বসন্তের পদাবলি

বসন্তের পদাবলি


দরদ
মাহমুদ নোমান

হঠাৎ আগুন ধরে গেল
ওয়াবীলতার চাঙেÑ
পোড়া মাংসের রঙ,
ঝুরঝুরে শিরা উপশিরা নিয়ে
ঝুলে আছে মাতৃতুল্যা গাছে

কফি পান করতেই,
নাকে এলো এ পোড়া ঘ্রাণ
কালো চাঁমের আকুতি-মিনতি ।


ছোঁয়া
সজল কুমার টিকাদার

তোর ওই একটুখানি ছোঁয়া
হাঁটতে হাঁটতে আজ
                   হৃদয়ের কাছে।

যেমন, সাগর মহাসাগর ঘুরে
অবশেষে জাহাজ পৌঁছায়
চূড়ান্ত বন্দরে !



চুলগুলো এলামেলো করে দাও
অনন্ত পৃথ্বীরাজ

মুখটা গোমরা করে রেখেছো কেন
চোখের কাজল মুছে যাবে!
বর্ষার ধারায় তোমার মনে কী এতো ঢেউ
স্থির, আনত দৃষ্টি
তোমার জন্য ঢাকার রাস্তায় যানজট বাড়ায়

কদমফুল সব ফুটেছে কী!
তোমরা বুকে উত্তাল সমুদ্র
সেখানে জলপিপিরা খেলা করে
তুমিও খেলাও রাতের সমুদ্রে

তোমার নির্জন পথের প্রান্তে; দিগন্তে
কে যেন দাঁড়িয়ে থাকেÑ
চোখ খুলে চেয়ে দেখো দৃষ্টির সীমানায়Ñ
মেঘের গর্জন, অবাধ্য চুল, ওড়না নাই, ঘোমটাহীন
কেবল এক টুকরো আঁচল ঝুঁলছে
ঝুলে আছে নক্ষত্রের মতন কতগুলো উদ্বাস্ত কষ্ট

বর্ষার জলের ধারায় পুরাতন কষ্টেরা
কেন যে মাথাচারা দেয়!!


তুমিও কি হতে চাও বসন্তপ্রেমিক ?
নাফছি জাহান

চতুর্দিকে প্রকৃতি আজ নন্দিত অপূর্ব সাজে সজ্জিত,
ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে মাতোয়ারা হয়ে
তুমিও কি হতে চাও বসন্তপ্রেমিক ?
আ¤্রমুকুলের মিষ্টি সুবাসে মোহ মোহ চারিদিক,
গৌধূলির লগ্নে মৌমাছির সনে পাল্লা দিয়ে
ফুলের সুবাসে মন ভরাবো দু’জনে,
শেষ বিকেলের স্বাদ নেবো এই ফাগুনে।

শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া দু’হাত বাড়িয়ে
অতি আদরে ডাকছে কাছে,
মলিনতা বিসর্জন দিয়ে-
একরাশ রক্তরাঙা আভা মেখেছে গায়ে।
বসন্তের কোকিল আপন মনে,
কুহু কুহু গাইছে গান সুমধুর সুরে।

সমন্ত প্রান্তর জুড়ে-
বসন্তের অপরূপ শোভা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
এ মিষ্টি বসন্তেই-
প্রকৃতির প্রকৃত স্বাদ অন্বেষণ করবো বলে,
তোমায় নিয়ে অগ্রসরমান হবো-
অরণ্যশোভিত পর্বতমূলে, মিষ্টি সমীরণের রাজ্যে।

পাখি
আরিফুর রহমান

তোমার চিরনিদ্রার শোক-পাখি আমাকে জাগিয়ে রাখে!
রাত বেড়ে যায়, চিরকালীন তার গতিবেগ;
রাত শেষে আসে দিন নির্ঘুমতার কলসি কাঁখে
দর্শক হয়ে, দেখি মানুষের ক্ষয়িষ্ণু আয়ু ও আবেগ।

দেখি কাশবনে এখন পড়ে থাকে বেওয়ারিশ লাশ
কুকুর, শেয়াল, শকুন, শূকর একত্রে আহা!
তরতাজা নরমাংসে ঝাঁপিয়ে পড়ে, করে উল্লাস

‘ভরা যৈবনে বিধবা হইব এই ছিল কপালে লেহা’

এই বাক্যটিই লাঙল চালায় এই নিদাগ অন্তরে!
দুঃখ-হিম জমে বরফ কুচি হয়েছে সব সুখ-সুন্দর
তাই জেগে থাকার আর সাধ নেই এই বিশ্ব-বন্দরে,
তবুও কেন যে তোমার পাখি ডানা ঝাপটায় নিরন্তর!

দলছুট পাখিটা
আলমগীর কবির

দলছুট পাখিটা
উড়তে উড়তে একদিন পথ ভুলে গেলো।

বিবর্ণ দিনের ভাঁজে
তার জমানো ছিলো কিছু দুঃখের পালক।

দলছুট পাখিটা
একদিন স্বপ্নের রং বুকে নিয়েছিল মেখে
আকাশ জয়ের স্বপ্ন ছিল তার ডানায়।

কোনো এক ঝড়ের রাতে পাখিটা
হারিয়ে ফেলে তার সুরের বাঁশি।

দলছুট পাখিটা
এখনো বসে থাকে
প্রতীক্ষা মেঘের প্রহর তার কাটে না।

তবু
পাখিটা বসে থাকে
হারিয়ে যাওয়া পাখিটা ফেরার আশায়।

ফাগুনের দ্বিতীয় পক্ষ
স্বপন শর্মা

ভালোবাসা ফুঁপিয়ে কাঁদে ফাগুন এলে।
বন্ধ ঘরের খিল এঁটে দেই শক্ত হাতে
পাষাণ নামের হৃদয় মাঝে-
প্রেম নামক সেই নিখোঁজ বস্তুর সন্ধানে
ফাগুনের একপক্ষ শেষ হলো আজ।

শিমুল ফুলের রঙ দেখে নিজেকে সাজিয়ে নিই,
সঙ সাজার মতো করে।
নয়নতারা সোনালু ফুলে হলদে বাসন্তী
পথের ধারে থরে থরে সাজিয়ে রাখা
ফুলদানির সেই উপচে পড়া হলদে রঙে
নিজেকে সেথায় লুকিয়ে রাখি।
নিভৃত নির্জনে প্রেম খুঁজি ফাগুনের দ্বিতীয় পক্ষে
সেই অচলা প্রেমময় জীবন সাজাতে।


জল আয়না
সুজিত মান্না

দূর থেকে দেখে উপলব্ধি করি
Ñজলতলের ওপর কয়েকটা গাছ আর মেঘেরা
                              একে অপরকে সুযোগ পেলেই ছুঁয়ে দেয়

