অক্ষরমালা : দ্বীপ সরকার

অক্ষরমালা :  দ্বীপ সরকার


অক্ষরমালা
দ্বীপ সরকার

আরশিনগর


মূর্তি এবং ছায়া - বিশ্বাসের প্রাচীন সহদোর ,
মানুষের ভেতর এই সব আজগুবি বিশ্বাস আছে

মনে আছে, আমার এক হাতে আগুণের ছুরি
প্রাচীন কাবা'র ভেতর ঢুকে পরাস্ত করেছিলাম কাল্পনিক ঈশ্বরকেÑ

ছুরির আঘাতে মূর্তিরা ঈশ্বরের দাবী থেকে পালাতে লাগলে
কেউ কেউ লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে
বিধবা হলো ছায়াবাদ ও মূর্তিবাদের অপব্যাখাÑ
অতঃপর কাল্পনিক ঈশ্বর নাক সিটকাতে লাগলেন

এর বহু বছর পরে ,
আমার গুরুজি উপদেশ দিলেছিলেন এই বলে যে
“একদিন মানুষ ঈশ্বরকে নিজের ভেতর দেখবে
এবং ভেবে নেবে নিজেকেই আরশিনগর”



ডুডল


দীর্ঘ বিরতির পর এই দেখলামÑ
তোমার বয়সের ছাপ এসে গেছেÑ
চোখের নিচে সমস্ত চিন্তার কালো কালো বোধ,

আসলে কতোটা ভালো আছো তুমি?

মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমার গভীরতা,
তোমার এই বেঁচে থাকা দেখেÑ

ডুডল এভাবেই আবির্ভূত হয় বিশেষ বিশেষ মহুর্তে
গুগলের কপালে অদ্ভূদ সুন্দর টিকলীকাটা ছবি তার।


বুদবুদ

একটা গভীরতা ছুঁয়েই দুঃখসমূহ বুদবুদ করেÑ

এই বুদবুদের নিকটে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম
আর কতো তাপিত হয়ে ভাতের নির্যাস মুখস্থ্য করবি ?
গন্ডমূর্খের মতো দাউ দাউ সেজে বিচক্ষণ উপলব্ধিকে সেঁক দিবি কতো ?

আমার এই প্রশ্নের উত্তর ভাতের  ফোঁড়সমূহ দিতে পারেনি Ñ
তবে উনুনে চসা তহমিনা খাতুন  উত্তর দিয়েছিলেন

“পাখিরা যেমন বনে সুন্দর Ñ কষ্টেরা বুদবুদে”



সাউন্ড অব স্কাই

ঢুকে যাচ্ছি শীতের খামে,সাথে কিছু কুয়াশাপথÑ
নির্জনতার  বাঁকে কিছু অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে জেনেও আমি ছুটছি সিধে পথেÑ

কিছু কম্পমান দাঁড়কাক উঁকি দিচ্ছে আকাশে
বাঁধাকপির খোপে পড়ে আছে সরল কুয়াশাÑ
মৌনতাকে ছিঁড়ে আঁকড়ে ধরে আছে হিমবাতাস ;
আমি তবুও হাঁটছি কুয়াশার চাতাল চিড়ে,কর্মযজ্ঞে
কম্পমান দাঁড়কাক আর আমি উঁকি দিচ্ছি আকাশে
হীম ছেঁকে ছেঁকে চুইয়ে নামছে বরফের সাম্পান
২.৬ সেলসিয়াস তাপে কুঁকড়ানো বৃদ্ধটিকে দেখছে চেয়ে চেয়ে মানবতাহীন এই আকাশ

এই একঘেঁয়েমি বিরুদ্ধাচার  কেনো? সহনশীল হলে ক্ষতি কি হে দাপুটে আকাশ ?
একটু নিরোপেক্ষ হতে শেখোÑ



থিসিস


জট বাঁধিয়েদের দেখতে খারাপ লাগে
কিন্তু ওদের জটের ভেতর যাদু বুনন আছে;
পরাবাস্তব আছে এবং যোজন দূরের কাল্পনিক শহর আছে
ওদের জট খুললে হীরের ঝলক পাওয়া যায়
নাভীর নীচে লম্বাটে খেকশিয়ালের মোচও

বৃত্তান্তের ভেতর যেতে ভয়ানক নিষেধ, ওরা বলেÑ
শত শত গোপন কপাট খুলে বেরোয় যদি?
তাই প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসিÑ ফল ফুলের গল্প বলি

এসো প্রকৃতি চেনার গল্প বলি Ñ প্রকৃতি চিনলে মানুষ চেনা যায়
সবুজ চিনলে মানুষের অন্তর চেনা যায়

এবার জট বাঁধিয়েদের না চেনার ভান করি চলোÑ


গয়নাকুড়ি,গোহাইল
শাজাহানপুর,বগুড়া

অক্ষরমালা : মাজেদুল হক

অক্ষরমালা : মাজেদুল হক


অক্ষরমালা
মাজেদুল হক

অপ্রাসঙ্গিক চাওয়া-পাওয়া

অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়
থেকে যায় কাগজের ভাঁজে ভাঁজে
কিংবা পাটাতনের নিচে
কিছু অপ্রাসঙ্গিক বোধহীন চাওয়া-পাওয়া।

