ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শাদমান শাহিদ : পর্ব ০৭

ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শাদমান শাহিদ : পর্ব ০৭

রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ

(গত সংখ্যার পর)
 বাসায় আসতে চেয়েছিলো; নিজের প্রস্তুতি নেই বলে আনিনি। অবশ্য আরেকটা কারণও ছিলো, বার থেকে বেরিয়েই দেখি দরজার সামনে বাইক নিয়ে সোহাস দাঁড়ানো। আমাদেরকে নাকি অনেক আগে থেকেই ফলো করছে। ভাবছিলো, এতোদিন পর চাতক-চাতকী পরষ্পরকে খুঁজে পেয়েছে, কখন একে অপরকে ছাড়ে কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, বেশি রাত হলে আবার গাড়ি পাবো না। সে-আশঙ্কাতেই সে বাইক নিয়ে ফলো করছিলো। তাছাড়া সোহাস রেণুর আড়ালে আমাকেও পছন্দ করে। রেণু যখন বাসায় থাকে না, তখন ওর চোখ-মুখ আমাকে ডাকে। আমিও একটু-আধটু খুলে-মেলে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। কথা যা হতো, সবই দেশ-সমাজ-পার্টি কেন্দ্রিক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা ঠিকই গুঁড়ো হতাম। সাজ্জাদকে বিদায় দিয়ে বাইক নিয়ে আমরা চলে গেলাম মিলুদের বাসায়। মিলুর জামাই নাকি হঠাৎ রেগে গিয়ে তিন তালাক বলে ফেলেছে। এখন সে ছেলে জোহানকে নিয়ে আরামবাগ বাবার বাসায় থাকে। ব্যবসায় লস, তাই বেশকিছু দিন ধরে তাদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। হয়তো এ সুযোগে আসলাম, একটু আধটু নেশার দিকেও ঝুঁকে গিয়েছিলো। সব মিলিয়েই ব্যাপারটা বিশ্রী হয়ে গেছে। এখন একদিকে ধর্ম আরেকদিকে আত্মীয়স্বজন-পরিবার-সমাজ, কীভাবে যে পরিবেশটা সামাল দেবে...। অনেক কেঁদেছে মেয়েটা। কোনোরকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাসায় ফিরলাম। ফিরতে ফিরতে রাত হলেও সোহাসকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে একবার ক্লাবে ঢুঁ মারি। দৈনিক একবার ক্লাবে না গেলে আর সবার মতো আমারও পেটের ভাত হজম হয় না। ক্লাবে নানা পেশার মানুষ জড়ো হয়, আড্ডাও জমে বেশ। আড্ডার ভেতর থেকে দেশ-বিদেশের অনেক খবরা খবর পাওয়া যায়। সে-সাথে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে কে কী সমস্যার মুখোমুখি হয়, বিনোদন হিসেবে তা-ও কম না। কেউ বলে, তার অফিসের ডিরেক্টর ম্যানেজার একটা চামার। কথায় কথায় তুই-তুকারি করে। অফিস টাইমের এক মিনিট এদিক-সেদিক হলে লাল কালি মারে। তিনদিন লাল কালি পড়লে নাকি একদিনের বেতন কাটা। কেউ বলে, তার কলেজের প্রেন্সিপাল একটা আস্ত লুচ্চা। সুন্দরী ম্যাডামদেরকে এটা-ওটার ছুতা ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সামনে বসিয়ে রাখে আর পৃথিবীর কোন কোন দেবতা নারীর প্রতি আসক্ত ছিলো এবং তারা কী কী ছলা-কলায় নারীকে বশ করতো, সেসব নারীর গর্ভে কোন কোন দেবতার জন্ম হয়েছে এবং সেসব দেবতা নিন্দিত না হয়ে কীভাবে, কোন যুক্তিতে পৃথিবীতে নন্দিত হয়েছে, তা সবই সে পুরাণ থেকে খুঁজে বের করে করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। কেউ বলে, আমাদের কোনো ভাবনা নেই। আমরা গভমেন্ট সার্ভিস-হোল্ডার। অফিসে গেলেও যেই, না গেলেও সেই। কারো কিছু বলার নেই। কেউ কিছু বললে আমরা সবাই মিলে তার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ি। উদাহরণ হিসেবে পেশ করে, একবার এক অফিসার নাকি অফিসের সবাইকে অসদোপায়ে আয়-ইনকাম না করার জন্যে শপথ করিয়েছিলো, তারপর তারা সবাই মিলে কীভাবে ঐ গ--মূর্খ অফিসারকে গাট্টিগোল করে খাগড়াছড়ি পাঠিয়েছিলো, তার চমৎকার বিবরণ দেয়। এমনই নানান কথার ভেতর রহিম মিয়ার দোকানের ছোকরা ছেলেটা চা পরিবেশন করতে এসে জানিয়ে যায়, মাসুদ আহমেদকে শাদা পোশাকের পুলিশ গত রাতে ধরে নিয়ে গিয়ে এখন অস্বীকার করছে। কথাটা শোনামাত্র মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লো। বলে কী! পুলিশ অস্বীকার করলে তো মারাত্মক সমস্যায় পড়ে যাবেন সিদ্দিকি সাহেব। পুলিশের অস্বীকার করা মানে গুম। আর ওটা হত্যার চেয়েও জঘন্য।
পুলিশের হাতে গেলে টাকা-পয়সা খরচ করে কোনো-না-কোনোভাবে ছাড়িয়ে আনা যায়। কিংবা কেউ মেরে ফেললে লাশ স্পর্শ করে কান্না-কাটি করে কাফন-দাফন শেষে ঘর লওয়া যায়। কিন্তু গুম বলে কথা। এর শোকের কোনো শেষ আছে? টাকা তো শেষ হবেই আবার হয়রানির অন্ত থাকবে না। তার ওপর অন্তহীন কান্নার স্্েরাত থাকবেই।
আমরা কয়েকজন সিদ্দিকি সাহেবের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি তিনি নেই। ছেলের খোঁজে সেই যে সকালে থানার উদ্দেশে বেরিয়েছেন, এখনো বাসায় ফেরেননি। কথা বললাম, মাসুদের আম্মা জাহানারা বেগমের সাথে। তিনিও সারাদিন ধরে কেঁদে কেঁদে একসার। আমাদেরকে দেখে হাতে আসমান পেলেন যেনো। কান্না বন্ধ করে সবিস্তারে বলতে লাগলেন। রাত সাড়ে তিনটার দিকে শাদা পোশাকে পাঁচ-সাতজনের একটা টিম ডোর বেল টিপতে থাকে। মাসুদের আব্বা তখন তাহাজ্জুদ নামাযের জন্যে বাথরুমে অযু করতেছিলো। বেলের আওয়াজে আমরা সবাই এক প্রকার জেগে গেলাম। তারপর আমি লুকিং গ্লাসে চোখ বসিয়ে দেখি দরজার সামনে শাদা পোশাকে ক’জন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। এসময় মাসুদের আব্বাও বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে জানতে চাইলো, কে এসেছে? আমি তখন যা দেখেছি বললাম। তিনি তখন দরজা খুলে দিলেন। তারপর যা হবার...। মাসুদের আম্মা আবার কাঁদতে থাকেন।