Ñএই জল-আয়নায় মুখ ঢেকে নেওয়া
    আসলে একটা মায়াবী স্বপ্নের মতো

এখানে মেঘেরা সহজেই গাছ পেরিয়ে বাড়িকেও নাড়িয়ে দেয়

উড়ে চলে যাওয়া ডানাদের বুকে ধানক্ষেত দুর্বল দেখে
হাসপাতাল ফেরত ফড়িংয়ের মতো
                           Ñজল-আয়নার পাশে গিয়ে বসি

ঢেউয়ের উপস্থিতিগুলো একে একে থেরাপির মতো আসে
কখনো মেঘ নামাই, কখনো গাছের পাতাদের দোলন;
কমবেশি যেভাবেই হোক আমার সুস্থ্যতা তুলে আনতে হবে

নক্ষত্র
মহাজিস মণ্ডল

বিকেলের শেষ রোদ্দুরের মতন
বিকেলের শেষ রঙের মতন
তুমিও ছড়িয়ে আছো আকাশে-আকাশে

সময়ের সীমারেখা বরাবর আমিও হেঁটে যাই
তোমার স্তব্ধতা ঘিরে থাকে ঝরা পাতার মতো চারপাশে

সমন্ত নদীর শব্দ তবুও আমি জড় করে রাখি বুকে
তোমার নিঃশব্দ সন্ধ্যার সমুদ্র পেরিয়ে
রাতের ডানায় ডানায় এঁকে দিতে
অনন্ত জোনাকির নক্ষত্র !

নদীটার বাঁক বদল হয়েছে
সুমন আহমেদ

চন্দ্রিমা,পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে নিত্য তোমার
আনাগোনা; তুমি তো সমস্ত পৃথিবীর রাখো খোঁজ...
বলনা আমার নদীটা কেমন আছে?
আজ কতদিন হয়ে গেলো দেখিনা আমার প্রিয় নদীটাকে।
শুনেছি আজকাল নদীটার বাঁক বদল হয়েছে,
দেহের পূর্ণতা সঞ্চয়ে বেলা অবেলায় সঙ্গমে লিপ্ত হয় রোজ।
যৌবন জোয়ারে সমস্ত অবয়বে সাঁতার কেটে যায় বুনোহাঁস,
আর রেখে যায় তার স্মৃতি চিহ্ন ঝরা পালক;
সেই পালক নিত্য টানা হেঁচড়া করে পুঁটির মিছিল।

এতদিন কোথায় ছিলেন
রবীন বসু

তিনটে জানালা পেরিয়ে চতুর্থ জানালায়
যে চাতুর্য খেলা করে
আপডেট কবিতা তাকে পাশ কাটায়Ñ
অসম্ভব স্মার্টনেস নিয়ে জিনস পরা মেয়েটা
খোলাচুলে তার গতিবেগ বাড়িয়ে দিল
কেননাÑ বনলতা, সুরঞ্জনা, সুচেতনা আর
আকাশলীনারা বসে আছে নন্দন চত্বরে,
একটু পরে কবিসম্মেলন শুরু হবেÑ
মাইক্রোফোন হাতে ঘোষিকা-কবি
যে কোন সময় তাদের যে-কাউকে ডেকে নিতে পারে;
আর এই ডাকার ফাঁকে যে অবকাশ
যে চলমান অস্থিরতা তাকে পাশে নিয়ে
এক অন্তর্জাল রহস্য মাখে মেয়েটি;
সরপুঁটির মত চিকন আর চন্দনফোঁটা নিয়ে
সে মঞ্চের কাছাকাছি যেতেই
এক বয়স্ক কবি অভ্যর্থনার হাত বাড়িয়ে দিল;
হাতের পাঁচ আঙুলে দীর্ঘ নখ
নখের ভিতরে জমে থাকা প্রাচীন ময়লাÑ
আর ময়লার ভিতরে উঁকি দিতেই
কে যেন বলে উঠলÑ এতদিন কোথায় ছিলেন ?

একটি বসন্তের অপেক্ষায়
জালাল জয়

তুমি এলে না হয় কাছে
তুমি দেখলে না হয়
কী  করে প্রানের স্পন্দন তুমিহীন
সুরহীন একলা ঘরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে বাঁচে
তুমি দেখলে না হয় জীবনের পথ...

তুমি দেখলে না হয় বসন্তের সকাল
দেখলে না ঝরাপাতায় মুগ্ধ বিকাল
তুমি দেখলে না হয় জীবনের শব্দ
যে শব্দের ¯্রােতে সমুদ্রের জোয়ার
ভাটার দিবারাতির খেলায় ভাসে চোখ
তুমি দেখলে না হয় এ চোখের কাজল
যে কাজলের মায়ায় তোমায় রাখি
দৃষ্টির নীলিমায়...

তুমি দেখেছো কী চেয়ে
এই চোখের তারায় কত স্বপ্ন কত গল্প
কত রাত কত দিন অপেক্ষায় ছিল
শুধু একটি বসন্তের...


ভালোবাসার সমীকরণ
বজলুর রশীদ

বিছিন্ন শীতকথন নয়,
ভালোবাসার শৈল্পিক ইচ্ছেগুলো
ডানা মেলে উড়ে যায়
তোমার খোঁপার ফোটা ফুলে।

সুবাসের অনুভবে রঙতুলিতে এঁকেছি
বসন্তের রূপ জিঘাংসা নয়;
এক একটি প্রহর হৃদয় গহীনে
ফাগুনের কচি সময়গুলো
গুনগুন সুর তুলিয়ে বাজে।

প্রস্ফুটিত গোলাপের সমীকরণ খুঁজি-
ভালোবাসার স্বর্গীয় সুখ।

এইতো বেশ ভালোই আছি
মাহদী হাসান

এইতোÑ বেশ ভালোই আছি
শীত পড়লে সোয়েটারে বুকটি লুকাই
তাল হারিয়ে গ্রীষ্মে ঘামি, রৌদ্রে শুকাই
হাসির সময় হাসি, কান্না এলে মুখ লুকিয়ে বাঁচি
এইতো- বেশ ভালোই আছি।

তুমি- কেমন আছো?
ছাদের ওপর পা এলিয়ে
খোঁপার বাঁধন খুলে দিয়ে
গুনগুনিয়ে গাওয়ার ছলে
আমার কথা, এখনো কী ভাবো! খবর দিও।

ট্র্যাডিশনের শিকল ভেঙে
দিগি¦বজয়ী বীরের মতো খেই হারিয়ে
ছুটেছিলাম লাগাম ছাড়া তীব্র রোদে, বর্ষা মাথায়
স্মৃতির পাতায় আঁকা আছে?

