পদাবলি

পদাবলি


ঘুড়ি
শারমিন আক্তার

লাগোয়া বাতাসে চুলওড়া সকাল খুঁজি নির্লিপ্ত,
যতটুকু এড়িয়ে গেছে ক্যাকোফোনি, এই খিটমিটে শহরের।
কে বা কারা এখানে ওখানে গুঁজে দিয়েছে ভারী লেড,
উদ্বায়ী নিঃশ্বাসের অবকাশ খোঁজ?
কোথাও কেউ মনে রাখেনি আমাদের, প্রিয়তম।
অথচ কেমন-
ঘুড়ির মতন ঘুরতে ইচ্ছ করে লাটাই ভুলে, আকাশ জুড়ে।
গুঁড়ো গুঁড়ো সাদা দলছুট রোদে কখনো মেঘলা শতদল!

দিন শেষে সব রঙিন ফানুস
মোস্তফা হায়দার

তাঁদের চিৎকারে আকাশ ভারী
যন্ত্রণার সায়াহ্নে সবাই বধির
ভোগের পেয়ালায় অভুক্ততার আস্ফালন;

এক সুতো সলতে আর যন্ত্রণা
মানুষের দৌড়গোড়ায় হাঁপাচ্ছে
কাঁতরানো সোহাগে ভুলে থাকে পেছনকথা।

বেহায়ার মধুর বারতা নিমিষে
দিন শেষে সব রঙিন ফানুস
দাঁত কেলিয়ে ভাসিয়ে দেয়
জাগতিক সুখের আয়নায় উড়িয়ে দেয়া বিসর্জন

ভোগ আর ক্রন্দন
সুতোবাঁধা বিশ্বাসের আস্তিন ধরে হাটে ।


আনন্দছাপ
অভিজিৎ মান্না

আলো আসছে কার্নিশে-
ওখানে তোলা আছে স্বপ্নেরা;
একটু নড়ে উঠছে মনে হয়
চক করে উঠছে ঝিমানো চোখ,
কতো এলোমেলো ঝড় এসেছিল
তবু পড়ে যায়নি ।
বাসি ফুল তুমি আর কেঁদো না
দেখো-  লোমে লোমে রোমাঞ্চ জাগছে,
অনেকটা পুড়েছি ভিতরে ভিতরে ।
এবার জল ফড়িঙের ডানায়
মাখিয়ে দেবো আনন্দছাপ ।
    


শরত
আনোয়ার রশীদ সাগর

স্বপ্নে বিভোর শরতের রাত, জোছনা ভাঙে বুকের পাঁজর;
নীরবতা ভেঙে অভিসারী হয় কাঙ্খিত বাতাস।
ছুঁয়ে ছুঁয়ে রংধনু কুঠিরে আবেশী শ্রাবণী ধারা,
সীমারেখা এঁকে ভেঙে দেয় পাখির পালক।
জল ভালবাসায় সুদূর অতীত চাহনি,
কৈশোরের ভাঁজে ভাঁজে কিশোরী মুখ,
চাঁদনী রাতে নিদ্রাদেবী খেলে পলানটুক।
শ্বেত সাম্পানে হেঁটে যায় স্কুলের পথে,
স্মৃতির রথে চলি আমি জোছনা এ রাতে,
আকাশ চাঁদরে নিঃশব্দ কষ্টধ্বনি।
 
বেহালা সুরে অভিমানগুলো শব্দ বুননে
নেমেছে আঁধারের ঠিকানায়, হেঁটেছে অবিরাম;
স্মৃতির ক্যানভাস এঁকে চলেছে, শূন্যের পাতায়
শঙ্খচিলের পালক ভাঙা শিশিরে শরতের খাতায়।

জলরঙের ব্যথাফুল
মাহবুব মিত্র

তোমাদের প্রতিদিন জন্মোৎসব- মৃত্যুর বাঁশি ডাকছে
তোমাদের প্রতিদিন কামোৎসব- বাতিগুলো জ্বলে-নিভে
তোমাদের প্রতিদিন বিবাহোৎসব- মাটির পুতুল ভাঙছে...
এবং দিনগুলো রাত আর রাতগুলো হয়ে যায় দাঁড়কাক;

রঙিন ফটকের দিকে ফ্যাল-ফ্যাল করে
তাকিয়ে থাকে মানিকজোড় নয়নযুগল,
তোমাদের জন্মদিনে ফুটতে থাকে নাইটমেয়ার
কাশিমপুর কারাগারে লাফিয় লাফিয়ে বাড়ছে কাঁটাতার;

নামাঙ্কিত কেকগুলো শয়তানের জলপাই-রঙ মুখোশ
তোমাদের প্রতিবন্ধী শিশু সন্তানেরা আঁকছে বিমূর্ত চিত্র
স্বপ্নগুলো হামাগুড়ি দিচ্ছে উত্তপ্ত হেঁসেলে কাঁচা ভোরে,
তোমাদের নেশাফুল- ঘ্রাণে ভরে যাচ্ছে বুকের আঁচল;

তোমাদের চোখ থেকে ঝরে পড়ছে শিশ্নতীর
তোমাদের মুখ থেকে ঝরে পড়ছে যোনির লালা,
তোমাদের এইসব উৎসব ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে
থোকা থোকা আঁধার; দুঃখরা জলরঙে আঁকা ব্যথাফুল।
      
অর্কিড
জীবন রাজবংশী

সবুজের কোলে ঘুমিয়ে আছে আমার মা,
সাদা চাদর মুড়িয়ে গায়ে সবুজের বিছানায়।
তাল তমাল সেগুনগাছের তলায়,
কি অপরূপ দৃশ্য দেখছি, আমি নই শুধু-
দেখেছেন বাপ ঠাকুর দা, কবি জীবনানন্দ দাস।


ছুট
আবু হানিফ জাকারিয়া

ছুটছি অবিরাম নিশিদিন একাকার করে ক্ষমতার জন্য,
অর্থের জন্য, খ্যাতির জন্য।
মৃত্যু সন্নিকটে ভুলে যাই, চেষ্টাও নেই না ভোলার।
হয়ত বিশ বছর নয়তো বড়জোর একশ বছর।
ক্ষুদ্র এই সময়টুকু পৃথিবীতে বাঁচার জন্য বরাদ্দ।
এই অবধারিত সত্য উপেক্ষা করে যাই মোহাচ্ছন্ন নেশাগ্রস্থ আমি।
এ নেশা সুখ খোজার নেশা, সুখী হওয়ার নেশা, এগিয়ে যাবার নেশা।
অথচ এই সুখের সংজ্ঞা নির্ধারণ হয়নি আজও।
হলফ করে কেউ বলতে ও পারেনা আমি সুখী।
দল নিয়ে দলাদলি, মারামারি, হানাহানি, খুন
কি করেনা মানুষ বা আমিও। 
ক্ষমতার লড়াই, সম্পদের লড়াই, পদের লড়াই, পদবীর লড়াই।
সব লড়াইয়ের সেরা লড়াই সুখী হবার লড়াই।

ছুটছি অবিরাম নিশিদিন একাকার করে
সুখের লড়াইয়ে সামিল হতে, জয়ী হতে।
ছুটছি বাড়ি গাড়ির মালিক হতে হবে কিনা,
বিলাসী বাড়িতে প্রাসাদোপম সজ্জাও লাগবে।
ছুটতে ছুটতে জীবনের শেষ বেলাতে এসে হয়ত
উপলব্ধি হবে নচেৎ উপলব্ধি হবার আগেই আমি নেই।
অনন্তকালের আবাসের জন্য ছোটাছুটি নেই, নেই কোন প্রস্তুতি বা আয়োজন।
সব আয়োজন শুধুই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে সুখী হবার।
সব ছোটাছুটি শুধুই স্বল্পকালীন লোকদেখানোর।
তারপর সব খেলা সাঙ্গ হবে, বন্ধ হবে ছোটাছুটি,
এটাই অবধারিত বাস্তবতা কেউ মানি বা না মানি
তারপর ফিরতে হবে স্রষ্টার কাছে তার হুকুমেই।


মৃত্যু বনাম মধ্যবিত্ত
সম্রাট তারেক

বৈষম্যের গর্ভে মধ্যবিত্তের জন্ম
আত্মসম্মানের হাতে হাত রেখে
       তার হাঁটতে শেখা।
এরপর মৃত্যুই তার দায়িত্ব নেয়
মায়ের আদরে গড়ে তোলায়।

উপমৃত্যু,অর্ধমৃত্যু, আদিমৃত্যু
হরেক রকমের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে
বাস্তবতা কতৃক খন্ডিত ক্ষুধায়,
মধ্যবিত্ত বেঁচে থাকে
নীল, গাঢ়, বাদামী, কালো রঙের আইরিসে।

মধ্যবিত্তের জন্ম হয়
এক পা, এক হাতের অক্ষমতার  অভিশাপে।
পঙ্গু পা নিয়েও, সে দৌড়বিদ হবার স্বপ্ন দেখে
হেরে যাবার পর, বাড়ি ফিরে বিজয়ের হাসি মেখে।
হাত ছাড়াও সে কবিতা লেখে
কবি হবার স্বপ্ন দেখে।

মধ্যবিত্তে অসুখ নেই
তার শরীরের চামড়া
রেইনকোটের কাপড়ে তৈরি।
বৃষ্টি ভেজা জামা, জগত শ্রেষ্ঠ ছাতা।

মৃত্যু ও মধ্যবিত্ত, অ্যানোড ক্যাথোড
গৃহপালিত বেদনা গুলো, লবণ সেতু।


স্বপ্নের ফুল
নূর মোহাম্মদ

পৃথিবীর মনিটরে মনভরে অনেক কিছুই দেখি
আজকাল বেশিদেখি হরেক রকম ফুলের হাসি
বিদেশি ফুলের নিত্য চাকচিক্য আধিক্য প্রভাব
আমাকে একটুও আকৃষ্ট করতে পারেনি...

আমাকে আকৃষ্ট করে সবুজ গাঁয়ের ঘাসফুল
তারপর একে একে সুবাসিত বাংলার পুষ্পরা
তাই সব স্বপ্নিল বৃক্ষ তরু লতা
সুবিমল ছায়ার মায়ায় আমাকে জড়ালো...

