পদাবলি
অন্তঃসত্ত্বার ভায়োলিন
বিটুল দেব
অন্তঃসত্ত্বার অপূর্ব সকাল
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চোখে ভায়োলিন।
নব প্রাণের সূক্ষ্ম অনুভূতিতে
কচি হাত; পাখির ডানার মতো আকাশহীন উদরে।
ধ্যানে নিশ্চুপ
বিশুদ্ধ গতিপথ
আর বাতাসে মাখোমাখো আনন্দ।
একটি মুজিব ইরমীয় কবিতা
দেলোয়ার হোসাইন
গেরাম ছাড়ছি বাক্কাদিন আগে, মনো নাই গরমো না মাঘে, তারফর খতো শীত গেল, খতো বরষা আইলো, আমি ছাইয়া রইলাম মেঘর দিগে, আমারেনি যদি এখবার নাম ধরি ডাখে, খেউ ডাখেনি খেউ ডাখে না, এই শহর আমারে ছিনে না, মাটির ঘ্রাণ লেগে আছে গতরে, আমি ছাড়তে ফারি না কত’রে, গেরামো যাইমু আবার ছান উঠলে, জোনাক দেখমু ফুকরির জলে, বাছি যদি আরো কিছু দিন, আদায় খরমু মা-বাফর ঋণ, আর মরি গেলে, মাটি দিবো সবে মিলে...
বাংলাদেশ
জোবায়ের মিলন
আমার অহংকার তোমার জন্য,
তোমার জন্যই খাদ্য-গ্রহণ, জল-পান,
শ্বাস-প্রশ্বাস।
এমন মাটি আর কোনদিন পাবো না।
একজন্ম, দ্বিজন্ম যে তত্ত্বই সত্য হোক, না হোক-
এমন গন্ধ আর কোনদিন পাবো না
কোথাও না,
কোথাও না।
এমন ছায়া কোথাও পড়বে না, পড়ে না
এমন রোদ কোথাও উঠবে না, ওঠে না
এমন দিন ও রাতের জোছনা
হাসবে না, হাসে না
ভরায় না তৃপ্তির সাত মহল।
আমার অহংকার তোমার জন্য
তোমার জন্যই খাদ্য-গ্রহণ, জল-পান,
শ্বাস-প্রশ্বাস।
প্রতিহিংসার মহাপ্রলয়
সুব্রত দাশ আপন
জাগ্রত ঘুমে বিভোর জাতি,
তাই কবিতার বারান্দায় আজো শুনি
ধর্ষিতা নারীর চিৎকার;
সুপ্ত বিবেকের অধঃপতন বলে
সমাজ, আইন, সংবিধানে
দেখি মুখোশপরা শয়তারের আড্ডা।
নরকেরকীটের বেসামাল রাজনীতি
জাহেলিয় যুগের আবির্ভাবে
বাকরুদ্ধ জনতার নিঃশব্দে পথচলা;
তন্দ্রাবিহীন বিবেকের কাঠগড়া
প্রতিহিংসার মহাপ্রলয়ে গণতন্ত্র আজ শিকড়হীন।
একটি কল্পনার রাত-বিরাত
সেলিম রেজা
নীল আকাশ মাথার উপর
বাড়ির কার্ণিশে কা কা স্বরে ডাকছে কাক
বাতাসে নারীকন্ঠ, স্টেশনে রেখে পদচিহ্ন;
যান্ত্রিক কোলাহলে পথচারী রাস্তা পার হয়ে-
মতিঝিলে এসে থামে
একটি কল্পনা;
অনিদ্রায় মাঝরাতে লালচে চোখ-
এপাশ ওপাশ করে বুকে টানে বালিশ
জীবনের রোজনামচায় হিসেব কষে বেহিসেবী মেজাজ
দীর্ঘাশ্বাস ঘড়ির কাঁটা ছুঁয় নিশিভোর
ঘুমের ঘোরে খুঁজে চিবুকের ভাঁজ
অশ্রুসমুদ্রে ভেজায় দু’চোখ
বেদনাভারে মিথ্যুক স্বপ্নসিন্দুক কাঁধে
প্রবল ইচ্ছে হংস মিথুন সাঁতারবিলাস
মুঠোফোনে অনবরত সুরের সিম্ফনি
উত্তাল তরঙ্গে আর ঢেউ খেলে না ডুবসাঁতার
একটি কল্পনা-
কেউ নেই, কেউ থাকার কথাও না
আছে একা, একাই চলছে আদিগন্ত পথ...
বইচোর মনচোর
সৈয়দ নূরুলআলম
ঢাকা শহরে চোরের উৎপাত বেড়েছে
প্রায়ই চুরি-চামারি, ছিনতাই হয় অলিতেগলিতে
ক্রমবর্ধমান এ ত্রাসে আতঙ্কিত সবাই।
কিন্তু বইচোর আর মনচোর একটিও বাড়েনি এত বছরে,
গত শতাব্দীর শেষ ভাগে যে তরুণ টিটিউশনি করতে যেয়ে
ছাত্রের বাসা থেকে সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’
চুরি করে অবলীলায় পাড় পেয়ে যায়। সেই একই যুবক
মৌমিতার মন চুরি করতে যেয়ে বৌদিও কাছে
হাতেনাতে ধরা খায়। এরপর আর হয়নি,বইচুরি-মনচুরি
কোনোটি তার। অথচ ঢাকাকে শুদ্ধ করতে মনচোর না হলেও
বইচোরের বড় বেশি প্রয়োজন, এই বৈরী আবহাওয়ায়।
অলব্ধ পতাকা
রুদ্র সুশান্ত
দেবী, শোন- তোর কাঁধে হাত রেখে ভালোবাসার রোমান্টিক উপখ্যান লিখে দিই, তুই চোখ তুলে থাকালে স্বর্গটা মর্তে বুক দাপিয়ে চলে আসে।
ঠিক যেন শ্যাওলা দেয়ালে একজোড়া টিকটিকির নির্মল বসবাস, এই পৃথিবীর গণতন্ত্র কিংবা জোতিষশাস্ত্র তাদের কোন ভাবনা দিতে পারেনি।
কে কি বললো, কোথায় কি হলো, তুই কাছে থাকলে আমার কখনো এসব মনে পড়ে না;
আমাকে যদি একটা বৃত্ত ভাবিস্ তবে ব্যাসের মধ্যবিন্দুতে তুই থাকিস্।
অযথা গনিতবিদ্যায় সহস্র ডিগ্রী না নিয়ে থিয়েটারের মঞ্চে তোর চোখে চোখ রেখে পড়ে যাবো রবীন্দ্রনাথ,
আর আমার কবিতার পান্ডুলিপি- যেসব কবিতার উত্থান হয়েছে দেবীর ভাবনা থেকে।
উন্মুক্ত মঞ্চের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তোরে নিয়ে হিজল বন চলে যাবো, পাশে জারুল গাছের শীতল বাতাস সোহাগ মেখে দিবে তোরে, হিজলের বাগানে রঙ মাখিয়ে তুই আর আমি উন্মুখ হয়ে জ্যোৎস্না স্নান করবো- আর পৃথিবীর ললাটপটে লিখে দিবো আদিতম ইতিহাস।
স্বর্গে পুষ্প বৃষ্টি হবে তোর আগমনে-
আমি ভিখারীর মতোন সুখ ছুঁয়ে নিবো তোর ভালোবাসার নদী থেকে।
আমাদের মোহনপ্রেমের রিহার্সাল লিখিতি হবে মাঠের সবুজ রুমালে,
তোর নির্বাক চাহনির উজ্জ্বল মন্ত্রধ্বনিতে নৈবেদ্য পেতে দিবো আমি, গঞ্জে ফিরে এসে প্রেসক্লাবে জানিয়ে দিবো আমাদের ‘শুভ পরিণয়’।
হাতে হাত রেখে সিনেমাহল থেকে ফিরে প্রেমের বেহেলায় তুলবো নিষ্পাপ পাললিক সুর। মগজের ভায়োলিনে তোকে গেঁথে মহাসমুদ্রের মহাকল্লোলের মতোন তোর চোখে এঁকে দিবো- সহস্র জনমের সুখ, প্রস্তর যুগের প্রেমোপন্যাস, টিএসসির নাট্যমন্দিরে বার বার ‘দেবী’ নাম ধ্বনিত হবে।
ভালোবাসা নামে কোন নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখিনি, আমি নির্ভেজাল মোহনায় মেখে রেখেছি তোর ছোঁয়া, অগন্থিত প্রণয়বাক্য।
চাঁদ যেখানে জ্যোৎস্না দেয়নি, সেখানে পৌঁছে গেছে তোর হাসি।
একদিন নির্ঝঞ্জাট বাতাস নিয়ে তোর সম্মুখে এসে বলে দিবো- ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’।
দেবী, তোর নয়নে লিখে নিস্ আমার নাম,
ধর্ম, কবিতা, জীবন সবখানেই ‘তুই’ একটি সর্বনাম।
ভালোবাসি তোরে, দেবী, ভালোবাসি।
এই হোক পৃথিবীর বৃহত্তম উপন্যাস।
চিরস্থায়ী অন্ধকার
নাফছি জাহান
তোমার নিক্ষেপ করা বেদনার চিৎকার শুনতে পাও?
