোলে। নিজের শষ্যের একবিন্দু সে ছেড়ে দিতে রাজি নয়।
আশ্বিনের রোদ। আমেনা বধু হয়ে আসলো এ বাড়িতে । ঘোমটা পড়া চামেলি ফুলটা এত বড় বাড়ি দেখে খুশি হয়েছিলো। ভেবেছিলো স্বর্গ হয়তো সয়ং নেমে এসেছে তার কপালে। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই। দু’তিন জন রাখাল। সারাবছর ক্ষেত-খামারি দেখার জন্য জনাতিনেক বছর কামলা। আর সকল কামলার কামলা করিম মুন্সি, সে তো নিজেই একশো।
কিন্তু সুখ স্থায়ী হয়নি আমেনার। বিয়ের বছরই শ্বশুরটা মরলো। সেও এক ভয়ানক পিচাশ ছিলো। একমাত্র ছেলে করিমকে নিতে দেয়নি তাকে ডাক্তারের কাছে। লোকে বলে, বুড়োটা চিকিৎসা না করাতে মারা গেছে। করিমের এসব শুনতে লাগে। সে নিতে চেয়েছিলো, কিন্তু বাপটা গো ধরল কি ধরলো! না, ডাক্তারের কাছে সে কিছুতেই যাবে না। হায়াত না থাকলে মারা যাবে। কিন্তু ওষুধ কিনে অপচয় করার মতো ফালতু লোক সে কিছুতেই নয়। করিমও কি কম কৃপন। বাবা একবার বলাতেই রাজি হয়ে যেতো, কিন্তু আমেনা কি মনে করবে? তবু সে দু’তিন বার সেধেছে, বলেছে, মরার সময়ও কি মানুষের ধনের লোভ যায় না। বৃদ্ধ কষ্টে হেসে বলেছে, না যায় না।
আসলে ধনের লোভ আমেনারও যায় না। তাই তার কষ্টটাও বাড়ে। রাত হলে করিম ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকে পাশ ফিরে। রাতের বেলায় করিমের দেহে জরও আসে প্রতিদিন। আমেনা গা হাত টিপে দেয়। করিম এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। কখনো কখনো বানচিলিকের মতো করিম হয়তো জেগে উঠে। কিন্তু সে ওঠাকে ওঠা বলে না। আকাশের বিদ্যুত চমকেরো স্থায়িত্ব আছে, কিন্তু করিমের নাই।
এভাবে একের পর এক দীর্ঘ দিবস-রাতগুলি পাথর হয়ে গেলে আমেনার মনে বিষ ডুকতে থাকে। বিষের জ্বালায় আমেনা অস্থির হয়। ছোবল মারে কাজের লোক রহিমের উপর। আমেনার বিষ রহিমের সারা দেহে ছড়িয়ে গেলে তারা চুপি চুমি মিল করতে থাকে যোগফলের। একদিন অংক মিলে গেলে তারা পরস্পরের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে নিঃসীম দিগন্তের রাতের অন্ধকারে।
আমেনা হাতটা শক্ত করে ধরে রহিমের। রহিমের পেশিবহুল হাত আমেনার হাতটাকে পেঁচিয়ে ধরে। গ্রামের অন্ধকার ভেদ করে তারা চলছে। রাত বারোটা অবধি তারা হেঁটেছে তিন ঘন্টা, পাড়ি দিয়ে এসেছে তিন ক্রোষ পথ। পথ তবু তাদের ফুরায় না। তাদেরকে যে আরও দূরে যেতে হবে। আরো দূরে, আরো আরো দূরে। অনেক দূরে হারিয়ে যাবে তারা। অনেক দূরে। কোনো এক উপত্যকার তীরে ছোট্ট একটি বাসা বাঁধবে তারা। তাদের কোল জুড়ে খেলা করবে ছোট্ট ফুটফুটে শিশু। সেসব অস্থির ভাবনায় তাদের রাতের পথ তেমন যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় না। তারা পরস্পরের হাত ধরে পরস্পরের হৃদস্পন্দন অনুভব করে পথ এগোয়।