নাকী তাল হারিয়ে সব ভুলেছো! খবর দিও।

খবর নিও। ভর দুপুরের শাদা-কালো স্বপ্নগুলো
রঙিন করার এম্বিসনে যাচ্ছে ভালোই
কান্না হাসির জোয়ার ভাটায়, দিন চলে যায়
বীজের ফলে তৃপ্ত ঢেঁকুর - চলছে ভালোই
এইতোÑ বেশ ভালোই আছি।

মেডিটেশন চলছে ভালোইÑ
ধ্যানের ঘোরে শাদা কালো অতীত ছবি
পাহাড় ঘেরা নিকেতনের কামরা সবই
গারদ থেকে মুখ দেখানোর হালত শেষে
ঘরবন্দী ইতিহাসের সাক্ষী বেশে, চলছে ভালোই
এইতোÑ বেশ ভালোই আছি।


নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া, তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তের’ই হাওয়া

নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া, তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তের’ই হাওয়া



নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া,
তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তের’ই হাওয়া

মামুন ম. আজিজ
 

বসন্ত নিয়ে কিছু কথা বলার প্রারম্ভে স্বভাবতই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বসন্তকে বিশেষায়িত করার অতি অভিলাষ 'ঋতুরাজ' জুড়ে দেয়া হয়, তারপর বন্দনা কীর্তন এগিয়ে যায়, এখানে আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি, আমি বসন্তকে ঋতুরাজ বলতে রাজী নই। যুগ থেকে শাতব্দী পেরিয়ে পেছনের ইতিহাসে আমরা যত রাজাদের দেখি, শুনি, পড়ি তারা ফাগুনের রক্ত রাঙা সবুজ পত্র কাননের মাঝে ঝিরি ঝিরি বসন্ত বাতাসের হিমেল পরশের মত মাধুরীময় রূপে আমাদের কাছে ধরা পড়ে না, রাজা স্বভাবতই কাঠিন্যেরা আবরণ বরন করেন, তা না হলে রাজত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন, প্রজার কাছে কেবল দয়ালু সাধু হলেই হয় না রাজাকে হতে হয় কঠোর, সত্য নিষ্টার পরাকাষ্টা, একটু উল্টো ভাবলে সেতো আরও কঠিন, আমি উল্টো ভাবনায় নিষ্ঠুর অত্যাচারী রাজাগণের কথাই বলছি, সেও ইতিহাসে ভরপুর। প্রিয় মিষ্টি মধুর পাখির কলকাকলী উচ্চকিত বসন্ত কেনো পুরুষ হবে, কেনো রাজা হবে, সেতো রানী হতে পারে, সৌন্দর্যের নিগুঢ় আলোড়ন হতে পারে, আমি তাই বসন্তকে বলব 'ঋতু শ্রেষ্ঠ'।
আমার ঋতুশ্রেষ্ট বসন্ত প্রাণে প্রাণে দোলা দেয়। সে এক নীরব নিবিড় দোলা, সে যার প্রাণ আছে সেই বোঝে। কবিরা প্রাণের নিগুড়তম আঁধার। বসন্ত আসবে আর কবিরা দুলবে না, তা কি হয়! বসন্ত আসবে আর কবিরা লিখবে না দু’কলম কিংবা আধুনিক যুগে কবিরা টিপপে না কিবোর্ডের বাটন, তা হয় না। কবিরা না লিখতে চাইলেও তাকে লিখতে হয়, মনে মনে আউড়াতে হয় কবিতার চরণ। সাধে কি কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন,
'হে কবি নীরব কেন, ফাগুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি ল’বে নাকি তব বন্দনায়? '
বসন্ত এলে পরে নিসর্গে যেমন নির্মেঘ রোদ্দুর জেগে ওঠে, সিন্ধ বাতাসের পরশে সকাল সন্ধ্যা দেহে দেহে হিল্লোলে লাগে মিষ্টি দোলা, তেমনি কবিরাও বিগত কালের কবিতায় লেখা যাপিত জীবনের বিষাদ, যাতনা, দুঃখ-ব্যথা, জরা, ঘুন চিত্র সব ভুলে এক আনন্দ সরোবরে সাঁতার কাটে, হাত নেড়ে সুখের আহ্বান জানায়, কবিতা হয়ে ওঠে ইতিবাচক। কিন্তু প্রায় কবির কবিতাই সুখের চেয়ে দুঃখকে অধিক উপজীব্য হিসাবে গ্রহণ করে কিংবা কবিতা আপন খেয়ালে বিষাদ নীড়ের ঘরে চোখ মেলে বেশি, আর কেবল ব্যতয় ঘটে ফাগুনের রঙে প্রায় সকল কবিরই প্রাণে।
কবিতায় যার স্বল্প আয়ুষ্কালেই ঝরেছে ভীষণ ক্ষোভ সব, করেছেন যিনি তীব্র প্রতিবাদ ‘ক্ষুধার রাজ্যে যেন পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ চরণ  লিখে। অতি  প্রিয় সেই ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ড ভটাচার্যও বসন্তে উতলা হয়ে ঠিকই সুখের ডাক দিয়েছেন, প্রাণের দোলায় দুলেছেন, অন্যকেও দুলিয়েছেন তার ‘ চৈত্রদিনের গান’ কবিতায়-

চৈতীরাতের হঠাৎ হাওয়া
              আমায় ডেকে বলে,
“বনানী আজ সজীব হ’ল
              নতুন ফুলে ফলে৷
এখনও কি ঘুম-বিভোর?
পাতায় পাতায় জানায় দোল
              বসন্তেরই হাওয়া৷
তোমার নবীন প্রাণে প্রাণে,
কে সে আলোর জোয়ার আনে?
নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া;
তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তেরই হাওয়া৷
              ওঠ্ রে আজি জাগরে জাগ
              সন্ধ্যাকাশে উড়ায় ফাগ
              ঘুমের দেশের সুপ্তহীনা মেয়ে৷
তোমার সোনার রথে চ’ড়ে
মুক্তি-পথের লাগাম ধ’রে
              ভবিষ্যতের পানে চল আলোর গান গেয়ে৷
রক্তস্রোতে তোমার দিন,
চলেছে ভেসে সীমানাহীন৷
              তারে তুমি মহান্ ক’রে তোল,
তোমার পিছে মৃত্যুমাখা দিনগুলি ভোল॥”
বসন্তের সুর এমনই গহীন, রক্তস্রোতে ভেসা চলা দিনের বেদনা ভুলেও কবি বলেছেন ‘ভবিষ্যতের পানে চল আলোর গান গেয়ে’। বসন্ত এমনই, এ যেন মুষঢ়ে পড়া মানুষকে সামনে ঠেলে দেয়ার কিছু ক্ষণ। প্রচন্ড বিপ্লব যার কবিতার পরতে পরতে সেই বিপ্লবের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে, খুনেরা ফাগুন..।’ শব্দ চয়নে তিনি বিপ্লবী সুর বজায় রেখেও বসন্তের সেই একই ডাক, একই প্রাণ সঞ্চারী দোলার কথাই পক্ষান্তরে বলে গেলেন কি সুন্দর। কেবলই বিপ্লবী সুরে নয় মিষ্টি সুরের বাঁশী বাজিয়েও নজরুল বসন্ত বন্দনা করেছেন অন্য কোথাও অন্য কোন কবিতায়, এমনই  তার ‘এলো বনান্তে পাগল বসন্ত ’ কবিতা-
এলো বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে,চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।
বাঁশীতে বাজায় সে বিধুর পরজ বসন্তের সুর,
পান্ডু-কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে
রাঙা হল ধূসর দিগন্ত।।
কিশলয়ে-পর্ণে অশান্ত ওড়ে তা’র অঞ্চল প্রাস্ত।
পলাশ-কলিতে তা’র ফুল-ধনু লঘু-ভার,
ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত।
এলো মেলো দখিনা মলয় রে প্রলাপ বকিছে বনময় রে।
অকারণ মন মাঝে বিরহের বেণু বাজে।
জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত।।
বসন্ত আর বসন্তের কবিতা নিয়ে অনেকটা লিখে ফেললাম অথচ বাংলার যে ব্যক্তিটি সর্বাধিক বসন্ত প্রেমিক তার কথা এখনও এলোনা। তাঁর কথা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে, সে যে কবি গুরু, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে কে আর বেশি বসন্ত বিলাসী এ বাংলায়। তার বসন্ত গীত যে বিরাজ করে প্রতি বাঙালির হৃদয়েই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য কবিতা ও গানে উঠে এসেছে  বসন্তের কথা। মাত্র তিন লাইনেও কবি গুরু বসন্তকে চিনিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন-
‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।’