অবিরত প্রতারণার ফাঁদগুলো কতোটা অনায়াসে
শৈল্পিক মনে গড়ে তুলেছিলে
আমায় আঘাত করবে বলে,
আশ্চর্যজনক ক্ষমতা ছিল তোমার অন্তরে।
অশ্রুজলে সিক্ত হয়েছি প্রতিক্ষণে
তবু বুঝতে পারিনি
বাহ্যিকতার বিপরীতে কেমন ছিল,তোমার অভ্যন্তরে।
প্রতিবাদহীন নিষ্প্রাণ কাঠের পুতুলের ন্যায় চলে এসেছি দূরে,
অন্ধকারের আগমন ঘটেছে এ জীবনে তোমার প্রার্থনাতে,
চিরস্থায়ী অন্ধকারের প্লাটফর্মে পৌছে গিয়েছি আমি
তুমিতো চেয়েছিলে এমনই।
মধ্যাহ্নের অধিকার
সতী
দূর্গাৎসব অদূরেই বৈ কি! বিষদ ও অভিমান উপেক্ষায় লাল পেরে সাদা শাড়ী সুখ রুপে। কোন এক মধ্যাহ্ন রাতে কুয়াশা হয়ে ছেয়েছিলে, টেনেছিলে চন্দ্র স্নানের নগ্নতায়।
উষ্ণাধরে ফিসফিসিয়ে বলেছিলে- ‘আমি প্রাণনাথ, তোমার প্রাণনাথ’ ‘দাও অধিকার আদিম গুহাবাসী উন্মুক্ত যৌবনা ললনার বক্ষাবেষ্ঠনে বাকলের মত’ ‘দাও অধিকার শাণিত পাথরাস্ত্রে নির্দিষ্ট লক্ষে আঘাতের’ ‘দাও অধিকার গাছের ডালে ঘর্ষণে ঘর্ষণে উৎপাদিত প্রথমাগ্নি ভীতিতে
নর ও নারীর কাছাকাছি হয়ে অদৃকার্ষণে ঘনিষ্ঠতায় কামাগ্নিতে জ্বলে উঠবার’ প্রাণনাথ.....
সেদিনের মধ্যাহ্ন রাতে নিদ্রিত সতী জাগ্রত
হবার পর থেকেই
স্বর্গীয় ফুলে তোমাতে অর্ঘিত হবার তপস্যায়। সত্যিকারার্থে কেউ না থাকার পরেও ‘কেউ আছে’ ভাবা কতটা
যাতনার তুমি জানো কিনা জানিনা! এবারের বিসর্জনের আগেই প্রাণনাথ আগত হলে
সহাস্যে দুর্দমনীয় প্রেমলীলায় তোমাতে সতীতে সংস্রব ঘটবে। তার পর দূর্গাৎসব হলেও অন্তত বিসর্জন হতো না।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নান্দনিক উপমা ও চিত্রকল্প
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নান্দনিক উপমা ও চিত্রকল্প
রাহাত রাব্বানী
বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ মানেই নান্দনিক উপমার বিশাল এক সমাহার। রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভবের এক জগৎ ফুটে আসে। গ্রাম বাংলার প্রকৃতির যে ছবি তিনি কবিতায় এঁকেছেন, তার তুলনা তিনি নিজেই। আর এই প্রকৃতির সাথে মিশিয়েছেন অনুভব আর বোধ; যা একত্রে কবিতা অনন্য এক শিল্প হয়ে ধরা দিয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বৈশিষ্ট্য ‘চিত্ররুপময়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, জীবনবাবু সম্পর্কে প্রথম মন্তব্য করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৫ সালে ষোলো বছরের জীবনানন্দ কিছু কবিতা পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি রূঢ় হলেও এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যে জীবন বাবুর কবিতায় নতুনের ছোয়া ছিলো।
‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে।’
উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক সৃজন, রঙের ব্যবহার, অনুভব সব মিলিয়ে জীবনানন্দ তৈরি করেছেন অপ্রতিম কবিভাষা। তাঁর ব্যবহৃত উপমাগুলো প্রতিষ্ঠিত অন্য কবিদের থেকে ব্যতিক্রম। এছাড়াও নান্দনিকতাঋদ্ধ এসব উপমা জীবনানন্দ দাশের কবিতা বিশেষভাবে শনাক্ত করতে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
জীবনানন্দ দাশের অন্যতম পাঠকপ্রিয় কবিতা ‘বনলতা সেন-এ বলেছেন:
‘...পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’
পাখির নীড়ের সাথে চোখের তুলনা! কী অদ্ভুতভাবে ভেবেছেন কবি। পাখি যেমন তার নিজ বাসায় শান্তি পায়, আনন্দ পায় ঠিক তেমনি বনলতার চোখে আনন্দ, শান্তি। এই শান্তির চোখের কথাই অসাধারণ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন ‘পাখির নীড়’ উপমায়। কখনো কখনো চোখের উপমা ‘বেতের ফল’ হয়ে ধরা দিয়েছে। ‘তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে! (হায় চিল)
আবার ‘রাত্রিদিন’ কবিতায় দেখা যায় জীবনের স্বচ্ছতা বাড়াতে ‘শিশির’ উপমা হিসেবে এনেছেন। জীবনের স্বচ্ছতা শিশিরের মতো। লিখেছেন:
‘একদিন এ জীবন সত্য ছিলো শিশিরের মতো স্বচ্ছতায়।’
কখনোবা শিশিরের জল তাঁর কবিতায় ‘কাঁচের গুঁড়ি’, আবার কখনো ‘বরফের কুচি’ হয়ে দেখা দেয়। আবার স্বচ্ছতার উপমা বুঝাতে ‘নক্ষত্র’-ও এসেছে। একই শব্দের উপমায় একেক জায়গায় একেক নতুন শব্দজুড়ে দিয়েছেন কবি।
সন্ধ্যা নামার দৃশ্যে কবি এঁকেছেন পেঁচার পাখা;
‘দামামা থামায়ে ফেল- পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক
রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ!’