আজো যেনো স্বর্গের সুখ সব পবিত্র ফুল
জানিনা কোন মনোহর বৃক্ষের স্বপ্নের ফুল
শাশ্বত বিধানের সুরভীর সমীরণ মেখে
সুবাসিত ভালোবাসা বিলানোর অপেক্ষায়...

হৃত্বিকময় দিগন্ত
টিপু সুলতান

সেদিনকার বেণীগাঁথা চুলে
আঁধারের রোপণ কেটে কদমের ফুলে
শ্রাবণের জল আমনের চারা ধানে
নারিশ গেরুয়া শালিক
আর আকাশের ঠোঁটবাঁকা মুখ
অরণ্যের দু’হাত বাড়ানো
বাতাসের মাতৃমঙ্গল পাড়াগাঁয়-
বেড়ালচখু, ব্রক্ষ্মপুত্র নয়নে এক অবেলা নারী
নদীর কল্লোল ধ্বনি,
শিরিষ কুয়াশার ফোঁটাফোঁটা এক গ্লাস জল
গাছের ছায়ায় হলুদ বিকেল জড়িয়ে
সুরতশ্রী ডাকছে
যৌবন ভরা সবুজের আইলজোড়া মাঠ,
অবমুক্ত খালাসের হৃত্বিকময় দিগন্ত;
সে রূপ আনন্দে বনানীরা আজো ক্লাপ শোনায়...

একাঙ্কিকা
সাহিনা মিতা     

প্রেমতো চাই নি, তবু যে এগিয়ে দিলে
মুঠবদ্ধ হাত! তুলে নেই মৃত চড়ুইয়ের পালক!
অশ্লেষ্য বলে আত্নহত্যায় নামে তাবৎ কাক,
পাখনা চুয়িয়ে মাথায় পরে ফোঁটা ফোঁটা ঘৃনা।
কতটা অসুন্দর থরে থরে সাজালে
এতটা রূপময় হয় ব্যথা!
সমর্পনের হাতে হাতে মোহর খচিত গ্লানি,
আবেদনে অনুগ্রহ যাচনা, নিবেদনে ত্যাগ,
তথাপি সাপপুষ্ট দুষ্ট নাগ হয়ে
ঘরময় বিশনিশ্বাস ফেলি মনি হরণের ক্ষোভে,
রাত নামলে তবু উঠোনে ফোঁটে হাসনাহেনা ফুল;

পিনপতন
হাবিবাতুল উম্মে

তোমার নাম দিলাম বাবুই;
খড়কুটোর বালাই নেই-
চাইলে তুমি ঘুমোতে পারো এ বুকে,
আমি শান্তি পাবো ভীষণ ।
 

আমার আব্বা

আমার আব্বা


আমার আব্বা
বাসার তাসাউফ

আমার আব্বাকে নিয়ে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারছি না। অনেকেই বলবেন, পিতাকে নিয়ে পুত্র গল্প লিখবে- এ আর কী এমন কঠিন কাজ! পিতা-পুত্রের মাঝে তো অসংখ্য গল্প থাকে। হ্যাঁ, থাকে। আমার আব্বাকে নিয়ে আমি অসংখ্য গল্প লিখতে পারতাম, যদি তিনি বেঁচে থাকতেন। (ইতিমধ্যে আপনারা অনেকেই হয়তো অবগত হয়েছেন, গত ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার রাত ২ টা ০৫ মিনিটে আমার আব্বা মুত্যুবরণ করেছেন) মৃত পিতাকে নিয়ে লিখতে গেলে একজন পুত্রের কী রকম কষ্ট হয়, তা কেবল পিতাহারা পুত্ররাই জানার কথা। আমার আব্বার মৃত্যুটা ঘটে গেল আকস্মিভাবে। একজন সুস্থ-সবল মানুষ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন ১০ মিনিটি পরই খবর পেলাম তিনি রোড এ্যাকসিডেন্ট করে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। তারপর এ্যাম্বুলেন্স, ঢাকা মেডিকেল হলেজ, পঙ্গু হাসপাতাল, ৫ ব্যাগ এ+ রক্ত সংগ্রহ, অপারেশন, সাইন্স নিয়োরলজি হয়ে আবার ঢাকা মেডিকেল হলেজ, ডাক্তারদের বোর্ডমিটিং, আই.সি.ও তে নেওয়ার পরামর্শ। কিন্তু পরিবারের মুরব্বিদের সিদ্ধান্তে আই.সি.ও তে না দিয়ে বাসায় ফিরে আসা। অতঃপর বাসায় তিন দিন থাকার পর মৃত্যুর কোলো চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়া... সহজ ভাষায় এই কথাগুলো লিখতে পারলেও আব্বার মৃত্যুটা সহজভাবে মেনে নেওয়ার মতো প্রস্তুত ছিলাম না আমি বা আমার পরিবারের কেউ। আব্বার মৃত্যুর পর আমাদের কাছে বিশেষত আমার কাছে অনুভূত হয়েছে, মৃত্যু শব্দটি পৃথিবীতে কতটা নিষ্ঠুর একটি শব্দ! নিষ্ঠুর হলেও এটি নশ^র এ পৃথিবীতে সবচেয়ে সত্য ও চিরন্তনও একটি বিষয়। হবেই বা না কেন? জন্মগ্রহণ করলেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন সেই ¯্রষ্টাই তো বলেছেন, ‘কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মাউত!’ 

আমাদের এলাকার পাঁচ-দশ গ্রামজুড়ে আব্বা ছিলেন প্রায় সকলেরই প্রিয়ভাজন। শুধু প্রিয়ভাজন বললে আব্বার প্রতি অসম্মান দেখানো হয়। প্রিয় ব্যক্তিত্ব বা প্রিয়মুখ শব্দ দু’টি যোগ করলেও যথাযথ হয়ে ওঠে না। সেদিন আমাদের মাদরাসা মাঠে আব্বার জানাজায় হাজার হাজার মানুষের চোখের জল শুধু আমাকে এই কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছে, আমার আব্বা বেঁচে থাকতে মানুষের কত প্রিয় ছিলেন!

অনন্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমার আব্বা। কত বছর আগে সেটা আমরা কেউ জানি না। আমার দাদা কিংবা দাদি আব্বার জন্মতারিখ লিখেন নি কোথাও। এজন্য আব্বার সঠিক বয়স জানা যায় নি। তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খাতায় বয়স লেখা হয়েছিল ৭২ বছর। সেই অর্থে আব্বার বয়স ৭২ বছরই ধরে নিতে হয়। আব্বার ডাক নাম ছিল মাজু। পুরো নাম মোহাম্মদ মাজুউদ্দিন ভূঁইয়া। আমাদের গ্রামের অন্য পরিবারগুলোর মতো দাদার পরিবারেও কৃষি কাজ ছিল জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায়। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, আমার আব্বার বয়স যখন ২১ তখন দাদা মারা যান। সেই সময় থেকে আমার আব্বা সংসার নামের ভাঁড়ারটি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আর সেটা নামানোর আর সুযোগই পেলেন না। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮’তে এসে তিনি কাঁধ থেকে সকল ভাঁড়ার নামিয়ে চিরতরে ভারমুক্ত হলেন।

আব্বা চলে যাওয়ার পর থেকে প্রত্যেকদিন মনে হয়েছে, আগামীকাল যখন আমি কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরব, তখন সবাইকে দেখব, ঘরে অনেক মানুষ থাকবে। আমার কাকারা, কাকিরা, ভাইবোনেরা, এমনকি আমার আম্মাও থাকবে। সাধারণত আমি ঘরে ফিরলে আব্বাকে দেখতাম মাগরিব নামায শেষে খাটের ওপর বসে তসবিহ জপছেন। আমাকে দেখে বলতেন, ‘বাসার আইলি?’

          ‘হ, আব্বা আমি আইছি।’

আব্বা একচিলতে হাসতেন। আমিও হেসে নিজের ঘরে চলে যেতাম। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমি ঘরে ফিরলেই কাঁদি। নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে আমার আব্বা আর নেই। আব্বা ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি আমাকে গল্প লেখতে বলেছিলেন, যিনি আমাকে মানুষের কল্যাণ হয় এমন কাজ করতে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। আব্বা বলতেন, ‘সৎ ও ন্যায়ের পথে চললে কেউ ঠকাইতে পারবে না।’

আব্বার সেই কথার পর নিজের মাঝে বিশ^াস জন্মেছিল। এ কারণে আব্বা ছিলেন আমার জীবনের সুপার হিরো। আমার সেই সুপার হিরোকে হারিয়ে যে আঘাত পেয়েছি, যে কষ্ট পেয়েছি, যে দুঃখ পেয়েছি- এখন আর জাগতিক কোনো অপ্রাপ্তী কিংবা হতাশায় কোনো দুঃখ অনুভূত হয় না। শুধু বার বার আমার মরমে স্মরিত হয়, আব্বা আর এই পথিবীতে নেই। শুধু আব্বা যে কক্ষে ঘুমাতেন দেয়ালে টানানো আছে বহুদিন আগের তাঁর একটা ছবি। ছবি দেখে কী হবে?

আব্বা যে চলে গেছেন আজ ষোলো দিন হলো। শুধু ষোলো দিন নয়, ষোলো বছর পর যদি আমি বেঁচে থাকি, যখন আমিও বাবা হব, তখন কি আব্বার কথা মনে করে এভাবে আমার বুকের ভেতর থেকে কান্না উৎসারিত হবে? নাকি আমার সন্তানেরা আব্বার কথা ভুলিয়ে দেবে? আমার সন্তানেরা যখন আমাকে আব্বা বলে ডাকবে তখন কি আমার আব্বাকে আমি ভুলে যাব? সন্তানের মাঝে পিতৃত্বের যে বন্ধন সে তো জাগতিক যে কোনো বিষয় থেকেও অনেক বড় কিছু।

 সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের শনিবার রাতটি আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য মনে রাখবে। এই দিনে আমার আব্বা পৃথিবীকে চির দিনের জন্য চলে গেছেন।

এর আগে ১৪ সেপ্টম্বর শুক্রবার সকালে আব্বা দড়িভাষানিয়া গ্রামে আমার ছোটমামার ছেলের সুন্নতে খাৎনা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। দড়িভাষানিয়া গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি (সি.এন.জি) থেকে নামতে গিয়ে পড়েছিলেন দুর্ঘটনায়। রাস্তা পার হতে গিয়ে উল্টো পথে একসঙ্গে তিনটে মাইক্রোবাস তেড়ে এসে প্রথমটি আব্বাকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়, পরেরটি পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। দ্ইু পা-ই ভেঙ্গে গিয়েছিল আব্বার। মাথায় ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন, সবচেয়ে বেশি জখম হয়েছিল বুকের হাঁড়ে। বাম পাঁজরের চারটি হাঁড়ই ভেঙ্গে গিয়েছিল। আব্বার মৃত্যু হয়েছিল মূলত এই পাঁজরগুলো ভাঙ্গার কারণেই। পুরো গ্রাম থমকে গিয়েছিল। জানাজায় আমাদের মাদরাসা মাঠ ছিল লোকজনে পরিপূর্ণ। আব্বাকে বহন করা খাট নিয়ে আমিও আমার বাকি দুই ভাই চলেছি কবরস্থানের দিকে, এই দুঃখ আর বেদনার ভাষা আমি কী করে লেখব!

