শুধু আওয়াজ শুনি, শব্দ শুনি না !
শুধু আওয়াজ শুনি,
শব্দ শুনি না...
হাসান মাহাদি
কথায় আছে, “ভরা কলস বাজে না।” তাহলে কি দু:খ ভরা হৃদয়ের আর্তনাদ ইহ জাগতি কোনো কান শুনতে পায় না? আমি হাঁটছি অনবরত। পুরান ঢাকার কয়েকশ বছর পুরনো অলিগলি দিয়ে আমার দেহটাকে নিয়ে আমার পা দুটো চলছে। আমার মন আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। সে ছুটছে বাতাসের গতিতে। যেন জাগতিক চেতনার বাইরে গিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেছে মহাজাগতিক কোনো ভাবনায়। আমি শুধু সেই ভাবনাগুলো প্রলাপের মতো বকে যাচ্ছি। কোনো চর্মচক্ষু দেখা মাত্রই আফসোস করবে, “আহা! এই অল্প বয়সেই মনে হয় মাথাটা গেছে। “আদতে শব্দের সাধনা করতে করতে হেঁটে চলছেন এক সাধক পুরুষ। এই শব্দ বাংলা ব্যাকরণের রূপতত্ত্বের আলোচনা না নয়। এ শব্দ তরল, কঠিন বা বায়বীয় মাধ্যম দিয়ে সঞ্চারিত মাধ্যম দিয়ে সঞ্চারিত যান্ত্রিক কোনো তরঙ্গ নয় যা আমাদের শ্রবনের অনুভূতি দেয়। এ শব্দ মজলুমের যা জালেমের কান কখনো শুনে না। এ শব্দ শীতের রাতে ফুটপাতে পরে থাকা হাড্ডিসার দেহটার যা চলন্ত পথিকের বড়লোকি উষ্ণতায় পৌঁছায় না। এ শব্দ লক্ষ্মীবাজারের সেই ছোট্ট শিশুটার যে প্রতিদিন সকাল বেলা মুসলিম হোস্টেলের গেইটের সামনে কংক্রিটের বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেন্ট গ্রেগরির ইউনিফর্মে মায়ের হাত ধরে হেঁটে যাওয়া তার বয়সী শিশুটার দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, “আহা! নম্বর কম পাওয়ার অপরাধে কেউ যদি আমাকে একটু বকে দিত।“ এ শব্দ জগন্নাথের সেই ছেলেটার, যার বন্ধুরা জানেনা সে মেসে মিলের টাকা কমাতে দুটো সিঙ্গারা খেয়েই দুপুরটা কাটিয়ে দিয়েছে। টিউশনির বেতনের টাকাটা বাঁচিয়ে টাকাটা বাড়িতে পাঠাতে হবে। এ শব্দ সব হারানো সেই লোকটার যে ঋণের বোঝা সমেত মাথাটা ট্রেনের নিচে দিয়েছিলো। ট্রেনের ঝনঝন শব্দে তার মৃত্যুকালীন কয়েক ন্যানো সেকেন্ডর আর্তনাদের শব্দটাও শুনা যায়নি। এ শব্দ মধ্যবিত্তের। যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নিজের ব্যক্তিত্ত্ব ও অস্তিত্ব টিকেয়ে রাখতে সংগ্রাম করে যায়। এ শব্দ টাকায় গড়াগড়ি খাওয়া এই ধনী মানুষটার, যে, টাকা দিয়েও সুখ কিনতে পারেনি। এ শব্দ সেই তরুণটার যে এলোমেলো চুলে নিজের স্বপ্ন নিয়ে হেঁটে যায়। হয়তো মাঝে মাঝে কোনো ব্যথিত মানুষের চিৎকার শুনা যায়। মানুষের কাছে হাত পাতা ভিক্ষুকটার সুর করে ভিক্ষা চাওয়াটা শুনা যায়। “আমাদের দাবি মানতে হবে”, “ধর্ষকের বিচার চাই” শুধু এই স্লোগানগুলোই শুনা যায়। গুম হয়ে যাওয়া স্বজনের খোঁজে মানববন্ধন বা সংবাদ সম্মেলনে