পদাবলি

পদাবলি
 

ধোঁয়া
দাউদুল ইসলাম

ধোঁয়া উঠে
নতুন আগুনে, তুষের স্তুপে, বরফে
শীতের সকালে
রোদ্দুর মাখা চাতালে...
ধোঁয়া উঠে
পুরনো গল্পে,
নতুন কল্পে- সংকল্পে, অলীক আশংকায়...
ধোঁয়া শুরু এবং শেষে
ঝড়ের তোপে, জলোচ্ছ্বাসে!...
ধুলোর প্রলেপে বিবর্ণ ছবি, নীরবে হাসে
আনন্দে, স্মৃতির মহোৎসবে।
ধোঁয়া অনিরুদ্ধ!
পরম আবেগে, রুদ্ধ শোণিতে, প্রভাত ফেরীর মেঘে...
দূর আকাশে
অগ্নি শিখা গায়ে মেখে ধোঁয়া বাঁধে ঘর
ছোঁয়ার দূরত্বে থেকে দ্বিধা পোড়ায় অণিমা অন্তর!
জানে অপেক্ষার প্রহর
বর্ণীল দিন ম্লান করে
ধোঁয়া বেরিয়ে যায় ঈশ্বরের পাণে!...



আঙুল
আজাদ বঙ্গবাসী

প্রিয় শাহাদাত আঙুল- শৈশবে দুধের বোটা ছিলে তুমি আমার
শতবার হোচটের পরও বাবার দিকে দিয়েছিলাম তোমাকে বাড়িয়ে
লাঙল জোয়ালের গল্পে- তুমি একদিন রোপা লাগানো, মার্বেল ছুড়ে মারা
শিখে নিলে কি নিখুঁত কারিগরের মত !
প্রিয় শাহাদাত আঙুল, তুমি কালো বর্ণের
শিল্পি হলে;  ক্লাসগুলো এঁকে দিলে চিন্তার কত্ত বড় জগতে। পুরুষ পরীক্ষায়
একবার লবণের খাদে তোমাকে লাজ্জাবতি দেখেছি।

তুমি এই সেই আঙুল
যাকে দিয়ে এখন আমি নদী নাড়ি
আর আমার মুখস্ত হয়ে যায় ‘কবুল পড়া একটি শরীর’ ।



পাষণ্ড
শ্যামলী বিনতে আমজাদ

কাঁকর মিশেছে চিন্তা চেতনায়, বিবেকে ধরেছে জং,
হেসে খেলে আজ মারছি মানুষ, করছি নানান ঢং।
নির্মলতার মুখোশ পড়ে ভাই, দু’টাকা করি যে দান,
বঞ্চিত শিশু মনে মনে ভাবে- আহা, কী মহীয়ান !
মানি না নাকো তার আদর্শ আর ঐক্যে ঘেরা তান,
পাষ- মোরা ভুলে যেতে চাই, মার্চের সেরা গান।



অভিপ্রায়
লুৎফুন নাহার লোপা

বেগতিক ঝড়ের মত ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিন,
আমার ঘরের পাশে কাঁঠাল গাছের ছায়া
পুরোনো ভালোবাসা ছেড়ে দূরে তপ্ত রশ্মিতে,
আদরে জমানো মৌচাক কেটে নিচ্ছে অন্য কেউ,
অথচ তুমি চাইছো সুখী হতে -
ঝি ঝিঁ পোকারা দেশছাড়া, পালানোর বাধকতা,
থেমে গেছে সন্ধ্যার অহেতুক কান্না, উচ্চস্বর।
অরণ্য চিরে চিরে ঢুকে যাচ্ছে যে মানুষেরা
তারাই এখন নির্ভিক, শ্বাস নিতে ব্যস্ত।
শত বছরের রাজত্ব হারিয়ে উইপোকা
প্রেম খুঁজে খুঁজে উঠে যায় প্রসিদ্ধ দালানে,
অথচ তুমি চাইছো সুখী হতে !



আত্মজীবনী
দেলোয়ার হোসাইন

অভিজ্ঞতার পান্ডুলিপি যতই দীর্ঘ
হোক না কেন, মন খারাপের ভয়ে
যা বলতে পারিনি তাতেই লুকিয়ে
আছে আত্মজীবনীর বিভ্রান্তি!

আমার মন কারাগারের কয়েদি
সে জানে- ভিতরে নৈঃশব্দ্যতা...


শীতল জোছনার অজ্ঞাত ছন্দোচ্ছল ঢেউ-০৩
ইউসুফ কবিয়াল

নিয়মের করাতে কাঁটতে পারো মনের শত খেদ, নিরহ বুক কিলিয়ে ভরসা জাগাও বুকে
নীড়ে জোনাকির মতো মিটিমিটিয়ে জ¦লে ওঠবে হারিকেন
আনন্দাবেগে লজ্জাবতীর পাতাছোঁয়া চোখে চুমু এঁকে দিয়ে যাবে সবুজিয়া আলোর নাচন
হুতুমপেঁচার চেঁচামেচিতে খোঁজে পাবো সেই হারানো জ্ঞান।
যখন মুখোমুখি হবে বিপ্রতীপ চড়–ই- তখন তারাবাজি জ¦লে ওঠবে আকাশের উঠোনে
পিপিলিকার ঠোঁটে বেজে ওঠবে সঞ্চায়িত যাতনার গান
ঝিরিঝিরি হাওয়ার ছোঁয়ায়- যখন মনে জাগাবে শিহরণ তখন তুমি পুষ্পাসনে বসে
মেহেদিরাঙা হাতে লজ্জানত মুখে পুড়ে দিবে সতেজ পান।
তুমি পোস্টকার্ডে হৃদয়ের গহীনের শব্দটি লিখে পাঠালে না, পাঠালে না কোন সাংকেতিক শব্দ
তুমিহীনা ল্যাম্পপোস্টে ঝুলে আছে কুয়াশায় আহত এ চাঁদ
শীত পোড়াচ্ছে শরীর স্বপ্ন পোড়াচ্ছে হৃদয় শুধু কয়লা- অঙ্গার হয়ে জ¦লছে অহর্নিশ
দৃশ্যের বাহিরে অদৃশ্যের ছায়া বাড়াচ্ছে- আপন দুটো হাত
স্বপ্ন যত কাছে টেনে নেয় তুমি ততটা দূরে সরে যাও, ক্রমযোজিত দূরত্ব বাড়তে থাকে
সর্বনাশা চোখের ভাষা পাঠ করে কেঁটেছে কত শত রাত।

