প্রেম ভয় বিরহ
প্রেম ভয় বিরহ
যাকারিয়া মুহাম্মদ
হঠাৎ একদিন আমরা দুজন আবিষ্কার করি, আমরা পরস্পর বন্ধু। সেদিন আমি আর মৌনতা সকালের মকতব থেকে ফিরছি, বাড়িতে প্রবেশের আগে রাস্তা থেকে বাড়িতে হইচইয়ের শব্দ শুনে দৌড়ে ঘরে এসে দেখি, বড়মামা মামীকে গালিগালাজ করছেন। তিনি ছাড়া ঘরের কেউ কোনো কথা বলছে না। নানী রান্নাঘরে মুখ গোমড়া করে বসে আছেন, আমি তাঁর কাছে গেলাম, তিনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি আর মৌনতা দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কী ঘটছে আমরা একবিন্দুও বুঝতে পারলাম না। একবার শুনলাম, মামা বরাবরের মতো বড় আওয়াজে বলছেন, ‘হৃদয়কে বাড়িতে পাঠিয়ে দাও, ক’দিন পর ও-ও মৌনতাকে নিয়ে পালাবে’। এ কথা শোনতেই আমার দিকে তাকাল মৌনতা। আমি তখনো কিছু বুঝতে পারছি না।
পরিস্থিতি শান্ত হলে আস্তে আস্তে বুঝতে পারি, রাতে ছোটখালা বড়মামীর ভাই সুহেল মামার সাথে পালিয়েছেন। ছোটমামী সকালে ছোটখালার রুমে গিয়ে একটা কাগজ দেখেন, সেখানে লেখা ছিল- ‘আমি সুহেলের সাথে যাচ্ছি।’ তারপর শুরু হয় এই চেঁচামিচি।
২.
সেদিন আমি আর মৌনতা ইশকুলে গেলাম না, কেউ যেতে বললও না। আমি পেছনের পুকুরঘাটে গিয়ে বসে রইলাম। মাথায় একটা কথাই কেবল বারবার ঘুরছিল, ‘ক’দিন পর ও-ও মৌনতাকে নিয়ে পালাবে।’
দুপুরে আম্মা এলেন। আমরা; ছোটদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে তারা সবাই মিলে এক রুমে বসে কী সব কথা বললেন। আমি আবার ঘাটে গিয়ে বসে রইলাম। মাঝেমধ্যে ঘর থেকে চেঁচানোর আওয়াজ আসছিল। আমি ঘাটে বসে রইলাম, আমার মাথায় সেই একটা কথাই কেবল ঘুরঘুর করছে।
রাতে আম্মাকে আমি মামার বলা কথাটা বলে দিতেই আবার হইচই শুরু হয়ে গেল। আম্মা জোরে জোরে আওয়াজ করে মামাকে কীসব বলছিলেন আর এই কথাটা- ‘আমার ছেলেকে আর তোমাদের এখানে পড়াব না’- বারবার বলছিলেন। আমি দেখলাম, আম্মার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। আমার মনে হল, কথাটা বলা আমার ঠিক হয়নি।
৩.
ছোটখালা তখন কলেজে পড়তেন এবং সুহেল মামাও এখানে থেকে কলেজে পড়তেন। সবাই বলত, তারা খুব ভালো বন্ধু- একসাথে কলেজে যেতেন এবং একসাথে ফিরতেন। মামা-মামাীর বিয়ের পর থেকে সুহেল মামা এখানে, ইশকুল এখানেই শেষ করেছেন।
পরদিন আম্মা বাড়ি চলে গেলেন কিন্তু আমাকে নিলেন না। আমি আর মৌনতা ইশকুলে যেতে-আসতে লাগলাম। আমরা তখন ফাইভে পড়ি। একদিন আমরা ইশকুল থেকে ফিরছি, রাস্তায় রুবেল নামের একজন, যে বড় ক্লাসে পড়ত, সে আমাকে বলল: ‘কী রে হৃদয়! সুহেল আর লামিয়ার মতো তোরাও তো দেখা যায় একসাথে ইশকুলে যাস-আসিস, ভালোই খাতির! বন্ধু বন্ধু লাগে, দেখিস কদিন পর ভাগিয়ে-টাগিয়ে নিয়ে যাস না আবার।’
ভাগিয়ে নেওয়ার কথাটা শোনে বড়োমামার বলা সেই কথাটা আমার মনে পড়ল। কিন্তু বেশি কিছু বুঝতে পারলাম না। তবে আমি আর মৌনতা একে অপরের বন্ধু, এতটুকু বুঝতে পারলাম।
৪.
