গুম
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
গুম
আহাদ আদনান
আলো যখন বাড়ে বাড়তেই থাকে। দিন যখন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, প্রদোষের হাতছানিতে তলানিতে ঠেকে দৈনন্দিন সূর্যটার জ্বালানি, তখনো যদি আলো বাড়তেই থাকে তাহলে ধন্দে পড়ে যেতে হয়। এমন হয় কখনো সখনো। গরুর দল ঘরে ফিরতে যেয়ে দেখে আলো উপচে পড়ছেই আর পড়ছেই। হলুদ আলো নয়, লাল আলো নয়, এমনকি জীবনানন্দের কমলা রঙের রোদও নয়, এ রোদ বর্ণনাতীত। এ রোদ রংতুলি হাতে সুলতানকেও করে দেয় হতবুদ্ধি।
অনেকদিন পর, ঠিক কতদিন জানা নেই, চোখে এমন আলো পড়তেই ভয়ে জড় হতে থাকে অরুণ। সে ভাবেনি কোনোদিন আর সূর্য নক্ষত্রটার চেহারা দেখতে পাবে। নক্ষত্র বিষয়ক কিছু মিথ শুনে শুনে সে বড় হয়েছে। আলোকবর্ষ নামের জটিল কিছু গাণিতিক হিসেব কষে কষে কেটেছে তার দিন। যদিও নক্ষত্রের চেয়ে প্রিয় ছিল উপগ্রহ। চাঁদটা তার কাছে শুধুমাত্র একটা ঘূর্ণায়মান উপগ্রহই ছিল না, ছিল বেঁচে থাকার অবলম্বন।
আলোটা আরও বাড়ছে। বেগুনি একটা আভা ছিল এতক্ষণ। সেটাও কেটে যাচ্ছে। এখন এর একটা রঙ বোঝা যাচ্ছে। কমলা রঙের রোদ। রোদের রঙটা বুঝতেই অরুণের কাঁধে ভর করে জীবন বাবু। একটি মেয়েকে সে চিরদিন ভালোবেসেছিল, অথচ মেয়েটা তার মুখ কোনোদিন দেখেনি। সে মেয়েটা পৃথিবীতে এসেছে কি? এতদিনে জন্ম নেওয়ার কথা। তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
রোদটা আরেকটু মাথাচাড়া দিতেই অরুণ ভয় পেয়ে যায়। দিন কি আসলেই শেষ হচ্ছে, না-কি শুরু হচ্ছে? সূর্যটা ডুবতে গিয়ে আবার উঠছে কি? পশ্চিম দিক থেকে উঠছে? এখন কি কেয়ামত হচ্ছে? পৃথিবীটার আর দেরি নেই বুঝি? অথচ সবাই কত স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কালো গাড়িটা ট্রাকটাকে ওভারটেক করে উঠে গেল মহাসড়কে। ছোট মেয়েটা মায়ের হাত ধরে হাঁটছে শপিং মলে। লুঙ্গি পরা খাটোমত একটা লোক বিড়ি টেনে ভুকভুক করে ধোঁয়া ছেড়ে গেল। অরুণ খুব টান দিয়ে শ্বাস নিল। কোন গন্ধ তার নাকে ঢুকছে না। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সে কি এখনো বেঁচে আছে?
আরও কিছুক্ষণ পার হয়ে গেছে। সূর্যটা এখন মাথার উপর। অরুণ নিশ্চিত, কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। চিৎকার করে কথাটা সে সবাইকে বলতে থাকে। কেউ শুনতে পায় না তার আহ্বান। তার শব্দের কোনো প্রতিধ্বনি হয় না। সে ছুটতে থাকে দিগি¦দিক। কারও গায়ে ধাক্কাও লাগে না। চুম্বকের উত্তর মেরু হয়ে ছুটে চলা অরুণ নিজেকে আবিষ্কার করে আরও অৎস্র উত্তর মেরুর জনসমুদ্রে। প্রবল বিকর্ষণে সে সরে যেতে থাকে সবার কাছ থেকে।
অরুণ বুঝতে পারে তার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। যদিও শরীর বলছে অন্যকিছু। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। না হলে সে বুঝতে পারত তার ব্যথাগুলো চলে গেছে। কালশিটে পড়া উরুর মাংসগুলো দৃঢ় হচ্ছে। বাহুতে ভর করছে দানবিক শক্তি। টেকো মাথাটার জ্বলজ্বলে ময়দান ক্রমশ ঢাকা পড়ছে। শম্বুকের মত শুরু করা সময়টা যতই পার হচ্ছে, সে ‘ফিরে পাচ্ছে’ চিতার গতি। ফিরে পাওয়া ব্যাপারটা অবশ্য তার জানা নেই। গতকালটাও এখন পূর্বজন্মের মত। অচেনা, অজানা, অনুভবের বাইরে। সবাই কি জাতিস্মর হয়?