হয়তো এমন করেই কেটে যাবে দিন-ক্ষণ-সময়
লালিত্য মাখানো সোঁদা গন্ধ গায়ে মাখিয়ে
বিন্দু বিন্দু করে গড়ে তুলবো অনাবাদী দু:খের বসতি।

কষ্টের ফাঁক গলে গলে উঁকি দিয়ে যাবে পরম্পরা
তমসার শৈল্পিক ছায়া।


অর্ধমৃত ভাবনার জলোচ্ছ্বাস

চার দেওয়ালের সেলে আটকে থাকা নিজের বৈভব
অসহিষ্ণুতার সমস্ত গ্লানি কপোল বেয়ে
          প্লাবিত হয় অর্ধমৃত মনের উঠোনে।
                     

প্রাত্যহিক বিত্ত, প্রাচুর্যের অহঙ্কার, নির্বোধ, নিলর্জ্জ
উঠকো ঝামেলাগুলোর শেকড় ছড়িয়ে গেছে
             ভূবনডাঙ্গার করকমূলে।

প্রাণোচ্ছ্বল মনের ভেতরকার
ওয়ারড্রোব এর অবকাঠামোগুলো ভষ্মিভূত, বিকারগ্রস্থ
ঘুণ পোকার রাজত্বে সয়লাব।
ক্লান্ত-শ্রান্ত, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে অনুসৃত ভাবনার
অথৈই জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যাচ্ছি।



অস্তিত্বের কারসাজি

দু’চোখের জল আর বুকের গভীরের চাপা আত্মনাদ
লুকিয়ে রাখার অভিনয় করাটা বড় ট্রাজেডি।
তারপরও মূল কাহিনী, দৃশ্যের প্রেক্ষাপটের কাঁধে ভর করে
চোখ-মুখ বুজে ঘোড়া গাড়ীর মতো কর্কিয়ে কর্কিয়ে পথ চলি
কোন এক সময় মস্তিষ্কের ভেতর শুরু হয় হাঁতুর পেটানো শব্দ।
           তখন ভুলের মধ্যে দিয়ে একাকী পথ চলি।
   
       নিজেকে ভাসমান খড় কুটোর মতো মনে হয়
       নিজেকে রক্ত মাংসের মানব ভাবতে পারি না
       নিজেকে সঁপে দেই দুঃখ নদীর অগাধ জলে
       নিজেকে প্রতিটি ক্ষণ অগোছালো মনে হয়
       নিজেকে নিজের মতো আর ভাবতে পারিনা
       নিজেকে নিজের আয়নায় দেখতে করুণা হয়
       নিজেকে সঁপে দেই দুঃখ নদীর অগাধ জলে
       নিজেকে নিজের অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ করি
       নিজেকে নিঃশেষ করে দেবার মন্ত্র পড়ি।





অবরুদ্ধসময়ের ব্যাকরণ

কংক্রিটের বিবর্ণ দেয়ালে পেরেকবিদ্ধ মানবতার
বিলবোর্ডে ঝুলে আছে বিমূর্ত ভাবনা।
ভাবনার নৈতিকতার বাঁধন ছিঁড়ে বেদনার্ত হয়ে
           দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে নিদাঘ চিতায়
                     অবরুদ্ধ সময়ের ব্যাকরণ।

অবসাদ, সংবেদনশীলতার মধ্যে জিঁইয়ে থাকা
বোধের পাঁজরে এঁটে থাকে মিহি ধূলোর আস্তরণ।

ক্লান্তিহীন, ঘুমহীন রাত্রির চৈতন্যে টোকা দিয়ে
ঘেটে যাই ভগ্নাকৃত হৃদয়ের গভীরতা।
প্রচ্ছন্ন নীরবতার রকমারী পসরা সাজিয়ে
বানের জলের মতো ভেসে যাই অজানা গন্তব্যে।


অক্ষরমালা : যাহিদ সুবহান

অক্ষরমালা : যাহিদ সুবহান



অক্ষরমালা
যাহিদ সুবহান

ভাঙা হৃদয় কিংবা নিভৃত স্টেশন

মফস্বলের এই স্টেশনটাতে প্রতিদিন
পাঁজরের হাড়ের মত স্লিপার বেয়ে
নিয়ম করে ট্রেন আসে হৃদপিন্ড ছুঁয়ে
আবার চলে গেলে ট্রেন সময় হলে
যেন গ্রামের সরল কুমারীর মত
একদম ফাঁকা পড়ে থাকে প্লাটফর্ম
গ্রামের সরল কুমারীর মত প্লাটফর্ম
চলে যাওয়ার পর কেউ আর কখনো
খোঁজ রাখেনা এই ফাঁকা প্লাটফর্মটার
হৃদয়টাও যেন স্টেশনটার মতই
যেন একা পড়ে থাকে জীবনের প্লাটফর্ম
ভাঙা হৃদয় আর নিভৃত স্টেশন ...  


