পদাবলি

পদাবলি


বাংলাদেশ
লতিফ জোয়ার্দার 

কোন এক হাড়কাঁপানো শীতের রাতে আমাকে আগুন ভেবে কাছে এলে তুমি
আর আমি তোমাকে ভাবলাম সু-দূর গ্রামের কোন এক যৌবনবতী সরিষাখেত
এভাবেই একদিন তোমার আদ্রতায় পা ভেজালাম আমি। আর তখনই এক
অদ্ভুত ম্যাজিক আমাদের গভীর উষ্ণতায় পোড়াতে থাকলো। আমরা তখন
মোহগ্রস্থ হতে হতে বুকের আগুনে একটা স্বপ্নে পোড়া মানচিত্র তৈরি করতে
থাকলাম।সেদিন থেকে একটা স্বাধীন ভূ-খ-ে হাজার বছরের স্বপ্ন বুনতে থাকলাম  
আর এভাবেই একদিন আমাদের সাদাকালো স্বপ্নগুলো রঙিন হলো। আর সেদিন
থেকে তুমি হলে, আমার প্রেম আমার ভালোবাসা আমার প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশ   



আমার আছে
নূরে জান্নাত

আমার আছে সবুজ কাফনে মোড়ানো
সুপ্ত এক মায়াবী শরীর,
যে শরীর বিস্তৃত সীমাহীন সবুজ রঙের
ভালবাসায় পরিপূর্ণ।
এই ভালবাসা চোখ দিয়ে দেখে
মন দিয়ে অনুভব করা যায়,
কিন্তু স্পর্শ করা যায় না।
আমার মায়াবী শরীরে আছে
লাল রঙের একটি মন।
যে মনে অবিরত বয়ে চলে..
ছলাৎ ছলাৎ যৌবনের স্বচ্ছ ¯্রােতধারা।
যেখানে চোখ রাখলেই দেখতে পাবে..
ঈাহাড়ের কান্না,সবুজের সমারোহ
নদীর হাতছানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ।
আমার আছে ৫২,আমার আছে ৭১,
আমার আছে ২১শে ফেব্রুয়ারী..
আমার আছে ৭ ও ২৬ শে মার্চ।
আমার আছে শোকে জর্জরিত ১৫ই আগস্ট।
আমার আছে খিলখিলিয়ে
হেসে ওঠা ১৭ই মার্চ।
আমার আছে লাহোর প্রস্তাব,
আমার আছে ছয় দফা।
আমার আছে ভয়ংকর সেই কালো রাত!
আমার আছে ৩০ লক্ষ শহীদ ও হাজারো বিরঙ্গনা।
আমার আছে সংগ্রাম,আমার আছে স্বাধীনতা।
আমার আছে নিজেস্ব একটি ভূ-খন্ড,
আমার আছে স্বার্বভৌমত্ব।
আমার আছে পাঁচটি অক্ষরের

হৃদয় কম্পিত একটি শব্দ।
যে শব্দটি শুনলে অনাহারী বৃদ্ধের
মুখখানা হাসিতে ভরে ওঠে।
যে শব্দটি শুনলে সকলে শিহরিত হয়ে ওঠে।
যে শব্দটি শুনলে আকাশ,বাতাস,মাটি
গোটা বিশ্ব শ্রদ্ধা ভরে দাঁড়িয়ে যায়।
যে শব্দটি আমাদের বাঁচতে শিখিয়েছে,
যে শব্দটি ১৬ কোটি বাঙালীর সুখ দুঃখের আশ্রয়।
যে শব্দটির নাম ‘প্রেম’
সেই শব্দটি ‘বাংলাদেশ’

মাটির রূপ
মোকসেদুল ইসলাম

অদ্ভুত এক পৃথিবীর নকশা এঁকেছি
মানুষেরর বদলে এখানে ঘুমিয়ে পড়ে পুতুল
রাত্রিকালীন সরাইখানায় আড্ডা জমে বেশ
কে খেলো পাখিমাংস সুস্বাদু হরিণ।

কিছু অভিশাপ পড়ে থাকে মরা নদীর বুকে
টেরাকোটায় আটকে থাকে মানুষের বিশ্বাস
যাদের জন্ম হয়েছিল মনখারাপের উপত্যকায়
তারা এখন শুনিয়ে যায় ক্ষুধার্ত দুপুরের গান।

রঙিন মোড়কে বেঁধে রেখেছি মাটির সংসার
প্রতি পদক্ষেপে বদলে যাচ্ছে বিজ্ঞাপন
মাটি খ্ড়ুলে শুধু পানি নয় ভেঙ্গে পড়ারও সম্ভাবনা থাকে।



আয়নাকুচি
অসীম মালিক

বিশ্বাসের আয়না ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে,
ছড়িয়ে পড়েছে গৃহস্থের উঠানে-
আয়নাকুচি চেতনা ছুঁয়ে আছে
                      গৃহস্থের ঘুনধরা কড়িকাঠ;
আজ বিশ্বাসকুচি টুকরো টুকরো মুহূর্ত
কখনও বা মুখ ভ্যাঙচায় ,
                       কখনও বা চোখ রাঙায় ;
আবার কখনও বা লজ্জায় জিভ কাটে-
চেষ্টা করি- আমার বিশ্বাসকুচি চেতনা,
একত্রিত করে সামনে এসে দাঁড়াই-

আশালতার হাতে সাজান ,
            আমার টুকরো টুকরো আয়নাজীবন;
আজ আলোক প্রত্যাশী সারা মুখে
অবিন্যস্ত দাগ কেটে যায়-
               নিজেকে বড় একা লাগে...
ভাঙা-ভালবাসার আয়নায়
              আজ নিজেকে বড় অসহায় লাগে !




