ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৮৮

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৮৮

তারুণ্যের শিল্প সরোবর। ধানশালিক। । সংখ্যা ১৮৮

শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭ আশ্বিন ১৪৩০, ০৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫ ।


















রাগিণী

রাগিণী


 


রাগিণী

আসআদ শাহীন 



বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামে

ধরিত্রীর এ নীলিমা খ-চিড়ে

পাখি-ঝাঁক প্রস্থান নেয় নীড়ে

মানবজীবন ব্যস্ত পৃথিবীর জ্যামে।


“আচ্ছা রাগিণী! তুমি আবার কবি হলে কবে? তুমি না বলেছিলে-“কবি মানেই পাগল”। তাহলে কী তোমার কথা আজ মিথ্যে হলো; নাকি তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছিলে? তুমি তো কখনো মিথ্যা বলো না! তবে...”


দৃষ্টিশোভিত-মনোজ্ঞ, সবুজের শামিয়ানায় ঘেরা সবুজাভ প্রাকৃতির লীলাভূমি রাজশাহী। এমন শহরে বসবাস আমার আর রাগিণীর। এই ব্যস্ত নগরীর নিস্পন্দন দুর্ভেদ্যনিশীথে আমি ও আমার প্রিয়তমেষু রাগিণী-জোনাকজ্বলা রজনীতে অনাবৃত অম্বরতলে নিজেদের দেহ প্রাণবন্তসজীব দূর্বা কাঞ্চনে বিলিয়ে শুয়ে আছি। আমি রাগিণীর উন্মুক্ত কায়ায় তার শুভ্রসফেদ-নরোম-মসৃণ-মখমল-কোমল পিঠে অঙুলি দিয়ে আনমনে এঁকে যাচ্ছি। জানি-রাগিণী এতে খুবই রোমাঞ্চিত ও সন্তোষিত হচ্ছে। আমারও ভালো লাগে রাগিণীর সফেদি পিঠে অঙুলির স্পর্শ-আঁকা প্রমোদলীলায় মেতে উঠতে। 


অদ্যকার নিশিথ হিমাংশুর দ্যুতি বেশ চমকপ্রদ। ঝকঝকে পরিষ্কার। নিশিকান্তের রশ্মিটা ঠিক যেন রাগিণীর উন্মুক্ত বস্ত্রহীন শুভ্র-সফেদ পিঠে এসে পড়েছে। এতে করে রাগিণীর শুভ্র-সফেদ পিঠ আরো প্রীতিকর-মনোহর করে তুলেছে। এমনই এক সুখময় মুহূর্তকালে সহসা রাগিণী স্ফুটস্বরে কবিতা আবৃত্তি করে ওঠে। আমি প্রথমত চমকে গেলাম। কিন্তু না,পরক্ষণই তার মুখ নিঃসৃত কবিতাপাঠ শুনে যাচ্ছি আর ভেবে যাচ্ছি-রাগিণীর মুখ নিঃসৃত পাঠ্য-কবিতা তো আমার লেখা নয়,তাহলে কার কবিতা আবৃত্তি করছে রাগিণী? রাগিণীর মুখ নিঃসৃত এই কবিতা তো রবী-নজরুল-জসীম-কায়কো-শরৎ-বঙ্কিম-সুধিন্দ্র সেকেলের কোনো কবিদেরও না। আবার-একালের হুমায়ুন-শামসুর-আল মাহমুদ-হাফিজ-সাদাত এদেরও তো না। তাহলে কার ? তৎক্ষণাৎ ভাবলাম-হয়তো আমার মত নতুন কোনো কবিদের কবিতা। কিন্তু! রাগিণী তো এমন না যে-অন্যের কবিতা সে আবৃত্তি করবে! সে তো কেবলই-শুধুই আমার কবিতা পড়ে-আবৃত্তি করে। আমার কবিতাকেই ভালোবাসে। নাহ্! রাগিণী এমন হতে পারে না আর এ কবিতাও আমার না-তবে কার? 


আমি প্রচন্ড অগ্নিশর্মা হলাম রাগিণীর উপর। ভাবলাম-তার পার্শ্ব থেকে উঠে যাব। কিন্তু, সহসাই রাগিণী বলে উঠে-কবি! ওগো কবি আমার!! তোমার কেমন লাগল আমার আবৃত্তি? এই যে কবি! তোমাকেই বলছি-কি ব্যাপার! তুমি নিশ্চুপ যে! তার এই কোমলময়ী সম্বোধনের উত্তরে কি বলব? যদি বলি-ভালো না, তাহলে রাগিণী আমার উপর রাগ করবে খুব। এমন রাগ যে-সে আমার সঙ্গে আর কথাও বলবে না। কেবলই কথা! না-একেবারে তালাক অবধি চলে যাবে। সেজন্য অনেক ভেবে-চিন্তে সৌজন্যবোধের জন্য বললাম, বেশ চমৎকার হয়েছে। খু-উ-ব সুন্দর আবৃত্তি করেছো তুমি মাশাআল্লাহ! (ভেতরে ভেতরে ক্রোধের অনলে জ্বলছি-তথাপি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলাম) আমার করা (ভুয়া) প্রশংসা শুনে রাগিণী বেহদ সন্তোষিত ও পুলকিত হল। (তবে রাগিণী সেটা জানে না এটা আমার অলীক প্রশংসা ছিল-তাকে খুশি করবার নিমিত্তে)।