আমি আর মৌনতা প্রত্যেকে নিজেকে অপরের থেকে ভালো বন্ধু প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। আমরা নিজেদের মনের সব কথা পরস্পরকে বলি, কোনো কিছু লুকোই না, কারণ আমরা শোনেছি— বন্ধু সম্পর্কে কোনোকিছু গোপন থাকা উচিৎ না। বন্ধুত্ব নিয়ে যখনই যার থেকে যা শুনতাম, তা-ই আমরা আমাদের বন্ধুত্বে কার্যকর করতাম।
সময় বরাবরের মতো এগুতে লাগল। আমরা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন। আমি একটু একটু করে অনুভব করতে লাগলাম, আমি মৌনতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। আর মৌনতাও যে দুর্বল হচ্ছে আমার প্রতি, সেটাও বোঝার বাকি রইল না আমার। তবুও আমি নিজেকে বেধে রাখলাম। যখনই কিছু করার কথা ভাবি, মামার সেই কথাটা আমার মনে পড়ে যায়।
সময় তখনও বয়ে চলছে নদীর জলের মতো। মৌনতা এখন আমার স্বপ্নে এসে হানা দেওয়া শুরু করেছে। আমরা এসএসসিতে ওঠলাম। আমার আর নিজেকে সংবরণ করা সম্ভব হল না। এক শুক্রবারে আমি আর মৌনতা ঘাটে বসে আছি, সাহস করে একসময় আমি মৌনতাকে কৌশলে বলতে শুরু করলাম। অনেকটা এভাবে-
: প্রেম জিনিসটা কী অদ্ভুত। তাই না মৌনতা?
: কেমন অদ্ভুত?
: এই যেমন ধর, আমরা বন্ধু। এবং আমরা আজন্ম বন্ধুত্বের পবিত্রতা অক্ষুণœ রেখে আসছি। আমরা চাই না আমাদের নিয়ে মামার শঙ্কা বাস্তবের রূপ নিক। তবুও দেখ, মন সে কথা বুঝতে চায় না। আসলে আমি নিজের অজান্তে তোকে ভালোবেসে ফেলেছি, মৌনতা।
আমি আরও কিছু বলতে যাব, মৌনতা আমাকে থামিয়ে অবাক করে দিয়ে বলল: চাইলে আমরা প্রেম করতে পারি। আমরা শুধু ভালোবাসব কিন্তু পরস্পরকে নিজের করে চাইব না। আব্বার শঙ্কা ছিল, আমি তোর সাথে পালিয়ে যাব। প্রেম করায় কোনো শঙ্কা ছিল না। চল, আমরা প্রেম করি, ভালোবাসি। শুধু ভালোবাসব, আব্বার শঙ্কাকে বাস্তব হতে দেব না কখনো।
এমন জবাবে যারপরনাই বিস্মিত ও খুশি হলাম।
৫.