জুবাইদা গুলশান আরা : সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

জুবাইদা গুলশান আরা  : সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র


জুবাইদা গুলশান আরা
সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র

রহিমা আক্তার মৌ



শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী ও নারী নেত্রী প্রতিটি ক্ষেত্রে যিনি অর্জন করেছেন সাফল্য। বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত যার নাম তিনি জুবাইদা গুলশান আরা। সাহিত্যের নানা শাখায় তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার। এক কথায় একজন সফল জীবনশিল্পী হিসাবেই তিনি সবার কাছে পরিচিত। ব্যক্তি কখনো চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু জুবাইদা গুলশান আরার কর্মই নক্ষত্র রূপে উজ্জল থাকবে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের মাঝে।

১৯৪২ সালে ২২ এপ্রিল বাবা আলহাজ মুহম্মদ ইউনুস এর কর্মস্থল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) খুলনা জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও জুবাইদা গুলশান আরার পিতৃনিবাস উত্তরবঙ্গে বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে পদ্মা নদী ঘেঁষে সবুজ শ্যামলিমায় ছায়াময় বর্ধিষ্ণু গ্রামের রূপপুরে। তাঁর মায়ের নাম আঞ্জুমান আরা। সাত ভাই দুই বোনের মধ্যে তার বড় পাঁচ ভাই ছোট দুই ভাই এক বোন।
বাবা আলহাজ মুহম্মদ ইউনুস পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। ছেলেবেলা কাটে কলকাতায় ও পরে দার্জিলিং কার্সিয়ং কালিম্পংয়ের পাহাড়ে। পাহাড়ে দুরন্ত শৈশব কাটিয়ে তিনি নেমে আসেন সমতলের টাঙ্গাইলে। তার শিক্ষাজীবনের শুরু হয় টাঙ্গাইল জেলার বিন্দুবাসিনী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে পড়াশুনার পাশাপাশি গান ও আবৃত্তিতে তিনি দক্ষতা ও সুনাম অর্জন করেন। ময়মনসিংহ জেলার বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। এরপর ইডেন কলেজ থেকে বিএ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন।

দশম শ্রেণি থেকে নিয়মিত লেখালেখি করলেই তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ‘দিলরুবা' পত্রিকায়  সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে এমএ পাস করে কর্মজীবন শুরু করেন ভিকারুননিসা নূন গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার দিয়ে। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত স্কুলে শিক্ষকতার পর ১৯৬৪ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে নির্বাচিত হয়ে ইডেন মহিলা কলেজ-এ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সরকারি কলেজ থেকে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

ব্যক্তি জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের খ্যাতিমান প্রফেসর অধ্যাপক মাহমুদ-উল-আমীনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই মেয়ে, বড় মেয়ে মুসবাহ চারুকলায়, ছোট মেয়ে মেহতাব আমীন ফটোগ্রাফার।

জুবাইদা গুলশান আরা তার সাহিত্য কর্মের অবদান স্বরূপ একুশে পদক লাভ করেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, শিশুতোষ ছড়া মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬০ এর মতো। তার বেশ কিছু গল্প উপন্যাস টিভি নাটকে রূপ দেয়া হয়েছে। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, উপাধ্যক্ষ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

জুবাইদা গুলশান আরার বেশকিছু উপন্যাস ও ছোটগল্পের প্রসিদ্ধ লাভ করে। উপন্যাস ও ছোট গল্পের মধ্যে রয়েছে বসতি, আলোটুকুর হাতছানি, নদী তুই কোনঘাটে যাবি, মধ্যরাতের তারা, সাগর সেচার স্বাদ, তখনো ঘুম ভাঙেনি, ভোরের হিরন্ময়, আধারে নক্ষত্র জ্বলে, অগ্নিস্লান, কায়াহীন গারাগার, বাতাসে বারুদ রক্ত নিরুদ্ধ উল্লাস, হৃদয়ে বসতি, বিষাদ নগরে যাত্রা, দাওদানবের মালিকানা, প্রমিথিউসের আগুন, ঘৃণার জঠরে জন্ম, উষারাগ, অশ্রু নদীর ওপারে, কি লিখেছ তরবারি তুমি, পদ্মা আমার পদ্মা, হৃদয়ে নীল নাম, চৈতী তোমার ভালোবাসা, বিবর্ণ নগরী, মন্দাকিনী, উপন্যাস নদী, ভালোবাসার স্বভাব এমন, সোনালী রংয়ের নদী প্রভৃতি।