ভোরের আগে আগে তারা ছাব্বিশ মাইল পথ চলে এসেছে। আখাউড়া থেকে ভোরের প্রথম ট্রেনে চেপে বসেছে কুমিল্লা গন্তব্য করে। কুমিল্লা এসে তারা সকালের সোনারোদে একটি বাসাও পেয়ে যায়। নদীর ধারে। পালপাড়া ব্রিজের কাছে ছোট্ট দোচালা টিনের ঘরটি তাদের আশ্রয় হয়ে উঠে। ধর্মমতে বিয়ে তাদের হয়নি। কিন্তু মনের ধর্মই বড় ধর্ম। স্বামী-স্ত্রী সংসার করতে থাকে। রহিম সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাসায় আসে। আমেনাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে কোয়েল পাখির মতো। চুমুতে চুমুতে আমেনার উজ্জ্বল মুখ রাঙা হয়ে উঠে।
আমেনার এ সুখও সয় না। একদিন দুপুরের নজর পড়ে আমেনার উপর বাড়িওয়ালার। তার নজর তীক্ষè। আমেনাকে বিদ্ধ করে যেনো। আমেনা দ্রুত রোদের আঁচলে শাড়ি মেলে দিয়ে দৌঁড়ে ঘরে পালায়। বাড়িওয়ালা মিটিমিটি হাসে। আরেকদিন দুপুরের বেলায় বাড়িওয়ালা এসে আমেনার কাছে জল চায়। বাড়িওয়ালা চেয়েছে, আমেনা না দেয় ক্যামনে। দরজা খুলে পানি দিতে গেলে ইচ্ছে করে আমেনাকে ছুঁয়ে দিয়েছে বাড়িওয়ালা। আমেনা দ্রুত দরজা ভেজিয়ে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে। রহিম বাড়ি আসলে সবকিছু খুলে বলেছে রহিমকে। রহিম আশ্বাস দিয়েছে খুব শীঘ্রই তারা নতুন বাসা দেখে উঠে যাবে। আমেনা যেনো সাবধানে থাকে সে ইঙ্গিতও দিয়েছে তাকে। কিন্তু ইঙ্গিত কাজ হয়নি। সেদিন রাতেই আমেনাকে তুলে নিয়ে যায় বাড়িওয়ালা। হাত-পা বেঁধে, মুখ বেঁধে মারতে মারতে অজ্ঞান করে রহিমকে গাড়ির ডিকিতে তুলে নিয়ে ফেলে দেয় গোমতি নদীর ভাটিতে। তারপর আমেনাকে নিয়ে বিশ্বরোডের এদিকে একটি হোটেলে উঠে বাড়িওয়ালা।
রাতভর অকথ্য বর্বর আনন্দে মেতে থেকে সকালের দিকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় তাকে হোটেলের লোকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। হোটেলে সারাদিন তালাবদ্ধ থাকে আমেনা। কাস্টমার এলে বাহির থেকে দরজা খুলে দিয়ে আবার বাহিরে তালা মেরে দেয়া হয়। হোটেলের চার দেয়ালে আমেনার আকাশ দেখা হয় না। সময়ে সময়ে খাবার দিয়ে চলে যায় একটা মানুষ। তাও দরজার তল দিয়ে। কে যায়, কে দিয়ে গেলো কিছুই দেখার সুযোগ নেই আমেনার। কেবল মুখ বুঁজে সহ্য করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
ভাবে, পুলিশ এসে একদিন উদ্ধার করবে তাকে। কিন্তু পুলিশ আর আসে না। হোটেলের এ অংশটা ব্যাজমেন্টের নিচে। ফলে পুলিশ আসলেও উপর দিয়ে সাজানো গোছানো আবাসিক হোটেল দেখে তারা ফিরে যায়। অথবা পুলিশও জানে ব্যাপারটা। হয়তো এ ব্যবসায় তাদেরও হাত আছে, আছে লাভালাভের হিসাব। তাই নির্বিগ্নে চলতে থাকে নগর সভ্যতা ও পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে নগর কদর্যতা।