আব্বাকে কবরে সমাহিত করার পর আমার বুকের ভেতর কান্না থেমে গিয়েছিল। আমি যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। কে যেন আমাকে ধরে ধরে সদ্য সমাহিত হওয়া আমার আব্বার কাছ থেকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল। যেতে যেতে আমি ভাবছিলাম, আজ থেকে আমি এতিম। আপনি যদি এ লেখাটি পড়ে থাকেন আর আপনার পিতা যদি আগেই মারা গিয়ে থাকে, তাহলে আপনার কাছে বলা বাহুল্য এ দুঃখের, এই কান্নার সীমা-পরিসীমা কতটুকু হয়! কেউ কেউ আমাকে বলছিল, ‘তুমি বাপের শিক্ষিত ছেলে, তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না।’

কেউ বলছিল, ‘দেখো তুমি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়ো, পরিবারের কেউ আর দাঁড়িয়ে থাকবে না। তোমার বড়বোন জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। তোমার বড়ভাই জহিরুল অজ্ঞান হয়ে আছে। কলসি কলসি পানি ঢেলেও হুশ আসছে না।’

কেউ বা এসে খবর দেয়, ‘এই মাত্র তোমার ছাত্তার কাকাও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।’

আবার কেউ এসে বলে, ‘তোমার এভাবে কান্না বন্ধ করতে হবে। তোমাকে শক্ত হতে হবে।  মনে রেখো, কারো বাবাই চিরদিন বেঁচে থাকে না। তোমাকে আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে।’

আল্লাহর ওপর ভরসা করেই তো আমি বেঁচে আছি। তা না হলে মরে যেতাম, সত্যি মরে যেতাম। হ্যাঁ, কারো বাবাই চিরদিন বেঁচে থাকে না, সেটা আমি জানি। হয়তো একদিন আমিও থাকব না, এটা বুঝি। আমি যখন বাবা হব (যদি বেঁচে থাকি) তখন আমার সন্তান কি আমার কাছ থেকে এমন কিছুু পাবে যা তাদের গর্ব করার মতো? আমি যখন মরে যাব অন্তত আমার আব্বার মতো লোকমুখে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সনদ রেখে যেত পারব তো? আমার আব্বা তো অঢেল ধন-সম্পত্তি রেখে যায় নি। কিন্তু তিনি আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন, আর যাই হোক কারো কাছে হাত পাততে তো হচ্ছে না। আমার আব্বা তো শুধু কৃষি কাজ করতেন। গ্রামের অতিসাধারণ একজন কৃষক হয়ে তিনি আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন, আমাদের তিন ভাইয়ের জীবন যাপনে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া আব্বা আমাদের কী দিয়ে গেলেন, কী দিয়ে গেলেন নাÑ সেই হিসাব-নিকাশে আমি যেতে চাই না। ‘সৎ ও ন্যায়ের পথে চললে কেউ ঠকাইতে পারবে নাÑ!’ আব্বার মুখে জীবনে বহুবার শোনা এই কথাটিই এখন আমার একমাত্র চলার পথের রথ।

কেউ যখন এসে আমাকে কান্না না করতে বলে, ভেঙ্গে না পড়তে বলে, বলে শক্ত হতেÑ আমি তাদের একটি কথাই বলব। তোমার বাবা আর এই পৃথিবীতে নেই, তুমি আর তোমার বাবার কথা কিংবা হাসির শব্দ শুনতে পাবে না। এমনকি তোমার বাবাকে আর কখনও তুমি দেখতে পাবে না। একবার ভাবো তো, তোমার কেমন লাগবে? বাবাবিহীন বেঁচে থেকে দিন যাপন করতে একজন সন্তানের কী যে কষ্ট হয়, তাদের আমি কেমন করে বোঝাব! কেউ কি সেটা বুঝবে?


নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্রজলে

নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্রজলে

নষ্ট শরীর ভিজে না রৌদ্রজলে   
ইজাজ আহমেদ মিলন

আশিক আহমেদ

কৈশোরে সেই ছড়া লেখার মাধ্যমে যার সাহিত্য চর্চা শুরু। এখনো পর্যন্ত তার লেখায় ছেদ ঘটেনি। আজো ক্লান্তহীন লিখে যাচ্ছেন এই মানুষটি। 
প্রতি নিয়তই করে যাচ্ছে স্বপ্নের চাষাবাদ।
স্বপ্নবাজ একজন মানুষ।
সত্য ও সুন্দরের উপাসক কবি ইজাজ আহমেদ মিলন।

যিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন এবং অন্যকে স্বপ্ন দেখান। মৃত ছায়া শূন্যমাঠ আর শুদ্ধতার অন্ধ জলে যার স্বপ্নের বসবাস।
এরকম স্বপ্নবাজ মানুষ সমাজে ক’জনই বা আছে।  হাতে গুনা হয়তো দু’চার জন এর চেয়ে বেশী নয়। সবাই স্বপ্ন দেখতে জানে কিন্তু দেখাতে জানে না ইজাজ  আহমেদ মিলন এর ব্যাতিক্রম। কারন তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখার  উৎসাহ যোগান।

তিনি জীবনে বহু সংগ্রাম করেছেন সমুদ্রের অনেক জ্বল সেচেছেন।
অনাহারে কাটিয়েছে  তার দুরন্ত বৈশাখের  ছন্দহীন দিন।  কৈশোরে মাওনা বাজারে বেগুনের ডোল ভরে দিত বিনিময়ে দশ টাকা মায়নে.. তা দিয়েই মা’র পান সুপারি কিনে আনতো। আর বাবার অসুখের জন্য গামছায় মুখ বেধে রিকশা চালিয়ে বাবার জন্য ওষুধ। চাচাদের সাথে যুক্ত হয়ে ঢাকা শহরে রিক্সা চালিয়ে  দু-এক কেজি চাল, ডাল কিনে বাড়িতে ফিরতো এভাবেই চলত তাঁর অভাবের  সংসার।

তাঁর সবচেয়ে যে পথে বেশী চলতে হয়েছে, সেটার মধ্যই থরে থরে বিছানো ছিলো কাটা।  পথের সে কাটা  দু-হাতে একটা একটা উঠিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করেছে।
আধারে পথ ভুলে অকারণে অনেক পথ ঘুরেছে কেউ বাধা দেয়নি তাঁর সামান্য মঙ্গল হবে বলে।  জীবনটা’ই হয়তো পাল্টে যেতো যদি কেউ তাকে  বাধা দিয়ে পথ দেখাতো  গন্তব্যর দিকে। কেউ চায়নি সে গন্তব্যে পৌঁছাক।

পা-ুলিপির ওপর একদিন তাঁর সুদৃষ্টি  পড়েছিলো অবশেষে প্রয়াস পেয়েছিলো বই প্রকাশের।

গন্তব্যর খোঁজে/লাশের গন্ধ/ আমার ও কিছু কষ্ট আছে/ শিশির ভেজা সকাল দিও/ নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে/  মৃত্যুর ও মৃত্যুর আছে/ স্বাধীনতা তুমি কার/ প্রিয়ার খোঁজে/ কবিতার পান্ডুলিপি আজ অগ্নিদগ্ধ /এরকম এক গুচ্ছ ৬৪ টি কবিতা নিয়ে ।

‘নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ। সত্য ও সুন্দরের উপাসক প্রেম ও দোহের কবি ইজাজ আহমেদ মিলন নিজস্ব   শৈলীর আবহে  সমৃদ্ধ করেন তার সাহিত্য  ভুবন। তার কবিতার পঙ্খিত জুড়ে রূপ বাস্তবতাই বেশি। রূপকের অন্তরালে তিনি বিচিত্র নানা ছন্দময় ভঙ্গিমায়  চারপাশের দারিদ্র আর কুসংস্কারে বেড়ে ওঠা চিত্র নিখুত ভাবে ফুটিয়ে তুলেন। প্রেম ভালোবাসাও তাঁর লেখায় উপেক্ষিত নয়। অসহায় দেবতা জ্ঞান  করে মস্তক অবনিত করেছেন তিনি।  আবার দেশ দরদীর লেবাসে দেশদোহীদের করেছেন তুলোধুনো। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের  কতৃর্ত্ব প্রবল ভাবে পীড়া দেয় তাঁকে।
নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে গ্রন্থটিতে প্রকাশিত অধিকাংশ কবিতাই দেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলোতে  প্রকাশিত হয়েছে।


একুশ আসছে। আসছে একুশে বই মেলা। আর  বইমেলার টানে সারাদেশ থেকে তরতাজা কবিতার বই নিয়ে ছুটে আসছে তরুণ কবির দল। একুশে বইমেলা বাংলাদেশের নবীন কবিদের জন্য আতœপ্রকাশের রণক্ষেত্র। এখানে যারা আসে তারা কেউ শূন্য হাতে ঘরে ফেরেনা। একুশ কম বেশী তাদের সবারই  স্বপ্নপুরণ করে। ‘নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে’ বইয়ের  বাম পাশের ফ্ল্যাপে এমনটায় লিখে ছিলেন বাংলাভাষার অন্যতম আধুনিক কবি নির্মলেন্দু গুণ  (২০০৯)। সতিই শূন্যহাতে ঘরে ফেরেনি ইজাজ আহমেদ মিলন। একুশ তার স্বপ্ন পূরণ করছে ।