শুধু লিখিত বক্তব্যগুলো শুনা যায়। বিনাদোষে কারাগারে থাকা সন্তানের জামিনের জন্য বাবা-মায়ের শুধু আকুতির ভাষাগুলো শুনা যায়। কমলাপুরে গুলি খেয়ে মরে যাওয়া মেয়েটার বাবা যখন বলে, “কার কাছে বিচার চাইব?” শুধু এই বক্তব্যটাই পত্রিকাই ছাপা হয়। এগুলো সবই আওয়াজ ¯্রফে আওয়াজ। কখনো কখনো শব্দ দূষণ। জাগতিক চামড়া শুধু সেই আওয়াজগুলো শুনতে পায়। শব্দ শোনার সময় কারো নেই। সবাই ছুটে আপন গতিতে। স্বার্থের সীসায় গভীর শব্দযন্ত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যতক্ষণ না নিজের সাথে ঘটে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত শুধু আওয়াজ শুনা যায়।
আমি কোনো এতোক্ষণ কল্পনায় হেঁটেছিলাম। আসলে আমি ক্লাশরুমে বসে আছি। প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কোর্সের লেকচার চলছে। মাইক্রোফোনে কেউ একজন কথা বলছে শুধু এই আওয়াজটুকুই কানে আসছে। হঠাৎ ডাক আসে,“লাস্ট ব্যাঞ্চ, স্ট্যান্ড আপ। হোয়াট ইজ সট এনালাইসিস?” আমার দিব্ব ধ্যান ভঙ্গ হয়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। কারণ সট এনালাইসিস টপিকের একটা শব্দও আমি শুনি নাই।
হাসান মাহাদি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
চাকমা বাড়ি
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
চাকমা বাড়ি
মিসির হাছনাইন
খাগড়াছড়ি শহর থেকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই এক পাশে নেমে গেছে পাহাড়ের সরু পথ। একপাশে কতগুলো ফুল ফুটে আছে। পাহাড়ের ঐ চূড়ায় উড়ে যাচ্ছে একটা পাখি, সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। এই পাশে একটা জুম ক্ষেত, ভুট্টা চাষ হয়েছিল, কয়েকটা গাছ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। নিচে নেমে গেছে ঝুকিপূর্ণ পথ, এরপর একটু হাঁটলে ঐ তো ঝর্ণার শব্দ কানে বাজছে, এই ঢালু পাহাড় নিচে নেমেই ঝিরিপথ বয়ে গেছে। হাড়িতে জল নিচ্ছে একজন চাকমা নারী, সে অনেকটা ভিজে গেছে। আশেপাশে কোথাও তার বাড়ি। সে ঝর্ণার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে আশেপাশে কয়েকবার দেখলো, তারপর নিজ ভাষাতে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে চললো ঐ উচু টিলাতে। পাহাড়ের এক ঢালে মাচাং ঘর, জুম চাষেই তাদের সংসার। ফসল বাজারে বিক্রি করেই ঘরের খরচ চালায় নীলিমা চাকমা। খুব ভয়ে আছে সে, এই বছর ঘর মেরামত না করলে তাঁর মাচা ভেঙে পড়বে, কিন্তু মিস্ত্রি খরচ সহ আরো কিছু কাঠ কিনতে তো অনেক টাকার কারবার। এসব ভাবলেই তাঁর স্বামীর উপর খুব রাগ হয়, সে কোন কাজ করে না সারাদিন খালি মদ খায়, মদ বানাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে দশবার। এখন সে আশা ছেড়ে দিয়ে মদ বানানো দেখে আর মদ খায়, সংসারের প্রতি কোন খেয়াল নেই, নীলিমা মা হতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। অথচ, চেহারায় বুঝাই যায় না তার দুঃখ, কি কিউট পুতুলের মতন দেখতে, আর এই নারীর লুকিয়ে লুকিয়ে কান্নায়থ মাঝে মধ্যে মনে হয় ঈশ্বর কেন এতো কষ্ট দিচ্ছে তাকে! তবুও দিন যাচ্ছে, কোনমতে ধার দেনা করে কিছু টাকা জোগাড় করেছে সে। এরপর বাড়িটা মেরামত করে নেয়।
হঠাৎ এক সাধু ভিক্ষুর সহচার্যে তাঁর স্বামীর অদ্ভুত পরিবর্তন হয় এখন আর প্রতিদিন সে মদ খায় না। স্ত্রীকে নানান কাজে হেল্প করে। বসে বসে সুন্দর সুন্দর ছবি আর্ট করে, সে নীলিমা চাকমারও একটি ছবি এঁকেছে। এবং আরো অনেক পাহাড় আঁকা ছবি বিক্রি করে রিগ্যান চাকমা। এক মাস আগে সে পুরস্কার জিতেছে দেড় লাখ টাকা। এর কিছুদিন পরই নীলিমার ভাগ্য দারুণ ভাবে খুলে যায় রিসোর্ট ব্যবসায়। কতগুলো চোখ ঝর্নার সৌন্দর্য উপভোগ করে পাশাপাশি মাচাং ঘরে বসে। সামনের ঝোপে একটা জবা ফুল ফুটেছে সাদা রঙের’ এর ছায়ায় দুপুর রোদে কে দৌড়ে পালিয়ে গেল..? নীলিমা চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসলো, তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল।
তিন মাস পর বর্ষার টানা বৃষ্টিতে বাইক এক্সিডেন্টে পাহাড় ধসে মর্মান্তিক মৃত্যু হল রিগ্যান চাকমার। শুরু হলো নাকি ভেঙে গেলো চাকমা বাড়ির জীবন যুদ্ধ, কয়েক দিন পর মা হয় নীলিমা চাকমা..।
পদাবলি : ০১
বিষমভাবে বেঁচে উঠুক
নাসিমা হক মুক্তা
দাঁড়াও পথিক!
পালকখানি আলগা করে ছুঁঁয়ে দাও- জমিন
ছিটেফোঁটা ধানি গাছে ফুল না আসলে
দুঃসহ এই বাস পুজোর আগে শ্রাবণ জলে ভাসিয়ে দাও।
গা ভর্তি নতুন পরাগ বিটপীর ভাঁজে ভাঁজে
শাড়ি পড়–ক নব কুঞ্জে
গোপনে গোপনে বাসর অস্থির বৃষ্টি হয়ে
ঝরুক- টিপটিপ
ক্রমশ দেহভা-ের দল সীমানা ছাড়িয়ে
বিষমভাবে বেঁচে উঠুক- ভুমির আয়ুতে!
পাললিক জীবন
শাদমান শরীফ
কবিতারা খুন করে বারবার ফিরে দেখে কামনাজমিন
প্রিয়বাসীনির চোখের সমাধিতে জমে আছে আকাক্সক্ষার পাললিক
প্রাচীরে বরফফুলের সাজানো বাগান ছিল আতর-লোবানে
অথচ দিনশেষে আমার বুকের কাঁটাতারে ঝুলে থাকে অবুজ ফেলানী।
শহরের পথে পথে নিয়ন আলো গড়িয়ে গেছে মাইলের পর মাইল
লুণ্ঠনে নিরোধ বিউগল জ্বলে অপ্রত্যাশিত ভোরের দরজায়
কান পেতে শুনি আহত পাখির গান।
হায়! আমাদের আগামী জন্মগ্রহীতারা যদি জানতো
খুন হওয়ার চেয়ে বেঁচে থাকা কতটা কঠিন।
ফিউ মোমেন্টস
ইয়াসির আরাফাত
এইসব মুহুর্তগুলো
মেহগনি ফুলের মতো ঝরে গেলে-
জুতোর তলায় পিষে যতটুকু দাগ রেখে যায়
তার মতো রেখেছো কি দু’ফোটা জল
যখন কাজল পড়ো, চোখ ভিজে যায়?