তা চোখে-মুখে হর্ষের দ্যুতি প্রস্ফুটন হল। তার গোলাপ রাঙা নরোম-মসৃণ ও কোমলীয় অধরযুগলে এক চিলতে স্মিতহাস্যের আভা ফুটে উঠলো। রাগিণীর এই স্মিতহাস্য আমার ক্রোধকে আরো দ্বিগুণ বর্ধিত করল। এদিকে আমি রাগিণীকে জিজ্ঞেসও করতে পারছি না যে-এটা কার কবিতা? কারণ-রাগিণী আবার সন্দেহ করাটা মোটেও পছন্দ করে না। এজন্য আমি মুখ ফুটে বলতেও সাহস পাচ্ছি না। কিন্তু হৃদয়ের ভেতরে ক্রোধের অনল দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে। বোধ হচ্ছে আজ এতোটা বছর পথ-পরিক্রমার পরও আমি আমার রাগিণীকে চিনতে পারি নি। তার মন বুঝতে পারি নি। আচ্ছা! আমার পরিবর্তে তার মনের মাঝে কাকে স্থান দিল? সে কথাটিও আবর্তমান আমাকে বিচলিত-উদ্বিগ্ন-বিহ্বল করে তুলেছে। আমার মন বলছে-কে সেই সৌভাগ্যবান কবি? যে আমার রাগিণীর মন করেছে চুরি! তাকে এক পলক দর্শনের ইচ্ছেটা ক্রমশই যেনো বেড়ে উঠেছে। মন যে কোনো কিছুতেই প্রবোধ মানে না। এরই মধ্যে নিজেকে স্থির করেছি যে, আর এক মুহূর্তের জন্যও রাগিণীর পাশে থাকব না। উঠে যাবো। তখনই রাগিণী এক গাল হাসি উপহার দিয়ে বলে উঠে -কবি! আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি তোমার বর্তমান মনের পরিস্থিতি। 


রাগিণী আমার মনের পরিস্থিতি কী উপলব্ধি করতে পেরেছে তা আর তাকে প্রশ্ন করি নি। তবে এমনই সময় স্মৃতির দর্পণে ভেসে ওঠে অতীতের স্মারক চিহ্ন। সেই রাগিণীকে দেখা যায়-যাকে আমি নিয়ে এসেছিলাম এক বিষাদময় আবদ্ধখানা হতে মুক্ত করে। যেখানে রাগিণী বহুকাল ধরে নিঃস্ব-অসহায়ের মতন জীবনযাপন করেছে। পুরনো সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়া মাত্রই নিজেকে আর সংযত করতে না পেরে অবশেষে রাগিণীকে বলি-রাগিণী! তোমার কি মনে পড়ে সেই দিনের কথা; সে সময়ের কথা! যেদিন আমি তোমার মত অন্য কোনো রাগিণী-মানবীর তালাশে উন্মাদের ন্যায় শহরের অলিগলি ঘুরছিলাম। কোনো একদিন, অকস্মাৎ নিজেরই অজ্ঞাতসারে আনোখা এক গলিতে প্রবেশ করেছিলাম। আর সেখানেই তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা অতঃপর পরিচয়-মোলাকাতের পর্ব। তুমি সেদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে খুব করে কান্না করছিলে। তোমার কান্নার প্রতিধ্বনি আমার কর্ণকুহরে অনিবার এসে বাদিত হচ্ছিল। আমি তোমার কান্না-ধ্বনি শুনেই দিশাহারা হয়ে এতো বড় গলির এদিক-ওদিক ঘুরছিলাম আর খোঁজ করছিলাম কোত্থেকে এতো হৃদয়বিদারক কান্নার শব্দ অনুরণিত হচ্ছে? 


সেদিন তো হাজারো লোকের আনাগোনা ছিল-লোকে লোকারণ্য ছিল সে গলি। তারা কি শুনতে পেয়েছিল তোমার কান্নার আওয়াজ? তা আমার অবিদিত। অতঃপর, হন্যে হয়ে অনেক খোঁজার পরে তোমার দেখা পেলাম। তুমি পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের এক কোণঘেঁষে বসে ছিলে। তোমার শরীর অনেক ধুলোবালিতে ভরপুর ছিল। তোমার দিকে তাকিয়েই যেনো আমার চোখে জল এসে গেল। আমি শত চেষ্টা করেও সেদিন আটকে রাখতে পারি নি চোখের জল। কেনো যেন তোমাকে সেখান হতে হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলাম কোনোরূপ প্রশ্ন ব্যতীতই। হয়ত তুমি কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারো নি। তোমার শরীওে লেগে থাকা ধুলোবালি আমার জামার আস্তিন দ্বারা পরিষ্কার করলাম। তোমার অশ্রুসিক্ত চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুকণা আলতো হাতে মুছে দিলাম। তোমার চোখের জল মুছতে গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরে কতোই না কেঁদেছি। কিন্তু কেনো কান্না করেছি তা আমি নিজেও জানি না। তবুও...