সূর্যটা আরেকটু পূবে যেতেই অরুণ পরিবর্তনটা টের পায়। বিশাল একটা দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে সে থমকে দাঁড়ায়। এ কে? সদ্য যুবক ছেলেটা কি সে নিজে? ওকে চিনে অরুণ। তখন পৃথিবীতে কোনো চাপ ছিল না। দায়িত্ব, প্রেম, সংসার ছিল না। রাজনীতি ছিল না, শত্রুতা ছিল না। পুলিশ, গ্রেফতার, রিমান্ড ছিল না। গুম ছিল না। এগুলো তার পার হয়ে আসা অতীত। এগুলো দেখেছে সে। রিমান্ডে দাঁত ভেঙে যাওয়া, মলদ্বারে উষ্ণ ডিমের অস্তিত্ব, মরিচ-জ্বলে শিশ্ন-স্নান, অন্তকোষে বিদ্যুতের ঝলকানি সব মনে পড়ে তার। মনে পড়তেই লুঙিটা খুলে ফেলে সে। এতক্ষণ লুঙ্গি ছিল গায়ে, এটাই তার মনে ছিল না। নগ্ন অরুণ শক্ত হাতে খাবলে ধরে অন্তকোষ। কঠিন তালুতে ঘষে নেয় উন্নত দৃঢ় শিশ্ন। যৌবনের প্রথম প্রহরে ভাবনার কেয়ামতটা উপভোগ করে তারিয়ে তারিয়ে।
রোদটা মিহি হয়ে এসেছে। উলঙ্গ অরুণের কোনো লজ্জা করছে না। গ্রামের দিকে পুকুরে আরও কয়েকটা আদুল ছোকরার সাথে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুরের জলে। আহা, কতদিন পর এই উদ্দাম সাঁতার। পুকুরটা আর শেষ হয় না। তার শক্তিও আর ফুরায় না। সব ছেলেকে পেছনে ফেলে সে দেখে কখন যেন পুকুরটা নদী হয়ে গেছে। কিংবা সমুদ্র, মহাসমুদ্র। এতকিছু ভাবতে বয়ে গেছে তার। এটা ভাবনার বয়স না। এই সময় শুধুই উদযাপনের।
এই লালচে আভাকেই কি সুবহে সাদিক বলে? জল থেকে উঠে অরুণ হাঁটছে মখমলের গালিচায়। এটা মাটি, না মায়ের কোল? ঘুম পাচ্ছে অরুণের। একটু শুয়ে পড়লে কেমন হয়? কে যেন বলছে, ওঠ অরুণ ওঠ। এখন ঘুমুতে নেই। ওঠ। বেলা হয়ে যাচ্ছে। এখন ঘুমুলে আর উঠতে পারবি না। কে বলছে এসব? মা? বাবা? অন্য কেও? কণ্ঠটা পুরুষ না মহিলা? কিছুই মাথায় আসছে না। মাথায় ঢোকানোর চেষ্টাও করছে না অরুণ।
এখন অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। পৃথিবীতে কোনো ঘড়ি কাজ করছে না। সময়, সূর্য, নক্ষত্র, নক্ষত্র বিষয়ক মিথ কিছুর অস্তিত্ব নেই এখন। তন্দ্রা, স্বপ্ন, কল্পনা, কুহক, পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা মিলে মিশে একাকার এখানে। ব্যথাটা ফিরে এসেছে আবার। ফেটে যাওয়া খুলিটা থেকে কিছু মগজ বের হয়ে এসেছে। ঝোপের মত একটা কিছুতে পড়ে আছে অরুণ। হাতটা কাজ করলে, ধরতে পারলে সে বুঝতে পারত শিশ্ন, অন্তকোষ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শরীরটা এখন শুধুই থ্যাঁতলানো মাংসপি-। দৃষ্টি ফিকে হয়ে আসছে। শ্রবণশক্তি ভোঁতা হয়ে আসছে। এক দুই তোলা মস্তিষ্কের কোষ কাজ করছে বোধহয়। এই অন্ধকারে আলো দেখছে ওরা। আলোর একটা ধর্ম আছে। যখন বাড়ে বাড়তেই থাকে। এই নিয়ম এখন চলছে না কেন?
