ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৩০

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৩০
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। ধানশালিক ।। সংখ্যা ১৩০
বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯























তারুণ্যের কবিতায় সময়ের সাহসী উচ্চারণ

 তারুণ্যের কবিতায় সময়ের সাহসী উচ্চারণ



তারুণ্যের কবিতায় সময়ের সাহসী উচ্চারণ
আনোয়ার কামাল

শব্দের সাধারণ অর্থ ও কাব্যার্থ পৃথক বস্তু। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দার্থের ক্ষেত্রে থাকে একটির পরিবর্তে দ্বিতীয় বা সহ-অর্থÑ এটাই নন্দন-পরিভাষায় ব্যঞ্জনা নামে অভিহিত। বাক্যাংশ বা যে-কোনো শব্দ উক্ত ব্যঞ্জনা দ্যোতিত করে বলেই বাক্য শব্দ কবিতাগত হয়। এই ব্যঞ্জনাশক্তির গুণেই সৃষ্ট হয় প্রতীক-উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের অন্তহীন জগৎ। [কবিতার নান্দনিকতা প্রাচীন ও মধ্যযুগ, বেগম আকতার কামাল]
‘কবিতাকে সাধারণত দুটি দিক থেকে দেখা হয়ে থাকে। তার ভাষা ও তার ভাবনা। কিন্তু ভাষা যেমন ভাবনাকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে, তেমনি ভাবনারও একটা অবলম্বন চাই। বিষয়বস্তু সেই অবলম্বন। ফলত, আমরা যখন কাব্যবিচার করতে বসি, তখন ভাষা ও ভাবনার মতো, বিষয়বস্তুও আমাদের বিচার্য বৃত্তের মধ্যে এসে যায়।’ বলেছেন কবিতার শিক্ষক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘কবিতা কোথায়’ প্রবন্ধে।
সেই কবিতার নান্দনিকতা নিয়ে, তার ভাষা ও ভাবনার কথা নিয়ে আজকের তরুণ কবিদের কাছে আমাদের অঢেল প্রত্যাশা রয়েছে। তরুণ কবিরা তাদের মননশীল কবিতার জমিনে কালোক্রমে যে বীজ রোপন  করে চলেছেন তারই পরিক্রমায় আজও তারুণ্যের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেকাংশে বেড়েছে। আমরা এখনো তারুণ্যের দিকে চেয়ে থাকি, অসীম সাহসে জয়গান গাইবার জন্য।
যদি তুমি ভয় পাও
তবে তুমি শেষ
যদি তুমি রুখে দাঁড়াও
তবে তুমিই বাংলাদেশ।
[তুমিই বাংলাদেশ, রকিব লিখন]
বাংলাদেশের আজকের তরুণ কবিদের কবিতায় এই সুর অনুরণিত হতে দেখা যায়। কেননা কবিতার ক্যানভাসে সেই কবে থেকেই তরুণ-যুবকদের দ্রোহের পঙ্ক্তিমালার ধ্বনিময়তা সাধারণ পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। মানুষকে প্রতিবাদে সামিল হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। মানুষের অবচেতন মনের কোণে গুনগুন করে তারই উচ্চারণ যেন বেরিয়ে আসে। আমরা আমাদের অগ্রজ কবিদের ভেতরও তার তরুণ-যুবক বয়সের তারুণ্যখচিত পঙ্ক্তিমালা বাঙ্ময় হয়ে প্রস্ফুটিত হতে দেখেছি। ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ হেলাল হাফিজের কালজয়ী এ কবিতায় যদি আমরা ফিরে দেখি তবে দেখা যাবে কবিতাটি কত সহস্রবার ঠোঁটের ডগায় উচ্চারিত হয়ে যুবকদের প্রাণিত করেছে, সাহসী করে তুলেছে। কত দেয়ালের বুকে জ্বল জ্বল করে দেদিপ্যমান হয়ে জেগে থেকেছে, যা থেকে সময়ের সাহসী সন্তনেরা আরো সাহসী হয়ে উঠেছে। জ্বলে উঠেছে স্বাধীন চেতনায় ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে।
আবার যখন দেশময় অরাজকতার এক ভয়াল গ্রাসে নিমজ্জিম ঠিক তখনই আমাদের রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে একটি পঙ্ক্তি ছড়িয়ে দিলেনÑ‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই/ আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখি।’ আহা! সেই লাশের পুতিময় গন্ধ থেকে কী আমরা আজো মুক্ত হতে পেরেছি? মাটিতে এখনো মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য আমাদের ঘিরে রেখেছে। এ কবিতাটিও কত সহস্রবার অবলীলায় উচ্চারিত হয়েছে, কবিতাকর্মী থেকে শুরু করে সাংস্কৃতির পরিম-লের আবেগঘন পরিবেশে। দেয়ালের গায়ে কালো হরফে লেখা হয়েছে...। আমরা এমনি কিছু কালজয়ী কবিতার চরণ যুগ যুগ ধরে ধারণ করে চলেছি। আমাদের বোধের ভোতা নিউরণে টোকা দিয়ে উসকে দেওয়া এসব পঙ্ক্তিমালা ভুলে যেতে পারি না। আরো একটু পিছন ফিরে দেখলে দেখতে পাইÑ ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো’। আহা! কি জ্বালাময় কবিতার পঙ্ক্তিমালা। কতখানি ক্ষুধার্ত হলে, কতটুকু বেদনায় কুঁকড়ে গেলে একজন কবি মানচিত্র খেতে চান। কবির দ্রোহের বান ভেঙে জোয়ারে প্লাবিত হয় অন্যায়ের বাঁধ। বালির বাঁধের মতো অন্যায়ের বেড়াগুলো ধ্বসে যায় অবলীলায়। আমরা কি তার এ বয়ানের গভীরে লুক্কায়িত বেদনার ভাবনাকে ব্যবচ্ছেদ করতে পেরেছি? আমরা কী তার যাতনার অংশীদার হতে পেরেছি?
রকিব লিখনের ‘তুমিই বাংলাদেশ’ কবিতাটি সাহসী কিশোর আর প্রতিবাদী যুবকদের ঠোঁটের ডগায় উচ্চারিত হয়েছে প্রতিক্ষণে। অতি সাম্প্রতিককালে স্কুলের ছাত্ররা তাদের সহপাঠির বাসচাপায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে কিশোর ছাত্রদের বিদ্রোহী আবেগকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে য়ায়। সে সময় নানা রকমের ষড়যন্ত্র ও ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে তরুণ-কিশোররা এই শ্লোগানে উজ্জীবিত হয়েছে, তারা হেরে যেতে না মানা বাঁধ ভেঙেছে। পরিশেষে এইসব ক্ষুদে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা বিজয়ের জয়মালা গলায় পরে রাজপথ ছেড়েছেন। যা বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে এই মাইলফলক হয়ে রয়ে গেছে।
অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনে ‘তুমিই বাংলাদেশ’ কবিতার পঙ্ক্তি দারুণভাবে ছাত্ররা লুফে নিয়েছে।
যদি তুমি ভয় পাও
তবে তুমি শেষ
যদি তুমি রুখে দাঁড়াও
তবে তুমিই বাংলাদেশ।
আসলেই যুবকরা সেদিন ভয় পায়নি। তারা ঘরে ফিরে যায়নি। নানান ভয়ভীতি উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন তারা আন্দোলনে নিজেদের জিইয়ে রেখেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছে। ফলত, পরিশেষে তাদেরই বিজয় হয়েছে। আসলে যেকোন আন্দোলন যদি নিয়মতান্ত্রিক ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তার সাফল্য পরিসমাপ্তিতে আসবেই আসবে।
যুগের পর যুগ কালোক্রমে কবিতায় বিভিন্ন ক্রান্তিকালে সময়ের সাহসী উচ্চারণে কবিতাকর্মীরা পিছপা হননি। তরুণ কবি জয়নাল আবেদীন শিবু তার ছুরি নামক কবিতায় শান দিয়েছেন। ছুরি দিয়ে আমরা কলিজা ফালি ফালি করি, মাথার শিরা, উপশিরা কেটে ফেলি কিন্তু এতো ধারালো ছুরি তা দিয়ে আপেল-কলা বা সবজি কাটে না। কবি যুগলঠোঁটের ডগায় সেই ছুরির সুতোয় শক্ত বাঁধনে আটকে ধরার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কবিতায় মজে যাওয়া তরুণ এ কবির কবিতায় আমরা প্রেমময় এক ভিন্ন ধরনের সুর ধ্বনির মূর্ছনায় উদ্ভাসিত হতে দেখি। কবি যুগ যন্ত্রণায় জর্জরিত প্রেমের বাঁকা আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে এমন তরো পঙ্ক্তি আওড়ে দিতে পেরেছেন। আমরা তার কবিতায় তারুণ্যনির্ভর এক প্রেমময় সিম্ফনি বুদবুদ হতে দেখি ‘ছুরি’ নামক কবিতায়।
একটা ছুরি
খুব ধারালো
গতি ক্ষিপ্র

কেটে যায় কলিজা
ফালি ফালি
মাথার শিরা, উপশিরা
কাটে না আপেল, কলা কিংবা সবজি

যুগলঠোঁটে জিয়েরাখা ছুরির
সুতোর বাঁধন শক্ত করো
শক্ত করো।
[ছুরি, জয়নাল আবেদীন শিবু]
বর্তমান সময়ে আমরা ভার্চুয়াল জগতের গভীর অরণ্যে ঢুকে পড়েছি। আমাদের যাপিত জীবনের নানান বোধের ভেতর ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ঢুকে পড়ে জীবনের অনেক দিকের বাঁক বদলে দিয়েছে। আমরা এখন আর নিজের মতো করে বোধ হয় চলতে পারি না। আমাদের যন্ত্রতাড়িত করছে ‘সাইবার এজ’। তাই কবি কাজী শোয়েব শাবাব তার কবিতায় মানুষ যে এখন আর মানুষ নেই পুরোমাত্রায় যান্ত্রিক মেশিনে পরিণত হয়েছে তারই সুনিপুণ চিত্রকল্প এঁকেছেন।

মানুষ নয়, মেশিন।
দৃশ্য নয়, স্ক্রিন।
ডিভাইস শাসিত মস্তিষ্ক
দেখা আর না দেখা টোটালি প্রোগ্রামড।
ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ভালো লাগে,
বস্তুকাম উপভোগ্য।

বায়োনিক হাত।
যান্ত্রিক শীৎকার
হ্যাঙ্গারে ঝুলন্ত মানুষের আইডি।
পৈতৃক সূত্রে পেয়ে যাবো বিছানায়
পিতার রেখে যাওয়া রোবট স্ত্রী।
[সাইবার এজ, কাজী শোয়েব শাবাব]
তরুণ কবি রাহাত রাব্বানীর কবিতার ছন্দময়তায় তারুণ্যের প্রতিভাস দেখতে পাওয়া যায়। এসময়ের তরুণ কবিদের ভেতর থেকে তার কবিতার সুর নানান বোধের মিশ্রণে আমাদের উদ্বেলিত করে। তার কবিতায় প্রেমের আখ্যান ভিন্নমাত্রিকতায় ধরা দেয়। কবিতা তো এমনই কেউ চলে গেলে তাকে তো আর থামিয়ে রাখা যায় না। হয়তো সে আকাশের পাশে কোনো এক তারা হয়ে জ্বল জ্বল করছে। কেউ কাউকে সুখের স্পর্শকাতরতায় আকড়ে ধরছে না। হ্যাঁ, রাব্বানী প্রশ্ন রেখেছেন, যদি একফালি মেঘ এসে তাকে আড়াল করলে অথবা ভোরের সূর্য তার চিহ্ন মুছে দিলে তখন তার প্রেয়সী কী করবে? এ যুগ জিজ্ঞাসার কোনো প্রতিউত্তর কি রাব্বানী পেয়েছে? কবি প্রকৃতির কাছে তার যুগ যন্ত্রণার সকল জিজ্ঞাসা জানতে চায়। কেউ পায়, কেউ পায় না। তবুও এ পথচলা, তবুও এ কবিতাময় যাপিত জীবন বহমান। কবিতার লিরিকে অনাদিকাল পথ পরিক্রমা।
এই ধরো, আজ আমি চলে গেলাম
আমাকে থামিয়ে রাখতে পারলে না আর

আকাশের এক পাশে একটা তারা হয়ে
তোমাকে দেখেছি, ধরো। অথচ,
কেউ কাউকে স্পর্শসুখে ভাসাচ্ছি না।