কান্নার পাশে যে থাকে প্রাচীন, সফেদ বকের
মতো দল বেঁধে এসেছিল যারা
এই সব বুক ভাঙা পাখি
মাস্তুলে লেগে থাকা দাগ
তোমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রঙ
অশ্বথ জেনেছিল যে নদী প্রবীণ
যার কাছে হারিয়েছ কিশোরী জামার দুটো হুক
যে বেদনা গভীর আঙুলে তোলে বিবাগী সিঁদুর
তার কাছে নিয়তি রেখে-
গমস্ত রঙের ছিপি খুলে গেছে আজ।
হারিয়ে যাচ্ছে এক একটি দিন
আখতারুল ইসলাম
হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিনের শুরু, ভোর
ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন দিনের সকাল
খোঁজে পাই না রাতভর,
অকৃত্রিম ভালোবাসার মোহ মায়া।
কীভাবে চেনা যায় সকালের রোদ
পাখির ডাক, ফুলের গ্রাণ
স্বপ্নরাঙানো এক একটি দুপুর
নির্জন জীবনের রাশি রাশি বোধ।
হারিয়ে যাচ্ছে বিকেলের সোনালি আভা
ক্লান্ত পাখির মতো অনায়াসে
নদীর ¯্রােতের সুর ছন্দে যায় ভেসে।
শরীর মনে জীবনে ক্রমশ সন্ধ্যা
ক্রমশ রাত। কখনো নিকষ কালো
কখনো অনন্ত কালের ঘুম।
একটি আস্ত মন চাই
অনুকূল বিশ্বাস
একটি আস্ত মন চাই
কোনোদিন যার বাটোয়ারা হয়নি।
নীলাকাশের ন্যায় উদার যার হৃদয়
সমুদ্রের ন্যায় ধৈর্য্য তার অহঙ্কার,
যেখানে নিকুঞ্জ বনে নিঃশর্তে ফোটে ফুল,
নদীর ন্যায় নিষ্পাপ কলঙ্কহীন চরিত্র যার গর্ব;
এমনই এক মন চাই যে চির অবিক্রিত।
একটি আস্ত মন চাই
যে মনের নীলাম হয় না কখনও
যে মনে ধরে না সন্দেহের জং,
নেই ক্রেডিট কার্ড বা বিপিএল কার্ডের সীমারেখা;
থাকবে না অন্ধকার চিলেকোঠার দূর্ভেদ্য কারাগার
কেবল থাকবে ভালোবাসার রোদ্দুরে সেকা প্রেম
এখন যা আসলে অলীক স্বপ্ন ডাইনোসর।
বৈদেশে নাগর
নীহার মোশারফ
কলিম শিক্ষিত ছেলে
মেধাবীও খুব
বিয়ে থায় গরিব ঘরের আনবে ফর্সা মেয়ে।
যেমন কথা তেমন কাজ
সুন্দরী এলো ঘরে
চাকরি নিয়ে কলিম বৈদেশে যাবে
দেশে মন্দা অর্থের বাজার।
প্রেয়সী একা
দেখা নেই নাগরের
ক’মাস পরপর টাকা আসে
সে টাকায় লটুয়া গন্ধ নেই
থেকে থেকে হাসি নেই।
একা একা কত রাত
প্রেমের বরাত দিয়ে
প্রহর পোহায়।
ঘরের আলো কালো করে
জিন, কবিরাজ।
পদাবলি : ০২
সমঝোতা
স্বপন গায়েন
সমঝোতা করতে করতে শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে
জীবনের পথ হারিয়ে যাচ্ছে ধূসর অন্ধকারে
গভীর অসুখে আক্রান্ত মানুষ, তার নাম সমঝোতা।
ঘরে বাইরে সমঝোতা করতে করতে সব্বাই এখন বোবা
সমঝোতা তোমাকে করতেই হবে নইলে অশান্তি সর্বত্র
জীবন থেকে চলে যাবে ভালোবাসা।
একফালি রোদ্দুর খুঁজতে খুঁজতে বসন্ত পেরিয়ে যায়
ভাঙা সংসার যেন ¯্রােতহীন রুগ্ন নদী
সমঝোতা করলেই সব সমস্যার সমাধান।
সুখের বিছানা কাঁটাতে ভরে যায়-
বিবর্ণ রোদ্দুরে পুড়ে যায় ভালোবাসার মধুর সম্পর্ক
মুখে হাসি নেই, রামধনু রঙ ক্রমশ ফিকে হয়ে যায়।
ভাঙছে মাটির বাঁধ-
আর্তনাদ করছে হৃদয়ের উঠোন
সমঝোতা করো, শান্তি পাবে...
