অনুবাদ গল্প : পঞ্চবরের জীবন
পঞ্চবরের জীবন
মূল: মার্ক টোয়েইন
অনুবাদ : রেজা কারিম
১.
জীবন প্রভাতে এক স্বর্গীয় পরী এলো এক যুবকের কাছে। মাত্রই তার প্রাণবন্ত যৌবন শুরু হয়েছে। স্বর্গীয় পরীর কাছে একটা ঝুড়ি ছিল। পরী যুবককে বললো, তোমার জন্য এখানে পাঁচটি উপহার রয়েছে। এদের মধ্যে যে কোনো একটিই তুমি বেছে নিতে পারো। আর হ্যাঁ সাবধান! ভেবে চিন্তে পছন্দ কর। খুব ভালো করে ভাবো। মনে রেখো, এদের মধ্যে কেবল একটিই মূল্যবান।
উপহারগুলো হলো- খ্যাতি, ভালোবাসা, সম্পদ, আনন্দ ও মৃত্যু।
যুবক অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বললো, এত ভাবার কিছু নেই। সে আনন্দকে প্রাধান্য দিলো ও আনন্দকেই বেছে নিলো।
সে পৃথিবীর মাঝে ডুব দিলো। আনন্দ আর আনন্দ তালাশ করে চললো। প্রচুর আনন্দে সে নিজেকে জড়িয়ে নিলো। দুনিয়ার চাকচিক্যের মাঝে সে নিজেকে আমোদে ভাসালো।
কিন্তু প্রত্যেকবার সে হতাশ হলো। এগুলো ছিলো স্বল্প সময়ের জন্য ও অত্যন্ত হতাশাজনক। অন্তঃসারশূন্য ও নিরস। এসব আনন্দ তাকে ছেড়ে চলে যায় ও তাকে উপহাস করে। শেষে সে একদিন বলে, আমি জীবনের বহু বছর অপচয় করেছি। যদি আমি আবার উপহার বেছে নেওয়ার সুযোগ পেতাম তবে বুদ্ধি খাটিয়ে বাছাই করতাম।
২.
স্বর্গীয় পরী আবার আসে। সে বলে,
চারটি উপহার বাকি আছে। যে কোনো একটি বেছে নাও। আর হ্যাঁ, মনে রেখো- সময় বয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে কেবল একটিই মূল্যবান।
লোকটি দীর্ঘক্ষণ ভাবে। তারপর ভালোবাসাকে বেছে নেয়। এদিকে পরীর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু লোকটির নজরে তা পড়েনি।
অনেক অনেক বছর পরে, লোকটিকে দেখা যায় একটি শূন্য ঘরে। একটি খাটিয়ার পাশে বসে আছে। সে নিজের সাথে কথা বলছে। রীতিমতো বিলাপ করছে।
‘একে একে সবাই আমাকে ছেড়ে গেছে। এখন আমার প্রিয়তমাও আমাকে ছেড়ে গেলো। আমার ভালোবাসার মানুষ। সে আজ চিরতরে ঘুমিয়ে গেলো। সে ছিলো আমার শেষ ভালোবাসা। একের পর এক প্রিয় মানুষের বিয়োগ ব্যাথায় আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত। জনশূন্যতার পর জনশূন্যতা যেন ভাঁটার মতো করে আমার সব নিয়ে গেছে। সুখের প্রতিটি মূহুর্ত যেন বিশ্বাসঘাতক বণিক। একটু ভালোবাসার বিনিময়ে আমি হাজারো দুঃখের মূহুর্ত ক্রয় করেছি। ভালোবাসা আমাকেই বিক্রি করে দিয়েছে। আমার হৃদয়ের কোথাও এমনকি হৃদয়ের বাইরেও ভালোবাসার আর কোনো জায়গা নেই। আমি একে অভিশাপ দেই।
৩.
আবারো স্বর্গীয় পরীর আগমন। পরী বললো, ‘পুনরায় বেছে নাও। বিগত বছরগুলো তোমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এমনটাই হওয়ার ছিল যেমনটা তুমি বেছে নিয়েছিলে।’
পরী পুনরায় বলে,
‘আরো তিনটি উপহার বাকি আছে। এদের মধ্যে একটিই কেবল মূল্যবান। মনে রেখো এটা। আর হ্যাঁ, খুব সতর্কতার সাথে পছন্দ করো।’
লোকটি দীর্ঘক্ষণ ভাবলো। তারপর খ্যাতিকে বেছে নিলো। এটা দেখে স্বর্গীয় পরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর নিজের পথ ধরলো।
অনেক বছর পর। স্বর্গীয় পরী আবার এলো। দিনের শেষে ম্লান আলোয় লোকটি একাকি বসে আছে। ভাবনায় ডুবে আছে সে। পরী তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সে জানে লোকটি কী ভাবছে। তার ভাবনাটা ছিল এমন;
সারাবিশ্বে আমার সুনাম ছড়িয়ে গেছে। সবার মুখে মুখে আমার নামের জয়গান। কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্যই আমার এ সুনাম অব্যাহত ছিল। আর এ সময়টা কতই না দ্রুত ফুরিয়ে গেলো। তারপর আমার জীবনে একে একে কত কিছুই না এল। হিংসা, নিন্দা, অপবাদ, ঘৃণা এমনকি নিগ্রহ। আর শেষের শুরুটা ছিল উপহাসে ভরপুর। সবার শেষে এলো সমবেদনা। যা আমার খ্যাতির দাফন। আহ, খ্যাতির কী তিক্ততা! কী দুঃখ!