আবার ধরো,
হঠাৎ একফালি মেঘ এসে আমাকে আড়াল করে দিলো
নয়তো,
ভোরের সূর্য মুছে দিলো আমার চিহ্ন
তখন তুমি কী করবে? বলো?
[প্রশ্ন, রাহাত রাব্বানী]
কবি পথের দিশা নিয়ে ভাবেন না। কবিকে পথপরিক্রমায় ক্লান্তিতে ধরে না। কবি স্বপ্নদ্রষ্টা, কবিকে ভাবতে হয়। কবি দেশ, জাতি সমাজ নিয়ে ভাবেন, কবিতায় রঙিন তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে মূর্ত করে তোলেন একের পর এক রূপক, উপমা, চিত্রকল্প। কিন্তু কবি যখন তার চারপাশের অশুভ রাজনৈতিক আস্ফালন, বুর্জুয়া রাজনীতিকের পুজিবাদী অট্টহাসি, তখন কবি অনুভব করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে স্বপ্নের বীজবপনের আবেদন তার কাছে ফিকে হয়ে যায়, নিষ্ফল হয়ে যায়। তরুণ কবি সুব্রত আপনের কবিতায় আমরা তারই সুররিয়ালিজম দেখতে পাই তার ‘রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার’ কবিতায়। তার পরেও বলবো কবিরা সবসময় আশাবাদী। কবিকে নিরাশ হলে চলে না। সমুখ পানে তাকে আশার মশাল জ্বালিয়ে পথ ভোলা পথিককে পথের দিশা করে দিতে হয়।
রাস্তা ভেবে ক্লান্ত হওয়ার মানুষ আমি নই, কিন্তু মহাকালের ঘূর্ণিপাকে
যখন শুনি বুর্জুয়ার রাজনৈতিকের পুজিবাদী অট্টহাসি,
তখন বুঝতে পারি ধ্বংসের ধারপ্রান্তে এসে স্বপ্নের বীজবপন নিষ্ফল।
[সুব্রত আপন, রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার]
‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবিÑকেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকিরণ তাদের সাহায্য করেছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়। [কবিতার কথা, জীবনানন্দ দাশ]
পরিশেষে এ কথাটি একারণেই বলবার আকাক্সক্ষা জাগলো যে, যাদের হৃদয়ে কল্পনা এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞাতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে তারাই কবিতায় সময়ের সাহসী উচ্চারণ তুলে ধরতে পেরেছে। কবিতা তো হাজারো রকমের লেখা হচ্ছে। কটি কবিতা কালোতীর্ণ হতে পেরেছে।
আজকাল তরুণদের লেখায় এলোমেলো ভাবনার পঙ্ক্তিমালাই বেশি দেখা যায়। এর ভেতরেও যে নান্দনিক শৈলীর আবহে কবিতা রচিত হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। তবে কবিতা তৈরির যে উপাদান, রসদ, কাঁচামাল-মসল্লারও যে প্রয়োজন হয়, তা কিন্তু এখন অনেক কম। আবার যা পাওয়া যাচ্ছে, তরুণ কবিরা সেদিকে পা বাড়াচ্ছে না, প্রতিকূল বৈরি পরিবেশের কারণে। সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যে স্পিরিট নিয়ে কবিতা রাজপথ উপ্তত্ত করেছে, তার ইমেজ তো এখন আর নেই। তা ফিকে হয়ে গেছে। আবার বর্তমানে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে, তাদের নিজেদের রাজনৈতিক স্থিরতাই নেই। কবিতা কিন্তু রাজনৈতিক আবহের ডামাডোলে নিজেকে শাণিত করে তুলে ধরে।
তবে সুখের কথা হচ্ছে, বর্তমানে দেশে যে নারী-শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কবিরা কিছুটা হলেও সোচ্চার হয়ে উঠেছেন, এটাই আশার দিক হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। কারণ তারুণ্যের কাছে দেশ-জাতি অনেক কিছুই আশা করে। তরুণ-যুবকরা যা করতে পারে, তা অন্যরা পারে না। এই পারা না পারার দিকেই তো আমরা চেয়ে থাকি; আশার দিশারী হিসেবে কেউ আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাক পাল তোলা নৌকার আলোকবর্তিকা হয়ে।

৪৮, মতিঝিল, ঢাকা ।

সে ডাকে ইশারায়...

সে ডাকে ইশারায়...




সে ডাকে ইশারায়...
আহাদ আদনান

আবু মিয়ার একটাই ভালো পাঞ্জাবি। ভালো মানে, কোন ছিদ্র নেই, পড়লে এখনও ভদ্রস্থ মনে হয়। চাঁদ ওঠার সাথে সাথে পাঞ্জাবিটা বের করে  অ্যালুমিনিয়ামের বাসনে জ¦লন্ত কয়লা নিয়ে একটু ডলে নিয়েছে। গরিবের ইস্ত্রি। নাকের সামনে পাঞ্জাবিটা ধরতেই একটা কুসুম উষ্ণ ন্যাফথলিন মাখানো গন্ধ ভেসে আসে। মনের অজান্তেই সে বলে, ‘এইটা গায়ে দিয়া কাল নামাজে যামু’। যদিও সকালে ঈদগাহের সামনে তাকে দেখেই শুক্কুর বলে, ‘আবু ভাই, এই ভালা পাঞ্জাবি পইরা বইলে তো কেও তোমারে ভিক্ষা দিবনা’।

গ্রামের ঈদগাহ। তবে সেই গ্রাম কি আর আছে? ঈদগাহের সামনে কিছু ছোকরা ছেলে, থুঁতনির নিচে একটু একটু লোম গজিয়েছে অবস্থা, মুখ বাঁকা করে ছবি তুলছে। আবু মিয়া এতদিনে জেনে গেছে, এটাকে সেলফি বলে। সে আরও জানে, এই ছোকরাদের ফোনগুলোর দাম কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা। তার মোটামুটি এক বছরের ভিক্ষার উপার্জনের সমান।

সব মিলিয়ে পনেরো জন বসে আছে ঈদগাহের তোরণের সামনে। পাঁচজন পুরুষ, দশজন মহিলা। দুইজন বৃদ্ধা বাদে বাকি মহিলাগুলোর কোলে একটা করে শিশু, বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন আহারের। কারও আহার বুকের দুধ, কারও বৃদ্ধাঙ্গুল, কারও সস্তা ললিপপ, আর একটু বড়গুলোর জন্য চড়-থাপ্পর। আবু মিয়া গণনার সময় এদের বাদ দিয়েছে অবশ্য।

খুব সম্ভবত ‘ভালো’ পাঞ্জাবিটার জন্যই আবু মিয়া তেমন ভিক্ষা পাচ্ছে না। যে মহিলাগুলো স্তনে বাচ্চা লাগিয়ে রেখেছে, যে লোকটার পিঠে বড় একটা টিউমার, এমনকি যে শুক্কুর বাসের ধাক্কায় দুইটা পা হারিয়েছিল, খুব ভিক্ষা পাচ্ছে। পরম বাধ্য কুকুরের মত নিরীহ মুখ করে আবু তাকায় আগত মুসল্লিদের দিকে। খুব মিহি করে আবেদন জানায়, ‘এই গরীবরে দুইটা টাকা দেন বাবা’। কিন্তু সে এখনও খুব ‘আবেদনময়’ হয়ে উঠতে পারছে না।

আবু মিয়াকে দেখেই নাসির একটা বিরক্তিমাখা দৃষ্টি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আবু মিয়ার দ্বিতীয় ছেলে এই নাসির। ওর জন্মের পর দুইটা ছাগল দিয়ে আকিকা দিয়েছিল সে। পাটমিলের তখন রমরমা অবস্থা। এরপরই মিলটা বন্ধ হয় আর খারাপ সময়ের শুরু। নাসির এখন গার্মেন্টসের ঝুটের ব্যাবসা করে খুব কামাচ্ছে। বাবার কোন খোঁজও নেয়না তাই।

একটু পরেই ঈদগাহে আসে জব্বর, তৃতীয় ছেলে। সে ফোনে কথা বলতে বলতে আসছিল। বাবা দেখলেও ছেলে দেখেনি তাই। রিকশাওয়ালাদের ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জব্বর প্রায়ই বাবাকে দেখে হাটে ভিক্ষা করতে। কিন্তু কথা বলার সময় কোথায় তার?

দূর থেকে নেয়ামতকে দেখতেই আবু মিয়া মুখ কোথায় লুকাবে ভেবে পায়না। হাজার হোক, বড় মেয়ের জামাই। দুবাই থেকে কবে আসল লোকটা? মেয়েকে সে দেখেনি তিনবছর। আর ছোট মেয়েতো প্রেম করে অন্য জেলায় বিয়ে করে পালিয়েছে আরও বেশিদিন হয়ে গেল। বউটাও সেই মাসেই মারা গিয়েছিল তার। আল্লাহ সহায়, নেয়ামত চিনতে পারেনি আবু মিয়াকে।

ছোটছেলে মকবুল নামাজ পড়তে আসবে না এটা জানে আবু মিয়া। সারাদিন গাঁজা, মাঝে মাঝে ইয়াবা খেয়ে পড়ে থাকে এই ‘হারামজাদা’। গতমাসে ভিক্ষুক বাবার ঝোলা থেকে টাকা কেড়ে নিতেও বাঁধেনি তার।

আবু মিয়া হয়ত এখনও অপেক্ষা করছে কারও জন্য। বাংলা খুৎবা শেষ হয় হয় এমন সময় আসে আনু, বড় ছেলে। সাথে তার ছোট ছেলে, আট-নয় বছর হবে হয়ত। আবুকে দেখে সে ডাক দিয়ে বসে, ‘দাদাজান, বাজান ওই যে দাদাজান’। ‘চুপ, নামাজ খাড়ায়া যাইব। পা চালা’ বলে আনু মিয়া টেনে নিয়ে যায় ছেলেকে।

আবু মিয়ার চোখ ভিজে আসে। সে তাকিয়ে থাকে নাতির দিকে। নাতি তার দিকে আকুল তাকিয়ে আছে। বাবার মুঠিতে আটকানো হাতটা ছাড়িয়ে নিতে তার প্রচন্ড যুদ্ধ। একসময় সে যুদ্ধে জিতেও যায়। আনু মিয়া নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে। আর তখনই নাতি তার দাদার দিকে দুই হাতের ইশারায় ডাকতে থাকে।

আবু মিয়া ভিক্ষার থালা ফেলে রেখে দাঁড়িয়ে যায়। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে তার। শুক্কুর একবার তাড়া দেয়, ‘পাগল হইছ নাকি! একবার উঠলে আর বইতে পারবা না। ভিক্ষা পাইবা না। বইসা পড় তাড়াতাড়ি’।

‘তুই দ্যাখস নাই, শুক্কুর? আমার নাতি আমার জন্য দাঁড়াইয়া আছে। আমি যামু ওই কাতারে। সে আমারে ডাকে। ইশারায় ডাকে আমারে সে’।

পদাবলি

পদাবলি



অঘ্রানে
তমসুর হোসেন

অঘ্রানের রাতে টুপটাপ ঝরে ছন্দময় শিশিরের হিম
বাদুড়েরা দল বেঁধে নিমফল খেয়ে হল্লা করে সারারাত
সকালে বনের গভীরে শুকনো পাতার বুকে শেষকৃত্যের
করুণ কান্না, রোদের সাথে ঝরে গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের পালক।

রোদের গন্ধে সটিফুলের অরণ্যে গোপন নেমে আসে
নির্বিষ সাপ বেনে বউয়ের কণ্ঠে গজমতি হার হয়ে দুলতে
মিষ্টি আলুর খেতে দোল খায় লজ্জারাঙা বেগুনি কুসুম
কালজিরা তিসি ধনেফুলে চকমকি পাথর জ¦লে দিনমান।

চাঁদের শরীর ছুঁয়ে উড়ে যায় দূরগামী সারিবদ্ধ মেঘ
বিলের পানিতে প্রবল ঠান্ডায় কাঁপে মিয়মান আকাশের ছায়া
শিশিরের স্বচ্ছ নেকাব পড়ে ধীরপদে হেঁটে যায়
নদীর পাড় ধরে বালুচরে বাতাসের ঢেউয়ে ধবল রঙের রাত।