নতজানু হয়ে স্বীকার করো সব অঙ্গীকার।
যদি মাটি হও মৃত্তিকার বুকে
গোলাম রাব্বানী
নীল সমুদ্রের জলে নীলিমার মতো মিশে যাবো
সুবিস্তৃত রাজ্য বেড়ে তোমাকে-ই রাজরানী করে
নিয়ে যাবো মালে- আরও জেইরেঞ্জারফোর্ডে..
নিয়ে যাবো তোমাকেই, আরও লাও চাই প্রভিন্সে,
দিতে পারি পাড়ি বহুদূর নিঃশ্বাস প্রশ্বাস পড়ার আগে
যদি চোখে চোখ রেখে ছবির মতো সৌন্দর্য হয়ে-
নুয়ে পড় প্রেম পিপাসিত ঠোঁটে; এই মৃত্তিকার বুকে
নিয়ে যাবো তোমাকেই ঝিলমিল হ্রদে, জলপ্রপাতে
প্রেমউপত্যকা ঘেঁষা; সেই জুরিখ, বার্ন, লুসান-ভেনেজা
একটি প্রেমের চকোলেট, চৌষট্টিটি দাঁতের সংস্পর্শে
আজ প্রেমের সুগন্ধ ওঠে; দু’দুটো হৃদয়ের বন্ধনে
যদি শক্ত কথা দাও, ভানুসিংহের গল্পগুচ্ছের মতো-
শেষ হয়েও কখনও হবে না শেষ; পাথরে ফুল ফোটাব
এক পলকেই টপকাবো পৃথিবীর পাঁচটি চূড়াশৃঙ্গ
পুঁথিপাঠ শুনে কান
রুদ্র সাহাদাৎ
মেঘে ঢেকে গেছে যৌবন ক্ষণে ক্ষণে কাঁদে জীবন
আমার বারো মাসই আষাঢ় শ্রাবণ।
তবুও পুঁড়ামন মাঝে মাঝে হাসে, শুনে গান
ধ্যানে জ্ঞানে শাহ আব্দুল করিম, আব্বাস উদ্দীন
ফকির লালনশাহ,হাসন রাজায় ডুবে থাকে পাগলামন ।
সনাতনী সুর, পুঁথিপাঠ শুনে কান অষ্টপ্রহর...
মৃত্যুর কান্না
তাপস চক্রবর্তী
মৃত্যুর কান্না শুনি রোজ রোজ
কাঠঠোকরার আদলে খট খট খট খট
নাকডাকা ঘুম ভাঙে মধ্যরাতে—
দেখি নগ্ন চাঁদ খেলছে রুপোর থালায়।
বালিশের বুকে একা- একেলা
এখনও
আঁকি রোজ অন্য কারো স্বপ্ন
যেমন পেঁচার স্বরে বিঁধে যায় পোকাদের সারাংশ।
পোকাদের মতো বুকের বাঁপাশে এখনও
শুন্যতায় ঘিরে ধরে
যেমন ঠুমরীর খেয়াল- হারমোনিয়ামে সরগম
বিষাদ স্মৃতির হাড়গোর।
ঝর্ণার শীতল হাওয়ায়— অনিন্দ্য জ্যোৎন্সা-
চোখ বুজে আসে ক্ষয়ে যাওয়া স্বপ্ননামা...
মিছে আবেগ
আজকাল পোনামাছের ঝোলেও বিস্বাদ হয়ে ওঠে
নির্বাণ আঁধারে।
কোনকিছু স্থির নেই
হাফিজ রহমান
আলোকের স্পর্শ পেতে সেই কোন ভোরে
হাত পেতে আছি মিছিলে
আলোকরশ্মি নিভু নিভু হতেই
ঝলকে ওঠে মিছিলের বাকানো শরীর
অস্থির সুরঙ্গের মতো আগ্রাসী জিহ্বা
লকলকে জিঘাংসায় নড়ে ওঠে।
শব্দ রশ্মি যেন ছুটে যায় ইথারে ইথারে
বিশ্বব্যাপ্ত সেই শব্দ কুহরে জেগে ওঠে পাহাড়
ঢেউ ভাঙে সমুদ্রের শরীর
আভূমিনত সরলরৈখিক ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
সামনে এক উদ্যত সঙিন
সহসা স্তিমিত কলরব, বিপন্ন বিমূঢ়,
নিস্তব্ধতা ভেদ করে জেগে ওঠে মহাপ্রলয় ধ্বনি!