বসন্ত কেবল রূপের ছটায় মুগ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, রক্ত রঙা পলাশ, শিমূল আর কৃষ্ণচূড়ায় প্রাণে প্রাণে রঙ ছড়িয়েই হারিয়ে যায়নি, কোকিলে প্রাণে যেমন প্রেমের ঢেউ ডিন্ডির শোভিত হয়ে ফুলে উঠেছে আর কোকিল ‘কুহু কু’ রব তুলে প্রেপিকার স্পর্শ আহ্বান করেছে, প্রেমিকা কাছ না আসা পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়নি, তেমনি বসন্ত মানব মাঝেতেও প্রেমের উৎসরণ ঘটিয়েছে, কবিগণ আপন কবিতায় সে বসন্ত বারৌ প্রেমের কথাও নির্দ্বিধায় তুলে এনেছেন বারবার,বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের গানের ভাষায়-
‘বসন্ত বাতাসে..সই গো,বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...। '
আবার কুমার বিশ্বজিৎ আধুনিক যুগের গানে বসন্ত প্রেমের উতলা হাওয়া বইয়েছেনঃ
‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে
ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে
এখন যে প্রয়োজন তোমাকে
নিঃসঙ্গ এই হৃদয়ে’
আধুনিক কবিরা বসন্তকে নতুন নতুন আঙ্গিকে উপমিত করতে চেয়েছেন। নির্মলেন্দু গুন এর বসন্ত বন্দনা কবিতায় তেমনি এক সৃষ্টি-
হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে,
হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি
তবুও ফুটেছে জবা, দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।
এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরন,
মন যেন দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে
অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে, মৃত্তিকার বুকে
নিমজ্জিত হতে চায়। হায় কি আনন্দ জাগানিয়া।
এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,
যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য।
বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্যখানি
নবীন পল্লবে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে
গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।
আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরূপ তাহার,
সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার।
 নির্মলেন্দু গুণ স্বীকার না করে পারেন নি-‘এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,/যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য’,আর তাই উপমার জালে বসন্তকে নিজের মাঝে আটকাতে চেয়েছেন অক্ষরবৃত্তেও। আবার ‘আমার বসন্ত’ নামে অন্য কবিতায় তিনি আরও উন্মাদ হয়েছেন বসন্তের ভাল লাগায় , বলেছেন...
‘এ না হলে বসন্ত কিসের? দোলা চাই অভ্যন্তরে,
মনের ভিতর জুড়ে আরো এক মনের মর্মর,
পাতা ঝরা, স্বচক্ষে স্বকর্ণে দেখা চাঁদ, জ্যোৎস্নাময়
রাতের উল্লাসে কালো বিষ । এ না হলে বসন্ত কিসের ?’
আরও উত্তরাধুনিক কবিও বসন্তকে আধুনিক দৃষ্টিতে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। বসন্তকে এড়িয়ে উত্তীর্ণ হবার দুসাহস এ যুগের কবির ও নেই। বসন্তের মাঝে নিজেকে খুঁজে নিয়ে তাই কবি টোকন ঠাকুর তার ‘বসন্ত রজনীতে বসিয়া রচিত কবিতা’ তুলে ধরেন-
‘...শিস প্রয়োজনে
আমি
হাওয়া-ধাক্কা দিচ্ছি
বসন্ত-জঙ্গলে গাছদেবতার
শুকনো পাতায়
কে আমি? বিখ্যাত কেউ? কী ছিলাম? গুরু কেউ? লঘু ঢেউ?
ঝরনার বাথরুমে শাওয়ার ছিলাম?
সুহাসিনীর ড্রেসিং টেবিলে আয়না ছিলাম?
গুপ্তকথা হচ্ছে, আদতে সেই রাক্ষসদের ছেলে, মানুষের ছদ্মবেশে থাকি
যোগ্যতা, নিজের মুখে জোছনারাত অনুবাদ করতে পারি, এর বাইরে
আমি যা ছিলাম, তাই
ছিলাম যা, তাই।
অনলাইনের যুগে, অনলাইনের বিস্তৃত পরিসরে’ উত্তারাধুনিক কবিগণও বসন্ত বিহীন কেবল যান্ত্রিকাতার মাঝে চোখ বুজে থাকে নি, বসন্ত বারবার এ যুগের সব কবির মনের ভেতর দোলা দিয়ে বলে ওঠে একই কথা যা কবি চারুমান্নান তার ‘এবং কবিতা বসন্ত’ তে বলেছেন-
‘আমার কবিতার গা এখন বসন্ত আবিরে ঢাকে
খোলা পায়ে নিত্য ফুলের পাঁপড়ি মাড়িয়ে চলে
বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত মানে না কোন বাঁধা
একি মাতাল হাওয়ায়?
মাতাল নেশায় ছুটে,মানে না বারন,মন যে উতল’ '
বসন্ত বন্দনার কোন শেষ নেই বাংলার কবিদের লেখায়। বসন্তের মাঝে এই প্রাণের হিল্লোল, এই যে উন্মাতাল সুখ সুর, এর পিছণে বিগত শীতের ভূমিকাও কিন্তু কম নয়। শীতের রুক্ষতার পরেই বসন্তের আগমন, শীতের শেষে ঝরে পতা পাতার আস্তর সরিয়ে, ধুলোর আলোড়ন এড়িয়ে সবুজ পাতার ঝাঁক, তারপর উঁকি দেয় রক্ত রাঙা সব ফুল। অথচ আড়ালে চৈত্র মাসের নির্মেঘ দিনে সূর্যের যে ক্ষীপ্রতা তা কিন্তু কবিদের চোখ এড়ানোর কথা নয় মোটেও। কবিকূল বসন্ত উচ্চারণে এই তাবদাহের যাতনা তুলে না ধরারই চেষ্টা করে গেছেন, এতে যেন বসন্তেরই জয়গান প্রাণবন্ত হলো। অবশ্য চৈত্র মাসের নাম চয়নে প্রখড় রোদের অতুষ্ঠি করতেও ছাড়েন নি অনেক কবিই। ভিন্নতার কবি জীবনানন্দ দাসের ‘কখন সোনার রোদ নিভে গেছে’ কবিতায় তাই যেন চৈত্রের বিষদগার করেছেন এইভাবে-
'কখন সোনার রোদ নিভে গেছে, অবিরল শুপুরির সারি
আঁধারে যেতেছে ডুবে, প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস
ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ অন্ধকার ফেলিতেছে শ্বাস;
কোন চৈত্রে চলে গেছে সেই মেয়ে, আসিবে না করে গেছে আড়ি :
ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি
কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে তাহার শরীর থেকে শ্বাস
ঝরে গেছে বলে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ,
কোথাও সে নাই আর — পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি?...