আমাদের প্রেমজীবন শুরু হল। আমাদের ভিতরে কী চলছে, তা কাউকে বুঝতে দিলাম না আমরা। পাশাপাশি রুমে থেকেও আমরা মেসেজে কথা বলতাম। ইশকুলে যাওয়া-আসার পথেই কেবল আমাদের মৌখিক প্রেমালাপ চলত। পাছে কেউ সন্দেহ করে এই ভয়ে বাড়ি আমরা সরাসরি মেলামেশা, কথাবার্তা কমিয়ে আনলাম। আর আমাদের এসব সতর্কতা কাজেও লাগল, কেউই বুঝতে পারল না আমাদের ভেতরকার প্রণয়ের কথা।
এসএসসি শেষে লম্বা বন্ধ হল, আমি বাড়ি গেলাম। মেসেজে আমাদের কথাবার্তা হতো দৈনিক। তখন বন্ধ প্রায় শেষের দিকে, হঠাৎ একদিন মৌনতা আমার মেসেজের কোনো উত্তর দিল না। একদিন দুইদিন করে দিন যেতে লাগল কিন্তু কোনো উত্তর নেই। সারাদিন আমি একটা উত্তরের অপেক্ষায় মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকতাম। কোনো উত্তর আসত না। একদিন আম্মাকে মামাবাড়িতে কিছু ঘটেছে কি-না জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন: কিছু তো হয়নি তবে মৌনতার বিয়ে নিয়ে কথা চলছে।
ইশকুল খোলার দুদিন আগে আমি নানাবাড়ি চলে এলাম। এসে জানলাম, মৌনতার বিয়ের দিনতারিখও ঠিক হয়ে গেছে। জানুয়ারির ১৭ তারিখ, আর বেশিদিন বাকি নেই। মৌনতা আমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে দেখে আমিও আর তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম না। দুদিন পর দুপুরবেলা আমি পুকুরঘাটে বসে ছিলাম, হঠাৎ মৌনতা এসে পাশে বসল। আমি কোনো কথা বললাম না। মৌনতা বলল-
: ‘চল, আমরা পালিয়ে যাই।’
: ‘কেন? আমাদের তো পালিয়ে যাওয়ার কোনো কথা ছিল না।’ কথাটা আমি পুরোপুরি অপ্রস্তুতভাবে বলে ফেললাম। মামার বলা সেই কথাটা আমার মনে পড়ে গেল।
: ‘তুই কি ভালোবাসিস না আমাকে? বাসলে, চল পালিয়ে যাই।’
: ‘আমাদের শুধু ভালোবাসার কথা ছিল, পালানোর না। আমি আজন্ম তোকে ভালোবাসব।’
মৌনতা ওঠে চলে গেল। এ রকম কথা বলা আমার উচিৎ হল কি-না আমি বুঝতে পারলাম না।
৬.
আজ মৌনতার বিয়ে। আমি পাথরের মতো অনুভূতিহীন হয়ে সবকিছু দেখছি। তখন সকাল সাড়ে ন’টা। উঠোনে একটা গাড়ি এসে থামল। আমি বারান্দায় ছিলাম। ঘর থেকেও অনেকে বেরিয়ে এসেছে কে এসেছে দেখার জন্য। সবাইকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে গাড়ি থেকে নেমে এলেন ছোটখালা ও সুহেল মামা। তাদের সাথে ফুটফটে একটা ছেলে। নানী খালাকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেম। তারপর শুরু হল কান্নাকাটি এবং তারপর এতদিন কেমন কেটেছে এইসব কথাবার্তা। মামাকেও দেখলাম, খালাকে বুকে নিয়ে কাঁদলেন। আমি এলোপাথাড়ি ভাবনায় হারিয়ে যেতে লাগলাম।