মৃত্যুর ঘ্রাণ যখন নীম ফুলে মিশে যায়
শুভ মন্ডল
নীম ফুলের গন্ধ সাথে নিয়ে এসেছে যে অন্ধকার, অস্ফুট আর্তনাদ কিংবা নিষ্প্রভ বিড়ালে চোখ, তা দেখে আমি আতকে উঠি; পড়ে দেখতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই এ রাতের ঘ্রাণ। আমার সেন্ডেল অর্ধেকটা ডুবে যায় পৃথিবীর কান্নায় নরম হয়ে যাওয়া উঠানে। হাঁটতে পারিনা শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠে; যেন ধ্বংসের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি; তবুও প্রকৃতির খেয়ালে ডোবার ব্যাঙ গলা ফুলিয়ে ডাকে। অপরিচিত লাগে এই পরিচিত চারপাশ। অপরিচিত লাগে আতংকিত বাদুরের ডানা ঝাপটানোর শব্দ; মনে হয় মৃত্যু যন্ত্রণা যেন রসুনের কোয়া অথবা জোনাক পোকা। আকাশ যেন অপঘাতে সিঁদুর মোছা নারী মুখ, রিলিফের চালের জন্য মৃত্যু সমান্তরাল অপেক্ষা। অবশেষে চৌরাসিয়ার বাঁশি যখন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে মিশে যেতে থাকলো, আমি অনুভব করতে শুরু করি এই নীমের ঘ্রাণময় অন্ধকার আসলে জীবন বোধের সারাংশ, গোয়ালা বধূর বানানো ঘী। এই আর্তনাদ আর নীম ফুলের গন্ধময় রাত আমার ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়কে জানান দেয় বৃত্তে বাঁধা পুরাণের সেই শরীর পোড়া পাখির গন্ধ। এতোকিছুর পর আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয় অথচ বেঁচে আছি বাজপাখির ঠুকরে খাওয়া কলিজা নিয়ে।
মদিরাক্ষী সিরিজ : রাবাত রেজা নূর
মদিরাক্ষী সিরিজ
রাবাত রেজা নূর
১
ভুল ফুলে ভরে গেছে অতসীফুলের
ডালদূরচারী হাওয়াদের তালে
কাঁপে বুনো কালিম পাখির ছানা
শিঙে ঘাসের গন্ধফেরে মহিষের পাল―
তীব্র নিনাদসুরে হাহাকার পাখি
রাত চিঁড়ে ছুটে চলে তারাদের ঝাঁক
চুমুর গন্ধ কোথায় লুকিয়ে রাখি?
জানে যদি কেউ তবে সব জেনে যাক―
জলের শিয়রে বসে দূরগামী চিল
মদির হাওয়ায় ঢুলে রঙধনু সুর―কেউ
কি মেপেছে কখনো? তোমার বাড়ি
থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব কতদূর―!
হুইসেল বেজে যায় জোনাকিট্রেনে
পুড়ছি দারুণ লোনলিনেসের জ্বরে
কেউ কি জানে―! কেমন করে একটা
পাতা ঝরে যায় কত অনাদরে―!
২
স্মৃতির সাইকেল টুংটাং বাজে
গোধূলিতে ডুবে আস্ত বনভূমি
সময়ের স্রোতে ভাসে থ্যালামাস
বিপরীতে কতদূর যাবে তুমি―?
পৃথিবীর গোলকে বৃথা হাঁটাহাঁটি
সময় সুড়ঙ্গ বেয়ে মহাকাল
সূর্যের বিপরীতে মাধবীলতা
হাতছানি দেয় আমার সকাল
স্বর্ণচাঁপার বাহুডোরে হাওয়া
হংসমিথুন ভাসে ময়ূরাক্ষী জলে
বিষাদপাখির নয়নজুড়ে মেঘ
সখি―প্রেম কাহারে বলে―?