জীবনের কবি জীবনানন্দের কবিতায় বসন্ত স্ব রূপেও এসেছে, তবে সেট্ওা অনেকটা নীরবে নিভৃতে। হতে পারে হেমন্ত প্রেমী কবির কাছে বসন্ত এক ভিন্ন রূপ বলেই হয়তো, কিন্তু আসলে কি তাই? কবিতার ছত্র তো ঠিকই বলে দিচ্ছে তিনিও নীরবে নিগুড় বসন্ত প্রেমিকই। তাঁর কবিতায়-
কোন এক বসন্তের রাতে
জীবনের কোন এক বিস্ময়ের রাতে
আমাকেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায় ৃ'
আবার ‘সবিতা’ কবিতায় জীবননানন্দ বসন্তকে তুলে ধরেছেন-
‘বসন্তের রাতে, যেমন দেখি ...
সবিতা, মানুষ জন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোন এক বসন্তের রাতে
ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন...'
আবার জীবনান্দনের নিঝুম মনেও বসন্ত দোলা দেয়, আর তাইতো ‘পাখিরা’ কবিতায় তিনি বলে ওঠেন-
'শরীরে এসেছে স্বাদ বসন্তের রাতে,
চোখ আর চায় না ঘুমাতে;
জানালার থেকে ওই নক্ষত্রের আলো নেমে আসে,
সাগরের জলের বাতাসে
আমার হৃদয় সুস্থ হয়;
সবাই ঘুমায়ে আছে সবদিকে-
সমুদ্রের এই ধারে কাহাদের নোঙরের হয়েছে সময়? '
প্রতি বসন্ত যেমন অজস্র কবিতা সৃষ্টি করে, তেমনি সৃষ্টি করে কবি। জীবনানন্দই সেই আহ্বানকেও তুলে ধরেছেন-
‘শীত-হেমন্তের শেষে বসন্তের দিন
আবার তো এসে যাবে;
এক কবি,- তন্ময়,- সৌখিন,-
আবারতো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে।’
আধুনিক কবিতায় অনেক কবিই চিরায়ত রূপে বসন্ত না ভেবে প্রখা ভাঙার তীব্র প্রচেষ্টা দেখাতে চেয়েছেন। আধুনিকতার এই এক এক বৈশিষ্ট্য অগ্রগামীতা, যেন প্রথার দেয়ালে হানি আঘাত...কবি মাসুদ খানের  'বসন্তকাল' কবিতায় তাই বসন্ত ভাবনা উঠে আসে সম্পূর্ন ভিন্ন রূপে, এক নিবিষ্ট প্রতিবাদী সুরে-
মাথা কেটে পড়ে গেছে, কণ্ঠনালী ফেটে ফিনকে উঠছে ঋতুরক্তলাভা,
লালের উল্লাসে আরো লাল হয়ে উঠছে পালকপুচ্ছডানা।
তবুও চলেছে উড়ে বনমোরগ, ছিন্নমস্তা, ডাল থেকে ডালে...
মোরগঝুঁটির আঁকাবাঁকা উচ্ছ্বাস থেকে আজ
ডিমের গলিত কুসুমের মতো উৎফুল্ল সূর্যোদয়
ছোপ-ছোপ রজোবিচ্ছুরণ...
ছিটকে ছিটকে শিমুলে মান্দারে গিয়ে লাগে ওই লাল
তুম-তানা-নানা ঘটিয়ে তোলে বনে বনে বিকল্প বসন্তকাল।


কবিরা বসন্ত অত্যধিক ভালোবাসে। কবিরা বসন্ত মাঝে রক্তিম ফুলে জাগরণের হাতছানি দেখতে পায়, কবিরা বস্ত দিনে বাসন্তীরঙা শাড়ির সাজে নারীকে চিত্রিত করতে চায়
কবি সরসিজ আলীম এর ‘হাঁসেদের পালকের গন্ধ’ নামে আধুনিক গদ্য কবিতায়ও উঠে এসেছে বাসন্তী শাড়ি আর বসন্দ রূপের মাধুর্য-
‘বাসন্তী রঙের শাড়ির সুতোয় সুতোয় বসে হাঁসেদের ঝাঁক তাহাদের পুচ্ছের উপর তেলের কৌটা খুলে ঠোঁটে তেল নিয়ে মাখিয়ে দিচ্ছে পালকে পালকে, আর পালকে পালকে রোদের ঝিলিক গড়িয়ে গড়িয়ে লাফ দিয়ে পড়ছে জলের উপর। জলের ভেতর থেকে লাল রঙের ভেজা ফুলের পোষাক পরে উঠে আসছে অনিমা হোসেইন রোদের ঝিলিক লাফ দেয়া ডিঙিয়ে, অনিমার শরীর গড়ানো জলে পুকুর ঘাট ভিজিয়ে নিচ্ছে নিজেকে, আর রোদ পোহাচ্ছে পুকুর ঘাটে তখন হাঁসেদের পালকের তেলের গন্ধ।...’
এভাবে যুগযুগ ধরে বাংলা কবিতায় বসন্ত রূপ আর আর তার আনন্দ হিল্লোল মাখিয়েছেন কবিগণ কবিতার সব রূপেই তা ছন্দের সব রূপেই। আধুনিক গদ্য রূপেও তার কমতি হয়নি। কখনও হবেও না, বসন্ত আসবে, বসন্ত নিয়ে কবিতা রচিত হতেই থাকবে। কষ্ট ক্লীষ্ট ক্ষণেও, নিদারুণ কালেও বসন্ত কবিদেও কবিতার প্রাণ, তাইতো কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত...’
বসন্ত দোলায়,এত এত কবিতার জাগরণে আন্দোলিত প্রাণ এখন আমার, তাই যেন বসন্ত আর বসন্তে বাংলার কবি ও কবিতার ক্ষুদ্র চিত্র তুলে ধরতে অক্ষম এই কবি আমিও বসন্ত কবিতার ছত্র বুনে ফেলি, লিখে ফেলি-
‘প্রাণে লেগেছে দোলা, সবুজ পাতার ফাঁকে রক্ত শিমুলের মেলা
হিমেল পরশে হৃদয় ছুঁয়েছে ফাগুন
হাসির শিখা যেন জ্বালিয়েছে বাসন্তী আগুন
এমনই এ দিন, পাতা ঝরার ঋন হলো ঐ আজই যে বিলীন
প্রাণে লেগেছে দোলা, জরা দিন ভুলে প্রাণে শুধু আনন্দেরই খেলা।'