৪.
আবারো স্বর্গীয় পরীর কন্ঠ শোনা গেলো। ‘আবার একটা বেছে নাও। দুটো উপহারের একটা বেছে নিতে হবে। হতাশ হয়ো না। মূল্যবান উপহারটা শুরু থেকে এখন অব্দি রয়ে গেছে।’
লোকটি কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর সম্পদকে বেছে নিলো। সে বললো, ‘এটা নিঃসন্দেহে সম্পদ। কারণ সম্পদই শক্তি। সম্পদই ক্ষমতা। এতদিন আমি কতই না অন্ধ ছিলাম। এখন জীবন হবে গতিশীল। প্রাচুর্যময়। এখন আমি প্রচুর ব্যয় করবো। টাকা ওড়াবো। মানুষকে বিমোহিত করবো। এসব ব্যঙ্গকারী, উপহাসকারী আমার সামনে মাটিতে হামাগুড়ি দেবে। আর আমি তাদের হিংসা দিয়ে আমার ক্ষুধার্ত হৃদয়ের ক্ষুধা মেটাবো। পৃথিবীর সব বিলাসিতা আমার। মনের আনন্দ, আত্মার বিনোদন ও শরীরের জন্য উপভোগ্য সবই আমার থাকবে যা মানুষের পক্ষে সম্ভব। আমি শুধু কিনবো আর কিনবো। আমি মানুষকে আমার বশ্যতা স্বীকার করাবো। সম্মান, মর্যাদা, আরাধনা এমনকি জীবনের ছোট বড় নগন্য প্রশংসাটুকুও কিনে নেবো। আমার জীবনের সবকিছুই নতুন করে সাজাবো আমি। আমি আমার জীবনের প্রচুর সময় হারিয়ে ফেলেছি। ইতপূর্বে আমি ভুল কিছু পছন্দ করেছিলাম কিন্তু সে সবই এখন যন্ত্রণাদায়ক অতীত। আমি অজ্ঞ ছিলাম। তাই আমার অনভিজ্ঞতার কারণে সঠিক জিনিস বেছে নিতে পারিনি।’
তিন বছর কেটে গেলো। একদিন লোকটাকে একটা জরাজীর্ণ চিলেকোঠায় বসে থাকতে দেখা যায়। সে প্রচন্ড কাঁপছিলো। সে ছিল রোগাটে, বিবর্ণ ও ফ্যাকাশে চোখের অধিকারী। পরনে ছেঁড়া পোশাক। সে শুকনো খড়ি চিবাচ্ছিলো আর মিনমিন করে কিছু বলছিলো।
‘পৃথিবীর সব উপহারকে অভিশাপ দিচ্ছি। কারণ এরা উপহাস। চাকচিক্যময় মিথ্যা দিয়ে মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এরা মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়। এরা কোনোভাবেই উপহার নয় বরং অভিশাপ। এরা মারাত্মক ঋণ। আনন্দ, ভালোবাসা, খ্যাতি, ধন-সম্পদ সাময়িক সময়ের জন্য ছদ্মবেশে আসে। কিন্তু এরা দীর্ঘ বাস্তবতা রেখে যায়। তা হলো- দুঃখ, দুর্দশা, অপমান ও দারিদ্র্য। স্বর্গীয় পরী সত্যই বলেছিলো; তার পাঁচটি উপহারের একটাই ছিলো মূল্যবান। কেবলই একটা যা কখনোই মূল্যহীন নয়। কতই না সস্তা ও মূল্যহীন ছিলো যেগুলো আমি পছন্দ করেছিলাম। আমি এখন তাদের সবগুলো জানি। আর সেই মূল্যবান একটার সাথে সবগুলোর তুলনা করতে পারি। সেই একটা উপহারই মূল্যবান উপহার। এটা এমন এক উপহার, যা দুনিয়াবি বস্তুর প্রতি স্বপ্নহীনতা এনে দেয়। এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী ঘুম। এটা এমন বেদনা যা শরীরকে যন্ত্রণা দেয়। এটা এমন লজ্জা যা অন্তরকে কুপ্রবৃত্তির জন্য লজ্জিত করে। এটা এমন দুঃখ যা হৃদয়কে শূন্য করে দেয়। আমার ওটাই চাই। আমি খুব ক্লান্ত। আমি বিশ্রাম নিতে চাই।’
৫.