জেগে ওঠো জাতির বিবেক
সিরাজ অনির্বাণ
(উৎসর্গ: ড. জাফর ইকবাল স্যার)

জাতির বিবেক আজ রক্তাক্ত, রক্তাক্ত আজ শুভ্র চেতনা; আমি লজ্জিত,
বেদনা কাতর সূর্যের দিকে চেয়ে বলো তুমি, তোমার বোধের উত্তাপ কতটুকু?
কতটুকু তুমি নিরাপদ দেশে মুক্ত ভাবনার পথে?
কতটুকু বিষ ছড়িয়ে রয়েছে তোমার চোখের পাশে?
অথচ, অথচ তুমি তা চেনো না, জানো না এখনো

শাণিত বিবেক মার খায় আজ লাল গালিচায়
তোমরা শায়িত হয়ে যাও তবু ঘাসের মতন
তৃণভোজী খেয়ে যায় তোমাদের সদ্য গজিয়ে ওঠা চেতনার চারা

মুক্তি কি নেই?
কোথাও কি নেই মুক্ত বিবেকবান মানুষের এতটুকু নির্ভার পথচলা?

কোথায় যাচ্ছো তুমি? ভেবে দেখো এই মুহূর্তে আজ এখন!
ঘুরে দাঁড়াবার এই তো সময়; মুক্ত বিবেক সব এক হও, সচেতন হও
চিনে লও সব শত্রুর কালো পদচিহ্ন ।

জাতির বিবেক তুমি জেগে ওঠো
জেগে ওঠো দূর আকাশের জ্বলে থাকা সূর্যের মতো করে
নষ্ট জগত থেকে পুড়ে যাক সব নষ্টের খড়কুটো
ফুলে ফুলে ভরে যাক এ দুনিয়া...

শুনেছি কষ্টের রঙ নীল
উষার মাহমুদ

আকাশের নীল ছায়ায় রঙ পাল্টায় জোছনা!
ইচ্ছেগুলো বাঁক হারায়; জোছনা দেখা ভুলে
আকাশের নীল সরাতে ব্যস্ত হয়ে উঠি;
কীভাবে স্থির  থাকি বলো? শুনেছি কষ্টের রঙ নীল !
আকাশ, বড্ড ভালোবাসি তোমায়...
তোমার নীল শাড়ির নীলাভ হাসিতে
ফুল পাখি প্রজাপতি মুগ্ধ হতে পারে;
শত জনমের কষ্ট লোকানো হাসিতে
সবুজ অরণ্য নীলাভ হয়ে যায় আমার!!
একাকার হয়ে যাওয়া নদী আর পুকুরের জল
আলাদা করার বৃথা প-শ্রম আমার।
যে আকাশে মন ভালো রাখার মন্ত্র পাই
সে আকাশে নীল রেখে কী করে পালিয়ে যাই বলো?