পথশিশুর মুখ যেন ঈশ্বরের

চৈত্রের ঝড়াপাতার মত প্রতিদিন
ওদের স্বপ্নকে পদদলিত করে
আমাদের সভ্যতার পা
ওদের অপ্রকাশিত গল্পগুলো চিরদিন
অপ্রকাশিতই থেকে যায়
আমাদের এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে
ওই যে পথশিশু-টোকাই-ফুল বিক্রেতা
ওদের চোখগুলো যেন ঈশ্বরের চোখ
ওদের হাতগুলো যেন ঈশ্বরের হাত
ওদের মুখগুলো যেন ঈশ্বরের মুখ
অথচ ওরাই যেন ধুলা ঈশ্বরের পৃথিবীতে
ওদের অপ্রকাশিত প্রশ্নদৃষ্টির উত্তর দিতে পারে না
আমাদের সভ্যতার চকচকে মুখ...


বাউথনামা দিন

আহা স্মৃতি আমাদের, হাসিমাখা স্মৃতি!
বাতায়ন খুললেই যেন সন্ধ্যার জোনাকি
উল্লাসে মেতে উঠি আমরা পূণরায়
আহা আমাদের অনুরণনের জীবন
বার বার ফিরে পাই সেই পুরোনো পথ
স্মৃতির কাদা ঠেলে ঠেলে আমাদের
ফিরে আসে বারবার এই জীবনে
রুপালি রঙের বাউথনামা দিন...   

যাহিদ সুবহান, পাবনা।

অনিকেত নন্দনে

অনিকেত নন্দনে



অনিকেত নন্দনে
আহাদ আদনান

মাঝরাত, ঘুমিয়ে আছি মরার মত। জন্মদিনের সারাটা সন্ধ্যা হৈচৈ শেষে গা এলিয়ে দিয়েছি বিছানায়। হঠাৎ গন্ধে ঘুম ভেঙে যায়। একটা ফুলের গন্ধ। নাকি কোন পারফিউম? কেও ঢুকেছে ঘরে? খুব মিহি আর মিষ্টি, কিন্তু একেবারে অপরিচিত গন্ধটা আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে। ঘরে নানা রকম উপহার। সবচেয়ে সুন্দর উপহার ছিল কিছু শোপিস। শুধুমাত্র কাগজের তৈরি শোপিস। পাশের ফ্ল্যাটে নতুন আসা ছেলেটার হাতে বানানো শোপিস। কাগজের ফুল থেকে আসা গন্ধ  ঘুম থেকে জাগিয়ে সারারাত ঘোরের মধ্যে একটা ভালোলাগা অনুভূতি জড়িয়ে অবাক করে দিতে পারে, আগে বুঝিনি।
‘এই, আপনার কাগজে কোন পারফিউম ব্যাবহার করেন’?
‘নাহ। কেন বলুনতো, সুমি’?
‘কাগজ দিয়ে এত কিছু বানানো যায় জানতাম না। আমাকে শেখাবেন’?
বিকেল বেলা। ছাদে আমরা দুজন। ছেলেটার হাত ভরতি কাগজ। আমি শ্বাস নিচ্ছি টেনে টেনে। কোন গন্ধতো পাচ্ছি না। আঙ্গুলের কারসাজিতে কাগজ ধীরে ধীরে ফুল হতে থাকে। ফুলটা আমার চেনা মনে হচ্ছেনা। আর তখনই সেই গন্ধ। মিহি, মিষ্টি কিন্তু অচেনা। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকে ফুলের দিকে, আঙ্গুলের দিকে। তারপর চোখের দিকে।
‘তুমি গন্ধটা পাচ্ছ না’?
আমি খেয়াল করার আগেই ‘আপনি’ ‘তুমি’ হয়ে গেছে।
ছেলেটা কিছু না বলে মুচকি হেসে উঠে যায়।
‘এই তুমি বললে না, এটা কিসের গন্ধ? এটা কি ফুল’?
‘রডোডেনড্রোন’।
দিন যায়, আর আমি রডোডেনড্রোনের নন্দনে হারাতে থাকি। ঘর, পড়ালেখা, চলাফেরা, ভালোলাগা, অভিমান সেই অবাক গন্ধে ভাসতে থাকে। সেই ফুলগুলো আমার ষষ্ঠ মৌলিক চাহিদা। বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে যাবে, এই ফুল ছাড়া।
কয়েকমাস পরের কথা। আমাদের বিয়ে ঠিক, এমন একসময় একটা দুর্ঘটনা সব তছনছ করে দেয়। ছেলেটা তখন না ফেরার দেশে। আমার ঘুম নেই, খাওয়া দাওয়া নেই। শুকিয়ে আমসত্ত্ব হয়ে গেছি। আমি, অথবা আমরা, গর্ভে আরেকজন নিয়ে তো ‘আমি’ ‘আমরা’ হয়ে গেছি, কি মারা যাচ্ছি?
যখন জ্ঞান আসে দেখি আমি একটা অপারেশন টেবিলে। আমাকে বাঁচানোর জন্য নাকি আমার ভেতরের মৃত আরেকটা আত্মজা বের করতে হচ্ছে। ট্রেতে একটা দলা পাকানো কি যেন রাখলেন চিকিৎসক।
‘মা মনে হয় বেঁচে যাবে। সিস্টার, একটা গন্ধ পাচ্ছেন? ওটি’তে ফুল আনলো কে দেখুনতো’?
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমার চোখে জল এসে যায়। বাকিটা জীবন আমাকে এই রডোডেনড্রোনের গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে হবে হয়ত।
মাতুয়াইল, ঢাকা।