স্বর্গীয় পরী আবারো সেই চারটি উপহার নিয়ে আগমন করে। কিন্তু এবার কেবল মৃত্যুই অবশিষ্ট আছে। স্বর্গীয় পরী বললো,
‘আমি এটা এক মায়ের ছোট্ট শিশুকে দিয়েছিলাম। যে তখনো কোলের শিশু। শিশুটি ছিলো এ ব্যাপারে অজ্ঞ কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করেছিলো। সে এটা আমার কাছ থেকে পছন্দ করেছিলো। কিন্তু তুমি এটা বেছে নেওয়ার জন্য আমাকে জিজ্ঞেস করোনি।’
লোকটি বললো, ‘হুম! আমার পোড়া কপাল। আর কী আছে আমার জন্য?’
স্বর্গীয় পরী উত্তরে বললো, ‘যা তুমি কখনোই প্রত্যাশা করোনি। শেষ জীবনের ভোগান্তি।’
(উপরোক্ত গল্পটি আমেরিকার বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েইনের ঞযব ঋরাব ইড়ড়হং ড়ভ খরভব নামক ছোটগল্পের অনুবাদ। মার্ক টোয়েইনের আসল নাম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স। অবশ্য তিনি মার্ক টোয়েইন ছদ্ম নামেই বেশি পরিচিত। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে জন্মগ্রহণ করেন। ৭৪ বছর বয়সে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেডিংয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তার জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম হচ্ছে ‘অ্যাডভেঞ্চারস অব টম সয়্যার’ ও ‘অ্যাডভেঞ্চারস অব হাকলবেরি ফিন’। এই উপন্যাসদ্বয় বিশ্বসাহিত্যে ক্লাসিকের মর্যাদা লাভ করে। তিনি প্রচুর গল্প লিখেছেন। টোয়েইনকে তার সময়ের শ্রেষ্ঠ রম্যকার হিসেবে অভিহিত করা হয়। উইলিয়াম ফকনার টোয়েইনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘আমেরিকান সাহিত্যের জনক’ হিসেবে।)
৪১১/এ, খিলগাঁও, ঢাকা -১২১৯
আলবেনিয়ান কবি ইসমাইল কাদারে
আলবেনিয়ান কবি
ইসমাইল কাদারে
অনুবাদ : আকিব শিকদার
ইসমাইল কাদারে
ইসমাইল কাদারে; আলবেনিয়ান কবি, ঔপন্যাসিক, রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী। ২৮ জানুয়ারি, ১৯৩৬ সালে আলবেনিয়ার জিরোকাস্তারে জন্মগ্রহণ করেন এই মেধাবী লেখক। ইসমাইল কাদারের বাল্যকাল কাটে আলবেনিয়ার জিরোকাস্তারে। সেখানে স্কুলজীবন শেষ করে ভাষা ও সাহিত্যে পড়াশুনা করেন তিরানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও দর্শন ফ্যাকাল্টিতে। এরপর ভর্তি হন মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড লিটারেচারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে পেশা হিশেবে গ্রহণ করেন সাংবাদিকতা। আলবেনিয়ান কম্যুনিস্ট, ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন ও শোষিত মানুষের চিত্র তাকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। ১৯৫৭ সালে লিখে ফেলেন প্রথম কবিতার বই “ড্রিমস” যা মস্কোতে প্রকাশিত হয়।
তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হলো দ্য ওয়েডিং (১৯৬৪), দ্য ক্যাসেল (১৯৭০), ক্রোনিকল ইন স্টোন (১৯৭১), ব্রোকেন এপ্রিল (১৯৮০), দ্য পিরামিড (১৯৯২), ইত্যাদি। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক কারণে ও ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লেখার অভিযোগে তার বই প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। এমনকি তার বিদেশ ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল বহুকাল। ১৯৯৬ সালে, তিনি ফ্রান্সের একাডেমি অব মোরাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের আজীবন সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রইজ সহ অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেছেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের জন্যও তাঁকে মনোনীত করা হয়েছিল, কিন্তু শেষে দেওয়া হয় নি। তার বই পৃথিবীর পঁয়তাল্লিশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
জলপ্রপাত
খাড়া জলপ্রপাতের ধারাগুলো
তেজি সাদা ঘোড়ার মতো নেচে নেচে নামে নিচে,
তাদের ফেনিল, বর্ণিল কেশরগুলো যেন রংধনু।
কিন্তু অকস্মাৎ, পাহাড় প্রান্তে
সামনের পাগুলোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল,
আহা, ভেঙে গেল তাদের শুভ্র সফেদ পা,
এবং তারা পাথরের লাথি খেয়ে মারা গেল।
এখন তাদের পলকহীন মৃত চোখগুলোয়
তুষারশীতল আকাশের প্রতিবিম্ব।
ট্রেনের সময়সূচি
ছোটখাটো স্টেশনগুলোর ট্রেনের সময়সূচি ভালো লাগে আমার
স্যাঁতসেঁতে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে অসংখ্য, অসীম রেললাইন অধ্যয়ন করি।
হঠাৎ গর্জন, পায়চারি থামে। কেউ চমকে ওঠে মুহূর্তখানেক, কী হলো?