‘ওই, অর্ডার আসছে। আর খোঁচাইতে হবে না। গুলি কর। মাথা, মুখ ঝাঁঝরা কইরা দে। দেখলে যাতে চেনা না যায়। তারপর নদীতে ভাসাইয়া দিবি। গুম কইরা দে’।
সূর্যটা এবার সত্যি উঠে গেছে। পূর্ব দিক থেকেই উঠেছে। কেয়ামতের দেরি আছে তাহলে। আলো ছড়াচ্ছে। ছড়াতেই থাকে। এটাই আলোর ধর্ম।
ঝকঝকে আলোতে নদীর জলে খুলিবিহীন নগ্ন একটা লাশ ভাসতে থাকে।
মাতুয়াইল, ঢাকা।
মুখোশ
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
মুখোশ
রায়হান আজিজ
”হ্যালো, আব্বা ! আমি স্টেশনো আয়া ফরসি”, শাহীনের কণ্ঠে উত্তেজনা ।
দুপুর বারোটা নাগাদ মানিকখালী স্টেশনে এসে পৌঁছেছে শাহীন। সে ময়মনসিংহ শহর থেকে এসেছে বাবার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে। বাবার সাঙ্গপাঙ্গরা আগেই স্টেশনে উপস্থিত ছিল। বাবা লুতফর মিয়া এবার বুরুদিয়া ইউনিয়নের মেম্বার প্রার্থী, পুরু গোঁফ, দাপুটে চেহারা, মেজাজও তিরিক্ষি।
শাহীনও স্বভাবে একটু উগ্র, আর দেখতেও ষ-ামর্ক চেহারার। ট্রেন থেকে নেমে অদূরে মসূয়া বাজারে বসে সিগারেট ধরাল সে। এ সময় সে দেখল, কিছু ছোকরা তার বাবার প্রতিদ্বন্দ্বী আলাউদ্দিনের পোস্টার লাগাচ্ছে। সে তাদের ধমকে ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিল।
বিকেলে আলাউদ্দিনের বাড়িতে বৈঠক বসল। মধ্যমণি বাবরি চুলওয়ালা আলাউদ্দিন ।
”লুতফইরা আর অর ফুতেরে একটা শিক্কা দেওন লাগব। এত বড় সাহস, আমার ফুশটার ছিরে। কী কইন আমনেরা’’?
বৈঠকে উপস্থিত সবাই এ ব্যাপারে একমত হল।
পেয়ার মুন্সী বলল, “ঠিহই কইসুইন” ।
”ওই কাজইল্যা, ব্যাকতের লেগা চা লয়া আয় ”। আলাউদ্দিন হুকুম করলেন তার বিশ্বস্ত চ্যালা কাজল কে। এই কাজলকে একটু বেশিই বিশ্বাস করেন লুৎফর । মেম্বারের সাথে থেকে কাজলও মোটামুটি ভালই পয়সা করেছে ।
আলাউদ্দিনের বৈঠকের খবর লুতফরের কানেও পৌঁছায়। শাহীন বলল, “আলাওদ্দি যেইতা কইতাসে, থানা ফুলিশই করন লাগব আব্বা”।
লুৎফর বললেন, ”আমরা কুনু মারামারিত যায়াম না” ।
রবিবার সকালে ধানক্ষেতে কাজ করতে যায় আমিন, শামীম, কাওসার ও আরও কয়েকজন ।
শামীমই প্রথম দেখে লাশটা- “কাওসার বাই, দেহুইন চাই, এইডা আলোদ্দী মেম্বর না ?”
পুলিশ ঘেরাও করে লুতফরের বাড়ি । ”ফুলিশ বাই, আমরা কিচ্চু জানিনা, আমরা এইতা করতাম ক্যারে”? বলল লুৎফর ।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? আটক হয় লুতফর ও শাহীন ।
অন্যদিকে মুচকি হাসে কাজল। আজ রাতে ওর ভালই ঘুম হবে ।
করিমুল্লারবাগ, পোস্ট- ফরিদাবাদ, থানা- শ্যামপুর, ঢাকা-১২০৪ ।
পদাবলি : ০১
হলাহল
সা’দ সাইফ
মনকে তো আমি বেঁধে রাখতে পারি না
সে তার মতই ভাবছে,
চ-ালের মত জীবন।
অচ্ছুৎ;
মন খারাপের দিনে এক আকাশসম দুঃখ আমাকে স্ফীত পীড়া দিয়ে যায়।
ডুকরে ডুকরে ব্যথা উগলে উঠছে।
চলমান পা-ও ধাবমান মড়ক।
কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে নির্নিমেষ,
চোখ খুলতেই কোণে এক ছটাক বৃষ্টি।
হয়ত পিঁজরাপোলের কেউ,
গ্রীবায় টান দিয়ে কেউ কেন নিয়ে যায় আস্তাবলে!
জোলো স্মৃতি মস্তকে গেঁথে থাকে,
আবার ধর্তব্যে না রাখার পণও ব্যর্থ।
ছ্যাঁত করে ওঠা মন,
ব্যথা দিয়ে যাওয়া লাগাতার ঢাল ঠেকাতে অপারগ,
অদৃশ্য শরে বিদ্ধ একটি মন-মন্দির।
আর আমি?