উদ্ভাবিত ‘বর্ণালী কবিতা’র কবি

উদ্ভাবিত ‘বর্ণালী কবিতা’র কবি



উদ্ভাবিত ‘বর্ণালী কবিতা’র কবি
লতিফ মাহমুদ
মোহাম্মদ অংকন

ভূমিকা
কবিতা সাহিত্যের প্রধানতম শাখা। যিনি কবিতা লিখেন, তিনি কবি। কবিতা লেখার নানা ধাচ বা ধারারয়েছে। কবিতায় কবিদের নিজস্ব ভাষা থাকে। আমরা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়লেই বুঝতে পারি যে এটা কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন। তেমনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা, আল মাহমুদের কবিতা ইত্যাদি। মাইকেল মধুসূধন দত্তের সনেট পড়লে উপলব্ধি করা যায়, কবিতা ও ভাষার বৈচিত্রতার সম্বনয়ে গঠিত এ যেন ভিন্নমাত্রার কবিতা। এসব কবিতা এখন ‘কবিতার ফরম্যাট’। সকল কবির ‘কবিতার ফরম্যাট’ নেই। গতানুগতিক ধাচের কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন অসংখ্য কবি। প্রচলিত  ধাচের বাহিরে কবিতা লেখার কাজ করেছেন,নানা তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন ও নিজস্ব নিয়মে বিশেষ ধরনের কবিতার উদ্ভাবন করেছেন এমনই একজন হলেন চলনবিল অধ্যূষিত এলাকা সিংড়ার লতিফ মাহমুদ।লতিফ মাহমুদ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন বগুড়া ও ঢাকায়। ৫৯ বছর বয়সী লতিফ মাহমুদের বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলার চামারি ইউনিয়নের বিলদহর গ্রামে। তিনি এখন কালীনগর গ্রামে বাস করেন। সংস্কৃতিমনা লতিফ মাহমুদের সংস্কৃতির পথে চলার একটা সময় খেয়াল হল, কবিতার নতুন ধারা তৈরি করার। কবি হিসাবে পরিচিত লতিফ মাহমুদ নিজস্ব ভাবনায় আবিষ্কার করলেন এক বিশেষ ধারার কবিতা। নামকরণ করলেন,‘বর্ণালীকবিতা’। তিনি দাবি করেন, এই উদ্ভাবন বা লেখার ধরন আগে কেউ বের করেননি। সেই হিসেবে তিনি বর্ণালির কতিার ‘জনক’ দাবি করেন।তাঁর প্রত্যাশা, কবিতার এই নতুন ধারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়–ক, ব্যাপক গবেষণা হোক, গ্রন্থাকারে প্রকাশ হোক এবং অন্যান্য কবিরা যেন তা আয়ত্ত্ব করে।

বর্ণালী কবিতা কী?
কবিতা রচনায় প্রথম চরণ থেকে শেষ চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ স্বরবর্ণ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে চরণ শুরু করে ও প্রথম থেকে শেষ চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ বর্ণালী বান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে রচিত কবিতাকে ‘বর্ণালী কবিতা’ বলা হয়। বর্ণমালার প্রকারভেদ হিসেবে বাংলা বর্ণমালা পঞ্চাশটি। বর্ণগুলো দুই ভাগে বিভক্ত।(১) স্বরবর্ণ: এগারটি, (২) ব্যঞ্জনবর্ণ: উনচল্লিশটি।

বর্ণালী কবিতায় বর্ণকে আবার দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। (১) বর্ণালী বান্ধব বর্ণ, (২) উপবান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ। বর্ণালী বান্ধব বর্ণগুলো হল- অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ। অর্থাৎবাংলা বর্ণের এগারটি স্বরবর্ণই ‘বর্ণালী বান্ধব স্বরবর্ণ’। অপরদিকে, ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, স, হ এই ঊনত্রিশটি ব্যঞ্জণবর্ণ হল‘বর্ণালী বান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ’। এগারটি স্বরবর্ণ ও উনত্রিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ, মোট চল্লিশটি বর্ণকে একত্রে‘বর্ণালী বান্ধব’ বর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