বনের ওপাশে ময়ূর―রক্ত, মাংস,
প্রেম, লতাগুল্ম খুঁটে খুঁটে খায়―
আমার সকাল কেমন করে জানি
তোমার সকাল হয়ে যায়―!
৩
তোমার দেহ মুবারকে এসে
থমকে গেছে মেহজাবিচাঁদ
মোকাম দূরে ফেলে রেখে―
জোছনা খুবলে খেয়েছে হাত
ফল্গুনদীর গভীরে ঊর্মিমালা
খুব ধীরে নেয় শুশুকেরা শ্বাস
ভূমি তো নদীর কাছে খাতা
লিখে রাখে ভ্রমণের ইতিহাস
সেঁওতি বাগানের পাশে একা
ফুটে আছে অ্যাসপ্যারাগাস―
তোমার মুখের ছায়া―হরিদ্রা
হাঁসুলি―কথা নেই ঠোঁটে―
কাঁথার ওম ফেলে বালকরোগ
এমন পূজারিদেবী জোটে?
হয়তো সবই তোমারই দেওয়া
তাই জপ করি মদিরাক্ষীনাম
তোমাকে ডাকলেই খুঁজে পাই
আলমে আরওয়ায় নিজ দেহখাম
৪
শঙ্খসন্ধ্যায় নুনমাখা দেহ
উঠলে ওঠে পিরিতের জ্বর
মন্দিরে শুকতারার সেঁজুতি
ভীষণ শূন্য আমার ঘর―!
ঝিঁঝিঁ পোকার ডানায় সন্ধ্যা
শরীর রাখে না মনের খেয়াল
হয়তো প্রিয় কোনো ফুল রেখে
মাছকাঁটা খায় মায়ের শেয়াল―
শূন্য― ভীষণ এমন শুন্য যে
পৃথিবী যেন ঘুরতে ঘুরতে নাই
শূন্য খোলস অনাদরে শামুক
যেন―আরো গভীরে ডুবে যাই
এই যে এমন― হাওয়ায় উড়ে
যাওয়া নিখোঁজ হওয়ার ভান
যতই হারাই ততই বাড়ে দেবীর
প্রতি আমার মুহব্বতের টান―
৫
**
সোনালু ফুলের জংলায়―
জোছনার চাঁদ একা হাসে
ঘাসের সুগন্ধি পায়ে মেখে
মন্দিরে পূজো দিতে কে আসে?
হয়তো কোচড়ে তার আধখানা
চাঁদ― ডুবে আছে পূরবী বাতাসে
দেবী দেয় তাকে মহুয়া প্রসাদ―
ডাহুকের চোখে নামে দীর্ঘরাত
পাতা আর ফুলের তোলপাড়
সুজনি বিছানো আকাশের গায়
মদিরাক্ষী দেবীর নীলাম্বরী উড়ে
বেপথু বালকঘুড়ি মদির হাওয়ায়
শরাবে ভেজানো চোখ জোনাকি
জ্বলে তোমার পায়ের প্রতি নখে
বালকঘুড়ি শুধু একটা আকাশে
ওড়ে― সেই তো গেছি আমি বখে
৬
**
বুনোচারী হাওয়ার হাওদায় মেঘ
কামনা করি তোমার মাগফেরাত
জলকলমিতে হাঁসের ডানার ঘ্রাণ
ভুল করে ফেলি রুহের ক্বেরাত―
রাতচোরা বেভুল তিয়াসে ডাকে
চোখে ভাসে আমাদের কোঠাবাড়ি
গমের শীষে ঘাম মোছে শালিকেরা
জলসায় ভেজে আব্বার সাদা দাঁড়ি
ঘূর্ণি তুফানে শৈশব উড়ে গোপনে
বিঁচিকলার পির রোজ ভোরে ধুপি
সুগন্ধি ভেসে আসে লক্ষীপূজোর
প্রসাদ থেকে হৃদয়ে বাড়ে মধুকূপি
ফিরতে চাই তুলোমেঘ―হাওয়াঘড়ি
এলোচুলে পথে দাঁড়িয়ো মায়াবিনী
চোখের জল সব আকাশকে দিয়ে
তার কাছে চিরপ্রেম রঙধনু কিনি