আর আমি সেই মন-মন্দিরের সমানুপাতিক সমার্থক।
ব্যাগ্রাউন্ড
নূরে জান্নাত
তোমার উঠানের শ্যাওলা জানে
কতোবার সেখানে স্লিপ কেটে
পড়েছিল বয়ঃসন্ধির সেই মুখ
যে মুখে তুমি নীল মেঘ সাদা বৃষ্টি
ঘিয়ে সংসার আর লাল রঙের
ঘুম এঁকেছিলে।
ধূলোমাখা পথের উঁচু নিচু কাঠামো
লজ্জাস্থানের মতো লুকিয়ে রাখে
সাইকেলের পেছনে তার স্কুল যাওয়ার স্মৃতি!
আমি জানি.. ভুট্টা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে থাকা কাকতাড়–য়ার যেমন অতীত থাকে
তেমন অতিত ছিল তোমার
ছিলো আমারও অধর্ষিত ডালিমের চারা!
তবুও ভুলবসে আমরা জলের ক্যানভাসে জীবনে ডিঙ্গি ভাসিয়ে
ফিরে যায়;
তুমি যাও ফাইভে পড়া ডাঙ্গর পেঁপে গাছটার কাছে
আমি যায় দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দেওয়া বুক শ্মশানে
পড়ে থাকা ছাঁইয়ের কাছে!
যখন আমাদের শোদ ফিরে আসে
রেশমের কৌটা খুলে মাতি ভালোবাসাবাসিতে
চোখের মলাট উলটে পড়ে নিই
যা হবার, যা হয়েছে, যা হয়ে যাক
তবুও আমাদের দু ডালের পাখি হবার সাধ্য নেই!
শূন্যতা থেকে যায়
মজনু মিয়া
কত জল জলের উপর এসে আচড়ে পড়ে
কত বালি,ধূলা স্তরে স্তরে উপরে সাজায়,
আকাশের গায়ে মেঘ জমে,
পথের পরে পড়ে পায়ের পদাঘাত,
তব্ওু শূন্যতা থেকে যায় জনম জনম!
একদিন ভালোবাসা ছিলো ভাবতে অশ্রু ঝরে
বেদনারা হৃদমাঝারে কুঠারাঘাত করে,
তবুও যার জন্য ক্ষত সে পূরণ করে না!
গর্ত করে মাটি সরিয়ে নিলে যে গর্ত হয়
তাতে পূরণ করার চেষ্টা সেই মাটিতে বৃথা
এখানে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা পূরণ হয় না।
মানুষের ভেতরে ক্ষত বা শূন্যতার সৃষ্টি হয়
আর তা অপূরনীয় রয়ে যায়!
জনম মোহ
নাসিমা হক মুক্তা
নক্ষত্রের গায়ে আধুলি মাখে
কিছু অভিমানের জল তৃষা
মনের চৌকাঠে ডুবুরি হয়ে মেদুর মৌতাত
গলা উচু করে আকাক্সক্ষার যাত্রী- পোষাকে
ভোগ-পথ্য নিষ্প্রাণের মত দীর্ঘতম অপেক্ষায়
ডাগর- ডাগর চোখে কাক- কাক করে
গাছ থেকে ডগার সারস!
ফেরার পথে পা আটকে ধরে
এক টুকরো- জনম মোহ
যার পর্দায় প্রেমহীন সোনা মাছি নেশার উজ্জ্বলে
টুকরো টুকরো বরফ গুলানো মুখে
নিভৃতে- জীবন ছাইপাঁশ, জীবন ছাইপাঁশ বলে
চাষ করে অতৃপ্তির চিবুক
পরচুলা সুখ লুটোপুটি খায়
অমানিশার অন্ধকারে
প্রেমহীন সংসার মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণা।
ফিলিস্তিন
মুহিব্বুল্লাহ ফুয়াদ
তোমার বুকে বোমা নিক্ষেপ হলে, আমি ছিন্নভিন্ন হই
তোমার কোলের কোনো শিশু স্তব্ধ হয়ে গেলে, আমার হৃদয় হাহাকার করে ওঠে
তোমার বোবা চিৎকারে, আমি ভেঙে পড়ি
তোমার উদরে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা দেয়াল ধ্বংস হলে,
আমি নিঃশেষ হয়ে যাই
কারণ,
তুমি’ই আমি- আমি’ই তুমি
তুমি আমাতেই মিশে আছো প্রিয় ফিলিস্তিন।
পদাবলি : ০২
লক্ষ যোজন দূরে...