গল্প- ছেড়ে হাঁটে বনেদী জীবন

গল্প- ছেড়ে হাঁটে বনেদী জীবন


ছেড়ে হাঁটে বনেদী জীবন
শাহমুব জুয়েল

না খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। যত বলি বিকেলে একটু ঘুমিয়ে নে। কিছুতেই কান দেয় না। পাড়ার দুষ্টুরা এলেই গদগদ করে দুচারটে ভাত গিলে ঝাঁফিয়ে পড়ে। বিকেল গড়ায় কাদামাটির সাথে খেলা করে। বুঝাতেই পারি না পড়াশুনো কর। বড় হলে াগড়ি হবে বাড়ি হবে। শেখ জেঠুর মত। বাড়ি এলে লোকে সালাম দেবে। কত কিছু খেতে দেবে। বাবা না একটু পড়াশুনা কর। কে শুনে কার কথা।
মতিন মাষ্টার কুব জেদী মানুষ। সংসারের জ্বালাযন্ত্রনায় মেজাজ খটখটে। বাবার কালের সয়সম্পত্তি তেমন নেই। মাঠে ঘাটে দু চারখন্ড থাকলেও ভাগবাটোয়ারা হয়নি। বহু কষ্টেই টেনে চলছৈ সংসারে কাঁধি। ছেলে মেয়ে লায়েক হয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেকেই স্কুলগামী। প্রতিদিন সকালেই তার সংসারের চিন্তু মাথায় তুলে দিন পার করতে হয়। এভাবে কী সংসার চলে তবুও চলতে হয়। একই গাঁয়ে বিয়ে করেছে সে। সংসারে অভাব ঘুচাতে শশুরালয়ের কয়েক খন্ড জমি চাষ করে জীবন চালায় মতিন মাষ্টার।
মতিন মাষ্টারের বড় ছেলে রাফিন। ছোট বেলা থেকেই সংসারের সব বোঝে। তেমন চাহিদা নেই।
এখন সে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার রয়েছে ছোট বোন মাহিন। দুজনেই পড়াশুনোয় বেশ ভালো। বাবার কষ্ট বোঝে। কী চায় তা থেকে জীবনের স্বপ্নে উঁকি দেয়।
সকালবেলা। প্রাইভেট টিউটর আসে। বেশ ভালো পড়ায় মনোযোগ দিয়ে পড়ে। কখন যে ঘন্টা চলে যায়। গিন্নী টিউটরকে নাস্তা দেবে। ফিন্নিবাটিটা ধুয়ে না নিতে সে উঠে পড়ে। সময় গড়ায়। রাফিন স্কুলে যাবে কিন্তু গোসল করতে চায় না। মায়ের বকাঝকায় দৌড়ে ঘাটকুলে ঝাঁপায়। অন্যদের সাথে পানি থইথই করে পেলে। হঠাৎ সাইকেলের আওয়াজ। কান ঘুরে বাড়ির আগপথে। বাব এলো। হাঁ- হায়রে পিঠের উপর আজ কী ভাঙ্গে খোদা জানে। ইতোঃপূর্বে বহু লাঠির দগদগে চিহ্ন পীঠে ঝামা পড়েছে। নতুন নেবে কী করে। পাশে রাহেলা ভাইয়া, বাবা... জলদি উঠ বলতেই রাফিন দৌড়ে।

ছেলে- মেয়েরা বড় হয়। সংসারের চাপ বাড়ে। মতিন মাষ্টার দিশেহারা। রাফিনকে লজিং দেয়। রাফিন এখন মাষ্টার। ছাত্র-ছাত্রী ক্লাসের সাইজের চেয়ে দেহে ভারী। এভাবে কেটেছে বহুদিন। মাঝে মধ্যে বাড়ী ফিরে। লিকলিকে শরীরের ভাঁজ। তার চাচা সুজন পড়াশুনা নেই। লোকে বলে মূর্খপন্ডিত। তার জোরেই সব নিজের মনে করে। তার অষ্টধাতুর জোরে রাফিনের দাদা দাদু নাতি নাতনির মায়া চুকে ফেলেছে। কিন্তু রাফিন তাদের বেশ শ্রদ্ধা করে। বাড়ি এলে ছোটে দাদুর বিছানায়। দাদু তখন পান খিলালে ব্যস্ত। কথা উঠতেই চুপ চুপ ভাই পালাও, সুজন আসছে। আহ ঠিকমত কথা হলো না। কথা আছে ভাই পরে এসো। রাফিন আবার ফিরে দাদুর হাত পা টিপে দেয়। আহরে ভাই কী ভালো লাগে। দাদু ভাই তোমাকে ঠিকমত খাবার দেয়? ভালো মন্দ খেতে দেয়? হ্যাঁ দাদু, বড় বড় মাছের পিছ। আরো কত কী। তাই দাদু? ছেড়ো না। বড় হবে। চাকরি করবে দাদুকে শাড়ি দেবে। তাই না দাদু ভাই?
দিন যায়। রাফিন ক্লাসের তালে তালে লজিং ছাড়ে আর ধরে। মা বড্ড ভালোবাসে। কিন্তু কী করবে? অভাবের তারে মায়াকে চুকে দেয়। মায়া আছে ছায়া নেই। নানীও রাফিনের জন্য টাকা গুচায়। পাঠায় না। রাফিনের খোঁজ করে। রাফিনের এসএসসি রেজাল্ট দেবে। রীতিমত মসজিদে পড়ে আছে। কিন্তু ফলাফল ভালো হলো না।
সে বাড়ি ফিরে না। খোদার উপর ভরসা রাখে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকা বোগলে চেপে রাত দেখে বাড়ি ফিরে। কথায় বলে “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত পোহায়”।
সুজন চাচা মিটমিট হাসে। জল ঝরে রাফিনের। সে কষ্টে এবং জ্বালায় মনোযোগী হয়। ভরসায় মানবিক বিভাগ নেয়। এইচ এস সি পরীক্ষঅর প্রথম দিন। বাবা তাকে হলে পৌঁে দেয়। দ্বিতীয় দিন কাকডাকা ভোরে নগদখবর মারছে তোর বাপেরে মারছে রে রে রে........
রাফিন বইয়ের পাতা খসে চমকে দৌড়ায়। মা... বাবা কই? কোরআন পড়ছে। বেপারীর কবরের পাশে। দৌড়া রাস্তাজুড়ে চাচাদের আড্ডা, প্রতিবেশীদের কানাঘুষা, মহিলাদের খিলখিল। কিন্তু বাবা এগুতেই দাদাদের বাড়ি সব দরজা বন্ধ, পাশের খেতে চিৎকার।
বাবা বাঁচতে চেয়েছিলো। কিন্তু দরজাগুলো বন্ধ ছিল। রাফিনকে জড়িয়ে ধরলো মান্নান মাষ্টার। এই রাফিন তুমি যেও না। পরীক্ষা- একঘন্টা আঁটকে থাকার পর চেয়ে দেখি কর্দমাক্ত বাবার দেহ চটপট করছে। তখনো অমানুষের আচাঁছা বাঁশ লাফিয়ে উঠছে। ওপারে কবরখানা। সে কবরের মত বাবার চারপাশে কবর। চিকচিক জলে শীষের ডগার মত ধানক্ষেতে নড়ছে বাবার দমখানা। বাতাস না থাকলে হয়তো তাও থাকতো না। দাদু আসলো মা আসলো ছোট ফুফু ঝর্ণা। টেনে টেনে তুললাম সায়হীন জবিন। সেদিন বুঝেছি দাদু খুব ভালোবাসতেন বাবাকে। আঁচল টেনে মুচে দিলেন শুধু মুখখানা কিন্তু, সে মুখে ভাষা নেই,লোল আছে।
হাসাপাতাল আর পরিক্ষার হল। পরীক্ষায় মন বসছে না। হল থেকে ফিরে বাবার বেডে ফিরতেই কেঁদে ওঠেন। বুকে বেঁধে হাঁফ ছাড়েন বাঁধা স্বপ্নে কাঁধিতে।
সেদিন বুঝেছিলাম। বাবা মতিন মাষ্টার নন আমার বাবা। সে বছর ধান হয়েছে কিন্তু গোলা ভরে নি। মা কান্নায় ঘর ভরেছে। কিন্তু গোলা উপুড়।
মসজিদের তারাবির ইমামতির টাকায় জুটেছে অনার্সে পড়ার স্বপ্ন। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। হঠাৎ বন্ধু শরীফ ফোন হাতে। বন্ধু বাড়ি থেকে কল এসেছে। বাবার কণ্ঠবাড়ি ফির... তোর দাদুর অবস্থা ভালো নেই। বাড়ি ফিরলাম, দাদু ঘুমায়, চারপাশে মানুষ। এ ঘুম নাকি তিনদিন। এগিয়ে দাদুর মাথার কার্ণিশে হাত বুলাতেই চোখ খুললেন দাদু। ক্ষণিক পরেই বুঝে গেলো। সে রাতে দাদুর ঘর থেকে কান্নার শব্দে সমস্ত বাড়ি ভারি হয়ে উঠলো।
রাফিন বড় হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বোন ভাইরাও তাই। দু চারটে পয়সা দেখে কিন্তু বনেদী জীবনে চিরসঙ্গী দাদুর ঠিকানায় বাবা চলেছে। মা বার বার বাবার পাশের খালি জায়গাটুকু চেয়ে দেখছে।
বনেদী ছেলে তার ছেলের সফেদী স্বপ্ন দেখছে।