এরপর, তোমাকে মুক্ত করে আনলাম সেই আবদ্ধখানা হতে। তোমার এহেন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাওয়াতে সেদিন তুমি বলেছিলে-

“কারো কারো জীবনের ভালোবাসার ডায়েরির কিছু পাতা অলিখিতভাবেই থেকে যায়। নিঃস্ব পাতাগুলো অপেক্ষায় থাকে, কখন তার বুকে লেখা হবে সুখ-দুঃখের, আবেগের কিছু কথা। নিঃস্ব ডায়েরির পাতাগুলো দোষ দিয়ে যায় ভালোবাসার দু’টি মানুষকে-যারা ভালোবাসার কালি দিয়ে ডায়েরি লিখত। এখন তারা স্বার্থপরের মত ডায়েরির দিকেও তাকায় না। সেলফেই অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকে। উপরে কিছু ধূলোময়লা জমা হয়। আজ তা কেউ মুছে দেয় না। বড্ড রাগ হয় তাদের উপর। হয়তো ডায়েরি জানে না তার মালিকের মনে কষ্ট কতো। তবুও ডায়েরি দোষ দেয়। কেনো ভালোবাসার কথাগুলো আজ হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো? উত্তর খুঁজে বেড়ায় নিঃস্ব ডায়েরি। আজও অপেক্ষা করে নীল ডায়েরি-কেউ বা কি তাকে হাতে তুলে নিবে? হাতে নিয়ে শুরু করবে কিছু আবেগের হৃদয়-মাখা কথামালা। মনে মনে বলে আমার মত কোনো ডায়েরি যেন এরূপ নিঃস্ব না হয়। ভালোবাসার ফুলঝুরিতে ভরে উঠুক সবার নীল ডায়েরি”।


রাগিণীর এই কথাগুলোর মর্ম যদিওবা সেদিন উপলব্ধি করতে পারি নি তবে অবশ্য পরে ঠিকই বুঝেছি। একজন কতোটা অবজ্ঞা ও ক্লিষ্টের শিকার হলে এমন বেদনার্ত কথাগুলো বলতে পারে! রাগিণীর কথাগুলো শোনার পরপরই আমার ভেতরটা যেন দুমড়েমুচড়ে যায়। অতঃপর রাগিণীকে বললাম, আমি তোমার প্রেমে পড়েছি তবে মোহময় প্রেমে না। তোমার মাথায় হাত রেখে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমি কোনো পরিস্থিতিতেই তোমাকে ছেড়ে চলে যাব না। রাগিণী আমার মুখে “মোহময় প্রেম” বাক্যটা শুনে অনেকক্ষণ কি যে ভেবেছিল তারপর বললো-“মোহময়” বলতে তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছো? রাগিণীর এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আমি যেন আকাশ থেকে এই মুহূর্তে জমিনে পড়লাম। বোধ হচ্ছে আমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। 


যাক! আমি একটু ভেবে উত্তর দিলাম যে, মোহ শব্দটির সঙ্গে একটি নেতিবাচক অনুভূতি জড়িয়ে আছে। রাগিণী পুনরায় আক্রমণাত্মক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে- “নেতিবাচক অনুভূতি”? রাগিণী যেন এই প্রথম শুনছে এমন বাক্য-আমার তাই বোধ হচ্ছে তার প্রশ্নের ভঙ্গিমা দেখে। তবে আমি এই মুহূর্তে একটু দীর্ঘ নিশ্বাস নিলাম। এরপর বললাম-হ্যাঁ! মোহ মানেই ক্ষণস্থায়ী কিছু একটা ক্ষতিকর এবং অগভীর কিছু। রাগিণী পরক্ষণেই আমাকে বলে যে-অবশ্য সবসময় ব্যাপারটা নেতিবাচক না-ও হতে পারে। মোহ থেকেও জন্ম নিতে পারে গভীর ভালোবাসা, অতুল প্রেম। রাগিণীর এই কথায় সম্মতি জানালাম আর ভাবলাম ঠিকই তো আমি অযথা সবসময় নেগেটিভ চিন্তা করি। তবে রাগিনীর কাছে একটা স্বীকারোক্তি দিলাম যে-সেদিন তুমি আমাকে একটা বিষয় শিক্ষা দিয়েছো, যা আমি তোমায় বলি নি লজ্জার খাতিরে। 