শিশুদের জন্য তিনি প্রচুর ছড়া কবিতা লিখেছেন। প্রথম ছড়ার বই ‘মজার ছড়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। প্রকাশিত আরো  বইয়ের মধ্যে রয়েছে  ছানাপোনাদের ছড়া, কলকাকলির গান, নিঝুম দ্বীপের গল্প কথা, ঘুম ভাঙ্গানো নদী, গল্প তবু গল্প নয়, রূপমের ছিরা খানা, তোমাদের জন্য গল্প, পরিচয় হোক বন্ধুর সাথে, শিশু তোর খেলার সাথী, ছোটদের নাটক মেলা প্রভৃতি।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। একাধারে  ছিলেন সুবক্তা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সংগঠক, চিত্রশিল্পী ও সফল উপস্থাপক। সত্তরের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান গণশিক্ষা ভিত্তিক ‘লেখাপড়া’র সফল ভাবে উপস্থাপনা করেন। আশির দশকে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয় তার উপস্থাপিত অনুষ্ঠান ‘কল-কাকলি’। এছাড়া ২০১১ সালে কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও বের হয় বাংলা গানের অ্যালবাম 'গান আমার পরশমণি'।

কর্মক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য জুবাইদা গুলশান আরা সমাজে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর সাহিত্যে রয়েছে দেশমাতৃকা, দেশের প্রতি দায়বোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এগুলোর গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে জীবনকে দেখার এক অসাধারণ ক্ষমতা তার সাহিত্য। তার সাহিত্য রচনায় স্থান পেয়েছে অতীত ইতিহাস, বাংলার খেটে খাওয়া দারিদ্র্য-পীড়িত জনমানুষ। প্রকৃতির অপার রহস্যময়তা, মানব-মানবীর মনলোক, শিশু মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি। জুবাইদা গুলশান আরা মূলত শিক্ষাবিদ ও সৃজনশীল লেখিকা হলেও শিক্ষকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজ উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক কর্মকান্ডের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।

নারী উন্নয়ন এবং নারী ক্ষমতায়নও নিয়েও নানাবিধ কাজ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের জন্মলগ্ন থেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। আমৃত্যু এই সংগঠনের সহ-সভাপতি ছিলেন। লেখিকা সংঘ প্রকাশিত বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সঞ্চয়ন’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতেন তিনি সুনিপুণ ভাবে। পেন ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখার সাহিত্যপত্র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০২ সালে এশিয়ান উইমেন্স, ড্রামাটিক কনফারেন্স ফিলিপিন্সের ম্যানিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ও তার তৈরি শর্ট ফিল্ম ‘উইম্যান ওয়াক আপ ইটস টাইম’ ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। ২০০৫ সালে তিনি ‘উইম্যান অব দ্য ইয়ার’ উপাধিতে ভূষিত হন।

জুবাইদা গুলশান আরা দেশ-বিদেশ সফর করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি স্বামী মাহমুদ-উল-আমীনের সাথে ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইডেন প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। ২০০০ সালে উইমেন প্লেরাইট ইন্টারন্যাশনালের সেকেন্ড কনফারেন্স অন উইমেন এ্যাড থিয়েটার সম্মেলন ম্যানিলায় (ফিলিপিন্স) যোগদান করা ছাড়াও তিনি ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

গত ১৯ মার্চ ২০১৭, রোববার বেলা আড়াইটায় সিদ্ধেশ্বরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ইন্তিকাল করেছেন। ইন্না নিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার সৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম, মানবিক বোধ আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে, থাকবে। তার সাহিত্য পাঠককে যুগের পর যুগ আনন্দ দিয়ে যাবে। জীবন থেকে ছুটি নিলেও এই জীবনশিল্পী পাঠকের মন থেকে ছুটি নিতে পারবেন না কখনোই। পাঠকের মনের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন, বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির মধ্যে।

মৃত্যুর আগে তিনি সম্মানিত হয়েছেন বহুবিধ পুরস্কারে।  ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়া কবি আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার, কমর মসতরী স্বর্ণপদক , বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন পদক, শের-এ বাংলা স্মৃতি পুরস্কার, জিসাস স্বর্ণপদক , কবি জসিম উদ্দীন পরিষদ পুরস্কার , চয়ন সাহিত্য পত্রিকা স্বর্ণপদক , বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক এবং লেখিকা সংঘ প্রবর্তিত ড. তাইবুন নাহার রশীদ স্বর্ণপদক , ত্রিভুজ সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার,  দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পুরস্কার , নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার ও আরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাহিত্য সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা লাভ করেন।

সাধারণ মানুষ থেকে সুশীলসমাজ পর্যন্ত সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের জীবনবোধ ও জীবনাচরণ তার সাহিত্যের পরতে পরতে লিপিবদ্ধ। জীবের জীবনকে নিয়েই ভেবেছেন তিনি। জীবনকেই উচ্চে তুলে ধরেছেন কলমের মাঝে। মাটি, মানুষ, দেশ, কাল, জাতি, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ তার সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য। আজকে যাকে আমরা সাহিত্যের নক্ষত্র বলি, তাঁর বর্ণাঢ্য যাত্রা কৈশোরে হয়, তার গোড়াপত্তন ঘটে ভাষা আন্দোলনের গান ও আবেগ নিয়ে।  ভাষা আন্দোলন তার ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে দিয়েছিল, তাকে লেখক হবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।



রফিক আজাদের কবিতা

রফিক আজাদের কবিতা

দু’টি কবিতা
রফিক আজাদ

ভালোবাসার সংজ্ঞা

ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি,
পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা;
ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া,
বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি;

ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি
খুব করে ঝুঁকে থাকা;
ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা
ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া;
ভালোবাসা মানে ঠা-া কফির পেয়ালা সামনে
অবিরল কথা বলা;
ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও
মুখোমুখি বসে থাকা।



প্রতীক্ষা

এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-
কোনো বন্ধুর জন্যে
কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবোৃ
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি-
হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা ক’রো
একসঙ্গে বেরুবো।”

এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি
কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো
উচ্চারণ করেছিলো, “বাড়ি থেকো
ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।”
হয়তো বা ওর মনের মধ্যে ছিলো
চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেস্ট বাংলো;
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি।

যুদ্ধের অনেক আগে
একবার আমার প্রিয়বন্ধু অলোক মিত্র
ঠাট্টা ক’রে বলেছিলো,
“জীবনে তো কিছুই দেখলি না
ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া। চল, তোকে
দিনাজপুরে নিয়ে যাবো
কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি,
বিরাট গোলাকার চাঁদ মস্ত খোলা আকাশ দেখবি,
পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি,
গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান
পেয়ে যেতেও পারিস,
তৈরী থাকিস- আমি আসবো”
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি;

আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি- শত্রুর জন্যেও
অপেক্ষায় থেকেছি,
বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে
অপেক্ষায় থেকেছি-

কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো না,
-প্রতীক্ষা করবো।
‘প্রতীক্ষা’ শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্যে খুব যতেœ
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,
অভিধানে শব্দ-দু’টির তেমন কোনো
আলাদা মানে নেই-
কিন্তু আমরা দু’জন জানি
ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক,
‘অপেক্ষা’ একটি দরকারি শব্দ—
আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন,
অনেকের প্রয়োজন মেটায়।
‘প্রতীক্ষা’ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,
ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য,
আমরা কি একে অপরের জন্যে প্রতীক্ষা করবো না ?

আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো
দাঁড়িয়ে থাকবো-
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের
জন্যে প্রতীক্ষমান,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে
আমার পায়ে শিকড় গজাবেৃ

আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না


তোমার কথা ভেবে

তোমার কথা ভেবে রক্তে ঢেউ ওঠে—
তোমাকে সর্বদা ভাবতে ভালো লাগে,
আমার পথজুড়ে তোমারই আনাগোনা—
তোমাকে মনে এলে রক্তে আজও ওঠে
তুমুল তোলপাড় হূদয়ে সর্বদাৃ
হলো না পাশাপাশি বিপুল পথ-হাঁটা,
এমন কথা ছিল চলব দুজনেই
জীবন-জোড়া পথ যে-পথ দিকহীন
মিশেছে সম্মুখে আলোর গহ্বরেৃ




গুচ্ছ কবিতা

গুচ্ছ কবিতা


গুচ্ছকবিতা
লতিফ জোয়ার্দার


জুলফিকার


নিজের জগৎটাকে ছোট করতে করতে একদিন জুলফিকার একা হয়ে গেল
একদিন বন্ধু বলতে যারা ছিলো তাদের অনেকেই রাজনীতির পালা বদলে ভেসে গেছে
তার সংসার বলতে চারচালা টিনের ঘর এক চিলতে উঠোন আর এক বুড়োবৃক্ষ
করাতকলের চোখ এখন সেই বৃক্ষের দিকে। জুলিফকার মাঝে মাঝে ভাবে
হয়তো মৃত্যু হলেই ভাল হতো। এই পরম্পরায় বেঁচে থাকার অর্থ অবরুদ্ধ হয়ে থাকা
কিছু কিছু অনউচ্চারিত দুঃখ আল্পনায় আঁকা যায় না। নিয়তির কাছে থাকা না থাকার অর্থ
জুলফিফার একদিন বুঝেছিলো, যেদিন রেললাইনের ধারে পড়েছিলো কিছু লালরঙ রক্তের আল্পনা 

ক্রীতদাস

জেলখানার সাক্ষাত কক্ষে আজ আমি আমাকে দেখে চমকে উঠি
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আরেক আমি
যেন চিৎকার করে আমি আমার সাথেই কথা বলছি
আজ আর কোন আবেগ উচ্ছ্বাস নেই আমাতে
বিবর্ণ রেখায় সাদা আর্তনাদ খেলা করে যায় একা একা
প্রতিশোধ আর প্রতিরোধের আয়নায় দ্বিধান্বিত রাস্তায় আমি
অনাবৃত পায়ে কোন এক ক্রীতদাস।
মনে পড়ে যায় রিক্সায় আসতে আসতে
জেলখানার লাল প্রাচীরেরর সাথে দেখা হয়েছিলো আমার
অদ্ভুত প্রাচীরের চোখ দেখে আমি থমকে যাই
তখন কেবলি মনে হয় আমি এক অপরাধী পিতা
শিকল ভাঙ্গার গান ভুলে যাই আমি
কেবলমাত্র বেদনাকে পূজি করে অন্ধ কালাকানুন মেনে নেই আমি
আমি আমাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠি
অথচ এই দিনটির কথা কোনদিন মনে আসেনি আমার
আমি আমাকে দেখি! প্রশ্ন করি আমি এক ক্রীতদাস 
মিথ্যে প্রবঞ্চনার কাছে  বার বার হেরে যাই আমি