ফুরফুরে হাওয়ার টানে শিমুল তুলোর মত রোদেলা দিনেরা
উড়ে যায় তেপান্তরের শূন্যতায় অজানা দানবের দেশে
প্রকৃতির সবখানে মউ মউ গন্ধের মাতাল কিশোরী সুবাস
উল্লাসে দুলে ওঠে খেতভরা সোঁদাগন্ধা কাঁচাপাকা মায়াবী ফসল।


রঞ্জু, একটা হাতিয়ার...
আকিব শিকদার

মিছিলটা হয়েছিলো প্রায় তিনশো গজ লম্বা। টানা পাচ দিন খেটেখোটে
লোক জড় করেছিলে। বিপক্ষ দলের সামনে ইজ্জত রাখা চাই।
গলিটা দখলে নিয়ে সাজালে প্যান্ডেল। ঝাঝালো ভাষণে
জনপদ কাপিয়ে স্বার্থক জনসভা।
নেতা তোমাকে কাছে ডেকে পরিপাটি চুলগুলো
আঙুলে উলোঝুলো করে দিয়ে বললো- “বেটা বাঘের বাচ্চা, তোর মতো
কেজো ছেলে আগে দেখিনি, একেবারে বিপ্লবী চে গুয়েভারা”।
তুমি বাহবা পেয়ে গলে গেলে রঞ্জু। বুঝলে না, ছোটদের বগলবন্দি রাখতে
বড়রা এমন প্রশংসার ফাঁদ প্রায়ই পাতেন।

পার্টি অফিসে প্রতিদিন কতো কাজ, কতো পরিকল্পনা। নেতারা তোমায়
পিতার মতোই ¯েœহ করে। গোলটেবিল বৈঠকে
জ্বালাময়ী আলোচনায় রক্ত গরম।
বাঁধা এলে অস্ত্র নেবে, প্রয়োজনে প্রাণ দেবে। অফিসের গোপন ঘরে
নেতারা গলা ভেজাতে ভেজাতে তোমাদের হাতে বুতল দিয়ে বলে-
“নে বাবারা, খা... শুধু খেয়াল রাখবি যেন হুষ ঠিক থাকে”।
ভেবে দেখেছোকি রঞ্জু, তাদের ছেলেরা এসব নোংরা জল
ছোবার কথা কল্পনাও করতে পাড়ে না। মায়েরা পড়ার টেবিলে
গরম দুধে গ্লাস ভরে রাখে।

কালো কাচ আটা পাজারু গাড়ি থামলো রাস্তাতে। জানালার কাচ খুলে
নেতা হাত বাড়িয়ে দিলেন হাজার টাকার দুটো নোট। বললেন-
“রঞ্জু... ঝাপিয়ে পর বাবা, মান সম্মানের বেপার”।
তুমি ঝাপিয়ে পরলে পেট্রোল-বোমা আর ককটেল হাতে। দুদিন পর
তোমার ঠিকানা হলো সরকারি হাসপাতালের নোংড়া বিছানা। হাত দুটু
উড়ে গেছে, দু’পায়ের হাটুঅব্দি ব্যান্ডেজ।

একবারও ভাবলে না, তিনি তোমার কেমন বাবা!
তার সম্পত্তির ভাগ পাবে? তার কালো কাচের পাজারুটা
তোমাকে দেবে? দেবে মখমল বিছানো বেডরোমে ঘুমানোর অনুমতি?
তার সম্মান রাখবে তুমি! তার ছেলে বিদেশে পড়ে,
নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে; সে তো ঝাপিয়ে পড়ে না!

তোমার হোষ কবে হবে রঞ্জু! তুমি ছিলে তাদের
স্বার্থের হাতিয়ার, কাটা তোলার কাটা।
তোমার মা হাসপাতালে গরাগরি দিয়ে কাদে, বাপ কাদে বাড়ান্দায়।
সেই নেতারা, তোমার পাতানো বাবারা, একবারও তো
দেখতে এলো না! বলি রঞ্জু, তোমাদের হুশ কবে হবে!



বাংলাদেশের সকাল
সাহিদা সাম্য লীনা

হলুদ রং এ ছেয়েছে মাঠ মাঠে আবার
নতুন ধানে কৃষক মনে খুশীর জোয়ার।
হেমন্তের সন্ধ্যায় জমে পিঠা পুলির ঘ্রাণ
শাড়ি চুড়ি পেয়ে গায় কৃষাণি গান।
হিমেল হাওয়ায় শিশির জমে গাছে,
দস্যি ছেলে মাতে খেজুরের রসের পিছে।
কুয়াশার ভোরে ওঠে  বাংলাদেশের সকাল
ধানের মাড়াই চলে সকাল আর বিকাল।


প্রিয় বিদ্যাপিঠ
নূর নাহার নিপা

নদীর মতো শীতল পাঠশালা ছিল আমাদের,
আমরাও ছিলাম কলকলে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলির বোন।
আমাদের ছিল হাসির ঝর্ণা, রোদ চিক চিক জল।

প্রিয় বিদ্যাপিঠ,
আজ মনে পড়ে খুব, তোমাকে
মনে পড়ে দূরন্ত কিশোরী বেলা
মনে পড়ে প্রিয় স্যারদের আদর-শাসনে মাখা সেইসব মিঠাবুলি
তাঁরাও ছিলেন তোমারই মতো
দিলখোলা-কর্ণফুলি!

প্রিয় বিদ্যাপিঠ,
তুমি ভালো থেকো
তোমার সহজাত চঞ্চলতায়,
আজ কেন যেন খুব করে
তোমার কথা মনে পড়ে যায়।

অদৃশ্য বার্তা
হাসান মাসুদ

যখন তোমার গুলিবিদ্ধ ঠোঁটে
রক্তের প্রবাহ বিছিয়ে দেয়
সবুজ রঙের গালিচা,
তখন তোমার সেই দেবীত্বটুকু
পাঠিয়ে দিও - উৎসুক কামনায়।

যখন তোমার মনের ভিতর
বেদনার ভায়োলেটে আড়ষ্ট সুর
বাজায় উচ্ছ্বল কাকাতুয়া,
তখন টেলিফোন বার্তায় পাঠিয়ে
দিও - দৃঢ় কামার্ত কন্ঠস্বর।

যখন প্রতিনিয়ত একটা অদৃশ্য
ছায়া তোমাকে আবিষ্ট করে রাখে
হলুদ রঙের বসন্তের মতো,
তখন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস পাঠিয়ে
দিও - বাতাসের ব্যাঞ্জনায়।



তোমার চোখে ভাগ্য নির্ধারণ
আহমাদ সোলায়মান

অনুভব করি বিদায় সাজের অশ্লীল চিৎকার
স্বার্থের মত ভয়ানক ব্যাধি ছিলনা আমার
চাঁদের প্রতি হিংসা তাই আকাশ দেখিনি কখনো
বলা হয়নি, অবকাশের জমানো কথা।

মধ্যরাত পান করে যার মিলে এক গ্লাস সুপ্তি
তাকে তুমি কা-পুরুষ বলতে পারো না
স্বপ্ন তোমার, এ দাবি করতেই পারো
অন্ধকার আমার বলে আজ আমি নিশ্চুপ।

একবার যদি তোমার চোখে তাকাতে পারতাম
তাহলেই হয়ে যেত আমার ভাগ্য নির্ধারণ
দেখতে পেতাম তোমার হৃদয়ের ছবি
হৃদয়ে থাকা মুখের ছবি।

ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার : আবুল কালাম আজাদ : পর্ব : ০১

ধারাবাহিক উপন্যাস : অনিঃশেষ অন্ধকার  : আবুল কালাম আজাদ : পর্ব : ০১



অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ



এক.
সে বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান।
বাবা উকিল। উকিল হিসাবে মোটামুটি নাম কামিয়েছেন। উকিলদের ব্যস্ত জীবনের কথা সবারই জানা। আর এই উকিলের ব্যস্ততা যেন আরও একটু বেশি। তার মূল ঠিকানা কোর্ট আর চেম্বার। বাসায় যান শুধু ঘুমাতে। কোর্ট বা চেম্বারে যদি ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে তার বাসায় যাবার কোনো দরকারই হতো না।
মা সরকারি চাকুরে। নয়টা-পাঁচটা অফিস। অফিস থেকে ফিরে অনেকটা সময় তিনি ক্লান্ত।
তবে একমাত্র মেয়ের প্রতি তাদের যথেষ্ট কেয়ার আছে। সাজানো-গোছানো একটা রুম দিয়েছেন মেয়েকে। ভালো পোশাক-আশাক, ভালো খাবার-দাবার। শিক্ষা সামগ্রী না চাইতেই হাজির। কোচিং বা শিক্ষকের বাসায় ঘুরে পড়তে গেলে সময় নষ্ট হবে, তাই অধিক টাকায় একাধিক গৃহ শিক্ষক রেখেছেন। বাসার কুটোটাও তাকে নাড়তে হয় না। বলা যায়, কাজের মেয়েটা সব সময় তার সেবায়ই নিয়োজিত।
একটা জিনিস দেয়া বাকি ছিল মেয়েকে। সেটা হলো সেলফোন। মেয়েও এ ব্যাপারে কিছু বলেনি কখনো। একটা ঘটনার পর বাবা-মা বুঝতে পারেন, একটা সেলফোন ছাড়া এই আধুনিক যুগে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে চলা নিরাপদ নয়। বিশেষ করে বাবা-মা যখন কর্মজীবী।
তখন সে ক্লাশ নাইন-এ। স্কুল ছুটি হয়েছে। সে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে কাজের মেয়েটার জন্য। কাজের মেয়ে কুলসুম বয়সে তার চেয়ে তিন/চার বছরের বড় হবে। সে সকালে তাকে স্কুলে রেখে বাসায় ফিরে যায়। বাসার কাজ-কর্ম সেরে আবার তাকে নিতে আসে।
আমাদের রাজনৈতিক আপদ সেদিন গিয়ে উঠে তাদের স্কুলের সামনে। সেদিন স্কুল গেটের অদূরে রাস্তায় পর পর দুইটা ককটেল ব্লাস্ট  হয়। লোকজন এলোমেলো ছুটতে থাকে। সেও ভয় পেয়ে ছুটে যায় এক গলির মধ্যে। কুলসুম সেখানে গিয়ে তাকে আর পায় না। উপরন্ত লোকজনের ছুটোছুটি আর পুলিশের আগমন দেখে কুলসুম নিজেও ভয় পেয়ে যায়। ভয় পেয়ে ছুটে পালায় অন্য এক গলিতে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে বেশ একটু সময় লাগে। কিন্তু পরবর্তীতে সে কুলসুমকে খুঁজে পায় না, কুলসুমও খুঁজে পায়না তাকে। নিজের কাছে ফোন না থাকায় সে যোগাযোগ করতে পারে না বাবা-মায়ের সাথে। সে খুব ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়ে। মূলতঃ এরকম বিরূপ পরিবেশের মুখোমুখি সে এর আগে আর কখনোই হয়নি। সে স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করতে থাকে। স্কুলের দারোয়ান তার বাবা-মাকে ফোন করে ঘটনা অবহিত করে।
বাবা-মা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, মেয়েকে সেলফোন কিনে দেবেন, যাতে ইমার্জেন্সি যোগাযোগ করা যায়। আর ফোন যখন দেবেনই, তখন ভাল দেখেই দেয়া যাক। মেয়ে লেখাপড়ার অবসরে সময় কাটাতে পারবে। একা থাকে সারাদিন। নামি কোম্পানীর দামী একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিলেন মেয়েকে। ফোনটার পেছনে আধ খাওয়া একটা আপেলের ছবি।
ক্লাশ নাইন-এর পুরো সময় ফোনটা প্রায় অব্যবহৃতই থেকেছে। বাসায় পড়ে থাকতো তার টেবিলের উপর, আর স্কুলে ব্যাগের ভেতর। বন্ধুদের অনেকে জানতোই না যে, তার পার্সোনাল সেলফোন আছে। সে স্কুলে থাকার সময় ফোনটা বাজতো কালে-ভদ্রে। ফোন আসে দুইটা মাত্র নাম্বার থেকে।
হয়তো বাবা জানতে চাইলেন, স্কুল ছুটি হয়েছে মা?
মাত্রই ছুটি হলো বাবা।
কুলসুম গেছে ?
জি বাবা।
রিকশা পাচ্ছো তো ?
জি বাবা, অনেক রিকশা। রিকশাওয়ালারা সামনে এসে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে-আফা, আসেন, কই যাইবেন আফা ? আমারটায় আসেন। বাবা, ওরা এমন করে কেন? আমার দরকার পড়লে তো আমিই ওদেরকে ডাকবো।
এটা কম্পিটিশনের যুগ মা। সবাই আগে যেতে চায়। ওরা যেমন প্যাসেঞ্জার নিয়ে টানাটানি করে, আমরাও তেমন মক্কেল নিয়ে টানাটানি করি। তুমি দেখে-শুনে বাসায় যেও।
আচ্ছা বাবা।
বাসায় থাকলেও সেই দুই নাম্বারের কোনোটা থেকেই ফোন আসে।
হয়তো মা ফোন করেছেন, বাসায় ফিরেছো মা?
জি মা।
কোনো সমস্যা হয়নি তো ?
না মা, কোনো সমস্যা হয়নি।
খাওয়া-দাওয়া করেছো ?
¬জি মা, কুলসুম মাংসের মধ্যে এত মরিচ দিয়েছে যে, ঝালে আমার নাক-মুখ জ্বলে যাবার অবস্থা। এখনও মুখ দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দ বের হচ্ছে। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো মা ?
ওকে এত করে বলি তরকারিতে ঝাল কম দিতে, তাও শিক্ষা নেয় না। আচ্ছা, আজ আবার বকে দিবো।
কখনও কখনও কুলসুম এসে পড়ে। সে টান দিয়ে ফোন নিয়ে বলে, আফায় মিছা কতা কইছে আম্মা। খাওয়ার সময় আমারে কি গাইলই না দিলো-বাসায় মরিচ নাই? তুই রান্নার সময় মরিচ দিস না কেন?
মা কুলসুমকে আদোর মাখা কন্ঠে বলেন, এই বোকা মেয়ে, আমি কি তোকে এ ব্যাপারে কিছু বলেছি কখনো?
রোজ রোজ মিছা কতা কইবো ক্যান? মিছা কতা কইলে হায়াত কাটা যায়।
ফোনে কথা বলার কিছু থাকে না তো তাই।