গল্প : আল্লাহর বান্দা

গল্প : আল্লাহর বান্দা


আল্লাহর বান্দা
শরীফ সাথী

সবুজ সমারহে ছেয়ে আছে যে গ্রামটি, তাঁর নাম তীরধরা। অরণ্যে ভরা পাখিদের আদরে আদরের কলরবে মুখরিত হয় পাখিদের আঙ্গিনা। গ্রামটির তিন দিকে নদীর জলের অবাধ কলতান। বৈঠা ঠেলে মাঝি দলের এদিক ওদিক ছোটা ছুটি। তীরে বসে রাখাল বাঁশির সুর সুমধুর। যদি সে বাঁশি ,নিশীথ সুরের মূর্ছনায় হারায়। বিকালেতে কিশোর দলের বিভিন্ন রকমের খেলা। গরু ছাগলের আপন মনে সবুজ সবুজ লকলকে ঘাস খাওয়ার মনোহরী দৃশ্যে। একাকার হয় নীল জমিনের নীল নয়ন। থোকা থোকা ফুলেদের মিষ্টিময় নির্গত ধোঁয়া, বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে, সারা গাঁয়ে দিয়ে যায় অনাবিল সতেজী সুগন্ধ। মৌসুমি ফুলের সুঘ্রানে ভরে থাকে বার মাস। নদী জলের ছোট মাছ গৃহিনীদের রান্নার চূলোয় কড়াইতে ভাজা। মুগ-কলাই ডালে ভাত মাখিয়ে ছোট মাছের চাকনি খাওয়া তৃপ্তিভেজা মজাদার অনুভুতি গুলো সারা গাঁয়ে ছড়ানো। গ্রামটি ছোট হলেও গোল বৃত্তে আবদ্ধ। মানুষ গুলোর অসাধারণ চালচলন। একেবারে সাদামাটা। নম্রতাই ভদ্রতাই গড়া দেহমন। একে অপরের প্রতি সহনশীল মনোভাব। ভালোবাসার চাদরে জড়ানো, মায়াবি পরিবেশে ছড়ানো সীমাহীন দায়বদ্ধতা। এই গ্রামে  গ্রীষ্মের বজ্রে আলোকিত হয়। বাতাসের উওাল ঝাপটাই বৃক্ষের ডালগুলো এদিক ওদিক দোল খাই। বর্ষার রিম ঝিম বৃষ্টি টিনের চালে, গাছের ডালে আছড়ে পড়ার দুরন্ত আওয়াজ আর বাতাসের বৃষ্টি ভেজা শমশম শব্দ শীতল করে । এ গাঁয়ে কাদা মোড়ানো পথে পিছলে পিছলে হেঁটে যাওয়া, কখনো আছাড় খাওয়া সারা শরীরে কাদা মাটি মেখে বাড়ি ফেরা মানুষ গুলোর খাঁিট চিত্র। বাদল দিনে বৈঠক খানার আঙিনা ভরে ওঠে প্রতিটি পাড়ার জমে ওঠে মানুষগুলো রুপকথার কাল্পনিক গল্পে। জ্বিন, ভূত, দৈত্য, দানবের নানান কাহিনীর নিদারুন সংলাপে হারিয়ে যায় সবার মন। ছোলা -মুড়ির ঠুসঠাস শব্দ সবার মুখে মুখে ছন্দ সুরে বেজে ওঠে। শরতে কদম কেয়ার লাবন্যতায়, বৈচিত্রের ছোঁয়ায় সজ্জিত হয় এ গাঁয়ের প্রতিটি আঙিনা। ভাদ্রের প্রকট গরমে হিমসিম খাওয়া। আশ্বিনে কখনো বা বানের জলের মারাত্বক উৎপাত। তাল পিঠার ধুম বয়ে যায় পাড়ায় মহল্ল¬ার ঘরে ঘরে। হেমন্তে -কাস্তে হাতে মাঠে মাঠে কৃষকের ধান কেটে মাথায় করে, গরুর-মহিষের গাড়িতে করে বয়ে এনে বাড়ি বাড়ি নয়া ধান ঝাড়াতেই ব্যস্ত থাকে । নবান্নের মহা উৎসব চলে নতুন চালের আটা করে। নতুন চালের যাও ,খির ছিন্নি করার মুহর্তে শিশু কিশোরের দৌঁড় দৌঁড়, হৈ- হুলে¬াড়¬ আনন্দে ভরে ওঠে সারাগ্রাম। বৈচিত্রময় চালের পিঠাই সাজে বাড়ি বাড়ির প্রতি হাড়ি। শীতে জবুথবু হয়ে চাদর কম্বল মুড়িয়ে, সকালের আলো পেতে মুখিয়ে থাকা। জানালার পর্দা ঠেলে উঁকি ঝুকি মারা। হাত-পা ঠান্ডা ঠেকাতে পাড়ায় পাড়ায় আগুনের কুন্ড জ্বেলে তাপ নিবারন করা । কুয়াশার বেড়াজাল ঘিরে রাখে এ গাঁয়ের সব কিছু। শিশিরে ভরে থাকে সবুজের বিস্তৃর্ন সমারোহ। বসন্তের হিমেল বায়ুতে যৌবনের উদাত্ত্ব আহবান দিতে থাকে। কোকিলের দুরন্ত ডাকে উড়ন্ত  হয় প্রকৃতির সবকিছু। নতুন সাজে সেজে ওঠে নান্দনিক রুপে। রবির আলোর মুচকি হাসিতে জেগে ওঠে তীরধারা গ্রামের সাবলিল পরিবেশ।  জোৎ¯œার স্বর্নালী ঢেউয়ে দোল খায় প্রকৃতিরা। এমনই দৃষ্টিপ্রিয় মিষ্টিমিয় গ্রামের নির্ভেজাল মানুষ খোদা বকশ। সহজ ,সরল, নিরিহ জীবন চলার পথ। কাদায় দেহ সাদায় মন তাঁর। নয়নে স্বপ্নীল সুখের ছোঁয়া। মুখে যদিও হুকোর ধোঁয়া বেমানান হলেও গ্রম্যে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো। প্রতি মুহুর্তের আনন্দটুকু সানন্দে গ্রহন করে হাসি খুশি মনে তার চলাচল। ব্যথাতুর কষ্টমাখা হৃদয়টা সহজে ধামাচাপা দিয়ে ফেলে ঠোঁটের কোণের মায়াবী হাসির ঝলকে, পলকে পলকে সুখের বীজ ছড়াতে একদম ভুল করে না কখনো। মনন জোয়ারে সতেজ ছোঁয়ার ঢেউয়ে ঢেউয়ে পাড়ি দেয় আগামির পথ। সহজেই কাউকে মনের আলোয় আলোকিত করে ভালো করে তুলতে পারে। সংসারিক পারিবারিক জীবনে অনন্য উজ্বল নক্ষত্র। যা সামাজিক দেশাতœবোধে, সংগ্রামী ন্যায়ের চেতনা বোধে জাগ্রত। সত্য স্বভাবে চলতে অভাব নেই। নেই তার কোন দ্বিধাদ্বধা। মনুষত্বে আতœবিশ্বাসী সে একজন। খোদা বকশের চলনে কিছু কিছু ব্যতিক্রমী বৈচিত্রের প্রতিফলন ফুঁটে ওঠে। যা কারো কাছে সে গুলো নেই। চরিত্র বর্ননায় ভেসে ওঠে সততা, তাঁর মিষ্টি কথায় হেসে ওঠে জনতা। তাঁর প্রতিটি কথায় একাট কথা সম্পৃক্ত হয় সারাজীবন জুড়ে, মুখে বলা প্রতি মুহুর্তের সেই কথাটি এরুপ: যদি মাঠের দিকে চাষাবাদ ক্ষেতখামারে যাই সে। তাকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় কোথায় যাও?
 -যাই আল্লাহর বান্দাদের জন্য কিছু বীজ বুনে আসি। তা না হলে আল্লাহর বান্দাদের জন্য  ফসলগুলো কেমন হয়েছে দেখে আসি। আবার নদীর দিকে যেতে দেখে  যদি প্রশ্ন করা হয় কোথায় যাচ্ছো? উওর দেয় এরুপ  -যাই আল্লাহর বান্দাদের জন্য কিছু মাছ ধরে নিয়ে আসি। সেই সঙ্গে গোসলটাও সেরে আসি।  গরুর গাড়িতে করে ধান গম ভানতে নিয়ে যেতে দেখে যদি বলা হয় কোথা যাও? বা কী হবে ?
   -যায় আল্লাহর বান্দাদের জন্য ধান ভেনে আনি। তাঁর জীবনটা জুড়ে প্রশ্নের উওরে একটি কথা থাকবেই। আল্লাহর বান্দাদের জন্য। খোদা বকশ ব্যাগ হাতে বাজারে যাচ্ছে। পথের বাঁকে হোক গ্রামের মাঁচায় বসা মানুষগুলো যদি প্রশ্ন করে "কোথায় যাচ্ছো?্  ঐ একই সুরের কথা-যাই আল্লাহর বান্দাদের জন্য কিছু বাজার করে নিয়ে আসি। এভাবে দিন মাস ঘুরতেই খোদা বকশের নাম পরির্বতন হয়ে গেল। বাইরে থেকে খোদা বকশের খোঁজে লোকজন আসলে গ্রামে ঢুকতেই মানুষ দেখলে বলে, ভাই আল্লাহর বান্দার বাড়িটি কোন দিকে। আবার কেউ যদি তাকে খুঁজতে থাকে প্রশ্ন হবে আল্লাহর বান্দা কোথায় গেছে বলতে পারিস? কালে কালে খোদা বকশ নামে আর তাকে কেউ চেনেনা। শিশু কিশোর তরুনরা তাকে আল্লাহর বান্দা নামে চেনে। এমন উপাধীময় নাম আর ক’জনেরই ভাগ্যে জোটে? ধীরে ধীরে পুরো গ্রামের নামটিই পাল্টে যাবে কিনা তা কে জানে? দেশবাসী হয়তো জেনেই গেল আল্লাহর বান্দা গ্রাম। কখন হয়তো এমন হবে -কেউ প্রশ্ন করল ও ভাই কেথায় যাচ্ছো? উওর হল এরুপ-আল্লাহর বান্দা গ্রামে যাচ্ছি।