‘বর্ণালী বান্ধব’ চল্লিশটি বর্ণ ব্যতিত বাকি দশটি বর্ণকে ‘উপবান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলা ব্যাকরণ মতে, ঙ, ঞ, ণ অনুনাসিক বর্ণ; ড়, ঢ়, দন্তমূলীয় বর্ণ; য় দন্তৌষ্টব্য বর্ণ; ৎ, ং, ঃ, ঁ পরাশ্রয়ী বর্ণ। এই বর্ণগুলোর বৈশিষ্ট্য- এরা কখনও শব্দের প্রথমে বসে না এবং শব্দের প্রথমে আছে এমন শব্দ নেই। আবার এসব বর্ণ ছাড়া শব্দ গঠন করা যায়না অনেক সময়। তাই ঙ, ঞ, ণ, ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং, ঃ এই দশটি বর্ণকে ‘উপবান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ’ বলা হয়।

বর্ণালী কবিতার প্রকারভেদ
লতিফ মাহমুদ তাঁর উদ্ভাবিত ‘বর্ণালী কবিতা’কে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন এবং নিজস্বভাবে নামকরণ করেছেন। যথা- (১) স্বর্ণা, (২) বর্ণা, (৩) শ্রাবণী। এসব কবিতার রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও লিখন পদ্ধতি।

কবিতার প্রত্যেক চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ স্বরবর্ণ-অ, আ, ই, ঈ, উ. ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ বর্ণালী বান্ধব স্বরবর্ণ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে রচিতএগার চরণের কবিতা হল‘স্বর্ণা কবিতা’।কবিতার প্রত্যেক চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ- ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, ষ, স, হ বর্ণালী বান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে উনত্রিশ চরণের কবিতা     ‘বর্ণা কবিতা’। কবিতার প্রত্যেক চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণ স্বরবর্ণ- অ, আ, ই, ঈ, উ. ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে শেষ হওয়ার পর প্রথম চরণ থেকে শেষ চরণের প্রথম শব্দের প্রথম বর্ণালী বান্ধব ব্যঞ্জনবর্ণ ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, ষ, স, হ আছে এমন শব্দ চয়ণ করে চল্লিশ চরণের কবিতা ‘শ্রাবণী কবিতা’।বিষয় আঙ্গিকে সহসাধ্য মনে হলেও এমন মিলবিন্যাস নিয়ে কবিতা লেখা বড়ই কষ্টকর। কষ্টের পথ পরিহার করতে কবিরা এসব পথে হাটেননি বলে হয়ত অদ্যাবধি এভাবে কেউই কবিতা লেখেননি।

‘বর্ণালী কবিতা’র প্রয়োগ

একাদশ চরণের- ‘স্বর্ণা কবিতা’
‘রাজনীতিবিদ’

অ-    অল্পে তুষ্ট, কর্মে সুষ্ঠ,
আ-আদর্শ-রাগ, অনুরাগপুষ্ট।
ই-    ইতিবৃত্ত মুখস্থ, আম জনতার,
ঈ-    ঈশ্বর ভীরু, নয় কারও গুরু,
উ-    উগ্রমূর্তি হয়না কভু।
ঊ-    উর্বর মস্তিস্ক, বাচ-বিচার সুক্ষ,
ঋ-    ঋষিতুল্য স্বভাব, প্রশ্নের জবাব,
এ-    একত্বের করে না প্রকাশ বিকাশ।

ঐ-    ঐকান্তিক আগ্রহে গণকথা শুনে,
ও-    ওষ্ঠের হাসি, মিলায়না ক্ষণে।
ঔ-    ঔপপত্তিকভাবে রাজনীতিবিদ গণনে।

ঊনত্রিশ চরণের ‘বর্ণা কবিতা’
‘ফেলে আসা দিনগুলি’

ক-    কানাকুয়া ধরতে গেছি, মাকে দিয়ে ফাঁকি,       
খ-    খুঁজে পায়নি মা আমায়, করেছে ডাকাডাকি।

গ-    গরু, ছাগল চড়িয়েছি, কৃষাণ সাজন সেজে,
ঘ-    ঘুঘু ধরতে ঘুরেছি, ঝোপ-ঝাড়ের মাঝে।

চ-চলনবিলে মাছ ধরেছি, জাল, পলো দিয়ে,
ছ-ছোট বড়ো যত মাছ, আনতে পারিনি বয়ে।

জ-জাম পেরেছি গাছে চড়ে, খেয়েছি পেট পুরে,
ঝ-ঝড়ের দিনে আম কুড়িয়ে, এনেছি ডালা ভরে।

ট-টক খেয়েছি চটকিয়ে, লবন মরিচ দিয়ে,
ঠ-ঠাট্টা করে বলতো দাদী, খাসনে গপ-গপিয়ে।

ড-ডাক পড়েছে লেখাপড়ার, সকাল সন্ধ্যা বেলা,
ঢ-ঢং ঢং বাজলে ঘন্টা, ইস্কুলের পথে চলা।

ত-তাল পাতাতে লিখেছি, কঞ্চির কলম দিয়ে,
থ-থইথই আনন্দ পেয়েছি, মা-বাবাকে দেখিয়ে।

দ-দুষ্টুমি করেছি কত, হয়না বলে শেষ,
ধ-    ধমক দিত পিতামাতা, তবু কাটেনি রেশ।

ন-    নাটোরকে লাটোর বলা, তরকারীকে বেসতি,
প-    পান খেয়ে মুখ রাঙিয়ে, করেছি কতো ফুর্তি।