(যেন কেউ বুঝতে পারে না স্টিম ইঞ্জিনের অস্পষ্ট ভাষা)
যাত্রীবাহী ট্রেন আসে। মালগাড়ি চলে যায়। দামি আকরিকসহ কত
মালবাহী ট্রেন, যারা একে একে আসে, যায়, সমাপ্তিবিহীন।
এভাবেই কেটে যায়, আমাদের জীবনের দিন
যার যার স্টেশনে। চেঁচামেচি, কোলাহল ও সিগনালপূর্ণ স্টেশন
যেখানে চলাচল করে স্মৃতির আকরিক বোঝাই সব মালবাহী ট্রেন।
অন্ধকারে মিশে আছে পাপের হাবিয়া...
অন্ধকারে মিশে আছে পাপের হাবিয়া
অনার্য আমিন
রাত তিনটে বাজে। শ্যামল আজকে একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে। স্থির দাঁড়াতে পারছে না। মদ পানের অভ্যাস শ্যামলের নতুন নয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে অনিয়মিত মদ গ্রহনে নিজেকে ন্যাস্ত রেখেছে। সিগারেটের স্বাদ নিয়েছিলো কলেজ জীবনে ক্যাম্পাস আড্ডায়, ওটা এখনো নিয়মিত। আর মদের নেশায় অভ্যাস্ত হয়েছে চাকুরীরত কলীগদের বদৌলতে। তবে আড্ডাবাজ কলীগদের মাঝে শ্যামল আলাদা, বিশেষ করে নেশার ক্ষেত্রে। মদ পানে সবাই মাতলামি করলেও শ্যামল শান্ত ও স্বাভাবিক আচরণ করে। তবে আজকে বেশ মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখের সামনে ধোঁয়াশা উপস্থিত। মস্ত রাস্তাটা এবড়ো থেবড়ো দেখছে। গাঢ় রাতের অপুষ্টিকর আলো ছড়ানো ল্যাম্পপোস্টের ঘুটি ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। নেড়ি কুকুরগুলো ময়লা স্তুপে মুখ ঢুকাচ্ছে। কতৃত্ব দখলে ঘেউ ঘেউ চিৎকারে এক দল আরেকদলকে তাড়া দিলো। নড়বড়ে মেরুদন্ডতে শক্তি জুগিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো শ্যামল। নিয়ন্ত্রণহীন পা দুটো কিছু দূর যেতেই থেমে গেল। ঘোর লাগা চোখদুটো স্থির হলো মুহূর্তেই। হাত দিয়ে চোখদুটো কচলে আবারো দৃষ্টিপানে স্থির করলো। শ্যাম বর্ণের একটা মেয়ে সীমানা প্রাচির ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স উনিশ কুড়ি হবে। সময়ের যৌবন জোয়ারে পূর্ণতা তার মানব নদীতে। বয়স্ক রাতের আলো আধাঁরীতে দৃষ্টির বিরতি দিয়ে শ্যামল আবার তাকালে। এ তো নার্গিস! নার্গিসের একমাত্র আশ্রয় ভিক্ষুক মা কিছুদিন আগে মারা গেছে। রাস্তার ওপারে পাহাড়ের গায়ে তার কবর। শ্যামল আগে থেকেই মেয়েটিকে চেনে। কালো রঙের হলেও গঠন অববয়ে যে কারো দৃষ্টি কাড়ে নার্গিস। শ্যামল ভাবনার খেয়ালে মেয়েটিকে পছন্দ করলেও অবস্থানের ভিন্নতায় কাছে আসে না। দূর থেকে দেখে কামনা জাগে শ্যামলের। ছোট্ট খুপরি ঘরটা ভেঙে গেছে। আসবাব-জিনিস বলতে কিছুই নেই ঘরে। ছন্নছাড়া নার্গিস মা মরার পর কই যেন চলে গেছিলো। শ্যামল ওকে মিস করতো ভালোবেসে নয়, কামনায়। নেশায় ছেয়ে যাওয়া দেহটা হঠাৎ অশান্ত হয়ে ওঠে। নার্গিসের সামনে এসে দাঁড়ায় শ্যামল। পুরনো ছেড়া কামিজের ভেতর থেকে নার্গিসের যৌবন উঁকি দেয় শ্যামলের চোখে। শ্যামল হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। নেশা আর বাসনার বিষ ফলায় বিদ্ধ শ্যামল নার্গিসকে ঝাপটে ধরে। নার্গিস শ্যামলকে চিনতে পেরেছে কিনা কে জানে, কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া করলো না। নিরব চতুর্দিক। সুনশান ঘুমন্ত পরিবেশ। জনমানবহীন রাস্তা। পাহাড় থেকে ভেসে আসা দু একটা অপরিচিত পাখির ছোট ডাক ছাড়া কোন শব্দ নেই