মৌনতার স্বামী খুবই স্মার্ট। তাকে দেখে ভালো লাগল আমার। কিছুটা হিংসেও হয়েছে কি-না বুঝতে পারলাম না। খাওয়া-দাওয়া শেষে মামা মৌনতাকে তার স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। তারপর, ছোটবেলায় দেখলে দূরে দূরে থাকতাম, ভয় পেতাম, না-জানি কখন তুলে নিয়ে যায়, এ রকম একটা কালো গ্লাসের কালো গাড়িতে করে মৌনতা চলে গেল।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। দেখলাম, বড়মামা সুহেল মামার সাথে কথা কথা বলছেন। যে এতদিন তার ঘরে খেয়ে তার বোনকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল একদা, তার প্রতি এখন কোনো ক্ষোভ নেই তার। অথচ এই ক’বছরে একবারও তাদের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেননি। আমি কিছু ভুল করলাম কি-না এ নিয়ে সংশয়ে এবং গভীর এক দুঃখবোধে মূর্ছা যেতে লাগলাম। মৌনতার কথা ভেবে আমার কাঁদতে ইচ্ছে হল।
ছাতক, সুনামগঞ্জ
অসংহতি
অসংহতি
জায়্যিদ জিদ্দান
‘তুই যা করার কর। আমি কিছু করতে পারবো না। তোকে বলছি না? কিছু করার আগে আমাকে আগে জানাবি। না জানিয়ে কিছু করবি না। কথা তো শুনোছ না। এখন যা ইচ্ছে কর।’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু থামলো ফরিদ। ওর চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আগুন বেরুচ্ছে যেন। একটু বেশিই রাগ হয়েছে মনে হয়। আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি ওর বকবকানি। আমারো ইচ্ছে করছে অনেককিছু বলতে। কিন্তু কিছু বলছি না। এখন না বলাটাই হয়তো ভালো হবে। ফরিদকে আমি চিনি অনেকদিন। আমি জানি কিছুক্ষণ বকাবকি করে ও ঠিক শান্ত হয়ে যাবে। বড়ভাইয়ের মতো মমতা মিশিয়ে একটু পরেই আমাকে শান্তনা দিবে। বুঝাবে। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে শিশুর মতো আদর করবে। তখন মনে হয় ফরিদ আমার কত বছরের বড়। কিংবা আমরা এক মায়ের । পেটের ভাই। ও আমার বড় ভাই।
তারপর কথা বলতে বলতে ও একসময় কেঁদে ফেলবে। অনেকক্ষণ কাঁদাকাটি করার পর বলবে ‘তোর কি লাগবে বল। আমি সব দিবো। তারপরও উল্টাপাল্টা কিছু করিছ না’। এই সময়টার জন্যেই আমি অপেক্ষায় থাকি। যা চাই তাই পাওয়া যায়।
ফরিদের চেহারার রং পাল্টাচ্ছে। আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসছে গলাটা অসম্ভব নরম করে ও বললো।
‘তুই একটা কথা কেন বুঝিছ না। আমার এসবে ভীষণ ভয় হয়। তুই জানস আমি তোরে কতটা আপন ভাবি। তোকে আমি এত তারাতাড়ি হারাতে রাজী না।
‘আমি তো তেমন কিছু করি নাই। জাস্ট...
‘চুপ কর ! জানি তো কি মহান কাজটা করেছিস। এখন বল কি করতে চাচ্ছিস? কি করবি?
‘তুই জানস আমি এখন কি করবো। প্রত্যেকবার যা করেছি এখনো তাই। নতুন করে বলার কিছু নাই।
‘মানে? তুই এখনো খুন করবি?
‘হুম। এ খেলার শেষ পরিণাম শুধুই মৃত্যু।
‘কিন্তু লোকটা তো ভালো ছিল। আমাদের শ্রদ্ধাভাজন।
আমি একটু মেকি হাসলাম। এ হাসির আড়ালে এমন কিছু আছে যেটা ফরিদ জানে না এবং কখনো জানবেও না।
‘রজব আলী কি শ্রদ্ধাভাজন ছিল না? রাতুল মল্লিক? ওরা সবাই হাজী সাহেব ছিল।
‘হুমম। শুনেছি শিহাব শিকদারও নাকি হজ্বে যাচ্ছে দুইদিন পর।
‘ভুল শুনেছিস। শিহাব শিকদার আর হজ্ব করতে যাচ্ছেন না।
‘কেন? একটু আগেই দেখা হলো আমার সাথে। এবং কিছুক্ষণ পর ফোনও দিবে বললো আমাকে।
‘তাহলে এটাও জেনে রাখ, শিহাব শিকদার তোকে আর ফোনও করবে না।
‘মানে..?