পেঁচার পাখা ছাড়াও কবি অন্ধকারকে আলোর রহস্যময়ী সহোদর বলেছেন ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায়। শিশিরের শব্দের মতন মনে হয়েছে কখনও-বা।
জীবনানন্দ দাশ কত সূক্ষ্মভাবেই তাঁর কবিতা কেবল উপমার প্রকাশ দিয়েই অন্যমাত্রায় নিয়েছেন। ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতাটির প্রায় অংশজুড়েই পরাবাস্তবতার ছাপ। পরাবাস্তবতা লিখতে গিয়েও জীবনানন্দ চিত্রকল্প তৈরি করেন:
ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পা-ুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্ত থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।
‘শিকার’ কবিতায় কবির চোখে ভোর আর ভোরের আকাশে তারার উপমা এসেছে নান্দনিকরূপে ভোর;
আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল:
চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ।
একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে:
পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো।
তাছাড়াও সূর্যকে সাজিয়েছেন নানান ভাবে। কখনো আবার সূর্য নিজেই হচ্ছে অন্যের অলংকার। যেমন:
‘সোনার বলের মতো সূর্য’
-এখানে কবি সূর্যকে দেখছেন সোনার বলের মতন করে। আবার এই সূর্যই হচ্ছে প্রেয়সীর সুন্দর বর্ণনার সাজসরঞ্জাম, ‘সূর্যের রশ্মির মতো অগণন চুল’। রোদ-ও এসেছে এখানে শরীরের রঙ বুঝাতে রৌদ্রের বেলার মতো শরীরের রঙ।
অন্যক্ষেত্রে কবি রোদের রং বর্ণনা করেছেন, রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নদীর কথাও এসেছে বারবার
‘মধুকুপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির
কালীদহে ক্লান্ত গাংশালিখের ভিড়’
কিংবা
‘পৃথিবীতে ম্রিয়মান গোধূলি নামিলে
নদীর নরম মুখ দেখা যাবে-’
বা
‘বিকেলের নরম মুহুর্ত;
নদীর জলের ভিতর শম্বর’
কোনো কবিতায় নদীর এ ঢেউ গোলাপী বর্ণ লাভ করে। কখনোবা প্রিয়তমার সাথে গভীর মিল খুঁজে পেয়েছেন তিনি। নদী-নক্ষত্র জীবনান্দ দাশের কবিতায় প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে। প্রিয়ার অপেক্ষায় বসে কবি শোনান, ‘বসে আছি একা আজ, ওই দূর নক্ষত্রের কাছে।’ এছাড়া ফুলের বন্দনাও করেছেন জীবনানন্দ দাশ। এখানেও তিনি অন্য কবিদের থেকে আলাদা। তিনি গোলাপ, জুঁই, হাস্নাহেনায় মাতাল হননি। তিনি মাতাল হয়েছেন চালতা, ভাঁট, চাঁপা, কাঁঠালীচাপা, অপরকজিতা, মচকা, করবী, সজিনা ফুল- এ। রজনীগন্ধা তাঁর কবিতায় ব্যথিতা কারো জন্য উৎসর্গ করেন। নারকেল ফুলের সুন্দরও দেখেন তিনি।
নদী, ফুল, গুল্ম, লতা ছাড়াও জীবনানন্দ দাশ চিত্রকল্প সৃষ্টিতে লক্ষ্মীপেঁচা, চিল, ইঁদুরকেও ব্যবহার করেছেন সফলতার সাথে। তাঁর এমন নান্দনিক উপমা প্রয়োগ এবং চিত্রকল্প সাধারণ পাঠকের কাছে ধরা দেয় অসাধারণত্ব নিয়ে। আর জীবনানন্দ হয়ে ওঠেন আধুনিক মন ও মননের প্রতিভূ।
মহাকালের কথা
মহাকালের কথা
সকাল রয়
জানি মহাকালরাত্রী পেরুলেই সোনার প্রভাত। বর্ষণে-গর্জনে-ঢেউয়ে আমাদের অপেক্ষা। বৃষ্টিদেবীর দমকল বাহিনীর মহড়া চলছে আর তান্ডব মঞ্চে আমাদের দশজোড়া ভেজাচোখ।
বাবা, বলছে- ‘থেমে যাবে ঝড় এক্ষুনি’। মা, বলছে- আরেকটু ধৈর্য্য ধর। আমি চোখ বুঝে অন্ধকারে উড়ে উড়ে ফিরে আসছি পথের পর পথ। হাত জড়াজড়ি করে আমরা ভাইবোন কতকাল যে দাড়িয়ে ভিজে যাচ্ছি তা বলা যাচ্ছেনা।
বৃষ্টিকুমারীর মহড়ায় উড়ে গেছে আমাদের ঘরের চাল! শিলানৃত্যের তান্ডবে জড়িয়ে আমরা ভাইবোনসব একটি ছাতার তলে। দুটো ছাতা নেই আমাদের। বাবা তার দু-হাত জড়িয়ে, মা তার আঁচল ধরে ভিজে যাচ্ছে একমনে। সকাল আর আসেনা বৃষ্টি আর থামে না শুধু আমাদের পায়ে খিল ধরে যায়। আমাদের দশজোড়া চোখে রাত নামে জলের মতো ভেজা ভেজা রাত। রাত জলে ডুবে ডুবে দীর্ঘ হয়।
উঠোন ডুবে গেছে। গেছে ডুবে সন্ধ্যা-বেলী আর টাইম ফুলের গাছগুলো। ভেসে গেছে কাগুজে নৌকা, শোলার শালিক পাখির ছানা। ভাঙ্গা টেবিলের উপর রাখা বইয়ের স্তপ উল্টে গিয়ে ভাজে ভাজে ঢুকে আছে শিলা আর বৃষ্টি। ভূগোল বইটি ভিজে ঢোল হয়ে এখন আর বৃষ্টি-শিলার পার্থক্যের কথা বলছে না।
মাথা নত প্রহরীর মতো বাঁশের বেড়া গুলো বেঁকে-ভেঙ্গে দাড়িয়ে আছে, ক্যালেন্ডার তার পথ পেরিয়ে পৌছে গেছে বছরের শেষ মাসে। বিছানা-বালিশ ডুবে ডুবে ভেসে ভেসে ঘুরে ঘুরে ঘরময় ঘুরছে। বাড়ছে ঢেউ হেসে যাচ্ছে না দেখা অনেক কিছু।
জানি রাত পেরুলেই সকাল হবে কিন্তু সে আর হয় না, বৃষ্টি আর থামে না। আঁধারে জড়োসড়ো আমাদের দশজোড়া চোখ। বেড়ে যায় চিরচেনা তরুণী রাত। বেড়ে যায় পায়ের পাতায় খেলা করা উর্বশী বৃষ্টিজলের আলোড়ন।
বৃষ্টিকুমারীর বাড়ন্ত তান্ডবে মা তার হাতদুটো কপালে ঠেকিয়ে ঈশ্বরকে ডেকে যান। বাবার ভয়ানক বিশ্বাস ঈশ্বর এসে আমাদের ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষে করবেন। অপরদিকে ঈশ্বর ফ্ল্যাশ লাইট জে¦লে দেখে দেখে হেসে নেয় খুব !
ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শাদমান শাহিদ : পর্ব ১০
রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ
(গত সংখ্যার পর)
তখনো আমি বোঝাতে চাইলাম—এ-বিষয় নিয়ে এখন কিছুই লেখবে না তুমি। তার চেয়ে বরং অন্যরা যেভাবে তেলতেলে লেখা দিয়ে কাগজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলা একাডেমির বইমেলায় চটকধারি বিজ্ঞাপনের বদৌলতে রাতারাতি নাম কামাচ্ছে। সিস্টেম করে ছোট-খাটো পুরস্কার থেকে শুরু করে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। তুমিও সে-পথে হাঁটো। দেখবে কোথাও কোনো ঝুট-ঝামেলা নাই।
ও তখন বলে—আমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শুনে হাসি পায়। বলি, ‘মানলাম মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার কিন্তু তোমাকে যা বলছি এর ব্যত্যয় হয় না যেনো। শিল্পচর্চায় রাজনীতির পঁচা লাশ টেনে আনবে না। এতে দুর্গন্ধ ছড়াবে। তার চেয়ে বুদ্ধিজীবীদের মতো বাতাস বুঝে ছাতা ধরো। দেখবে লক্ষ-কোটি বছর ধরে বেঁচে আছো। দুনিয়ার কোনো আঁচড়ই তোমার গায়ে পড়বে না। সে তখন জানতে চায়—আমি তার সাথে ঠাট্ট্রা করছি কি না? আমি বললাম—না, ঠাট্টা করছি না, ‘আর্ট ফর লাইফ’ তো আমাদেরই মনের কথা। কিন্তু সময়টা এখন আমাদের পাশে নেই। পাকিস্তান বা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সাথে এ-সময়টাকে মেলানো ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। তখন মানুষ অতটা আত্মকেন্দ্রিক ছিলো না। এবং এ-কারণেই সন্তানহারা পিতাকে মিডিয়ার সামনে ‘এ-ছেলে আমার নয়/ আমি তাকে সন্তান বলে স্বীকার করি না/ তার লাশ যেখানে খুশি ফেলে দেয়া হোক ইত্যাদি ইত্যাদি’ চিৎকার করে বলতে হয়। কিংবা ‘শুভবুদ্ধির উদয় হোক’ অমরবাণী উড়িয়েও কেউ কেউ নিজের ভেতর সান্ত¦না খোঁজার চেষ্টা করেন। এজন্যেই বলছি, তুমি যে পথে হাঁটছো, ওটা