কোথাও। ছোট বড় দালানগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে যে যার মতো। রাস্তার মাথায় একটা দালান এখনো জেগে আছে আপদমস্তক আলোকসজ্জা নিয়ে। হয়তো বিয়ে বাড়ি হবে, কে জানে! শ্যামল নার্গিসকে পাশের স্কুল মাঠে নিয়ে যায়। মাঠের কোনে কিছু পরিত্যক্ত চেয়ার টেবিল পড়ে আছে। শ্যামল নার্গিসকে একটা বেঞ্চে শুইয়ে দেয়। পাশের দালান থেকে ঘুলঘুলির মতো একটা আলো এসে নার্গিসের মুখে পড়লো। ক্ষুধার্ত মলিন মুখটা দেখে শ্যামল মায়ার বিপরীতে কামনায় জ্বলে উঠলো। একটু পরেই ঘুলঘুলিটা নিভে গেল। আঁধারে নেশাগ্রস্থ শ্যামল এখন ক্ষুধার্ত, হিংস্র বাঘ। নরম জমিন থেকে পান করে গোবলেটে যৌবনের মদিরা। শ্যামল হারাতে থাকে নার্গিসের অন্তঃপুরে, গভীরে। ওর পুরো দেহ প্রকম্পিত, শিরা উপশিরা, কোষে কোষান্তরে ছড়িয়ে গেছে অনাস্বাদিত আনন্দ। ধীরে ধীরে শ্যামলের নেশা কাটতে থাকে। আর যতক্ষণে নেশা কেটে যায় তখন ওর শরীরটা ক্লান্ত হয়ে আসে। ক্লান্ত দেহটায় বিবেক জেগে ওঠে। মাথা ঝিম ধরে যায় নিজের অবস্থান ও কর্ম দেখে। শ্যামল উঠে দাঁড়ায়। চারদিকে কালো কালো অন্ধকার ঝিম মেরে আছে। শ্যামল নার্গিসের দিকে ঝুকেছে আসে। কেঁপে কেঁপে ওঠা দেহটা নির্বাক লেপ্টে আছে বেঞ্চে। চোখদুটো বন্ধ। মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় শ্যামল। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না! অন্ধকারে মিশে আছে পাপের হাবিয়া। কালো সে পাপ ছোপ ছোপ দাগ এটে দেয় শ্যমলের যৌবনে, সভ্যতার মগজে।
নার্গিস এখনো শুয়ে আছে নিথর হয়ে। কোন তাড়া নেই, উৎকন্ঠা নেই। এটাই বুঝি নার্গিসদের জাগতিক জীবনের পাথেয়।
শ্যামল পকেট থেকে টাকা বের করে নার্গিসকে ধাক্কা দেয়। নার্গিস উঠে বসে। শ্যামল ওর হাতে টাকাগুলো গুজে দিয়ে দ্রুত হেঁটে যায়। স্কুলের খোলা গেটে এসে পিছনে ফিরে তাকায়। আবছা অন্ধকারে দেখে নার্গিস এখনো বসে আছে। শ্যামল নার্গিস থেকে দৃষ্টি এনে নিজের দিকে তাকায়। যাপিত জীবনের অর্জিত শিক্ষা নেশার ঘোরে, রাতের আধাঁরে অজ্ঞতার সনদ দিলো। পাহাড়ী বুনো হুতুমের ডাকে সামনে পা বাড়ায় শ্যামল। নার্গিস তখনো বসে আছে বেঞ্চে।
ঘাসের ডগায় ভর করে সকাল আসে, নেতিয়ে পড়া দুপুরটা সন্ধ্যায় মিশে যায় রাতের আহ্বানে। রাতের আদিম চেহারায় উৎকন্ঠা জেগে সকালে রূপ নেয়। এভাবে কেটে যায় দিন, রাত। চার দিন পর। শ্যামলের স্বপ্নের পর্দায় হাজির হয় নার্গিস। প্রতিটি মুহূর্ত নিজের কৃতকর্মের চিন্তা ও নেশা না করার পাথর শপথে বেশামাল উদ্বেগ শ্যামল। নিজের প্রতি নিজের ঘৃনা বেড়ে যায়। বর্ণহীন হাজারো জিজ্ঞাসায় নিজের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসে হঠাৎ হঠাৎ। পাপের নদীতে ডুব দেয়া দেহটা পাপমোচনে যারপরনাই হতাশ। ভাবনায় ঘুম যাওয়া শ্যামল স্বপ্নে নার্গিসকে দেখে ভয়ে আৎকে ওঠে। অন্ধকার ভেদ করে অনেক দূর থেকে নার্গিস শ্যামলের দিকে আসছে। নার্গিসের সামনে সামনে দৌড়ে আসছে ছোট্ট একটা বাচ্চা। কী মিষ্টি বাচ্চা! বাবা, বাবা, ডাকে শ্যামলের কাছে আসতেই বাচ্চাটা বিভীষিকাময় এক আগুন কুন্ডে শ্যামলকে ঝাপটে ধরে। লেলিহান তাপে শ্যামলের বুকটা অঙ্গার হয়ে যায়। নিজের দৃষ্টে নিজেই ভস্ব হচ্ছে। হন্তদন্ত হয়ে শ্যামলের ঘুম