আরাধ্য আকাশবৃত্তি : এই আরাধনা পূর্ণতা পাক

আরাধ্য আকাশবৃত্তি : এই আরাধনা পূর্ণতা পাক


আরাধ্য আকাশবৃত্তি : এই আরাধনা পূর্ণতা পাক
ইয়ার ইগনিয়াস

‘চোখে এ কোন পথ মেলেছে আজ, রাস্তায় নেমে দেখি- চলমান রিকশা এক-এক করে ঢুকে যাচ্ছে চোখের ভেতর। বড় রাস্তার বাস, কখনো ট্রাক, ক্রমাগত ধেয়ে আসছে চোখে। ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে দুসারি মানুষ, এক পাশে ধার্মিক অন্যপাশে নতুন পরিচয়ে। ফুরসত নেই কারো দিকে তাকাবে কেউ। তোমাকে খুঁজেছি দুলাইন মানুষের মাঝে। অথচ এ শহরে আমার কোন ধার্মিক অথবা মানবিক প্রেমিকা নেই। আমি আস্তে আস্তে বুজে নিলাম চোখ।’
(চোখের বিশালতা,  পৃষ্ঠা-২৯)
এমন সব দৃশ্যকল্প যদি পড়তে চান- ভেসে বেড়াতে চান শব্দের রূপকল্পে- মুর্ছা যেতে চান উপমা-অলঙ্কারের ঝঙ্কারে, তবে আপনিও হাতে তুলে নিতে পারেন শেখর দেব-এর নতুন কবিতাকিতাব আরাধ্য আকাশবৃত্তি। কবিতার দিক দিয়ে গ্রন্থটি তৃতীয় হলেও অন্যগ্রন্থগুলোর চেয়ে এই গ্রন্থটি স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর বহন করে। শেখর দেব মূলত প্রি-ভার্সে কবিতা চর্চা করলেও চলতি বইয়ের বেশকিছু কবিতা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত, সনেট রচনায়ও দেখিয়েছন মুন্সিয়ানা। এখানে কবি সরাসরি বলার চেয়ে আড়ালকে আশ্রয় করেছেন। কবিতাকে করেছেন মোহনীয়। কবিতা এমনই এক মোহনীয় রূপসী- দ্যুতি ছড়াবে ঠিকই- সহজে দেবে না ধরা। কেবল কবিতার সমঝদার পাঠক-ই এই আস্বাদ পায়। আশার কথা এই- কবি শেখর দেব ফুরিয়ে যেতে আসেননি, নিয়ত নতুন নতুন কবিতা প্রসব করে আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তুলতুলে সন্তান। গ্রন্থপঞ্জি দেখলে তা স্পষ্ট হয়। ২০১৪ সালে প্রথম গ্রন্থিত হলেও ২০১৮ সালে এসে তার বইসংখ্যা দাঁড়ালো চার, যার তিনটি-ই কবিতার ও একটি প্রবন্ধের।
ইতিহাস-ঐতিহ্য-মিথ-পুরাণ আর সমকালের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা তার কবিতায় নিপুণভাবে অঙ্কিত হলেও- প্রেম তার কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। তাই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যুগের কবি উচ্চারণ করেন-
-ভালোবাসার জন্য বিজ্ঞান পড়তে হয় না।
(পৃষ্ঠা-১৯)
-তোমাকে না-ছুঁয়ে কলঙ্ক লেগেছে গায়ে
ভেবেছি- চুমু খেলে গোপন বোমার আকারে
ধ্বসে পড়তো সভ্যতার খোলস!
(বোমা বিষয়ক, পৃষ্ঠা-১৫)
-হাতে হাত রাখলেই ভেবেছি বৃষ্টি হবে অথবা ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে ঝড়।
(রাত্রিবন্দি মানুষ, পৃষ্ঠা-২২)
-সব পাবে তুমি আমার মোকামে
(সবুজ খামের চিঠি, পৃষ্ঠা-৪২)
কবিতায় অন্তর্বয়ান নতুন নয়। ‘সব পাখি ঘরে ফিরে না’ ও ‘ফিরে না চাকা’ এ দুটি কবিতা বর্তমান বাংলা সাহিত্যের আলোচিত দুজন কবির কবিতার অন্তর্বয়ান। যথাক্রমে জীবনানন্দ দাশ ও বিনয় মজুমদার। ভাবনার বিনির্মাণে কবিতাদ্বয় মনোজ্ঞ মনোযোগ দাবি রাখে।
নদীমাতৃক এদেশে নদী ভাঙন নতুন কোনো ঘটনা নয়; তবে যে নদীর আবহে অগণিত কবি কালক্ষেপণ করেছেন, যার সান্নিধ্যের স্বপ্ন দেখেন নব চর্যাপদ-চাষী। সে যদি কেড়ে নেয় সবুজ বাসর! কেড়ে নেয় রুগ্ণ মা; হোক সে মৃত্যুমগ্ন! তখন, দীর্ঘশ্বাসে মুদ্রিত হতে থাকে নিজস্ব আকাশ। এমন মর্মস্পর্শী ঘটনাকে উপজীব্য করে কবি লিখলেন '‘ব্রহ্মপুত্র তুই ফিরে যা’। কবিতাটি অংশত এরকম-
কখনো পারিনি যেতে ব্রহ্মপুত্র-মায়ায়। তার শান্ত সৌম্য জলের স্বপ্নে প্রায়স ভেঙে যায় ঘুম। অথচ আজ ঘরে চলে এলে ঘুম ভাঙানিয়া আর্তির শব্দে। ছুঁয়ে দিলে ভাঙা চৌকিতে শোয়া রুগ্ণ মায়ের শরীর। এভাবে তোমাকে ভাবিনি কখনো। ভয়ংকর পৌরুষে মুষড়ে দিলে বেড়া ঘেরা সংসার।
(ব্রহ্মপুত্র তুই ফিরে যা, পৃষ্ঠা-১৭)