সাংঘাতিক মৃত্যুময়। এখন যেহেতু লিখে ফেলেছো, তখন গোপন করে রেখে দাও। সময় হলে একদিন তা ঠিকই কথা বলবে। কিন্তু শোনেনি। আরেকদিন শুনি প্রফেসর বাসির আহমেদ সস্ত্রীক কানাডায় চলে গেছেন। তিনি চলে গেলেন কেনো? তাঁর ছোটো মেয়ে ব্যারিস্টার কুহিনূরকে জিজ্ঞেস করলে জানায়, তিনি নাকি সাম্প্রতিক সময়ে ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে পত্রিকায় কী সব লেখালেখি করছিলেন। যে-কারণে ভিসি মহোদয় তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে অপমান করেন। শুধু এখানেই শেষ নয়, বিষয়টাকে কেন্দ্র করে বাসার বাইরেও তাঁর জন্যে চলা-ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। মোবাইলে প্রায়ই নানান হুমকি-ধুমকি আসতো। কুহিনূর আমাদেরকে কয়েকটা এসএমএসও দেখায়। একজন লিখেছে, ‘কীরে নটির পুত ফোন ধরিস না ক্যান? আবার যদি উল্টা-পাল্টা লেখিস না, বাংলাদেশে বাস করা তোর জন্য হারাম কইরা দিমু’। আরেকজনকে দেখলাম সাত পা এগিয়ে। সে লিখেছে, ‘তোর বাসার ঠিকানাটা দে, তোর বউ-ঝি’রে একটু আদর কইরা আসুম নে, তাইলেই তোর মাথামুথা ঠিক অইবো’। এসব করেও যখন দমাতে পারেনি, তখন লেলিয়ে দিলো পেশাদার খুনি আকবরকে। ভাগ্যিস আকবর কোনো-এক সময় তাঁর ছাত্র ছিলো। তা না হলে...।
আকবর তো চলে গেলো। আবার হয়তো আকমলকে পাঠাবে। সে-ও লজ্জায় মাথা নুইয়ে চলে গেলে, পাঠাবে আফজলকে। সে-ও চলে গেলে, আসবে আকরম। আর সে যদি পরশুরামের মতো পিতৃআজ্ঞা-মাতৃআজ্ঞা মনে করে...তখন? সে- আতঙ্কেই হয়তো চলে গেলেন তিনি।
মাঝখানে আমিও একবার ভেবেছিলাম, দেশের বাইরে কোথাও চলে যাবো। বড় খালা ইংলেন্ডে আছে, ইমু’তে কথা হয়। প্রায়ই বলে চলে যেতে। ওখানে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে। যাইনি। মনে হলো মহল্লার পাতিদেবতারাও তাই চায়। আমি চলে গেলেই বাড়িটা দখল নেবে। একাত্তরের পর শীতল বাবু যেমন ইকরতলীর তালুক, খাটিংগার লিচুবাগ, রাধাগঞ্জের পাটগুদামটা আর ফিরে পায়নি, ঋষিদেবীর ভিটে যেভাবে নয়ামুক্তিযোদ্ধা রফিক কমিশনারের হয়ে যায়, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রহমানের নাম-সনদ যেভাবে গায়েব হয়ে গেলো, আমার বাড়িটাও সেভাবে পাতিদেবতার হয়ে যাবে। মেয়েমানুষ বলে কথা, যতোই রাজনৈতিক সচেতন হই, একপাল হায়েনার সামনে একটি হরিণ শাবকের কিছুই করার থাকে না। সবাই জানে, একাত্তরসহ তার আগে-পরে দেশের জন্যে বাবা কী করেছে। অথচ সবই আজ হাঙরের পেটে। কোথাও তার নাম-গন্ধটা পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
‘সারভাইবল অব দ্য ফিটেস্ট। বেঁচে থাকতে পারাটাই যোগ্যতার পরমিাপ। মনীষী ডারউইনের এই তত্ত্ব ধরেই এগুতে হবে। কোনো তস্করের হাতে এই ঠিকানা ছেড়ে দেয়া যাবে না। বাঁচতে হবে অনন্তকাল। অনন্তকাল বাঁচতে হলে অভিনয় করতে হবে। আমরা অভিনয় করবো। দেবতারা সবাই যেখানে অভিনয় করে যুগ যুগ ধরে টিকে আছে, সেখানে বাদ যাবো কোন্ দুঃখে? আমরাও অভিনয় করবো। এতে পাছের লোক যা ইচ্ছে বলে বলুক। কান দেবো না। অভিনয় করবো। দেশের যতো স্থাপনা আছে সবকটাতে দেব-দেবীদের নাম লাগিয়ে দেবো। এতে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সুরক্ষা হবে। আবার সময় বদলে নতুন দেব-দেবীরা সামনে এসে দাঁড়ালে, সাবেক দেব-দেবীদের নাম মুছে দিয়ে নতুনদের নাম বসিয়ে দেবো।’ একদিন ক্লাব সভাপতি নজরুল আলম সাহেবের মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর মনে হলো, উপস্থিত সদস্যরাও যেনো তাই চায়। এসবের কিছুই আমরা সরাসরি করবো না। কাঁটা তুলবো কাঁটা দিয়ে। আজকে যার প্রশংসা করবো, কালকে তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়বো। এ-দোষও আমাদের ঘাড়ে পড়বে না। সুযোগ পেয়ে দেবতারাই একে অপরের দোষ শতমুখে বলে বেড়াবে। আমরা কেবল হাততালি দেবো। আনন্দ উল্লাস করবো। মিষ্টি বিতরণ করবো। সে-মিষ্টির টাকাও দেবতারাই দেবে। আমাদের কাজ শুধু তেলাপোকার মতো তেলতেলে আভিনয় করা। হাত কচলাতে কচলাতে বলবো—জি আজ্ঞে, জাঁহাপনা। আদতে আমরা কিছুই করবো না। কোনো সাহায্য করবো না দেবতাদের। সেদিন এক দেবতা ঘোষণা দিয়েছিলো; মহাশ্মশান থেকে স্বর্গে যাওয়ার জন্যে নরকের ওপর দিয়ে বিগ বাজেটে একটা ব্রিজ তৈরি করা হবে। ভক্তবৃন্দ যেনো যার যার এ্যাবিলিটি অনুযায়ী দান-খয়রাত করে। শুনে আমরা মনে মনে বলি—এক পয়সাও না। আমরা এক পয়সাও দিইনি। দেবতা নিজেই তার কেরামতি দিয়ে ব্রিজ তৈরি করছে। করুক। ওটা হলে আমাদেরই লাভ। আমরাই ওটার উপর দিয়ে আসা-যাওয়া করবো। যাদের হাত-পায়ে ভর করে জীবিকা খুঁজতে হয়, তাদের যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ না হলে চলে না। কিন্তু দেবতাদের কোথাও যেতে ব্রিজের দরকার হয় না। তাদের তো রথই আছে। রথারোহীদের কাছে উত্তর-গোলার্ধ, দক্ষিণ-গোলার্ধ বলতে কোনো শব্দ নেই। তারা উড়ন্ত রথে বিশ্বব্রহ্মা-ে যেখানে খুশি নিমিষে চলে যেতে পারে। আর যদি কখনো সড়ক পথে নেমেও পড়ে, তাতেও আমাদের লাভ। ভেঙে পড়া পুরোনো রাস্তাগুলো দেখিয়ে বলবো, ‘দেখুন ভোলানাথ, কী চরম ভোগান্তিতে আছি। শুধু আপনার পূজারি বলেই আমাদের এই সিদ্দত। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বিরা আমাদেরকে দেখতেই পারে না।’ তখন উন্নয়নও হবে, পাশাপাশি দেবতায় দেবতায় মল্ল যুদ্ধও উপভোগ করা যাবে।
যে জিতবে তার নামেই হবে আমাদের বন্দনা। স্ক্রিপ্ট থাকবে আগেরটাই। আমরা শুধু কয়েকটা শব্দ বদলিয়ে নেবো। ‘জয় বাংলা’ ওঠে গিয়ে সংলাপে স্থান নেবে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। বাবা হয়ে যাবে আব্বা আর মা হবে আম্মা। সবুজ দা স্থলে লিখবো সবুজ ভাই। জনক-মহাজনক বলতে কোনো শব্দ স্ক্রিপ্টে স্থান পাবে না। সেখানে লেখা হবে নায়ক-মহানায়ক। আমরা সবকিছু সুচারুভাবে রপ্ত করে নেবো। কোথাও ভুল করবো না। অভিনয়ে ভুল করা যাবে না। এমনিতেই দেশে অভিনয়-বাণিজ্যের অবস্থা করুণ। সেখানে ভুল করলে বিএফডিসি’তে মানুষ তো দূরের কথা গরু-ছাগলও ঢুকতে দেবে না। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া ঘোষণা দিয়ে ওটাকে বানাবে বুট জাদুঘর। কোন ছায়াদেবতা কোন বুট পরে নরকের ওপর দিয়ে লাফিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করেছিলো, কোন্ বুটের আঘাতে আমাদের ছালেহা-মালেকা-হরিদাসীর তলপেট ফেটে পদ্মা-যমুনার পানি লাল হয়ে গিয়েছিলো, কোন্ বুটের লাথি খেয়ে আব্বাস-কুদ্দুস-রঞ্জিতের মুখের সবকটা দাঁত মারবেলের দানার মতো পরে পিচ-ঢালা পথে গড়াগাড়ি খাচ্ছিলো; সবই সংরক্ষিত হবে ঐ-জাদুঘরে। আমাদের প্রজন্ম তখন পাঁচশো-এক হাজার টাকায় টিকেট কিনে পবিত্র বুটজুতো দেখতে সপরিবার লাইন ধরে জাদুঘরে ঢুকবে। আমাদের রক্তে তো আবার আবেগ বেশি, কেউ কেউ হয়তো বুটের রক্তছাপ দেখে আবেগে জিহ্বা দিয়ে চাটতে যাবে। তখন তাদের মরণ ব্যাধি হতে পারে। সুতরাং অভিনয়ে ভুল করা যাবে না। এখন অবশ্য পারত পক্ষে ভুল হয় না। সেদিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে জসিমউদ্দীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। দেখি আমাদের সম্মানিত বক্তারা চমৎকার অভিনয় করছে। ভুল হচ্ছে না কোথাও। তারা একবারও তাদের বক্তৃতায় জসীমউদ্দীনের নাম উচ্চারণ করেননি। যতোক্ষণ মঞ্চে ছিলেন ততোক্ষণই দশমুখে প্রধান অতিথি মন্ত্রী মহোদয়ের প্রশংসা করেছেন। আর আমরাও ঘন ঘন হাততালি দিয়ে তাকে সাপোর্ট করে গিয়েছি। শেষে মহান অতিথি খুশি হয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারে, সেজন্যে দশ রাস্তায় দশটি বাস নামানোর ঘোষণা দিলেন। ধন্য ধন্য করে রব উঠে গেলো সেমিনার জুড়ে। যাতায়াতের বিড়ম্বনা থেকে আমাদের সন্তানরা মুক্তি পাবে ভেবে খুশি হলাম আমরাও।