ফ-    ফন্দিফিকির কাকে বলে, জানিনি তার ধরণ,
ব-    বাবার কাছে জানতে চেয়েছি, কিবা তার গড়ন,
ভ-    ভূতের ভয় কেন করে, একা থাকি যখন,
ম-    মধু খেতে চাক ভেংগেছি, মউয়ালের মতন।

য-    যাদু দেখে চেয়েছি হতে, যাদুবিদ্যা জানতা,
র-    রাক্ষসের গল্প শুনে, মুখটা হয়েছে নোনতা।

ল-    লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখি, গল্প কবিতা পড়ে,
শ-    শোভন, সাজন, অলংকরণ, পঞ্চ কবির ঠাঁরে,
ষ-    ষড়রিপুর শাসন, বাঁধন, শোক্ত পোক্ত করে।

স-    সাংবাদিকতা লেখালেখি, বাবার কাছে হাতেখড়ি,
হ-    হাতছানি দেয় অতীত আমায়, বাবাকে মনে করি।

চল্লিশ চরণের ‘শ্রাবণী কবিতা’
চলনবিল

অ-    অনাবিল পদ্মার জলে, চলনের চলন,
আ-আয়তনে সমুদ্র, গতি, প্রকৃতিতে নদী,
ই-    ইন্দ্রিরা রুপে, বয়ে যায় নিরবধি।

ঈ-    ঈশানের আত্রাই-গুড়নই ধারায়,
উ-    উত্তর-দক্ষিণে বেড়ে যায় সীমা।

ঊ-    র্ঊর্মি মালার নাচন, আছে সারাক্ষণ,
ঋ-    ঋষি বলে শস্য ভান্ডার, মৎস আশ্রম।

এ-    এঁটেল মাটির গড়া ঘর-বাড়ী,
ঐ-    ঐ উদয় অস্ত তারা সারি সারি,
ও-    ওখানে বসবাসে, নির্মল নিঃশ্বাস,
ঔ-    ঔষধ,পথ্য, চিকিৎসা দুষ্প্রাপ্য।

ক-    কৈ, শিং, মাগুড়, পাখি তিলে চলনবিল,
খ-    খাবারের প্রয়োজনে, করি, বোরো চাষ,
গ-    গুলতি, বন্দুক বিষে, নেই, পাখির নিবাস।

ঘ-    ঘাসী দেওয়ানের মাজার, চলনবিলে,
চ-চলে শিরণী-মানত, চৈতি চাঁদে মেলা,
ছ-ছুটে আসে সব বয়সী, ধর্ম, বর্ণ ভুলে।

জ-জলা-জলে জড়াজড়ি, চলনের জীবন,
ঝ-ঝরা, খরা নিত্য সাথী, রাস্তা ছাড়া হাটন,
ট-টুস-ঠাস করে, চোর ডাকাতের চরণ,
ঠ-ঠুটো হয়ে গোনা-গাঁথা চলনীর স্বপন।
ড-ডাস চোষে গরু, মোষ মানুষের রক্ত,
ঢ-ঢেউয়ে ভাংগে ঘরবাড়ী, হই উদ্ববাস্ত,
ত-তেড়ি হয়ে নেড়ী ঝড়, গিলে খেতে ব্যস্ত।

থ-থরথর কাঁপে বুক, বিল পারাপার হতে,
দ-দেউড়িতে দাঁড়িয়ে, প্রিয়জন থাকে চেয়ে,

ন-নয় গাঁয়ে যত চাষী, ধান পেতে মুঠিমুঠি,
প-পানি পেতে বোরো সেচে, ফাল্গুন-চৈত্রে,
ফ-ফেলে মাটি পুঁতে খুটি, দিয়ে বেটন-বেড়া,
ব-বাঁধে বাঁধ গুড়নইএ, চলনের কৃষাণেরা।

ভ-ভরা ক্ষেত ডুবে যায়, আটকায় দম,
ম- মোল্লার রণা, ফকিরপাড়া জলা সাক্ষাৎ যম,
য-যায় ভেসে সেথা দিয়ে, কত পাকা ধান।

র-রক্ষক রক্ষনাবেক্ষণে, চলনের তেল গ্যাস,
ল-লক্ষ্যচ্যুত পেট্রোবাংলা করে না বিশ্বাস,
শ-শহরবাড়ীর স্মৃতি অম্লান, ফেলি নিঃশ্বাস।

ষ-ষোলকলা পূর্ণ করি, কর চলনের উন্নয়ন,
স-সহজ যাতায়াতে পাকা রাস্তা প্রয়োজন,
হ-হর্তাকর্তা-বিধাতা, কর আজি বাস্তবায়ন।