আজ বলছি- ‘তুমি আমাকে সবসময়ই সব ব্যাপারে পজিটিভ ভাবতে শিখিয়েছো’। কিন্তু আমি তো হার মেনে নেওয়ার মত ছেলেই না মোটেও। তাই রাগিণীর কথা শেষ না হতেই বলতে আরম্ভ করলাম যে- “মোহ এটা দ্রুত কেটে যায়। এটাই মোহের বৈশিষ্ট্য। অবশ্য প্রেমেরও মৃত্যু ঘটে, অহরহই ঘটে তবে এতো দ্রুত না”। কথাটা আমি খুব দ্রুতই বলেছি রাগিণীকে। কারণ, কথা বলার সময় রাগিণীর ঠোঁটের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। রাগিণীর ঠোঁট জোড়া যেনো আর্দ্রতার পরশে সিক্ত। সেই আর্দ্রতাময় লাবণ্য কম্পমান ঠোঁট যেন আমাকে পাল্টা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত যে, প্রেমেরও দ্রুত মৃত্যু ঘটে? তাই রাগিণী যেন পাল্টা প্রশ্ন না করতে পারে সেজন্য প্রশ্নের আগেই উত্তর বলে দিয়েছি। কিন্তু আমার কল্পনাতেও জানা ছিল না যে-রাগিণী আমার চাতুরী বুঝে ফেলবে আর এতোটা জটিল কথার সম্মুখীন আমাকে হতে হবে। রাগিণী বললো-“মোহের অবসান কোনো ক্ষত রেখে যায় না হৃদয়ে, বরং মোহমুক্তি যেন বন্দিদশা থেকে মুক্তির আনন্দ দেয়। যেমনটি তুমি আজকে আমাকে বন্দিশালা থেকে মুক্ত করলে। কিন্তু প্রেমের মৃত্যু! সে তো দীর্ঘস্থায়ী, এমনকি কখনো কখনো চিরকালীন ক্ষত রেখে যায়”। আমি রাগিণীর এই কথার জবাব আজও দিতে সক্ষম হই নি। এতে আমি রাগিণীর কাছে পরাজিত হয়ে আছি। 


রাগিণীর কাছে তার জীবনের বিভীষিকাময় অধ্যায়গুলো পেশ করা মাত্রই দেখি তার হাস্যোজ্জ্বল, লাবণ্যময়ী চেহারা বিষণœময় ও কৃষ্ণাভে রূপান্তরিত হয়েছে। আমি অনুধ্যান করলাম, তার অতীত স্মৃতিগুলো এই মুহূর্তে বলা হয়ত আমার জন্য উচিৎ হয় নি। ভুল হয়েছে। তবে আমি তো তাকে কষ্ট দেয়ার নিমিত্তে বলি নি। আমি খুব অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়েছিলাম যে, সে কেনো আমার কবিতা ব্যতীরেকে আজকে এই মাহেন্দ্রক্ষণে অন্যের কবিতা আবৃত্তি করছে? রাগের বশিভূত হয়ে বলেছি। তবে যদি এ ব্যাপারে পূর্ব অবগত হতাম যে, সে খুব কান্না করবে। তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা মলিন হয়ে যাবে। তাহলে কখনোই বলতাম না। মূলতঃ রাগিণীর কান্না আমার বরদাস্ত হয় না। মেনে নিতে পারি না। কেনো যেনো তার কখনওবা যদি মন খারাপ দেখি আমার খুব কান্না আসে। সে যখন হাসি মুখে থাকে তখন রাগিণীকে দেখতে পরীর মতন দেখায়। যেনো একটি পিচ্চি মেয়ে। অবশ্য সে পরী-ই। তবে আমি এবার পড়লাম এক মহা বিপাকে। কী বলতে গিয়ে কি বলে ফেললাম? যদি এতে রাগিণী ক্রোধান্বিত হয় তাহলে তো এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার অন্ত থাকবে না। কারণ, এর আগেও ¯্রফে একবার নয় বহুবার সে আমার উপর রাগান্বিত হয়ে কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না। আমি তো রাগিণীর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। নাওয়া-খাওয়া, ঘুম সবকিছু ছেড়েই দিয়েছিলাম। 


কি বলব! এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে-আমি একসময় নিজেকে নিজেই চিনতে পারতাম না। মানুষগুলো কীভাবে যে আমাকে চিনত আল্লাহ মা’লুম। দীর্ঘ কয়েক বছর-বহু বছর পর আবারও রাগিণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল রাজশাহীতে। তখন সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের শিক্ষার্থী। ২০১২-১৩ সালের কথা। একদা এক বিকেলে রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরিতে হুমায়ুন আহমেদের বই পড়ছিলাম। সহসাই আমার দৃষ্টি ফিরে অন্যদিকে। এক মেয়েলি ঘ্রাণে। ঘ্রাণটা খুব চেনাজানা ও পরিচিত, যেন রাগিণীর শরীরে ঘ্রাণ। কারণ, রাগিণীর শরীরের গন্ধ আমার নাসিকায় আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে। তাই সেই গন্ধ নাসিকাকে স্পর্শ করা মাত্রই আমি বই পড়া ছেড়ে দিয়ে রাগিণীকে খুঁজতে লাগলাম। পুরো লাইব্রেরি তন্ন-তন্ন করে খুঁজছিলাম। আমার এমন কর্মকান্ডের জন্যে সেদিন লাইব্রেরিতে থাকা অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিল-এই যে! এভাবে উ™£ান্তের মত কি খুঁজছেন? আমি হয়ত আবেগের বশীভূত হয়ে নির্লজ্জের মত মুখ ফুটে বলেছিলাম-রাগিণীকে খুঁজি। জানি না তারা সেদিন আমাকে কীভাবে দেখেছিল কিংবা ভেবেছিল। অনেকে আবার অট্টহাসিও দিয়েছিল। কারণ, ওখানে মেয়েরাই বেশি ছিল। যাই হোক! অবশেষে খুঁজে পেলাম আমার রাগিণীকে। অশ্রুসজল চোখ নিয়ে কোনো কথা না বলেই তাকে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললাম-ভুল হয়ে গেছে আমার আর কখনও এমন হবে না। রাগিণীর এরূপ বিষণœ-মলিন চেহারা দেখে আমি তাকে ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে নিলাম। কারণ, মেয়েদেরকে বশে আনার এটাই একমাত্র মহৌষধ। তবে আমার ক্রোধ-ক্ষোভ, প্রশ্ন সবকিছুই ধূলোয় ধূসরিত হলো...


পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১

 



গ্রাম 

সোহেল রানা 


ছায়ার ভেতর দিয়ে উঠে আসছে মায়া! 

মায়ায় আঁচল হাওয়ায়, হলুদ গন্ধে

টুনটুনির টুনটুন ভারা দুপুর...ভরদুপুর! 

কুটুম পাখি ডেকে ডেকে আগাম অনুষঙ্গ জানান-

গৃহস্থবাড়ি! 


মাঝি পাল বেয়ে ফিরছে, গোধূলি গোধুম... 

চাঁদনিরাতে - কবিগান-পালাগানের আসার বসেছে

পিঠাপুলি সাজিয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকছে 

আমার মায়াভরা সেই চিরসবুজ কায়া!


এই ছায়া-মায়া-কায়া -

ধুলোমাটি, ঘাস, শিশির -

দোয়েলের শিস, ঘাসের বুকে ফড়িং নিবিড়!

খালে, বিলে, ঝিলে -

আমি মাছরাঙা মন, হড়াই নদীর হাঁটুজলে

উড়ছি উড়ছি বাঁকে বাঁকে -

মাছ মাছ মাছ মাছ। 

শারদ-সুন্দর কাশফুলের আকাশ! 

ডানা মেলেছে শাদা-শাদা বকের পাল! 

আর এখানে দক্ষিনা বাতাস।

আর যদিও তুমি গাছ 

এখানে তার অটুট বন্ধনে শিকড়।



ভিজে ফুল

বনশ্রী বড়ুয়া


এমনও মুষলধারা-

অকারণ বুকের পাঁজরে কথা বলে কেউ

নদীর সাপিনী শরীর থেকে উঠে আসে চপলা ঢেউ।


ভিজে উঠে শিরীষের বাঁকল

বিমর্ষ পাখির পালকে লেগে আছে জল

স্মৃতির গর্ভাঙ্কে ধূপগন্ধীর সুতীব্র ঘ্রাণ।


পৃথিবী ডুবে থাকে নীলাভ প্রেমে

জল গুনে নিভে যায় আগুন

সাদা মুখে লেপ্টে থাকে আরও একটি শঙ্খমালা।


গতরাতে জোনাকির আলো ফিরে আসে নি

তাই বিষন্ন ভোরের ঠোঁটে-

বৃষ্টি হয়ে এলে তুমিও শ্রাবণ।



মাটি

ছাদির হুসাইন 


আমি হলাম মাটির মানুষ

মাটি আমার ঘর,

মাটির কোলে সুখে-দুঃখে

আছি জনম ভর। 


মাটির প্রেমে পাগল আমি

মাটি আমার সব,

মাটির দ্বারা’ই এই পৃথিবী 

সৃষ্টি করেন রব। 


মাটির মাঝে ঘাঁটি আমার

মাটির মাঝে ঠাঁই,

মাটির পরশ পেয়েই আমি

মাটির গানই গাই। 


মাটি আমার জীবনযাপন 

মাটি’ই চলার রেশ,

মাটির বুকেই জীবন শুরু

মাটির বুকেই শেষ।




চোখ

সাব্বির হোসেন


মুক্তি চাই মুক্তি, 

দেবে- 

আমি বিষাক্ত অনলে জ্বলে যাওয়া

দুর্ভিক্ষের বিপ্লবী চোখ।



অভিমান

সোলায়মান জয়


জোছনার প্রতি হিংসা করে আকাশ দেখিনি

করিনি নিদানি কালের করুণ আর্তনাদ

তুমি আকাশ দেখাতে চেয়েছিলে বলে বলেছি-

এ গভীর বেদনার প্রতিষেধক তোমার নেই

তুমি কোন মহা যন্ত্রণার মায়াবিনী নও।


আজ গভীর বিষাদের আস্বাদে ডুবন্ত হৃদয়

প্রেমবৃক্ষ মরে গেছে ভালোবাসার অভাবে

এক ভোররাত্রির স্বপ্নের দেনায় ডুবে গেছি

অন্ধকারের আদরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি।


একবার যদি তোমার চোখে তাকাতে পারতাম

তাহলেই হয়ে যেত সকল অংকের সমাধান

মিলে যেত সকল ভগ্নাংশ, সরল রেখার সূত্র

দেখতে পেতাম ফলাফলে কার নাম বসা।


পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২



যদি সত্যটা বলতে না পারি

মুহাম্মদ ইমদাদ হোসেন


সত্য-ন্যায় নীতি আর আদর্শের কথা স্পষ্ট যদি বলতে না পারি, তবে কি

হবে এই জবানের মিষ্টি মধুর বচনে?

ইচ্ছে করে তাই আমার ঠোঁট দু’টি সেলাই করে নিতে সুঁই সুতোয়।

সত্যটাকে সাহস করে লিখতে যদি না পারি, তবে কি হবে কলমের

আঁচড়ে শব্দের গাঁথুনিতে ছন্দেও ঝংকারে কাগজের পাতা ভরিয়ে?