করিমের বাপের বংশের আর কেউ নেই। নিজের বংশের কেউ হওয়ার আগেই বৌটা ভেগেছে। করিমের কেমন যেনো উদাসীন উদাসীন লাগে আজকাল। কোনো কিছু ভালো লাগে না। কেমন মনমরা হয়ে থাকে সারাক্ষণ। কাজকর্মে মন নেই। জমির ধান শুকিয়ে তামা হতে থাকে। কামলারা বলে, প্রভু, আবার বিয়া করেন। সব ঠিক হয়া যাইবো। কিন্তু কিছুই ঠিক হয় না। করিমের আর বিয়ে করতেও ইচ্ছে জাগে না। কেমন যেনো বৈরাগ্য ভাব চলে আসে তার ভেতর। কেবল রাত হলে প্রবলভাবে মনে পড়ে আমেনাকে। চোখের তারায় তখন আমেনা ভানুমতি-খেল হয়ে দেখা দেয়। তার রাতের ঘুম চলে যায়। একটা গরম আগুন তখন মেরুদ-ের ভেতর দিয়ে জেগে উঠে। প্রবলভাবে নাড়ায় তাকে। একসময় লাভাবিস্ফোরণ করে ক্লান্ত হয়ে ঢলে পড়ে করিম। আহা, সুখ। এই সুখের জন্যই তো আমেনা আজ ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। আগে এমন সুখের মজা বুঝলে তার হয়তো চামেলি ফুলের মতো বৌটাকে হারাতে হতো না।
ডাক্তারের কাছে যায় করিম। ওষুধ খায় যৌনশক্তি বাড়াতে। তারপর প্রস্টিটিউটের খোঁজে যায় শহরের দিকে। বাড়ি থেকে ছাব্বিশ কিলোমিটারের পথ আখাউরা। সিএনজিতে যেতে বড়জোড় ঘন্টাখানেক লাগে। তারপর ট্রেনে উঠে সোজা কুমিল্লায় গিয়ে নামে। এ হোটেল ও হোটেল করে অনেক মেয়ের সাথে মিলিত হয়েছে সে। কিন্তু সে তৃপ্ত হয়নি। কোথায় যেনো একটা গোপন অতৃপ্তি থেকেই যায় শেষমেষ। যার কাছেই উদগমিত হয়, তার মুখেই সে আমেনার মুখ খোঁজে। কিন্তু আমেনার মতো চামেলিফুলের শোভা কয়জনের আছে। সুখ পায় না করিম। ভ্রমরবিভ্রান্তি নিয়ে এ ফুল থেকে সে ফুলে, ও ফুল থেকে অন্য ফুলে হন্যে হয়ে মরে।
করিমের মা মারা গেছে শৈশবে। লোকে বলে জন্মের তিন দিনের মাথায়ই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে সে। এ নিয়ে অবশ্য অনেক কথা আছে। লোকে বলে, বাঞ্জা বুইড়ার ঘরে সন্তান? অসম্ভব। এই সন্তান কোনো কাজের লোকের টোকের হইব। এই কলঙ্ক ঢাকতেই নবপ্রসূতা বিষপান করে। আজ করিমের মনে মায়ের কথা ভাসছে ভীষণ। কেমন ছিলো তার মা। তার মা কি সত্যিই কারো সাথে শুয়েছিলো? সে কি অন্য কারো সন্তান। হলেই বা হলো কি? তার মাকে মরতে হলো কেনো? ছেলেসহ মাকে বের করে দিতো। বড় হয়ে করিম মায়ের চোখের জল মুছে দিতো গভীর মমতায়।
আজ হোটেলে বড় কোনো খদ্দের এসেছে। সাবসুবা মানুষ। হোটেলের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। করিমকে আজ পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। এ ব্যাপারটি করিমের মনে খুব লাগে। সে জানে, এরকম সাবসুবা সে দুচারটা কিনে ফেলতে পারে। হ্যা, সে হয়তো সাহেবদের মতো কোট টাই পড়ে না। তার হয়তো ফটাস ফটাস ইংরেজি বলার বিদ্যা নেই। কিন্তু তার ধন সম্পদের কমতি তো নেই। সে এগিয়ে যায় মেনেজারের দিকে। মেনেজার তাকে অবজ্ঞাভরে দূরে সরাতে চায়। করিম সরে না। বলে, অই লোক কত দিবো। দশ হাজার। করিম বলে আমি দিমু চল্লিশ হাজার। মেনেজার হেসে বলে, কন কি স্যার? আর দুই গুন বাড়ালে তো আপনাকে সারাজীবনের জন্য দিয়ে দিতে পারি। হ, পছন্দ হইলে সারা জীবনে জন্যই কিন্যা লইয়া যামু।