পরিশেষ
কবিতার মিলবিন্যাস হয়ে থাকে শেষ চরণে। লতিফ মাহমুদের পদ্ধতিটি গতানুগতিক ধারা থেকে ভিন্নতর মনে হয়েছে। তার নমুনা কবিতা থেকে আমরা দেখলাম, কবিতাগুলো রচনার ক্ষেত্রে তিনি শেষ চরণে যেমন অন্তমিল রেখেছেন, তেমনি চরণের প্রথমে বর্ণানুক্রমিকতা ধরে রেখেছেন।

লতিফ মাহমুদ প্রায় দুই শত ‘বর্ণালী কবিতা’ লিখেছেন। এ সর্ম্পকিত তার কোনো বই নেই। শুধু লিফলেট আকারে বিভিন্ন সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে বিতরণ করেন। তাদেরকে তার পদ্ধতি মেনে কবিতা লিখতে আহ্বান করেন। আমার এ প্রবন্ধের আলোকে সুসাহিত্যিকদের প্রতি আহ্বান, লতিফ মাহমুদের ‘বর্ণলী কবিতা’ নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, কিংবা এর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু প্রগাঢ়, এ বিষয়ে খতিয়ে দেখা দরকার। আমি মনে, কবিতা ও কবিদের প্রতি আমাদের অনুধাবনমুলক দৃষ্টিভঙ্গি কাব্যসাহিত্যের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

আমার প্রিয় বাবা

আমার প্রিয় বাবা


আমার প্রিয় বাবা
আহমদ মেহেদী 

-বাবা, কালকে ঢাকা যাইবা?
-হ্যাঁ যাবতো।
-বাবা, আমার জন্য একটি ফুটবল আনবা কিন্তু ।
-ঠিক আছে আনব, বড় না ছোট ?
- মাঝারিটা আইন্নো কেমন।


বাবার সাথে ঘুমানের আগে আমার এসব নিত্যনতুন বায়না-বিলাস বলা যায়। আমার আরেকটা ফুটবল আছে , এটা নাকি গুঁইসাপের চামড়া দিয়ে বানানো তাই খেলার সময় পায়ে ব্যাথা পাই। ব্যাথা নিরাময়ের জন্য চিন্তা করতে করতে একদিন বিকালে হিজল গাছের নিচে আমি আর আমার জ্যাঠাত ভাই ইব্রাহিম মিলে বলটাকে ইচ্ছেমতো কুপিয়ে জখম করে মনে কি যে আনন্দ - ঊল্লাস তা বলে শেষ করা যাবেনা। ইব্রাহিম একবার বলতে চেষ্টা করেছিল বলটা কেটে ফেলবি ? কে শুনে কার কথা ! আমাদের হৃদয়-রাজ্যে তখন বিজয়ের ঘনঘটা।

বাবা আসতে দেরি হওয়ায় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরে দেখি আমি বাবার বুকে শুয়ে আছি । আর চোখ খুলতেই দেখি আমাদের ঘরের বাঁশের তীরে আমার নতুন ফুটবল ঝুলছে ! আমার ছেলেবেলার আনন্দ-দিনের মধ্যে এটি একটি । আমার বাবা জুতা-ব্যাবসা করতেন । স্কুল ছুটি দিলে প্রায়ই আমাকে তার সাথে দোকানে নিয়ে যেতেন । আর সারাদিন চলত আমার বায়না-বিলাস , আম খাব,জাম খাব এবং আরও কতো কি। বাবা ঢাকা গেলেই আমার জন্য একটি হাফ-শার্ট নিয়ে আসতেন আর এটা দোকানে যেদিন যেতাম সেদিনই আমাকে দিয়ে বলতেন- ‘ তোর মা জিংগাইলে কবি মামা কিন্না দিছে ’ ।
তিনি দোকানে যাওয়ার সময় আমাকে মক্তবে দিয়ে যেতেন আর পকেট থেকে কখনো  দশ টাকা কখনো বিশ টাকা দিয়ে যেতেন  স্কুলে টিফিনের জন্য । আমিও বাবার পকেট থেকে আরো দশ /বিশ টাকা চুরি করতাম । বাবা দেখেও অনেক সময় না দেখার ভান করতেন , শুধু বলতেন –‘তোর মা যেন না দেহে ’। আমি মনে করতাম বাবার পকেট থেকে টাকা নিলে যেহেতু কিছু হয় না ,তাই কাকাদের পকেট থেকেও টাকা চুরি করে এটা কিনি , ওটা কিনি । ক্রিকেট ব্যাট দুইটা আছে আরেকটা কিনা দরকার, ছয়টা স্টাম্প কিনা দরকার আরোও কত শত চিন্তা মাথার মধ্যে। এরজন্য  চাচিদের অনেক কটুকথা শুনতে হয়েছে অবশ্য । তখনও আমি বুঝতে শিখিনি কাকা আর বাবা সম্পূর্ণ আলাদা দুটি সত্তা এই সংসারের যাপিত জীবনে।