ভাঙে। ঘামের স্নানে ভিজে আছে পুরো শরীর! ভয়ের আঁধারে আলো খুঁজে পায় না শ্যামল। মগজে হাতুড়ি পেটানো আঘাত। অন্ধকার ঘরে এই বুজি পুড়ে যায় শ্যামল। পাপের হাবিয়া তাকে ঘিরে ধরেছে। স্বপ্নের সেই আগুন শ্যামলের পাপের ফসল। ভাবতেই অশান্ত হয়ে ওঠে শ্যামল। বিছানা, ঘর ছেড়ে বাইরে আসে শ্যামল। ভুতুড়ে অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো পরিবেশ। শ্যামল দ্রুতগতিতে হাঁটতে লাগলো রাস্তা মাড়িয়ে। নার্গিসকে খুজঁতে লাগলো। ওর কাছে ক্ষমা চাইবে শ্যামল, আর ক্ষমা না করলে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিশেবে নার্গিসকে ঘরে নিয়ে আসবে। স্কুল গেটে আজও নার্গিসকে পাওয়া গেলো তবে সেদিনের সেই অবস্থায় নয়। প্রকাশ্যে দেয়ালের গায়ে ভর করে জড়িয়ে রেখেছে অন্য পুরুষকে! আজ নার্গিস বেশ পরিনত। খুব কৌশলেই জীবনের লাগাম টেনে চলছে। এগুলো কি সেদিনের পর থেকে না আগেও ছিলো ভাবনায় আসছে না শ্যামলের। যে অপরাধের দায় নিয়ে এত রাতে শ্যামল নার্গিসকে খুঁজতে এসেছে সে অপরাধের জন্য এতটুকুও পেরেশানি নেই নার্গিসের। নার্গিস আঁধারকে ভালোবাসলেও শ্যামলের কাছে তা পাপ, কালো পাপ। এ পাপ থেকে নার্গিসকে সরানো সম্ভব নয়। দূরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো শ্যামল। কি করবে ভাবছে। ভাবনার মাঝেই নার্গিস রিক্সা চেপে অন্যত্র চলে গেল। না বলা কথা আর হতাশা নিয়ে বাসায় চলে এলো শ্যামল।
শব্দমালা : মিসির হাছনাইন
কয়েকটা তিল গোপন একটা চোখে
একটা তিল লিখে রাখা আদর
মুচকি হাসিতে মেলে নকশী চাদর।
এই তিলটা হেঁটে হেঁটে বেড়ায়
একটা নগর শীত আবেশে হারায়।
আরেকটা তিল ঢেকে রাখা প্রেম
চোখের ভ্রু কালো একটা মেঘের নাম।
বৃষ্টি নামা নীল সমুদ্রে জমেছে হেম
তাকিয়ে থাকা কাজল পাখির সর্বনাম।
ছোট্ট একা তিল নগরগড়া অসুখ
তোমার আমার পৃথিবী, নাই কোন বিসুখ।
কতগুলো কবিতায় লিখে রাখা রং ঢং
সেই রাতেও চাঁদ ছিল, কয়েকটা চুমুর ভং!
কয়েকটা তিল গোপন একটা চোখে
খসে পড়–ক নিজ দেশে, যে দিল পাহারা।
চাতাক পাখি সেই তিলটা কার দুঃখে
ভালো নাই, তবুও চাই ভালো থাকুক তারা।
আড়ি
গভীর রাতের গল্প বলি
রাতজাগা ঐ পাখিটার ডাক,
কি জানি এতো করে ব্যাঙ ডাকে;
ফুলের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে কোন গাছটার?
বুদ্ধ পূর্ণিমার ঐ চাঁদ দেখো-
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে মেঘের আড়ালে,
ঐ নদীটার নাম কেন তবে আড়িয়াল খাঁ
শব্দ করে বিমানখানি কাদের নিয়ে উড়ে গেল,
মনের ভেতর নিঃসঙ্গতা তোমার খুব ঘুম ফেল..।
সন্ধ্যার বৃষ্টি ভেজা এক বিলে
সন্ধ্যার বৃষ্টি ভেজা এক বিলে
ফুটেছে কিছু শাপলা, পদ্ম..
অনাহারী এক বার্মিজ বালিকা
ফুল গুলো তুলে নিল সযতনে,
গ্রামের এক পাশে মহুয়া তলায়
বসেছে এক আদিম রাতের বাজার,
মেয়েটা ক্ষুধায় ফুলগুলো বিক্রি করে
আনমনে যখন, গাছটার দিক তাকালো,
দেখলো- কতগুলো ফুল না পাওয়ার দুঃখে
মৃত মায়ের করুণ চোখের সবটুকু মায়া নিয়ে
এক অচেনা যুবক ফুল মনে করে এক নজর
মেয়েটার দিক তাকালো, তখনই একটা ফুল ফুটলো,
বেখায়ালে মঙ্গোলিয়ার রাস্তায় একটা দূর্ঘটনা ঘটলো
দুইটা ফুলের মতন নিষ্পাপ শিশুর শরীর ছিঁড়ে গেলো,
এক জাপানিজ কবি তাঁর কবিতায় চেরি ফুল লিখলো..