‘নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে’ তাঁর প্রথম কাব্য গন্থ (২০০৯) প্রকাশের পর চারদিকে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গ্রন্থটি তাঁকে সফলতার শৈলচূড়ায় নিয়ে যেতে খুব বেশী সময় নেয়নি। এই  কাব্য গ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম  (চ্যানেল আই) এবং সিটি ব্যাংক প্রর্বতিত সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরষ্কার (২০০৯) ও একই মঞ্চে পুরস্কার লাভ করনে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সব্যসাচী  সৈয়দ শামসুল হক, কবি  নির্মলেন্দু গুণ,  অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ও কবি হালিম আজাদ। চ্যানেল আইয়ে সরাসরি সম্প্রচারিত হয় পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠান।

 বাংলাদেশে হাতেগনা কয়েকটি দামি পুরস্কারের মধ্যে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার অন্যতম। পুরস্কার প্রাপ্তিটা তাকে ভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। যাদের সাথে সে পুরস্কার পেয়েছিলো তারা প্রত্যেকেই এক একটি নক্ষত্র। বুদ্ধিজীব সেইদিনের  অনুভূতি সে আজও প্রকাশ করতে পারিনি। তার অভিধানে সেটা প্রকাশের কোন শব্দ বা বাক্য নেই। তবে পুরস্কার প্রদান মঞ্চে বলেছিলেন  ( আবেগাপ্লুত হয়ে) মনে হচ্ছে আমি নোবেল পুরস্কার পেলাম। তার এই বক্তব্যের সাথে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার দ্বিমত করে বলেছিলেন, অপেক্ষা করো আরো বড় কিছু পাবে। তখন এটাকে আর নোবেলের মতো মনে হবে না।


হ্যা, সত্যিই বলেছিলেন আবু সায়ীদ স্যার । বরেণ্য  সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন - ইজাজ এর হাত বেশ শক্তিশালী এবং তিনি একদিন বড় কবি হবেন, যদি তাঁর সাধনায় ছেদ না ঘটে। এর পর প্রবীণ রাজনৈতিক মো: রহমত আলীর পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনী নিয়ে কালের আয়নায় এড.রহমত আলী রচনা করে ব্যাপক সারা ফেলেন। কবি নির্মলেন্দ গুণ গ্রন্থটি প্রসঙ্গে লিখেছেন এড. রহমত আলীর অর্ধ শতাব্দী -ব্যাপ্ত  রাজনৈতিক জীবনে এমন ও অনেক অজানা অধ্যায় ইজাজ আহমেদ মিলন রচিত। এই গ্রন্থটিতে বর্ণিত হয়েছে যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় গবেষক কাজে লাগবে। শব্দের কারিগর ইজাজ আহমেদ মিলনকে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, ইজাজের মতো তরুণ কবিই শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়ে যান।
ইজাজের দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ বের হয় ২০১২ সালে গ্রন্থটি পাঠ করে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক  প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন ‘তুমি পদ্য বাদ দিয়ে গদ্য লিখো, অনেক ভালো করবে। হুমায়ুন আহমেদর প্রেরনায় প্রখর জীবনবোধের গল্পনিয়ে প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘ছাতিম গাছের মিত ছায়া’  এ গ্রন্থ সম্পর্কে আবদুল  গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন,  এ প্রর্জমের শক্তিমান লেখক ইজাজ আহমেদ মিলন কবিতার মতো গল্প লেখাতেও মুনশীয়ানা  দেখিয়েছেন। ‘কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন  ইজাজ এর কবিতা আমাকে স্পর্শ করেছে। বরেণ্য  সাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন নতুন দিনের কবিরা স্পর্ধাময়, তারা কোন প্রবীণ কবির সনদ পত্রের জন্য হা করে তাকিয়ে নেই।
ইজাজের কোন সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। প্রাবন্ধিক ও গবেষক মাহামুদুল বাসার এক প্রবন্ধে লিখেছেন ইজাজ আহমেদ মিলন তারুণ্যের উত্তাল  জলে ভাষা পরিণত এক পদ্ম। সেটার প্রমান তিনি দিয়েছেন বিস্মিত সেই সব শহীদ  শিরোনামের গ্রন্থটিতে।
যাপিত জীবনে অনেক  বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিক দের সানিধ্য পেয়েছে।

দুঃখ আর বেদনাকে জন্মসহোদর করে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। সফলতার ঝুড়িতে অর্জন করছেন একের পর এক পথিকী খেতাব।

গবেষনা মুল্যক সাংবাদিকতায় পেয়েছেন বজলুর রহমান স্মৃতি পদক ২০১৫। যা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার দেশের সেরা পুরষ্কার। 
এবছর ও তার যাপিত জীবন নিয়ে ২০১৮তে  এ বের হয়  আতœকথন : ‘বেদনা আমার জন্মসহোদর’। এ বইয়ের  প্রতিটি পাতা ভেঁজা স্যাতসেতে। প্রতিটি পাতা বেদনায় ভরা।
গুণী ও বরেণ্য কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে এ বছর ও ‘দাগ সাহিত্য পুরস্কার ’ পাচ্ছে। কবি ও সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন বেদনা আমার জন্ম সহোদর ‘ গ্রন্থের জন্য আয়োজকরা  তাকে মনোনিত করেছেন বলে এক পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছেন। রবীন্দ্র জার্নাল ও দাগ প্রবর্তিত এ পুরস্কার (২০১৮) সত্য ও সুন্দরের উপাসক কবি ইজাজ আহমেদ মিলন ১৯৮৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার  ঘন সবুজে  আচ্ছদিত মাওনার আক্তাপাড়া গ্রামে  পিতা ইদ্রিস আলীর ঔরশে মাতা জমিলা আক্তারের গর্বে  নানা বাড়িতে তাঁর জন্ম। কিন্তু বেড়ে উঠেছেন উপজেলার চকপাড়া (সলিংমোড়)  গ্রামের আলো বাতাসে তাঁর পৃতভিটায়। স্ত্রী নূরন্নাহার আহমেদ বিউটি, পুত্র মীসাম আহমেদ প্রান্তর ও ইমতিয়াজ আহমেদ রাহীকে নিয়ে তাঁর সংসার।

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৩

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৩


জোছনার সুষমা হারিয়ে যায়। শুধু সারি সারি ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বলে। রুবী বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। আকস্মিক উর্মিলার মনে হয়, ওর মেরুদ- বেয়ে শৈত্য বয়ে যাচ্ছে। ও কী কোনো কারণে ভয় পাচ্ছে। ভয় কিসের? বেবী আপা বলেছে, যৌবন ক্ষণকাল শিক্ষা আমৃত্যু মানুষকে বয়ে বেড়ায়।’

তাইতো!

আকস্মিক উর্মিলার ভালো লাগতে থাকে। এতক্ষণে বুকের ভেতর যে উত্থাল-পাথাল ভাব ছিলÑএখন তা আস্তে আস্তে প্রশমিত হচ্ছে। ওর চেতনায় ছায়া ফেলছে। এখন ও শুভপুরে থাকে না। নগরে থাকে। শুভপুরের বন-বাঁদাড়ে ঘোরাঘুরি, এ পাড়ায় ও পাড়ায় দাপিয়ে বেড়ানো উর্মিলার মৃত্যু হয়েছে। শুভপুর উর্মিলার জন্য নিরাপদ আশ্রয়। নগরের বাসিন্দাদের সন্ধিগ্ধ চোখে দেখতে শুরু করেছে। উর্মিলা তুই পালিয়ে যা। কেন পালিয়ে যাবে উর্মিলা? ও গ্রাম ছেড়ে নগরে এসেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকরা যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যায়। ও বাবাকে বিশ্বাসের কথা বলেছে। বাবা আশান্বিত! ঘুমানোর আগে অসংখ্য আলোর বল চোখে ক্ষীণ আলো ছড়াতে ছড়াতে অনন্তে হারিয়ে গেল। এপাশ-ওপাশ করতে করতে মনে পড়ে। বাবাকে জানানো প্রয়োজন। বাবা কি নিঃসঙ্গ? এক জনম উর্মিলার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিলো। সংসারে এতবড় আত্মত্যাগ উর্মিলাকে ভাবিত করে।

উর্মিলা বাবাকে লেখে, বাবা, পরম করুণাময়ের আশীর্বাদে এখানে ভালো আছি। বেবী আপা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আমার সঙ্গে থাকে ময়মনসিংহের মেয়ে রুবী। আমার মতো বয়স। কোনো কাজ এখনো শুরু করিনি। এখন সবকিছুই শিক্ষানবিশ। খুব শিগগিরই বেবী আপার সঙ্গে আমার পড়াশোনা নিয়ে কথা হবে। তবে উনি বলেছে, শিক্ষাই মানুষকে পথ দেখায়। বাবা বিশ্বাস করো, যেভাবেই হোক আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছাব। শুভপুরের জন্য পরান পোড়ে। চিন্তা করো না। শরীরের দিকে নজর দিও।

ইতি তোমার উর্মিলা।

চিঠি লিখতে গিয়ে বুক ভরে কান্না এল ওর। চোখ দিয়ে জল গড়ায়।

চিঠি লেখা শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। রুবীও সিটে ঘুমুচ্ছে। ওর বড় বড় নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। লাইটের সুইচ অফ করে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। শোঁ শোঁ শব্দে ফ্যান ঘুরছে।

উর্মিলার মাথার মধ্যে এখন বহুবিদ বিষয় কাজ করছে। অন্ধকারে ওর হাত দুটো সমস্ত শরীরে হাতড়ে বেড়ায়।

পা পাতা থেকে ঊরু, জঙ্ঘা, কিউবেক হেয়ার, এবং স্তনের বোঁটায় হাত রাখে। ক্ষণকালের জন্য এক রকম  শিহরণ অনুভব করে। মনে পড়ে পুজোর সময় ওর এক পিসতুতো ভাই স্তন ঝাপটে ধরেছিল। তা ছিল অসহনীয়। ইতরবিশেষ। উর্মিলা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। আজ পুলক অনুভব হচ্ছে। কেন? উর্মিলার অজানা।

স্তনের গড়নে হাত দিয়ে উর্মিলার মনে হলো ও নারী হয়ে উঠছে। কাম-লিপ্সা কাতর আর দশটা নারীর মতো সাধারণ। কামাগ্নির দাহে শতধা খ-িত বাৎসায়নী মানবী। চোখ দুটো জ্বালা করতে থাকে ওর। হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে পানি খায়। কতক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। জানালা দিয়ে রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ক্ষীণকায়া কালো কালো শিশুদের দর্পিত পদচারণা। ওর মনে হয় ওরা মানুষ। অসহায় হোমোসিপিয়েন। ওরা অগণন। নগরে ওরা উদ্বাস্তু। ঘরহীন। ওরা শুভপুরের শিশুদের মতো নয়। ওদের  শরীর পুষ্টিহীন। তাদের খোঁজ নেওয়ার লোক নেই।

হঠাৎ করে ওর পায়ের পাতা ঘেমে ওঠে। মনে পড়ে, বাবাকে কথা দিয়েছে, ভাত এবং মানুষের পক্ষে থাকব।

এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে মধ্যরাতে। টেবিলে রাখা ভাত খায়। রুবী ঘুমুচ্ছে।



০৩.