ফরিদ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর চোখের চারপাশে শিশির বিন্দুর মতো ফুটে আছে অসংখ্য জিজ্ঞাসা।
আমি গলা ছেড়ে হেসে উঠলাম। হাসির বিকট আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হলো দেয়ালের চারপাশে।
পদাবলি
অবশেষে আমি মিলিয়ে যাচ্ছি,
নাদিম আমিন
অবশেষে আমি মিলিয়ে যাচ্ছি,
ধুলো থেকে ধোঁয়াতে কিংবা বায়ুকণাতে,
শহুরে রৌদ্র-তাঁবুর ওমে,
এবং নর্দমার জলের বদ্ধতাতে।
আমাকে তো নর্দমার জলে মানায় বল?
আজীবন কীটের মত গুমড়ে থেকেছি,
শ্রাবণ কাকের মত হয়েছি সিক্ত ও পরিত্যক্ত,
প্রতিটি সময়ে হয়েছি আমি গারদ গাঁড়ল,
আর তোমার চোখের মত স্বচ্ছ সমাজে ব্রাত্য।
আমাকে তো ব্রাত্য হয়ে বাঁচা মানায় বল ?
এক বাক্যে সবাই স্বীকার করে নেবে,
আমার চাইতে তুমিই বেশি দামি,
তাই কখনও নিজেকে আয়নায় দেখি না,
কারণ ওপাশে দেখা যায় আত্মঘৃণিত আমি!
আমাকে তো ঘৃণা করা মানায় বল ?
তোমার আজন্ম যে আভিজাত্য,
ঝিনুকের মত পোষা যে রহস্য,
তোমার অদেখা যে হাসি আজও অনাবৃত,
সবকিছুর ওপর অধিকার ছেড়ে হলাম নিঃস্ব।
আমাকে তো নিঃস্ব হয়ে থাকা মানায় বল ?
আমি প্রতিদিন সকালে মার্ক্সেতে কামড় বসাই,
বিকেল ঘনালেই আমি পান করি ইবনুল আরাবি,
তোমার এসবে বরাবরই নাক সিঁটকায়,
তোমার পশ্চিমা পবনে আমার ফুসফুস খায় খাবি!
আমাকে চিরকাল প্রতীচ্য নামক নোংরা ভাগাড়ে মানায় বল ?
তাই আমি তোমার থেকেও লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে
কারণ তোমাকে মানায় অত্যুচ্চ অহমি দালানের ভিড়ে
আর আমাকে মানায় প্রাগৈতিহাসিক গুহায় ধ্যানমগ্ন ফসিলরূপে
আদিম সত্য দ্রোহকে বুকে চাষ করে থাকবার জন্য
যাকে তোমার মিথ্যে মনে হয়েছিল
অথবা মনে হয়েছিল ঠাট্টামো !!
দেয়াল
দ্বিপ্রহর
কোনো কারণে আশপাশের মানুষগুলোর খোঁজ না নিলে,
তারা ভাবে-
খোঁজ না নেওয়ার কারণ হলো, অবহেলা কিংবা ভুলে থাকা
অথচ তারা একবার খোঁজ নিয়ে দেখেনি,
কোন পিড়া আমার আর তাদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে
আজন্ম অসুখ
সাগর আহমেদ
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুকের ভেতর
অনুবাদ হয় তোমাকে দেখার আজন্ম অসুখ
অন্ধকারের সারাৎসারে মৃত্যুর মত মিশে আছো
ঘুনে জর্জরিত দরজা মৃদু বাতাসে নড়েচড়ে উঠে
ঘোলাটে চোখে তাকাই তুমি এলে কি?