দুই।।
ক্লাশ টেন-এর প্রথম থেকেই তার ফোনটা অধিক ব্যবহৃত হতে শুরু হলো। তখন বন্ধুদের কাছ থেকে প্রায়ই এটা-ওটা জানার দরকার হয়। ক্লাশ টেস্ট, মডেল টেস্ট, সাজেশন ইত্যাদির ব্যপারে কথা বলতো সে। আর তখন সে নিজেও বুঝতে পারলো, আধুনিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটা সত্যিই খুব দরকারি। সে যখন ইংরেজি রচনা ‘গিফট অব মডার্ন সায়েন্স’-এ পড়তো-মডার্ন সিভিলাইজেশন ইজ দ্যা গিফট অব সায়েন্স, তখন তার চোখ চলে যেতো ফোনটার দিকে। মডার্ন সিভিলাইজেশনের অন্যতম একটা অংশ সেলফোন। সেলফোন ছাড়া দ্রুত কমিউনিকেশন অসম্ভব।
বন্ধুদের পেরিয়ে তার নাম্বারটা যেতে থাকল আত্মীয়-পরিজনের কাছে। সে প্রায়ই মামা-মামী, খালা-খালু, চাচা-চাচী এদের সাথে কথা বলত। সমবয়সী কাজিনদের সাথেও কথা বলত।
এক রাতে ফোন করল এক কাজিন। তার বড় খালার বড় ছেলে। নাম নিলয়। সে জেলা শহরে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। নিলয়ের ফোন পেয়ে সে অবাক হল খুব। কেননা, সে তাকে ফোন নাম্বার দেয়নি। কাউকে ফোন নাম্বার না দিলেও যে তার নাম্বারটা কারও কাছে চলে যেতে পারে, সেটা বোধহয় সে জানত না।
নিলয় বলল, সুমাইয়া, তুমি যে ফোন নিয়েছো তা আমাকে একবারও জানালে না ?
আমি তো আপনার নাম্বার জানতাম না নিলয় ভাই।
জানার ইচ্ছা থাকলেই জানতে পারতা। আমি তোমার নাম্বার জানলাম কিভাবে?
সরি নিলয় ভাই, এক্সট্রামলি সরি, আপনি কেমন আছেন নিলয় ভাই ?
ভাল, তোমার লেখাপড়া ভাল চলছে তো ?
হ্যাঁ, খুব ভাল চলছে। আশা করি জিপিএ ফাইভ পাবোই পাবো।
তা তো পেতেই হবে, নাহলে ভাল কলেজে চান্স পাবা না। ভাল কলেজে চান্স না পেলে ইন্টারেও ভাল রেজাল্ট হবে না। তখন বুঝবা কত গমে কত আটা, কত আটায় কত রুটি। কত আখে কত গুড়, কত গুড়ে কত শরবত।
মানে?
আমাকে দেখতেছো না? ঢাকায় ভাল কোনো কলেজে চান্স পেলাম না বলে ইন্টারেও ভাল রেজাল্ট হল না। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম না। এসে ভর্তি হলাম জেলা শহরের এই কলেজে। কলেজ মানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেশন জটের এই নৌকা শেষ পর্যন্ত ঠেলতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। সুযোগ খুঁজছি, অষ্ট্রেলিয়া চলে যাব।
সেশন জট কি নিলয় ভাই ?
এখন বুঝবা না, কলেজ শেষ করো তারপর বুঝবা সেশন জট কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি। লেখাপড়া ছেড়ে দিবা তবু ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাইবা না। কারণ, লেখাপড়া শেষ করে দেখবা বিয়ার বয়স নাই।
হি-হি-হি। আপনি সব সময় মজা করে কথা বলেন নিলয় ভাই।
আমি তো মজার লোক।
সত্যিই আপনি অনেক মজার লোক।
আচ্ছা, ফোন নিয়েছো যখন, তখন মাঝে মাঝে ফোন-টোন দিও।
দিবো, আপনিও দিয়েন।
আচ্ছা, আমি দিবো। কিন্তু তুমি কি সব সময় ফোন দিতে পারবা?
কেন পারব না নিলয় ভাই?
তোমার ফোনে যদি ব্যালেন্স না থাকে?
আমার ফোনে সব সময় ব্যালেন্স থাকে নিলয় ভাই।
শোন, তোমার ফোনে সব সময় আমিই ব্যালেন্স দিয়ে দিবো।
না না, আপনি কেন আমার ফোনে টাকা দিবেন?
অসুবিধা কি? আমি তোমার খালাতো ভাই না? তোমার প্রতি কি আমার কোনো দায়িত্ব নাই? ক্লাশ টেন-এ উঠেছো। স্কুলের সবচেয়ে বড় ক্লাশ। এখন নিজেও বেশ কিছুটা বড় হয়েছো। এটা-সেটা কেনার দরকার পরে না? আমি ফোনের ব্যালেন্স দিলে খালা-খালু যেটা দিবেন সেটা দিয়ে নিজের মতো কিছু কিনতে পারবা।
আমার যা দরকার হয় চাইলেই তা পাই।
তারপরেও.....। শোন, আসল কথা তো বলাই হয় নাই। গত মাসে আমি বাইক কিনেছি। দাম দুই লাখ আশি হাজার। প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাই, বাসে ঝুলে বাড়ি যাওয়া যায় বলো? বেড়াতে এসো, বাইকে করে ঘুরাবো। সবাই বলে, আমি খুব রিস্কি বাইক ড্রাইভার। বাইক যখন চালাবোই তখন অতো পুতুপুতু করে লাভ আছে বলো?
পুতুপুতু কী নিলয় ভাই?
তোমার পুতুপুতু বোঝার দরকার নাই। সত্যি কথা হল, জন্মিলে মরিতে হইবে।
তাই বলে সাবধানে চালাবেন না ?
সাবধানীরা মরে বেশি। আমার চাচাকে চোনো না ? জনমের সাবধানী। ব্যবসা করবেন, রিস্ক নেবেন না। দশ হাজার টাকা ইনভেস্ট করতে বুক কাঁপে। তার লাভ কত হবে বলো? আর আমার বাপজান? নো রিস্ক নো গেইন-এই থিমের ওপর ব্যবসা করে যাচ্ছেন। এখন তার বড় ভাইকে ত্রেত্রিশ বার কিনতে পারবেন। আমি সেই বাপের ছেলে। এখন রাখি। মন দিয়ে লেখাপড়া করবা। এ ব্যাপারে কোনো রিস্ক নিতে যেও না যেন।
নিলয় বড়লোক বাপের একমাত্র সন্তান। গ্রামের হাট-বাজারে তার বাবার নানারকম ব্যবসা। গ্রামের হাট-বাজার ছাড়িয়ে জেলা শহরেও তার বাবার ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটেছে।
এরপর থেকে প্রতি রাতেই নিলয়ের সাথে তার কথা হয়। অপ্রয়োজনীয় কথা। খুনসুটি। হাসাহাসি। ব্যপারটা তার কাছে যেমন মজার তেমন আনন্দের। ফোনে কথা বলার মধ্যে যে এতটা আনন্দ, এতটা ভাল লাগা আছে সে তা আগে বুঝতে পারেনি।
রাত বারোটা বাজলেই সে পড়ার টেবিল থেকে উঠে যায়। গিয়ে বসে খাটের কোণায়। পিঠের নিচে একটা বালিশ গুজে দেয়। কোলের পড়ে টেনে নেয় একটা। তারপর অপেক্ষা করে নিলয়ের ফোন আসার জন্য। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিলয়ের ফোন এসে যায়। কথা চলে রাত একটা কি দেড়টা পর্যন্ত। কত কথা!
চুপচাপ টাইপের মেয়েটার মধ্যে যে মধুর স্বরে এত মধুময় কথা লুকানো ছিল নিলয় তা কল্পনাও করতে পারেনি। নিলয়ের কথাই বা কি বলবো, নিজের কথার পরদর্শীতায় সে নিজেই অবাক হতে থাকে। সে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় ফোনটাকে। ফোনটা না থাকলে সে জানতেই পারতো না যে, সে এত সুন্দর করে এত কথা বলতে পারে।
প্রথম মিথ্যা বলা।
বাবা বললেন, তুমি কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো তোমার ফোনের জন্য টাকা নিচ্ছো না। ফোনে কি টাকা আছে?
জি না বাবা।
কেন নেই ? ইমার্জেন্সি প্রয়োজনে ফোন করবে কিভাবে? মনে করো, স্কুল থেকে ফেরার সময় পথে এ্যাটম বোমা ব্লাস্ট হলো, লোকজনের ছুটোছুটি, রিকশা পাচ্ছো না। তখন........?
এ্যাটম বোমা! স্কুলের পথে এ্যাটম বোমা ব্লাস্ট হবে কেন?
এ্যাটম বোমা বলেছি? প্যাট্রল বোমা বলতে গিয়ে এ্যাটম বোমা বলে ফেলেছি। শোন, এরকম করবে না বুঝলে। সব সময় ফোনে ব্যালেন্স রাখবে।
বাবা মানি ব্যাগ খুলে পাঁচশ টাকার একটা নোট তার হাতে দিলেন। টাকাটা নেবার সময় তার হাত একটু কেঁপেছিল। তার মনে পড়েছিল, তার ফোনের ব্যালেন্স তখনও ৫৫০ টাকা। নিলয় গতকালও ৫০০ টাকা পাঠিয়েছে।
পরদিন সে স্কুলে গিয়ে প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে ফুসকা আর লাচ্ছি খেল। তারপরও কিছু টাকা তার হাতে থাকল।
স্কুল থেকে ফেরার পথে সেই প্রথম তার স্কুল থেকে অন্য কোথাও যাওয়া। স্কুলের পাশেই একটা শপিংমল। সে কুলসুমকে বলল, তুই সব কাজ শেষ করে এসেছিস তো?
কাম ফালায়া আবার কবে আইলাম ?
তাহলে চল, একটা নেইলপলিশ কিনে নিয়ে আসি।
আপনের ক্ষিধা লাগে নাই ?
না, আমি ফুসকা আর লাচ্ছি খেয়েছি।
তায়লে লন যাই।
শপিংমলে কয়েকটা দোকান ঘুরে সে হালকা খয়েরি রঙের একটা নেইলপলিশ কিনলো। নেইল পরিস্কার করার জন্য একটা রাবার কিনলো।
বাসায় ফিরে বিকেলে বারান্দায় বসে খুব যতœ করে রাবার দিয়ে ঘষে ঘষে নেইল পরিস্কার করল। নেইলগুলো একেবারে চকচকে হয়ে উঠল। তারপর চকচকে নেইলগুলোতে সে নতুন কেনা নেইলপলিশ লাগাল। নেইলপলিশ লাগাতে লাগাতে ভাবল, মাঝে মাঝে এভাবে কিছু টাকা নিলে মন্দ হয় না। বন্ধুদের সাথে মজা করে খাওয়া যায়, এটা-ওটা কেনাও যায়।
তারপর থেকে তার মিথ্যা বলতে আর ঠোঁট কাঁপে না। মিথ্যা বলে টাকা নিতে আর হাত কাঁপে না। সে নিজেকে বোঝায়-বাবা-মা-ই তো। সে তো আর অন্যের পকেট থেকে টাকা চুরি করছে না।
সকালে বাবার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নেয়। বিকেলে বাবার অনুপস্থিতিতে মায়ের কাছ থেকে নেয় ৫০০ টাকা। যাতায়াত খরচ থেকে টাকা বাঁচে। টিফিন খরচ থেকেও বাঁচে। তারপরও কলম, খাতা, ইন্সট্রুমেন্ট বক্স ইত্যাদি কেনার কথা বলে প্রায়ই টাকা নিতে থাকে। বাবা-মা এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না। মেয়ে বড় হচ্ছে। এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। নিজের টুকটাক দরকারি জিনিস সে কিনতেই পারে।
দেখা যায়, তার হাতে সব সময় ভাল পরিমাণ টাকা থাকে। এ পরিমাণ টাকা তার ক্লাশে আর কারও হাতেই থাকে না। আগে তার বন্ধু ছিল গুটি কয়েক। রাতারাতি ক্লাশের সবাই তার বন্ধু হয়ে যায়। সে হয়ে যায় ক্লাশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেয়ে। সে এই জনপ্রিয়তাকে খুব উপভোগ করে। সে এটা ধরে রাখতে চায়। তাই প্রায় প্রতিদিনই একে-ওকে নিয়ে খাবার দোকানে, শপিংমলে তাকে যেতে হয়।
কাজের মেয়ে কুলসুম তার সঙ্গী থাকে। তার প্রথম প্রথম ভয় হতো, কুলসুম আবার বাবা-মাকে কিছু বলে দেয় কিনা। কিন্তু না, কুলসুম বিশ্বাসঘাতক না। অথবা সে বিশ্বাসঘাতক হতে সাহস পায় না। পাছে আবার নিজেই বাড়তি কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে যায়। সে কুলসুমের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। মনে মনে ভাবে, মাঝে মাঝে কুলসুমকেও কিছু দেয়া উচিত।
একদিন বলে, তুই কিছু কিনতে চাস কুলসুম?
আমি আবার কি কিনুম ?
কিনতে চাইলে বল, কিনে দেবো।
আমি কি আপনের নাহাল নেলপালিশ, লিপিসটিক মাখি নাকি ?
আহ! অন্য কিছু কিন। কত কিছুই তো আছে কেনার মতো। 
দিতে চাইলে একটা জিনিস দিতে পারেন।
কী জিনিস বল ?
আফনের বন্দুগো সামনে..........।
তুই কি বোমা বা ককটেল জাতীয় কিছু কিনতে চাস যে, ওদের সামনে বললে ওরা পুলিশকে খবর দেবে?
না মানে...........।
মানে-টানে বাদ দে’। ওরা কি ছেলে মানুষ? অতো ভনিতা না করে যা বলার বলে ফেল ?
আম্মা আর চাচাজান সবই দেয়, খালি একটা জিনিস দেয় না। চাচাজানের কাছে তো আর সেইটা চাওয়া যায় না। আম্মারও খেয়াল হয় না। খালি জামা পড়ি, কেমন ঢলঢল করে.....।
বুঝেছি, চল কিনে দেই।
দোকানে যেতে যেতে সে বলল, তোর সাইজ কত জানিস ? আমার তো ৩৪।
আমারও মনে হয় তাই হইবো।
বললি এক কথা। তোর ৪০ এর কম না।
পরে দেখা গেল কুলসুমের সাইজ ৪২। কুলসুমের জন্য ৪২ সাইজের ২টা ব্রা কেনার পর সে নিজের জন্যও ৩৪ সাইজের ২টা কিনলো। যখন সে ৪টার দাম দিতে যাবে তখন কুলসুম বলল, আফা, ২ প্যাকেট মোনালিসা নিয়া যান।
মোনালিসা কি?
আপনে দেখি কিছুই বোঝেন না।
তোর কথা সব বোঝা যায় না। ভাল করে বল।
আপনের তো ৩/৪ দিনের বেশি থাকে না। আর আমার শুরু হইলে ৭ দিনের আগে যায় না।
দোকানী মহিলা মুখে মিটিমিটি হাসি টেনে মোনালিসা নামের ২ প্যাকেট প্যাড বের করে দিল। তার বন্ধুদের মুখেও হাসি। একজন বলল, সে আছে সব দরকারি জিনিস কেনার তালে।
[চলবে...]