ফজলুর রহমান
নির্জনে তোমাকে পাবো এমন বিশ্বাসেই কোলাহলে তোমাকে খুঁজি না আর। জলের ভিতর আলোর রেখা মিলিয়ে যাওয়ার আগে মীন সন্তানদের কানকোয় যে চঞ্চলতা ফুটে উঠে তেমন আকুলতা কী তুমি আমার মাঝে দেখ না? আঁশটে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ার আগে শিকারী কীভাবে বুঝে ফেলে মীনের গতি! এই যে বৈধব্য বেশ, আমিষ ছেড়ে দিয়ে নিরামিষ এ আসক্ত Ñ এই উপবাস কিংবা যৌবনকে কাঁচের বয়মে পুরে তোমার পায়ে বর্তে দেওয়াÑ এসবের বিনিময়ে বেহেশতে কী প্রগাঢ় প্রেম, চির তরুণ জীবন দেবে না আমায়? একটা তন্দ্রা টুটে যাওয়া ভোর, পুবাকাশে ঘোড়ার খুরের ছায়ার মতো মেঘ, সারারাত জেগে থাকা বেশ্যার ঘুঙুর ও তার করুণ মুখে, শারাবে নিমজ্জিত গালিবের চোখে তুমি কী দেখা দাও না? ভাসো না মেঘের শায়রে? ফেনায়িত ঢেউয়ে? তোমাকে কী পাওয়া যায় না ঝিনুকের শব্দে, বায়স্কোপের Ñ ‘কী চমৎকার দেখা গেল’ ছবিতে? ম্লান সাঁঝের আযানে, মন্দিরের ঘণ্টায়, গির্জার সুউচ্চ মিনারে? তোমাকে পাবো বলেই মোমবাতি হই। পুড়ে পুড়ে শেষ হই তবুও লালনের মতো ‘লক্ষ যোজন দূরত্ব’ ঘোচে না।
আমি যদি পাখি হতাম
বশির আহমেদ
সাঁঝের আলো অধরে মেখে কুলায় ফিরে যায়
সন্ধ্যা পাখি,
ইস আমি যদি পাখি হতাম।
ভোরের শিশির আমার স্বপ্নীল ঠিকানা
নতুন বইয়ের মলাটে খুঁজে পাই হেমন্তের ঘ্রাণ।
মানুষকে ভালোবেসে কাছে যেতে চাই যতটুকু আছি তার চেয়েও বেশি।
সদা প্রস্তুত মৃত্যুর পয়গাম সালাতে কামনা করি মার্জনা।
প্রলম্বিত জীবন হিসেবের খাতায় দোটানা তবুও
অন্তরে বপন করি সবুজ নীতি।
তুমি যা কর
মাজরুল ইসলাম
যখনই ভোট উৎসব আসে, তখনই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে
উচ্চকণ্ঠে বেদগান শোনাতে
সুরের ত্রুটি কর না।
নানা উপায়ে তুমি গোপন কথা, গোপন রেখে
অনায়াসে কাজের তালিকা পেশ কর।
নজর আলি, রবি রুইদাস উৎসবের মুখে খুব অন্তরঙ্গ
আর কাজ চাইলে
কাজের পরিবর্তে হাতকড়া পরাও।
তোমাকে মিথ্যাতেই বেশি মানায়।
রাস্তায় পড়ে থাকলে
দেখতে আসা তো দূরের কথা
খবর নেবার সময়টুকু পাও না।
তার পরেও- তুমি’ই এখন আবার
প্রধান পদে উন্নীত।
তুমি যা কর
তা যে কতটা সত্যি, সে কথা তুমিও জানো বোধহয়!
একটি নির্জন আবর্জনা
ইয়াকুব শাহরিয়ার
আলো, বাতাস, রাস্তা-নদী
সব আছে, আছে ‘আন্তাজি’ ব্যস্ততা
জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার লাগামহীন দৌঁড়,
কাঠটুকরার মত টুকরে খাওয়া নষ্ট সমাজ,
সব আছে। এসব থেকে যেতে যেতে চলে যাবে-
পরের প্রজন্মে, খোলা খামে।
এক গ্লাস নেশা ধরা বৃষ্টি
পৃথিবীর মলাটের উপর পড়ে থাকবে প্রবল ঘৃণায়
কুকুর, শুয়োর, শেয়ালেরা হয়তো লজ্জিত হবে একদিন
মিথ্যার বেসাতি দেখে। রূপান্তরের মানুষগুলো
তবু বেলাজ হয়ে বসে থাকবে নিজস্বতার আশায়।
আহ! ছিঃ, লজ্জা, ঘৃণা
একটি নির্জন আবর্জনার গল্প
রচিত হতে থাকবে তথাকথিত মানুষের হাতে
প্রকৃত মানুষেরা হারাতে থাকবে কালের আবর্তে,
মহাকাল অতি আদরে লুকাবে তাদের, যারা-
স্বপ্ন বুনে সুন্দর সমাজের, অথচ তাদের মাড়িয়ে
গড়ে উঠবে আবর্জনার স্তুপ।
শব্দমালা
শব্দমালা
দেলোয়ার হোসাইন
খেয়াল
আমি ছেড়ে দিয়েছি উন্মুক্ত ঝড়ের মাঠ
তোমরা প্রসব করে যাও বঞ্চিত বেদনা,
আমি বর্গাচাষ করে জমিয়েছি জলের বৈভব
তোমরা ম্লান ঘরে কাপড় বদলে এসো...!