আমরা বললাম, আন্টি, আঙ্কেল এমন বোকামিটা করলেন কেনো?
বোকামি করলো কোথায়? সে তো একসময় ডিফেন্সের বড়ো কর্তা ছিলো। শাদা পোশাকধারী লোকদের কর্তব্য এবং ক্ষমতা সম্পর্কে তার অজানা বলতে কিছু নেই। আবার মাসুদ বিরোধী দলীয় রাজনীতির কর্মী হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা-মোকদ্দমা ছিলো না। সে-ভরসাতেই দরজা খুলে দিয়েছিলো। এমনকি সকালেও আমাদের কাছে বিষয়টা এতো আতঙ্কের কারণ ছিলো না। টোটাল বিষয়টা পরিষ্কার হলো তো থানায় যাওয়ার পর। পুলিশ যখন অস্বীকার করলো।
এখন?
‘এখন কী হবে, আল্লা জানে গো মা।’ আবার কাঁদতে লাগলেন।
আমরা বললাম, থানায় জিডি করেছেন?
জিডি করলে কী হবে গো মা, আমার ছেলেরে তো ওরাই গুম করে ফেলেছে। চোখের সামনে পুলিশে ধরে নিয়ে এখন অস্বীকার করছে। বলে, গত রাতে থানা থেকে কোনো পুলিশই নাকি বাইরে ডিউটিতে যায় নি। ওরা বললেই হলো?  কোনটা পুলিশ আর কোনটা সিভিল পারসন তা কি আমরা চিনি না? আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু তোমাদের আঙ্কেলও কি চেনে না? চিনেছে বলেই তো দরজা খুলে দিয়েছিলো।
আন্টি, আমরা কি পত্রিকায় কোনো রিপোর্ট করবো?
পত্রিকায় রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। সাংবাদিক এসেছিলো। তারা এসে আমাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে গেছে। মাসুদের পার্টির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও এসেছিলেন। তারাও অভয় দিয়ে গেছেন, যেভাবেই হোক তারা মাসুদের হদিশ পাওয়ার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে।
তাহলে আন্টি আজকের দিনটা অপেক্ষা করুন। দেখুন কোনো খবর হয় কিনা। পুলিশ পারে না, এমন কোনো কাজ নেই। তারা আন্তরিক হলে মাসুদের একটা খোঁজ হবেই। এমনও তো হতে পারে, উপরের চাপে তারা মাসুদকে কোথাও আটকে রেখেছে এবং এটাকে হাতিয়ার করে তারা কোনো সুবিধা হাসিল করবার চায়।
যা ইচ্ছে করুক না, আমরা তো কোনো আপত্তি করছি না। আগে ছেলেটার খোঁজ দিক। তারপর যা ইচ্ছে করুক। আমাদের ক্ষমতা থাকলে টাকা-পয়সা দিয়ে ছেলেকে উদ্ধার করবো, না হয় যা হাবার হবে।
আন্টি, আমাদেরও বিশ্বাস, টাকা-পয়সার লোভ দেখালে একটা কিছু হতে পারে। টাকা-পয়সার সমস্যা থাকলে বলুন, আমরা আপনাদের পাশে আছি। যখন ইচ্ছে ডাক দেবেন, আমরা আছি।
আমাদের কথায় মাসুদের মায়ের চোখে-মুখে একটা পাখি ওড়ে। ড্রাগনের তাড়া খেয়ে উদ্বিগ্ন পাখিটা কত অজানা নদী-খাল-বিল-জনপদ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবে এটাও আশা রাখছে উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো এক সময় বাসাটা ঠিকই পেয়ে যাবে। আমরাও তা কামনা করে চলে আসি। পরদিন আবার পনেরো আগস্ট। আমি কোনোকিছুতে না থাকলেও, অনেকের হাতে অনেক কাজ। সরকার এবছর দিবসটিকে কেন্দ্র অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সে মোতাবেক সরকারি-বেসরকারি তো আছেই; এমনকি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে পর্যন্ত নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানে গভীর শ্রদ্ধার সাথে সেসব নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে এবং পালন করা হয়েছে কিনা প্রমাণ স্বরূপ অনুষ্ঠানের ছবি তুলে অথবা ভিডিও করে তার কপি সংশ্লিষ্ট বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পাঠাতে হবে। এসব ক্ষেত্রেও কেউ কোনো প্রকার ফাঁকি-ঝুঁকি করে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুরে বেড়াবে অদৃশ্য দেবদূতেরা। 
সে-জন্যে ক্লাবের সদস্যরা স্থির করেছে, সরকারি নির্দেশনা তো পালন করবেই, তার বাইরেও বাড়তি কিছু করে সবাইকে দেখিয়ে দেবে যে, তারাও দেশপ্রেমিক হতে পারে। গক কয়েকবছর ধরে দেখে আসছি বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গরু-মহিষ জবাই করে বিরিয়ানি পাকিয়ে খায়। এবারো খোঁজ জানা যায়, আরো তিনদিন আগেই স্থানীয় হাটগুলোতে গরু-মহিষের টান পড়ে গেছে। যে-কারণে ক্লাবের সদস্যদেরকে ঢাকা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী-ভৈরব ঘুরে, শেষে নবীনগরের বাইশমোজাবাজার পয়ন্ত যেতে হয়েছে। তারপরও গুরু পায়নি। হাতির সাইজ দুটো মহিষ কিনে এনেছে। সেগুলো যবেহ করে বিরিয়ানি পাকিয়ে নিজেরাও খাবে, মহল্লার গরিব-গোরবাদেরও খাওয়াবে।
গরু কেনার মহড়া দেখে আমার কেনো যেনো সন্দেহ হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে দিনটা বিরিয়ানি দিবস হয়ে যায় কিনা!
আমি বিষয়টা নিয়ে একদিন প্রফেসর আতাউর রহমান স্যারের সাথে শেয়ার করতে গেলে তিনি বললেন, তোমার ধারণা অমূলক নয়, তবে এটাও ঠিক কেউ তা মন থেকে করছে বলে মনে হচ্ছে না। লোকদের অভিব্যক্তি দেখে আমি যদ্দূর আন্দাজ করতে পেরেছি, কিছু একটা তরে সবাই নিরাপদ থাকতে চাচ্ছে। মহাকবি আলাওলের একটা কথা আছে না—
‘পড়শি হৈলে শত্রু গৃহে থাকা দায়,
            নৃপতি হৈলে শত্রু দেশেত ন ঠাঁই।’