চিন্তা করলাম, এমন একটা অনুষ্ঠান তো আমরাও করতে পারি। বছরের শুরুতে ক্লাবের উন্নয়নের জন্য বেশকিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম, টাকার অভাবে একটিও বাস্তবায়ন করতে পারিনি। লোক-টোক ধরে যদি কোনো-মতে এই প্রধান অতিথিকে নেয়া যায়—তাহলে আর ঠেকায় কে? ‘সত্যেন সেন স্মারক বক্তৃতা’টা আবার শুরু করবো। প্রজন্মের সামনে সত্যেন সেনকে তুলে ধরতে হবে। সত্যেন সেন না পড়লে পৃথিবীর রাজনীতির নষ্টামির কোন চিহ্নই ওরা ধরতে পারবে না। তিনি যেভাবে উপন্যাসের ভেতর বিশ্বরাজনীতিকে পোস্ট-মর্টেম করে সিদ্ধান্ত টেনেছেন, এমন দৃষ্টান্ত এখন কল্পনাও করা যায় না। অথচ এ-নামটিই দিন দিন পাঠকের উচ্চারণের বাইরে চলে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্য তো এখানেই, অলেখকদের নিয়ে যতোটা মাতামাতি করি, সেখানে সত্যিকারের লেখকদের ততোটা চিনিই না। আবার এটাও ভাবি, হবেই বা কী করে? তাঁকে তুলে ধরার যাদের দায়িত্ব তারাই এখন পুঁজিবাদের দালাল। একদিকে মেহনতি মানুষের কথা বলে নিজেদের জিভ ছিঁড়ে ফেলছে, অন্যদিকে তারাই ব্যক্তিগত দুটো সুবিধার জন্যে পুঁজিবাদের দোর-গোড়ায় বসে থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে অনুগত ভৃত্যের মতো অভিনয় করে। টিভিতে তাদের চেহারাটাও দেখার মতো। মনে হয়, ঊনিশ শতকের ইংরেজ পালিত হিন্দু জমিদার বুঝি। কথাও বলে আকাশে তাকিয়ে। আর ভাবটা এমন যে, কোথাকার কোন মালো লেখকের নাম উচ্চারণ করার সময় কোথায় তাদের? এজন্যেই আমাদের কোনো কাজে ওদেরকে ডাকি না। ওদের চাইতে আমাদের দেবতারা অনেক ভালো। বাসি ফুল দিয়েও যদি হাসিমুখে দুটো কথা বলি, তাতেই আমাদের দেবতারা গলে যায়। হৃদয়টা ছিঁড়ে হাতে তুলে দিতে চায়।
আমরা তখন মনে মনে হাসি।
যাক এসব। একটা অনুষ্ঠান করতে হবে। ‘সত্যেন সেন স্মারক বক্তৃতা’টাই আয়োজন করবো। এতে অবশ্য ব্যানারের সত্যেন সেন ব্যানারেই থেকে যাবে। যাক। তারপরও কিছু টাকা আয় হবে এবং ওটা দিয়ে সত্যেন সেন নামে একটা স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা যাবে। এটাও মন্দ হয় না।
এই ভেবে যখন পরস্পরের মধ্যে আলোচনা শুরু করছি, তখনই একদিন শুনি রাতের অন্ধকারে কে বা কারা ক্লাবের দরোজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে। ক্লাবে নাকি রাজনীতির চর্চা হয়। সরকার বিরোধী উল্টা-পাল্টা কথা হয়। ক্লাব হচ্ছে অবসর সময় কাটানোর স্থান। এখানে পত্রিকা থাকবে, লোকেরা পত্রিকা পড়বে। ইনডোর-আউটডোর খেলা-ধুলার সরঞ্জামাদি থাকবে, লোকেরা সেগুলো ব্যবহার করবে। কিন্তু রাজনীতির চর্চার জন্য ক্লাব নয়। রাজনীতির চর্চা করতে চাইলে রাজপথে যাও অথবা নিজেদের দলীয় অফিসে গিয়ে যা ইচ্ছে করো। এ-ধরনের কিছু কথা বাতাসের মুখ থেকে শোনার পর আমরা আর ক্লাবের দিকে পা বাড়াই না এবং আমাদের একবারও মনে পড়ে না যে, আমরাই ক্লাবটাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম এবং আমাদের অনেকেই এ-ক্লাবের আজীবন সদস্য। ক্লাবটাকে প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করেছি। নির্ধারিত মাসিক চাঁদা উঠাতে গিয়ে কতো জায়গায় যে নাজেহাল হয়েছি, তা লিখে রাখলে পনেরো খ-ের বই হয়ে যেতো। এসব কোনো কিছুই আমাদের মনে পাড়ে না। মনে পড়ে কেবল ক্লাবে আড্ডা মারতে মারতে আমরা টিভিতে ডিসকভারি দেখতাম। দেখতাম গহীন জঙ্গলে বেকায়দায় পড়ে বেয়ার গ্রিল্স নামে ভদ্রলোক কীভাবে বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছু-কীট-প্রতঙ্গ কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে জীবন ধারণ করতো।
দৃশ্যগুলো এখন যার যার ঘরে দেখি। বাংলা চ্যানেলের কচকচানি বাদ দিয়ে শুধু ডিসকভারি দেখি। সেসব দৃশ্য দেখতে দেখতে এক সময় আমাদেরকে আবিষ্কার করি; কেউ যেনো আমাদেরকে প্যারাসুট জালে বন্দি করে অথবা সিরিয়ার উদ্বাস্তু শরণার্থীদের মতো নৌকোয় ভরে পৃথিবীর কোনো গহীন জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছে। পথহীন গহীন বনে আমরা ঘুরছি তো ঘুরছিই কিন্তু পথ মেলে না। শেষে কী আর করা। জীবন বাঁচাতে সাপ খুঁজি, বিচ্ছু খুঁজি। আমাদের চোখে কিছুই পড়ে না। তারপরও খোঁজা বন্ধ হতো না। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় দেখি নিজেরাই নিজেদের পেটে ঢুকে গেছি।
(চলবে)
আত্মকথন: বেদনা আমার জন্ম সহোদর
আত্মকথন: বেদনা আমার জন্ম সহোদর
ইজাজ আহমেদ মিলন
ইস্রাফিল আকন্দ রুদ্র
বেদনা-ই জীবন । বেদনা তাঁর নিত্যসঙ্গী। জন্মের পর থেকেই বেদনার সাথে তাঁর বাস। বেদনা তাঁর সহোদর। হ্যাঁ, ইজাজ আহমেদ মিলন এর ‘আত্মকথন: বেদনা আমার জন্ম সহোদর’ এর কথাই বলছি। অকপটভাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ৩৩৬ পাতায় লিখেছেন তাঁর বেদনার কথা। বইয়ের প্রতিটি পাতাই ভেঁজা ও স্যাঁতস্যাঁতে। প্রতিটি পাতায় বেদনা। যে পড়েছে শুনিনি সে না অম্বু ঝরিয়ে থাকতে পেরেছে। আমিও শেষ করলাম, কাঁদলাম ‘আত্মকথন: বেদনা আমার জন্ম সহোদর’। সত্যত অবাক হলাম তাঁর বলার ভঙ্গি দেখে। জন্ম থেকে শুরু করে ‘১৫ সাল পর্যন্ত অসমাপ্ত আকারে প্রকাশিত হয় তাঁর এ গ্রন্থটি। লোকে নিশ্চয়ই বলবে, ছেলেটা এমন কি হয়ে গেল, কি অর্জন করলো ? এই বয়সেই তাঁর আত্মজীবনী লিখতে হবে। তিনি সে জবাবটাও দিয়েছেন তাঁর প্রাক-কথনে। তাঁর চাওয়া খুব অল্পই ছিল। বেশি চাওয়া ছিলনা, ছনের ঘরে যখন বাস করতো স্বপ্ন দেখতো চালটা যেন শ্রীঘ্রই টিনের হয় বৃষ্টির ফোঁটা যেন তীরবেগে উপর থেকে প্রবেশ করতে না পারে। সেই লোকটা আজ শ্রীপুর তথা গাজীপুরের নক্ষত্র, অহংকার। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকার আক্তাপাড়া গ্রামে নানাবাড়িতে। বেড়ে উঠা চকপাড়া ছয়শত পাড়ায় দাদা বাড়িতে। জন্মসময়ে মায়ের প্রসব বেদনা ছিল অতি তীব্রতর;যা সব নারীর ক্ষেত্রে-ই হয়। মশা তাড়ানোর জন্য কাঁঠাল মুচির ধোঁয়া ব্যবহার করতো তখনকার সময়ে। প্রসব যন্ত্রণায় মা ভুলে গেলেন ধোঁয়ায় কান্নার কথা!