অন্ধকারে মুখটা ঠাহর হয় না করিমের। এই কি আমেনার মুখ? না, না, এমন হতে পারে না। বিছানার এক কোণে বাঁশি ফুলের মতো লুটিয়ে আছে আমেনা। আমেনাও চিনতে পারে না করিমকে। না না, এ হতে পারে না। যেই লোক ছয় বছরে ছয়বারের মতো জেগে উঠতে পারেনাই সেয় কীভাবে মাইয়া মানুষ খুঁজতে হোটেলে আইসবো? না না, এ হতে পারে না। কিন্তু তারপরেও এ-ই হয়। করিম চিনতে পারে আমেনাকে। আমেনাও চিনতে পারে করিমকে। তারা পরস্পর গলাগলি করে কান্দে। আমেনা পায়ে পড়ে করিমের। আমারে তুমি মাফ কইরা দাও। করিম আমেনাকে টেনে বুকে নেয়। আমিও আর নিষ্পাপী নই। কত রমনীর কাছেই তো গেছি, নিজেরে নষ্ট করছি আমিও! চল, এই বার ঘরে ফিইরা চলো। আমেনা বিস্ময়ের চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে করিমের মুখের দিকে।
মো. আরিফুল হাসান
কুমিল্লা, বাংলাদেশ
পদাবলি ০১
নতুন ভোরের অপেক্ষায়
শাহ জালাল শামীম
পরিচিত মুখগুলোর অনেকে হারিয়ে গেছে
পেটের তাগিদে ছিটকে গেছে অনেক মেধাবী মুখ।
স্বামীর অত্যাচার মেনে নিয়ে গুমরে পড়ে থাকা মেয়েটির চোখ জ্বলছে।
সবাই ভাতের হোটেলে কাজ নিতে চায় কেন!
অনেকে ফিরতে পারে না
ইচ্ছে হলেই ফেরা যায় না।
বলা যায় না ভালো আছি
বলা যায় না ভালোবাসি!
তবুও চাই, নতুন ভোর আসুক।
বুকের বাঁ পাঁজর ভেঙে যায়
রুদ্র সাহাদাৎ
বুকের বাঁ পাঁজর ভেঙে যায় অজানা শঙ্কায়
পাখিদের গান শুনি না কোনোখানে
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনি নৈঃশব্দ্যে অন্ধকার পথে
জোনাকিপোকাও অভিযোগে অভিমান করে আছে।
আলীশান রোড়ের মোড়ে বসে থাকি
হারিয়ে ফেলেছি সব স্মৃতি চিহ্ন।
মানুষ জন্মসূত্রে নিজে নিজেই একা
স্বার্থে অভিনয় মানুষে মানুষে দেখা।
দম ফুরালে সবই শেষ
সাড়ে তিন হাত মাটিতে নিঃশেষ
বুকের বাঁ পাঁজর ভেঙে যায় অজানা শঙ্কায়
কখন কে আসে কখন কে যায়
হিসেব নেই জীবনপাঠে...
আফসার স্যার
মিসির হাছনাইন
চোখ ভিজে গেছে নীরব দাঁড়িয়ে থাকা গাছদেরও কি এক গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছেন স্যার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে.. এতো এতো করে যে ডাকলাম মনে হল, এখনই চোখ খুলে তাকাবেন, সাদা কাপড়ের যে ফুল ঝরে পড়ে আছে ঠান্ডা হিম ঘরেথ কতটা প্রিয় সে চেনা হাসিমুখ দোল খায় হৃদয়ে হৃদয়ে দূর আকাশের নক্ষত্রথ জীবন জানে কিনা জানি না! যে সান্নিধ্য কখনও মনে হবে না ফুরিয়ে গেছে আপনাকে হারিয়ে এই শরৎ ভাঙা সময়ে চলে যাবে দিন যদি কখনও নক্ষত্র জীবনের মানে বুঝতে পারি, দেখা হবে নক্ষত্র জীবনে।