স্বপ্নের প্রীদিম

স্বপ্নের প্রীদিম


স্বপ্নের প্রীদিম
শরীফ সাথী 

        গ্রামের ছেলে ফিনাল। এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন তাঁর দুচোখে। উঁকি দেয় ভবিষ্যতের স্বপ্নের স্বর্ণালী আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ভর্তিযুদ্ধে রীতিমত নামতে হচ্ছে তাকে। কৌশলী হতে হচ্ছে সর্বদিক দিয়ে। সুদূর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নতুন চমক আসে তাঁর মনে। শহুরে পরিবেশ তাকে সবকিছুই আপ্লুত করে তুলছে। রেলওয়ে ষ্টেশন যে এতা বড় হয়, সৌন্দর্য কারুকার্য দুচোখকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। হোষ্টেলে থাকা অভ্যাস নেই। সিট ভাড়া রুমে একাকী থাকা ঘুমহীন রাত। গ্রামের বাড়িতে মা বাবা ভাইবোন মিলেমিশে একসাথে মহব্বতি থাকা খাওয়া। আর এখানে সঙ্গহীন কেমন কেমন ভীতি ভীতি মনে বেড়ানো, হোটেলে খাওয়া দাওয়া। ভাবনার সাগর অসীম গহীনে ঢেউ তোলে। কী জানি কি হয়? বাবা মায়ের টাকা পয়সা খরচ করে এসে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এলাম। ঠিকমত পরীক্ষা দিতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি এমান আশা ভরসা। মা বাবার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আশা আমাকে নিয়ে। আমাদের ছেলে ফিনাল ভার্সিটি পড়বে? সে এখন ভার্সিটির ছাত্র? বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করে ফিরেছে... কত না অনুভব অনুভূতি দোলা দেয় হোষ্টেলের বেডে রাত জাগা ফিনালের মনে। পড়াশুনার দিকে খুবই ঝোঁক ফিনালের। উচ্চ শিক্ষিত হবো, মানুষের মত মানুষ হবো। কৃষক বাবা গর্ব করে বলবে, আমার ছেলে ফিনাল ভার্সিটি পড়া শেষ করে শিক্ষিত, ন¤্রভদ্র, সামাজিকতায় গড়া এক জীবন্ত ইতিহাস। ভাবনার অতলে ডুবে থাকা ফিনাল বুঝতেই পারিনি গভীর রাত পেরিয়ে ভোরের আগমনী বার্তা মুয়াজ্জিনের চিরচেনা আযানের কণ্ঠধ্বনী তাঁর কর্ণে ভেসে এলো। বেড থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে পাখির কিচিরমিচির কলতানে বিমুগ্ধ রবির হাসির প্রতীক্ষায় ফিনাল। সকালে খাবার হোটেলে ডাল দিয়ে দুপিচ পরোটা খেয়ে ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্রে উপস্থিত হতেই দেখতে পেল হাজার হাজার পরীক্ষার্থীর উপস্থিতি। মনে সাহস থাকতে ভীতি বিরাজ করছে।
এতো পরীক্ষার্থীর মাঝে টিকবো তো? আমার তো কোন নামীদামি স্বজন নেই। সহযোগিতা কিংবা আশ্বাস দেবার মত কেউ নেই। আশা আর আমার লেখাপড়ার অভিজ্ঞতার ভা-ার অপার করুণাময়ের কৃপা হলে নিশ্চয় ভাল ফলাফলের সৌভাগ্যতা অর্জণ করবো। পরীক্ষা দিয়েই ফিরতে হবে। বেশি দিন থাকা হবে না। থাকলে পদে পদে খরচ। পকেটের দিকে লক্ষ তো রয়েই যায় ফিনালের।
           ভালো মত ঠিকঠাক পরীক্ষা দিয়ে ফিনাল ফিরছে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও স্বপ্ন ছিল রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী পদ্মার পাড়, পার্কসহ দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার। ট্রেনে উঠে নিজ আসনে বসে জানালার কাঁচ তুলে বাহিরের প্রকৃতির দৈনন্দিন দৃশ্যের ইচ্ছেগুলো নয়ন ভরে দেখছে ফিনাল। ষ্টেশনে কংক্রিট পাথরের বিস্তৃর্ণ অনুরাগ ছোঁয়ায় একের পর এক রেল লাইন। প্লাটফর্ম গুলোর দিক নির্দেশনা কার কোন দিকে গন্তব্য মাইকিং। আশপাশের বিভিন্ন ভবনের সমাহার। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছাড়তেই সাইড এর খোলা গ্লাচ ক্লোজ করে বসে আনমনে ফিনাল উপরের দিকে তাকাতেই ব্যাগ লাগেজ রাখা হ্যাঙ্গারের তলে লম্বা সুদূর ঝকঝকে গ্লাচ কাচের মাঝে জ্বলজ্বলে পরিচ্ছন্ন হাসিমাখা সুন্দরীর মুখ দেখতে পেল। সম্মুখীন সিট বিশেক দূরের সিটে মেয়েটি সামনাসামনি বসা। গ্লাসের আয়নায় দুজনের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ও হেসে উঠল। ফিনাল মুচকি হাসি দিয়ে লজ্জা বরণ চেহারায় তাকাতেই দেখতে পেলো ওর ঝলমলে মসৃণ ঠোঁটের মাঝে হাসির ফোয়ারা চকচকে গ্লেস বর্ণ দাঁতসমূহ। স্কাট দিয়ে মাথার কেশ কালো লম্বা চুল গুলো ঢেকে মুখম-ল আরও আয়নার সামনে তুলে ধরলো। টেনশনে জর্জরিত ফিনাল সুন্দরী লাবণ্যভরা মায়াবী চেহারার মুখয়ব দেখে তৃপ্তির ছোঁয়া খুঁজে পেলো। অনুভবে আনন্দ অনুভুতির প্রথম যৌবন ফুঁটে উঠল ভালোলাগার অপার বাস্তবতায়। ফিনাল ভাবতেই পারিনি এত দূরে দুজন বসে থাকা সত্ত্বেও মাথার উপরের এই হ্যাঙ্গারের গ্লাস আয়নায় এভাবে দুজন দুজনের দেখে দেখে হেসে হেসে এত দূরত্ব এত সন্যিকটে আসে। ভালোই লাগছে, মন্দ না? সময় কাটছে। ট্রেন চলছে ট্রেনের ছন্দময় গতিতে। মেয়েটির দৃষ্টি নন্দিত নয়নের সুদৃষ্টির কাছে বারবার পরাজিত সৈনিক এর ন্যায় মাথা নিচু করছে ফিনাল। আবার চোখ মেলতেই মুখ অবয়বে ফোঁটা সৌন্দর্যের বাঁধ ভাঙা সীমাহীন তারণ্য দ্বীপ্ত সমুজ্জ্বল মায়াবতীর পরিস্ফুটিত রূপের রঙে চেতনালব্দ জ্ঞান পিপাসু আবেগ ভালবাসার মোহনা খুঁজছে। এত রূপবতী শোভাবর্ধনকারি ফুলেল ছোঁয়া বিমুগ্ধ ধোঁয়া বিস্তারকারি যৌবনবোধের জীবন্ত প্রতিভা প্রকাশ। কই মনে পড়ে না দেখেছে নয়ন কোথাও কি? তুমি কে গো? তোমার হাস্যোজ্বল গোলাপী বরণ, তৃষ্ণার্ত ডাগর আঁখির নীল নয়নাভিরাম পলকহীন দৃষ্টি, প্রেমময়ী বৃষ্টি আভাসে, বাতাসের কুঞ্জনে গুঞ্জনে শিহরিত স্পন্দনে একাকার। মাঝে মাঝে তুলতুলে নরম হাতের টার্চ মোবাইলে খেলা, বহিঃপ্রকাশে আনন্দ মেলা দিচ্ছে দোলা মনে। হৃদপি- কম্পিত হচ্ছে। দুয়ার খুলছে নতুন অধ্যায়ের। ফিনালের ইচ্ছে ছিল রাজশাহী টু চুয়াডাঙ্গা আসার পথে ট্রেনে জানালার ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন লোকেশনের চিত্র, মিত্র করবে দুচোখে। একের পর এক ষ্টেশনগুলো নোট বুকে লিপিবদ্ধ করার। মাঠ ঘাট বন বনানী পেরোনো দৃশ্য দেখে দেখে চলন্ত ট্রেনের ঝকঝকাঝক শব্দ দুকর্ণ চেতিয়ে শুনবে। কিছুই হলো না। কখন যে চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে পোঁছে গেল ট্রেন। হুড়োহুড়ি নামার তোড়জোড়। প্লাটফর্মে নেমে পিছে ট্রেন রেখে হাঁটা শুরু করলো ফিনাল। এমন সময় মেয়েটি ঘাড়ে হাত দিল। ফিরে চাইতে মুচকি হেসে মেয়েটি বলল, আমি রিমঝিম। তুমি তো বেশ বসেছিলে ট্রেনে। পরীক্ষা কেমন দিলে?
ফিনাল অবাক চোখে চেয়ে বলল, মুটামুটি। তবে কি হবে জানি না?
রিমঝিম বলল, তোমার রোল নম্বর এবং মোবাইল ফোন নম্বর দাও?
রিমঝিমের হাতে দিতেই রিমঝিমের বাবা ডাক দিল তাড়াতাড়ি আসার জন্য। অম্লান করে চেয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল চোখের আড়ালে। চাওয়াকে অমলিন করে ফিনাল ফিরে এলো গ্রামে।
বেশ অনেক দিন পর হঠাৎ ফিনালের ফোন বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই সুমিষ্ট আবেগী কণ্ঠে ভেসে এলো কেমন আছো ফিনাল?
আলহামদুলিল্লাহ বলতেই মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, ভর্তি হচ্ছো তো? তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছো? ভর্তি হতে কবে যাচ্ছো রাজশাহী ফিনাল?
হতবাক হয়ে ফিনাল বলল, রিমঝিম বলছো? সত্যি বলছো?
হ্যা। দেখা হবে ভার্সিটি প্রাঙ্গণে। ভাল থেকো...।

ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন : সৌর শাইন : পর্ব : ০১

ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন : ক্রাইটেরিয়ন   : সৌর শাইন : পর্ব : ০১



ক্রাইটেরিয়ন
সৌর শাইন


দাবানল

ভাওয়াল গড় ও মধুপুর শালবনের অগ্নিকা-ে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে ধারণা করা হয় আগুনের সূত্রপাত বনের অভ্যন্তরে একটি বাংলো বাড়ির বৈদ্যুতিক শটসার্কিট থেকে। সে বাংলো বাড়িতে গুরুতর আহত অবস্থায় পাওয়া যায় আটত্রিশ বছর বয়সী এক যুবককে। বৃহৎ বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াতে সরকার, বৃক্ষ ও প্রকৃতি মন্ত্রণালয় পড়েছে চরম সমালোচনার মুখে। সবধরনের মিডিয়ার দৃষ্টি তখন দেশের অন্যতম বৃহত্তর বনাঞ্চল শালবনের দিকে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বিপর্যয় কাটিয়ে না ওঠা পর্যন্ত ভাওয়াল ও মধুপুর বনাঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি থাকবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি বৃহৎ জেলা জুড়ে দাবানলের বিস্তার ঘটেছে!

প্রথমদিকে বনাঞ্চলের স্থানীয় জনগণ আগুন মোকাবেলার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিসের প্রায় সবগুলো ইউনিট ধীরে ধীরে যোগ দেয়। একযোগে কাজ করা সত্ত্বেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি ঘটেনি। আগুন ক্রমেই আশঙ্কা সীমার বাইরে চলে যেতে থাকে। লাগামছাড়া এ দাবানল পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ভয়াবহ এই অগ্নিকা- কি ষড়যন্ত্র নাকি দুর্ঘটনা, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। দাবানল এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে বন্য পাখিদের চিৎকার চেঁচামেচি। ওরা নিরুপায় হয়ে এদিক-সেদিক উড়াউড়ি করছে। বহুপাখি হাইওয়ে রোড ও বনের পার্শ্ববর্তী নদ-নদীর পাড়ে জড়ো হয়েছে। হাইওয়ে রোড থেকে যতদূর দেখা যায়, পুরো বন ধূ ধূ ধূসর। কালো কঙ্কালের মতো গাছ, ডাল-পালা ও মাটিতে ছাই ছড়িয়ে আছে। পোড়া বৃক্ষের পাশে পড়ে আছে বন্যপ্রাণীর দেহভস্ম। বানর, হনুমান, বনবিড়াল, বাগডাশ, সজারু ও মেছোবাঘগুলো বন ছেড়ে ভয়ঙ্করভাবে লোকালয়ের দিকে ছুটছে। অসহায় প্রাণীদের চোখে নিরাপত্তার আকুতি। নিয়তির এ নির্মম খেলা ভারি করুণ! লোকালয়ে ছুটে যাওয়া পশুদের নিয়ে মানুষ খুবই আতঙ্কগ্রস্থ! জানা গেছে, দিশেহারা গ্রামবাসী আত্মরক্ষার্থে কয়েকটা বেপরোয়া মেছোবাঘ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। বনের পাশের গ্রামগুলোও আগুনে পুড়েছে, পুড়েছে মানুষের ভাগ্য, পুড়েছে ঠিকানা।
সেসব গ্রামের মানুষ ও গবাদি পশু গৃহহারা হয়ে ঠাঁই নিয়েছে খোলা আকাশের নিচে। কেউ কেউ হারিয়েছে ওদের স্বজন। আগুনে পুড়ে ও ধোঁয়া বন্দি হয়ে শিশু ও বৃদ্ধদের মৃত্যুর সংখ্যা সবচে বেশি। বহুসংখ্যক পশু, হাঁস-মুরগির খামার পুড়ে নিমেষে ছাই হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার সম্বল হারিয়ে ওদের শুষ্ক চোখ এখন নিঃস্ব সীমানার দিকে।

গতসপ্তাহে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে বনাঞ্চলের আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। তবে সে যৌথ অভিযানের সাথে প্রকৃতির করুণা আশীর্বাদ হয়ে নেমেছিল বৃষ্টি। অন্যথায় হয়তো পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করত।

অনুমান করা হচ্ছে গত দু’সপ্তাহের এ অগ্নিকা-ে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অন্যদিকে ধারণা করা হচ্ছে এ অগ্নিকা- ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক পরিবেশকেও চরমভাবে প্রভাবিত করবে। এর সাথে অন্যান্য দুর্যোগের আশঙ্কা তো রয়েছেই। অভিযান চলাকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে রোড ও ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে রাজধানীর সাথে উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের যোগাযোগ স্থবির হয়ে পড়ে। যার ফলে ব্যবসায়ীদের পড়তে হয়েছে চরম ক্ষতির মুখে।



মিডিয়ার দৃষ্টি

শালবন অগ্নিকা-ের সূত্রপাত হয়েছিল একটি বাংলো বাড়ি থেকে। নিউজে সে বাড়িটির বর্ণনা ও ভিডিও চিত্র বার বার দেখানো হয়েছে। বাড়িটি গ্রামের রাস্তা থেকে কিছুটা বনের ভেতরে। বাড়ির চারপাশেই শালগাছে ভরপুর। বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হলেও, ঘরের ভেতর বহু বই-খাতা পোড়া ছাইয়ের স্তুপ দেখে মনে হয় এগুলো উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পোড়ানো হয়েছে। যাই হোক, সে ঘরে থাকা যুবকটির প্রসঙ্গ বার বার ওঠে এসেছে। যুবকটির নাম সোম মজুমদার। তিনি দুর্ঘটনায় ব্যাপকভাবে আহত হন। তবে অগ্নিকা-ের পরপরই তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তারপর থেকে চিকিৎসাধীন।

দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সোম মজুমদার অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ খবর শোনে গণমাধ্যম কর্মীরা তার সাক্ষাতকার নেবার জন্য ছুটে যায়। সেখান থেকে জানানো হয়, সোম পুরোপুরি সুস্থ নন। সুতরাং তার পক্ষে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।
পরবর্তীতে সাক্ষাতকার নিতে গেলে, সোম মজুমদারের বৃদ্ধ পিতা ফারদিন মজুমদার সরাসরি বাধা দেন। তিনি বিষয়টি নাকচ করে বলেন, সোম এ ঘটনার ব্যাপারে কোনো প্রকার সাক্ষাতকার দেবে না।
কিন্তু গণমাধ্যম এটা কিছুতেই মানতে রাজি ছিল না। তারা প্রচার করে, দেশের এত বড় বিপর্যয়ের পেছনে কী কারণ বা রহস্য লুকিয়ে আছে তা জানা অবশ্যই প্রয়োজন। মিডিয়া প্রশ্ন তোলে, কী এমন ভয়ের কারণে সোম মজুমদার সাক্ষাতকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করছে?
পরদিনই সোম মজুমদার তার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দেন, ঘটনার বর্ণনা দিতে আমার কোনো ভয় নেই। সাংবাদিক ভাইদের বলছি, ‘আপনারা আগামী সপ্তাহের যেকোনো দিন, সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করুন। আমি অগ্নিকা-ের সূত্রপাত কিভাবে হলো তার বর্ণনা দেব। গা শিউরে ওঠা সে ঘটনা কারোর পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হবে কিনা জানি না।’

পরবর্তী সপ্তাহে সোম মজুমদার একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ঘটনার বিবৃতি দেন। যা তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ ডেকে আনে। সোম মজুমদারের ঘটনা বর্ণনা থেকে বেরিয়ে আসে অগ্নিকা-ের একটি অদ্ভূদ কারণ। বিষয়টা কারোর কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। অতি অস্বাভাবিক এ ঘটনার ব্যাখ্যা শুনে, সবার রোষানল গিয়ে পড়ে সোম মজুমদারের উপর। অনেকেই অভিযোগ করেন ও যুক্তি দাঁড় করান এই অগ্নিকা-ের জন্য দায়ী সোম মজুমদার। এখন তিনি নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যে আজব ঘটনা প্রচার করছেন। কেউ কেউ তাঁর ব্যক্তিজীবনের ঘটনা উল্লেখ করে, তাকে মানসিক রোগি বলে দাবি করেন।

সোম মজুমদার প্রথমদিকে পরিবেশবাদীদের চরম ক্ষোভের মুখে পড়ে। পাবলিক প্লেসে কেউ কেউ তাঁর প্রতি চরম দুর্ব্যবহার, রূঢ় আচরণ প্রদর্শন করে, এমন কি হত্যার হুমকিও দেয়। তখন তিনি খুবই অসহায় ও নিরুপায়। এরূপ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সোম মজুমদারের জীবন আশঙ্কা ক্রমেই বেড়ে ওঠে। একদিন টিভি নিউজে দেখা যায়, সোমের বৃদ্ধ পিতা ফারদিন মজুমদার অশ্রুসজল চোখে দু’হাত জোড় করে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাচ্ছেন। এই ঘটনাগুলো প্রায় সবার কাছে পরিচিত। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে মিডিয়া দীর্ঘদিন ধরে তুলকালাম কা- ঘটিয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিন পরের কথা। তখন মিডিয়ার স্বভাবসুলভ দৃষ্টি অন্যদিকে মোড় নিলো। জনতা যে খবরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে, মিডিয়ার নজর সেদিকে। জনগণের আবেগ ও মনের বিপরীত পৃষ্ঠাকে সমীহ করে চলাই কিছু তোড়জোড় গণমাধ্যমের ধর্ম। ঘটনাটা অন্যসব ঘটনার নিচে চাপা পড়ল।