টার্গেট
আমরা যারা প্রতিনিয়ত ‘টার্গেট’ হই
তাকে আমরা সর্বদা মৃত্যু বলে মানি।
আপনারা এক সের দুধ বললেও, আমরা
আধা সের দুধ আর আধা সের পানি বলে জানি!
অনুগ্রহ
তপ্ত সময়, দীর্ঘ ব্যবধান। মাথার
উপর অনিশ্চিত এক পাহাড়!
আমি তো ঘুমের রেফারি, বাঁশি
হাতে ছুটছি অলৌকিক চূড়ায়...
লাশের যাপনচিত্র
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
লাশের যাপনচিত্র
মো. আরিফুল হাসান
হেমন্তলোক থেকে যাপনলোকে সে সহজেই পৌঁছুয়। তারপর আবার পেছন ফিরে চায়। ফেলে আসা পথে তার মায়া লেগে থাকে। পথের রোশনাই তার চোখে-মুখে ঝিকিমিকি করে। সে স্তব্ধ হয়ে ক্ষাণিক্ষণ দাঁড়ায়। তারপর আবার পথ চলতে থাকে। না, থামলে চলবে না। এ যাত্রা তার দূরপরবর্তী যাত্রা। এ যাত্রা তার চোখের বাঁধন।
যেতে যেতে সে কতকিছু তুলে নিতে চায়। কতকিছুতে হাত লাগায়, ছুঁয়ে দেয়। আবার হাত সরিয়েও নেয়। না, এ যাত্রা তার কোনকিছু নেবার নয়। এ যাত্রা তার দেবারও নয়। মন কাঁদে, কত অভাব অভিযোগ দেখে তার চোখ ভিজে আসে। সে নীরবে চোখ মুছে। পথের দূরত্ব তাকে দুঃখবোধের বেদনা হতে নিষ্কৃতি দেয়। সে আবারও পথ চলে। পথ চলতে থাকে এঁকেবেকে তার সাথে।
গ্রামের পরেই মাঠ। সেখান থেকে আরেকটু এগুলে জলা। সেখানে শীত থাকে। আর তার ওপাড়ে আছে বসন্ত। আপাতত মাঠের এই যাপনচিত্রটাকে সে অতিক্রম করে। দুপুরের রোদ তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে যায়। এক পশলা সবুজ বাতাস তাকে দোল দিয়ে আবার কোথায় মিলিয়ে যায়! সব মিলে সুন্দর এক যাত্রাপথে তার কেবল গ্রামের কথা ভাসে।
গ্রামে কে আছে তার? মেয়েটির নাম লুৎফা। বড় অভাবী পরিবারের মেয়ে। কোনো রকমে খেয়ে পড়ে মানুষ। শিক্ষা কি জিনিস সে জানে না। ফলে ভালোবাসার কোনো ছকে বাঁধা সংজ্ঞা তার জানা নেই। তবে যেটুকু আছে, সেটুকু হৃদয় নিংড়ানো উজার করা প্রেম। সেখানে খামখেয়ালি থাকতে পারে, তবে তাতে প্রতারণা নেই। সেখানে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তবে তাতে কপটতা নেই। এ কথাটি জানা। তবু তাকে ফেলে যেতে হয় অনিবার্য কারণে। আর এই ছেড়ে যাওয়া পথটিই দীর্ঘতর হয়ে যায় বিস্তীর্ণ বিষাদের মতো। যে চিত্রটি যাপনের, তখন তা শুধু একটি লাশের শবযাত্রার অনুকূল।
এখান থেকে পেছনে ফিরলে সে লুৎফাকে হয়তো পেতে পারে। আবার নাও পেতে পারে সে। লুৎফা হতে পারে গ্রামের অশিক্ষিত মেয়ে, লুৎফা হতে পারে রূপচর্চার প্রসাধনহীন সাধারণ সুন্দর। কিন্তু তার মনের ভেতর যে ঐশ্বর্য, সেখানে পরাজিত না হয়ে পারা যায় না। আপনি ডুবে যায় তরী। কূল-তীর হারা গহীন গহনে ডুবতে ডুবতে তল পায় না শেষমেশ। তাই লুৎফাকে নিয়ে যত সহজভাবে ভাবার অবকাশ আছে, আছে ততটাই জটিলতা তাকে না পাবার। গ্রামের মন, একবার যদি না করে দেয় তাকে আর হ্যাঁ বলানোর সাধ্য আছে কার? সুতরাং দ্বিধায় পথ দ্বিধাবিভক্ত হতে থাকে।