অপেক্ষারা বৃদ্ধ হয় কেটে গেল সহ¯্র বসন্ত
শরীরের কোণায় কোণায় অসুস্থতার বসবাস
সঙ্গম নয়, শুধু একটু অন্ধ আলিঙ্গন চাই
ব্যাকুল দু’হাতে আঁকড়ে ধরবে নিভৃতে
পৃথিবীর শেষ দিনটিতে অমীমাংসিত আলো
নিয়ে এসো শরীর হয়তো চলে যাবে মাইনাসে।
শহুরে বসন্ত
মোহাম্মদ আল রাহাত
হাওয়ায় আটকে ছিলাম বাসতলি লেকের পার দূষিত নগরী থেকে আঠারো মাইল দূরে; তবুও নগরীর রাস্তাঘাট, দেয়াল জুড়ে জাগ্রত বসন্তের বাতাস বহে। বাতাসে ভাসছে আমের মুকুলের কড়া স্মেল দুপুরে প্রেমিকার চুলে আমের মুকুল ঝরে পড়ে কখনো চিরুনির ছুয়ায় সন্ধ্যার সাক্ষাৎকারে হয় এর পতন ; কখনো বা প্রেমের সুখ বহে হৃৎপি-ের কাছাকাছি অন্ধকারের মতন। শহরের অট্টালিকায় বন্দী প্রেয়সীর প্রার্থনা ফাল্গুনের শিউলি বা রঙ্গন যেন ঝরে না আর। কিন্তু হাওয়ার ঝাপটায় যদি তোমায় ঝড়ে যেতে হয় ? কষ্ট পেয় না। যেমন কষ্ট পাইনি শহুরে চড়–ই ও ম্যাগপাই।
ক্ষুধা
নাঈমুর রহমান
আমার ক্ষুধা এই মানচিত্র খাওয়া নয়
কিংবা নয় এই শহর খাওয়া,
আমার ক্ষুধা দুবেলা অন্ন, শুধুই দুবেলা অন্ন।
আমার ক্ষুধা মার্সিটিজে চড়ে মানবতার বাণী ছড়িয়ে
পাঁচ তারকায় বসে প্রমোদ ভোজ নয়,
আমার ক্ষুধা শুধুই দুবেলা অন্ন।
আমার ক্ষুধা ঐ দর কষাকষি করা ত্রিশ কিংবা ষাট
মিনিটের মোল্লার মত পকেট ভারী করা নয়,
আমার ক্ষুধা দুবেলা অন্ন, শুধুই দুবেলা অন্ন।
আমার ক্ষুধা লক্ষ মুখের অন্ন লুটে
প্রাসাদসম বাড়িতে বসে রাজ ভোজ নয়,
আমার ক্ষুধা শুধুই দুবেলা অন্ন।
আমার ক্ষুধা নদী খেয়ে, গাছ খেয়ে
উন্নয়নের সোপান গাওয়া নয়;
আমার ক্ষুধা একটু বিশুদ্ধ অম্লজানের
আর একটি জীবন্ত নদীর।
সব দাগ মোছে না ইরেজার
ইসলাম মুহাম্মদ তৌহিদ
সব দাগ মোছে না ইরেজার
সব ক্ষত হয় না পূরণ
ভূমিকম্পেও টলে না অভিমানী পাহাড়
আহ্নিকগতির তাড়া খেয়ে ঘুরতেই থাকে পৃথিবী
সূর্যের বিচ্ছেদ সইতে না পেরে কোমায় চলে যায় দিন,
স্বজনদের প্রার্থনায় ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে আবার ফিরে আসে সূর্য,
অতঃপর সুস্থ দিবালোক বসুধার সাথে আলোকিত করে প্রেমের সংসার।
হে ঈশ্বর,
তুমি এমন প্রেম দাও আমার ‘তুমি’ কে।
ভ্রমণকাহিনী : পর্ব : ০৪ : মুর্শিদাবাদ- পথে প্রান্তরে ইতিহাস...