নিস্তরঙ্গ দিন কাটছে উর্মিলার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখে রুবী অফিসে চলে গেছে। বুয়া রুম, বাথরুম ঝকঝকে পরিপাটি করে রেখেছে। কাপড়- চোপড় সুবিন্যস্ত রাখা আছে আলনায়। টেবিলে সকালের নাস্তা রেখে গেছে। বাথরুম থেকে ফিরে নাস্তা খেয়ে আবারও ঘুমিয়ে যায় উর্মিলা।

গভীর ঘুম। ঘুম ভাঙে বারোটার দিকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাঙে। উঠতে ইচ্ছে হয় না। ক্লান্তি শরীরে বাসা বেঁধেছে।

লাঞ্চের পর হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এল রুবী।

বিছানায় ব্যাগ রেখে বলে, ‘সুখবর আছে। বেবী আপা তোমাকে এবং আমাকে ছয় হাজার টাকা দিয়েছে। কাপড়-চোপড় কেনার জন্য।’

উর্মিলা প্রশ্ন করে, ‘কেন?’

‘জানি না। তবে তোমাকে এবং আমাকে অফিসের জন্য যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। কী পোশাকে কী চলনে বলনে।’ হঠাৎ করে উর্মিলার মনে পড়ে, আসার সময় বাবা তাকে দু’হাজার টাকা দিয়েছিল।

বলেছিল, ‘নগরে  পরিপাটি থাকতে হয়। ওটাতো শুভপুর নয়। কতরকম মানুষের সঙ্গে দেখা হবে। টাকা ছাড়া নগরে থাকা যায় না।’ বাবার জন্য মমতা বাড়ে। রুবী গুনগুন করতে করতে বাথরুমে ঢুকে যায়। ওর সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়। স্বপ্নাচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে। পৃথিবীর তিন ভাগ জল ধুয়ে মুছে যাচ্ছে চারদিক। সুচি-শুভ্র এ ধরণীর স্নিগ্ধ চরাচর। অস্ফূট বেরিয়ে আসে, আহ!

ইতোমধ্যে বাথরুম থেকে পরিপাটি হয়ে বেরিয়ে আসে রুবী। রুবীর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। গোসল করার পর অসম্ভব কমনীয় লাগছে। রুবীকে গত দু’দিন এমন করে দেখা হয় নাই। রুবী ওর মতো। উর্মিলা রুবীর চেয়ে একটু বেশি ফর্সা। কটিদেশে বাঁক আছে। মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, সারল্যে মাখামাখি। কোনো পঙ্কিলতা স্পর্শ করতে পারেনি। রুবীর  চেহারায় বিষণœতা ভর করেছে। ওর পিঙ্গল চোখ, কথনে আঞ্চলিক টান। উর্মিলার কাছে রুবীর এরূপ মুখচ্ছবি অত্যন্ত আপনার মনে হলো। রুবীর মাঝে প্রিয় সহযোদ্ধার ছায়া আবিষ্কার করে।

‘তোমাকে নিয়ে নিউমার্কেট যাব। নিজেও কেনাকাটা করব। কিছুই তো নেই।’ নিজকে নগরের মেয়ে ভাবতে পারছি না।’ চুলে চিরুনি চালাতে থাকে রুবী।

‘বাবা আমাকে দু’হাজার টাকা দিয়েছে।’ উর্মিলা আশান্বিত কণ্ঠে বলে।

‘তা হলে তো তোমার পোয়াবারো।’

‘কেন?’

‘তুমি ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করতে পারবে।’

‘তুমিও করবে।’

‘বাবাকে কোনো সাহায্য করতে হবে না। তারপর বোনদের কথা মনে হয়। কত অপূর্ণতা রয়েছে। ক্ষুদ্র জিনিসের জন্য রয়েছে কাঙালপনা।’ রুবীর কণ্ঠে হাহাকার।

‘তুমি তো সুন্দর কথা বলেছ। আমার মা নেই। ছোটবেলা থেকে আমারও কাঙালপনা আছে।’

উর্মিলার দিকে তাকিয়ে রুবী বলে, ‘বিকেল হয়ে আসছে তুমি রেডি হও।’

উর্মিলা ট্রাঙ্ক খুলে গত পুজোয় বাবার দেয়া সালোয়ার-কামিজ বের করে। ভেবেছিল অফিসের প্রথম দিন এটা পরে যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে রুবীকে মনে হচ্ছে নগরের সব চাইতে পারঙ্গম মহিলা। নগরের গলি-ঘুপচির গ্রহণ-বর্জনও জানে।

রুম থেকে বেরুতে বেরুতে বিকেল গড়িয়ে এল।

রিকশায় উঠে রুবী বলল, ‘তোমাকে যা লাগছে না!’

উর্মিলা বলে, ‘তোমাকেও।’

‘আমি তোমার মতোন না।’

রিকশার ঝাঁকুনিতে উর্মিলার কুমারী বেনুনি দোল খায়। উর্মিলা  ইতিউতি তাকায়। রাস্তার লোকজন, দোকানপাট, হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো কাধ বাঁকিয়ে দেখে। এ নগরীর মানুষগুলো ক্যামন পরিপাটি। বাবা ঠিকই বলেছে, ‘নগরে সুবেশ থাকতে হয়।’

নগরের সবকিছুই বর্ণাঢ্য। রঙিন। শুভপুরের মতো নিস্তরঙ্গ নয়।

‘তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।’ রুবী প্রশ্ন করে।

উর্মিলা ভয়ানক অবাক হয়। ভাবে, রুবী বলে কী। মেয়েদের আবার ছেলেবন্ধু থাকে নাকি? হঠাৎ করে ওর চোখ-মুখে আরক্ত লজ্জা ছুঁয়ে যায়।

‘না না আমার তেমন কেউ নেই।’

‘তুমি যে রূপবতী! ক’দিন পর নগরীর সব তরুণ তোমার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তুমি সামাল দেবে ক্যামনে।’

‘তুমি যে কী বলো রুবী আমি এসব নিয়ে ভাবি না।’

‘তুমি আসার আগে আমার মধ্যে নানা ভয় কাজ করত। এখন করে না। মনে হয় তুমি আমাকে ভয় থেকে মুক্ত করেছ।’

উর্মিলা কথা বলে না। রিকশা এগোয়। নিউমার্কেটের কাছে আসতেই রুবী হ্যান্ডপার্স থেকে একটি খাম উর্মিলার দিকে এগিয়ে দেয়। খামের মুখ আঠা দিয়ে লাগানো। খামের মাঝ বরাবর লেখা উর্মিলা পাল।

‘বেবী আপা দিয়েছে।’

‘আমি কি কিনব। বুঝতে পারছি না।’

‘তোমার বোঝার দরকার নেই। নগরে আমি তোমার সিনিয়র? আর অফিসের  চাল-চলন এই ক’মাসে কিছুটা হলেও আমাকে প্রভাবিত করেছে। অন্যান্য মেয়েদের অবহেলা, গ্লানি আমাকে কষ্ট দিয়েছে। ধোবাউড়ার মেয়ে। গ্রাম্যতা শরীরে রয়ে গেছে। প্রথম প্রথম নিজেকে ভয়ানক অসহায় মনে হতো। এখন হয় না। বেবী আপা থেকে প্রায় সবাই, গ্রাম থেকে উঠে এসেছে। কিছু আছে কথা বললে মনে হয়, গ্রাম, এ শব্দটি প্রথম শুনল।’

বলতে বলতে নিউমার্কেটের গেটে রিকশা থেমে যায়। পার্স খুলে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসো।’

টুথপেস্ট থেকে ন্যাপকিন পর্যন্ত কেনাকাটা করে ওরা দু’জন যখন নিউমার্কেট থেকে বের হয় তখন রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।

রিকশায় উঠেই রুবী বলল, ‘উর্মিলা যা কিনলাম তা আমি জীবনে কিনিনি। তাছাড়া নগরে না আসলে জানতামই না মেয়েরা এভাবে কেনাকাটা করে। ওপরওয়ালার নিকট প্রার্থনা কর। আমি বিশ্বাসী মানুষ। আমি অনেক কষ্ট করেছি। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, তারপরও আমার প্রতি পক্ষপাত ছিল। সাধ ছিল সাধ্য ছিল না।’

‘এসব কথা বাদ দাও।’ উর্মিলা রুবীকে থামিয়ে দিলো। রাতের নগরের বর্ণিল চেহারা দেখে উর্মিলা আকাশের দিকে তাকায়।

তারাদের মুখ দেখা যায় না। আকাশের চাদর ঘন কালো। তারপরও অসম্ভব ভালোলাগার দোলাচালে দুলতে থাকে উর্মিলা। মানুষ হয়ে জন্মানো এ এক বিড়ম্বনা। মানুষের কত কী নিয়ে ভাবতে হয়। অন্য প্রজাতির কিছুই নিয়ে ভাবতে হয় না। শুধু খাদ্য আর সন্তান উৎপাদন ছাড়া।

নাখালপাড়ার গলিতে রিকশা ঢুকতেই উর্মিলা রুবীকে বলে, ‘তুমি আমার সঙ্গে থেকো। ভগবান সহায় হলে সব বিপদ অতিক্রম করতে পারব।’