গল্প : বোধোদয়

গল্প : বোধোদয়


বোধোদয়
কবির কাঞ্চন

গভীর রাত। চারদিক জনশূন্য। একাকী পথ চলছে বিশ্বজিত চৌধুরী। হালকা বাতাস বইছে। তবুও খুব ঘামছে সে। কিছুক্ষণ পরপর পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালসহ পুরো মুখমন্ডল মুছছে।

বিশ্বজিত মিশ্র ভাবনার মধ্য দিয়ে বাসার দিকে ছুটছে। বারবার মায়ের মুখটা চোখের সামনে আসছে। মা যেন আকুতি ভরা গলায় ডাকছেন,
- বিশ্বজিত, আমাকে এভাবে একা ফেলে চলে যাসনে, বাবা। প্রয়োজনে না খাইয়ে রাখিস। তবু তোকে দেখবার সুযোগ থেকে আমায় বঞ্চিত করিসনে। তোর বৌ'র সাথে সুন্দর আচরণ করব। যা করতে বলবে তাই করবো। তোদের ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। আমার বুকের মানিক, আমাকে রেখে যাসনে।

মায়ের ডাকে বিশ্বজিত "মা! মা!" বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে যায়।
বেশকিছু সময় মাথা নিচু করে থাকে। মায়ের মুখখানা মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার পথচলা শুরু করে। খুব বড় বড় পায়ে বাসার দিকে ছুটতে লাগলো।
কিছুপথ চলার পর হঠাৎ বৌ'র মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে।

বিশ্বজিত চৌধুরী।
একটি বেসরকারি ফ্যাক্টরীর সামান্য বেতনের অফিস সহকারী ছিলেন। প্রমোশন পেয়ে পেয়ে এখন অফিসের প্রধান হিসাবরক্ষক। নিজের আয় যত বেড়েছে বৌ'র প্রতি তার নির্ভরশীলতা ততই বেড়েছে। সেই সাথে মায়ের প্রতি উদাসীনতাও বেড়েছে। ইদানিং অফিসেও কাজের চাপ বেড়েছে।
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের আগমনের হাওয়া লেগেছে। দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে বেশ রাত করে বাসায় ফিরেছে। মায়ের বিরুদ্ধে বৌ'র নিত্যকার অভিযোগ এড়িয়ে চলেছে।
এ নিয়ে সংসারে রীতিমত অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। রোজ অফিস থেকে ফিরে বৌ'র কালোমুখ দেখতে হয় তাকে। মায়ের বিরুদ্ধে শত অভিযোগ শুনে সে বলেছে,
শোন, তুমি যাঁর বিরুদ্ধে কথাগুলো বলছো তিনি আমার মা। আজকের আমিকে যিনি তিলেতিলে এতটুকুতে এনেছেন। তাঁকে নিয়ে তুমি কোন বিরূপ মন্তব্য না করলেই আমি খুশি হই। প্লিজ আমাকে আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলো না। আমাদের খোকনও ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। ও আমাদের থেকে কি শিক্ষা নিবে!
- তোমার সব কথা আমি বুঝেছি। কিন্তু আমার একটাই কথা। তোমার মা যদি এ বাসায় থাকে তবে আমি আমার বাবার বাসায় চলে যাব। আমাকে রাখতে চাইলে তোমার মাকে অন্য কোথাও রেখে আসো। কোন আপদ আমি এ বাসায় রাখবো না।
- তাহলে আমার মা তোমার কাছে আপদ হয়ে গেছে! কয়দিন পরে তো তোমার কাছে আমিও আপদ হয়ে যাবো।
- এত প্যাঁচালের দরকার নেই। তুমি অন্যত্র তার থাকার ব্যবস্থা করে দাও।
- আর কোথায় থাকবে? আমিই তো তার একমাত্র সন্তান। বাবাকে হারিয়ে আমাদের নিয়ে বেঁচে আছেন।
- আমি বলি কি! আজকাল বুড়োবুড়িরা বৃদ্ধাশ্রমেই ভাল থাকেন।
তাদের সব শখ আহ্লাদ তো পূরণ হয়েছে। এখন বৃদ্ধাশ্রমে থেকে নিরিবিলি ঈশ্বরকে ডাকুক।