নাম তাঁর ইজাজ আহমেদ মিলন। নামটা নিয়েও বেশ কাহিনী আছে। প্রথমত নাম রাখেন বাহাউদ্দিন তাঁর নানা। বাহাউদ্দিন থেকে মিলন মিয়া-পরে মিলন হায়দার সবিশেষ বন্ধুর সাথে ভাবনায় নিজেই তাঁর
নাম রাখেন ইজাজ আহমেদ মিলন। পিতা ইদ্রিস আলীর ঔরসে মাতা জমিলা আক্তারের গর্ভে জন্ম। স্ত্রী নুরুন্নাহার ইজাজ, দুই ছেলে মিসাম, রাহি আর বাবা-মা কে নিয়ে তাঁর জীবন সংসার । হাতেখড়ি অ আ ক খ দিয়ে নয়; হয়েছিল আলিফ ,বা, তা, ছা দিয়ে। মসজিদের মুয়াজ্জিনও ছিল বেশ সময়, ধার্মিক কাজে লিপ্ত থেকে তাঁক লাগিয়ে দেয় এলাকাবাসীকে । সবাই বলতো,‘এতো ছোট ছেলে?’
জীবনে বহু সংগ্রাম করেছেন তিনি। সমুদ্রের অনেক জল সেঁচেছেন। ছেলেবেলাকার কথা মাওনা বাজারে বেগুনের ডোল ভরে দিতো; বিনিময়ে পেতো দশটা টাকা মাইনে, তা দিয়ে মায়ের জন্য পান-সুপারি কিনে আনতো। বাবার অসুখের সময় গামছা মুখে দিয়ে রিকশা চালানো, ঢাকা শহরে গিয়েও চাচাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন রিকশা চালানোর কাজে। বাসায় নিয়ে দু-এক কেজি চাল-ডাল। চাচার পুরনো কাপড়ে কাঁটিয়েছে জীবন। পঞ্চম শ্রেণী পাশের পর ভর্তি হন মাদ্রাসায়, ‘কেওয়া তমির উদ্দিন আলিম মাদ্রাসা’। অসাধারণ কৃতিত্ব পূর্ণ ছিল তাঁর শিক্ষাজীবন। অভাবের তাড়নায় আর লেখালেখির নেশায় পড়াশোনা হয়নি বেশিদূর। নিন্দুকের অপমান আর গালিতেও থমকে যায়নি। অনেকে শারীরিকভাবে আঘাতও করেছে। সাংবাদিকতা অষ্টম
কোনো এক জ্ঞানী লেখক বলেছেন,‘বাঙালি তার আত্মজীবনীতে ফেরেশতার মতো রূপ তুলে ধরে। ‘কিন্তু ইজাজের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখলাম। নিজের ভালো খারাপ সকল দিকই তুলে ধরেছেন তাঁর আত্মজীবনী তে । বাংলাদেশ সহ ভারতেরও অনেক সাহিত্য ভাবনার ভাবুকেরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজ্জ্বলে’। এ গ্রন্থটির জন্য লাভ করেন ‘সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার-২০০৯’। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য সর্বোচ্চ পদক ‘বজলুর রহমান স্মৃতি পদক’ সহ বহু সম্মাননা লাভ করেন তাঁর এই তরুণ জীবনে। আপনারাও দেখুন, পড়–ন, ‘আত্মকথন: বেদনা আমার জন্ম সহোদর’।
শ্রেণীতে থাকাকালীন থেকেই দৈনিক গণমুখ থেকে। বর্তমানে তিনি দেনিক সমকালের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি।
গল্প : কবিতার কবিতা
কবিতার কবিতা
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
সারাদিন কবিতা কবিতার বইয়ের মধ্যে বুদ হয়ে থাকে। কি একটা অন্যধরণের আনন্দ সে কবিতার মধ্যে পায়। কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমে চোখ বুজে আসে তার পরও চোখের পাতাকে ধরে রাখার চেষ্টা। আজকের দিনটা আর দশটা দিনের মতো কবিতার মনে হচ্ছেনা, কেমন যেন একটা মন হারানোর দিন মনে হচ্ছে। বাইরে ঘন্টার পর ঘন্টা রিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টিটা যখন একসাথে পেয়েছে তখন তার শব্দে মনটা আরও হালকা বাতাসার মতো হয়ে যাচ্ছে। বাইরে হালকা বাতাস। গাছের পাতাগুলো যেন নুপুর পড়ে হেলেদুলে বৃষ্টির গানে প্রাণ জুড়িয়ে নাচছে। সেই ছন্দময় দোলায় কবিতার খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বাতাসে উড়ছে। কবিতার বইটা হাতে নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সে খুব জোরে জোরে কবিতা পড়ছে। কেমন যেন একটা জেদ ভিতরে ভিতর কাজ করছে। বৃষ্টির শব্দকে সে হার মানাবে। পাশের ঘর থেকে মা ডাকেন "কবিতা, এদিকে একটু আয় তো মা।" খুব রাগ হয় কবিতার। খুব কষ্টের একটা কবিতা পড়ছিলো সে। চোখ থেকে তখনও টপ টপ করে বৃষ্টির মতো পানি পড়ছে। আর কষ্টটা যেন বৃষ্টির মেঘ হয়ে গেছে। কবিতার কোনো সারা শব্দ না পেয়ে মেয়ের কাছে মায়েই চলে আসেন। চোখ গড়িয়ে গাল বেয়ে কান্নার পানি দেখে মা বলেন, "পাগলী মেয়ে আমার, তুই কি বড় হবিনা"। কিন্তু মায়ের মনও ভিতরে ভিতর কাঁদে। মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট হয়। আহা, কচি পাতার মতো মেয়েটার জীবনে কত বড় ঘটনা ঘটে গেছে। মা সব জানেন, বুঝেন কিন্তু তারপরও পাথরের মতো মনকে শক্ত করে ধরে রাখেন। মেয়েটা ছাড়া তার জীবনে তো আর কিছুই নেই। মা কবিতাকে নিয়ে বারান্দায় আসেন। খুব বড় লম্বা চুল। খুব আদর করে মা চুলগুলোকে এক জায়গায় এনে খোঁপা করে দেন। কবিতার এদিকটায় যেন কোনো খেয়াল নেই "একটার পর একটা কবিতা পরেই চলেছে।" বৃষ্টিটা থেমে যায়। নীরবতা নেমে আসে চারিদিকে। কবিতা চিৎকার করে মাকে ডাকে, "মা, মাগো দেখে যাও কত সুন্দর রংধনু আকাশে উঠেছে।" মায়ের মনও মেয়ের আনন্দে হেসে উঠে। একটা মৃদু আশা মায়ের মনে দোল খেয়ে যায়, "আহা রংধনুর মতো মেয়েটার জীবনটাও যদি আবার রঙে ভোরে যেত।"
সন্ধ্যা হলেই কবিতা মাকে খুব বিচলিত হতে দেখে। অস্থির হয়ে এপাশ থেকে ওপাশে মা পায়চারি করেন। এরপর প্রতিদিন ঠিক সন্ধ্যা ৭ টায় মোবাইলের রিং বেজে উঠে। ফিসফাস করে মা কার সাথে যেন দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। দরজাটাও বন্ধ থাকে। আগে ফোনের কথাগুলো শুনবার জন্য কবিতা দরজায় কান লাগিয়ে থাকতো। এখন কেমন গা সোয়া হয়ে গেছে। ভাল্লাগেনা, আড়ি পেতে শুনার আগ্রহটাও হারিয়ে ফেলেছে সে।একদিন কবিতাদের বাড়িতে একজন বিদেশি লোক আসেন। ধপধপে ফর্সা গায়ের রং। কবিতা অবাক হয় লোকটাকে দেখে। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারে লোকটা। এই প্রথম কাউকে কবিতা তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে দেখলো। এর আগে কেউ তো কোনোদিন কবিতাদের বাসায় আসেনি। পাড়াপড়শিরাও কবিতাদের এড়িয়ে চলে। কবিতার মা লোকটাকে ঘরে নিয়ে যায়। লোকটার কান্না শুনতে পায় কবিতা। লোকটা ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, তোমার মেয়েটার কি হবে। খুব কষ্ট হয় ওর জন্য। এখন তো সে অনেক বড় হয়েছে ওকে আমার দেশে নিয়ে যাই। কবিতার মা কিছু বলেননা। শুধু লোকটার কথা শুনে যান। এসব দেখে শুনে কবিতা আর কিছুই ভাল্লাগেনা। এমন সময় কবিতাদের বাইরের দরজা থেকে করা নাড়ার শব্দ আসে। দৌড়ে কবিতা দরজাটা খুলে দেয়। রাজপুত্রের মতো একটা ছেলে কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে। কবির কবিতার রূপকথার রাজপুত্রের সাথে হুবহু চেহারার মিল। কবিতা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে কাকে চান। ছেলেটা বলে কবিতাকে। কবিতা অবাক হয়। যার সাথে তার কোনোদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি সে নাকি চায় কবিতাকে। কবিতা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে কেন কি দরকার তাকে। ছেলেটা বলে খুব দুঃখী মেয়ে কবিতা। তার জীবনে যা ঘটেছে তা আর অন্য কোনো মেয়ের জীবনে ঘটেনি। তার অতীত নিয়ে, তার বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে আমি গবেষণা করে একটা বই লিখতে চাই। কবিতার মাথা আর চোখগুলো যেন ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। সে এতো দুঃখী, তার জীবনে অনেক কিছু নাকি ঘটেছে আর সে কিছুই জানেনা। লোকটাকে ধরে পিটাতে ইচ্ছা করে কবিতার। কবিতাদের কথাবার্তা শুনে কবিতার মা ও লোকটা বেরিয়ে আসে। মা কবিতাকে কাছে ডাকেন। এরপর ছেলেটা ভিতরে ঢুকতে বলেন। বাইরে লোকজনের হৈ হুল্লোড় শুনতে পায় কবিতা। মনে হচ্ছে তাদের বাড়ির বাইরেই লোকজন হট্টগোল করছে। লোকজন চিৎকার করে বলছে অনেক সহ্য করেছি আমরা। আর নয়। কবিতার জীবনটা কেন এমন হলো আমাদের জবাব দিন, কেন মেয়েটার জীবনে এমন ঘটনা ঘটলো যা আগে কেউ কখনো ভাবেনি। এরাই মনে হয় পাড়া পড়শি। এবার হুড়মুড় করে লোকগুলো কবিতাদের বাড়ির ভিতরে চলে আসে। কবিতার মা আর লোকটাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। কবিতা এতো মানুষ দেখে ভয়ে ঘরের ভিতরে চলে যায়। ভাবে আর ভাবে। কবিতার পাতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখে কিন্তু কিছুই ভালো লাগেনা। সে কিছুই জানেনা আর তাকে নিয়ে এত্তোসব। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা সে। বিদেশি লোকটা কবিতা, কবিতার মা আর ছেলেটাকে নিয়ে পিছনে দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে। একটা দামি সাদা রঙের জীপ গাড়িতে করে রওনা হয় সবাই। কবিতা কিছুতেই কিছু মিলাতে পারেনা। গাড়িটা ফার্মগেটে হয়ে গুলশানের দিকে এগিয়ে যায়। একটা রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়িটার হর্ন শুনে একটা বৃদ্ধা মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসে। বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করতে থাকে দুনিয়ার এতো মানুষ থাকতে আমার কবিতা জীবনটা কেন এমন হয়ে গেলো। কবিতা শুধু অবাক আর অবাক হয়। যাদের সে চিনেনা, জানেনা তারা কিনা তাকে নিয়ে কি সব কথাবার্তা বলছে। বাড়িতে ঢুকতেই চমকে উঠে কবিতা। এ কি দেখছে কবিতা? কবিতার সামনে কবিতা। মাথাটা ঘুরে উঠে কবিতার কিন্তু নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে। মা নতুন কবিতাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। কবিতার খুব হিংসে হয়। নতুন কবিতাও কবিতাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আর আর্তনাদ করে বলতে থাকে কেন তোমার জীবনটা কবিতা এমন হয়ে গেলো যা অন্য কারো জীবনে কখনো ঘটেনি। কবিতা ভাবে আর ভাবে কিন্তু কোনো কুল কিনারা পায়না। তার মতোই অবিকল দেখতে আরেকজন। অদল বদল করলেও কেউ বুঝতে পারবেনা। কবিতা মাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছিল তার জীবনে। মা কিছুই বলেন না শুধু অচল দিয়ে চোখ মুছেন। অচেনা লোকগুলো সম্বন্ধে জানতে চায় কবিতা। মা অনেকটা ধমকের স্বরে বলে উঠেন, এটা তোমার জানার প্রয়োজন নেই। আরও বড় হও, জীবনকে আগে বুঝতে শেখো, তোমার উত্তরগুলো তুমি পেয়ে যাবে। কবিতার সবকিছুই কেমন যেন সন্দেহ লাগে। তার কবিতার বইটাও সে আনতে পারেনি। কবিতা মার কাছে আবদার নিয়ে বলে, মা, মাগো, ওগো মা কবিতার কয়েকটা বই চলো মার্কেট থেকে কিনে নিয়ে আসি। মা ও কবিতার মতো দেখতে দেখতে মেয়েটার সাথে বেরিয়ে পড়ে নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেটে। একটা কবিতার বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। মা বলেন এটা আমাদের নিজেদের দোকান। কোন কোন বই নিবে বলো। দোকানের বইগুলো পিছন দিক হয়ে একটা মেয়ে পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখছে। কবিতাদের দিকে তাকানোর যেন সময় নেই। এবার কবিতার অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে যায়। একটু উঁচু গলায় বলে উঠে, এই মেয়ে আমাদের কবিতার বইগুলো দেখাও না। দোকানের মেয়েটা এবার গলা ঘুরিয়ে কবিতাদের দিকে তাকায়। কবিতা অবাক হয়ে যায়। পা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে কবিতার। আবার সে দেখছে কবিতার সামনে কবিতা। একজন পাশে, আরেকজন সামনে। কবিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে কেননা সে জানে এর উত্তর মা দিবেন না। অনেকগুলো সুখের আর আনন্দের কবিতার বই নিয়ে মেয়েটা কবিতাটা দেখতে দেখতে বলে, কবিতা কেন তোমার জীবনটা এমন হয়ে গেলো যা অন্য কারো জীবনে কখনো ঘটেনি। চোখ মুছতে মুছতে মেয়েটা বলতে থাকে আর কষ্টের কবিতা পড়োনা। জীবনে অনেক কষ্ট তোমার এখন আনন্দ, সৃষ্টি আর প্রেমের কবিতা পড়ো। কবিতা খুব অবাক আর শংকিত হয়; সে জানেনা তার জীবনে কি ঘটেছে আর অন্যেরা সব জানে। অবাক আর অবাক হয়। তার মতো দেখতে অনেকগুলো মেয়ে কে তারা, তাদের সাথে কি তার কোনো সম্পর্ক আছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। সাগরের ¯্রােতের মতো ধাক্কা খায় আর তলিয়ে যায় ভাবনা থেকে ভাবনায়।