‘তুমি আসার পর মনে হচ্ছে আমিও পারব।’
 (চলবে)

প্রিয় শিক্ষক মৃণময় দাস

প্রিয় শিক্ষক মৃণময় দাস


প্রিয় শিক্ষক মৃণময় দাস
নূরনবী সোহাগ

নাইন-টেনে পড়া কালীন সময় স্কুলে প্রতিদিন প্রায় আট’টা ক্লাস হতো। টিফিনের আগে পাঁচটা পরে তিনটা। টিফিন পরবর্তী ক্লাসগুলো অনেক সময় করা হতোনা। সোজা বাংলায়  টিফিন পিরিয়ডে স্কুল পালাতাম। আমাদের ক্লাসশুরুর প্রথমদিকে ইংরেজি, গণিত, বাংলা আর গ্রুপের দু একটা ক্লাস হতো। প্রথম পিরিয়ড থেকে প্রত্যেক শিক্ষক ক্লাসে আসতেন। হড়বড় করে পড়াতেন, রোল ডাকতেন, ক্লাস ঘণ্টা পড়লে চলে যেতেন।  এরকম করে চতুর্থ পিরিয়ডে আসতেন সুধীর স্যার। তিনি বাংলা পড়াতেন।  আমি ধীরে ধীরে খেয়াল করতে শুরু করলাম তিনি নিছক বাংলা গল্প, কবিতা পড়াতে আসতেন না। তিনি পাঠ্য বইকে, পড়াকে, বাংলাকে ভালোবাসাতে আসতেন। তিনি ক্লাসে থাকাকালীন সময় পুরো ক্লাসে ভর করতো সুনসান নিরবতা। সবাই যেন ভুলেই যেতো ক্লাসে পড়ার ফাঁকে কলম দিয়ে খোঁচা দেওয়া, স্কেল ফেলে দেওয়া, হিহি করে হেসে দেওয়া, অকারণে পানি খেতে যাওয়া। কারণ তখন সবাই সত্যি সত্যি ক্লাসের পড়ায়, জানায় মগ্ন হয়ে যেতো। দিন দিন এমন হতে শুরু করলো যে একমাত্র সুধীর স্যারের ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের একটা বাড়তি চাপ পড়তে লাগলো। পচাত্তরজন শিক্ষার্থীর ভেতর যেন একজনও অনুপস্থিত নেই ক্লাসে।  নেই কোনো হৈহুল্লোড়, কোনো বাড়তি আওয়াজ।  একজন যাদুকর যেন মুখ দিয়ে শব্দের যাদু দেখাচ্ছেন আর সকল দর্শকরা সেই যাদু চোখ কান খোলা রেখে গো-গ্রাসে গিলছে।
কি বিস্ময়কর সে দৃশ্য! ভীষণ মনে পড়ছে স্যারের একটা ক্লাসের কথা। সেদিন ক্লাসে ‘জীবন বিনিময়’ কবিতার শেষ তিন পঙক্তির ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন।  ক্লাসের ঘণ্টা পড়লো। কিন্তু আমরা কেউ তেমন গায়ে মাখলাম না।  যে যার মতো মুখটা একটু আড়াল করতে চাইছিলাম সবাই।  আমি খেয়াল করলাম কেবল আমার চোখই ভিজে নি।  প্রায়জনই চোখ ঢাকছে আঙুল দিয়ে।  বোধ করি, সেদিন থেকে আমি কবিতাকে আরো বেশি ভালোবাসতে শুরু করি। বাংলার প্রতি আরো ভালোবাসা বাড়তে শুরু করে। স্যার বাংলাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। একজন শিক্ষকের সফলতাটা এখানে। এত এত বছর পরেও আমি তার কথা মনে রেখেছি। হয়তো অনেকেই রেখেছে।  শিক্ষকের গড়পড়তা বৈশিষ্ট্যর মধ্য সুধীর স্যারের কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য ছিল যা বরাবরই অন্যান্য শিক্ষকদের থেকে তাকে আলাদা করে রাখতো।  এমন শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরেছিলাম বলে আজও গর্বে দীর্ঘ নিঃশ্বাস টানি। 

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হলো ২০১৬ তে।  আমি স্বভাবত কারণে শিক্ষকদের ভালোবাসি। তিনি শেখান এটুকু পরিচয় জানলেই আমি তার প্রতি শ্রদ্ধায় নত হই।  তবে মনের মতো শিক্ষকদের প্রতি আমার আলাদা রকম দুর্বলতা আছে।  বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে মনের মতো শিক্ষকের ক্ষুধায় ভুগছিলাম। সৃষ্টিকর্তা হয়তো তা আঁচ করতে পেরেছিলেন।  দ্বিতীয় বছরের নতুন সেমিস্টারে ক্লাসে এক জোয়ান এসে বসলো শিক্ষকের আসনে। দেখতে একদমই শিক্ষকদের মতো গুরুগম্ভীর নয়। হালকা পাতলা শরীর, বড় বড় চুল বামপাশে সিঁথি করে রাখা, চোখে লাল ফ্রেমের চশমা, হাতে মার্কার। ক্ষাণিক বাদে হঠাৎ অকারণবশত তিনি হাসলেন। হাসলাম পুরো ক্লাস সুদ্ধ সবাই।  তিনি বললেন- আমি মৃন্ময় দাস।  তার বাকী কথাগুলো মনে হচ্ছিলো অনেক পুরনো কোনো নিয়মে আমি অনবিরতভাবে গিলছি।  তার বাচনভঙ্গি, মূকাভিনয় ও পড়ানোর ধরণ আমাকে প্রথম দিনেই প্রবল আকৃষ্ট করলো।  পুরো সেমিস্টারে তার ক্লাস আর বাদ দেইনি। কেবল তার বিষয়ে পাশ করতে চাই বলে নয়।  তার শেখানোর ভঙ্গিমাটা মিস করতে চাইতাম না।  তিনি যেন বুঝতেন ক্লাসের পুরো শিক্ষার্থীর চোখ, মুখ, অন্তর এখন কি বলছে!
কেন বলছে?
আমি দ্বিতীয়বার কোনো শিক্ষকের দিকে বিস্ময় ভরে তাকালাম। কিভাবে তিনি পারেন? কেন অন্যরা নয়?
শিক্ষকতায় যারা আসেন তারা অবশ্যই যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই আসেন।  তবে কোনো শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের শিখতে আগ্রহী করে তুলতে পারেন তবে তার কাজটা আরো বেশি সহজ হয়ে যায়।  এই আগ্রহী করতে পারাটা হয়তো শিক্ষকদের একান্ত যোগ্যতা। এর কোনো সার্টিফিকেট হয়না। হয়তো সেই মৌলিক গুন শেখানো হয়না কোনো প্রশিক্ষন কেন্দ্রেও। তারা নিজেরা অর্জন করেন শেখানোর ভিন্ন কৌশল। সুধীর স্যার ও মৃন্ময় দাস স্যারের মতো শিক্ষক দরকার আমাদের শিক্ষাঙ্গনে।  যারা মুখের মধ্য যাদুর শব্দ নিয়ে ক্লাসে ঢুকবেন।  আর এক দুই করে তিন তিনটা ঘণ্টা কেটে যাবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থেকে।

স্বপ্নের নীল মেঘের স্বপ্ন

স্বপ্নের নীল মেঘের স্বপ্ন


স্বপ্নের নীল মেঘের স্বপ্ন
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে।

স্বপ্ন খুব অস্থির। ঘরের ভিতর এপাশ ওপাশ পায়চারি করছে। কিন্তু মনটাকে একটা জায়গায় ধরে রাখতে পারছেনা।
এখন তার কাছে মনেহয় স্বপ্ন নামটাই তার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিদিন রাতে ঘুমিয়ে পড়লেই স্বপ্ন স্বপ দেখা শুরু করে।
অনেক স্বপ্ন মনে থাকে আবার অনেক স্বপ্নমন থেকে হারিয়ে যায়।

যে স্বপ্নগুলো মন থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় সেগুলো হারিয়ে যাওয়া জিনিসের মতো হাতড়াতে থাকে স্বপ্ন। কিন্তু যাজীবন থেকে হারিয়ে যায় তাকি কখনো খুঁজে পাওয়া যায়। কে জানে?

প্রতিদিনের স্বপ্ন আর গতরাতের স্বপ্ন এক রকম না।
এমন একটা স্বপ্ন যা বিশ্বাস করা যায়না আর অবিশ্বাসেরও সুযোগ নেই।

বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমতে কমতে এক সময় থেমে যায়। কিন্তু স্বপ্নের অস্থিরতা কমে না।

বাড়ির সামনের টং ঘরের মতো চায়ের দোকানটার ব্রেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে থাকে স্বপ্ন।
পিছন থেকে ধাক্কা দেয় নীল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় স্বপ্ন।

কিরে স্বপ্ন মাথা নিচু করে বসে আছিস। বুড়ো দোকানদারকে ইশারা করে নীল বলে, চাচা গরম গরম দু’টা চা দাওতো।

চা খেতে খেতে নীল জিজ্ঞেস করে, স্বপ্ন, বলতো তোর কি হইছে।”

স্বপ্ন বলে কিছুনা। নীল একটু সিরিয়াস হয়ে বলে কিছু তো একটা হয়েছেই। আমার কাছে কি লুকোতে পারবি?

স্বপ্ন এবার নীলের দিকে তাকায়। স্বপ্নের এই তাকানোটা নীলের কাছে আকাশ ভেঙে মেঘ পড়ার মতো মনে হয়। চোখ দুটো ছলছল।

নীল স্বপ্নের ভিতরের কষ্টটা বুঝতে পারে। আরেকটু কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে নীল বলে, কিরে দোস্ত, বলতো তোর কষ্ট কিসে!