গতকাল মহল্লায় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। চৌধুরী সাহেবের মেজো ছেলে পবন নাকি তার বান্ধবীকে বাসায় ডেকে এনে বন্ধুদের নিয়ে রেপ করেছে। তারপর নানা প্রকার হুমকি ধুমকি দিয়ে মেয়েটাকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দেয়। মেয়েটাও চুপচাপ বাসায় চলে যায় এবং বাসায় যেয়েও কারো কাছে কিছু বলেনি। কথা বলেছে তার ব্লিডিং। মেয়েটা নাকি অনেক চেষ্টা করেছে রক্তের মুখ বন্ধ করতে। প্যাডের পর প্যাডে চাপা দিয়েছে। কাজ হয়নি। এক পর্যায়ে যখন তার মরণাপন্ন অবস্থা, তখনই সে দৌড় দেয় হাসপাতালের দিকে। এভাবেই এক পর্যায়ে ঘটনাটা সবার কাছে জানাজানি হয়ে যায়। মিডিয়াও এগিয়ে আসে, আসে পুলিশও। কিন্তু মেয়েটার মা-বাবা কারো কাছে কোনো প্রকার অভিযোগ করতে নারাজ। মেয়েটার বাবার একটাই কথা, যা হবার হয়েছে, যা জেনেছেন কেবল আপনারাই। আপনারা কোনো ধরনের রিপোর্ট না করলে আর কেউ জানতে পারবে না। ও হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেলেই আমরা আমাদের হোম-ডিস্ট্রিকে চলে যাবো। আপনার হোম ডিস্ট্রিক কোথায়, আপনি কী করেন, আপনার মেয়ে কোন কলেজে পড়তো, এ ধরনের অনেক প্রশ্নই করা হলো, শক্তগোছের লোকটি কোনো কথারই উত্তর দিলো না।
তখন আর কারো কিছু করার থাকে না। সবাই যার যার মতো হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে থাকে। পুলিশও চলে যাচ্ছিলো। তখনই কে যেনো ভিড়ের ভেতর পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলে ফেললো, স্যার, আমাগোর মাসুদ মিয়ার কোনো খবর আছেনি? প্রশ্ন শুনে পুলিশ ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে প্রশ্নকর্তাকে খুঁজতে থাকে। আমরাও লোকটাকে চেনার জন্যে অনেক কসরত করলাম, কিন্তু লোকটি যে-কারণেই হোক ধরা দেয়নি। তখন পুলিশই মুখ খুলে এবং জানায় আগামিকালই তাকে কোর্টে হাজির করে এবং তখনই আমরা জানতে পারি তার বিরুদ্ধে হত্যা-নাশকতাসহ সাতটি মামলা রয়েছে। এসব মামলার বাদিদেরকে আমরা না চিনলেও পুলিশ তাদেরকে চেনেন এবং তারা যাতে সুবিচার পেতে পারে সেজন্যে পুলিশ আদালতের কাছে ত্রিশ দিনের রিমান্ড চায়। মহামান্য আদালত তখন মাসুদের দিকে এক নজর তাকিয়ে দশ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তাতেও আমরাা খুশি। মনে মনে বলি, নিক রিমান্ডে। তবুও তো মানুষটাকে চোখের সামনে পাওয়া গেলো। এখন টাকা খরচ করলে অবশ্যই একটা কূল পাওয়া যাবে। চাহিদা অনুযায়ী মাল-মশলা দিতে পারলে রিমান্ডও নাকি পানিভাত হয়। ছেলেকে বাঁচাতে সিদ্দিকি সাহেব নিশ্চয়ই কার্পণ্য করবেন না।
(চলবে)

গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা ২

গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা ২

শুধু তোমার জন্য
রাকিবুল হাসান শ্রাবণ

কয়েকটা বসন্ত পেরিয়ে যাবে তোমার অপেক্ষায়।
রাষ্ট্রীয় কর পরিশোধ কোরে,
ঢুকে যাবো সেরা করদাতার তালিকায়।
জমানো টাকা থেকে অল্প অল্প কোরে
কিনবো আসবাব, সাজাবো ঘর
দেয়ালে করবো নতুন চুনকাম।

উঠোন সাজাবো ফুলে ফুলে
বাম পাশে হাসনাহেনা, ডানে গন্ধরাজ
সদর দরজায় থাকবে সন্ধ্যামালতী
গোলকচাঁপার শাদার মায়া মিশিয়ে
করবো চৈত্র উদযাপন।

অন্ধকার রাত গুলো
তুমি আমি পাশাপাশি বসে রবো,
কাছাকাছি বসে রবো,
হাতে হাত ছুঁয়ে করবো অন্ধকার মৈথুন।

এমন করেই আরও কয়েক বসন্ত পেরিয়ে গেলে
কার ক’টা চুল গেছে পেকে,
খুলে বসবো সে হিসেবের খাতা
পেয়ে যাবো ভালোবাসার ফলাফল।

শুধু তোমার জন্য,
মৃত্যুর সাথে হেঁটে হেঁটে করবো মার্চপাস্ট।        
                                



ভালোবাসা
সাঈদ চৌধুরী

একবার এক বিষন্ন কিশোরী বলেছিলো
আমি হাট থেকে বাড়ি ফেরার সময় যেন
তার উদ্যাম বারান্দার সামনে দিয়ে যাই
সে আমার হাঁটার সময় দোল খাওয়া চুলের সাথী হবে,
তাতে নাকি সে তার বন্দী জীবনের মুক্তি খোঁজে

আমি বলেছিলাম তোমাকে নিয়ে আমি রোদ্র  ¯œানে যাবো
একবার মেঘ ¯পর্শ করে বৃষ্টির গন্ধ দেবো
পূর্ণিমা রাতে কৃষকের লাঙলে অঙ্কিত অসমান ভূমিতে দাঁড়িয়ে
তোমার কপালে চুমোর দাগ কেটে ভালোবাসার বাঁধা পেরুবো
তুমি নিয়ম করে প্রতিদিন দাঁড়িও অপেক্ষাতে....

কিশোরী এখন পূর্নাঙ্গ নারী
বলা চলে আমার শরীরে প্রাণের অস্তিত্ব
সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এখন আমাকে ডাকে
বলে, শুধু সামান্য এ চাওয়াটুকুর জন্য হিমালয় সমান বাঁধা পেরিয়েছি
সাগর, মনি মুক্তার অভাবে হয়ত নারীর বিলাস জীবনে ক্ষত হয়
কিন্তু তোমার ভালোবাসা না পেলে আমি
আমার অস্তিত্বের বিলীন সময় দেখতাম
তাই, ভালোবাসি তোমাকে, খুব বেশী ভালোবাসি ....