মাজরুল ইসলাম
[গত সংখ্যার পর...]
সপ্তদশ শতাব্দীর কাছাকাছি সময় মাড়ওয়ার থেকে এই বংশের অন্যতম আদি পুরুষ হীরা নন্দ সাহু পাটনাতে আসেন এবং আর এক বেনিয়া ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য কুঠি গড়ে তুলেন। তাঁর বড় ছেলে জাহাঙ্গীর নগরে একটি কুঠি স্থাপন করেন। জাহাঙ্গীর নগর তখন বাংলার রাজধানী মানিক চাঁদের উত্তরাধিকারী ফতে চাঁদ ১৭২২ সালে নবাবদের নিকট থেকে জগৎ শেঠ উপাধি লাভ করেন। মুর্শিদকুলী খাঁর দারোগা রঘু নন্দনের মৃত্যু হলে ফতে চাঁদ নবাবের ব্যাঙকার হন। জগৎ শেঠের আদি বাড়ি ছিল মহিমা পুরে। যা এখন ভাগীরথীর গর্ভে বিলীন হয়েছে। অতীতের গৌরব আজ ধূলিসাৎ। ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে ইদ্রপুরীতুল্য রাজপ্রাসাদ।
খাজা খিজির: খোয়াজ খিজির বা খোয়াজ পরির কাহিনি আরবি লোক প্রবাদ থেকে শোনা যায়। খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকে আরব দরবেশ ইব্রাহিম ইবন অহদম তাঁর সুফি সাধনায় এই অলৌকিক পুরুষের কথা প্রচার করেন। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী খোয়াজ হলেন জলের মালিক। সঞ্জীবন বারি পান করে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী ও সিদ্ধকাম মহাপ্রাজ্ঞ। তিনি নদী- সমুদ্রে ঝঞ্ঝা আনেন আবার ভক্তকে উদ্ধারও করেন। অনেকের মতে নবী ইলিয়াস ইহুদীদের কাছে যিনি এলিজা নামে পরিচিত, তিনিই এই রূপক চরিত্রে পরিচিত হয়েছেন। এনিয়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য অনেক প্রবাদ প্রচলিত আছে। এতে মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। নদ- নদী এবং সমুদ্র মধ্যে বিপন্ন নাবিকদের রক্ষা করে বলে জনসাধারণের বিশ্বাস, বিশেষ করে সিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে। ঢাকার নবাব মকরমখাঁর সময়ে বাংলার মুসলমান এই অনুষ্ঠানের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ জানতে পারে। পূর্বে এই পর্ব অতি সমারোহে পালিত হত। আজও লালবাগ কেল্লার সামনে ভাগীরথী তীরে সিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে। ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার এই উপলক্ষে কলা গাছের প্রকান্ড আলোকজান প্রস্তুত হয়। তার উপর নানা বর্ণের রঞ্জিত এবং কাগজে ও অভ্রে সুশোভিত করে। এই উৎসব বেরা নামে পরিচিত। ধারণা করা যায় লালবাগ শহরে এই উৎসবের প্রচলন করেন মুর্শিদকুলী খাঁ।
তোপখানা ঘাট: বাংলার রাজধানী ও মুর্শিদাবাদ শহর রক্ষার জন্য কাটরার দক্ষিণপূর্বে গোবরানালা বা কাটরা ঝিল ঘেঁষে একটি অস্ত্রাগার তৈরি করেছিলেন মুর্শিদকুলী খাঁ। এখনও জাহানকোষা কামান অতীতের নবাবী প্রতাপের নীরব সাক্ষীস্বরূপ একটি বেদীর উপর দৃশ্যমান। কামানটি অষ্টধাতুর নির্মিত। বাংলাদেশের কুলাউড়ার জনার্দন কর্মকারের খ্যাতি ছিল উপমহাদেশ ব্যাপী। মোঘল যুগে কুলাউড়ায় সমরাস্ত্র বন্ধক কামান তরবারি তৈরি হত।