‘বহুমাত্রিক রাত্রি’ কবিতাটিতে কবি- কতিপয় ধর্মযাজক, প্রগলভ-পুরোহিত ও চতুর ফতোয়াবাজদের চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচনে সক্ষম হয়েছেন। কবিতাটা মূলত রূপক; আমাদের বিচারব্যবস্থা অদ্যাবধি মোড়লদের আজ্ঞাবহ। যাদের ইশারায় বিচারের বাণী পাল্টে যায় অলৌকিক আঁধারে। কবিতার শুরুটা এরকম-
দ্বিমাত্রিক রাত নেমে আসে তোমার ঘরহীন ঘরে। রাত হলে মানুষের বিশ্বাসী শাস্ত্র থেকে উড়ে যায় অক্ষরেরা। তার শাদা পাতায় অজগ্র নিয়ম নিজের মতো গড়ে ওঠে শ্রুতিতে, ধীর ও শান্ত মননে।
(বহুমাত্রিক রাত্রি, পৃষ্ঠা-৫০)
ঘুম ভেঙে দেখি- শরীরে প্রবেশের জন্য ভিড় করে আছে পালিয়ে যাওয়া পাখিরা!
(মায়াপাখি, পৃষ্ঠা নং-৫৫)
কী এক মোহবাস্তবতা! শেখর দেব’র কবিতা এমনই। মোহবাস্তবতায় ধরে রাখে পাঠককে। আলোচ্য বইটি এক-বসাতেই শেষ করেছি। কোথাও থামতে হয়নি। সংযতবাক্, প্রাঞ্জল ও প্রজ্ঞাময় উপস্থাপনে এগিয়ে গেছি। তবে, দুয়েকটি কবিতায় সামান্য অতিকথন আছে। দুয়েকটি পঙ্ক্তি দ্বিরুক্তি দোষে ঈষৎ দুষ্ট। শত যতœ-আত্তিরেও কিছু ভুল থেকে যায়, তেমনি তিনটি বানান প্রমাদ থেকে গেছে। ধ্যনস্থ, চুতুর্মাত্রিক, ঘীরে, যা ধ্যানস্থ, চতুর্মাত্রিক ও ঘিরে হবে। বাকি আয়োজন সুখকর। বইটিতে ৪৭টি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে। যার অধিকাংশ সংবেদনশীল পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে আশা করছি, আমার পাঠ অন্তত তাই বলে। নির্মেদ ও ঝরঝরে ভাষায় আদিম উত্তাপ, ষড়সুখব্যথা, জলের ভেতর একরাত, কিছু সৌরভের জন্য, কবিতার কঙ্কাল, মৌন মুদ্রা, লীলা সমগ্র, মৃত নক্ষত্রের স্মৃতি, অদ্ভুত আলোর রেখা, ক্যালেন্ডার, স্মৃতি-শব, ঈশ্বরের বালাম থেকে, যোজন-বিয়োজন, অন্ত্যেষ্টিক্রয়া, ম্যামোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং, অনার্যাবর্ত, চন্দ্রগ্রহণ, মোহন্ত মানুষের মায়া, বৃত্তাবদ্ধ, আরাধ্য আকাশবৃত্তি ইত্যাদি কবিতাগুলো পড়ে নিতে পারেন। একটা বইতে এতগুলো ভালো কবিতা দুর্লভ। সেক্ষেত্রে কবিতামোদীদের এটা সুখবর বটে। তবে ‘রবীন্দ্রনাথ জানে বা জানে না’ ও ‘স্বল্পমাত্রার কবিতা’ কবিতাদুটি আমার কাছে তুলনামূলক দুর্বল মনে হয়েছে। একথা অবশ্য স্বীকার্য যে আমার দর্শন-ই চূড়ান্ত নয়; এটা আপেক্ষিক বিষয়। কবিতার টেক্সট একেকজনের কাছে একেক রকম। প্রিয় পাঠক, বইটি আপনারা সংগ্রহ করুন, প্রকৃত কবিতার আস্বাদ নিন।
কবিতায় কী লিখে কবি? এমন প্রশ্নের জবাব কবি আগেই দিয়ে রেখেছেন কবি- ‘অতঃপর নিজেকেই লিখে রেখেছি কবিতায়’। কবিকে হতে হয় একার সন্ন্যাস। তাই কবি নিঃসঙ্কোচে উচ্চারণ করেন- ‘কবিতা ছাড়া আমার কোনো ঘর নেই’। কবিতা ছাড়া যার ঘর নেই, তার কবিতাঘর নিয়ে কবি নিশ্চয় আরও যতœবান হবে এই আশা রাখতেই পারি। কবি আরও বলেছেন- ‘নিয়ত সরব চাকা চলে যায় দূরে’, এভাবে সরব থেকে কবি –সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কেঁপে -মহাকালের পথে অনেকদূর যাবেন এটাই কাম্য। তো কবির কাব্য প্রয়াস মসৃণ হোক। জয়তু কবিতা...