এক ঘরে
যাহিদ সুবহান

আমাকে একঘরে করার বৃথা চেষ্টায় মত্ত তুমি
জানো না আমার শূন্য ঘরে বাতাসও কথা বলে
ঘরের বাতায়নগুলো আমার পাহাড়াদার
ঘরের ফুটকির আলো আমার বার্তাবাহক
পাখিরা কিচির মিচির শব্দে আমাকে গান শোনায়
আমার ছনের ঘরে মাকড়শা কাজের ফাঁকে গল্প শোনায়
আমাকে একঘরে করার চেষ্টা করে লাভ নেই
আমি একা নই আমার সাথে আছে পৃথিবী
বরং তুমিই একা চারপাশে অনেক প্রাণী মানুষ নেই ...  

অলস
মীর সাহাবুদ্দীন

শামুক আর কচ্ছপের গল্প পড়ে
পিঁপড়েকে পাঠ করি
কি ভাবে কাঁধে কাঁধে
ঠোঁটে, ঠোঁট রেখে দ্বিগুণ বহন করে পিঁপড়া
মানুষ অলসের দলে
ছায়া পেলে ঘুমাতে যায়।






কাগজের নৌকায় মাত্রাহীন আমি
ইকরামুল হাসান শাকিল

নীলাভ শাড়ীর আচঁলে বৃষ্টির শব্দে লেগে আছে
অপেলিয়ার মুক্ত ছন্দ
সমুদ্রের মৌসুমিতা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেখি
অক্ষরবৃত্তে তার বসবাস
বিংশ শতাব্দীর হে বালিকা আমার দৃষ্টিসীমার
যেটুকু পরিধি তারও
বহুদূরে আপনার ছড়ানো লতাপাতা
মাত্রাহীন আমি বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে
কাগজের নৌকো ভাসাই কাস্পিয়ান হ্রদে।



ইদানিং আমি
সবুজ আহমেদ কক্স

কোনো গিটার বেজে উঠলে
কোনো মিউজিক্যাল শো, বাড়ির বেডরুমে
হৃৎপিন্ডে কেমন যেনো  কম্পন শুরু হয় 
পেয়ে হারানোর বেদনা,
না পাওয়ার বেদনা আমাকে কাঁদায় অহর্নিশি।

মুহুর্তে  মুহূর্তে  চেঞ্জ হতে থাকি
ভুলে যাই আমি আমাকে
চিৎকার আসে কানে বারংবার।
কে আমি?
কে আমি?

এখন ইদানিং এসব কিছুই হয়না।
বালিশের একপাশে রবীন্দ্র সংগীত,
নজরুল সংগীত, দেশাত্মবোধ গান,
অন্যপাশে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ব্যান্ড মিউজিক ।

অলস সময়ে মিউজিক বেজে উঠে
কখন কি শুনি উপরঅলা জানে।

যন্ত্র বাজে বাজুক,
এসো, বেজে উঠি নব আয়োজন, নব উদ্যম
সুনিপুণ আঙুলের ছোঁয়ায়
সুরমূর্চ্ছনায় চোখ সমগ্রে ঝরে পড়ুক অনুরাগ...



বিধৌত
হাবিবাতুল ‍উম্মে

বুকের ভেতরটা খুঁড়ে দেখলাম
আগুন জ্বলছে, মৃতদের ‍উল্লাস

দিন যায়- অহমিকায় ঘুমিয়ে পড়ি
পাপের খসড়া জারি করে
কেবল ফেরারী হই...

তারপর কেউ কখনও
আমার কথা বলে না;
আমি মৃতদের একজন !

গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা

গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা

একটি কবিতা লিখবো
শরীফ সাথী

একটি কবিতা লিখবো বলে নিরবে নির্জনে একা
অম্লান নয়নে চেয়ে থেকেছি বহুক্ষন, বহুবার, বহুদিন, বহুমাস, বহু বছর।
বাড়ির পাশেই সবুজ পেখম মেলে বাতাসের ঢেউয়ে দোল খাওয়া
মিষ্টি মিষ্টি ডালের কচিকচি পাতার সমাহারে ছাওয়া আম্র গাছটির দিকে...
যে গাছটি জুড়ে বসত করে পাখিদের দল।
সেখানে দোয়েল কোয়েল ঘুঘু টিয়া, কুলঝুটি-পেঁচা শালিক-চড়–ইসহ
লাল-নীল হলুদ সাদার পালক বিছানো বৈচিত্রতায় ভরা নিদারুনভাবে
সৌন্দর্যে গড়া পাখিদের বিচিত্র জীবন-যাপনের মায়াবী চিত্র ফুঁটে থাকে।
তাকে ঘিরে যেন উঠে থাকে গগনের রবী নিশিতে রূপালী চাঁদ
আলোক বাতি দিয়ে সাথী করে মিশে আছে এই পরিবেশে।
শুধু একটি কবিতা লিখবো বলে আমার সুনয়না সুদৃষ্টি
অপলক থেকেছে সারাবেলা,পাখিদের মিলনমেলা চেয়ে বেয়ে গেছে
চোখের মায়াবী সমুজ্বল ঢেউ। কাঠবিড়ালী পাশের পাট খড়ি গাদা হতে
পাটের ফেঁসো সংগ্রহ করে হরদম দৌঁড় পাড়াপাড়িতে ব্যাস্ত সময়ের
চাওয়াটুকু যেন আমার নজর কেড়েছে। মগডালে বাসা বুনানো 
আপন হাতে আপন কারিগর চিত্রশিল্পীর কারুকার্য জীবন্ত ছবি ফুঁটে
ওঠে গাছটি ঘিরে।
শুধু একটি কবিতা লিখবো বলে গাছটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে
দেখেছি দু’নয়নের বহুছবি আঁকতে। মনের ফ্রেমে বন্দিকরে সন্ধি করে
রাখতে দেখেছি অতিথি পাখিদের আসা যাওয়া থাকা খাওয়ার
আত্মীয়তার বন্ধণ। ভালবাসার স্পন্দন আমরণ...।
দেখেছি মিষ্টি সুরে প্রাণ খুলে আনন্দে সানন্দে গায়তে গান।
শিশির ভেজা লগ্নে মৌমাছিদের আম্র মুকুলের ঘ্রাণ ছড়াতে দেখেছি।
মায়াবী সুরের ছন্দে বাতাসে সুমিষ্টি গন্ধ ভাসতে দেখেছি।
শুধু একটি কবিতা লিখবো বলে চেয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে
হঠাৎ কাল-বৈশাখীর উড়ন্ত দূরন্ত দমকা ঝড় এসে মড়াৎ করে ভেঙে
ছড়িয়ে দিলো চতুর্পার্শ্বে আম্র-গাছটির তরতাজা ডালপালা।
নিমিষেই ম্লান হলো প্রতিক্ষীত এতো চাওয়ার অবসান ঘটাতে।
আজ আর সেখানে নেই পাখিদের কোলাহল। ফাঁকা শুধুই ফাঁকা চারিপাশ।
সেই অপেক্ষামান চাওয়া ফিরে পেতে পরিপূর্ণ একটি কবিতা লিখতে
আবার সবার নজর কাড়তেই নিজ হাতে প্রীতি সাথে রোপণ করেছি
আর একটি নতুন  আম্র গাছের চারা...। শুধু একটি কবিতা লিখবো বলে
অপেক্ষার পথ  পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি আজ ও জানি না এ অপেক্ষার
শেষ কোথায়...?