প্রেম

ফিরে এসে বলবে বলেও বলতে পারেনি সে। দ্বিদ্ধা সংকোচ আর ভয় ছিলো মনে
মাঝে কিছু লজ্জার লু-হাওয়া লেগেছিলো বুকে। ম্যানিপ্লান্টে লুকিয়ে রেখেছিলো সুখ।
মন খারাপ হয়েছিলো বলতে না পারার ব্যথায়। তবুও বুকে তার অসীম তৃষ্ণার ঘোর
আর চোখে তার তুলতুলে নরম বিড়ালের আদর। জানালায় রেখেছিলো হাত, মন তার
দিয়েছিলো উকি। বার বার প্রেম আসে মনে তবুও সে বুঝে না অদ্ভুত প্রেমের ঝুকি

কবি ও তার জন্মসনদ

সম্ভবত পৃথিবীর সর্বশেষ কবি আমি
আমার পরে আর কোন কবির জন্ম হবে না
যেমন শেষ নবীর পরে আর কোন নবীর জন্ম হয়নি
আজো। এমন একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেবার পর
কিছু মানুষ আমাকে ভুল ভাবতে শুরু করলো
কিছু মানুষ আমি আস্তিক নাকি নাস্তিক?
এ বিষয়ে বিষদ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে
পারলো না।চৌচির মাটির মত তখন আমার বুকের অধর
অতঃপর  কেউ কেউ  আমাকে আক্রমন করে
কথা বলতে শুরু করলো। কাক-মৌলভীদের
আনাগোনা তখন চারদিকে। শরৎ সন্ধ্যায় বৃষ্টির শহর
আমাকে নিয়ে ব্যস্ত এ শহরের নাগরিক গণ
মিছিলে মুখরিত রাজপথ আমার ম-ুপাতের দাবীতে!
এমন একটা স্বপ্ন দেখার পর
কিছুতেই আমার চোখে আর ঘুম এলো না

মুখ

এই ক্ষণকালীন জীবন আমার ভালো লাগে না
শত বছরের যৌবন চাই আমি
হয়তো এমন চাওয়াতে কোন নতুনত্ব নেই
হয়তো আরো অনেকেই ঈশ্বরের কাছে এমনটাই চেয়েছিলো
হয়তো চায়ের দোকানী অটোচালক কিংবা কয়লাখনির
কালোচামড়ার শ্রমিকের চাওয়াতেও কোন ভিন্নতা ছিলো না
একদিন মৃত্যুদ- প্রাপ্ত কয়েদীও সংসারী হবার কথা ভেবেছিলো
মরে যাবার আগে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার কথা ভেবেছিলো
প্রিয়জনের আকুতি শুনেছিলো জেলখানার গুমোট হাওয়ায়
দীর্ঘশ্বাসের সাথে কিছু কথা বলেছিলো সে চুপিচুপি
আমিও তার মত করে শতবর্ষী বৃক্ষের মন চাই
মৃত্যু আমাকে ভেজা ভোরের হাওয়ায় ডাকে
একদিন জন্মচিৎকার শুনে যারা নতুন সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলা
সেখানেও মৃত্যু ছিলো। পাশাপাশি বিষাদমাখা একখানা মুখ
হয়তো প্রিয় এই বোবাশহরের ট্যাফিক জ্যামে আটকে আছি আমি
অথচ আমার দু’চোখে স্বপ্ন
আর দীর্ঘজীবন নিয়ে বেঁচে থাকার অনন্ত আকুতি


সাহিত্য সংবাদ

সাহিত্য সংবাদ


কুয়েত থেকে প্রকাশিত ‘বর্ণমালা’ ম্যাগাজিন’র এর পাঠ উম্মোচন ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা

কুয়েত থেকেঃ ভাষার মাসে মৃত্তিকা প্রকাশন কুয়েত থেকে প্রকাশিত বর্ণমালা ম্যাগাজিন’র পাঠ উম্মোচন উপলক্ষে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ইং কুয়েত সিটিস্থ প্যারাগন ক্লাসিক রেস্টুরেন্ট এর হলরুমে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। মোহাম্মদ জাকারিয়ার শেল্পিক উপস্থানায় ইজাজ আহমেদ এর সুললিত কন্ঠে কুরআন থেকে তেলওয়াত এর মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়, এতে সভাপতিত্ব করেন সম্পাদক- বর্ণমালা ম্যাগাজিন ও প্রকাশক, মৃত্তিকা প্রকাশন, কুয়েত এর কবি সেলিম রেজা। প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন মোঃ আনিসুজ্জামান- কাউন্সেলর (রাজনৈতিক) ও দূতালয় প্রধান, বাংলাদেশ দূতাবাস, কুয়েত। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন রবিউল আলম রবি- সভাপতি-বৃহত্তর ঢাকা সমিতি-কুয়েত; হাজ্বী জুবায়ের আহমেদ- বিশিষ্ট সংগঠক ও সমাজসেবক; আলহাজ্ব জাফর আহমেদ চৌধুরী সভাপতি- চট্টগ্রাম সমিতি, কুয়েত; মোঃ মিজানুর রহমান- প্রশাসনিক কর্মকর্তা- বাংলাদেশ দূতাবাস-কুয়েত; আবুল বাশার- সভাপতি- ম্যানেজার’স এসোসিয়েশন, কুয়েত; মোরশেদ আলম বাদল- সভাপতি প্রবাসী সাহিত্য পরিষদ, কুয়েত; আব্দুর রউফ মাওলা- সম্পাদক- মাসিক মরুলেখা; ওমর ফারুক জীবন- সম্পাদক- শিখর (একটি সাহিত্যের কাগজ); রফিকুল ইসলাম ভুলু- সভাপতি- বাংলাদেশ সাহিত্য অঙ্গন, কুয়েত; আব্দুর রহিম- সাধারণ সম্পাদক- বাংলাদেশ সাহিত্য অঙ্গন, কুয়েত প্রমুখ। স্বাগতিক বক্তব্য রাখেন কবি ওমর ফারুক জীবন। প্রধান অতিথি, ম্যাগাজিন’র সম্পাদকসহ মঞ্চে উপবিষ্ট সবাই মিলে ‘বর্ণমালা’ ম্যাগাজিন’র পাঠ উম্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে বক্তারা শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রবাসে সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজে কবি সেলিম রেজার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ম্যাগাজিন প্রকাশে তাঁর অনন্য ভূমিকা পালনের কথা ব্যক্ত করে বলেন- কুয়েতে সাহিত্য জগতে তিনিই বেশি শ্রম ও মেধা দিয়ে পাঠকের খোরাক যুগিয়েছেন। একাধারে তিনি ‘মৃত্তিকা’ (একটি সাহিত্যের কাগজ), ‘দেশান্তর’, ‘বর্ণমালা’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন -কবি আব্দুর রহিম, রক্তিম বিশ্বাস, শিল্পী নুপূর বিশ্বাস, মিজানুর রহমান, কবি মনিরুল হক এমরান, কবি জাকির ভিক্টোরিয়া, কবি নাসরিন আক্তার মৌসুমী, কবি রফিকুল ইসলাম ভুলু, কবি মোরশেদ আলম বাদল, কবি বাবুল মুন্সী, প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম জহির প্রমুখ এবং গানে পুরো অনুষ্ঠান টা মাতিয়ে রাখেন কন্ঠশিল্পী কেয়া, নূপুর বিশ্বাস, রুবেল বড়ুয়া, সন্তোষ দাশ সহ আরো অনেকেই। প্রাণবন্ত একটি অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সাংবাদিক অঙ্গসংগঠনের নেত্রীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অবশেষে অনুষ্ঠানের সভাপতি কবি সেলিম রেজা সমাপনী বক্তব্যে আগত অতিথিদের শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নৈশ ভোজের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।