প্রাচীন সমরাস্ত্রের এবং আধুনিক সমরাস্ত্রের গতি- শক্তি নিয়ে কথা উঠতেই পারে। কিন্তু এখন যেরূপ যুদ্ধের ব্যুহ সাজানো হয়ে থাকে, প্রাচীন কালেও সেরকম ব্যুহ সাজানোর নিয়ম চালু ছিল। যিনি ব্যুহ সাজান তাকে মহাব্যুহপতি বলা হত।
মুর্শিদাবাদের জাহানকোষা কামান তৈরি করার সময় নিযুক্ত ছিলেন জাহাঙ্গীর নগরের দারোগা শের মহম্মদের ও পরিদর্শক হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে প্রধান কর্মকার জনার্দন দ্বারা অক্টোবর মাসে ১৬৩৭ খ্রীষ্টব্দ নির্মিত হয়েছিল। এই তোপের ওজন ২১২ মন এবং অগ্নিসংযোগ করতে ২৮ সের বারুদের প্রয়োজন হতে।
বুধুরি গ্রাম: ভগবানগোলার ইতিহাস সুপ্রাচীন। এই ভগবানগোলার নিকটেই বুধুরি গ্রাম। এখানেই রামচন্দ্রে ও গোবিন্দ বসবাস করতেন। রামচন্দ্র ধর্ম প্রচারের জন্য দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন। গোবিন্দ প্রথমে শক্তি- উপাসক ছিলেন। তাঁর অনেকগুলো শাক্ত পদে কথা জানা যায়।পরে রামচন্দ্রের অনুরোধে শ্রী নিবাস আচার্য বুধুরিতে এসে গোবিন্দকে দীক্ষা দেন। তিনি চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি। ছিলেন। বুধুরি- বিলাস মতে গোবিন্দ দাস ১৫৩৫ শকাব্দে পরলোকগমন করেন।
কুমোরপাড়ার রাধামাধব মন্দির: সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়াতেই মতিঝিলের পূর্ণ পাড়ে শ্রীজীব গোস্বামীর শিষ্যা হরিপ্রিয়া ঠাকুরানী রাধামাধব মন্দির স্থাপন করেন। এবং এই মন্দিরে রাধামাধব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠান করেন। সাবেকি আমলের মাধবীকুঞ্জ বৃক্ষটি এখনও কালের সাক্ষী বহনকারী হিসেবে দৃশ্যমান। কথিত আছে, নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাকি নিষিদ্ধ খাবার (গোমাংস) ভর্তি পরাত সেবাইতের নিকট পাঠান। পরাত বাহক সেবাইতকে জানায় নবাব দেবতার ভোগ পাঠিয়েছেন। পরাতের ঢাকনা তুলে দেখা গেল পরাত ভর্তি ফুল। বাহক এই ঘটনা নবাবকে জানান এবং নবাব নিজেই সেবাইতের নিকট আসেন। অলৌকিক ঘটনা দেখে মন্দিরের জন্য নিষ্কর জমি দান করেন। তবে এর সত্যতা কতদূর সত্য তা জানা যায় না।
গ্রামের নাম কুমোর পাড়া। মুর্শিদাবাদ জেলার মুর্শিদাবাদ থানার অন্তর্গত প্রান্তিক একটি ছোট গ্রাম। মুর্শিদাবাদ রেল স্টেশন থেকে দক্ষিণে বহরমপুর যাবার পথে মাত্র দেড় -দুই কিমি দূরে। লালবাগ শহরের অদূরে অন্যতম আকর্ষণ রাধামাধব মন্দির। এই মন্দির মতিঝিলের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। মন্দিরে গেলে একদ- বসলেই শান্তি পাওয়া যায়।
[চলবে...]