ভোরের মুখ
অসীম মালিক

মৃত শালিকের পাশে শুয়ে আছে
         একটি মৃত ভোর ।
যার নিথর ডানায় নেই ,
                 আজ মুক্তির আনন্দ !

রক্ত হিম হয়ে যাওয়া দুটি ডানায় ,
এক ঝাঁক লাল পিঁপড়ের প্রত্যাশিত দখলদারি ।
স্পন্দনহীন মুক্তির শরীর,
                তারা মহানন্দে ভাগ করে খায়

এ রাস্তায় এখনও কুকুর আসেনি,
এ রাস্তায় এখনও বিড়াল আসেনি ।
           এলেও আজ পাখির চোখে ফিরে তাকাবেনা-
                              ডানার স্বাধীনতা...

কতশত শুঁয়োপোকা ,
প্রজাপতি হয়ে ফিরে আসে ।
কিন্তু মৃত শালিকের ডানায় ভর করে
                   রাত্রি দ্যাখেনা ভোরের মুখ ।


তোমাকেই ভালোবাসি
মাহবুবা নাছরিন শিশির

দূরে সরে যাই তবু কেন যেন বারবার ফিরে আসি
হয়তো আমার আমি আজো শুধু তোমাকেই ভালোবাসি
ছিলে তুমি, আজো আছো জানি, জানি থাকবে হৃদয় জুড়ে
ছায়ার মতই মিশে রবে তুমি এ আমার পাশাপাশি।

অভিমান-রাগ-ক্ষোভ সব কিছু তোমার বচনে হারে
তুমি ডাক দিলে অশান্ত দিলে শান্তি আসতে পারে
সুখ তো সয় না কপালে রয় না অস্থির মতিগতি
তাই অভিমানে দুঃখ পালনে ছুঁড়ে ফেলি কারাগারে।

বিরহ-দহনে অনুভব করি ভালোবাসি ভালোবাসি
আধেক দিনের বাকসংযমী, দিন শেষে ছুটে আসি
সহস্র কথা অব্যক্ত ব্যথা জল হয়ে ঝরে পড়ে
তোমার চোখের হাসিটি দেখলে ফোটে দুই চোখে হাসি।

একলা তুমি খুব অভিমানী? আমারও অভিমান আছে
শোধ নিতে চেয়ে  চলে যাবে তুমি অন্য কারোর কাছে?
পরাধীন নও, মুক্তি দিলাম; যত দূরে চাও, যাও
স্মৃতির জানালা খিল আঁটা রেখে কতদিন প্রাণ বাঁচে?
 
ফেরা না ফেরার মন্ত্র তোমার তুমি চলো নিজ মতে!
শত ব্যস্ততা তার অবসরে চেয়ে রব চেনা পথে
চোখের পাতায় পুরনো দিনের খুনসুটি কল্পনা
মুখে না বলেও ‘ভালোবাসি’ বীজ বাড়বে হৃদয়-ক্ষতে।


রাস্তা
আশিক বিন রহিম

সকালের প্রথম রোদে প্রায়ই আমি বড় রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকি।
দেখি; দূর থেকে আসা যন্ত্রদানবগুলো কি করে বড় হতে হতে
আমার সামনে আসে।
তারপর পায়ের কাছের মাটিকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছোট হতে হতে
ছোটোয় মিলিয়ে যায়; হরিয়ে যায়।

সকালে সোনা রোদ বিছানো ধানিজমিতে প্রায়ই আমি বাবাকে খুঁজি।
দেখি; কাঁধের গামছা দিয়ে তিনি ঘাম-ক্লান্তি মুছে মুছে কি করে
কাদা মাটিতে স্বপ্ন আঁকেন।
তার পর চাকার মতো ঘুরে আমাদের-বড় করতে করতে
নিজেই শুণ্যে মিলিয়ে যান; হারিয়ে যান।

এই যে চৌকাঠে ঘর, সান বাঁধানো ঘাট, বাড়ির উঠোনে পেয়ারা গাছ
এ সব কিছুই তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন।
পুকুরের বড় মাছ, মুরগির প্রথম ডিম আমরা খেলেই বাবা সুখি হতেন;
হয়তো হাসতেন।

অথচ কি আশ্চর্য; একদিন বাবাও নাকি জুতা কিনছেন।
নতুন জামা কিনতে মাটির ব্যাংক-বাঁশের খোঁড়লে পয়সা জমাতেন।
একটা ফুলতোলা রুমালের অপেক্ষায় মামাদের আম বাগানে-
রাতভর মশা তাড়াতেন।

আজ বাবা নেই; আমাদের পোয়াতি জমি, মাচের পুকুর আর
আমের মুকুল-শোভা বিশাল বাগান-সব এখন ইট আর কংক্রীটের দখলে।
যন্ত্রদানবের নিষিদ্ধ মিছিল আমাদের বড় রাস্তাটাগুলো খেয়ে ছোট
থেকে- আরোও ছোট করছে দিনি দিনে।

তালা সিরিজ : দিশারী মুখোপাধ্যায়

তালা সিরিজ : দিশারী মুখোপাধ্যায়


তালা সিরিজ
দিশারী মুখোপাধ্যায়



আমি কেবল তোমাকে দেখছিলাম
কিভাবে তোমার ভেতরের নক্সাকে বুঝব
তোমার মনের মধ্যে ঢুকব
ঢোকার পর খুলব
খুলে যাওয়ার পর আমি
তোমার সঙ্গেই ঝুলে থাকব

ওরা সবাই দরজার কথা বলছিল
তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ নিয়ে
তার কাঠের শরীরের কারুকাজ নিয়ে
এমনকি সেই কাঠের বাজারদর নিয়ে
একজন দরজার প্রতিশব্দগুলো সাজাচ্ছিল
কেউ খুঁজে খুঁজে বার করছিল তার অনুবাদগুলো
একজনতো দরজার উপর একটা বিস্ফোরক ভাষণই দিয়ে দিল
বাকিরা সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল
একটা দরজা বিক্রির দোকানে

আমি কেবল তোমাকে দেখছিলাম
আর ভেতরে ঢোকার মতলব করছিলাম




বাজারে কথাটা ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মত
সে নাকি অন্য জনের হাতে খুলে গেছে

হু হু করে বিক্রি হতে শুরু করল
বহুদিনের পুরনো অব্যবহৃত খিস্তিখেউড়গুলো
ক্রেতাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু চাই
যে লোকটার হাতে সে খুলেছে
তাকে তো কিছু উপহার দেওয়া দরকার

কথাটা আদালত পর্যন্ত গড়াল
মহামান্য বিচারপতি সব শুনলেন মন দিয়ে
তারপর শাস্ত্রবিদদের মতামত চাইলেন
অবশেষে যে হাতে সে খুলেছিল
সেই হাতটিকে বলা হল আর একবার খুলে দেখাতে
মহামান্য আদালতের সামনে



লাগিয়ে যাওয়ার পর থেকেই চিন্তা হয়
খুলবে তো ?