স্ত্রীর এমন কথায় বিশ্বজিতের
গলা শুকিয়ে আসে। আর কোন কথা না বাড়িয়ে গেষ্ট রুমের সোফার উপর শুয়ে নীরবে কাঁদতে থাকে। পরদিন উপোস অফিসে চলে আসে। মন খারাপ করে চেয়ারে বসে থাকে সে। কোনভাবেই কাজে মন বসছে না তার। সারাক্ষণ স্ত্রীর কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ও কি করে এমন নীচ হতে পারলো। ওরও তো বাবা-মা আছেন। ইদানিং কথায় কথায় খোকনকেও কারণে-অকারণে মারধোর করছে। কিছু বললে আমার সাথেও দুর্ব্যবহার করে বসে। লোকসমাজের ভয়ে কিছু করতেও পারিনা। সংসারে অশান্তি যেভাবে শুরু হয়েছে এভাবে চলতে থাকলে আমার ছেলের ভবিষ্যৎ তো নষ্ট হয়ে যাবে। না, আর এভাবে চলতে দেয়া যায় না। আজই এর একটা বিহিত করতে হবে।
অফিস শেষে বাসায় ফিরে বিশ্বজিত। স্ত্রী দৌড়ে এসে বলল,
- এতো দেরী করে এলে যে? কি একটা ব্যবস্থা করে এসেছো?
- কিসের ব্যবস্থা?
- তোমার মাকে অন্য কোথাও রাখবার ব্যবস্থার কথা বলছি।
- আমার মা তোমার কি?
- শাশুড়ি।
- মা তোমার কি এমন ক্ষতি করেছে যে প্রতিদিন অভিযোগ করো।
- বুড়ো মানুষ। নিত্য অসুখ-বিসুখে পড়ে থাকে। আমার ছেলেকে বারণ করলেও তার কাছে ছুটে যায়। যদি ওরও অসুখ হয়?
- তুমি তো ছেলের বৌ হিসেবে যা করা দরকার তা করো না। যা ঐ কাজের মেয়েই করে থাকে।
- তার পিছে যা ব্যয় করো তা অপচয় ছাড়া কিছু না। এই সংসারে তিনি একটা অচল পয়সা।
বিশ্বজিত খুব উত্তেজিত হয়ে বৌকে গালাগাল করতে থাকে। বৌও কোন অংশে কম যায়না। মুখে মুখে তর্ক শুরু করে।
বিশ্বজিত নিজের রাগকে সংবরণ করে বলল,
- প্লিজ, আস্তে কথা বলো। মা শুনতে পারেন। তাছাড়া পাশের বাসার লোকজনে শুনলে ছিঃ! ছিঃ! করবে।
দেখি কী করা যায়!
এরপর কেউ কারো সাথে কোন কথা না বলে শুয়ে পড়ে।
পরদিন অফিস শেষে বিশ্বজিত সোজা চলে যায় ঢাকাস্থ একটি বৃদ্ধাশ্রমে। মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার সব বন্দোবস্ত করে বাসার পথে রওনা দেয়। মোবাইলটা অবিরাম বেজেই চলেছে। কিন্তু বিশ্বজিতের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আজ এক ঘোরের মধ্যে কাটছে তার সময়। আপ্রাণ বাসার পানে ছুটছে। কিন্তু তবুও পথ যেন শেষ হয় না। জীবনের সবচেয়ে নিন্দনীয় কাজটি আজ তাকে করতে হয়েছে। বিশ্বজিত বারবার তার হাতের ডকুমেন্টের দিকে তাকাচ্ছে। দু'চোখে অঝরে জল ঝরছে।

রাত সাড়ে বারোটা। বিশ্বজিত ঘরে পা ফেলতেই ভয় পেয়ে দ্রুত বেডরুমে প্রবেশ করে। স্ত্রীকে পাগলের মতো হায়হুতাশ করতে দেখে ছেলের কাছে গিয়ে বসে। খোকনের মা খোকনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। খোকন তখনও বিছানায় দাপাদাপি করছে। যেন ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রীতিমত মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। খোকনের এমন অবস্থায় ওর বাবা-মা দু'জনেই ভয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। পাশের রুম থেকে খোকনের দাদি কাঁপতে কাঁপতে খোকনের কাছে আসে। তিনি কাঁদো গলায় বললেন,
আমার দাদুর কি হয়েছে?
বিশ্বজিত অস্থির অবস্থায় বলল,
- হঠাৎ করে খোকনের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। দেখো না, মা, আমার খোকন কেমন যেন করছে!
খোকনের দাদি এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বললেন,
- বাবা, আগে খোকনকে বাইরে বারান্দায় নিয়ে যা। আর বৌমা কয়েল জ্বলছে কোথায়? তাড়াতাড়ি কয়েলটা নিভিয়ে দাও।
খোকনের মা দ্রুত জ্বলন্ত কয়েলটা নিভিয়ে দিয়ে খোকনের কাছে ছুটে যায়। ততক্ষণে খোকন একটু একটু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
খোকন দাদিকে শক্ত করে ধরে রাখে।
পাশ থেকে খোকনের মা স্বামীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
- তোমার হাতে ওটা কি?
বিশ্বজিত স্ত্রীর হাত ধরে আবার বেডরুমের নিয়ে এসে
হতাশার সুরে বলল,
- দ্যাখো, এতোদিনে তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হতে যাচ্ছে। অন্তত আজকের দিনের জন্য হলেও আমার মায়ের সাথে একটু সুন্দর আচরণ করো। কাল সকাল হলেই আমি মাকে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যাবো।
এই কথা বলে বিশ্বজিত নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। খোকনের মা স্বামীর হাত থেকে বৃদ্ধাশ্রমের ডকুমেন্টস কেড়ে নিয়ে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল,
- আমি বড় পাপী। তোমার যত ইচ্ছে আমাকে শাস্তি দাও। আমি সোনা চিনতে ভুল করেছি। তোমার মা তো আমারও মা। মাকে শুধু শুধু ভুল বুঝেছি। আজ মা এ বাসায় না থাকলে তো আমাদের খোকন মরেই যেতো। মাকে অন্যত্র রেখে আসতে বলে আমি তোমাকেও খুব টেনশনে রেখেছি। আমাদের পুরো সংসারে অশান্তি লেগেইছিল। সব দোষ আমার। আমার মাকে তুমি কোথাও নিতে পারবে না।
এই বলে স্বামীর বুকে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করে খোকনের মা।