পরদেশী কবিতা
আমার দেশের আকাশে আজ অযুত নিযুত তারা। তোমায় আমি খুঁজতে খুঁজতে হলেম দিশেহারা। কতদূরে তোমার দেশ সে আকাশে জ্যোৎস্না বুঝি? আমি পাগল দিকভোলা উল্টো হয়েও খ্ুঁজি..। তোমার জন্যে কতগুলো ফুল হয়ে যায় শাড়ি। আমার খালি ইচ্ছে করে ছেড়ে দি ঘর বাড়ি। হঠাৎ করে উড়াল দি এই আকাশখান পাড়ি.. হঠাৎ কখন তোমায় দেখি স্বপ্নে ভাসা চোখে, তার ভেতরে হৃদয়খানি আছে দারুণ সুখে..। তুমি প্রিয় ভালো থাকো রাতদিন আমি পাগল চাই। বলো, পৃথিবীতে এমন কি আছে তোমায় দিতে না’ নাই। তুমি যা চাও তাই হবে, সবকিছু তাই এতো সুন্দর, যুগে যুগে তোমার জন্যে দিবো পাড়ি আটলান্টিক বন্দর।
নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পদাবলি
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
সুরের খোয়াব
নীহার মোশারফ
চেহারা নিয়ে অনেকেরই অপছন্দে সময় কাটে
কৃষ্ণকলির বুকে শরতের হাওয়া
একাডেমির মাঠের কোনায় বৃক্ষের ছায়ায়
আদরে-সোহাগে সন্ধে গড়ায় তার।
সেই চেনা ঘাট, বিষুদবারের হাট
ভেতরে প্রখর রোদে কৃষ্ণকলি হাঁটে।
শাড়ির আঁচলে পুষ্পের ঘ্রাণ
চোখের ধাঁধায় জাগে সুরের খোয়াব।
নবাবী হালচালে ধুনধুমার নেই,
মিয়ার কথায় হয় না কাবু
হাবুর পরিবার।
পরচর্চায় মোহ বাড়ে
ঘরে ঘরে উর্বর ঝগড়ার চাষ।
তবুও দুঃখ নেই কৃষ্ণকলির,
রাগে-অনুরাগে ছুঁয়ে যায় ভ্রমর
অন্তরের ধ্বংসস্তূপ
এম সোলায়মান জয়
বৈতরণী থেকে হৃদয়ে সূর্য ডুবছে
স্মৃতির জানালায় উঁকি-ঝুঁকি দেয় বৃদ্ধ কোকিল
আহ্নিকগতির বেলায় আকাশে ভাসে স্বপ্নের মেঘ
অঙ্কুরিত আকাক্সক্ষায় ফেটে পড়ে যৌবন
হারিয়ে খুঁজি নির্বাসিত বাসনা
কষ্টের শৈল্পিক ভ্রুকুটি নিষ্প্রভ
হতাশার হ্রেষায় নির্বাপিত সময়।
এখানে টুকরো হওয়া অন্তর জমে আছে;
গভীর যাতনায় বেড়ে উঠা অন্তর
ছলনায় স্বপ্ন কবর দেওয়া অন্তর
আমি জীবন থেকে দূরে-
অন্তরের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আছি।
বেকার প্রেমিক
অভিষেক
স্মৃতির কঙ্কাল করছি ফেরী
বুকের বামপাশে তোমার বাড়ি
উৎসবমুখর দ্বিকবিদিক
কত আলোর রোশনাই
নীলা আমি তোমার বেকার প্রেমিক
তোমার কাজলা দিঘীর মতো
চোখে আমি বারেবার হারিয়ে যাই
অভিমান, মনখারাপ আর বাকিটা ব্যক্তিগত।
নদীবক্ষের সামনে হাতে হাত ধরে
একদিন আমরা বলেছিলাম দুজন দুজনকে কখনও ছেড়ে যাবো না
অথচ তোমাকে ছেড়ে আমাকে থাকতে হবে,
জীবনযুদ্ধে একা একা লড়াই করতে হবে-
ভাবিনি কখনও!
শুধু এটুকু’ই বলবো
আমাকে ছেড়ে
সরকারী চাকরী করা যে ছেলেটার হাত ধরেছো তার সাথেই
তুমি সুখে থেকো
ভালো থেকো
কারণ, ভালোবাসার অপর নাম- ‘ভালো রাখা’
তোমার ভালোতেই আমার ভালো
দু’চোখে যতই বিষাদের মেঘ
করুক না কেনো আমি চাই
তুমি ভালো থেকো।
বাতিঘর
সাজ্জাদুর রহমান
বিচার-অবিচারের পাল্লায় যখন
দোল খায় ভাগ্যের পরিহাস
তখন বলতে পারবোনা সঠিক কথাটি।
নির্মমতার ফণা তুলে বিষকান্নায়
স্বপ্নের ডালপালা ভেঙ্গে পড়ে
সজ্জিত জীবনের বাতিগুলো নিভে যায়
হাস্যজ্জ্বল দৃশ্যে ধরে পচন
ম্লান হয় রঙিন স্বপ্নের চেনামুখ !