অফিসে যাই
জ্ঞাতিকুটুমের বাড়িতে যাই
নিছক বেড়াতেও যাই কাছাকাছি বা দূর
বাজার যাই
চুলদাড়ি কাটাতেও কিম্বা
ইলেকট্রিক বিল, জলের বিল, হোল্ডিংট্যাক্সের জন্য

হেঁটে যাই
মোটরসাইকেলে যাই
বাসে,  ট্রেনে, প্লেনে চেপেও

মনে সবসময় একটাই চিন্তা খিঁচখিঁচ করে
খুলবে তো



কেনার সময়ই দোকানদার বলেছিল-
নিয়মিত ব্যবহার করবেন
আর মাঝেমধ্যে তেল দেবেন

ঠিকঠাকই চলছিল দীর্ঘদিন
হঠাৎ কিছুদিন হল
তার আচরণে রহস্য দেখা দিয়েছে
লাগাবার সময় খুলে যাচ্ছে
লেগে যাচ্ছে খুলবার সময়

সেই লোকটাকে একদিন ডাকলাম
রিংএর মধ্যে গোছাগোছা চাবি সাজিয়ে নিয়ে
যাকে ঘুরতে দেখাও যায় অবরে সবরে
এপাড়ায় ওপাড়ায়
ওর গোছা থেকে বিভিন্ন রকমের চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল
রোগী দেখা শেষ হলে বলল-
জিনিষটা খারাপ হয়ে গেছে চাবির দোষে




ঝুলে আছে আজ বহুদিন
মুখ খোলে না
কোনো কথাও বলে না
অথচ স্পষ্টতই বোঝা যায়
বহু কথা তার ভেতরে মৌন রয়ে আছে

কেউ কোনো একদিন তাকে
প্রহরী করে রেখে গেছে
এই কাজ আর কতদিন সে নিজেও জানেনা

চারপাশের পৃথিবীটা একদিন হয়তো ভেঙে পড়বে
তবু তার মুখ খোলার কোনো উপায় থাকবে না
যতদিন না মৃত্যু এসে তাকে মুক্তি দেয়




পলেস্তারা খসে পড়েছে
ছাদ ভেঙে ঝুলছে এখানে ওখানে
ফ্রেম সহ জানালা খুলে নিয়ে গেছে কেউ
দরজার অধিকাংশটুকুই উইপোকায় হজম করেছে
শুধু বালাদুটো আঁকড়ে ধরে ঝুলে আছ তুমি

বিষধরগুলো যাওয়া আসা করে যখন তখন
বাদুড় চামচিকে এসে অসহ্য দিনটুকু পার করে নেয় কোনোক্রমে
অজানা লোকের একটি শবও এসে একদিন আশ্রয় নেয় এইখানে
তুমি সব দেখ নির্বিকার

যতক্ষণ তুমি আছ
ততক্ষণ অতীতের ফটোকপি পাওয়া যাবে
জেরক্স মেশিনে !