ইচ্ছে করে তাই আমার কলমটা তোলে রাখি বাক্সে আর ডাইরিটা সেল্ফে।

সত্যের সুচিন্তা আর ভালোর ভাবনাটা

যদি না থাকে মগজে, তবে কি হবে বিকশিত বুদ্ধির মহাচিন্তক, পাহাড় বা

সাগর সম জ্ঞানের মহাপ-িত হয়ে?

তাই আমার চিন্তাশক্তিটা বিলুপ্ত কিংবা মগজটা বিকৃত হলেও কোনো দুঃখ নেই।

ভালো আর আলোর প্রতি ভালোবাসা মন্দ আর আঁধারের প্রতি চরম ঘৃণা

যদি না থাকে হৃদয়ে, তবে কি হবে হৃদয়ের কোমলতা আর বিশালতায়?

তাই আমার হৃদয়টা যদি পাথর কিংবা সংকীর্ণ হয়ে যায় তবে কোনো কষ্ট নেই।

সত্যের পথে অন্যায়ের প্রতিবাদে লড়তে

যদি না পারি, তবে কি হবে বাহুবল বুদ্ধিবল কিংবা অর্থ শক্তির পাহাড় গড়ে?

তাই অর্থহীন পেশিশক্তি বিহীন নির্বোধ

থাকাটাই সবচে শ্রেয় মনে হয় আমার।

সত্য-ন্যায় নীতির পথে বুক ফুলিয়ে বীরদর্পে যদি চলতে না পারি, 

তবে কী হবে পায়ের জোড় বা সচলতায়?

তাই পা দু’টি যদি খোঁড়া কিংবা অচল হয়ে যায় তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই।

সত্য আর ভালোর আলোয় জীবনটা যদি রাঙাতে না পারি 

তবে সাহসহীন ভীতু হয়ে অন্যায় অবিচার নীরবে সহ্য করে 

বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু কামনাই উত্তম নয় কি?



ফিরতে দেরি হলে

জীবন রাজবংশী 

   

আমার ফিরতে দেরি হলে-

তুমি আর অপেক্ষা করবে না 

তুমি ভেঙে পড়বে না, কারণ-

সেই সময়টুকুও তোমাকে দেওয়া হয় নি। 

বরং আবার হাটতে শুরু করবে সময়ের সাথে, সময়ের পথে। 

মানুষ এক লক্ষ্যে হাটতে শুরু করলে, 

সব ব্যথা বেদনা ভুলে যায়।

জীবনের হিসেব মিলাতে গিয়ে। 

জীবন ভাঙা গড়ার খেলা মাত্র, থেমে থাকার জন্য নয়। 


আমি না আসলেও আবার সূর্য উঠবে

আবার ফুল ফুটবে

আবার পূর্ণিমায় চাঁদের আলোয় ঝলমল করবে আধার রাত। 

আমি যেমন ঘুম ভেঙে দেখি নতুন আলো, 

তুমিও দেখবে নতুন প্রভাত। 

আমার ফিরতে যদি দেরি হয়.... 



প্রথম মৃত্যুর আগে

রহিম উদ্দিন 


তালাবদ্ধ স্মৃতির আলমারি জুড়ে- থরে থরে সাজানো জীবন

প্রথম মৃত্যুর আগের, আরো অগণিত মৃত্যুর দৃশ্য

দেহ ছেড়ে পালানো অসংখ্য আত্মার আর্তনাদ

বিরহ, বিচ্ছেদ! বিরহ বিচ্ছেদ!

অথচ প্রিয় কোনো বিচ্ছেদ নেই

আচ্ছা, প্রেমিকের মৃত্যু বিরহ না বিচ্ছেদ?

অথবা প্রেমিকার ছেড়ে যাওয়া?

জহুরি, তুমি সাগর সেচে মুক্তো খুঁজো,

কেবল জানো না, 

কয়লার অনলে সোনা খাঁটি হয় না,

গলে যায়- বরফের মতন

গলতে গলতে আমিও এখন বরফ-গলা নদী।



আয়নার ঝালর 

অক্ষয় কুমার বৈদ্য


সুতো জুড়ে গেঁথে আয়নার ঝালর 

দোল দেয় হাওয়া, সৌখিন সাজে ঘর 

খেয়াল করিনি চোখে তুমি লেগে আছ

আলগোছে ঝুলছে ঝুলন্ত রঙিন ঝালর

রঙটুকু মনের গহীনে শীত ফিরে গেলে 

সুতো খুলে খুলে পড়ে পাতা ফুল 

সাজ ঘর একা, একা একা দোল দেয় হাওয়া..  


ডোরবেল

ডোরবেল

 


ডোরবেল

রোমেনা আফরোজ


লিয়া বারান্দায় বসে আছে। তার চারপাশে ঠাঁসা বুনোনের ঘন অন্ধকার। আজ কোথাও কোন শব্দ নেই। বাতাস নেই। এ কারণেই বুঝি তার কান্নার মৃদু শব্দও বোধগম্য হয়ে উঠে। কান্নার নিজস্ব একটা ভাষা আছে। কেবল অনুভূতিসম্পন্ন মানুষরাই এই ভাষা বুঝতে সক্ষম।


-লিয়া, তুমি কি তোমার সিদ্ধান্তে অটল?