বাতাসের গায়ে কাঙ্গালের আর্তনাদ
আকাশে ভাসে অশ্লীল পদাবলী
নর্তকীর দেহ তল্লাসি করে নষ্ট চুমুর দাগ।
আমি দূরে বসে-
থৈ থৈ অন্ধকারে হাতড়াই ব্যথার প্লাবন।
চোখ রজনীর ফাঁদে
রহমান মিজান
এখনো রাত নামেনি
ভুলে গেছি কখন নেমেছিল রাত চোখে,
বুক পকেট অসহায়ত্ব বারো জোড়া বাঁপাশে যাতনা।
ধারদেনা করা এক প্যাকেট আসক্তি পড়ে আছে নিয়মিত যেন জীবন্ত প্রযোজনা।
রাত নামেনি চোখে জীবিকার বিশ্রী ভাষায় অতিষ্ঠ,
শেষ রাতের জংশন স্টেশনে নেমে কথোপকথন হয়েছে
চারপাশের নীরব হত্যাকান্ডের চেয়ে ঢের ভালো কাকতালীয় জীবন।
ফেরারি
ইবনে আব্দুর রহীম খুরশীদ
নগরের অলিগলি কংক্রিটের পিচঢালা পথ
পাহাড়ের উপত্যকা, বিস্তির্ণ মরুভূ’র মাঠ,
প্রত্যন্ত অঞ্চলেই খুজি তারে কাব্যের শপথ
যদিও বা তার খোঁজে আত্মদান নয়তো বিরাট।
পাখিদের ঘুমভাঙা, প্রভাতের দীপ্ত ঊষা-ক্ষণ
দুপুরের তীব্র রোদ- পিপাসার্ত লো-হাওয়ার দিন,
বিকেলের নিরুত্তাপ, নিশিথের কালো আবরণ
আকাক্সক্ষা সর্বদা তার খুজে থাকে উদাসীন।
আকাশের চাঁদ-তারা সাক্ষী আরো পাহাড়-পর্বত,
অরণ্য-জঞ্জালেও তার খুজে ঘুরেছি অধিক,
নদী আর সাগরের তীরে তীরে সুদীর্ঘ পথ,
নিশ্চিহ্ন করে শেষ হারিয়েছি উন্মুক্ত দিক।
একদিন খুজে খুজে অবিশ্রান্ত আশার ঝলক
প্রত্যাশার প্রান্তরে সহসাই দেখা পাবে তার,
অভিমানে হবে লাল আকুতির সোনার ফলক
একফালি হাসিতেই ঘুচে যাবে ক্লেশ সাধনার।
শিকড়ে পৌঁছাতে
মাজরুল ইসলাম
বুড়ো পানকৌড়ি বসে বসে কতগুলো কথা বলে গেল।
আর তাতেই
চেলার ধূসর ডানা হয়েছে রূপোলি।
এখন কাদা-বালি ধসিয়ে নদী, নদীর তীর
গিলার মিশনে মেতেছে বুড়ো পানকৌড়ির চেলা।
দেখছে বিশ্ব !
খরার মুখে পড়ে- অন্ধকার, হাহাকার
চারিদিকে লাশ আর লাশ !
পা রাখার জায়গাটুকু হারানোয়
বসে থাকতে পারলো না- মরণ আর কি !
বার বার নামে ওরা
নরকাসুরের থাবা দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দিতে
কিংবা শিকড়ের নাগালে।
বেড নম্বর উনিশ
মুস্তফা হাবীব
যেদিন ভেসে আসে তোমার মুখরশ্মি- অবয়ব
মায়ায় জড়ানো কবিতার সংসারে রেখেছি খুব যতœ করে।
তারপর কত প্রকল্প গড়েছি, বুনেছি ফাঁদ
তুমি আসবে, তুমি আসবে উড়ালপঙ্খী ডানায়
এসে বসবে পাশাপাশি। রিনিঝিনি হাসি
আর রসভারি কবিতার জলে ভেজাবে হৃদকমল।
আশ্চর্যের আশ্চর্য!
অনেক স্বপ্নের কাচাপাতা ঝরে গেছে বিনা নোটিশে
তবু এক নদী আবেগে তোমাকে দেখার শাশ্বত প্রবাহ
দু’চোখে মর্মরিত হতেই ছিল দিনের পর দিন।
অবশেষে বীরের বেশে তোমাকে খুঁজে পেলাম
একটি বনিদী হাসপাতালের ডি ব্লক- লিফটের পনেরো,
ষোল- বি কক্ষের উনিশ নম্বর বেডে।
প্রেমিকের শার্ট আর সংগোপিত অক্ষরমালা
অনিন্দিতা মিত্র
সাগরের উথাল পাথাল ঢেউয়ের কাছে গচ্ছিত রাখো সংগোপিত স্বপ্নের মণিমালা, স্মৃতির পত্রাবলিতে অভিমানের টুকরো টুকরো সংকেত, তোমার রয়াল ব্লু শার্টের কলারে টুপটাপ দীপ জ্বালায় ঝিলিমিলি তারাদের দল, নিঃসঙ্গতার বাকল খসিয়ে বিরহিণী স্টারলিং ঠোঁট রাখে প্রেমিকের ঠোঁটে। ঝরা ম্যাপেলের বনে উদাসী বিকেলের প্রবল উল্লাস, নতুন ভালোবাসার স্বপ্ন তুমি সন্ধান করতে থাকো নির্জন গোধূলির জলমহলে।