রহস্যজনক মৃত্যু

কিছুদিন আগে, সৌরক বিশেষ কিছু কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিল। সেখানে ওর দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। হঠাৎ শালবন অগ্নিকা- ওর মন খারাপের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাতে ঘুমের মধ্যেও সে দাবানলের দৃশ্য দেখতে পায়। প্রায়ই আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। অতিষ্ঠ হয়ে সে টিভি নিউজ দেখা বন্ধ করে দেয়। অভয়মিত্র ঘাটে দাঁড়িয়ে কর্ণফুলি নদীর দৃশ্য দেখে। মন খারাপকে দূরে ঠেলে দেবার কিছু পরিকল্পনা সে ভাবনার ভেতর সাজায়। সেগুলো লিখে ফেলারও চিন্তা করে। কিন্তু লিখতে গিয়ে ওর কলম ভিন্নদিকে সরে যায়। নতুন একটা সায়েন্স ফিকশনের ভাবনা উঁকি দেয়। উঁকি দেয়া ভাবনাটাকে ওর পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অবশেষে কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখা শুরু করে। ঘটনার প্যাঁচকে মাপা যায়, এমন ধাঁচের একটি নামও ঠিক করল। “মিস্ট্রি টায়াঙ্গেল”। লেখার কলম বেশ কয়েক পর্ব দৌড়ে গেলেও হঠাৎ হোঁচট খায়। তারপর লেখা এগোচ্ছে মন্থর গতিতে। যখন বুঝল চট্টগ্রামের আবহাওয়ায় এ লেখা খুব বেশিদূর এগোবে না। তখন সে লেখাটা বন্ধ করে রাখল, অন্য কাজে মনোনিবেশ করল।

একদিন সকালের ট্রেনে সৌরক ঢাকায় ফিরছে। হকারের কাছ থেকে পত্রিকা কিনে, হেড লাইন দেখে চমকে ওঠে। সেখানে লেখা,“লাইভ টিভি অনুষ্ঠানে সোম মজুমদারের রহস্যজনক মৃত্যু”। বিস্তারিত খবরে লিখেছে, সেই সাথে গুরুতর আহত হয়েছেন সিনিয়র টিভি সাংবাদিক মৃদুল হাসান, সোম মজুমদারের বন্ধু অনীল উৎসবসহ আরো কয়েকজন। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেলে জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। পত্রিকার রিপোর্টে মূল ঘটনা এড়িয়ে পরবর্তী পরিস্থিতির প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। দুর্ঘটনার সঠিক কারণও উল্লেখ নেই। ঘটনাটি সৌরককে ভাবিয়ে তুলল।

সোম মজুমদার ছিল একটি অচেনা সাধারণ নাম। তিনি কোনো সুপার স্টার নন। তবু তর্ক-বিতর্কের বদৌলতে তাকে এখন সারাদেশ চেনে। কিছু বিশেষ কারণে চ্যানেল “অনুসন্ধান” সোম মজুমদারকে নিয়ে একটি লাইভ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর উদ্যোক্তা ছিলেন সিনিয়র রিপোর্টার মৃদুল হাসান, সৌরক যাকে মৃদু ভাই বলে ডাকে। অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল ব্যাপক। এক সপ্তাহ আগে থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা শুরু হয়। সৌরকেরও ইচ্ছে ছিল, সরাসরি অনুষ্ঠানটি দেখার। কিন্তু কিছু ব্যস্ততা ও নিয়ন্ত্রিত সময় তা হতে দিলো না।

ঢাকায় ফেরার পরপরই সৌরক বিষয়টি পুরোপুরি জানার চেষ্টা করল। ওর কয়েকজন মিডিয়াকর্মী বন্ধু তাদের ধারণা থেকে বলল, লাইভ অনুষ্ঠানে সোম মজুমদারকে হয়তো পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সৌরক কোথাও সঠিক কোনো সংবাদ পেল না। কেবল ধোঁয়াশা মাখা কিছু তথ্য ওর কানে পৌঁছল।

দুর্ঘটনার পরবর্তী সময় থেকে “অনুসন্ধান” চ্যানেলে ঐ লাইভ অনুষ্ঠানের খ-িত অংশ বার বার স¤প্রচার করা হয় ও শোক জানানো হয়। নিউজে জানায় সোম মজুমদারের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মৃত্যুর কারণ জানানো হবে। তবে ডাক্তার ধারণা করছে, তিনি ব্রেইন স্টোকজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে থাকতে পারেন। এদিকে ঘটনা তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি ইমার্জেন্সি ইনভেস্টিগেশান কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন প্রদান করা হবে।

সেদিন বিকেলেই সৌরক মনোযোগ দিয়ে ভিডিও ক্লিপটা দেখল। মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিটের ভিডিও। সরাসরি স¤প্রচারকৃত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করা হয় শালবনের ভেতর ঐ বাংলো বাড়ি থেকে। যেখানে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত হয়েছিল। দেখেই আন্দাজ করা যায় বাংলোটি বেশ পুরনো। ঘরের ভেতর একদিকে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো কয়েকটা বড় ধরনের আলমারি। ঘরের অন্যপাশে কতগুলো পোড়া কাঠ ও ছাইয়ের স্তুপ। দেয়াল ও ছাদের দিকে ক্যামেরা ধরতেই ফুটে ওঠে পোড়া কালির ছাপচিত্র।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সোম মজুমদার প্রথম দিকে খুব স্বাভাবিকভাবে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। ঘটনার চক্রে চক্রে ওঠে আসছিল, সোম মজুমদারের পিতামহ গণিতবিদ ডক্টর রিয়ন সাহেবের (প্রকৃত নাম আবুল কালাম মজুমদার) ক্রাইটেরিয়ন ফর্মূলা ও বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণের সমীকরণ সমূহ। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে ওঠেন, ও দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরেন। দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল তিনি মাথায় প্রচ- আঘাত পেয়েছেন। মাথা ফেটে রক্তপাত হলো। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন মৃদুল হাসান। তিনি সোম মজুমদারের পাশের চেয়ারে বসা ছিলেন। সোম মজুমদারের চিৎকারের পরপরই মৃদুল হাসান চেয়ার থেকে পড়ে যান। ততক্ষণে সে ঘরে সৃষ্টি হয় প্রলয় কা-। ক্যামেরাটা অনবরত কাঁপতে থাকে। পুরনো বড় বড় আলমারিগুলো একে একে মেঝেতে পড়তে শুরু করে। আলমারি চাপা পড়ে ক্যামেরাটা বিচূর্ণ হয়ে যায়। তারপর স¤প্রচার বন্ধ।

পুরো ঘটনাটি সৌরককে দারুণভাবে ভাবিয়েছে। সিনিয়র রিপোর্টার মৃদু ভাইয়ের জন্য ওর খুব খারাপ লাগছিল। মৃদু ভাইয়ের সাথে ওর সখ্য তৈরি হয় অক্ষিপট সাহিত্য আড্ডা থেকে। তাঁর দরাজ কণ্ঠের আবৃত্তি শুনতে বেশ ভাললাগে। তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও সুচিন্তিত যৌক্তিক সমালোচনা বোধশক্তি সম্পন্ন যে কাউকে অনায়াসে নাড়া দিবে। বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই মানুষটি সৌরককে বরাবরই দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। মৃদুল হাসানও সৌরককে খুব ¯েœহ করতেন।
রাতে সৌরক ওর বন্ধু নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক মৌন মিহিরের সাথে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কথা বলল। মৌন মিহিরও মৃদু ভাইয়ের ঘটনায় খুব বিধ্বস্ত। মৌন জানাল, মৃদু ভাইকে আজ সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল থেকে স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
ওরা দু’জনই ঠিক করল আগামীকাল মৃদুল হাসানকে দেখতে যাবে।

ভোর। সৌরক তখন বিছানায়। ঘুমো স্বপ্নে বিভোর। সে একটি টিভি নাটকের স্ক্রিপ্টে ইডিটিংয়ের লাঙল চালাচ্ছে। ঠিক তখনই মৌনর কল বেজে ওঠে। ইডিটিংয়ের ব্যস্ততায় ছেদ পড়ে। সৌরক চোখ বন্ধ রেখেই কলটা রিসিভ করে।
সৌরক।
বল।
আমি তোর বাসার সামনে। দ্রুত নেমে আয়।
এত সকালেই চলে এলি।
শুনলাম মৃদু ভাইয়ের অবস্থা ভাল নয়। মাথায় সাংঘাতিক আঘাত পেয়েছেন। তাঁকে আজই সিঙ্গাপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সৌরক আর স্থির থাকতে পারল না। শার্ট-প্যান্ট পরে নিচে নেমে, ট্যাক্সিতে মৌনর পাশে বসল। তারপর সোজা স্কয়ার হাসপাতাল।

মৃদুল হাসানকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। তাঁর সিটিস্ক্যান ও এমআরআই রিপোর্ট ভাল নয়। সন্ধ্যার ফ্লাইটে তাঁকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হলো। সৌরক খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সোম মজুমদারের বন্ধু অনীল উৎসব ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি। সৌরক ও মৌন সেখানে ছুটে যায়। দেখে তার পরিস্থিতিও গুরুতর।

ময়না তদন্তে সোম মজুমদারের ব্রেইন স্ট্রোক প্রমাণ হয়নি। লক্ষণ দেখে ধারণা করা হয়, তিনি শ্বাসরুদ্ধ ও মাথায় আঘাত জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মাথায় আঘাতের চিহ্নগুলো খুব অদ্ভুত! এটা আলমারি কিংবা মেঝেতে পড়ে চাপ লাগার মতো আঘাত নয়। কেউ যেন পুরো মাথাকে চারদিক থেকে চাপ দিয়ে প্রায় থেঁতলে দিয়েছে!

অন্যদিকে জরুরি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বের হলো। ঘটনাটিকে অস্বাভাবিক ও আকস্মিক বলে অভিহিত করা হয়। এরূপ ব্যাখ্যাহীন রিপোর্ট দেখে সৌরক খুব অবাক হলো। সৌরক ও মৌন বিষয়টি নিয়ে একটু গভীরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলো। মৌন বলছিল, এখানে কেমন মিথ্যা আর ষড়যন্ত্রমূলক গন্ধ পাচ্ছি।
ওরা দুজনই কয়েকবার ভিডিও ক্লিপটি দেখল। অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারেনি।
মৌন বলল, ভূ-তত্ত্ব অধিদপ্তর জানিয়েছে সেদিন ভূমিকম্পের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাহলে এমন হবে কেন?
নিশ্চয়ই এই ভিডিও ক্লিপের বাইরে রয়েছে কোনো রহস্য ও রোমাঞ্চকর ঘটনা।
আমারও তাই মনে হয় সৌরক।
পাঁচদিন পর সিনিয়র রিপোর্টার মৃদুল হাসানের মৃত্যু সংবাদ শোনা যায়। কষ্টে সৌরকের হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছিল। মৃদু ভাইয়ের ফর্সা রাশভারী মুখটা বার বার ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাঁর দরাজ কণ্ঠের আবৃত্তি ধ্বনিত হয় ওর কানে। সৌরকের দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মৃদু ভাইকে হারানোর ব্যথা কখনোই সে ভুলতে পারবে না।


কালো কু-লী

কিছুদিন পরের কথা। মরহুম সোম মজুমদারের বন্ধু অনীল উৎসব খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠেছেন। কথাও বলতে পারেন। সৌরক ও মৌন ঠিক করল ল্যাবএইড হাসপাতালে যাবে। ওরা অনীল উৎসবের কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনতে চায়। মৃদু ভাইয়ের মৃত্যু কি কোনো দুর্ঘটনা না হত্যাকা-? এই প্রশ্নটাই ওদেরকে বার বার আঘাত করছে।