- অতীতে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো এ কথা সত্যি। সেই কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেও পারিনি। কিন্তু আজ আমি সন্দেহমুক্ত।

-তবে কাঁদছ কেন? তোমার কান্নাই বলে দিচ্ছে তুমি অটল কিংবা স্থির নও। 

-হয়তো তাই। কিন্তু তাতে আমার সিদ্ধান্তের কোনও পরিবর্তন হবে না।

-তুমি আরেকবার ভেবে দেখো।

-প্রভু, এখানে ভাবার কিছু নেই। আপনি তো সবই জানেন। এও জানেন আমার কোন বসন্ত নেই।

-সত্যিই কি বসন্ত নেই? এই যে তুমি মনেপ্রাণে তোমার প্রভুকে স্মরণ করছো, তোমার অন্তরে উজ্জ্বল আলোর আভাস, একাকীত্বকে বশীভূত করে তোমার হৃদয়জুড়ে শিশুরা বিচরণ করছে এগুলো কি বসন্তের ফুলগুলোর চেয়েও সুবাসিত নয়?

-সে তো আপনারই করুণা। কিন্তু আঠারো বছরকে ভুলতে পারার মতো শক্তিশালী আমি নই।

-এই ভুলতে না পারা তোমার দুর্বলতা নয় লিয়া। অতীত মানুষের জীবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে অতীত শুধু ছায়াসঙ্গী। তুমি যদি অতীতকে বর্তমানের পথে দেয়াল তৈরি করতে দাও তবে বর্তমান ধসে পড়বে।

-আমি জানি, এই চার দেয়াল, একাকীত্ব আমার দুর্বলতারই সাক্ষ্য বহন করছে। হয়তো এজন্য আমিই দায়ী। কিন্তু বারো বছর আগে আমাকে যে দু দু’বার ভ্রুণ হত্যা করতে হয়েছিল এবং আজকের এই মাতৃত্বহীনতা এর দায় কি শুধুই আমার? এই দায় থেকে আমার স্বামীও মুক্তি পেতে পারে না...

-লিয়া, একজন নারী হিসেবে তুমি তোমার মধ্যকার অপার শক্তিকে জাগাতে পারোনি।  এর দায় কেবল তোমার। অন্য কারো নয়। কণ্ঠের দৃঢ়তা টের পেয়ে ঘাবড়ে যায় লিয়া। বিশাল দীর্ঘশ্বাস অবমুক্ত করে অতীতের ভুলগুলো নতুন করে ভাবতে থাকে। একসময় স্বীকার করে, উর্বরতার দিনগুলোতে সে যদি আর একটু কৌশলী হতো তবে হয়তো আজ নিরবতার পরিবর্তে সন্তানদের কোলাহলে চারদিক মুখরিত হত। তবে এও ঠিক, স্বামীর মদ্যশালায় ডুবে থাকার বিষয়টি তার মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করেছিলো। সেজন্য নতুন প্রাণের কথা ভাবতে পারেনি। তখন প্রচ- ভয় পেতো। যখন প্রভু একটু একটু  করে পরম মমতায় দখল করে নিচ্ছিলো তার আত্মা এবং শরীর, সে সময় প্রথমবারের মত তার মধ্যে মাতৃত্ব জেগে উঠে। এরপর অনেক চেষ্টা করেছিল। প্রথমদিকে ডাক্তাররা আশাও দিয়েছিল। সেই আশা আর স্বপ্নের দিনগুলো ছিল সত্যিই সুন্দর। কিন্তু গতকাল তার ডাক্তার জানিয়েছে সে আর কখনোই মা হতে পারবে না। 


-লিয়া আর একবার ভেবে বল, তুমি কি সত্যিই তোমার স্বামীর মৃত্যু কামনা কর? তুমি চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারো।

-না প্রভু, আমি ক্ষমা করতে পারি না। স্ত্রী হিসেবে ক্ষমা করতে পারলেও একজন মা হিসেবে আমি ক্ষমাহীন। বিয়ের পর থেকে দেখছি মানুষটা প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম করে পানশালায় যায়। আড্ডায় সে এতই অভ্যন্ত যে মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার পথটাও ভুলে যায়। আমাদের বিবাহবার্ষিকী, আত্মীয়-স্বজনের বিয়ে কিংবা অন্য কোন অনুষ্ঠানে আমি নিতান্ত একা ছিলাম। একাকীত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে অনেকদিন ধরে নিরবতাই আমার সঙ্গী। এখন স্বামীর আগমন, চলাফেরা, তার কথাবার্তা আমাকে রক্তাক্ত করে। তারপর ডোরবেল... কথাটি বলে মৃদু হেসে ওঠে লিয়া। নিজেকে উপহাস করার এ ভঙ্গিমা তার নতুন নয়।


-যে ডোরবেলের জন্য আমি এতো বছর অপেক্ষা করছি সেই শব্দে এখন বিভীষিকা জাগে। মনে হয় তার আগমনে গৃহের ভেতর একজন পাপাত্মার প্রবেশ ঘটেছে, যে কিনা নিজ হাতে আমার প্রাণপ্রিয় সঙ্গী নীরবতাকে খুন করতে চায়। এই মৃত্যুকে আমি কোনমতেই মেনে নিতে পারি না প্রভু। 