স্বাধীনচেতা কবি : সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী

স্বাধীনচেতা কবি : সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী


স্বাধীনচেতা কবি
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী

মীম মিজান

যে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য সোনার অক্ষরে লিপিবদ্ধ। কেন সেই জাতি আজ নিগৃহীত-লাঞ্চিত? যারা ছিল শাসক ও উত্তম রাষ্ট্রনেতা, কেন তারা আজ শোষিত, পরাজিত ও করুণার পাত্র প্রজা? সেই নিগৃহীত জনগোষ্ঠীটি হলো দিবানিদ্রারত আয়েশী জীবনের পাবন্দ অলস-অকর্মণ্য মুসলিম সমাজ। সেই চোখখুলে দিবানিদ্রারত মুসলিম সমাজকে ডেকে যাচ্ছেন একজন স্বাধীনচেতা মানুষ ও কবি তার নাম হলো সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী। তার আহ্বানটি ছিল,
‘আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া,
উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া,
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া,
পূত বিভূ নাম স্মরণ করি।’
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সেই ঐতিহ্যবোধের কবি ইসমাঈল হোসেন শিরাজী ১৮৮০ সালের ১৩ জুলাই তারিখে তৎকালীন পাবনা জেলার অন্তর্গত সিরাজগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার সম্পূর্ণ নাম ছিল গাজী - এ- বলকান মওলানা আবু মোহাম্মদ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। ( কবি পৈৗত্র পীরজাদা সৈয়দ মুনীর উদ্দৌলা শামীম শিরাজী)। এখানে উল্লেখ্য যে, তার পরিবারের সদস্যগণ শিরাজী বানানে তার পদবি উল্লেখ করেছেন। তাই আমি শিরাজী বানান সিরাজী লিখিনি। উৎস হিসেবে তার পৌত্রের লেখা তাকে নিয়ে অনেকগুলো প্রবন্ধ দেখা যেতে পারে। তার বাবার নাম সৈয়দ আবদুল করীম এবং মাতার নাম নুরজাহান বেগম। তারা উভয়েই ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার মানুষ।
শিশু ইসমাইল হোসেনের লেখাপড়ার প্রথম সবক দেন তার মা নূরজাহান খানম। নূরজাহান খানম তার শিশুপুত্রকে প্রথমেই কোরআন শিক্ষা দেন। কোরআন শিক্ষা শেষ হলে তাকে মধ্য ইংরেজী স্কুলে ভর্তি করা হয়। মেধাবী ইসমাইল হোসেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সিরাজগঞ্জের বিএল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে এ সম্ভাবনাময় তরুণ লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আর অগ্রসর হতে পারেন নি। তাছাড়া স্বদেশের পরাধীনতা, সমগ্র মুসলিম জাহানের দুর্দশার জন্য বেদনাবোধ হতে সৃষ্টি উৎকন্ঠাও তাঁকে স্কুলের চার দেয়ালের মধ্যে বসে থাকতে দেয় নি।
তিনি এ সময়ে নির্যাতিত অবহেলিত, লাঞ্চিত ও পদদলিত মুসলিম জাতির জন্য বেদনাবিধুর, এতই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে তুরস্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এ যাত্রায় তিনি তুরস্কে যেতে পারেন নি ঠিক কিন্তু সেই যে মুসলিম জাহানের কল্যাণের মানসে ঘর হতে বের হলেন আর কখনই সুবোধ বালকের মত ঘরে বসে থাকেননি। অবশ্য তিনি পরবর্তীকালের তার বাল্যকালের স্বপ্নের তুরস্কে গিয়েছিলেন তা অনেক পরের কথা।
ইসমাইল হোসেন শিরাজীর সবচেয়ে পরিচিত কাব্যগ্রন্থ হল ‘অনল প্রবাহ’। এটি ১৮৯৯ সনে মুনসী মেহেরউল্লা প্রথম প্রকাশ করেন। পুস্তিকাটি এত জনপ্রিয় ছিল যে ১৯০০ সালে আরো কিছু কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি আবার প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯০৮ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। আর এ সময়ই ‘অনল প্রবাহ’ ও লেখক বৃটিশ রাজশক্তির আক্রমণের শিকার হন। ‘অনল প্রবাহ' বাজেয়াপ্ত হয় এবং লেখকের দু’বছর কারাদন্ড হয়। তিনিই প্রথম কবি যার কাব্যগ্রন্থ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় এবং তিনিই বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে কারাদন্ড ভোগকারী উপমহাদেশের প্রথম সাহিত্যিক।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও মিথ্যা অপপ্রচার করতো তখন হিন্দু কবি সাহিত্যিকরা। বিশেষ করে চরম মুসলিম বিদ্বেষী ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার লেখায় সুপরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের হেয় করার চেষ্টা করতেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজী এ সমস্ত কুৎসিৎ লেখার জবাব দিতে গিয়ে উপন্যাসও রচনা করেন। তার উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে তারাবাই, ফিরোজা বেগম, নুরুদ্দীন, রায়নন্দিনী ও বংকিম দুহিতা। না, জবাব দিতে গিয়ে শিরাজী প্রতিআক্রমণ বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি বেছে নেননি। সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় উপন্যাসে তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন। ইসমাইল হোসেন শিরাজীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘রায় নন্দিনী’।
শিরাজী রচিত কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী ও সঙ্গীত বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের সংখ্যা ৩২টি।
এগুলোর হচ্ছে, কাব্যগ্রন্থ: উচ্ছ্বাস (১৯০৭), নব উদ্দীপনা (১৯০৭), উদ্বোধন (১৯০৮), স্পেন বিজয় কাব্য (১৯৮৪), মহাশিক্ষা কাব্য প্রথম খন্ড (১৯৬৯), মহাশিক্ষা কাব্য দ্বিতীয় খন্ড (১৯৭১)।
উপন্যাস: রায়নন্দিনী (১৯১৫), তারাবাঈ (১৯১৬), নূরউদ্দীন (১৯১৯)।
প্রবন্ধ গ্রন্থ: মহানগরী কর্ডোভা (১৯০৭), স্ত্রীশিক্ষা (১৯০৭), আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪), সুচিন্তা প্রথম খন্ড (১৯১৬), তুর্কি নারী জীবন (১৯১৩)।
ভ্রমণ কাহিনী: তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১৩)। সঙ্গীত গ্রন্থ- সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬), প্রেমাঞ্জলী (১৯১৬) প্রভৃতি।
অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: সুধাঞ্জলী, গৌরব কাহিনী, কুসুমাঞ্জলী, আবে হায়াৎ, কাব্য কুসুমোদ্যান, পুস্পাঞ্জলী।
অসমাপ্ত উপন্যাস: বঙ্গ ও বিহার বিজয় এবং জাহানারা।
গোটা বিশ্বের মধ্যে প্রথম মুসলিম কবি কে? যিনি কবিতা লেখার অভিযোগে দুই বছর সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করেছিলেন, দেশের কোন কবি বাগ্মীশ্রেষ্ঠের মৃত্যুর পর তুরস্কের জাতির জনক মোস্তাফা কামাল আতাতুর্ক প্রথম শোক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। কোন বিদ্রোহী কবির বই বাজেয়াপ্ত করার পর ব্রিটিশ ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ লয়ের তার পারিবারিক লাইব্রেরী পরিদর্শন করে নির্দ্বিধায় নিঃসঙ্কোচে দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন, গজ. ঝঐওজঅতঊঊ ঘঙঞ ঙঘখণ অ ঘঅঞওঙঘঅখ চঙঊঞ অঘউ এজঊঅঞ ঙজঅঞঙজ ইটঞ অখঝঙ অ এজঊঅঞ ঝঈঐঙখঅজ (শিরাজী শুধুমাত্র একজন জাতীয় কবি এবং উচ্চস্তরের বাগ্মীই নয় একজন বিরাট পন্ডিতও বটে)। হ্যাঁ! তিনিই আমাদের শিরাজী।