গুচ্ছকবিতা

গুচ্ছকবিতা


গুচ্ছকবিতা
 সেলিম রেজা


দিনলিপি-৭৪

স্বপ্ন কখনো সখনো কষ্ট দেয়-
বলেই পিছু হটে অনেকেই;
স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে ! সুখের
আঁচে নিজেকে বাঁচাতেই এসো ।



দিনলিপি-১০৮

টিনএজ সময় বিলবোর্ডজুড়ে বুকের চশমা
হরেকরকম রঙে এক একটি উদোম শরীর
মডেলিং বালিকা নয় যেন শিকারী সি-গাল
অন্তর্বাস খুলে তাকিয়ে আছে স্বপ্নের চারা ।



কথোপকথন

কেমন চলছে হিমশীতল দিন!
-এই তো সাধারণ মানুষের জীবন যেভাবে যায়
সাধারণ কে অসাধারণ করলে ক্যামন হয় !
-অসাধারণ করার ইচ্ছে নেই
ইচ্ছেঘুড়ি উড়াতে চায় না মন?
নাকি ইচ্ছে করেই ডুবে থাকা চিরচেনা সেই জীবনে!
-উড়াটাই সব নয়
-নিজের কল্পনায় উড়িতো প্রতিক্ষণ
বেশ তো
-তবে মাটিতে পা রেখে
তাহলে তো আর চিমটি কাটতে হবে না
-মানুষ পাখি নয়
পাখি থেকেও বেশি মানুষ
উড়তে পারে, ঘুরতে পারে ইচ্ছেমত। পাখি তা পারে না।
পাখি তো পাখি, সে তো মানুষ নয়: স্বপ্ন তাকে ছুতে পারে না
মানুষ স্বপ্নে বিভোর হয়। স্বপ্ন পূরণে যুদ্ধ করে, সময়ে লড়ে বেসুমার
-মানুষ বুদ্ধিমান যদি সে জনে কোথায় তার সীমা
তবুও মানুষের আহুতি সীমানা পেরোতে
মানুষ স্বাপ্নিক, শুধু দরকার একটু রঙ এর।
মানুষ হতাশ হলেও আবার ঘুরে দাঁড়ায়
পাখি তা পারে না।
আশা, স্বপ্ন তাকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে  সাহস যোগায়
-হ্যা তাই
মানলেন তো আমার লজিক, যুক্তি !
অবশেষে হেসে কুটিকুটি, উত্তরে-
-মানলাম


সবুজ জমিনে ঝরে পড়া রক্তজবা

ঝোঁপে ঝাঁড়ে ঘেরা পুকুরপাড়, ভুতুড়ে অন্ধকার
নির্ঘূম রাত্রি অকুতোভয় যুবকের তীক্ষ্মদৃষ্টি
সবুজ গাছের আড়ালে, সামনেই ভয়ংকর মৃত্যু;
চোখের পলকেই হামাগুড়ি দিয়ে এগুই তুখোড় নওজোয়ান
তারা আজ একতাবদ্ধ, অহমিকায় জীবনবাজী
রেখে লড়বে মিলিটারিদের কুপোকাত করতে;
কাদা- পথ-মাঠ-ঘাট মাড়িয়ে স্বপ্ন দেখে
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের...
মিলিটারিদের শোষণ- লুন্ঠন- অত্যাচারে
ঘেন্নায় গা জ্বলে
হায়েনাদের বুটের আওয়াজ, কুচকুচে জল্লাদী
চেহারা দেখে জ্বলে ওঠে চেতনার নিউরোন
সবুজের সমারোহে সোনার বাংলা
মা-মাটি- স্বাধীনতার মান বাঁচাতে তারা আজ যোদ্ধা।
বুলেটের দ্রিম দ্রিম শব্দের আর্তনাদের
সুর ধরে পাখি সব উড়ে যায়
রক্তজবা ঝরে পড়ে সবুজ জমিনে
লাল সূর্যের রক্তিম আভায়।
কালে কালান্তরে ইতিহাস হয়ে রয়
সবুজ জমিনে ঝরে পড়া রক্তজবা।