গল্প : আবিষ্কার

গল্প : আবিষ্কার


আবিষ্কার
জাহিদ হোসেন

কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে সোনিয়ার চিঠি পেয়ে আদনানের ভেতরটা ছটফট করে ওঠে। অনেক কথার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা নামক শব্দটি বারবার তাকে সোনিয়ার কাছে টেনে নিয়ে যায়। সে ক্রমশঃ পেছনের দিকে হাঁটতে থাকে।
সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। বাঙালি সংস্কৃতির এক উলে¬খ্য দিন। সকাল থেকেই আদনানদের কলেজ চত্বরে বসেছিল বৈশাখী মেলা। গ্রাম্য ঐতিহ্যের নানা আয়োজনে চারপাশ ছিল মুখর। প্রকাশিত হয়েছিল কলেজের সাহিত্য সংগঠনের পক্ষ থেকে কবিতা পত্র  ‘বোশেখের পাতা’। সেখানে ‘আবিস্কার’ নামে আদনানের একটি কবিতা ছাপা হয়। কষ্টের কথায় মোড়ানো এই কবিতাটির অবয়বে ছিল ভালবাসার তৃষ্ণা। ছিল ঘৃণার বিদ্রুপ ভুলে যাবার জিয়নকাঠি। পহেলা বৈশাখের সেই আনন্দের দিনে কবিতাটি পড়ে কারও মনে কোন প্রশ্ন জেগেছিল কিনা জানা নেই কিন্তু নানা প্রশ্ন নিয়ে সোনিয়া নামের এক অপরিচিতা উপস্থিত হলো।
রাতে ঘুম হয়নি। আদনান কলেজের পশ্চিম দিকের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে ঝির ঝির শব্দে বাতাস বইছে। সে বাতাসের সুরে সুরে বৈশাখী আয়োজনের কলরোল ভেসে আসছে। হঠাৎ মেয়েলি কন্ঠে সে চমকে ওঠে। এক্সকিউজ মি! মুখ ফেরাতেই ঝটপট প্রশ্ন এলো, আপনার লেখা আবিস্কার কবিতাটি পড়লাম। কষ্টের কথা দিয়ে এখানে ভালোবাসাকে কিন্তু বেশ শাসিয়েছেন। আবার ঘৃণাকে ভুলে যাবার সুনিপুণ যুক্তিও ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতাটি আমার খুব ভাল লেগেছে। কাজিন এর কাছে পরিচয় জেনে তাই কথা বলতে এলাম। আপনি মনে কিছু নেন্নি তো? এক নিঃশ্বাসে মেয়েটি অনেকগুলো কথা বলে গেল। আদনান বিস্মিত না হয়ে পারলো না। যে মেয়েটিকে সে চেনে না, কোনদিন দেখেছে বলেও মনে পড়ে না তাকে হঠাৎ কেন যেন ভাল লেগে গেল। অসংখ্য ভাবনার ভিড় ঠেলে সে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনি- মেয়েটি দ্রুত বাধা দিয়ে বললো, আমাকে তুমি বললেই খুশি হবো। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আদনান আবার জিজ্ঞেস করলো, তুমি- কথা শেষ না হতেই মেয়েটি উত্তর করলো, এখানে খালার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমার নাম সোনিয়া, চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। বলেই সে হাত বাড়িয়ে একটা ডায়েরি আদনানের সামনে মেলে ধরে আবেদনের সুরে বললো, পি¬¬জ একটা অটোগ্রাফ দেবেন। মেয়েটি যে অত্যন্ত চঞ্চল, আদনানের বুঝতে কষ্ট হয় না। চঞ্চল মেয়েদের চঞ্চলতা কি কারণে যেন ভালই লাগে। সে মুচকি হেসে ডায়েরি হাতে নিতে নিতে বললো, আজ পহেলা বৈশাখ। তুমি নিশ্চয় জানো। মেয়েটি ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর করলো, জি জানি। আদনান বললো, দেখ তোমার বয়সি মেয়েরা বেশ সেজেছে। পড়েছে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, খোঁপায় বেলি, রজনীগন্ধা ফুল। হাতে রিনিঝিনি বাজছে নানা রঙের চুরি। কিন্তু অবাক হচ্ছি তোমাকে দেখে। তুমি মোটেও সাজনি। জানতে পারি, সাজনি কেন? খানিকটা সংকোচ নিয়ে দুষ্টমির সুরে সোনিয়া বললো, অনেকেই বলে, সাজলে নাকি আমাকে ভাল লাগে না। সে জন্য সাজিনি। আদনান অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, সোনিয়া আসলেই সুন্দর। তবে সাজলে ভাল লাগবে কিনা বুঝতে পারলো না। ডায়রির পাতায় কিছু একটা লিখতে, লিখতে সে সোনিয়াকে আবার প্রশ্ন করলো। ক’দিন এখানে থাকবে। সোনিয়া উত্তর করলো বেশ কটাদিন। আদনান সময় নিয়ে বললো, আবার কি দেখা হবে। মিষ্টি হেসে সোনিয়া উত্তর দিলো- হয়তো হবে। এরপর থেকে প্রায়ই ওদের দেখা হতে থাকে। আর এর রেস ধরে একপা, দুপা করে কখন যে ওরা ভালোবাসাবাসির খেলায় জড়িয়ে গেছে বুঝতে পারে নাই। সময় কারও জন্য বসে থাকে না। সোনিয়ার যাবার সময় হয়ে আসে। যাবার আগে আদনানের সাথে অনেক কথা হয়। কথার ফাঁকে হঠাৎ কি জানি কি ভেবে সোনিয়া বলে ওঠে, আদনান তোমার কবিতা দিয়েই আবারও আমার আবিস্কার ঘটবে। সেদিন যেন আমাকে চিনতে ভুল করো না। সোনিয়া বিদায় নেয়। আদনান এ কথার অর্থ বুঝে উঠতে পারে না। মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