পথ ফুরোলো না। রথ ফুরোলো না। দুপুরের সূর্যটা আগের মতোই চলতে থাকে। মাথার উপর ছায়া ফেলে ফেলে চলতে থাকে একটুকরো মেঘ। মেঘটিকে লুৎফা মনে হয়। না হলে এই হেমন্তের নভে, যাপনের মাঠে আসার সঙ্গ কি সে এমনি এমনি দিচ্ছে। মেঘটিকে মনে হয় জ্বরেরঘোরে লুৎফার হাতের জলপট্টি। আর রোদটাকে মনে হয় লুৎফার উষ্ণ আলিঙ্গন।
পথ অনেক দূরে। এভাবে চলতে চলতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে একসময়। এই তো, অদূরেই তো জলাশয়। কিন্তু অদূরে নয়। যেতে যেতে পথের হিসেব যখন ধূলিকণা হয়, তখন এক কদমেও কয়েকশো প্রয়াস থাকে। বিশেষ করে মন যখন দ্বিধার চলক, তখন তো মন বলে চলো না, দ্বিধা বিভক্ত পাগুলো সরে যায় সামনে অথবা পিছে, বিপরিত গোলার্ধের অন্তরালে। তবু পথ যেতে হবে। এ পথ যে বিশাল। সবে মাত্র যাপনলোকের প্রস্তর শুরু হয়েছে। তারপর আছে মিহিদানার প্রান্তর।
এখানে মিহিদানার প্রান্তরে মানুষ শষ্য চাষ করে। এখনও চাষের কার্যক্রম চলছে। তবে হেমন্তচিত্রটি এখন আর মাঠে নেই। মাঠের হেমন্তের ফসল এখন কৃষকের ঘরে ঘরে জ্বলন্ত আগুনে সুস্বাধু হচ্ছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। অথবা তারা মহাজনের গদিতে জমা হচ্ছে আগত কোনো দুর্ভিক্ষের জন্য। কিংবা এমনিতেই জমা করছে মহাজনা। হয়তো বদমতলব আছে। হয়তো তারা দাম বাড়লে চড়া দামে বিক্রি করবে সেসব। তবে মাঠে যে হেমন্ত শষ্যের কোনো চিহ্ন নেই এ বিষয়টি নিশ্চিত। দুটো হাল দেয়া শুকনো খরখরে মাটিগুলো যুবতীর প্রতিক্ষিত জরায়ুর মতো উন্মুখ হয়ে আছে নতুন বীজ গ্রহণ করতে।
ক্ষেতের আলপথ ঘাসে ঢাকা। ঘাসের চাদরে পথ আটকে যায় পায়ে পায়ে। আলের দু পাশের জমিগুলোতে জৈষ্ঠ্যে যে ধান বুনা হয় তা হেমন্তে আসে। বর্ষার দিনে এ ধানগাছগুলো জলে ডুবে বেঁচে থাকে। জল সাঁতরে ভেসে থাকে। জল ফড়িঙেরা ধান গাছের পাতায় পাতায় উড়ে বেড়ায়। ইঁদুরেরা বাসা বানায় এসে ধানক্ষেতে। কৃষক জাল পাতে ধান গাছ ফাঁক করে। মেনি, টেংরা পুটি শিং, কখনো কখনো গজারটাও লেগে থাকে জালে। জাল তুলে এনে কৃষকেরা মাছ দেখিয়ে নতুন বৌয়ের হাসিমুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করে। বধুয়ারা মাছ কুটতে বসে যায়। কৃষকেরা জল খাবার খেয়ে আবার ছুটে ক্ষেতে। মাঠের ইঁদুর তাড়াতে হবে। না হলে আমন ধান রক্ষা করা কঠিন।
আমন ধানের চারাগুলো জলের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। কখনো কখনো দশ ফুট বারো ফুট পর্যন্ত হয়ে যায়। জল চলে গেলে ধানগাছগুলো বিছিয়ে পড়ে থাকে মাটিতে। কিছু দিনের মধ্যেই মোচার মতো শীষ আসে সারামাঠ হেসে। ধানের স্বপ্নে কৃষকের ঘুম চলে যায়। মোচা থেকে ধানফুল ফুটটে থাকে। ফুলগুলো দুধ হয়ে ধানের ভেতরে ঠাঁই নেই। তারপর পাকা ধানের সুবাসে কার্তিক অগ্রহায়ণ হেসে উঠে গোলায় গোলায়। নবান্ন উৎসবে মেতে উঠে চিরায়ত গ্রামবাংলা।
হেমন্ত উৎসব শেষ। এখন একটি যাপনের ভেতর দিয়ে শীতের ভেতর প্রত্যক্ষণ করা ছাড়া আর গতি নেই। কিন্তু ফিরে যাবারও কোনো জো নেই পেছনের দিকে। যদিও পেছন থেকে লুৎফার হাতছানি। যদিও পেছন থেকে নবান্নের প্রাণের উৎসব, কিন্তু কোনো উপায় নেই। যাপন পথের নিজের ভেরতটাকে দুচালকে রেখে জীবনের কাটা ঘোরানো সম্ভব নয়। এমনি অবশ্যম্ভাবী যাত্রায় যদি মন কাঁদে তবু সে ফিরে আসতে পারে না।