পিপাসার জলে মৃগহরিণের জৌলুস  উৎসব

মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে উড়ুক্কু শব্দগুলো
স্পর্শে লজ্জাবতী লতার মতন কুঁকড়ে যায়;
নীলিমার নীলে ঘষে দেয় নাক নিটোল সারস
সাধনার সাধক প্রেমরাগ বাজে মথুরা বৃন্দাবনে
কামুক ঋষি চোখ বুজে, সব্যসাচী বৈরাগী
বাসনার হলাহলে ঢেঁকুর তুলে
ঈশ্বরের সমাপ্তিহীন ক্ষুধায় মাগে জল
সময়ে কাটে চাঁদ করে দু’ভাগ
কালের সাক্ষী বেবিলন, মিশরের পিরামিড
আঁকাবাঁকা গিরিপথে উম্মাতাল পথিকের কানাকানি
সারাদিন খেলা করে চুমো খায় গালে
লাল শালুকের ঢেউ ওঠে সন্ধ্যার আকাশে
উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা মাংশালু ঢিবি-সাংহাই সিটি
ঠোঁটের ধারালো চুম্বনের মতো উত্তাল সমুদ্দুর
পিপাসার জলে মৃগহরিণের জৌলুস  উৎসব।

মুদ্রণ শিল্পের কথা : বুদ্ধিবৃত্তিক একটি কাজ

মুদ্রণ শিল্পের কথা : বুদ্ধিবৃত্তিক একটি কাজ


মুদ্রণ শিল্পের কথা : বুদ্ধিবৃত্তিক একটি কাজ
আলমগীর মাসুদ

বই তো অনেক লেখা হয়। বলা চলে গল্প, কবিতা, উপন্যাস ছাড়া গবেষণার কাজ খুবই হতে গোনা। কিন্তু গবেষণার কাজটি কিঞ্চিৎ হলেও ব্যতিক্রম। আর এই ব্যতিক্রম কাজটিই খুবই সতর্কতার সঙ্গে করতে হয় একজন গবেষককে। করেছেনও। গবেষক আরিফুল আমীন রিজভী নিজের পাঠসচেতনতায় বইটি সম্পন্ন করেছেন। এখানে বলতে হয়, গবেষণা কাজে মানুষের এক ভিন্নতা উন্মোচন ঘটে এবং যদি স্বয়ং সে মানুষ আরিফুল আমীন রিজভী হন, তবে সন্দেহহীন বলতে হয়Ñ সৎ, সত্যসন্ধ, জ্ঞানব্যক্তিক উন্মোচনের পাশাপাশি, তাঁর কাজÑসমাজ, রাষ্ট্র আর মানুষের উপকারে সৃষ্টি হয়।
মুদ্রণ শিল্পের গবেষণা সূচনাভাগ ৮৬৮ সাল থেকে ২০১৭ চলমান। নিরপেক্ষকর্ম এ কাজ বাংলাদেশে এই শিল্পকে আরিফুল আমীন রিজভীÑ তাঁর শ্রম, ঘাম আর মেধাদিয়ে প্রকাশ করেছেন ‘মুদ্রণ শিল্পের কথা; অতীত ও বর্তমান’ বইয়ে। মুদ্রণ শিল্প সম্পর্কিত অনেক বেশি দুর্লভ তথ্য এই বইটিতে উঠে এসেছে। একইসঙ্গে ফেনীর গবেষণা কাজকেও অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও স্পষ্ট করবে। অনুসন্ধান আর বুদ্ধিবৃত্তিক এই কাজ-একজন গবেষকের। প্রকৃত গবেষক কেবল গবেষণাই করেন নাÑ তাঁকে জানতে হয়, হাঁটতে হয়, পড়তে হয়, ঘুরতে হয় এবং খাটুনির মধ্য দিয়ে অনেক বেশি একাজে সময় দিতে হয়। মুদ্রণ শিল্পের এই কাজে গবেষক আরিফুল আমীন রিজভী তাই করেছেন। অতঃপর আনন্দটা এখানে যে, একমাত্র বরাবর মানুষের মধ্যেই অন্তহীন ক্ষমতাসম্পন্ন একটা সত্তা জাগ্রত রয়। আরিফুল আমীন রিজভী সে মানুষ। যাঁর গবেষণার হাতও শিক্ষা-শক্তির যোগ্যতা রাখে।
ফেনী ও মুদ্রণ শিল্পকে জানতে বা গবেষণা ও তথ্যের কাজে এই গ্রন্থ সংগ্রহে রাখাটা জরুরি। গবেষণা শুধু তথ্য আর সত্যের সমাবেশই নয়Ñপাঠক ও সমাজের অগ্রসর মানুষের, পাঠের একটা সংকলনও। বইটি প্রকাশ করেছে ‘ভাটিয়াল প্রকাশন’ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। দাম ২৫০ টাকা।