আজ যখন সে সব কথা মনে পড়ে তখন তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা শুরু হয় এক ভাবে তবে সব ভালোবাসা শেষটা বোধ হয় একরকম হয় না। যেমনটি তাদের হয়নি। জীবনটাকে মধুময় করার অভিপ্রায়ে ওরা যখন উদ্বিগ্ন তখন সোনিয়ার হঠাৎ প্রস্থান আদনান মেনে নিতে পারে না। সংবাদ আসে রোড এক্সিডেন্টে সোনিয়া পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। একটা অদৃশ্য কষ্টে আদনানের সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে কিন্তু কাউকে কিছু জানাতে পারে না। মানুষের অনেক কষ্ট থাকে, সব কষ্টের কথা বলা যায় না। এরপর থেকে আদনান অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে যায়। মনের অজান্তে খানিকটা অনিয়মের মধ্যে বসবাস শুরু হয় তার। অধিক রাত জেগে থাকা, অসময়ে নাওয়া খাওয়া, কোন কিছুতেই মনোযোগ আসে না। ছেলে মেয়ের কিছু হলে মায়েরা তা আগাম বুঝতে পারে। একমাত্র ছেলের এই নিশ্চুপ অনিয়মের মধ্যে বসবাস আদনানের মা আমেনা রহমানের চোখ এড়াতে পারে না। সে ছেলের সাথে আদনানের বাবা মাহবুব রহমানের অনেক মিল খুঁজে পেলেও খানিকটা অমিল লক্ষ্য করে ভড়কে যায়। আদনানের বাবা ছিলেন একজন সৃজনশীল সাহিত্য প্রেমী মানুষ। তার লেখা কবিতা, গল্পে উঠে আসতো মাটি, মানুষ ও স্রষ্ঠার চিত্রপট। সে ছিল অত্যন্ত বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ মানুষ,   পক্ষান্তরে আদনান বাবার সাহিত্য ভাবনাকে অন্তরে ধারণ করে থাকলেও বাবার মতো হয়নি। সে স্বল্পভাষী এবং ঘরমুখো। আদনানের মা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, আদনানের বাবা একজন রহস্যাবৃত মানুষ। আর এই কারণে তাদের মধ্যে নানা রকম সন্দেহের সৃষ্টি এবং বাকবিতন্ডাও হতো। কারণে অকারণে আমেনা রহমান আদনানের বাবাকে এমন সব প্রশ্ন করে বসতেন, যার উত্তর মাহবুব রহমান খুজে পেতেন না। নিখাদ ভালবাসা আজ আমেনা রহমানকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যার চারপাশে শুধু সন্দেহ, দিধা-দ্বন্দ আর মিথ্যা বিশ্বাস। আদনানের বাবা সবকিছু বুঝতে পারলে স্ত্রীর উপর আচর হওয়া এই অপছায়াকে দূরে ঠেলে দিতে পারে না। যার প্রেমের পরশে আজ তিনি একজন লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তার এই অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে বসবাস মাহবুব রহমানকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়। অনেক কথা থাকে যা বলা যায় না। তিনি কাউকে কিছু বলতে পারেন না। এক ধরনের চাপা আর্তনাদে তার বুকের ভিতরের পুরোনো ব্যথাটি ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং একদিন প্রত্যুষে হঠাৎ করেই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আজ আমেনা রহমান একটু একটু করে বুঝতে পারছেন তার ধারণা সম্পূর্ণ রূপেই মিথ্যে ছিল। যে মিথ্যে ধারণাকে সম্বল করে তিনি বার বার কষ্ট পেয়েছেন এবং আদনানের বাবাকেও কষ্ট দিয়েছেন, সেই একই ধারণা তিনি ছেলের মধ্যে খুঁজে পেয়ে চমকে ওঠেন। তার সমস্ত অবয়ব দুঃচিন্তার চাদরে ঢেকে যায়।  