ক্লাশে প্রথম হই বলে বাবা সবার আগে নতুন জামা আর ইংলিশ প্যান্ট বানিয়ে দিতেন ।রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই স্কুলের লাইব্রেরি থেকে নতুন ক্লাশের নতুন বই নিয়ে আসতেন। নতুন বইয়ের গন্ধে আমার কৈশোরের বান্দ্রামি আরো বেরে যেতো । অন্যায় আবদার করতে গিয়ে অভিমানও করতাম অনেক। মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও তার সাথে রেগে যেতাম যা আজ ও ভাবলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় । আমাদের পরিবারের সুখের  জন্য এখনো বাবা নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন। এখনো আমি বাড়ি থেকে কোথাও বেরোলে বলে বসেন- ‘ ছাতাটা নিয়ে যা , যা রোদ পড়ছে এবার ! চুল-দাড়ি একটু বড় হলেই বাড়িতে গেলে জবাবদিহি করতে হয় , এখনো কাটলাম না কেন? জামাটা ইস্ত্রি করা হয়নি কেন ইত্যাদি ..... ইত্যাদি । তার স্বাস্থের অবস্থা ভাল না কিন্তু আমার কিছু হলে একেবারে দিশেহারা হয়ে যান, বাবার ছেলের প্রতি এই আন্তরিকতা দেখে আমি ফিফটি পারসেন্ট ভাল হয়ে যাই। এখনো খরচের ব্যাগ বয়ে বেড়ান। তার ধারনা তিনিই যেমন থাকেন না কেন তার ছেলে -মেয়েরা টাটকা খাবার খেতে পারে। আমি মাঝে মাঝে বাবাকে ফোন দেই
-‘বাবা, খরচের ব্যাগ আছে আজকে?
-আছেতো, তুই রিকশা করে বাড়িত যা , আমিই নিয়ে যাব। যাবার সময় বাতেনের দোকান থেকে একটা ডাব খেয়ে যাইছ।
আমি ভাবি এই মানুষটি আসলে কি! আমি এখন পর্যন্ত তার কোন দোষ খুজে পাইনি আমার জন্মের পর থেকে।

আমাদের দোকান পুড়ে যাবার পর বাবা আর ঘুরে দাড়াতে পারেনি কিন্তু বাজারে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে তাই একদিন আমাকে বলল
-‘আমাকে একটি কাজ ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?
-কেন বাবা? কি হয়েছে ?
-কিছুনা , আমার বাড়িতে ভাল লাগেনা তাই।
বাবার ভাল লাগা দিয়ে কথা , বাবা যেহেতু জুতা ব্যাবসার সাথে জড়িত ছিল তাকে আমাদের এক আত্মীয় কথায় কথায় তার  দোকানে বসতে বলেছিল । বাবার সাফ কথা তার ছেলের অনুমতি লাগবে। বাবার মনের অবস্থা চিন্তা করে অনুমতি দিয়ে দিলাম। লোকে যে যাই বলুক-ভাবুক ,আমার বাবা ভাল থাকুক।  সেদিন আমি কষ্টও পেয়েছিলাম খুব । সে দোকানে আমি প্রায়ই যাই বাবার সাথে দেখা করতে। খরচের ব্যাগটা বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই ,তিনি বারন করেন কিন্তু ভাবি বাবা আর কত করবে আমাদের জন্য ! খরচের ব্যাগটা দিলেও বলে দিবেন-‘রিকশা করে যাইছ , হেটে যেতে পারতি না’। একদিন বাবাকে বললাম
-বাবা, তোমার সাথে একটা ছবি তুলব !
-আরে না , ময়লা জামা পড়ে আছি এখন কি ছবি তুলবি ।
-তুমি ক্যাশে বসতো বাবা , কোন সমস্যা নাই।
বাবার সাথের আরেকজনকে বললাম-একটা ছবি তুলেনতো দেখি । তখনই আলামিন কয়েকটি ছবি তুলে দিলেন।
এখনো বাড়িতে গেলে বাবা প্রথমেই জানতে চান আমি খেয়েছি না , আর না খেলেও কেন খাবনা নানান ধরনের জবাবদিহিতা। বাবা, তোমার মতো এমন বাবা কি আর কারো আছে ? আমার মনে হয় না বাবা । তোমার মতো কি তার ছেলের জ¦র হলে এমন মমতায় পানি ঢেলে দেয় ? কখনো না । বাবা এই পৃথিবিতে শুধু তুমি একজনই বাবা আমার যেকিনা তার ছেলের সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে মানুষের কাছে হাত পাততে দ্বিধা করতো না। আল্লাহর কসম বাবা-তুমিই পৃথিবির শ্রেষ্ঠ বাবা, আমার প্রিয় বাবা। আমিও তোমার মতো বাবা হতে চাই। আমার জন্য, এই ফ্যামিলির জন্য কতোটা কষ্ট করে যাচ্ছ তা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারব তখন। বাবা, একটি কথা বলব বলব করেও বলা হয়নি-আবার একদিন তোমার বুকে ঘুমাতে চাই, সেদিন শুধু একটি বায়নাই করব-‘তুমি ভাল আছতো বাবা ? এখন থেকে  তোমার নিজের কথা শুধু ভাববে কেমন ’। তোমার এই রাগি ছেলেটা আছে তোমার পাশে ।

নোয়াগাঁও, দেবিদ্বার , কুমিল্লা