এ লোকটা শেষ হলেই শীতলোক। সেখানে লুৎফার বুনা সুয়েটারের মতো উষ্ণতা দরকার হয়। শীত নিবারণের জন্য চাই এক মালশা আগুন। যা লুৎফা রান্নার পর যতœ করে তুলে রাখে রাতের হীমের বিপরিতে। আরও দরকার হয় পান করার জন্য উষ্ণ পানিয়। যা কেবল লুৎফার কমলার কোয়ার মতো দু ঠোঁটেই পাওয়া যায়। এতকিছু ছেড়েও সে হেমন্তলোক থেকে যাপনলোকে এসে পৌঁছে। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে আসতে হয়। আসতে বাধ্য করা হয়। লুৎফা যে গরিব ঘরের মেয়ে। কোনো ধনকুবেরের চোখে সে যদি পড়ে তবে আর তাকে তার প্রেমিক কখনো ফিরে পায় কি? লুৎফার বাবা বিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু লুৎফা মন থেকে ভালোবাসাকে মুছে ফেলতে পারে না। প্রস্তাব করে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। শেষদিন, সে পায়ে পড়ে কাঁদে। এই বিরহের চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ জানায়। কিন্তু লুৎফাকে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে লুৎফাও অভিমান করে বিয়েতে রাজি হয়। জানা আছে, আবার যদি সে লুৎফার হাত ধরে, যদি বলে নিতে এসেছি, তাহলে লুৎফা বিবাহবাসর থেকে উঠে চলে আসবে। কিন্তু এ কথা বলতে সায় দেয় না মন। মনে হয়, বড় ঘরে লুৎফা নিশ্চয়ই সুখেই থাকবে।
পথ চলতে চলতে একদিন পথ ফুরায়। যাপন লোকের শেষ সীমানার কাছাকাছি এসে একটি সাপ মুখোমুখি হয় তার। সামনেই জলা। ভেবেছিলো জল থেকে কোনো ঢোঁড়া সাপ হয়তো উঠে এসেছে। কিন্তু ফণা তুলতেই দেখা গেলো তার মস্তকে বিষচক্রের ত্রিশূল। সাপটি ডানে বাঁয়ে দুলতে লাগলো বিপদজনক ভাবে। সামনের দিকে ঝুঁকে ছোবল মারতে থাকলো হিসহিস করতে করতে।
সাপটিকে হয়তো এড়ানো যেতো। কিংবা আঘাতে আঘাতে সাপটিকে হত্যা করা যেতো। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হলো যে সাপটিকে সে পোষ মানাতে চায়। ঠিক একই রকম মনে হয়েছিলো লুৎফাকে যখন প্রথম দেখেছে সে। লুৎফাও পোষ মেনেছে। বুকের গহীণে লুকিয়ে রয়েছে দুরন্ত সর্পিণী। কিন্তু কখনো তাকে ছোবল মারেনি। একবার মনে হলো, লুৎফা তো মানুষ, রক্তমাংসের গড়া আমারই মতো মানুষ, মানুষকে আদর করে বুকে রাখা যায়। তা বলে সত্যিকারের সাপকে কি পোষ মানানো উচিত? সমস্ত প্রশ্ন এবং দ্বিধার দেয়াল ভেদ করে সে আরেকটু এগিয়ে যায় সাপটির দিকে। কোনোকিছু চিন্তা না করে খপ করে ধরে ফেলে সাপটির ফনা। ফনাবদ্ধ সাপটি তার হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে যায়। বাঁ হাতে প্যাঁচ খুলে সে সাপটিকে ছেড়ে দেয় জামার ভেতরে নিজের বুকের মধ্যে। সমান্তরাল দুটো বিষবিন্দু হৃদপি-ের কাছাকাছি মৃত্যুঘুম ছড়াতে থাকে। ঠিক তখনই বিবাহের আসরে বিষপান করে আত্মহত্যা করে লুৎফা।
কুমিল্লা, বাংলাদেশ