৭ই মার্চের ভাষণ : স্বজাতি ও স্বাধিকার বোধের বাতায়ন

৭ই মার্চের ভাষণ  : স্বজাতি ও স্বাধিকার বোধের বাতায়ন


৭ই মার্চের ভাষণ 
স্বজাতি ও স্বাধিকার বোধের বাতায়ন
 
মীম মিজান

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্থানের সেনা শাসিত সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপন করতে থাকে। প্রকৃত পক্ষে তাদের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্থানিদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু তারা দূরভিসন্ধি করে হঠাৎ ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেষণ অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করে। এই খবরে পূর্ব পাকিস্থানের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। গোটা পূর্ব পাকিস্থান তখন অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করে। জনতার সাগরে তখন অশান্ত ঊর্মিমালার গর্জন। আকাশ-বাতাস তখন প্রকম্পিত হচ্ছে জনতার বিক্ষোভ নাদে। এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২রা মার্চ ঢাকায় ও ৩রা মার্চ দেশব্যপী সর্বাতœক হরতাল পালিত হয়। ৩ রা মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক শোক সভায় বঙ্গবন্ধু সর্বাতœক অসহযোগ কর্মসূচী ঘোষণা করেন। উক্ত সভায় তিনি ৭ই মার্চ দুপুর দুইটায় রেসকোর্স ময়দানে এক গণসমাবেশ কর্মসূচীর ঘোষণাও দেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রোজ রবিবার। রৌদ্র করোজ্বল ঝলমল করছিল চারপাশ। পুরো ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ স্বাধিকারকামী জনতায়। ঘড়িতে তখন ঠিক তিনটা বেজে বিশ মিনিট। হ্যামিলিওনের বাঁশি ওয়ালার কণ্ঠ বাঁশি নিয়ে মঞ্চে আসলেন বাঁশি বাদক। অতপর তিনি শুরু করলেন বাঁশি বাজানো। ১৮ মিনিটের সেই বাঁশির সুর নাদে উম্মাদ সর্পরূপী জনতা ক্ষোভে ফোস ফোস করলেন বহুবার। স্বাধিকারকে ঘরে আনতে শানিত করল নিজেদের। ১২ টির ও অধিক ভাষায় অনূদিত সেই অমর ভাষণটি ছিল- "ভাইয়েরা আমার, আজ-দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তাঁর অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পুর্ণভাবে আমাকে-আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।

১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খাঁন মার্শাল’ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ৬-দফা আন্দোলনের ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুব খাঁনের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খাঁন সাহেব সরকার নিলেন- তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন-গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম; ১৫ই ফেব্র“য়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেননা, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে আমরা এসেমব্লিতে বসবো। আমি বললাম, এসেমব্লির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশী হলেও একজন যদিও সে হয় তাঁর ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।

জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাঁদের সঙ্গে আলাপ করলাম, আপনারা আসুন-বসুন আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেমব্লি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ এসেমব্লিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেমব্লি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেমব্লি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেমব্লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন তিনি যাবেননা। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠল। আমি বললাম, শান্তিপুর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো, তারা শান্তিপুর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কি পেলাম আমরা, জামার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্র“র আক্রমন থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের মধ্যে- তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি- তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

তার সাথে আমার দেখা হয়, তাকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খাঁন সাহেব আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমিতো অনেক আগেই বলেছি কিসের আরটিসি, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাঁদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।

ভাইয়েরা আমার, ২৫ তারিখ এসেমব্লি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে এসে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেমব্লি কল করেছে, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখবো আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেমব্লিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিস্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্টকাচারী, আদালত-ফইজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেই জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবেনা- রিকসা-ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জর্জকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবেনা। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।

এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমারা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবেনা। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবাইয়া রাখতে পারবানা। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের ডুবাতে পারবে না।


আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাঁদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই ৭ দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাঁদের বেতন পৌঁছাইয়া দেবেন। সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয়, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না। শুনেন, মনে রাখবেন, শত্র“ বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাঁদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাঁদের মাইনা পত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন-টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়- বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুল এবং তোমাদের যা কিছু তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, ‘‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।" বঙ্গবন্ধুর উপর্যুক্ত ভাষণটিতে হঠকারিতার লেশমাত্র নেই। তখন পর্যন্ত যা ঘটেছিল ও ভবিষ্যতের সকল বিষয়ের দায়ভার তিনি পাকিস্থানি শাসকদের উপর চাপালেন দূরদৃষ্টির সঙ্গে। তিনি একটি বারের জন্যও স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম বলেননি। বরংচ বুদ্ধিমত্তার সাথে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এই ভাষণটিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হবে সে বিষয় গুলি সুক্ষ্ণভাবে তুলে ধরেছেন- "ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো" বলে। প্রকাশ্যে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করে ভিতর ভিতর স্বসস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়ার ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। তিনি এও বুঝতে পেরেছিলেন যে যেকোনো মুহূর্তে তাকে আটক করা হতে পারে তাইতো বললেন- "আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি..." । আগামী দিনে কিভাবে কর্মসূচী চলবে তারও একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা ছিল। তার বক্তৃতা দেয়ার ভঙ্গি যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে দেখি যে, বক্তৃতার অন্তর্নিহিত গাম্ভীর্য প্রকাশে ও গুরুত্ব প্দানের জন্য যেখানে যেরকম শারীরিক ভঙ্গি ও কণ্ঠের উঁচু-নিচুতা প্রয়োজন ঠিক সেখানে সেই রকম ব্যবহার করেছেন। "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।" এই বাক্যে তিনি "মুক্তির" ও "স্বাধীনতার" শব্দ দুটিতে বেশ জোরারোপ করেছিলেন কণ্ঠে। দৃঢ় সাহসিকতার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অঙ্গুলি নির্দেশনা ইত্যাদি ছিল সুনিপুণ। গভীর পর্যালোচনায় তার ভাষণের মূল কয়েকটি দিক ফুটে উঠে। যেমন: ১. সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা। ২. নিজ ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা। ৩. পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত। ৪. সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহবান। ৫. অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকাবিলার হুমকি । ৬.দাবী আদায় না-হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা । ৭.নিগ্রহ ও আক্রমণ প্রতিরোধের আহবান। একটি বদ্ধ ঘরের অভ্যন্তর যদি নিকষ কালো আঁধারে পূর্ণ থাকে, সেই ঘরের একটি বাতায়ন খুললে যেমন দিনের সূর্যের আলো প্রবেশ আরম্ভ হয় ও আঁধার দূরভিত হয়। ঠিক তেমনি বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশের নিকষ কালো লাঞ্ছনা, বঞ্ছনার আঁধার ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দূরভিত হওয়া আরম্ভ হয়। কেননা আনুষ্ঠানিক ভাবে এখানেই প্রথম বাঙালির স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়। তাইতো ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালিদের স্বজাতি ও স্বাধিকার বোধের বাতায়ন।