এবার দোকানের সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর সামনেই স্বপ্ন হু হুকরে কেঁদে উঠে। নীলের মনে হয় ভিতরের চাপাকান্নার বিস্ফোরণের মতো ।

দোকানের আশেপাশের লোকজন স্বপ্নকে ঘিরে দাঁড়ায়। সবার একটাই প্রশ্ন কি হয়েছে ওর।

নীল  লোকজনকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে, আরে ভাই সরেন তো ভাই। এটা আমাদের দুই বন্ধুর বিষয়। এতো কিছু বলার পরও লোকজন সরে না। তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে কি একটা গুপ্তধনের রহস্য হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
নীল একটু হালকা হয়। চোখ দুটো উপরে তুলে বলে কি হয়েছে রে বোকা। এই বয়সে মানুষ কাঁদে।

স্বপ্ন এবার চোখের কান্না ছেড়ে মুখ খোলে।

না তেমন কিছুনা। কিন্তু অনেক কিছু। আমার সব স্বপ্নই তো সত্যি হয় জানিস। ভালো মন্দ  মিলিয়ে প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি। কিন্তু কাল দেখলাম আমি মরে গেছি। ঘুমোতে গিয়ে আর উঠছিনা। মা, বাবা, তুই সবাই কাঁদছে। এরপর আবার একটু কেঁদে উঠে বিরহীর মতো বলে আমি আর বাঁচবো নারে। আমাকে সবাই মাফ করে দিস।

ঘিরে থাকা লোকজনের মধ্যে লাঠিতে ভর করা বুড়োটা আফসোস করে বলে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখছিস রে বাজান। খুব খারাপ স্বপ্ন। আহাপোলাপানটারে আমি কোলেপিঠে মানুষ করছি। আমার আগে চলে যাবে।

নীল ধমকে বলে, থামেন তো দাদা। কি যে বলেন। স্বপ্ন আবার সত্যি হয়।

হয় হয়। স্বপ্নই তো সত্যি হয়। গেলো মাঘে আমার দাদিটা স্বপ্নে দেখলো উনি আর বাচঁবেন না। কি বলবেন ভাই। এটা বলার দুদিনের মধ্যে মারা গেলো। একটু জোর গলায় কথাটা বললো এলাকার মাস্তান গোছের বড়ভাই।

এবার বুড়ো দোকানদার বললো, স্বপ্নের স্বপ্ন তো কখনো মিথ্যে হতে দেখিনি। যখনই ও স্বপ্নের কথা বলেছে তা সত্যি হয়েছে। কোনোটাই মিস হয় নি।

নীল এবার জোরে ধমক দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে বলে, আরে ভাই এখন থেকে সরেন তো। যত্তো সব আজগুবি গপ্পো।

যে যার মতো চলে যায়।

নীলও স্বপ্নকে দুশ্চিন্তা করতে না বলে রাস্তার মোড়টা বেঁকে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়।

নীল কোনোদিন স্বপ্ন দেখেনি। স্বপ্ন কি নীল জানেনা। কিন্তু সে জানে স্বপ্ন যে স্বপ্ন দেখে তা সত্যি হয়।

কি যেন একটা ভেবে নীল মোবাইলে ফোন দেয়। ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ ভেসে আসে। কথা হয়। নীল আর স্বপ্নের কথা।

নীল ঘুমিয়েছিল। নীলের ঘরের দরজায় ধাক্কা। নীল উঠ, বাবা উঠ। মা ডাকে আর দীর্ঘশ্বাস দেয়। আহা মায়ের একমাত্র ধন চলে গেলো রে।

নীল চোখ কচলাতে কচলাতে বলে কি হয়েছে মা। এতো সকাল সকাল ডাকছো। উঠরে তোর বন্ধু স্বপ্ন আর নাই। আহা বাছারে, রাতে খুব হাসি খুশি হয়ে ঘুমাতে গেছিলো। আর ঘুম ভাঙলোনা। পাখিটা উড়াল দিলো।

নীল কথাটা শুনে ঘাবড়ে যায়, চিৎকার করে কাঁদতে যায় কিন্তু কেন যেন থেমে যায়। যে বন্ধুকে জীবনের চেয়ে ভালোবাসে নীল তার জন্য সে কাঁদছেনা। নিজের কাছেই অবাক লাগে নীলের। নিজেকে নিজেই আজ চিনছেনা নীল। নীলের নীল রঙের কষ্টগুলো যেন মরে গেছে আর মনে মনে সৃষ্টি হয়েছে একটা গোপন আনন্দ। বন্ধুকে হারিয়ে পাবার আনন্দ। কিন্তু সেটা আজ বন্ধুর ভালোবাসার চেয়ে বড় হয়ে গেলো। নীল ভেবে কুল কিনারা পায়না। কষ্ট করে মনের খুশিটা চেপে রেখে কাঁদো কাঁদো চেহারাটা করে নীল স্বপ্নদের বাড়িতে ঢুকে। চারদিকে কান্না, কষ্ট আর হাহাকার। কিন্তু নীলনির্বিকার। স্বপ্নের নিথর মৃতদেহটা দেখেও কষ্ট হচ্ছেনা। কান্না পাচ্ছেনা।

শেষবারের মতো সবাই দেখছে স্বপ্নকে। স্বপ্নের মৃত দেহের উপর কপাল চাপড়িয়ে আচ্ছাড়ি বিচ্ছাড়ি খাচ্ছে তার মা। নীল তবুও নির্বাক।

মাটির কবরে স্বপ্ন। সবাই মাটি ফেলছে। নীল দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। কিন্তু কান্না নেই, কষ্ট নেই, হাহাকার নেই, হারানোর বেদনা নেই।

নীল অনেক বেলা হয়েছে উঠ উঠ। আর কতো মরার মতো ঘুমাবি।

নীলের ঘুমন্ত শরীর বিছানা থেকে চোখ মেলে। বাইরের কড়া সূর্যের আলোটা তার চোখকে যেন জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।

নীল নিজের দিকে তাকায়। এতক্ষন যা দেখেছে সব স্বপ্ন। সত্যি নয়। স্বার্থপর একটা মানুষ সে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে। খুব ঘৃণা হয় নিজেরউপর। তার জীবনের প্রথম স্বপ্ন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সে কত বেশি স্বার্থপর।

নীল ভুলটা বুঝতে পারে। কেউ জানেনা নীলের এই স্বার্থপর তারকথা। স্বপ্নও জানে না।

কিন্তু নীলের বিবেক আর মন তো জানে।

নীল নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। অস্থির হয়ে উঠে তার মন। তার মনে যে পাপ ছিল তা থেকে সে মুক্তির পথ খুঁজে। সে দৌড়াতে দৌড়াতে স্বপ্নদের বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। বিয়ের সানাইয়ের শব্দ কানে  ভেসে আসে। স্বপ্ন বন্ধুকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরে। স্বপ্ন হাসতে হাসতে বলে নীল তোকে সারপ্রাইজ দিবো বলে কিছু বলিনি। বউ নিয়েই তোর বাড়িতে আজ যেতাম। আমি মেঘকে বিয়েটা করেই ফেললাম।

কথাটা শুনে কষ্ট হয় নীলের। কষ্ট কেন, কিসের কষ্ট। নীল নিজেকে সামলে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। এবার নীলের ভিতরের বিবেক তার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিবেকটা অদৃশ্য কিন্তু খুব দৃশ্যমান। দমকা হওয়ার মতো ধাক্কা দেয় তাকে। এবার বুঝে নীল, স্বপ্ন যেমন মেঘকে ভালোবেসেছিলো সেও মেঘকে ভালোবেসেছিলো। প্রকাশ্যে নয় গোপনে। এই জন্য তার মধ্যে নিজের অজান্তে স্বপ্নের প্রতিহিংসা তৈরী হয়েছিল। স্বপ্নকে সে স্বপ্নে মরতে দেখেছিলো। স্বপ্নের কাল্পনিক মৃত্যু তার কাছে মনে হয়েছিল বাস্তব। কিন্তু সে কাঁদেনি কষ্টও পায়নি। নিজের স্বার্থপর মুখটা লজ্জায় ঢাকলো নীল। খুব ছোট মনে হলো নিজেকে। স্বার্থের চেয়ে ত্যাগ যে অনেক আনন্দের সেটা তার বিবেক থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। কিছুই আর বলা হলো না নীলের। নির্বাক ক্ষমায় নত হলো তার মন। জড়িয়ে ধরলো তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু স্বপ্নকে। কেউ কিছু জানবে না কোনোদিন। নীল জেনেছিলো কিন্তু ভুলে যেতে চায়।

আবার মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামে নীল আকাশ থেকে স্বপ্ন দেখবে বলে।

স্বপ্নের মেঘ আর নীলের স্বপ্ন সব কোলাহলের ভিড়ে নতুন জীবনের সন্ধানে নামে। যেখানে মন কি চায় কেউ জানেনা। জানবে না কোনোদিন।


শিল্পীর সম্মান ও সম্মানী নিশ্চিত কবে হবে?

শিল্পীর সম্মান ও সম্মানী নিশ্চিত কবে হবে?