অনেক অজানা প্রশ্ন আর কৌতূহল নিয়ে আবার গুলশানের ঐ বাসায় ফিরে আসে কবিতা। বইগুলো হাতে নিয়ে চিৎকার করে করে কবিতা পড়তে থাকে। মনে হচ্ছে আজ যেন আকাশ বাতাস তোলপাড় হয়ে যাবে। মেজাজটাও বিগড়ে উঠে কবিতার। তার মাথায় ঘুরপাক খায় তার মতোই তিন জন কবিতা। ওরা কারা? কেন তারা তার মতোই দেখতে? তার জীবনের সবকিছ তারা কিভাবে জানে? এলোমেলো হয়ে পড়ে কবিতা। রাত আসে। তিন কবিতায় এক বিছানায়। চোখে ঘুম আসেনা কবিতার কিন্তু ওরা গভীর ঘুমে। একসময় ভূমিকম্পের মতো নড়ে উঠে দালানটা। সব কিছু যেন ভেঙে পড়ছে। মানুষের হৈ চৈ। বাঁচাও বাঁচাও আওয়াজ। তারপর গভীর নিস্তব্ধতা। কবিতা খুব আসতে আসতে চোখ খুলে। মনে হয় অনেকদিন পরের চোখ খোলা। তীব্র আলোটা চোখে যেন আঘাত করছে। কবিতার চারপাশে এপ্রোন পড়া বুড়ো বুড়ো ডাক্তাররা। ফিস ফিস করে ওরা বলছে ২ মাস পর কোমা থেকে ফিরে এসেছে মেয়েটা। মিরাকেল। ওর তো বাঁচার কথা ছিলোনা। ডাক্তাররাও ফিস ফিস করে বলছে, খুব কষ্ট করেছে মেয়েটা জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে উঠেছে কিন্তু হারিয়েছেও অনেক কিছু। বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনে কবিতা। এপাশ ওপাশ তাকাতেই দেখে দুটো একই চেহেরার বাচ্চা। তার মতোই হয়েছে তারা। একজন খুব বুড়ো কপালে ভাঁজ পড়া ডাক্তার কবিতার সামনে এসে বলে. মা, মাগো তোমার দুটো যমজ সন্তান। দেখতে ঠিক তোমার মতোই হয়েছে। মাগো একটু মনে করার চেষ্টা করো সেদিনের ভূমিকম্পের কথা, তোমার পিছনে ফেলে আসা জীবন।
এবার কবিতার সব কিছুই ধীরে ধীরে মনে পড়তে থাকে। কবিতার বাবা ছিলেন একজন বিদেশি। এদেশে চাকরি করতে এসে ভালোবেসে বিয়ে করে তার মাকে। খুব আনন্দের জীবন ছিল বাবা মায়ের। মায়ের গর্ভে কবিতা আসে। কবিতা তার মায়ের কাছে শুনেছিলো কবিতার জন্য কবিতার বাবা পৃথিবীর সব খেলনা যেন এনে বাড়ি ভর্ত্তি করে দিয়েছিলো। কবিতা তখন মায়ের গর্ভে। এরপর কবিতার পৃথিবীতে আসার সময় হয়। ১০ তোলার একটা অপারেশন থিয়েটারে কবিতা যখন ঠিক জন্ম নিচ্ছে। কবিতার বাবা হাসপাতালের নিচ্ছে লিফটের দশ তোলার বাটন চাপ দিয়ে উপরে উঠে আসছে। ঠিক দশ তলায় লিফটের ভিতরের দরজা খোলার অপেক্ষা আর কবিতার পৃথিবীতে আসার কান্না। হঠাৎ করেই লিফটে ভেঙে পড়লো। রক্তাত্ব নিথর দেহ হয়ে গেলো কবিতার বাবা। অতৃপ্ত আত্মারা পাখি হয়ে উড়ে গেলো হয়তো আকাশে। কবিতার জন্মই যেন হয়ে গেলো আজন্ম পাপ। সবাই বলতো সর্বনাশী, ওর বাপ টাকে খেলো। মায়ের আদরে বড় হতে থাকে কবিতা। প্রেম হয় একজন কবির সাথে। এরপর বিয়ে। ভাগ্যটা বুঝি খারাপই কবিতার। হঠাৎ করে কবিতার শশুরের বুকের বা পাশটায় ব্যথা উঠে, প্রচন্ড থেকে প্রচন্ড হয়। বিয়ের "কবুল" বলার সাথে সাথেই হার্ট স্ট্রোক করে বিয়ের দিনেই শশুরের মৃত্যু হয়। কবিতার শাশুড়ি কবিতাকে অলক্ষুনি মেয়ে বলে অপবাদ দিতে দিতে আহাজারি করতে থাকে। কবিতার মায়ের মন ভয়ে আর আতংকে চুপসে যায়। প্রেসারটা হঠাৎ করেই দুশ্চিন্তায় বেড়ে যায়। বিয়ে বাড়িতেই কবিতার মা ব্রেন স্ট্রোক করে মারা যান। এরপর প্রতিদিন শাশুড়ির অভিশাপ আর বঞ্চনা নিয়ে সংসারকে সাজানোর চেষ্টা করে কবিতা। কবিতার স্বামী কবি। সবার থেকে আলাদা। সে এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করেনা। খুব ভালোবাসে কবিতাকে হয়তো প্রাণের চেয়েও বেশি। কবিতাকে দেখে দেখে একটার পর একটা কবিতা লিখে যায়। আর জোরে জোরে কবিতাকে শোনাতে থাকে। কবিতাকে নিয়েই যেন কবি স্বামীর গবেষণা আর অনুপ্রেরণা। স্বামী ভালো হলে শাশুড়ির অবহেলা আর অবজ্ঞা একটা মেয়ে জন্য কিছুনা। সন্তান সম্ভবা হয় কবিতা। স্বামীর আনন্দ আর ধরেনা। কবি স্বামীর মনে হয় নতুন ঝকঝকে কবিতার মতো নতুন জীবন সৃষ্টি করতে যাচ্ছে সে। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। সময় গড়ায় কবিতা আর কবিতার স্বামীর চোখে মুখে আনন্দরা দোল খায়। পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে কবিতার আড্ডা জমায় কবি। আর খুব জোরে হাসতে হাসতে সবাইকে বলে, আমার সন্তানের জন্য সবাই দোআ করবেন। অনেক অনেক ধরণের মিষ্টি খাওয়াবো আপনাদের। কাল পরশু সন্তান ডেলিভারি হবার সময় দিয়েছে ডাক্তার। সময় যেন ফুরায় না। আনন্দের সময়টা আসতে যেন দেরি করে ফেলে। রাতে ঘুমাতে যায় কবিতা আর কবিতার স্বামী। হৈ হুল্লোড় আর চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। খুব জোরে নড়ে উঠছে দালানটা। হয়তো ভেঙে পড়েছে। কবিতা আর কিছুই জানেনা।
কবিতা আর্তনাদ করে কেঁদে উঠে। বুড়ো ডাক্তারটা কবিতার মাথায় হাত দেয়। ডাক্তারের চোখেও পানি। সান্তনা দিতে গিয়ে কষ্ট হয় ডাক্তারের। তারপরও দেয়। মাগো, এই পৃথিবীটা একটা কঠিন জায়গা। বাস্তবতা আরো কঠিন। ঐ দিন যে ভূমিকম্প হয় তাতে তোমার স্বামী ও শাশুড়ি মারা যান। তাদের লাশগুলো এখন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তোমাদের এলাকার একটা লোকও বেঁচে নেই। শুধু ধ্বংস স্তুপের নিচে তোমাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ধুক ধুক করে তোমার হৃদস্পন্দন তখন চলছিল। আজ দুইমাস কমায় থাকার পর তুমি ফিরে এসেছো। তোমার দুটো যমজ কন্যা সন্তান হয়েছে ঠিক তোমার মতোই দেখতে। কবিতা কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারেনা, চাপা কান্নারা হয়তো বের হতে পারেনা।
এবার কবিতা তার জীবন মরণের সন্ধিক্ষণের আরেক জীবনকে মেলাতে শুরু করে। যে দুটো কবিতা সে দেখেছে, ঠিক তার মতো। তারা তার দুটো যমজ সন্তান। বিদেশি লোকটা তার লিফটের ভেঙে পড়া মৃত বাবা। তার স্বামী তো টাকে নিয়ে গবেষণা করতো। কবিতা লিখতো। যে লোকটা রাজপুত্রের মতো তাদের বাসায় এসেছিলো সে তার স্বামী। তার লেখা ভালোবাসার কবিতা গুলো কবিতার হয়ে গিয়েছিলো কষ্টের কবিতার বই। গুলশানের বাড়িতে যে বুড়িটা আহাজারি করেছিল সেটা তার শাশুড়ি। স্ট্রোক করে মারা গিয়েছিলো তার মা আর শশুর। পাড়াপড়শি যারা কবিতাকে নিয়ে হৈ চৈ করছিলো তারাতো আজ সবাই মৃত।
মেয়ে দুটো হঠাৎ করেই একসাথে কেঁদে উঠে। কবিতাটাও কেঁদে উঠে। এখনো হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে সে। দুটো ছোট ছোট কবিতা ছাড়া তার জীবনে আর কেউই নেই। ভাবতেই থাকে কবিতা। হয়তো একসময় ভাবতে ভাবতে কবিতার জীবনের কবিতাগুলো কোথায় ভেসে যাবে কেউ জানেনা। হয়তো জানবেনা কোনোদিন। তবুও কবিতা স্বপ্ন দেখে তার কবিতাদের নিয়ে। হয়তো সব হারিয়ে মৃতের মতো বেঁচে থাকতে হবে ওদের জন্য।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)