গল্পটি শুনতে চেয়ো না
সোহেল নওরোজ
(গত সংখ্যার পর)
কিছুই করার না থাকার সময়ে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। হাফিজুল হক নিজের জীবনে অনেকবার এ সত্যের মুখোমুখি হয়েছেন। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোকেও এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি করাবেন এটা পূর্বানুমিত ছিল। তাদেরকে কঠিন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। জীবনকে জানতে হবে। জীবনের দুই পিঠ। এক পিঠে তীব্র আলোর রোশনাই। অপর পিঠে গাঢ় অন্ধকার। যে কোনো এক পিঠে দীর্ঘদিন বসবাস করতে থাকা মানুষদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অনুভূতি হয়ে পড়ে ভোঁতা। সেখান থেকে তাই বের হয়ে আসার পথও খুঁজতে হয় দ্রুত। নাহিদ ও অনিকেত যখন বেঁচে থাকার সব চেষ্টা করে যাচ্ছে তখনই এগিয়ে আসে অনিকেতের স্বল্প পরিচিত এক কাকী। কবিতা তার নাম। হাফিজুল হকের হাতের ছবিটি কবিতার।
অনিকেত চরিত্রটিকে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘঁষামাজা করতে হয়েছে। হাফিজুল হক চেয়েছিলেন আবেগকে পাত্তা দিবেন না। নির্মোহ থেকে লিখবেন। অনিকেতের ক্ষেত্রে তিনি তা পারেননি বলেই অর্পার ধারণা।
‘অনিকেতের প্রতি তোমার মমতা ছিল, একটা দায় ছিল। একজন লেখক হয়েও সে দায়কে তুমি অগ্রাহ্য করতে পারনি।’
‘দেখ মা, নাহিদের প্রতি আলো ফেলতে গিয়ে অনিকেতের প্রতি সত্যিই আমি অবিচার করিনি। করলে সে আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। হয়তো কোথাও গিয়ে নাহিদকেও থামিয়ে দিতে হতো। আমি তা চাইনি।’
‘এমন একজন অনিকেতকে তুমি কখনো কোথাও দেখেছ?’
‘কত জনই তো আছে অনিকেতের মতো। যারা নিজেদেরকে ভাঙতে-গড়তে পছন্দ করে। অদ্ভুত খেলা করে। এই ভাঙা-গড়ায় কখনো কেউ জড়িয়ে গেলে তার জন্য কিছু করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।’
‘অনিকেত এরপর আর কখনোই তোমার লেখায় আসবে না বাবা?’
হাফিজুল হক জবাব দেন না। ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির রেখা নিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। সে হাসির অর্থ হতে পারে, তুইও কি অনিকেতের প্রতি মমতা অনুভব করছিস!’ অর্পা তার বাবার এ হাসি খুব পছন্দ করে। সে মুগ্ধ হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবাকে তখন উপন্যাসের চরিত্রের চেয়েও বেশি রহস্যময় মনে হয়।
একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল বলেই সবিতার কাছে আশ্রয় চেয়েছিল অনিকেত। নিজের জন্য না, নাহিদের জন্য। তার ভবিষ্যত কারো হাতে নেই। সে নিজেও নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। নিজের কথা সে ভাবেওনি। তার ভাবনা ছিল নাহিদের জন্য। অনিশ্চিত এ পরিস্থিতির জন্য অনিকেত ছাড়া আর কেউ দায়ী নয়। জীবনের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়ে দিয়ে স্বার্থপরের মতো সে সরে পড়তে পারে না। নাহিদের একটা গতি করার জন্য সে কম চেষ্টা করেনি! কাছের অনেকের কাছে গিয়েছে। সবাই ফিরিয়ে দিয়েছে। তার কথা বিশ্বাস করেনি কেউ। আস্থার জায়গাটা নড়বড়ে তা অনিকেতও জানত। তাই সম্ভাব্য সব জায়গায় চেষ্টা করেছে। শেষমেশ এখানে এসে ঠাঁয় মিলেছে।
কবিতারা শহরে থাকে। তার একটা গানের স্কুলে আছে। সেখানে গানের ব্যাকরণ শেখায়। একবার একটা অনুষ্ঠানে অনিকেতদের গ্রামে গিয়েছিল। সেখান থেকেই পরিচয়। শহরের গল্প শোনায়। এ জীবনে তাকে অল্প কিছু মানুষই তাকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। কাকী তাদের একজন। আরেকজন অবশ্যই অনিকেত। প্রথম পরিচয়েই এত ঘনিষ্ঠ হয়েছিল যে সে কবিতাকে কাকী ডেকেছিল। কবিতারা বড় হৃদয়ের মানুষ হয়। সমগ্র পৃথিবীটাই তাদের ঘর। তার স্বামী বড় চাকরি করত। মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার ছোটখাটো সংসার। নানা কাজে একটা ছেলের অভাব প্রায়ই অনুভূত হয়। তিনি চেয়েছিলেন অনিকেত ও নাহিদ দুজনই তাদের সঙ্গে থাকুক। দুদিন না পেরোতেই নাহিদকে রেখে অনিকেত চলে যায়। বালিশের তলে ফেলে রাখা চিঠিটা পড়ে নাহিদ প্রায়ই কাঁদে। অনিকেত হয়তো দূর থেকেও তা দেখতে পায়। তখন কি খুব আনন্দ হয় তার?
অনিকেতে লিখেছিল, ‘জীবনকে দেখার তীব্র নেশা আমার। তবে আমি জানি এর পরিণতি ভালো হবে না। কোথাও গিয়ে ঠিকই তীব্র হোঁচট খাব। তখন আর উঠে দাঁড়াতে পারব কিনা জানি না। যেদিন থেকে তোকে আমি সঙ্গী বনিয়েছি, খারাপ অভ্যাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি; সেদিন থেকে ভেতরে তীব্র অস্বস্তি অনুভব করেছি। আমার কারণে তোকে অপরাধী হতে দেখে একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। সেদিন যদি শুধু আমার শাস্তি হতো তবে কখনোই তোকে নিয়ে এতিমখানা থেকে এভাবে পালাতাম না। আমিও তোকে ভীষণ মিস করব। কিন্তু আমার সরে যাওয়াটাই ভালো হবে জেনেই চলে যাচ্ছি। জানি তুই এখানে ভালো থাকবি। কাকী খুব ভালো রে! এই দুঃসময়ে তিনি এগিয়ে না এলে আমাদের কী হতো ভাবতে পারছিস! কাকীকে ভুলেও কষ্ট দিবি না। যদি পারিস, তোর জীবনকে কঠিন আর এলোমেলো করার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিস। আবার যদি কখনো দেখা হয় তোকে সফল মানুষ হিসেবেই দেকতে চাইব। ভালো থাকিস।’
চিঠিটা সে কবিতা কাকীকেও দেখিয়েছিল। তিনি কেবল একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। তার চোখে বিষাদের রেখা ফুটে উঠেছিল। স্বল্প পরিচিত কারো জন্য এই মায়ার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। সেদিন খুব বিস্মিত হয়েছিল নাহিদ।
নাহিদকে দ্রুতই পছন্দ করতে শুরু করে কবিতা। এটা ভালো লক্ষণ। নাহিদের স্বাভাবিক হওয়ার জন্য এটা খুব প্রয়োজন। তার সামনে অবারিত দুয়ার খোলা। ভালো না মন্দÑ কোনটা দিয়ে যাবে তা নির্ধারণ করার জন্য এমন একটা আশ্রয়ের ভূমিকা অনেক। নাহিদ ভাগ্যবান বলেই তা পেয়েছিল।
(.....ক্রমশ)