অনীল উৎসব বললেন, মিডিয়ার সমালোচনা সোমকে মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল করে ফেলে। ও এসব বিতর্ক একদম সহ্য করতে পারেনি। জীবনের প্রতি ওর বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। মৃদু ভাইয়ের সাথে মূল ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা করার পর, উনি সোম ও তার বাবার একটি সাক্ষাতকার নিয়ে রিপোর্ট প্রচার করে। তারপর উনি একটি লাইভ অনুষ্ঠানে সোমের পুরো ঘটনা তুলে ধরার পরিকল্পনা নেন। যেখানে দর্শক ফোনকলের মাধ্যমে প্রশ্ন করতে পারবে, তাদের মতামত দিতে পারবে। মৃদু ভাইয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী শালবনের ঐ বাংলো বাড়িটিকে ভ্যেনু করে সরাসরি অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, খুব সুন্দরভাবে লাইভ অনুষ্ঠান স¤প্রচার শুরু হয়। আমরা ক্যামেরার পেছনে ছিলাম। লাইভ অনুষ্ঠানটা কিভাবে প্রচার হচ্ছে তা মৃদু ভাইয়ের নির্দেশে অনলাইনে চেক করেও দেখছিলাম।
হঠাৎ পোড়া গন্ধ নাকে আসে। সেই সাথে ঘরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। আমি সোমের পিছনে একটি ছাই রঙের শেপ দেখতে পাই। এটি অন্য কেউ দেখেছে কিনা জানি না, ভিডিওতে সে শেপ এসেছে কিনা তাও জানি না। তৎক্ষণাৎ সোম ওর মাথা দু’হাতে চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে। মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি আলমারিগুলো ঠেলে আমাদের উপর ফেলে দিচ্ছে। একটি আলমারি সোম ও মৃদু ভাইয়ের উপর পড়ে। পরের মুহূর্তে আরেকটি আলমারি ক্যামেরাম্যান জাহিদ ভাইয়ের উপর পড়ে। আমি তার সাথেই ছিলাম, আমিও আঘাত পাই, সেই সাথে ক্যামেরাটা আলমারির তলায় চাপা পড়ে স¤প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। তখনও আমার জ্ঞান আছে। দেখতে পাই সোম ছটফট করছে, একটি নারীর ছায়া বার বার ওর কাছে আসছে। যদিও সেখানে কোনো মহিলা ছিল না। ছায়াটা যখন কাছে আসছে, তখন সে স্বস্তি পাচ্ছে। ছাই রঙের শেপটি সে ছায়াকে দূরে ঠেলে সোমের মাথা ও গলার চারপাশ ঘিরে চেপে ধরে। তখন সে শেপটিকে কালো কু-লি মনে হচ্ছিল। এক সময় দেখতে পাই সোম নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। ওর ছটফট চিরতরে সান্ত হয়ে যায়। তারপরেই ছাই রঙের স্যাপটি একে একে সবার ওপর হামলে পড়ে। তখন সে নারী ছায়াটি দূরে সরে যায়। আমাকে যখন আক্রমণ করে তখন মাথায় প্রচ- চাপ অনুভূত হয়। একমুহূর্ত পরেই জ্ঞান হারাই।

ওরা দু’জন অবাক হয়ে ঘটনাটি শুনল। বিশ্বাস অবিশ্বাস ওরা কিছুই জানে না। তবে এই অস্বাভাবিক ঘটনা সৌরক কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।
সে বলল, উৎসব ভাই, আমি আপনাকে অনুরোধ করব, মূল ঘটনাটি খুলে বলার জন্য। ভৌতিক, অদ্ভুত বা অসংজ্ঞায়িত কোনো কিছু আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনীল উৎসব বললেন, সৌরক ভাই, এরূপ ঘটনা বিশ্বাস না করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ব্যাখ্যাহীনতার পেছনে কী কারণ লুকিয়ে আছে তা আপনাদের জানা উচিত।
মৌন বলল, আপনি নির্ভয়ে বলুন। আমরা সবকিছু শুনব।
অনীল উৎসব বলে ওঠলেন, কিছু ঘটনার ব্যাখ্যাহীন দ্বন্দ্বে আমিও ভুগছি। সোম বেশ কিছুদিন আগে ঐ বাংলো বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করে। বলা যায়, অনেকটা বিলাসী ভাবনা থেকে ওর বনে বাস করা। শালবনের ভেতর বাংলো বাড়িটি ওর দাদাজানের রেখে যাওয়া একমাত্র সম্পত্তি। সোম, সেখানে থাকাকালীন বহু অস্বাভাবিক ঘটনার মুখোমুখি হয়। যা কেবল সে জানে, আমার কাছে কিছুটা শেয়ার করলেও, তা আমি অবিশ্বাসের হাসিতে ছুঁড়ে দিয়েছি। ওর কাছে জানতে পারি এই অস্বাভাবিকতার যোগসূত্র রয়েছে শালবন অগ্নিকা-ের পেছনে। সোমকে যখন সবাই ঘৃণা করছিল, তখন সে পুরো ঘটনা লেখার সিদ্ধান্ত নেয়। লেখার কথা আমাকে সে অনেকবার জানিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, অগ্নিকা-ের ঘটনাটা লেখা সম্পন্ন হলে, সোমের বই প্রকাশ করব। পাগল মিডিয়ার ও হুজুগে মানুষদের ভুলগুলো শোধরানো খুব প্রয়োজন। ও মৃত্যুর আগের দিন অনুরোধ করে বলেছিল, লেখাগুলো যেন ওর মৃত্যুর পর প্রকাশ পায়। অর্থাৎ বইটি আত্মজীবনী হিসেবে গৃহীত হোক তাই সে চেয়েছিল। কে জানত, তার পরদিনই এ ঘটনা ঘটবে। এভাবে ওর মৃত্যু হবে।
বলতে বলতে অনীল উৎসব আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন।
সৌরক বলল, একটু শান্ত হউন। আমরা পুরো বিষয়টা জানতে চাই।
মৌন বলল, সোম মজুমদারের লেখাগুলো কোথায় আছে? সেগুলো কি আমরা পড়তে পারি?
লেখাগুলো সোমদের বাসায় থাকতে পারে। ওর বাবার সাথে যোগাযোগ করলে এ ব্যাপারে জানা যাবে।
সৌরক বলল, এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
অনীল উৎসব বললেন, সৌরক ভাই, আমার নিজস্ব কোনো ধারণা নেই। আমি বাস্তবিকভাবে হতভম্ভ! তবে এ ঘটনার সাথে সোমের দাদাজানের একটি সম্পর্ক রয়েছে। সোম বলেছিল তাঁর দাদাজান গণিতবিদ ড. রিয়ন মজুমদার বহুমাত্রিক জগত ভ্রমণের সূত্র আবিষ্কার করেন। সে সূত্রটির পেছনে ভিন্ন মাত্রিক জগতের শত্রু হানা দিতে থাকে। সোমের কথাকে আমি পাত্তা দেইনি। আসলে সে সময় কথাগুলো শুনতে চাইনি। কিন্তু এ হত্যাকা-ের পর, আমার ধারণা চতুর্মাত্রিক জগতের কোনো এক আগুন্তুক এই ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে।

আত্মজীবনীর সন্ধান

অনীল উৎসব সুস্থ হয়ে ওঠলেন। একদিন সৌরক ও মৌনকে তিনি সোমদের বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানে ওরা সোমের বাবা বৃদ্ধ ফারদিন মজুমদারের সাথে সাক্ষাত করে। অনীল উৎসবের মুখে পুত্রহারা পিতা যখন শুনলল, ওরা সোম সম্পর্কে জানতে এসেছে। তখন তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তবে তিনি ঐ বাংলো বাড়ি ও ড. রিয়ন মজুমদার সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারলেন না। বললেন, ড. রিয়ন সাহেব, আমার পিতা হলেও, তাঁর সাথে আমাদের তেমন যোগাযোগ ছিলো না। রিয়ন সাহেব ঐ বাংলো বাড়িতে বাস করতেন, টিভি নিউজের মাধ্যমে সর্বপ্রথম আমরা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারি।
মৌন বলল, সোম মজুমদারের আত্মজীবনীটি আমরা পড়তে ইচ্ছুক।
বৃদ্ধ বললেন, আমি তো সে সম্পর্কে কিছুই জানি না, বাবা।

অতঃপর অনীল উৎসব বললেন, চাচা, আমি দেখেছি সোম চকলেট রঙের একটি খাতায় ওর আত্মজীবনী এবং অগ্নিকা-ের ঘটনা সম্পর্কে কিছু লিখছিল। ওর লেখা শেষ হয়েছে, তাও বলেছে। আপনি অনুমতি দিলে, সোমের ঘরে খুঁজে দেখব।
ঠিক আছে, যাও দেখো।
ফারদিন মজুমদার অনুমতি দেবার পর ওরা সে ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকেই অনীল উৎসব দৌড়ে টেবিলের উপর থেকে চকলেট রঙের খাতাটি হাতে নিলেন।

সৌরক ও মৌন লেখাগুলো দেখল।
মৌন বলল, আমরা লেখাটা পড়তে চাই। অনুমতি দিলে নেব।
অনীল উৎসব সোমের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ফটোকপি করে উনাদের একটি কপি দেই।
ফারদিন মজুমদার সায় দিতেই, অনীল উৎসব বেরিয়ে গেলেন। এদিকে একজন কাজের লোক অতিথি সমাদরের আয়োজন স্বরূপ চা নাস্তা পরিবেশন করল।

ওরা ফিরে আসার আগে ফারদিন মজুমদার বললেন, শোনো বাবা, আমার ছেলে এক সময় মানসিকভাবে অসুস্থ থাকলেও, বিগত পাঁচ ধরে সে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। দয়া করে আমার ছেলেকে পাগল ভেব না, প্লিজ।
মৌন বলল, না, আঙ্কেল। আমরা জাস্ট লেখাটা পড়ব। মিডিয়ার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।

চলে আসার আগে সৌরক পাশের কক্ষে উঁকি দিয়ে সোম মজুমদারের মাকে দেখল। উনি প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যায়।
ফারদিন মজুমদার বললেন, অনেক বছর হয়েছে বিছানায়। ছেলের মৃত্যুর সংবাদ জানাইনি। কিছু বুঝতে পেরেছে কিনা জানি না, বেশ কদিন ধরে কথা বলা বন্ধ। আগে অল্প অল্প কথা বলত, এখন তাও বলে না। বলতে বলতে বৃদ্ধ কেঁদে ফেললেন।

ফেরার সময় বাইরে বেরিয়ে অনীল উৎসব দু’জনকে বললেন, আপনারা লেখক মানুষ। সোমের এই ইচ্ছেটা পূরণ করবেন তো? খরচটা না হয় আমিই বহন করব। আপনারা চেষ্টা করলে..।
সৌরক বলল, কথা দিলাম ভাই। ভাল প্রকাশনী থেকে বইটা প্রকাশ পাবে। উনার মৃত্যুর অংশটাও ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

পা-ুলিপির পৃষ্ঠা

তখন সন্ধ্যা। সৌরক ও মৌন ধানম-ি লেকের পাড়ে বসে আছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ওরা সোম মজুমদারের বাবাকে নিয়ে কথা বলছিল।
সৌরক বলল, লোকটার জন্য ভীষণ মায়া হয়। একমাত্র সন্তানকে হারাল, ঘরে স্ত্রীটাও মৃত্যু পথযাত্রী। উনার অবস্থাও একইরকম।
মৌন একটা নিশ্বাস ফেলল।
হ্যাঁ, শীঘ্রই তাঁর বেঁচে থাকার সাথে যোগ হবে একাকিত্ব!
পা-ুলিপিটা ভালভাবে পড়তে হবে। ভেতরের ঘটনাটা জানার পর হয়তো কিছু বুঝতে পারব।
মৌন অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলল, সৌরক শোন, পা-ুলিপিটা আমি আগে পড়ব। ওটার প্রতি প্রথম থেকেই আমার আগ্রহ।
শোন, আজ ওটা না পড়লে আমার ঘুমও হবে না, ক্ষুধাও মিটবে না। তাছাড়া এই ভূতটা মাথা থেকে দূর করতে না পারলে, নতুন লেখাটাতে গতি আনা, ইম্পসিবল হয়ে পড়বে।
কী লিখছিসরে?
সে তেমন কিছু না, চিটাগং গিয়ে শুরু করেছিলাম “মিস্ট্রি টায়াঙ্গেল” সায়েন্স ফিকশন।
মৌন হাসল। ঠিক আছে। পা-ুলিপিটা তুই-ই পড়। তবে সময় সীমিত।
থ্যাংকস মৌন। তোর নতুন কোনো নাটক লেখা হয়েছে?
না। তবে লিখব ভাবছি। সোম মজুমদার ও মৃদু ভাইয়ের ঘটনা নিয়ে।

গল্প আড্ডা ও খুনসুটি শেষে রাত ন’টার দিকে সৌরক বাসায় ফিরে এল। মধ্যরাতে সে সোম মজুমদারের পা-ুলিপিটা পড়া শুরু করল। না, মিডিয়া সোম মজুমদারকে পাগল বলুক আর যাই বলুক, তাঁর হাতের লেখা বেশ স্পষ্ট ও সুন্দর! ভাষাটাও সাবলীল। পড়তে গিয়ে বিরক্ত হবার সুযোগ নেই।

সৌরক লেখাটা একটানা পড়ে যাচ্ছে। উল্টাচ্ছে পা-ুলিপির একের পর এক পৃষ্ঠা।
[চলবে...]