১৯৪০ সালের ২২ মার্চ কলিকাতা ২/১ ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে, সিরাজী পাবলিক লাইব্রেরী ও ফ্রি রিডিং রুম- এর উদ্বোধন করা হয়। উক্ত দ্বারোঘাটন অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘সিরাজী সাহেব ছিলেন আমার পিতৃতুল্য। তিনি আমাকে ভাবিতেন জ্যেষ্ঠ পুত্র-তুল্য। তাঁহার নিকট যে স্নেহ আমি জীবনে পাইয়াছি তাহা আমার জীবনের পরম সঞ্চয়। ফরিদপুর কনফারেন্সে তাঁহার সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তাঁহার সমগ্রজীবনই ছিল অনল প্রবাহ এবং আমার রচনায় সেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গের প্রকাশ আছে। সাহিত্যিক ও রাজনীতিক ছাড়াও আমার চোখে তিনি প্রতিভাত হয়েছিলেন এক শক্তিমান দরবেশ রূপে। মৃত্যুকে তিনি ভয় করেন নাই, তুরস্কের রণক্ষেত্রে তিনি সেই মৃত্যুর সঙ্গে করিয়াছিলেন মুখোমুখি। তাই অস্তিমে মৃত্যু তাঁহার জন্য আনিয়া দিয়াছিল মহাজীবনের আস্বাদ।’
পল্লীকবি জসিমউদ্দিন শিরাজী স্মরণে লেখেন (হোসেন মোহাম্মদ সম্পাদিত সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর সংকলন ১৯ পৃষ্ঠা) ‘সকালবেলা শিরাজী সাহেবের নিকট হইতে বিদায় লইয়া বাড়ি ফিরিবার সময় তিনি আমার হাত ধরিয়া বলিলেন, ‘জসীম! তুমি ত কবি! কবিরা নাকি দেশের দূর-ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। বলতে পার আমার এই আজন্ম সাধনা কি একদিন সফল হবে? আমি নিজের জন্যে সম্মান চাইনে, অর্থ সম্পদ চাইনে, আমি চাই এই ঘুমন্ত জাত আবার মাথা নাড়া দিয়ে জেগে উঠুক- সিংহ গর্জনে হুঙ্কার দিয়ে উঠুক। আমি চাই এমনই একটি মুসলিম-সমাজ, যারা বিদ্যায়, সাহিত্যে, সাহসে, আত্মত্যাগে কারুর চাইতে পিছপা হবে না। যা কিছু মিথ্যা, যা কিছু অন্ধ কুসংস্কার তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। দেশের মেয়েদের পরদায় আবদ্ধ রেখে তাদের কাছ থেকে দুনিয়ার আলো-বাতাস বন্ধ করে রাখবে না স্বাধীন সজীব একটি মুসলিম জাতি। বলত জসীম! একি আমি দেখে যেতে পারব?
আমি বলিলাম, ‘আপনি আজীবন সাধনা করেছেন আমাদের জন্যে। আমাদের অনাগত জীবনের সাধনায় আপনার সেই স্বপ্নকে আমরা রূপ দেব। নিশ্চয় আপনার স্বপ্ন সার্থক হবে।’
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বড় দুর্ভাগ্য যে আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা মহান পুরুষ শিরাজীকে হীনমন্যতার কারণে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। দেশের মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পাঠ্যসূচিতে শিরাজী রচনাবলী উপেক্ষিত। শিরাজীর লেখা থেকে বঞ্চিত এদেশের শিক্ষার্থীরা। শিরাজী সম্পর্কে তরুণ সমাজকে জানতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ শিরাজীর অনলবর্ষী  বক্তৃতায় প্রকম্পিত হয়েছিলো ব্রিটিশ সিংহাসন। তার কণ্ঠ ও লেখা থেকে বারুদের গন্ধ বের হতো। তার বক্তৃতায় জেগে ওঠেছিলো লাখো লাখো তরুণ। সেখানে মুসলিম বা হিন্দু বলে কোনো প্রশ্নের সৃষ্টি হয় নাই। ব্রিটিশ রাজ শুধু তাকে কারাবন্দীই করেনি, তার কবিতাও নিষিদ্ধ করেছিলো। সেই স্বাধীনচেতা মহাকবিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অবমূল্যায়ন করছেন।
যারা মুসলমানদেরকে লাইভস্টক বা গৃহপালিত পশু বলে আখ্যায়িত করছে, যারা আমাদেরকে কাক পক্ষী, দস্যু, তস্কর, দানব, অসুর, অনার্য, ইতর, নরপশু, ডাকাত বলে গালি দিয়েছে তাদের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী ঘটা করে পালন করা হয়। তাদের লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের। অথচ শিরাজীর মত মহানায়কের রচনাবলী পাঠ্য বহির্ভূতই থেকে যাচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশের ক্রান্তিকালীন দুর্বিষহ অবস্থার প্রেক্ষিতে শিরাজীর মতো বিপ্লবী পুরুষের প্রসঙ্গ টেনে আনা অতীব জরুরী।
ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশী জাতি সৃষ্টির এই গঠনকালে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর উদারতা, দৃঢ়তা, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাতন্ত্র্যবাদ, ঐতিহ্য চেতনা, সংস্কৃতি চেতনা, বিজ্ঞান-ইতিহাস ও সাহিত্য-চেতনা প্রভৃতি থেকে প্রেরণা আহরণ একান্ত কর্তব্য। ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম দশক থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত সারা উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে যে জাতীয় ঐক্যবোধ, জাগরণ স্পৃহা আপন জাতীয় সত্ত্বার পরিচয় ফুটিয়ে তোলার আকাক্সক্ষা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে যে প্রতিষ্ঠা অর্জনের প্রয়াস তীব্র আবেগে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবোধের প্রেক্ষিতে সেই উদ্যম নিষ্ঠা ও কর্ম-চাঞ্চল্য একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠেছে। আবশ্যক হয়ে উঠেছে আজ আবার নতুন করে ঘনিয়ে ওঠা বিভ্রান্তির, দিশাহীনতার দিগন্তের কালো আবরণ ভেদ করে আলোকবন্যা আবাহনের জন্য নতুন করে গর্জে ওঠা হাজার হাজার সিরাজীর।’
‘কবি গাজী শিরাজী যার লেখনী ও বাগ্মিতায় আগুন ঝরতো' শীর্ষক প্রবন্ধে কবি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘দেশের অন্যতম দ্বীপপাল ধর্ম, সাহিত্য, রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক মহাকবি, মহাবাগ্মী, অকুতোভয় সাংবাদিক, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত, মুসলিম রেনেসার কবি, ঔপন্যাসিক, যোদ্ধা, সমাজসংস্কারক, নারী জাগরণের অগ্রদূত, কৃষক নেতা, শিক্ষা ব্রতী, দেশপ্রেমিক, ধর্মীয় নেতা, আধ্যাত্মিক সাধক অনল প্রবাহের কারা লাঞ্ছিত অমর কবি গাজী - এ- বলকান মরহুম মওলানা আবু মোহাম্মদ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। তিনি দেশের প্রথম বিদ্রোহী কবি, যার লেখায় ঝরতো আগুন। নানা বিশেষণের তিনি ভূষিত হয়েছিলেন- বাগ্মী শ্রেষ্ঠ, কবিকুল- সূর্য; সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল লেখক, অগ্নি পুরুষ, পন্ডিত প্রবর, অনল বর্ষী বাগ্মী, বঙ্গকেশরী, সিংহ সাবক, বাগ্মী প্রবর, বাণী সাগর, জাতিবন্ধু, ইসলাম জগতের নেতা, আধ্যাত্ম সাধক ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন সিরাজগঞ্জের সিংহ সাবক বাংলার শিরাজী। গাজী ইসমাইল হোসেন শিরাজী সারা বিশ্বের অন্যায় শাসন শোষণের বিরোধিতা করেছেন, সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। উপর্যুক্ত আলোচনা ও তার সমসাময়িক গবেষক, কবি- সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সম্পাদকগণের তাকে নিয়ে মূল্যায়ন থেকে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে শিরাজী একজন স্বাধীনচেতা কবি ও পরাধীনতার শৃঙ্খলকে ভাঙ্গার বিদ্রোহী কবি।
মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই দুরারোগ্য পৃষ্ঠব্রণ রোগে আক্রান্ত হয়ে মুসলিম বিশ্বের এই মহান পুরুষ ইন্তিকাল করেন। জীবনের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বপ্রকার অনাচার, কদাচার, কুসংস্কার, অন্যায় ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সিংহের মত লড়ে গেছেন। না কোথাও কোন কারণে তিনি মাথা নত করেন নি। আজ সেই স্বাধীনচেতা কবির ৮৭তম মৃত্যুবার্ষিক। আসুন তার এই প্রয়াণ দিবসে আমরা শপথ নেই দেশপ্রেমিক হওয়ার! তার অমূল্যবান সাহিত্যকর্মসমূহের ব্যপক পঠণ ও গবেষণার দাবি রাখে।