না-না, তা হবে কেন? তিনি নিজেকে চিন্তামুক্ত করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে মুছতে দরজা ঠেলে ছেলের কাছে এসে বসে। আদনান বিছানায় শুয়ে ছিল। মাকে দেখে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, মা এসো, বিনীত স্বরে বলল কিছু বলবে? ছেলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে আমেনা রহমান বললো, বাবা তোমার কি কিছু হয়েছে ? ইদানিং খুব অন্যমনস্ক থাক। বহু কষ্টে আদনান ভেতরের যন্ত্রণাকে আড়াল করে থেমে থেমে বললো, কই নাতো। কিছু হয়নি মা। তুমি অযথা চিন্তা করছো। নরম সুরে আদনানের মা বললেন, তোমার বাবা বেঁচে নেই। তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। তুমি যদি ভেঙে পড়ো তাহলে এ সংসারের হাল কে ধরবে। প্রতিটি মানুষের জীবনে বিশেষ কিছু সময় আসে কিন্তু সে সময় মনের ভিতর লালন করে কষ্ট নেয়া ঠিক নয়। এটা তো মানতেই হবে করুণাময় যা করেন তা ভালর জন্যই করেন। মায়ের কথায় আদনান খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে মনে মনে ভাবে, মা কি কিছু জেনে ফেলেছেন। এক ধরনের লজ্জায় তার মুখটি শুকিয়ে ওঠে।
বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমেনা রহমান হতাশ গলায় বললেন, কখন যে ওপারে চলে যাই বাবা ঠিক নেই।  শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। আমি তোমার বিয়েটা দেখে যেতে চাই। তুমি চিন্তা করে আমাকে জানিও। ধীর পায়ে আমেনা রহমান পা বাড়ান। আদনান অবাক দৃষ্টিতে মায়ের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এর কিছুদিন পর আদনান বিয়ে করে। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সে আস্তে আস্তে সব কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ ভাবেই দিন যায়। একদিন এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে প্রতিবন্ধী সংস্থার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে সে থমকে যায়। মঞ্চ থেকে কেউ একজন তার লেখা সেই ‘আবিস্কার’ কবিতাটি ভাঙা ভাঙা কন্ঠে আবৃত্তি করছে।
‘আমার আবিস্কার সেতো যন্ত্রণার
কিন্তু বড় বেশি তৃষিত আমি ভালোবাসায়,
কষ্টের গরিমা থেকে ভালোবাসা পেতে
কে না ভালোবাসে।’
সে উৎসুক হয়ে এগিয়ে এসে মঞ্চের পাশে দাঁড়ায়। পা হীন একটি মেয়ে হুইল চেয়ারে বসে তার লেখা কবিতাটি আবৃত্তি করে চলছে। মেয়েটির চোখে কালো চশমা। সমস্ত অবয়ব, মুখমন্ডল কাপড়ে ঢাকা। আদনান মেয়েটিকে চিনতে পারে না। তার মনে হাজারও প্রশ্ন জাগে, কে এই মেয়ে? এক ধরনের কৌতুহল নিয়ে, সেদিনের মত সে বাসায় ফেরে। পরদিন প্রতিবন্ধী সংস্থায় এসে সংস্থা প্রধানের সাথে কথা বলে জানতে পারে, এই সেই রায়না মির্জা। যার মৃত্যুই হয়েছিল কিন্তু বিধাতা তাকে কি জানি কি অদৃশ্য কারণে বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে সে অন্ধ হয়ে গেছে। শরীরের অনেক অংশ অকেজো হয়ে পড়েছে। সংস্থা প্রধান আদনানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, একবার ভেবে দেখুন, একটা দুর্ঘটনা মানুষকে কতটা অসহায় করে ফেলতে পারে। তারপরও কি আমরা সচেতন হতে পেরেছি কিংবা দুর্ঘটনা এড়াতে সরকার কি কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন ? জানেন আমরা আসলে দুর্ভাগা। আদনানের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। সে উঠে দাঁড়ায়। তার কানে বার বার সোনিয়ার সেই কথাটিই বাজতে থাকে। হয়তো আবারও তোমার কবিতা দিয়েই আমার আবিষ্কার ঘটবে, সেদিন যেন আমাকে চিনতে ভুল করোনা। আদনানের চোখের পাতা ভিজে আসে। ইচ্ছে করে সোনিয়ার সাথে দেখা করে কিন্তু পারে না। তার মনে হয়, যে যন্ত্রণাকে ভালবেসে রায়না আজ সুখ খুঁজে নিয়েছে সেখানে তার উপস্থিতি শুধু দুঃখই বাড়াবে। সে প্রতিবন্ধী সংস্থা থেকে ক্লান্ত মনে বের হয়ে বিড় বিড় করে বলে যায়, সোনিয়া তোমার কথাই ঠিক। আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। ক্ষমা করে দিও.....।