শিল্পীর সম্মান ও সম্মানী নিশ্চিত কবে হবে? 
আবুল খায়ের

সংগীত মানুষের মনকে আলোড়িত করে। খাদ্য যেমন পেটের খোরাক, তেমনি সংগীত হলো মনের খোরাক। সংগীত আত্মার পরিশুদ্ধতার একটি মোক্ষম উপাদান। সংগীত চর্চা একটি মননশীল পেশা। আর যারা এই সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের সাথে সম্পৃক্ত তারা সমাজের আর দশটা মানুষের মতো নয়। কিছুটা হলেও আলাদা স্বভাবের এবং আলাদা মন মানসিকতার হয়ে থাকে। যদিও তাঁদের কোন চাহিদা তেমন নেই-সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে। কেউ শখে বশে কিংবা নিজের কল্পনাকে বাস্তবরূপে প্রকাশের নিমিত্তে সংগীত চর্চা করে থাকেন। আমাদের দেশে সংগীত চর্চাকে এক সময় ভালো দৃষ্টিতে দেখা হতো না। সংগীতের একটি আধুনিক শাখা হলো ব্যান্ড সংগীত। পশ্চিমা সংগীতের অনুকরণে অত্যান্ত আধুনিক/ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং দেশীয় কিছু যন্ত্রপাতির সংমিশ্রণে একটি ফিউশান ধর্মী সংগীতই হলো ব্যান্ড সংগীত। যা আরো খারাপ বা পাগলাটে সংগীত হিসেবে মনে করা হতো শুরুর দিকে। তবে কালে ভদ্রে তা মানুষের মনে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এখন আর কেউ ব্যান্ড মিউজিক’কে অতোটা খারাপ দৃষ্টিতে দেখে না, বরং বেশ কিছু ব্যান্ড সংগীতের গান জনপ্রিয়তার চরম শীর্ষে অবস্থান করতে দেখা গেছে। যেকোন বিয়ে বা উৎসবে ব্যান্ড সংগীত না হলে কি আর চলে? তবে নামী দামী কিছু ব্যান্ড এবং ব্যান্ড তারকা মানে নতুন কিছু বা বেশী কিছু। যা অনুষ্ঠানকে নতুন মাত্রা দিয়ে থাকে। নব্বইয়ের দশকে ব্যান্ড মিউজিক ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ৮০ থেকে ৯০ দশক’কে এদেশের ব্যান্ড সংগীতের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
বিশে^র প্রায় সব দেশেই সংগীত শিল্পীদের সম্মান অনেক উঁচুতে থাকে। শিল্পীরা যেন যথাযথ সম্মান এবং সম্মানী পেতে পারেন তার জন্য রয়েছে বহু সংস্থা এবং রাষ্ট্রীভাবে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা, তদারকি ও ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা। শিল্পীদের শতভাগ সম্মানী/রয়্যালিটি পাওয়ার নিশ্চয়তার জন্য যা করা দরকার তার সবই আছে উন্নত দেশগুলোতে। আমাদের দেশে এখনও এরকম কোন সংস্থা নেই, যারা শিল্পীদের যথাযথ সম্মানী বা রয়্যালিটি নিশ্চিত করবে। ফলে শিল্পীরা বঞ্চিত হচ্ছে তাঁদের ন্যায্যপ্রাপ্য থেকে। অনেকে প্রতারণার স্বীকার হতেও দেখা যায় মাঝে মধ্যে। কোন গান-কখন, কোথায় বাজতেছে, তা একজন শিল্পীর জানার কোন উপায় নেই বা হিসেব রাখার কথা নয়, তা সম্ভবও নয়। তাহলে কে নিশ্চিত করবে শিল্পীর গানের রয়্যালিটি/সম্মানীর। কে দেখবে, কার দায়িত্ব? এসব দেখার কেউ নেই? অথচ সংগীত বড় একটি শিল্প মাধ্যম এবং বহু জনবল এ সেক্টরের সাথে জড়িত। যাঁরা বাংলা সংগীতকে বিদেশে নিয়ে গেছেন এবং যাঁদের অবদানের কারণে আজ বাংলা সংগীত সারা বিশে^র মধ্যে একটি মর্যাদার স্থান দখল করে আছে। তাঁদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান নিশ্চিত করা জাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্য। যে দেশে গুণীর কদর থাকেনা, সে দেশে গুণী জন্মায় না।
আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সম্মান প্রায়শই দেখা যায়-মরনোত্তর প্রদান করতে। যা একটি শিল্পীর জন্য সম্মান দেখানোর জন্য যথেষ্ট নয়। দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে যদি ওই সম্মান নিশ্চিত করা যায়, তবে শিল্পীদেরকে যথাযথ সম্মান জানানো সম্ভব। বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ফাহমিদা নবী এক টিভি সাক্ষাতকারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন-তাঁর বাপের গাওয়া গানের জন্য তাঁরা কোন দিনও কিছুই পাননি। নিজের গাওয়া গানের কী হবে তাও তিনি জানেন না। প্রখ্যাত ব্যান্ড তারকা মাইল্সের শাফিন আহমেদ একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন-তাঁর বাপের গাওয়া, মায়ের গাওয়া গানের কোন প্রকার রয়্যালিটি কখনও তারা পাননি। নিজের গাওয়া গান নিয়ে কী হবে তাও জানেন না। তবে সোলসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য টিপু’র আশা-যেহেতু কিছু কিছু কাজ হচ্ছে ইদানিং রয়্যালিটি ও শিল্পীদের অধিকার নিয়ে, তবে সেটা আরো দ্রুততার সাথে এবং ব্যাপকভাবে হওয়া উচিত বলে মনে করেন। তবে শিল্পীদের পাওনার বিষয়ে শিল্পীরা নিজেরাও অনেকটা উদাসিন, যার ফলে কোন আন্দোলনই সফলতার মুখ দেখছেনা বলে মনে করেন তিনি।
ব্যান্ড তারকা গীতিকার, সুরকার, লিডগিটারিষ্ট (এলআরবি), সঙ্গীতাকাশের উজ্জল নক্ষত্র, ব্যান্ড সংগীতের রাজাধিরাজ, সংগীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু পরপারে পাড়ি দিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁর এই অকাল প্রস্থানে কী পরিমান ভেঙ্গে পড়েছি তা বলে বুঝাতে পারবো না। ঢাকা থাকতে তাঁর কোন কনর্সাট মিস্ করতাম না। যা হোক। তাঁকে আমি দেখেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে ‘বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড্স এসোসিয়েশন (ইঅগইঅ)’ আয়োজিত ৩১ ডিসেম্বর তারিখে ‘শাহিন স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে, ঢাকায়; এবং সর্বশেষ গত ১৬ তারিখ রংপুর জেলা স্কুল মাঠে। ঢাকা’র সেই কনসার্টের উচ্ছ্বাস আর রংপুরের কনসার্টে তাঁর সে উচ্ছ্বাস আমরা দেখিনি। হয়তো অসুস্থ থেকেও ভক্তদের টানেই ছুটে এসেছেন রংপুরে। ঢাকার এক কনসার্টে তিনি বলেছিলেন যদি-আবার পৃথিবীতে আসতে পারতাম! কারণ ভক্তদের এতো ভালোবাসা পেলে কে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চাইবে? যাক সে সব। তিনি কী জানতেন-এই কনসার্টই তাঁর জীবনের শেষ কনসার্ট? মঞ্চে উঠেই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন শ্রদ্ধাভরে। গাইলেন দরদ দিয়ে-‘অবিনাশী আমি, অভিমানী তুমি.. যানে অন্তর্যামী... কেউ আগে পরে, সবাইকে একা করে-চলে যাবো অন্ধঘরে, আর কতো এভাবে, আমাকে কাঁদাবে? আরো বেশী কাঁদালে... উড়াল দিবো আকাশে।। এই গাওয়াই তাঁর জীবনের শেষ গাওয়া। এই দেখাই শেষ দেখা!

তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর গাওয়া গানগুলোর চাহিদা আরো অনেকগুণ বেড়ে গেছে। যা সামাজিক যোগাযোগ’সহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিয়মান হচ্ছে। এমনিতে তাঁর গাওয়া বেশ কিছু গান সকল শ্রেণির মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে আসছে-সে নব্বইয়ের দশক থেকে। দূভার্গ্যজনক হলেও সত্য যে-তাঁর গাওয়া গানগুলো বাজবে বিভিন্ন চ্যানেলে বা রেডিও’তে, কিন্তু রয়্যালিটি সিস্টেম না থাকার কারণে তাঁর পরিবার বঞ্চিত হবে রয়্যালিটি থেকে। যদিও আইয়ুব বাচ্চু’র মতো অনেক গুণী শিল্পীরা এদেশে বেঁচে থাকতে যথাযথ মুল্যায়ন না পাওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। ব্যান্ড সংগীতের গুরু প্রয়াত আযম খান, প্রয়াত লাকী আকন্দ’সহ আরো অনেকেই বেঁচে থাকতে যথাযথ মুল্যায়ন পাননি। তাঁদের সৃষ্টিকর্ম কী অবস্থায় আছে, কেউ জানে না। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করার দাবী ভক্ত ও শ্রোতাদের।
অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে..., আম্মাজান আম্মাজান তুমি বড়ই মেহেরবান...প্রভৃতি প্লেব্যোক গান সাধারণ মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যদিও তিনি আইয়ুব বাচ্চু প্লেব্যাক থেকে অনেকটা অভিমান করে দূরে ছিলেন বহু দিন। চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াৎ এক সাক্ষাতকারে বলেছেন-কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু একদিন তাকে বলেছিলেন যে ‘আম্মাজান’ গানটির জন্য তাঁর জাতীয় পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল কিনা?
আন্তর্জাতিকভাবে প্রত্যেকটি গানের জন্য একটি ‘ইউনিকোড’ থাকে। ফলে দেশে বা বিদেশে যেখানেই ওই গান বাজবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা/প্রতিষ্ঠান ওই গানের যাবতীয় পাওনা/রয়্যালিটি নিশ্চিত করে শিল্পীকে পৌঁছে দিবে। শিল্পী ঘরে বসেই পেয়ে যাবেন তাঁর যাবতীয় পাওনা। কিন্তু আমাদের এরকম কোন সিস্টেম আদৌ হয়নি বা কোন অজানা কারণে নিশ্চিত করা যায়নি। দেশে এরকম সিস্টেম চালু হওয়া জরুরী। শিল্পীদের প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন/পাইরেসী এ্যাক্ট কার্যকর সময়ের দাবী। তবে সেটা শিল্পীরা দুনিয়াতে বেঁচে থাকতেই হতে হবে। কাউকে মরনোত্তর মুল্যায়ন করলে, সেটা কখনও সঠিক মুল্যায়ন হতে পারে না। সঠিক নীতিমালার অভাবের কারণে বহুশিল্পী তাঁদের শিল্পী সত্তাকে বিকিয়ে দিচ্ছে অকাতরে। গুণী শিল্পীরা অনেকেই মান সম্মানের ভয়ে মুখ না খোলার কারণে প্রকৃত ঘটনা জানাও যায়না।
পরিশেষে কিংবদন্তি ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু’র প্রতি বিনম্্র শ্রদ্ধা ও তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। পাশাপাশি সকল গুণী শিল্পীদের মূল্যায়ন তাঁদের জীবদ্দশায় বা বেঁচে থাকতেই নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মাদকমুক্ত ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে সংগীত ভূমিকা রাখবে। সংগীত সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে এগিয়ে যাবে। দলমত নির্বিশেষে প্রকৃত গুণীদের নির্বাচিত করে সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে যথাযথ সম্মান জানানো নিশ্চিত হবে, সেই প্রত্যাশায়।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ঊন্নয়ন কর্মী।