চারপাশে এতো ঘন অন্ধকার যে লিয়াকে দেখা যায় না। তবে কণ্ঠস্বরে বেশ বোঝা যায় তার চোখে, মুখে অসহ্য যন্ত্রণার ছাপ। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। কোন কথা নেই। অনেকক্ষণ নিরব থেকে পুনরায় নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে চলে, প্রভু আমার এই অশ্রুপাত তাকে হারানো কিংবা অনুশোচনার জন্য নয়। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অনেকটা সময় আমি অপচয় করে ফেলেছি। সে কারণেই এই কান্না।   


এমন সময় একদল কুকুর কাছাকাছি কোথাও ডেকে উঠে। ডাক শুনে লিয়া উত্তেজিত হয়। সে উন্মাদের মতো ছুটতে থাকে বিশাল বারান্দায়। একসময় স্থির হয়। একবার গ্রিলের বাইরে উঁকি মেরে কী যেন দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। অনেকক্ষণ ধরে ইলেক্ট্রিসিটিও নেই। কিছু দেখতে না পেয়ে লিয়া মৃদু স্বরে ডাকে, প্রভু। আপনি কি আছেন? অপর প্রান্ত থেকে কোন উত্তর না পেয়ে সে পুনরায় অস্থির হয়ে উঠে। বিমর্ষ। হতাশার সুর তুলে বলে, প্রভু আপনিও কি সবার মতো প্রিয় বৎসকে পরিত্যাগ করলেন? ঐ যে কুকুরগুলো এগিয়ে আসছে। এখনি ডোরবেল বেজে উঠবে। একজন মাতালের প্রলাপবাক্য থেকে আমাকে রক্ষা করুন প্রভু।


হঠাৎ কোন কারণে লিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রথমে সে বুঝতে ব্যর্থ হয় কোথায় আছে।  কিছু সময় অতিবাহিত হলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে তার অবস্থান। প্রতিদিন স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে সোফার ওপর। আধোঘুমের পর তার খুব এলোমেলো লাগে। মাঝে মধ্যে দুঃস্বপ্নও দেখে। তখন সদর দরজার উপর প্রচ- রাগ হয়। মনে হয় খ- খ- করে খুলে ফেলে দরজা।   


প্রতিদিনের এই দাসত্ব থেকে সে মুক্তি চায়। চিরকালীন মুক্তি।


রাত প্রায় দুটো বাজে। সে বোধহয় আধঘন্টার মতো ঘুমিয়েছে। এতোক্ষণে তার মনে পড়ে একটু আগের স্বপ্নের কথা, যেখানে প্রভু তার সাথে কথা বলছিলেন। সেই স্বপ্নের রেশ এখন তার মন জুড়ে বিস্তৃত হয়। শরীরে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। এমন সময় অনেকগুলো কুকুর পানশালার কাছাকাছি কোথাও ডেকে উঠে। সম্ভবত এই ডাকের জন্যই তার ঘুম ভেঙেছে। সে জানে আর মাত্র কয়েক  মুহূর্ত। তারপর ডোরবেলের তীক্ষè ধ্বনি কেড়ে নেবে তার শান্তি। জ্বলে উঠবে বাতি। উফ! বাতিগুলোকে তার অসহ্য লাগে। গ্রহে প্রবেশের পর মাতাল মানুষটি সারাদিনের সব কথাবার্তা উগড়ে দিতে চায় কিন্তু ঐ সব অপলাপের চেয়ে তার কাছে ঘুম খুব প্রিয়।   


লিয়া সোফায় উঠে বসে। নিজেকে প্রস্তুত করে দরজা খোলার জন্য।


আজ কুকুরগুলো বিরামহীন ডেকে যাচ্ছে। কী এক অশুভ ইঙ্গিতে তারা বুঝি মধ্যরাতের নীরবতা ছিঁড়ে ফেলতে চায়! সাধারণত ওরা এমনভাবে ডাকে না। অনেক রাতে কোন লোকজন দেখলে এক কি দু’বার ডেকে উঠে। একসময় থেমেও যায়। নতুবা কলোনীর দারোয়ান ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় ওদের। আজ দাড়োয়ানদের কোন খবর নেই। মধ্যরাতের পর ওরাও কোন কোনদিন ঘুমিয়ে যায়। একমাত্র তাকেই জেগে থাকতে হয়। সারাবছর। ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, শীত কোন ঋতুতেই তার ছুটি নেই।


আজ কুকুরগুলো থামছে না। সেই কখন থেকে একটানা করুণ সুরে বিলাপ করে তার কান এবং হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে। এতোক্ষণে ডোরবেলও বেজে উঠার কথা। প্রতি রাতে অদৃশ্য বুলেটের মতো যে ডোরবেলের শব্দ তাকে আহত করে সেই ডোরবেল আজ বেজে উঠছে না। কিন্তু কেন? স্বামীর আসার সময় ক্রমেই পার হয়ে যাচ্ছে। সে কয়েকবার ঘড়ির দিকে তাকায়। তার কান উৎকীর্ণ হয়ে আছে। কিন্ত ডোরবেল মধ্যরাতের মত নিশ্চুপ। শুধু দূর থেকে কিছু মুক্ত বাতাস এসে তার কানে কী যেন বলে যায় ফিস ফিস করে!